1

বিশেষ ক্রোড়পত্র - শতবর্ষে রবিশঙ্কর

Posted in




পণ্ডিত রবিশঙ্কর, সেতারবাদনে কিংবদন্তিতুল্য শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী, একজন ভারতীয় তথা বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ! প্রতিভার বিচ্ছুরণ আর ব্যক্তিত্বের মোহজালে যিনি আবিষ্ট করেছেন সমগ্র বিশ্ববাসীকে। তাঁর প্রতিভার কথা অনুচ্চারণেও স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল, যে রবিকরচ্ছায়া বরংবার বিমুগ্ধ করে সঙ্গীতপ্রেমী বিশ্বমানবকে। ভারতীয় তথা প্রাচ্যদেশের সঙ্গীত চর্চার ধারাকে সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখেই তিনি অনায়াস প্রচেষ্টায় এক অনাবিল গ্রহণযোগ্য রূপ দিয়ে সযত্নে পৌঁছে দিয়েছেন পাশ্চাত্যের মরমীয়া শ্রুতি-কুহরে। তাঁর যন্ত্রবাদন তো কেবল শ্রবণীয় নয়, পূর্ণমাত্রায় দর্শনীয়ও – যেন দেবসভায় বাদনরত অপ্সরা… প্রত্যক্ষদর্শী মাত্রেই একথা স্বীকার করবেন একবাক্যে। আজ জন্মশতবর্ষের সন্ধিক্ষণে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য শুধু শিল্পী রবিশঙ্করের প্রতি নয়, প্রেমে-অপ্রেমে, বেদনায়-অভিমানে পূর্ণতাপ্রাপ্ত ‘মানুষ’ রবিশঙ্করের প্রতিও - বিশ্বের সুর-লোকের মধ্যগগণে যাঁর অক্ষয় অবস্থান।
- রাজা মুখোপাধ্যায়




পাঠ-সূচী

১। পণ্ডিত রবিশঙ্কর - আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ
২। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য - ছায়াছবির রবিশঙ্কর
৩। তনুশ্রী শঙ্কর - আমার কাকা রবিশঙ্কর
৪। অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় - “রবিশঙ্কর ও আই পি টি এ”
৫। শুভাপ্রসন্ন - আমার দেখা রবিশঙ্কর
৬। জয়রূপ ভট্টাচার্য্য - আমার চোখে রবিশঙ্কর
৭। তন্ময় বোস – পণ্ডিতজী
৮। তীর্থঙ্কর ব্যানার্জি - কালজয়ী শিল্পী রবিশংকর






আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ
পণ্ডিত রবিশঙ্কর


‘রাগ বলতে বোঝায় রং অনুরাগ ইত্যাদি- সে তো তোমরা রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাতেও পেয়েছ।’ (রাগ অনুরাগ- পৃ.৬৯, ১৯৮৩, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা)

‘ঠুংরী গাইলেই যে কেউ জাতভ্রষ্ট, কুলভ্রষ্ট হয়ে গেল তা আমি বিশ্বাস করি না। এবং সেই জন্যেই আমার আদর্শ যাঁরা- সে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাবা কি দাদা এঁদের কারো মধ্যে ওরকম নাক সিঁটকানো ভাব ছিল না। তাহলে রবীন্দ্রনাথের মত একটা মনের উচিত ছিল শুধু ধ্রুপদাঙ্গের গান বানিয়ে যাওয়া কেবল! কই, তা তো উনি করেননি। সেই পল্লীগীতি, ঠুংরী, ভাঙ্গা খেয়াল ভাঙ্গা থেকে কিছুই তো বাদ দিলেন না রবীন্দ্রনাথ! ওঁর ক্যানভাসটা ভাবুন! কি বড়, কি সম্পূর্ণ!’(রাগ অনুরাগ- পৃ. ৮৯)

‘তাছাড়া ঐ জিনিসটা যেটা আমি বলতে চাই যে ভালোবাসা, আছে।... যে কোন ভাল শিল্পীই, যিনি সত্যিকারের মহান শিল্পী হয়েছেন, লোক যাঁকে পেতে এবং শুনতে চায়, তাঁর মধ্যেই এটা থাকতে হবে। সেটা ঠিক কারো চেহারা, গান-বাজনা এবং ব্যবহারেই Locate করা যায় না। সেটা কি বলব! একটা inexplicable something- যেটা বিরাট আকারে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল। ওঁর তো মানে একেবারে অণুতে-পরমাণুতে ভরা ছিল। দিয়েওছেন, পেয়েওছেন। না দিলে পাওয়া যায় না। এ হল আমার স্থির সিদ্ধান্ত। একান্ত বিশ্বাস।’(রাগ অনুরাগ- পৃ. ২০৩)

‘এবার আপনি এমন একটা বিষয় তুললেন যে আমার ভাষা হারিয়ে যাওয়ার যোগাড় হবে। একেই তো বলেছি আমি ভাষার শিল্পী নই, তার ওপর রবীন্দ্রনাথ আমাকে এমনভাবে ছেয়ে আছেন যে ওঁকে নিয়ে ভেবে তো কোন কূল পাই না। রবীন্দ্রনাথের ওপর আমার মনে-প্রাণে এত শ্রদ্ধা যে কী রকম অভিভূত হয়ে পড়ি ওঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেও। সেই ছোটোর থেকেই দেখেছি উনি আমার মনে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। ওঁর কথা নিয়ে, ওঁর গানের সুর নিয়ে অনেকেই অনেক চর্চা, অনেক কাজ করেছেন এবং করবেনও। সেখানে আমার প্রবেশের কোন অধিকার নেই। আর রবীন্দ্রনাথের সমস্ত বিষয়ে প্রবেশ করে, সে অধিকার, সে ক্ষমতা কার আছে? তবে ওঁর কবিতা, তাঁর শব্দ, তার বর্ণ আমাকে মুগ্ধ করে। আমার তো ওঁর অনেক কবিতাকেই tone poetry মনে হয়…tone poetry-র কোন বাংলা শব্দ নেই? আছে! যা হোক। ওঁর সেই কবিতা, ওঁর সেই কথা নিয়েOrchestral Music, mood music আমি আগে করেছি। ভীষণ উৎসাহ আমার ওঁর কাজ নিয়ে ঐসব করায়। একটা পতিত জমি পড়ে আছে ঐখানে। আগে রেডিও-তে বহু কিছু করেছি। তারপর দাদার ব্যালের জন্য করেছিলাম ওঁর লিপিকা থেকে একটা Couplet। দাদারই জন্য ফের করেছিলাম ওঁর সামান্য ক্ষতি। ঐ ব্যালেটায় আমি রবীন্দ্রনাথের গান সুর কিছু রাখিনি, কিন্তু সামান্য ক্ষতির বিষয়, চেতনা ইত্যাদি নিয়ে ব্যালের গঠনটা তৈরি করেছিলাম। এরকম আরও অনেক রবীন্দ্রভিত্তিক ব্যালে করার ইচ্ছে আছে। তবে ওঁর গানের সুর সেখানে থাকবে না। যেমনটা করেছি ওঁর চণ্ডালিকা নিয়ে। আসলে ওঁর বিষয়, তার ভাব এত পোক্ত যে অন্যের পক্ষে সেই ভিত্তিতে কাজ করার স্বাধীনতা অনেকখানি। বড় সৃষ্টির আমি মনে করি এটাই ধর্ম। যুগ যুগ ধরে তাকে আওইনি নব নব রূপে সাজিয়ে নিতে পারেন।

রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গে বলি। ওঁর গানের কথার অংশই ধরুন না কেন। কথায় উনি তো রাজা বাদশা, যাই বলুন, ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওঁর বহু গানে এত সুন্দর বাণী এবং সুরের যোগাযোগ যে ঐ বাঁধুনিতে মানুষটা এত গান ফাঁদলেন কী করে ভাবতে হয়। তারপর ধরুন নিছক সুরেরই Combination এবং এ সমস্ত কিছুই সব গোঁড়ামির উর্ধ্বে গিয়েই। সেই প্রথম জীবনের গোঁড়া সুর বিন্যাসে উনি তো থাকলেই থাকতে পারতেন। জীবনের নানান নৈতিক বিষয়ে তো উনি যথেষ্ট গোঁড়া ছিলেন। কিন্তু ওঁর গানে এসে দেখুন। ওঁর ব্রহ্ম সঙ্গীতই ধরুন। তাতে কতই না রাগ-রাগিণীর প্রয়োগ পদ্ধতি আছে। একেবারে ধ্রুপদের মত। অদ্ভুত সুন্দর পঞ্চম সাওয়ারিতালে, তের মাত্রার তালে, নয় মাত্রার তালে, কত কী! তাতে বোঝা যায় উনি একটা বয়সে এ সমস্তই শিখেছিলেন, জেনেছিলেন, চর্চারাখতেন ক্ল্যাসিকাল গানের… বিশেষত ধ্রুপদ, ধামারের। এ একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা বৃত্ত ওঁর কীর্তনের… পদাবলির সে রূপান্তর ওঁর কথায়, ওঁর সুরের জালে। তারপর সে বাউল-ঘেঁষা গান। ভাটিয়ালি-ঘেঁষা। তারপর ওঁর সেই সুরের ঘোরাঘুরি… হয়ত নিলেন একটা ইমন কল্যাণের মুখ, কোথায় গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হামীর হয়ে গেল, কি কেদারা হয়ে গেল। এই যে একটা কোথায় না কোথায় গিয়ে সুরকে মিলিয়ে দেওয়া এটা ওঁর অদ্ভুত কল্পনার কাজ। আমি চিরদিন মুগ্ধ হয়েছি এতে। সুরকে এরকম ওদন করে কথার সঙ্গে ব্যবহার করা… এ বড় কঠিন কাজ কিংবা ভাবুন, হঠাৎ কী করে একটা Scottish কি Irish tune এসে মিশে গেল বাঙালির মনের ভাবের সঙ্গে, সেই কথায়। কিংবা ধরুন ওঁর ‘বাজে করুণ সুরে’ গানটা। গানটা ধরলেন সিংহেন্দ্র মাধ্যমে। কিন্তু অন্তরায় গিয়ে একটা শুদ্ধ মাধ্যমে লাগিয়ে দিলেন। অথচ সিংহেন্দ্র মাধ্যমে শুদ্ধ মধ্যম লাগে না। কিন্তু এই যে Artistic একটা Conception এবং ঐ যে একটা সাহস… অবশ্য ওঁর Position এমন ছিল যে উনি সাহস করতে পারতেন… কিন্তু বড় কথা হল ওঁর চেতনা। জেনেশুনে উনি যে একটা নিয়মকে ভাঙতে পারতেন এবং ভাঙতেন কোন বুজরুকির জন্য নয়, একটা মহৎ চিন্তার রূপায়ণ ঘটাতে, সেটা আমরা শ্রাদ্ধ না করে পারি না। বড় প্রতিভা উনি নিশ্চয়ি ছিলেন, কিন্তু প্রতিভাকে পদে পদে এরকম সাহসের পথে, ঝুঁকির পথে টেনে নিয়ে, তার ব্যবহার করে উনি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে গেলেন। কেবল এটা ঋষি রবীন্দ্রনাথের কাজ বলে কোন কিছুকে মানতে বাধ্য হই না, মানতে বাধ্য হই সে-সব কাজের শৈল্পিক অনিবার্যতার জন্য। এই জন্যই রবীন্দ্রনাথ- রবীন্দ্রনাথ। আমার জীবনে উনি এক আশ্চর্য প্রভাব। বাবা আলাউদ্দিন খাঁসাহেব, দাদা উদয়শঙ্কর এবং রবীন্দ্রনাথ… এঁরা আমার জীবনের তিনটে প্রভাব, তিনটে স্বপ্নের মতন। সর্বক্ষণ এঁদের আমি ভাবি। আমি রবিশঙ্কর- ঐ জাতীয় অহমিকাগুলো তখন বিলীন হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আরও একটা কথা আছে। আমার জীবনে উনি যতনা প্রভাব তার চেয়ে ঢের বেশি অনুপ্রেরণা। এ জীবনে তো অনেক মহাপুরুষ, এত বহুমুখী উনি… ওঁর কথা কী বলব? উনি এত ভাস্বর কথার প্রয়োজন সেখানে হয় না’

(স্মৃতি, রবিশঙ্কর পৃ. ৯৯-১০২। অনুলেখক ইন্দ্রাণী ভট্টচার্য। সম্পাদনা শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, ১৯৯২ সাহিত্যম, কলকাতা)

সংকলন - অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়



ছায়াছবির রবিশঙ্কর
শঙ্করলাল ভট্টাচার্য


ছায়াছবির সত্যজিৎকে যেমন গানের সত্যজিতের থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনি গানের রবিশঙ্করকে ছায়াছবির থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। ‘অপু’ ত্রয়ী ছাড়াও আরও অজস্র ছবিতে তিনি সুর করেছেন বলেই এটা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। আসলে দাদা উদয়শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে আট বছর বয়সে প্যারিসে গিয়ে পড়ে কোনও যন্ত্রেই হাত পাকানো শুরু হয়নি, নাচের টুকটাক রোলে সামান্য নাচা হয়, এই যা। কিন্তু সন্ধে হলেই দলের থেকে কাউকে জুটিয়ে সিনেমা হলে ঢুকে পড়া চাই। ওঁর কথাতেই আছে, “দেখতে দেখতে কখন একসময় সিনেমার পোকা হয়ে গেলা।” দাদার সঙ্গে গিয়ে অপেরা শোনা হচ্ছে আন্দ্রে সেগোভিয়ার, কিংবা শুধু দর্শন নিতে যাওয়া হচ্ছিল মহান চেলো শিল্পী পাবলো কাসালজ-এর। আর এর পাশাপাশি চলছিল সুযোগ হলে, সন্ধে নামলে সিনেমা হলে ঢোকা। ১৯৭৭-এ লণ্ডনে ওঁর সঙ্গে ওঁর স্মৃতিকথা ‘রাগ-অনুরাগ’-এ কাজ করার সময় গানের কথা, গানের কথার মধ্যে হঠাৎ একদিন সিনেমার কথা ঢুকে পড়ার একটা ছোট্ট গল্প আছে। আমার প্ল্যানেই ছিল একটা সময় ‘পথের পাঁচালী’ দিয়েই অথ করব বায়োস্কোপে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল এরকম…

একদিন সকালে ঘণ্টা তিনেকের রেকর্ডিং শেষ করে আমরা চা নিয়ে বসেছি, ওঁর সঙ্গিনী কমলা এসে টিভিটা চালিয়ে দিলেন। রবিশঙ্কর আগে থেকেই মাথায় রেখেছিলেন এই প্রোগ্রামটা দেখবেন। বললেন, “দিস ইজ অ্যান অলটাইম ক্ল্যাসিক। আগে কবার দেখেছি। আজ প্ল্যান ছিল ছিল তোমার সঙ্গে দেখার। লেট্‌স্‌ ওয়াচ।”

কী ওয়াচ করছি আমরা? না, রুডলফ নুরিয়েভ ও মার্গো ফন্টেনের ‘রোমিও আণ্ড জুলিয়েট’ ব্যালে। যার সুর আমর সংগীতজ্ঞ সের্গেই প্রকোভিয়েভের। এই ব্যালেতেই একসময় জুলিয়েট হয়েছেন গালিনা উলানোভ। আর তারপর এই মার্গো ফন্টেন। ছবি দেখতে দেখতে শুনছি প্রকোভিয়েভের সুরের চলন নিয়ে রবিশঙ্করের ব্যাখা, বিশ্লেষণ। কখনও দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালের ধরণ নিয়ে বলা। নাচের মুভমেন্ট ক্যামেরায় ট্র্যাক করা নিয়েও বললেন। আমার মনে পড়ল তাঁর ‘বালা’ ছবিটা করার সময় সত্যজিৎ বাবু উদয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ‘কল্পনা’-র পরিচালকের থেকে সিনেমার নাচ তোলা নিয়ে জানতে।

সিনেমা নিয়ে রবিশঙ্করের এত গল্প রেকর্ড হয়েছিল যে তাদের ‘রাগ-অনুরাগ’-এ না রেখে ‘স্মৃতি’ নামের আরেকটি বইয়ে জায়গা দিতে হ্য। সে সবে যাওয়ার আগে ছোট্ট দুটো ঘটনার কথা বলি যাতে সেতারিরি মনের চেহারায় দুটি ঝলক আছে। প্রথমটা লণ্ডনের ব্যাপার। যখন আমাদের কাজ চলছে জোর দমে। হঠাৎ বাজনার জন্য রবিশঙ্করের দক্ষিণ ফ্রান্সের এর্দলো শহরে যেতে হল। আমায় বললেন, “তুমি এই ক’দিনের টেপগুলো চটপট লিখে ফেলো। ফিরে এসে দেখব”। বললাম, “আচ্ছা”। তখন বললেন, “আরেকটা কাজ কোরো প্লিজ!”


কী?


অতি অবশ্য ‘ওয়ান ফ্লু ওভার দ্যা কুকুজ নেস্ট’ ছবিটা দেখে নিও। প্লিজ!

দ্বিতীয় ঘটনা বোম্বাইতে। আমাকে বললেন, “কাল একটু তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করব। তারপর একটা ভাল ডিনার খাওয়াব তোমাকে। তার পরেও একটা প্রোগ্রাম আছে। তোমাকে যেতেই হবে আমাদের সঙ্গে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”

বললেন, “ ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ দেখতে।”

এই হচ্ছেন রবিশঙ্কর।


# # # #


লণ্ডনে যখন কাজ চলছে তখন বিবিসি টিভিতে ফি শনিবার সন্ধ্যায় দেখানো হল ইঙ্গমার বার্গম্যানের ছয় এপিসোডের টেলিসিরিয়াল ‘সিক্স সিনজ ফ্রম অ্যা ম্যারেজ’। রবিশঙ্কর বলতেন, “আমি সত্যিই ওঁর খুব ভক্ত। সিনেমাইয় উনি আমার কাছে অবতার। ওঁর প্রায় সব ছবিই আমার দেখা, তবে খুব বেশি মনে আসে ‘সেভেন্থ সিল’, ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’, ‘পার্সোনা’ আর ‘ক্রাইজ অ্যান্ড হুইসপার্স’। এ ছাড়া লিভ উলমানকে নিয়ে যেটা শেষের দিকে করলেন, ‘ফেস টু ফেস’। অদ্ভুত!”

পর পর ছ’সপ্তাহ ‘সিক্স সিনজ ফ্রম অ্যা ম্যারেজ’ দেখে বললেন, “মাঝবয়সী দম্পতির অবসাদগ্রস্থ সম্পর্ক নিয়ে এ কী ছবি করলেন ভদ্রলোক! ছবি তো দেখছিই। মনে হল যেন একটা বইও পড়লাম। মনে হল মানুষটাও যেন আমাদের মন পড়ে নিয়ে এই কাজে নেমেছেন।”

আমি দেখতেই পাচ্ছিলাম ওঁর কথার শেষ বাক্যটা ওঁর জীবন থেকেই উঠে আসছে। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় ছবি শেষ হলে একটা দৃশ্য আমায় দেখতেই হত। কমলাদি চোখে রুমাল চাপা দিয়ে পাশের ঘরে চলে যাচ্ছেন আর রবিশঙ্কর উদাস চোখে জানালার বাইরে রাতের লণ্ডন দেখছেন। আমি চুপচাপ বেরিয়ে আসতাম হোটেল থেকে।

এরপর সোমবার দিন ওঁর কাছে গেলে গানুবাজনার কথায় যাবার আগে কিছুক্ষণ বার্গম্যানের ছবিতে সংগীতের ব্যবহার নিয়ে বলতেন। বলতেন, “খুব কম সংগীতই ব্যবহার করেন ভদ্রলোক। কিন্তু যেখানে করেন, Oh God! সে যে কী নিপুণ, কী অনিবার্য ভাবে তা বলে বোঝানো যায় না। আর নৈঃশব্দ্য বাস্তবিকই একটা ভাষা।”

এরকম একদিন রবিশঙ্কর ঠিকই করলেন শুধু সিনেমার স্মৃতি নিয়ে বলবেন। কোনও প্রশ্ন করব না মনস্থ করে টেপ চালিয়ে দিলাম। উনি বলে চলেছেন, আমি শুনছি, আপনারাও শুনুন…

“… এখন ছোটোবেলার কথা যখন ভাবি তখন আর্নস্ট লুবিৎজ কী ফ্রাঙ্ক কাদ্রার কথা খুব মনে আসে। ওঁরাই তখন ছিলেন এক-একটা দিকপালের মতন। পরে এল উইলিয়াম ওয়াইলার, বিলি ওয়াইল্ডারের যুগ। বিলি ওয়াইল্ডারকে আমার বরাবরই খুব মনে ধরত। একটা অদ্ভুত হিউমার নিয়ে কারবার করতেন ভদ্রোলোক। তবে আর একটা লোকও আছেন। ওঁকেই বলতে পারো সাক্ষাৎ ভগবান। চার্লি চ্যাপলিন।

আমার মনে আছে আমরা একদিন প্যারিসে আড্ডা মারছিলাম। আমার খুব বন্ধু জ্যাঁ রিবু। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা, বাঙালি মেয়ে। কৃষ্ণা রিবু। ওঁদের বাড়িতেই বসেছিলাম আমরা। সেখানে সিনেমাতেকের ডিরেক্টর আঁরি ল্যাংলোয়া, মারা গেছেন, তিনিও ছিলেন সস্ত্রীক। আর ছিলেন জ্যাঁ রেনোয়া। আঁরি কার্তিয়ের ব্রেসঁ… আর এরকমই ফিল্ম, ফোটোগ্রাফি, মিউজিকের সব ভারী ভারী লোক। বসে কথা হচ্ছিল খুব। হঠাৎ কে যেন জিজ্ঞেস করল রেনোয়াকে, whom do you consider the best director in films? Can you name three or four of the best you have seen?

তো জ্যাঁ রেনোয়া, বুড়ো, ভারি রসিক ছিলেন। আঙুল ছড়িয়ে গুনতে বসলেন। Frist, Charlie Chaplin. Second, Charlie Chaplin. Third, Charlie Chaplin. হাঃ হাঃ হাঃ। বোঝো চ্যাপলিনের ওপর কী শ্রদ্ধা ওঁর। তবে রেনোয়া বলেই না, হেন লোক দেখিনি সিনেমায় যে অমন করে ভাবেনি। He was a prophet in cinema.”

ফ্ল্যার্হার্টর সঙ্গে খুব আলাপ ছিল রবিশঙ্করের। ওঁর ‘নানুক অফ দ্যা নর্থ’ তথ্যচিত্র ’৩৫ কী ’৩৬ সালে লণ্ডনে দেখে ১৫-১৬ বছরের সদ্যতরুণ সেতারি তো বিলকুল ফিদা। এর কিছুদিন পর দিব্যি আলাপ জমে। এবং ওই সময়েই ফের ফিদা হলেন, যাঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি কখনও কিন্তু ভক্ত থেকে গেলেন চিরকাল- আইজেনস্টাইন। “যাই দেখছি সাহেবের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়— ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’, ‘ইভান দ্যা টেরিবল’, ‘পিটার দ্যা গ্রেটার।‘ দেখা হয়নি শুধু ‘আলেকজণ্ডার নেভাস্কি’।

আমি বলেছিলাম, “ ‘নেভাস্কি’-ও আমার দেখা।” তখন চোখ বড় বড় করে রবিশঙ্কর বললেন, “খোকা তাহলে দিব্যি তৈরি হয়েই এসেছে! বলো, তাহলে এবার কোন কথায় যাব? কার কথায়?”

আমার আর তর সয়নি বলতে, “সত্যজিৎ”

# # # #


রবিশঙ্কর শুরুই করলেন দারুণ একটা personal note-এঃ “আমার কাছে এঁদের সকলের থেকেই কিন্তু আমাদের দেশের সত্যজিৎ রায়ের কথা স্বতন্ত্র। ওঁর সঙ্গে আমি এত বেশি জড়িত, সেই শুরু থেকেই, যে একটা সেন্টিমেন্টের কথা এসে যাবেই। ওঁর সঙ্গে প্রথম ছবি, দ্বিতীয় ছবি, তৃতীয় ছবি, চতুর্থ ছবি, সবের সঙ্গেই আমি জড়িয়ে ছিলাম। এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমরা প্রায় একই সঙ্গে গড়ে উঠেছে। কাজেই একটা জোরালো সেন্টিমেন্ট আমার এসে যায় ওঁর ছবির কথা ভাবলেই।”

ওঁদের কজাএর সম্পর্কে বললেনঃ “আমার মনে ওঁর প্রথম ছবিটাই দারুণ ছাপ ফেলেছিল। ‘পথের পাঁচালী’। মনে আছে, সেটা ’৫১ কী ’৫২ সাল। জঙানদার(জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ) বাড়িতে ছিলাম যখন উনি এই ছবিটার ব্যাপারে আসেন। ওঁকে অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই চিনতাম। এ মুখে, ও শুনেওছিলাম যে উনি একটা ভাল ছবি করতে খুব আগ্রহী। কাজেই উনি এসে যখন বললেন পুরো ব্যাপারটা, যে কীরকম কষ্ট করে উনি ছবিটা দাঁড় করিয়েছে, শেষের দিকে দাঃ বিধান রায় খুব সাহায্য করেছেন… তখন সত্যি খুব ভাল লাগল ওঁর একগ্রতা দেখে। ভদ্রোলোক খুব মুশকিলে পড়েছিলেন, struggle করছিলেন। বললেন, আপনি যদি ছবিটার সুর করেন খুব ভাল হয়। তাতে ছবিটার অনেক মর্যাদাও বাড়বে…

তারপর যাই হোক, উনি আমাকে ছবিটা দেখালেন ভবানী সিনেমায়। Rushes. কিন্তু ঐ rushes দেখেই আমি একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। Rush Print তো বুঝতেই পারছ ছবির খুবই কোরা অবস্থা। কিন্তু আমি খুব ছোট থেকেই ফিল্ম মিডিয়ামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম, আমি ‘পথের পাঁচালী’-র rushes দেখেই বুঝলাম এ এক অদ্ভুত ছবি হয়েছে। এত realism অথচ কীরকম প্রাণে ছোঁইয়া। তাছাড়া ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ছোটবেলাতেই পড়েছি, ‘ভারতবর্ষ’-ইয় যখন … ‘ভারতবর্ষ’-ই তো? ধারাবসিক বেরোত। বইটা সেই থেকেই একটা খুব আপন জিনিস থেকে গিয়েছিল আমার। ওরকম একটা শান্ত, সুন্দর বই কীরকম ফুটে উঠেছে দেখলাম সত্যজিৎবাবুর ছবিতে। ভীষণ ভাল লাগল আমার। ততক্ষণে আমিও অত্যন্ত inspired বোধ করছিলাম। বললাম, বলছেন কী? এ ছবির সুর করব না?”

বাকিটা ইতিহাস।


লেখক পরিচিতি : সাংবাদিক ও লেখক



আমার কাকা রবিশঙ্কর
তনুশ্রী শঙ্কর


রবিশঙ্করের আদরের ‘তনুশ্রী’ তিনি। এই বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য ঋতবাকের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় নৃত্যশিল্পী তনুশ্রী শঙ্কর স্মৃতিচারণা করলেনঃ


ঋঃ কত বছর বয়স আপনার যখন রবিশঙ্করকে আপনি প্রথম দেখেন?

তনুশ্রীঃ সালটা ঠিক মনে নেই। আমি তখন উদয়শঙ্করের নৃত্য স্কুলে নাচ শিখি। এলগিন রোডের জাহাজ বাড়িতে কাকা (রবিশঙ্কর) অনুষ্ঠান করতে আসেন। আনন্দদার(আনন্দ শঙ্কর) আর আমার তখন প্রেমপর্ব চলছে। তাই কাকার অনুষ্ঠান শুনতে আনন্দদা মা আর মমর সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যান ওই অনুষ্ঠানে। সেই প্রথম কাকাকে দেখি এবং ওনার সঙ্গে আমার আলাপ।

ঋঃ প্রথম আলাপের অনুভূতি?

তনুশ্রীঃ আমি তখন তো জানতামই না, উনি কে। স্কুলে পড়া একটি মেয়ে আমি তখন। ওনাকে প্রথম দেখার পর এবং ওনার বাজনা শোনার পর অনুভব করলাম, উনি কে। কাকার এই অনন্যসাধারণ প্রতিভা এবং তাঁর উপস্থাপনা আমাকে মোহমুগ্ধ করেছিল সেই প্রথম দর্শনেই।

ঋঃ যখন বিবাহ সূত্রে শঙ্কর পরিবারে এলেন, তখন শিল্পী রবিশঙ্করের সঙ্গে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়। সেই সম্পর্কে কিছু বলুন।

তনুশ্রীঃ কাকা প্রথম থেকেই আমাদের সম্পর্কটাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। যখন আমার বিয়ে হয়, আমার বয়স তখন সতেরো। সেই সময় অবশ্য এসেছিলেন। আমরা খুব আনন্দ করেছিলাম।

ঋঃ কিছু স্মৃতি আছে সেই সময়কার?

তনুশ্রীঃ হ্যাঁ, আছে। কাকা বেশিরভাগ বিদেশে থাকতেন। বছরে একবার দেশে আসতেন। একবার কাকা বেনারসে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চিনাম্মা (সুকন্যা শঙ্কর)। পুরো শঙ্কর পরিবার দেখা করতে পৌঁছোলো বেনারসে। আমাদের অন্য দুই কাকা রাজেন্দ্র শঙ্কর এবং দেবেন্দ্র শঙ্করও এলেন। কি অসম্ভব মজা করেছিলাম। একদিন সবাইকে নিয়ে একটা বিচ্ছিরি সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গেলেন। সিনেমা দেখার চেয়ে ওনার কৌতুকগুলোতে মজা পেয়েছিলাম অনেক বেশি। যত ফেরিওয়ালা খাবার নিয়ে হলে ঢুকছে, তাদেরকে ডেকে বিভিন্ন খাবার কিনছেন, মজার মজার কথা বলছেন। সে কি আনন্দ! এছাড়াও আমাদের সঙ্গে তাস খেলা, দাবা খেলা, বিভিন্ন দেশের গল্প— আমাদেরকে মাতিয়ে রেখেছিলেন।

ঋঃ ওনাকে রেওয়াজ করতে দেখেছেন কখনো?

তনুশ্রীঃ হ্যাঁ, এদেশে এবং ওদেশেও, ওনার বাড়িতে। রেওয়াজ ছিল ওনার পুজো। ঠাকুর ঘরে বসে রেওয়াজ করতেন।

ঋঃ স্যান ডিয়েগোর বাড়িতে দেখা রবিশঙ্কর কি অন্যরকম ছিলেন?

তনুশ্রীঃ না। একই মানুষ। আমি আর আনন্দদা ওনাদের কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অসাধারণ সময় কেটেছিলো আমাদের। চিনাম্মা বাঙালি খাওয়ার রান্না শিখেছিলেন। কাকা বিদেশে জীবনযাপন করলেও আদতে ছিলেন একজন বাঙালি। আমাদের কত জায়গা ঘুরে দেখিয়েছিলেন দুজনে।

ঋঃ আপনাদের মে-ফেয়ার রোডের বাড়িতে উনি এসেছেন?

তনুশ্রীঃ অনেকবার। আমাদের যে নাচের হলঘরটা, সেটার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কাকা। উনি এখানে সেদিন বাজান আর সঙ্গতে ছিলেন পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী। আর দর্শকাসনে বসে আছেন সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, বসন্ত চৌধুরী প্রমুখ।

ঋঃ আপনার কী মনে হচ্ছিল তখন?

তনুশ্রী(একটু হেসে)ঃ আমি তখন হাসপাতালে ভর্তি। মিষ্টুর(শ্রীনন্দা শঙ্কর) জন্ম হয়। কাকা সবার সামনে সেদিন মিষ্টুর আগমন বার্তা জানান।

ঋঃ শিল্পী এবং মানুষ রবিশঙ্কর সম্পর্কে কিছু বলুন।

তনুশ্রীঃ যেমন অসাধারণ শিল্পী, তেমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। মানুষ হিসেবে প্রচণ্ড দয়ালু। শেষদিন পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। এর অন্যথা কোনোদিনও দেখিনি।


লেখক পরিচিতিঃ নৃত্যশিল্পী, উদয় শঙ্করের শিষ্যা, আনন্দ শঙ্করের স্ত্রী এবং তনুশ্রী শঙ্কর ডান্স একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা।





“রবিশঙ্কর ও আই পি টি এ”
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়


রবিশঙ্কর প্যারিসের বিলাসবহুল জীবনকে ছেড়ে মধ্যেপ্রদেশ্রে মাইহারের মতন অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়ে অসীম নিষ্ঠার সঙ্গে তালিম নেন উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের কাছে। শৈশব ও কিশোর পাশ্চাত্যে কাটাবার ফলে ওনার অভিজ্ঞতা ছিল যেমন বিশাল তেমনি দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল ভিন্ন ধরনের যার ফলে তিনি গতানুগতিক সঙ্গীত ছাড়াও বেতার, চলচ্চিত্র, নাটক, ব্যালে ও নাচের সঙ্গে নির্দ্বিধায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরেছিলেন আর এখানেই পেরেছিলেন স্বকীয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। তাই বিশ্ববিখ্যাত বেহালা বাদক ইহুদি মেনুহিন বলেছিলেন, ‘কম্পোজার হিসাবে রবিশঙ্করের প্রতিভা কেবলমাত্র মোৎজাটের সঙ্গে তুলনীয়’।

আইপিটিএ যুক্ত থাকাকালীন রবিশঙ্করের কম্পোজার মনের ডানা সম্পূর্ণভাবে মেলে ওঠে। যোগাযোগ হয় পুরনো বন্ধু শান্তি বর্ধনের সঙ্গে। শান্তি বর্ধনে ছিলেন নৃত্যশিল্পী বিশেষ করে ‘টিপরা’ অর্থাৎ ত্রিপুরার এক বিশেষ নৃত্যশৈলীতে দক্ষ ছিলেন। সেই সময় শান্তি বর্ধন আন্ধেরির আইটিপিএ-র কালচারাল স্কোয়াডে কাজ করতেন। সেই সময় ওনারা ‘স্পিরিট অফ ইণ্ডিয়া’ বলে একটা ব্যালে করছিলেন। সেই ব্যালের রিহার্সাল দেখে রবিশঙ্করজী দলের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দলে যোগ দিয়ে ওঁর একটা স্বপ্ন যেন পূরণ হল। অঁর নিজের ভাষায়, “অথচ জীবনের প্রথম থেকেই বলতে পারো আমার একটা জোরালো ঝোঁক ছিল গান-বাজনার ক্রিয়েটিভ দিকটার প্রতি – কম্পোজিশনের প্রতি। ধর নাচের সঙ্গে সুর দেও্যা বা নাচের একটা পুরো সাংগীতিক কাঠামো তৈরি করা কিংবা সুরকে বিভিন্ন প্রথায় অন্যান্য শিল্পাঙ্গে ব্যবহার করা – এইরকম আর কি। তো আমার আনন্দটাও হয়েছিল ঠিক এই কারণেই। ভাবলাম নিতুন কিছু কম্পোজ করার সুযোগ সুবিধা পাব।”১ সেই সূত্রে কতকগুলি ছবির সুর করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। খ্বাজা আহমেদ আব্বাসের ‘ধরতি কি লাল’, আর চেতন আনন্দের ‘নীচা নগর’ ছবির সুর করলেন। আইপিটিএ ছিল কমিউনিস্ট পার্টির একটা শিল্পশাখা। ফলে কিছুদিন ওখানে কাজ করার পর উনি বুঝতে পারলেন স্বাধীনভাবে কাজ করার অসুবিধা। রাজনৈতিক বাধানিষেধ, পার্টির আদেশ এইসব রেজিমেন্টশন ওঁর ভালো লাগেনি। তাই একবছর বাদে উনি আইপিটিএ ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল থিয়েটারে যার পেছনে ছিল কংগ্রেস। এই খানেই হাতেখড়ি হল জওহরলাল নেহেরু-র ‘ডিসকভারি অফ ইণ্ডিয়া’র ভিত্তিতে ব্যালেতে সুর দেবার। আইপিটিএ তে থাকার সময় ওঁর পরিচয় বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, বিষ্ণু দে, সত্যজিত রায়, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত ও সলিল চৌধুরি, তাপস সেন ও খালেদ চৌধুরির সঙ্গে। আইপিটিএ এর প্রথম তিন চার বছর খুব ভালো ভালো কাজ হয়েছিল যার বেশির ভাগটা জুড়েই ছিল পল্লীগান আর থিয়েটার। যদিও এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বা তার সঙ্গীত করে উনি খুবই উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে উনি ওঁর আত্মজীবনী বা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এর কোনো উল্লেখ উনি করতেন না। বরং যার আবহ সঙ্গীত নিয়ে উনি বারবার বলেছেন তা হলো সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী-র। সঙ্গীত সমালোচক ও প্রাবন্ধিক অতনু চক্রবর্তী এক সাক্ষাৎকারে ওঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “এই কলকাতা শহরে একসময় উৎপল দত্তর ‘অঙ্গার’ ও ‘ফেরারী ফৌজ’ নাটকের জন্য মিউজিক করেছিলেন সেই সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন-” উত্তরে উনি বলেছিলেন, “বহুদিন আগের কথা এখন আর ডিটেল মনে নেই, তবে আমি কোনো দৃশ্য বা ঘটনা দেখে তাৎক্ষণিক ভাবনা বা রিঅ্যাকশন অনুযায়ী স্বতঃস্ফুর্তভাবে মিউজিক তৈরী করতে অভ্যস্ত এবং ভালোবাসি”২ ফলে কেমন ছিল ‘অঙ্গার’ ও ‘ফেরারি ফৌজ’র সঙ্গীত সে সম্বন্ধে জানতে গেলে আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে ঐ দুই নাটকের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের কথা। এই নিয়ে যে দু’জন তাঁদের স্মৃতি কথায় লিখেছিলেন তাঁরা হলেন শোভা সেন ও তাপস সেন। শোভা সেন লিখেছিলেন, “২৯ নভেম্বর ১৯৫৯ নীলিমা দাস পণ্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে এসেছিল ‘নীচের মহল’ দেখাতে। নাটক দেখে ব্যাকস্টেজে এসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রবিবাবু বলেছিলেন, “আপনাদের যে নতুন যে নাটকের প্রস্তুতি চলছে তার সঙ্গীত আমি করব।” এবার রবিশঙ্করজীকে নাটক পড়ে শোনানো হলো। নাটকের মহলা পুরোদমে চলছে। সকাল থেকে মহলা রবিবাবু নিজেই তাঁর সব যন্ত্রী ঠিক করলেন। এম পি স্টুডিও-র কর্ণধার ও মালিক শ্রদ্ধেয় মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় কোনো অর্থ না নিয়ে তাঁর স্টুডিওতে সঙ্গীত গ্রহণের অনুমতি দিলেন। উৎপল তার এক লেখায় লিখেছে, ‘রবিশঙ্কর মির্নাভায় এলেন ‘অঙ্গার’এর রিহার্সাল দেখতে। ফাটা ছাদ, ভাঙ্গা সীত, বিবর্ণ যবনিকা। তার মাঝে বিশ্ববরেণ্য শিল্পী তন্ময় হয়ে মহলা দেখলেন। মাঝে মাঝে গুনগুন করে সুর ভাঁজলেন।

পরদিন ২৪ শে ডিসেম্বর স্টুডিওতে পৌঁচ্ছে তটস্থ একদল বাজনাদারের সামনে মুখে মুখে রবিশঙ্কর রচনা করেছেন সুরের পর সুর তাদের কাঊন্টার পয়েন্ট, তালের বহুরকম ফেরতা। সহকারী দ্রুত হাতে লিখছেন স্বরলিপি, আর কপি হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। তারপর রিহার্সাল, মনিটর টেক। এক শিফট্‌-এ চোদ্দটি পূর্ণাঙ্গ আবহ সঙ্গীত সৃষ্টি করে রবিবাবু চলে গেলেন অন্য কাজে।… আমরা প্রথম থেকেই টের পাচ্ছিলাম দর্শকের ভাল লাগার স্পর্শ। প্রতি শো এর পর ন জন শ্রমিকের জন্য চোখে জল নিয়ে অভিভূত দর্শকেরা স্তব্ধ হয়ে সীট-এ বসে থাকতেন কিছুক্ষণ। এক এক দিন কেউ কেউ অজ্ঞানও হয়ে গেছে। শেষ দৃশ্য এতই হৃদয় বিদারক, তার সঙ্গে রবিশঙ্করের সঙ্গীত এমন শ্বাস রোধকারী যে দর্শক নাটকের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম হয়ে যেতেন।”৩ এর থেকে বোঝা যায় যে একটা নাটককে একটা জায়গায় উত্তীর্ন হতে হলে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গীতের গভীরতার কতোটা প্রয়োজন যা রবিশঙ্করজীর মতন সঙ্গীত শিল্পীই করতে পেরেছিলেন। তাই তাপস সেনের ভাষায়, “সত্যজিৎ রায়ের মতো উৎপলের কম্বিনেশনটা সত্যি মিনিংফুল হয়ে উঠেছিল ‘অঙ্গারের’ কাজে। নাটকের এক জায়গায় যেখানে যেখানে সই হচ্ছে, আগের দিন রাতে সবাই মিলে অনেক দ্বিধাদ্বন্ধের মধ্যেও সিদ্ধান্ত নিল সই করবে। তারা জানে নিচে নামলে মরে যাবে কিন্তু কিছু কমপেন্‌সে্‌শন পাবে। তাই একে একে সই করতে আসছে। বৃদ্ধ-যুবক, কেউ কাঁপছে, কেউ সই করতে জানেনা- তাই উল্টোপাল্টা করছে, কেউ ফস্‌ করে সই করে দিল। পুরো সময়ের সাসপেন্সটাকে রবিশঙ্কর অসাধারণ মিউজিক ধরেছিলেন। অনেকগুলো মটকা আর পারকাশন দিয়ে মিউজিক পিসটা করেছিলেন… আরেকটা জায়গাও খুব রিমার্কেবল ছিল… যেখানে এক্সপ্লোশন হত, ভীষণ বিস্ফোরণ… তখন সনাতন(রবি ঘোষ) ‘জান বাঁচাও’ বলে চেঁচাতে থাকে আর সেই চীৎকারের সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিউজিক রবিশঙ্কর করেছিলেন। চড়া স্কেলে মিউজিকটা করেছিলেন। সেই চিৎকার আর মিউজিক মিলে যে সিচুয়েশন হত তখন গায়ে কাঁটা দিত। ভীষণ সাউণ্ড।”৪

আমি অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ সব নাটকই দেখেছি আমার দশ এগারো বছর বয়সে। তখন্‌ উতপল্বাবু এই নাটকে অভিনয় করতেন না। তবে ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘কল্লোল’ নাটকের কিছু কিছু দৃশ্য আমার এখনো মনে আছে বিশেষ করে ‘অঙ্গার’ নাটকের শেষ দৃশ্য যেখানে খনিতে জল ঢুকে খনি শ্রমিকরা মারা যাচ্ছেন, সেই দৃশ্যে রবিশঙ্করের সঙ্গীত, তাপস সেনের আলো ও কলা-কুশলীদের অভিনয়ের সমন্বয়ে যে মর্মস্পর্শী দৃশ্য তৈরী হয়েছিল, তা আমি কেন যাঁরাই এ নাটক দেখেছেন তাঁদের স্মৃতিতে তা চির উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই তাপস সেনের ভাষায়… “সেই ছেলেটি, যে খেতে বসে নানা স্বপ্নের কথা বলতে বলতে, খাওয়া অসম্পূর্ণ রেখেই খনিতে চলে আসে – সেই ছেলের নাম ধরে বিনুর মায়ের আর্ত চিৎকার – সেই চিতকারের সঙ্গে রবিশঙ্করের বাঁশি আর সারেঙ্গি দিয়ে তৈরি হৃদয় মোচড়ানো সুর পুরো অডোটোরিয়ামকে ছেয়ে ফেলতো।”৫



তথ্যসূত্র :-

১. রবিশঙ্কর : রাগ অনুরাগ – পৃঃ ১২৪ – আনন্দ পাবলিশার্স।
২. অতনু চক্রবর্তী : মুখোমুখি রবিশঙ্কর – পৃঃ ৫৬, প্রতিভাস
৩. শোভা সেন : স্মরণে-বিস্মরণে – নবান্ন থেকে লাল দূর্গ – পৃঃ ৪৫-৪৬ – এম. সি. সরকার ও সন্স।
৪. তাপস সেন : ছায়ায় আলোয় – পৃঃ ২৯৮-২৯৯, করুণা প্রকাশনী।
৫. ঐ


লেখক পরিচিত : সরোদবাদক এবং সংগীত গবেষক





আমার দেখা রবিশঙ্কর
শুভাপ্রসন্ন


ঋতবাকঃ রবিশঙ্করের সঙ্গে আপনার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এবং উনি আর্টস একর-এ এসেছেন। আমরা এই নতুন আর্টস একর-এ ওনার ছবিও দেখেছি। একটু আমাদের যদি বলেন, প্রথমে আমি জানতে চাই যে, আপনার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগটা হয়েছিল?

শুভাপ্রসন্নঃ আমার সঙ্গে যোগাযোগ কিন্তু আর্টস একর-এর সূত্রে কিছু হয়নি। আমার সাথে একটা অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয়। রবিশঙ্কর, ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর একটা বিশেষ রাগ রচনা করেন। সেই রাগটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে উনি সকলকে শুনিয়েছিলেন। তখন উনি আমাকে বলেছিলেন যে, শুভা ভালো হয় যদি তুমি এটার একটা ভিস্যুয়াল পার্ট করতে পারো! উনি খুবই ক্রিয়েটিভ মনের ছিলেন। আর অনেকে জানে না যে, উনি এতদিনে প্রবাস জীবন-যাপন করলেও বাংলার সঙ্গে, বাঙ্গালীর সঙ্গে বাংলার শিল্প-সাহিত্য, সবকিছুর সঙ্গে উনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এমনকি তৎকালীন যে লিটল ম্যাগাজিন, সেই লিটল ম্যাগাজিনেরও কে কোথায় কী লিখছে, উনি সব খবর রাখতেন। একদিকে অফুরান সৌন্দর্য, প্রাণবন্ত তার সঙ্গে একটা সৃষ্টিশীল মন। তিনি বিখ্যাত সেতারবাদক এটা আমরা জানি। তিনি আলাউদ্দিনের জামাই এবং শিষ্য এটা আমরা জানি। এই ব্যাপারগুলো তাঁর সংস্পর্শে আসার ফলে আমার জানার সুযোগ হয়েছিল। তা আমি ওঁর কথা মতো নানান রকম ছবি, আমার নিজের ছবি, Eduard Munch এর The Scream. সব দিয়ে-টিয়ে ভিস্যুয়াল পার্টটা করেছিলাম।

ঋতবাকঃ সেটা কি ওঁর ঐ মিউজিকের সঙ্গে?

শুভাপ্রসন্নঃ হ্যাঁ মিউজিকের সঙ্গে। এই কাজ চলাকালীনই আমার মেয়ের জন্ম হয়। তা শিপ্রা তখন হসপিটালে। আমি খবর দিই যে ওইদিন আমি আসতে পারব না। বলেন সে কি! আমি তোমার মেয়ের নাম রাখব। তো শেষ পর্যন্ত ওঁরই দেওয়া নামে আমার মেয়ের নামকরণ হয় জোনাকি। এরকম সময়ই আমি ওঁকে বলেছিলাম যে আমি আর্টস একর, শিল্পীদের একটা গ্রাম তৈরি করতে চলেছি কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে, এটা একটা ইউরোপে দেখা, জার্মানিতে, সেই থেকে আমার মনে হচ্ছিল, ওটার যদি উনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আসলে রবিশঙ্করের জন্যে আমার ভাবনা ছিল না। ছিল হুসেনের সঙ্গে।

ঋতবাকঃ হুসেন?

শুভাপ্রসন্নঃ হ্যাঁ। কিন্তু হুসেন, আমার যারা একটু সিনিয়র, তাঁরা বললেন, হুসেন কখনও কথা রাখেন না। হয় তো আমরা সব আয়োজন করব, হুসেন সেইসময় অনুপস্থিত থাকবেন। তখন বললাম যে তাহলে হুসেনের পরিবর্তে কে হতে পারে? সকলেই বললেন রবিশঙ্কর।

ঋতবাকঃ কারণটা কী? দুজনে তো দুটো আলাদা জগতের।

শুভাপ্রসন্নঃ দুটো আলাদা ফিল্ডের হলেও। রবিশঙ্কর একজন শিল্পী , যে শিল্পী শুধু একটা সেতারবাদক হিসাবে পরিচিত নন, তাঁর গণ্ডীটা অনেক বড়। আর আমার সবসময়ই খুব স্বপ্ন দেখার একটা বড় স্বপ্ন দেখার একটা রোগ আছে।

ঋতবাকঃ জানি।

শুভাপ্রসন্নঃ তা আমি তখন খুব ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সেইসময়ই আমার বন্ধু শঙ্করলাল তখন রবিশঙ্করের রাগ-অনুরাগটা লিখছে। আমার তাঁর সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল না বলে আমি শঙ্করলালকে জানাই। শঙ্করলাল রবিশঙ্করের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই সূত্র থেকে প্রায় আমৃত্যু আমার সঙ্গে রবিশঙ্করের সম্পর্ক ছিল। আমরা তাঁকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করিয়েছিলাম। তারপর উনি যখন বললেন যে তোমরা কী করে পয়সা জোগাড় করবে? আমি বলেছিলাম একদিন যদি আমাদের জন্য বাজান। তাতে উনি রাজি হয়ে আশুতোষ সেন্টিনারি হলে বাজিয়েছিলেন। আমিও খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিলাম সে মঞ্চ। ত্রিস্তরে এবং পিছনে একটা কুড়ি ফুটের ছবি এঁকেছিলাম। আর উনিই...

ঋতবাকঃ কীসের ছবি সেটা?

শুভাপ্রসন্নঃ সেটা হচ্ছে একটা বিশাল অফুরন্ত ডানা। অনেক সারস পাখি যেন মেলে ধরেছে। এরকম একটা। অনন্ত ডানার মতো।

ঋতবাকঃ সেই ছবিটার সঙ্গে কোথাও কি মানে যেহেতু আপনি এক্ষুনি বললেন যে রবিশঙ্কর...

শুভাপ্রসন্নঃ না। কোথাও সেরকম মিল নয়, তবে একটা আবহাওয়া তৈরি হয়। মনে হয় তাই। আমি আমার মতো করেছি। উনি ওঁনার মতো করেছেন। তবে আমার কাছে যেটা গর্বের বা স্মরণীয় যে ফরাসী একটা গ্রুপ, তাঁর ওপরে একটা ডকুমেন্টারি করছিল এবং হওয়ার কথা ছিল মভলঙ্কার হলে, যেখানে রবিশঙ্করের কনসার্ট হবে, সেইখানে ওরা তুলবে।

ঋতবাকঃ কি হলটার নামটা?

শুভাপ্রসন্নঃ মভলঙ্কার হল। দিল্লী।

ঋতবাকঃ আচ্ছা। আচ্ছা।

শুভাপ্রসন্নঃ তখন রবিশঙ্কর ওটা বারণ করে উনি ওদেরকে কলকাতা আসতে বলেছিলেন এবং এই কলকাতায় যে উনি বাজাচ্ছেন, সেটা সবটা ফরাসীরা তুলে ধরেন। এরকম নানাবিধ ছোট-খাটো নানা বিষয়। পরে আমার এক্সিবিশন, মানে রেট্রস্পেক্টিভ যখন দিল্লীতে হয় উনি এসেছিলেন। অনেকক্ষণ আমরা কাটিয়েছি। ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঋতবাকঃ আর একটু গল্প ইত্যাদি জানতে চাই।

শুভাপ্রসন্নঃ গল্প মানে আমি বারবারই বলছি যে, এই ধরনের মানুষ যাঁদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি, সে মানুষের কোনও বিকল্প হয় না। আমাদের একদিকে যেমন উদয়শঙ্কর। তিনি যে কত বড় প্রতিভা! তাঁর যথোপযুক্ত সবাই সম্মান দিতে পেরেছে কিনা জানি না। আমি অন্যকিছুতে গেলাম না।

রবিশঙ্কর অনেকে মনে করেন যে অন্নপূর্ণাদেবীকে হয়তো উনি আঘাত দিয়েছেন, এটা যে কত বড় ভুল, কল্পনা করা যায় না। উনি অন্নপূর্ণাদেবীকে ভীষনই ভালোবাসতেন কিন্তু কোথাও একটা হীনমন্যতা খেলা করত। যখনই ওঁরা দুজনে কোথাও যেতেন, রবিশঙ্করের এতো লোকপ্রিয়তা, এতো জনপ্রিয়তা! তাঁর সেই রূপে মানুষ আকর্ষিত হত। অন্নপূর্ণা দেবীকে সেভাবে মানুষ গ্রহণ করত না। এটার ফলে একধরণের হীনমন্যতা দেখা দেয়। ক্রমশ সেটা একটা বড় আকার ধারন করে। এমনকি উনি মাইহারেতে আলাদা করে অন্নপূর্ণাদেবীর জন্যে বাড়ি তৈরি করে দেন। শেষ পর্যন্ত রবিশঙ্কর পরে অন্য প্রেমে পড়লেন, উনি একাধিক প্রেমে পড়েছেন। প্রাণবন্ত মানুষ । তা অন্নপূর্ণাদেবী কিন্তু তাঁকে ডিভোর্স দেননি। পরবর্তীকালে যখন অন্নপূর্ণা দেবী একজনকে বিবাহ করার মানসিক প্রস্তুতি নিলেন, তখন ডিভোর্স পান। এবং সেটা অনেক বয়সে। তার জন্যই রবিশঙ্করকে বিবাহ করতে হয় শেষ জীবনে।

ঋতবাকঃ আচ্ছা আচ্ছা। আমি বলব এখানে, এটা তো মানুষ হিসাবে আপনি বললেন। ওঁর সৃষ্টি নিয়ে যদি কিছু বলেন, ওঁর তো অনেক পড়াশুনা ছিল...

শুভাপ্রসন্নঃ আমি তো সঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলি জানিনা। আমার একটা ভালো লাগা বোধ আছে। সে ভালো লাগা থেকেই যখন ওঁর সেতার শুনি। সেটা তো একটা অন্য মূর্চ্ছনা। আরও একটা কথা যেটা রবিশঙ্করের ক্ষেত্রে ভীষন কাজে লাগে, উনি কিন্তু শুধুই একটা ঘরানায় বিশ্বাসী থেকে কাজ করে যাননি। উনি অনেককিছু মিশিয়েছেন। কর্ণাটকের সঙ্গে এবং অন্যান্য ঘরাণার সঙ্গে এবং এটাকে বিশ্বের দরবারে ছড়াবার জন্যে যতটুকু সামান্য একটা কম্প্রোমাইজ করা যায়, উনি কুণ্ঠিত হননি। যেমন ওঁর প্রিয় রাগ, আমরা আছি, তেমনি একটু মিশিয়ে যে কাজগুলো, এগুলো পৃথিবীতে সাঙ্ঘাতিক সমাদৃত হয়েছে। সেটাও একটা আছে। আর তাছাড়া আমরা তো জানি যে ব্রিটিশদের উনি কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন।

ঋতবাকঃ অনুষ্ঠানও করেছেন।

শুভাপ্রসন্নঃ এবং তাদের গুরু ছিলেন উনি। ইহুদি মেনুইন যেমন অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাদের দুজনের বাজনা পৃথিবীতে অনেক খ্যাত হয়েছে। সুতরাং এগুলো মানুষ জানে। আমার সেইভাবেই জানা। কিন্তু আমি যে মানুষ রবিশঙ্করকে দেখেছি কাছ থেকে সেটুকুই আমার উপলব্ধি, ধারণা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস।

ঋতবাকঃ যেরকম আপনি একটা বললেন যে, ওইসময় এখানে বাজিয়েছিলেন ঐ পুরনো আর্টস একর-এ

শুভাপ্রসন্নঃ হ্যাঁ, গড়ার জন্যে।

ঋতবাকঃ গড়ার জন্যে। এরকম আরও কিছু কি ওনার এই মানুষ হিসাবে, যেগুলো অনেকেই জানে না।

শুভাপ্রসন্নঃ হ্যাঁ অনেক ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে।

ঋতবাকঃ যদি আরও দু-একটা বলেন।

শুভাপ্রসন্নঃ আর উনি যে ধরনের যে সময়ের আমরা, তখন তো পিক এবং তাঁর একটা দিন পেতে গেলে তিন বছর, চার বছর

ঋতবাকঃ অপেক্ষা করতে হতে হতো।

শুভাপ্রসন্নঃ হ্যাঁ, অপেক্ষা করতে হতে হতো। আবার উনি যদি মনে করতেন, কোনও চ্যারিটির জন্যে মানুষের কাজে যাতে লাগে, তাতে উনি অনেককিছু, ওঁর নিজের জগত এসে করে দিতেন।

ঋতবাকঃ নিজের গণ্ডীর বাইরে এসে।

শুভাপ্রসন্নঃ যেমন আমাদেরটা, উনি সময় দিয়েছিলেন। মাত্র ৪-৫ মাসের মধ্যে। আমি তখন আমার সেই আয়োজন করতেই অনেক সময় লেগেছিল।


লেখক পরিচিতি : চিত্রশিল্পী



গৈরিক ভট্টাচার্য্য (বয়স ৮)



আমার চোখে রবিশঙ্কর
জয়রূপ ভট্টাচার্য্য


‘রবি শঙ্কর’ নামের মধ্যে যেন একটা ঝঙ্কার আছে, যার মূর্ছনা বাঙালি সহ সারা বিশ্বের সঙ্গীত প্রেমি মানুষকে একটা সময় আবিষ্ট করে রেখেছিল এক সুরেলা মায়াজালে। তাঁর ব্যক্তিত্ব বা কারিশ্মা যাই বলুন না কেন, তাঁর নাম সবার মনে একটা myth তৈরি করেছিলো। সে যুগে আরও অনেক প্রতিভাবান ও বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রী ছিলেন যাঁরা সবার প্রণম্য তাঁদের নিজ নিজ গুণে। কিন্তু রবি শঙ্কর নামের যে ভারতীয় সঙ্গীতের আইকন, যাঁকে সারা পৃথিবীর সঙ্গীত প্রেমি মানুষ এক নামে চিনতো, সেই আইকন এর পর্যায়ে বাকি আর কজন যেতে পেরেছিলেন সেটা তর্কের বিষয়।

ভারতে তো বটেই, এরকমও শোনা যায় যে বিদেশে রবি শঙ্কর নামের ব্যক্তিত্বকে সামনাসামনি না চিনলেও তাঁর নাম, ট্যাক্সি চালক থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ অনেকেরই জানা ছিল। একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা বা বিখ্যাত ক্রীড়াবিদের মত তাঁকে চাক্ষুষ করার জন্য বিদেশে ছোট থেকে বড় অনেকেই প্রেক্ষাগৃহ বা হোটেলের বাইরে ভিড় জমাতেন বা সারা রাত অপেক্ষা করে বসে থাকতেন। এটা যেকোনো শিল্পীর পক্ষে কোনো বিশেষ পুরস্কারের চেয়ে কম পাওনা নয়।

আমার নিজের, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয়ও কিন্তু সেই রবি শঙ্কর এর cassette শুনেই। সেটা ১৯৮৮ সাল হবে। সেবার স্কুলের শীতের ছুটিতে মামারবাড়ি থাকতে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্যে। তাঁর ‘West Meets East’ সঙ্কলনটির তিনটি অ্যালবাম আমার ছোটমামার সংগ্রহ থেকে প্রথম শোনা সেইবারেই। রবি শঙ্কর তাঁর সেতারের সঙ্গে বেহালায় ইহুদি মেহেনুইন, বাঁশিতে জঁপিয়েরে রাম্পাল, ও তবলায় আল্লারাখার সঙ্গে এক অনবদ্য সুরের জাল বুনেছিলেন। এগুলো কিন্তু কোনটাই fusion সঙ্গীত ছিল না। বরং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারে যুগলবন্দী বলাটাই ঠিক হবে।

সেই সময় রাগ সঙ্গীত সম্পর্কে আমার তেমন কোন পরিচিতি ছিল না। তা সত্ত্বেও গুনকেলি, পুরিয়া কল্যাণ, পিলু, আনন্দ ভৈরব, তিলাং, নট-ভৈরব, এবং বাকি track গুলো প্রথমবার শোনার পর আবারো শোনার লোভ সামলাতে না পেরে মামাকে অনুরোধ করে cassette গুলো বাড়ি নিয়ে আসি। তারপর সেগুলো বহুবার শোনার পর একদিন গোলপার্ক এর মেলোডি দোকানটি থেকে রবি শঙ্কর আর জুবিন মেহেতার ‘রাগ মালা’ অ্যালবামটি কিনে নিয়ে এলাম। এটিতে জুবিন মেহেতার কন্ডাক্ট করা অর্কেস্ট্রার সঙ্গে রবি শঙ্কর সেতারে বিভিন্ন রাগের ওপর ভিত্তি করে সুর বাজিয়েছেন। সেই অর্থে এটিকে fusion সঙ্গীত বলা যেতে পারে।

সেই আমার প্রথম কেনা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে রচিত কোন অ্যালবাম। অ্যালবামটি শুরু হয়েছে রাগ ললিত দিয়ে। ভোরের আলো ফোটার সময়ের এক স্বর্গীয় আমেজ ধরা হয়েছে এই অংশটিতে। সেতারের খরজের তারের সুরের কাজ আর তার সঙ্গে চার্চের ঘণ্টার আওয়াজ আর হার্পের সুর একাকার হয়ে সকালের এক গম্ভীর অথচ শান্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

এর পরের track বৈরাগীর ওপর নির্ভর করে রচিত। এই রাগটি পণ্ডিতজির নিজের তৈরি, আর রাগের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখানে যেন জগৎ সংসার ছেড়ে এক পরম প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে যাত্রার বর্ণনা করা হয়েছে সঙ্গীতের মাধ্যমে। কিছুটা এগোবার পর সংসারের মায়া যেন আবার পেছন পানে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। থমকে দাঁড়িয়ে, কিছুটা ভেবে আবার এগোনো। শেষে মনের সব উচাটন দূরে সরিয়ে রেখে আবার দৃঢ়তার সঙ্গে যাত্রা করা সেই অজানার উদ্দেশ্যে।

অপর পিঠের দুটি অর্কেস্ট্রা রাগ ইমন কল্যাণ আর মিয়াঁ মল্লারের ওপর রচিত। মিয়াঁ মল্লার track টিতে পাশ্চাত্য ড্রামের মাধ্যমে বর্ষার মেঘের গুরু গম্ভীর ডাকের সঙ্গে ভায়োলিনে জলের স্রোত আর সেতারে বৃষ্টির ফোঁটার চঞ্চল প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস, শ্রোতাকে যেন এক সিক্ত অনুভূতির কল্পনা জগতে অনায়াসে নিয়ে যায়।

‘রাগমালা’ নামের সার্থকতা বজায় রেখে এই প্রধান চার রাগের সঙ্গে আরো বিভিন্ন রাগ (যেমন কেদার, খাম্বাজ, বেহাগ, দেশ, সারাং, কানহাড়া ইত্যাদি) মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে গেছে প্রধান রাগের চলনের ভিতর।

গড়িয়াহাটের Bambino থেকে সদ্য কেনা Sony র মিউজিক সিস্টেমের ‘surround sound’ সমেত ১০০০ ওয়াট স্পিকারে সেই অর্কেস্ট্রা শোনা ছিল এক স্বর্গীয় অনুভূতি। মাথা আর মন কেমন যেন বুঁদ হয়ে ছিল অ্যালবাম শেষ হবার বেশ কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত।

এই একই genre এর তাঁর এন্ড্রু প্রেভিনের লন্ডন ফিলার্মনিক অর্কেস্ট্রার সঙ্গে যে সেতার কন্সার্টো-১ অ্যালবামটি আছে, সেটির কথা বলাটাও প্রাসঙ্গিক হবে। এই অ্যালবামটিও, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে ততটা ওয়াকিবহাল নয়, সেরকম কোনো ব্যক্তিকেও মুগ্ধ করতে বাধ্য। রাগ আড়ানার ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রথম track টি শুনলে এক কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন ও তাণ্ডব, কল্পনার চোখে মূর্ত হয়ে ওঠে। এছাড়াও রাগ খাম্বাজ, সিন্ধি ভৈরবী, ও মাঝ খাম্বাজের ওপর বাকি তিনটি track fusion সঙ্গীতের এক অপূর্ব নমুনা।

রবি শঙ্করকে সামনা সামনি দেখার সুযোগ হয় ১৯৯১ সালের ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সের শেষ দিনে। তারিখটা ছিল ২৫শে জানুয়ারী। আমার সেদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমেস্টর পরীক্ষার শেষ দিন। সারাদিন পরীক্ষা দিয়ে প্রবল উত্তেজনার সঙ্গে সন্ধ্যাবেলা হাজির হলাম বিবেকানন্দ পার্কে। হাতে, গড়িয়াহাটের Stylo থেকে তার কদিন আগে কেনা ২৫ টাকার নীলচে রঙের সিজন টিকিট। সেবারই শেষ বারের মতন বিবেকানন্দ পার্কে আয়োজিত হয়েছিলো ওই কনফারেন্স। শেষ দিনের শেষ শিল্পী পণ্ডিত রবি শঙ্কর। সেই রাতের অনুষ্ঠানে তাঁর আগের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বিদূষী গিরিজা দেবী ও পণ্ডিত ভীমসেন যোশী।

ভীমসেন যোশীর এক মুগ্ধ করা দরবারি কানাড়া, বসন্ত, আর যোগিয়ার পর প্রবল করতালির মধ্যে মঞ্চে উঠলেন পণ্ডিত রবি শঙ্কর আর ওস্তাদ জাকির হোসেন। শামিয়ানার প্রায় শেষ প্রান্তে আমার ২৫ টাকা মূল্যের আসনটি ছেড়ে আমি গুটি গুটি পায়ে কিছুটা সামনে আসার চেষ্টা করলাম, আরও স্পষ্ট ভাবে সেই স্বপ্নের মানুষটিকে জীবনে প্রথমবার চাক্ষুষ করার জন্য।

অনুষ্ঠান শুরু হল রাগ পরমেশ্বরী দিয়ে। তার আগের দিনের পরীক্ষার আর রাত জাগার ক্লান্তি যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। চোখ আর কান – দুই দিয়েই তখন আমি যেন আস্বাদন করছি সেই সুরেলা মুহূর্তগুলো। দোলা দিয়ে যাওয়া আলাপ আর জোড়ের পর চার-তাল-কি-সাওয়ারি তালের ওপর গৎ। দ্বিতীয় পরিবেশন ছিল আশা

নামের রাজস্থানি লোকসঙ্গীতের সঙ্গে ভৈরবের সংমিশ্রণে তৈরি রাগ আশা ভৈরব, যার চলন উনি ওনার গুরু আচার্য আলাউদ্দিন খানের কাছে শিখেছিলেন। তিন তালে বিলম্বিত গতের পর একতালে দ্রুত গৎ ও ঝালা।

অনুষ্ঠানের সর্বশেষ নিবেদন ছিল রাগ মিশ্র ভৈরবী। শুরু আদ্ধা তাল এর গৎ দিয়ে এবং শেষ যখন হল তিন তালের দ্রুত গৎ আর ঝালা দিয়ে, তখন সেই শীতের সকালে ভোরের আলো ফুটে গেছে আর তার সঙ্গে পাখির কলতান। দীর্ঘ করতালির মধ্যে বাজনা শেষে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে সবাইকে নমস্কার করার পর প্রায় পাঁজাকোলা করে পণ্ডিতজিকে মঞ্চের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।

রবি শঙ্করকে প্রথম শোনার পর ঘোরের মধ্যে বিবেকানন্দ পার্কের প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্র সরোবরের পাশের রাস্তা ধরে লেক গার্ডেনসে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম আশা ভৈরব গুনগুন করতে করতে। বাড়ি ফিরে এক ঘুম দিয়ে দুপুরে ঘুম থেকে উঠেছি, তখনো দেখছি মাথার মধ্যে ঘুরছে সেই আশা ভৈরব !

এর মধ্যে একটা কথা বলা হয়নি। একটু পিছিয়ে যাই ১৯৮৯ সালে। স্কুলে ১২ ক্লাসের শেষে আমরা নিজেদের উৎসাহে স্কুলের প্রেক্ষাগৃহে এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। তাতে গান, নাচ, নাটক ও সেতার পরিবেশন করেছিলো আমাদেরই বিভিন্ন বন্ধু বান্ধব। আমি নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আর সেতার বাজিয়েছিল আমার বন্ধু জ্যোতির্ময় (বর্তমানে সে একজন বড় ডাক্তার আর তার সেতার শিক্ষা, ওস্তাদ দাবির খানের শিষ্যা শ্রীমতী মায়া মিত্রের কাছে)। সেই প্রথম আমার সামনাসামনি কাউকে সেতার বাজাতে শোনা। তার আগে আমার সেই ‘West Meets East’ এর অ্যালবাম গুলো শোনার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। কাজেই এই সেতার শোনা আমার কাছে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এতটাই অভিভূত হয়েছিলাম যে দুএকদিনের মধ্যে ওর বাড়ি গিয়ে ওর কাছ থেকে আরো কিছু বাজনা শুনলাম ও সেতারের ব্যাপারে খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করলাম।

এর বেশ কিছুদিন পর, আবারো সেই মামারবাড়িতে গিয়ে একদিন প্রায় কাকতালীয় ভাবেই আবিষ্কার করলাম একটি পুরনো দিনের সেতার, যেটা আমার দাদামশায়ের গানবাজনার একটি ক্লাব ছিল, তাতে কেউ বাজাত। লোভ সামলাতে না পেরে পত্রপাঠ সেটিকে বাড়ি নিয়ে এসে আমাদের নিকটবর্তী বাজারে একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকানে সারাতে দিলাম। আর স্বভাবতই, এর পরের পদক্ষেপ হল আমার সেই বন্ধুর কাছে সেতারটিকে নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে সেতারের কিছু প্রাথমিক তালিম নেওয়া!

এই পুরনো ঘটনাটা বললাম কারণ সেইদিন ডোভারলেন থেকে ফিরে, সেতার বাজানো নিয়ে আমার অত্যন্ত সীমিত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, কী করে জানি না আমি সেই আশা ভৈরবে শোনা একতালের গৎটি মনে মনে গুনগুন করতে করতে সেতারটিতে বাজাবার চেষ্টা করলাম, ও অল্প কিছুক্ষণের কসরতের পর সক্ষমও হলাম। এই হল আমার ওপর রবি শঙ্করের প্রথম প্রভাব!

এরপর থেকে কলকাতার বিভিন্ন সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে যাওয়া শুরু করলাম। কোনোটা সারাদিন ব্যাপী, তো আবার কোনোটা বিকেল থেকে পরের দিন ভোরবেলা পর্যন্ত। এর মধ্যে রবি শঙ্করকেও একাধিকবার শোনার সুযোগ হয়েছে। তাঁর শেষ কলকাতাতে বাজানো কনসার্টটিরও সাক্ষী ছিলাম। জলসাঘর সংস্থা আয়োজিত কনসার্টটি হয়েছিল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ২০০৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি। স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। তবলাতে ছিলেন তন্ময় বোস। সেতারে সঙ্গত করেছিল অনুষ্কা শঙ্কর। প্রথম রাগ হামির কল্যাণ। প্রথাগত আলাপ, জোড়, ঝালা বাজিয়ে তারপর গৎ। তারপর বিভিন্ন রাগ বাজিয়ে শোনানোর সঙ্গে, জর্জ হ্যারিসনকে শেখানো, রাগ জনসন্মোহিনিতে তাঁর রচিত একটি বাংলা গান ‘কত ভাল লাগে তোমারি নয়ন’, সেটি বাজনার সঙ্গে তার সুরেলা মিহি গলায় গেয়ে শোনালেন। সেদিনের শেষ রাগ ছিল রঙ্গিলা পিলু। পিলুতে একের পর এক গৎ বাজাতে বাজাতে লয় বাড়তে থাকল। সওয়াল-জবাব ও ঝালার শেষ পর্বে লয় যেখানে গিয়ে পৌঁছল সেটা না শুনলে বিশ্বাস করা মুশকিল যে এক অশীতিপর বৃদ্ধের হাতে সেটা শোনা যাচ্ছে।

অনুষ্ঠান যখন সমাপ্ত হল, তখন প্রায় তিন ঘন্টা ছুঁই ছুঁই। একজন ৮৯ বছরের বৃদ্ধ যে অতক্ষণ একটানা বসে থেকে বাজাবেন সেটা প্রায় কেউই ভাবতে পারেননি। মাঝে একটা বিরতি হয়েছিল বটে, কিন্তু পণ্ডিতজি ঠায় বসে ছিলেন মঞ্চে। পুরো অনুষ্ঠান পর্বে একবারের জন্যেও ওঠেননি মঞ্চ ছেড়ে। ওই বয়সে কতটা অধ্যবসায় থাকলে এটা সম্ভব সেটা ভাববার বিষয়।

আমার কাছে দুটি জিনিষ আছে যে দুটিকে আমি রবি শঙ্করের memento বা আশীর্বাদী বলতে পারি। প্রথমটি হল রবি শঙ্করের সেতারের একটি কান (tuning peg)। এটি আমার সংগ্রহে আসার ইতিহাসটি হল এইরকম।

আমার বড় মামার বাল্যবন্ধু শ্রী নৃপেন পাল ছিলেন পূর্বে বলা জলসাঘর সংস্থার কর্ণধার শ্রী রবিন পালের নিজের দাদা। সেই সুত্রে রবি শঙ্কর ওনার বাড়িতে এসেওছেন। এই নৃপেন পাল বা নেপি মামা, আমাকে কেন জানি না খুব স্নেহ করতেন। সেই কারণে ওনার নিজস্ব সংগ্রহে থাকা বেশ কিছু দুর্মূল্য লাইভ রেকর্ডিং আমাকে উনি কপি করে নিতে দিয়েছিলেন। ওনার কাছেই আমার প্রথম শোনা মার্বেল প্যালেসে ১৯৮৪ সালে রবি শঙ্করের বাজানো এক ঘন্টার দরবারি কানহাড়ার রেকর্ডিং। এরকম আরো অনেক রেকর্ডিংই ওনার কাছে আমার প্রথম শোনা, যেগুলো আজকাল YouTube এর দৌলতে খুব সহজেই শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেইসময়, মানে নব্বই এর দশকে সেগুলো একেবারেই সহজলভ্য ছিল না।

এই নেপি মামার শাঁখারিটোলার বাড়ির শোবার ঘরে একদিন গল্প করতে ঢুকে আমি আবিষ্কার করলাম যে জামাকাপড় বা বইএর আলমারির পাল্লা খোলার একেকটা knob সেতারের কান দিয়ে তৈরি। এর কারণ জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে একবার রবি শঙ্কর ওনার সেতারটি নেপি মামার মারফত শ্রী নোদু মল্লিকের কাছে পাঠিয়েছিলেন কিছু মেরামতের জন্যে। প্রসঙ্গত, কলকাতাতে অবস্থিত এই নোদু মল্লিকই (পুরো নাম নদের চাঁদ মল্লিক) এক সময় রবি শঙ্করের সেতার দেখভাল করতেন। সেইবার মেরামতি বাবদ ওনার সেতারের সব কানগুলোকে পাল্টাতে হয়েছিল। আর ফেলে দেওয়া পুরনো সেই কানগুলোকেই নেপি মামা নিয়ে এসে দরজার পাল্লায় লাগিয়েছিলেন। আরো জিজ্ঞাসা করায় জানলাম যে তখনো দু একটা পুরনো কান অক্ষত অবস্থায় অবশিষ্ট আছে ওনার কাছে। অল্প পীড়াপীড়িতেই তার মধ্যে একটি কান (যেটি সম্ভবত চিকারির তার লাগাতে ব্যবহৃত হতো) আমাকে দিতে উনি রাজি হন। আমার সংগ্রহে এখন পরম সম্পদ হিসেবে আছে রবি শঙ্করের সেতারের ওই কানটি। ভেবে রোমাঞ্চ লাগে যে সেতারের ওই কানে রবি শঙ্করের হাতের স্পর্শ লেগে আছে এখনো।

দ্বিতীয় জিনিসটি হল ওনার অটোগ্রাফ। একবার বইমেলা থেকে ওনার ইংরেজি আত্মজীবনী ‘Ragamala’ কেনার কিছুদিন পর সংবাদ মাধ্যমে খবর পেলাম যে উনি একটি অনুষ্ঠানের জন্যে কলকাতাতে এসেছেন এবং হায়াত রিজেন্সি হোটেলে উঠেছেন। আর দেরি না করে সারা সন্ধ্যে বসে ওনার একটা পোর্টরেট এঁকে পরদিন সকাল বেলা একটি ফুলের বুকে আর ওই পোর্টরেটটি সঙ্গে করে নিয়ে পৌঁছলাম বাইপাসের ধারে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে। বুকের মধ্যে তখন ধুকপুক ধুকপুক করছে এক অজানা ভয়। অনেক সাহস সঞ্চয় করে হোটেলের রিসেপ্শানে গিয়ে বললাম যে আমি পণ্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গে দেখা করে ওনাকে ওই ছবি আর ফুলের বুকেটি দিতে চাই আর ওই বইটিতে ওনার সই নিতে চাই। হোটেলের কর্মী ওনার ঘরে ফোন করে জানালো যে উনি তখন দেখা করতে পারবেন না, তবে বইটি পাঠিয়ে দিলে তাতে সই করে দিতে পারবেন। অগত্যা তাই করলাম। আমার আঁকা ছবি, ফুলের বুকে, আর Ragamala বইটি হোটেলের লোকের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। সঙ্গে একটা চিরকুটে আমার নামটি লিখে দিলাম। কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর পণ্ডিতজির সই সমেত বইটি ফেরত এল আমার কাছে। নিজে হাতে আমার নামটি লিখে শুভেচ্ছা সহ তার তলাতে উনি সই করেছেন। অতি যত্নসহকারে সেই অমূল্য বইটি এখন আমার বইয়ের আলমারিতে রাখা আছে।

রবি শঙ্করের বাজনার গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে যে বিশেষ জায়গাগুলোর জন্যে আমার নিজের ওনার বাজনা ভাল লাগে সেগুলো বলতে পারি। প্রথমত ওনার বাজানো কোন রাগের আলাপ আর জোড়ের অংশগুলো আমার খুব প্রিয়। এতে ধ্রুপদ অঙ্গের ওপর ভিত্তি করে ওনার নিজস্ব যে বাদন শৈলী সেটার সাহায্যে উনি একটি রাগকে ধাপে ধাপে মন্দ্র থেকে তার সপ্তক অবধি যে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, যন্ত্রসঙ্গীতে আর কেউ ততোটা করতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। আর একটা জিনিস হল ওনার লয়কারি আর ছন্দের কাজ। এটাও আমার কাছে অনবদ্য লাগে।

শতবর্ষে এসে রবি শঙ্করকে আবার যেন নতুন করে চিনছি তাঁর প্রথম দিকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজানো রেকর্ডিং শুনে, যা সাম্প্রতিক কালে কিছু মানুষ YouTube এ আপলোড করেছেন তাদের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে। কম বয়সের সেইসব বাজনায় তাঁর ডান হাতের দাপটের সঙ্গে বাঁ হাতের সুরের কাজের এক অনন্য মিলন ঘটেছে। এ যেন রবি শঙ্করকে আবার নতুন করে শোনার এক অনুভূতি, যা এই শতবর্ষে এক অমূল্য প্রাপ্তি।

লেখক পরিচিতি : শিক্ষক, লেখক ও শিল্প-গবেষক



পণ্ডিতজী
তন্ময় বোস


ঋতবাকঃ রবিশঙ্করের সঙ্গে তোমার আলাপ কত বছর বয়সে?

তন্ময় বোসঃ আমি ওনাকে প্রথম কাছ থেকে দেখলাম ৮৩ সালে। যখন ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সের কম্পিটিশন হলো, নিখিল ব্যানার্জীর সম্মানে, ওনার নামে। তো আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম তবলায়। ঐ একটাই কম্পিটিশনে আমি দিয়েছিলাম জীবনে। সেটা রবিশঙ্কর নিজে প্রাইজ দিয়েছিলেন। সেটাই আমি প্রথম ওনাকে সামনাসামনি দেখলাম। তার আগে আমি বহু অনুষ্ঠানে গিয়েছি যেখানে আমার গুরুরা ওনার সঙ্গে বাজিয়েছেন। আমার প্রথম গুরু পণ্ডিত কানাই দত্ত। আমার যখন সাত বছর বয়স, তখন যখন কানাই দত্তের কাছে যেতাম আমার বাবার সঙ্গে, তবলা শিখতে, গুরুজীর বাড়িতে দেখতাম ওনার সব ছবি রবিশঙ্করজীর সঙ্গে। উনি প্রথম বাঙালি তবলিয়া যিনি আমেরিকা গিয়েছিলেন ৬০ সালে প্রফেশনালি। তখন থেকে ছবিতে দেখি আর তারপরে আমার গুরুজী পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ। ওনার সঙ্গে বাজনা শুনেছি সাদারাং-এ। তো আল্লারাখা খাঁ সাহেবের সঙ্গে সিংহীপার্কে। তারপরে রবীন্দ্রসদনে জাকিরজি, আল্লারাখা খাঁ সাহেব, রবিশঙ্কর- আলি আকবর ডুয়েট- এইসব সব তো শুনেই ছিলাম। কিন্তু সামনাসামনি আমি ওনাকে দেখতে পেলাম পুরস্কার প্রদান অনুশ্তহানে। এবংতারপরে দীপকদা আমাদের অত্যন্ত প্রিয় দাদা। গুরুর মতন ছিলেন। দীপকদার বাড়ি যেতাম। দীপকদা আমাদের রেওয়াজ করাতেন।

ঋতবাকঃ দীপক চৌধুরী?

তন্ময় বোসঃ হ্যাঁ, দীপক চৌধুরী। এবং দীপকদাই আমাদের রেওয়াজ করাতেন। আমি, বিক্রম আমরা সবাই যেতাম। এবং দীপকদার সঙ্গেই আমি লালা শ্রীধরজীর বাড়িতে পণ্ডিতজীর কাছে প্রথম গিয়েছিলাম। অথচ আমি যখন এদেশে বাজাচ্ছি,উনি তখন তো আমেরিকায় থাকতেন। ওনার অনেক ছাত্ররা ওনার লুধি এস্টেটের বাড়িতে থাকতেন। ওখানে থেকে রেওয়াজ করতেন। পার্থসারথি, শুভেন্দ্রা। তো এরা সবাই থাকতো।আর আমি দিল্লী যখনই যেতাম, ওনার বাড়িতে যেতাম। রেওয়াজ করতাম ওনার ছাত্রদের সঙ্গে। আমি তখন টুকটাক বাজাচ্ছি।

ঋতবাকঃ তারপরে তুমি কবে থেকে সঙ্গত করতে আরম্ভ করলে?

তন্ময় বোসঃ ১৯৯৭-এ। তার মাঝখানে ৯৩ সালে আমি আর তেজেন্দ্র নারায়ণ আমেরিকা ট্যুর করছিলাম। তো স্যান ডিয়াগোতে উনি বলে পাঠালেন পুণ্য পাট্টানায়েকজির মাধ্যমে। ওনার বাড়ির সঙ্গে কাছেই থাকতেন পণ্ডিতজীর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। উনি খবর দিলেন যে তেজেন্দ্র আর তন্ময়কে পণ্ডিতজী বাড়িতে ডেকেছেন। তো আমরা গেলাম স্যান ডিয়াগোতে বাজাতে গেলাম যখন, বাজাতে গেলাম পণ্ডিতজির বাড়িতে তো তখন শ্রোতা ছোট্ট অনুষ্কা, চিনাম্মা আর পণ্ডিতজী। আর কেউ নয়। তো আমি আর তেজেন প্রায় তিন ঘণ্টা বাজালাম।

ঋতবাকঃ ও তেজেন্দ্রও তাই বলেছেন।

তন্ময় বোসঃ আমি আর তেজেন তিন ঘণ্টা বাজালাম। তো সেইটা আমি সামনাসামনি ওনাকে বাজনা শোনালাম। তার পরে পরেই...

ঋতবাকঃ সেটা কি এমনিই ডেকে পাঠিয়েছেন? তখন তোকে…

তন্ময় বোসঃ বাজনা শুনবে বলে।

ঋতবাকঃ ভালো করে চেনেনও না?

তন্ময় বোসঃ না, চেনেন মানে।আমি ওনার সব ছাত্রদের সঙ্গে তো বাজাতাম। এঁরা তো খবর রাখেন। কে কোথায় বাজায়? উনি খুব খবর রাখতেন। ইয়াংরা কারা ভালো বাজাচ্ছেন। উনি তেজেন্দ্রকে আর আমাকে ডেকে পাঠালেন। তা আমরা বাজালাম। সেটাই প্রথমে আমি ওনাকে কাছ থেকে দেখলাম।

ঋতবাকঃ মানে Interaction বলতে যেটা বোঝায়।

তন্ময় বোসঃ হ্যাঁ তারপরে অনেকক্ষণ তো ছিলাম রাত্তিরে। খেলাম । ঐ প্রথম closely ওনার কাছে আরকি থাকতে পারলাম বেশ কিছুক্ষণ। ৯৩ তে

ঋতবাকঃ তারপরে তোমার জার্নিটা ওনার সঙ্গে একটু বলো?

তন্ময় বোসঃ তারপরে হলো কি, তারপরে আবার আমি ইউনিভার্সিটি অফ পিটস্‌বার্গে ড. দীক্সিত ছিলেন। উনি একটা ট্যুর করতেন সমস্ত ইউনিভার্সিটির। সার্কিট আমেরিকান ইউনিভার্সিটি। তো আমি, শুভেন্দ্র রাও আর পার্থসারথি। আমরা তিনজন ঐ ইউনিভার্সিটি অফ পিটস্‌বার্গের জন্য ১৯৯৫-এ আবার আমেরিকায় ট্যুর করছিলাম। আবার সেইবারে পণ্ডিতজীর বাড়িতে ওনারা দুজনেই পণ্ডিতজীর ছাত্র। আবার স্যান ডিয়াগোতে গিয়ে আমরা বাজালাম। তো তারপরে আমি বার্লিনে ছিলাম। বার্লিনে তখন আমার স্কুল ছিল। আমি শেখাতে যেতাম। বাজাতেও যাতাম। আমার ব্যাণ্ডও ছিল। আন্দ্রেয়াসদের নিয়ে।

ঋতবাকঃ মাধুরীদির…

তন্ময় বোসঃ মাধুরীদির বাড়িতে আমি থাকতাম সবসময়। তো মাধুরীদির বাড়ি গৌরব রাত্রির বেলা ১১টা তখন বার্লিন টাইম। ফোন করে বললেন যে গুরুজি তন্ময়কে খুঁজছে।

ঋতবাকঃ না আমার এটা মনে আছে। তাও তুমি বলো?

তন্ময় বোসঃ ৯৭-এ, তখন সেটা অগস্ট মাস। বললেন গুরুজী তন্ময়কে খুঁজছেন। তন্ময়কে ফোন করতে হবে স্যান ডিয়াগোতে। তা আমি বার্লিন থেকে ফোন করলাম । তো উনি তখন বললেন যে …

ঋতবাকঃ ওখান থেকে বোধ হয় চলে যেতে বলেছিল।

তন্ময় বোসঃ আমি যখন দিল্লীতে বাজাবো, তুমি এসো। দিল্লীতে। তারপর মজার ঘটনা যেটা ঘটেছিল সেটা হচ্ছে এক সরস্বতী পুজোয়। সরস্বতী পুজো বা কোন একটা পুজো ছিল আমাদের বাড়িতে। তখন তো ল্যান্ড লাইন। উনি ফোন করেছেন। তখন আমার মা ধরেছিল। তখন তো এবাড়িতে আমরা। মা ভেবেছে কেউ আমার বন্ধুরা আমার সাথে মজা করছে। বলেছেন উনি,“আমি রবিশঙ্কর বলছি ক্যালিফোর্নিয়া থেকে”। তো মা ভেবেছে কেউ মজা করছে। তো মা ফোনটা রেখে দিয়েছে। আবার যখন ফোন করেছেন, তখন মা আমায় বলছেন, “দেখো কেউ একটা ফোন করছেন” । আমি যখন ফোন ধরেছি, তখন বলছেন তন্ময় আছে? আমি রবিশঙ্কর বলছি ক্যলিফোর্নিয়া থেকে। আমি তো ভীষন নার্ভাস হয়ে গেছি। নার্ভাস হয়ে গিয়ে বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ প্রণাম নেবেন, বলুন। বলছেন তুমি কি আমার সাথে বাজাবে?আপনি এটা কী বলছেন? আমার গুরুদেব শুনেছি আপনার সঙ্গে বাজাতে, ছোট থেকে আপনার বাজনা শুনে, যারাই গান-বাজনা করেছে রবিশঙ্কর মানে হচ্ছে লাস্ট রিসর্ট অফ ইণ্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিক। ওর পরে আর কিছু নেই। আমি বললাম আপনি আমায় এরকম কথা বলছেন? ঊনি বললেন, “ঠিক আছে, দিল্লীতে আমি আসছি তুমি দিল্লীতে এসো”। তা আমি তারপরে দিল্লীতে গেলাম। গৌড় প্রাঙ্গনে ১৯৯৭ এ। উনি দেশিকোত্তম পেলেন বিশ্বভারতী থেকে। ঐ গৌর প্রাঙ্গনে আমি প্রথম ওনার সঙ্গে বাজালাম। বাজানোর পরে আবার সাইন্স সিটিতে বাজালাম। বাজানোর পর উনি আমাকে বললেন তুমি আমার সঙ্গে আমেরিকা চলো। ৯৮ থেকে আমি ওনার সঙ্গে পার্মানেন্টলি বাজাতে শুরু করলাম।

তারপরে, তারপর আমার তো আর ব্রেক হয়নি।

ঋতবাকঃ না

তন্ময় বোসঃ তারপরে লাস্ট কনসার্ট পর্যন্ত। আমি প্রায় সারা পৃথিবীতে সমস্ত কনসার্টেই বাজিয়েছি। একটা দুটো ছাড়া । এই।

ঋতবাকঃ এমনকি তুমি অনুষ্কার সঙ্গেও বাজিয়েছো?

তন্ময় বোসঃ অনুষ্কার তো বাজিয়েইছি। অনুষ্কার তো ওর প্রথম কনসার্ট থেকেই আমি বাজিয়েছি। ও ছোট ছিল তখন।

ঋতবাকঃ এবারে তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করব। এই যে তোমার সামনে একটা বিশ্বের দরজা খুলে গেল ওনার জন্য এবং উনি, এটা তো সত্যি মানবে যে ইয়ং জেনারেশনকে ভীষণভাবে সাপোর্ট করতেন। তো এই ব্যাপারে তোমার অনুভূতি? সেটা আমি জানতে চাইছি।

তন্ময় বোসঃ পণ্ডিতজি আমার দুটো কথা, আমার নিজের জীবনে যেটা মনে হয়েছে। আমার… আমি তার অনেক আগে থেকে বিলেত ঘুরি। খুব অল্প বয়স থেকে ১৯৮৬ এ প্রথম ওস্তাদ মুনাবার আলি খাঁ সাহেবের সঙ্গে আমি ট্যুর করা শুরু করি। তারপর যোগ সাহেবের সঙ্গে অগুনতি ট্যুর করেছি ইউরোপে।তারপরে ওস্তাদ আমজাদ আলি খান সাহেব আমার আর এক গুরু প্রতীম প্লাস আমার বন্ধুরা, রসিদ, তেজেন্দ্র বিশেষ করে সুজাত। আমি রেগুলার আমিই বাজাতাম তখন ওদের সাথে। তবে হ্যাঁ পণ্ডিতজির সঙ্গে ওনার চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখাটা একটা অন্য গল্প অলটুগেদার। কারণ বেস্ট অফ অডিটরিয়ামস, বেস্ট হোটেল, শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখতে পাওয়া। এটা ডেফিনেটলি পণ্ডিতজির সঙ্গে ছাড়া, এটা আর কোনো ভাবে সম্ভব হত না। এবং এটাও ঠিক যে ওনার যে ভাব মূর্তিটা আমাদের ওপর উনি ইনফ্লুয়েন্স করেছিলেন সেটা হচ্ছে, সবকিছু শুনতে হবে। সবকিছু দেখতে হবে এবং শেখবার চেষ্টা করতে হবে। আমি তার আগেও হীরেন রায়ের ছেলে অমিতদা অর্থাৎ বাচ্চু রায়, বাচ্চুদা। বাচ্চুদার সঙ্গে তাহলে জাপানে যেতাম না। জাপানী শেখাতাম না।আমার অনেক জাপানীজ ছাত্র অলরেডি ছিল। পণ্ডিতজীর সঙ্গে যখন গেলাম রেডিও সিটি হলে টোকিওতে, তার আগের দিন রাত্তিরে ওনার ছাত্র কেনজিকে উনি আমায় বললেন যে, যে তুমি...

ঋতবাকঃ কি নাম কেনজি?

তন্ময় বোসঃ কেনজিওটা। লস্‌ অ্যাঞ্জেলসে থাকে। আমাকে বললেন, “ তুমি চপস্টিকে খেতে জানো তো?” তখন আমি বললাম, জানি খুব একটা সড়গড় না। তখন উনি বললেন যে এটা ঠিক কথা তো না। তুমি যে দেশে আসছ, সে দেশে আমাদের ভাত যদি কেউ চপস্টিক দিয়ে খায় বা মাছ যদি কেউ কাটা দিয়ে খায় আমাদের যেরকম বিরক্ত লাগে! তুমি জাপানে এসে যদি কাটা দিয়ে সুসি খাও বা সাসেনি খাও সেটা ওদের বিরক্ত লাগবে। আজ সারা রাত্রি প্র্যাক্টিস করবে কালকে আমরা লাঞ্চ খাব, তুমি চপস্টিক দিয়ে খাবে।

তো সারারাত্রির প্রায় দুটো আড়াইটে পর্যন্ত, কেনজি তো জাপানীজ। ও আমাকে শেখাল চপস্টিক আরও ভালো করে কিভাবে ধরতে হয়। তো এটা ছিল পণ্ডিতজী।

ঋতবাকঃ পারফেকসনিস্ট।

তন্ময় বোসঃ পারফেকসনিস্ট আর এক্সপোজ করা ছেলেদের। আমি যেহেতু গান গাই, উনি আমায় ডারটিনঙটন কলেজ বিখ্যাত কলেজ ইংল্যাণ্ডের, ওখানে ওনার লেকচার ডেমনস্ট্রেশন, তারপর অর্কেস্ট্রা। উনি আমাকে দিয়ে গান গাওয়ালেন ওনার কম্পোজিশনে।

বারবিকান সেন্টারে সে তো ইউটিউবেও আছে। রবি ঠাকুরের দেড়শো বছর সেদিন দুজনে উনি গাইবেন। আমি গাইলাম প্রথমে। উনি গাইলেন এবং বাজালেন আমার সাথে। আমি গান গাইছি আরকি। আর বাঁয়াতে ঠেকা দিচ্ছিলাম। তো আমাকে দিয়ে বোল পড়ানো, আমি যেহেতু বোল পড়তাম ভালো। উনি বোল পছন্দ করতেন। তো এই সবাইকে খুঁজে বার করা। কার মধ্যে কোনটা ভালো আছে এবং সেটাকে এগিয়ে দেওয়া।

That was Rabi Shankar ji. এবং আমার এটাও মনে হয়েছে উনি প্রত্যেক মানুষের কাছাকাছি থাকলে পাশাপাশি থাকলে, আমাদের উপকার হবে। আমাদের বাবা-মার অনেক ভুল চোখে পড়ে। পড়ে তো?

ঋতবাকঃ হুম হুম একশোবার।

তন্ময় বোসঃ আমার নিজের উপলব্ধি রবিশঙ্করের চোখ দিয়ে যে পৃথিবী দেখেছি, অন্য কোন ভারতীয় শিল্পীর আরও হয়তো দুশো বছর লাগবে। আবার একজন ওরকম আসতে যে প্রত্যেক কোনায় রবিশঙ্করের মতন আল ছড়িয়ে দেবেন। লোকে পাগল হয়ে যাচ্ছে ওনাকে দেখে।

কিন্তু আমি অনেকের কাছে শুনি। পণ্ডিতিজীর সঙ্গে থাকা লোক যারা। তাদের অনেক বক্তব্য আছে পণ্ডিতজীকে নিয়ে। তারা মনে হয় পণ্ডিতজীকে হয়তো ভালোভাবে বুঝতেই পারেনি। সেইজন্যই তাদের এতো বক্তব্য।

কিন্তু ওভার অল রবিশঙ্করজী এবং সুকন্যাজী সম্বন্ধে কত লোক কত কথা বলেন আমিও শুনি। কিন্তু আমি তো বাড়িতে থেকেছি অতগুলো বছর । I know, how much she did for him?

ঋতবাকঃ অফকোর্স...

তন্ময় বোসঃ এতো সেবা করেছেন। এতো সাহায্যও করেছেন।

ঋতবাকঃ সেটা কিন্তু তেজন্দ্রও বলেছেন। যে উনি ছাড়া ওনার হত না। এই জিনিস ।

তন্ময় বোসঃ এতো সাহায্য করেছেন শারিরীকভাবে।

ঋতবাকঃ ডেডিকেশন

তন্ময় বোসঃ মানসিকভাবে। সেবা করেছেন পণ্ডিতজীর। তো আমার মনে হয় রবিশঙ্করজীর…

ঋতবাকঃ আমার মনে হয় তোমাকে একটা কথা বলব। তুমি যেটা ফিল করেছ সেটা মনে হয় দূর থেকে অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু কাছে গেলে অনেক…

তন্ময় বোসঃ নিশ্চয়ই তাই।

ঋতবাকঃ সেখানে কিন্তু দোষে-গুণে পুরো মানুষটাকেই দেখা যায়।

তন্ময় বোসঃ আর এটা সত্যি কথাই যে রবিশঙ্করজীদের দিয়ে শুরু হয়েছিল। আমার গুরুজীদের দিয়ে সেটা ক্যারি ফরওয়ার্ডেড হয়েছিল। এই যে ঘরানার বাজিয়েরা, এদের দেখে আমি অবাক হই।আমার বাবা বাজায় তবলা। আমার বাবা বাজায় সেতার। আমার বাবা বাজায় সরোদ। তাছাড়া আমি অন্য কিছু বাজাতে পারব না। আমার কোন দাম নেই । এই যে একটা ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ঘরানার একটা লেগিসি ছিল, পণ্ডিতজী প্রথম জেনারেশন যিনি ভেঙে দিলেন ।

ঋতবাকঃ তুমিও ভেঙেছ।

তন্ময় বোসঃ আমরা তো পরে।

ঋতবাকঃ না আমি বলছি তুমিও ভেঙেছ।

তন্ময় বোসঃ আমরাও তাই।

ঋতবাকঃ তোমাদের বাড়িতে তো এইটা ছিল না।

তন্ময় বোসঃ প্রফেশনাল কেউ ছিল না।

ঋতবাকঃ কেউ ছিল না।

তন্ময় বোসঃ আমার গুরুরাও তাই। তারা ভেঙে দিয়েছেন, যে ওস্তাদ, পণ্ডিতদের ঘর থেকে গান-বাজনা শিখতে আশবে না, সাধারণ ছেলেরা যারা ভালো তারাই করবে। নিখিল ব্যানার্জী, রবিশঙ্কর, শঙ্কর ঘোষ, কানাই দত্ত। এঁরা প্রত্যেকে ফার্স্ট জেনারেশন যারা সারা পৃথিবীতে বাজিয়েছেন বাঙালী হিসেবে। হুম … তো এই হচ্ছে পণ্ডিতজীর সঙ্গে আমার...

ঋতবাকঃ আচ্ছা এইবারে আর একটা জিনিস তোমাকে বলব আলি আকবর খাঁ সাহেবের সঙ্গে বাজিয়েছ তুমি?

তন্ময় বোসঃ হ্যাঁ খাঁ সাহেবের সঙ্গে তিন বছর। আমার পরম সৌভাগ্য ছিল যে আমি আর তেজেন্দ্র খাঁ সাহেবের কলেজে থাকতাম। গেস্ট হাউসে। ৯৩-৯৪, ৯২-৯৩-৯৪ আমেরিকাতে। ওটা সান রাফেলেতে

ঋতবাকঃ সান রাফেলে

তন্ময় বোসঃ ওখানে গেস্ট রুম ছিল। সেই গেস্ট রুমে আমি আর তেজেন্দ্র থাকতাম। সন্ধ্যেবেলা ৪টের সময় স্বপনদা আসতেন, পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী । তবলার ক্লাস শুরু হত। আর সাড়ে পাঁচটার সময় আলি আকবর খান সাহেব আসতেন। এবং আমি আর তেজেন্দ্র কখনও খান সাহেবের ক্লাসে কখনও স্বপনদার ক্লাসে ভাগে ভাগে বসতাম। আবার ঐখান থেকে আমরা ট্যুরে যেতাম। আমরা নিজেদের বাজনা বাজিয়ে অন্যান্য শহরে আমেরিকায় । আবার ফিরে আসতাম আলি আকবর কলেজে। আর ক্লাস হয়ে গেলে প্রায়ওশই খাঁ সাহেব আমাকে আর তেজেন্দ্রকে নিয়ে রাত্রি সাড়ে নটার সময় ওনার ক্যাডিলাক গাড়ি চড়ে বাড়িতে যেতেন। ওনার বাড়িতে। এবং তখন উনি মাংস রান্না করতেন। তারপরে গল্প শুরু হত। তারপরে গানবাজনা শেখানো শুরু হত।

ঋতবাকঃ চলত প্রায় সারারাত?

তন্ময় বোসঃ অনেক রাত্তির পর্যন্ত। আর জেমস পমেরাংস বলে ওনার একজন আমেরিকান ছাত্র ছিল। তিনি খাঁ সাহেবের কলেজের বাড়ির কাছেই থাকতেন। ও আমাদের প্রায় ভোর রাত্তিরে এনে আবার কলেজে ফেরত দিত। কোনও কোনও দিন সকালবেলা যেদিন ক্লাস থাকতো না কলেজে খাঁ সাহেব আমাকে আর তেজেন্দ্রকে ডেকে পাঠাতেন। তো ঘরে বাজাতাম। উনি শেখাতেন। এই আর কি।

ঋতবাকঃ তো তুমি তো দুজনের সঙ্গেই করেছ? বাজিয়েছ।

তন্ময় বোসঃ ম্যাক্সিমাম আমি সময় কাটিয়েছি রবিশঙ্করের সঙ্গে।

ঋতবাকঃ অফকোর্স সেটা তো জানি। আমি তুলনায় যাচ্ছি না। কিন্তু ভারতীয় মার্গীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে তুমি কার অবদান সামান্য হলেও বেশি মনে করবে?

তন্ময় বোসঃ না না ডেফিনেটলি পণ্ডিতজীর বেশি। এটা নিয়ে তো আর কোন দ্বিমত নেই। হ্যাঁ কিন্তু আলি আকবর খাঁ সাহেব ওখানে থেকেছেন ওখানে শিখিয়েছেন অত বছর। ওনার কন্ট্রিবিউশনও হিউজ।

ঋতবাকঃ হুম

তন্ময় বোসঃ কিন্তু এটাও ঠিক কথা পণ্ডিতজীর কন্ট্রিবিউশন কি সেটা আমি বহুবার শেয়ার করেছি।

ঋতবাকঃ একটু বল।

তন্ময় বোসঃ একটা তো একবার আমরা হিউস্টনে পণ্ডিতজী মাঝে মাঝে বয়েজ ডে আউট করতেন। ওনার সেক্রেটারী ওনার ডাক্তার সবাইকে লুকিয়ে হোটেল থেকে আমাদের নিয়ে পালিয়ে যেতেন।

ঋতবাকঃ হিঃ হিঃ।

তন্ময় বোসঃ তো একবার হিউস্টনে উনি বললেন যে হোটেলের পিছনে ট্যাক্সি ডাকো। গাড়ি নেবেন না ট্যাক্সি। আমরা সিনেমা দেখব । সিনেমা দেখে ডিনার খাব। তো আমেরিকান থিয়েটারে যাব। তা আমি, বিক্রম আর পণ্ডিতজী। ট্যাক্সির প্রথমে ড্রাইভারের পাশে আমি বসে আছি , পিছনে রবিশঙ্করজী আর বিক্রম বসে আছে। তো আমেরিকান ট্যাক্সিওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করছে যে হোয়াট ইউ ডু ফর লিভিং? তো আমি ইণ্ডিয়ান ক্লাসিক মিউজিশিয়ান। ডু ইউ নো রবিশঙ্কর? (ড্রাইভার)

আমি বলছি হ্যাঁ আমি জানি। ও ভেরি গুড(ড্রাইভার)।

তা আমরা যখন থিয়েটার হলের সামনে চলে এসে গেছি, আমরা নেমেছি। পণ্ডিতজী পয়সা দিতে দেবেন না আমাদের। যখন পয়সা দিচ্ছেন, দিয়েছেন আমার হাতে টাকাটা। আমি ওনাকে টাকাটা দিয়ে ড্রাইভারটাকে বলেছি তুমি জানো কাকে তুমি নিয়ে এলে? এটা রবিশঙ্কর। ভালো করে মুখের সামনে মুখ নিয়ে দেখে হিস্টিরিক হয়ে গেল। আমেরিকানরা যেমন বলে ইউ আর কিডিং মি ম্যান দিস ইজ রবিশঙ্কর। আই কান্ট বিলিভ , বলে চেঁচাচ্ছে। তারপরে ট্যাক্সির মধ্যে ঢুকে একটা ফেল্ট পেন নিয়ে এল। নিজের জামাটা ছিঁড়ে বললে এখানে তুমি সাইন করে দাও। পণ্ডিতজি বললেন এখানে আমি সাইন করব না। হাসছেন পণ্ডিতজী। একটা কাগজ নিয়ে পণ্ডিতজী নিজের নামটা সাইন করে দিলেন। লোকটা পয়সা নিল না।

ঋতবাকঃ শুনেছি। তেজেন্দ্রর কাছে এই গল্পটা

তন্ময় বোসঃ পণ্ডিতজীর এইরকমই পপুলারিটি ছিল। আর আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব এজন্য ছিল যে আমি গল্প করতাম ওনার সঙ্গে বসে বসে। এরকম বহু বহু ঘণ্টার রেকর্ডিং চিন্মার কাছে আছে। কারণ চিনাম্মা বললেন উনি যেসব কথা তোমায় বলেন বিজন ভট্‌চায হ্যাঁ…

ঋতবাকঃ হুম… মানে নাটক, সাহিত্য

তন্ময় বোসঃ সিনেমা, গল্প। তারপরে তখনকার বাংলা খেয়াল, বাংলা গান

ঋতবাকঃ বা আই.পি.টি.এ

তন্ময় বোসঃ আই.পি.টি.এ-এর গল্প, এইসব না না রকম গল্প চিনাম্মা ভিডিও করতে লাগলেন। উনি ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমাকে ডেকে পাঠাতেন আর আমরা তিন-চার ঘণ্টা বসে বসে গল্প করতাম। উনি নানারকম বলতেন। আমার ছোটবেলা এরকম ছিল। প্যারিসে আমি দিন কাটিয়েছি বা মাইথনে এরকম দিন কাটিয়েছি। এখানে এমন দিন কাটিয়েছি। আমেরিকায় এমন দিন কাটিয়েছি। কলকাতায় এমন দিন কাটিয়েছি। তো পণ্ডিতজী একটা আমাকে বললেন, তুমি সার দু সুলেল দেখেছ? আমি বললাম না। সার দু সুলেলএকটা ফ্রেঞ্চ প্রোডাকশন ছিল। কিন্তু সেটা মন্ট্রিয়েল থেকে পরে ঐ কোম্পানিটা চালাত। ওটা হচ্ছে থিয়েটার অফ হিউম্যানস। উনি আমাকে নিয়ে গেলেন প্রায় ৫০ মাইল দূরে। সার দু সুলেল।টেন্ট পড়েছিল। আমি, চিনাম্মা আর উনি গেলাম। দেখালেন। দেখিয়ে তারপর তার হিস্ট্রি আমায় বলতে বলতে এলেন। ফ্রেঞ্চ প্রোডাকশন। মন্ট্রিয়াল যেহেতু ফ্রেঞ্চ স্পিকিং প্রভিন্স অফ কানাডা। এখন ওটা ওখানে আছে। তো এখন কথা হচ্ছে যে, যেটা খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, সেটা হচ্ছে যে সঙ্গ করবে তাকেও তো ঐ জিনিসগুলোর প্রতি ইন্টারেস্ট থাকতে হবে।

ঋতবাকঃ একশোবার।

তন্ময় বোসঃ যদি না থাকে তাহলে তার সঙ্গে মনের মিল হবে কি করে?

ঋতবাকঃ এবং আমি শুনেছি উনি জীবনানন্দ শুধু নয় জয় গোস্বামীরও কবিতা বলতে পারতেন।

তন্ময় বোসঃ হ্যাঁ বলতেন নয় শুধু। আমি এখান থেকে এত পুজোসংখ্যার বই নিয়ে যেতাম

ঋতবাকঃ সেগুলো পড়তেন।

তন্ময় বোসঃ বাংলা ডিভিডি নিয়ে যেতাম।এবার একবার গৌতম

ঋতবাকঃ গৌতম ঘোষ দা

তন্ময় বোসঃ বললাম যে

ঋতবাকঃ হ্যাঁ

তন্ময় বোসঃ আপনার ডিভিডিগুলো আমায় দেবেন। আমায় ওনার ৪-৫ টা ডিভিডি, ওনার ছবির শট দিলেন। আমি নিয়ে গেলাম। ওনার ফিল্ম টাইম ছিল না। রাত্রিবেলা ১০টা থেকে ১টা।বাড়িতে বিরাট স্ক্রীন ছিল। স্যান ডিয়াগোর বাড়িতে, সেখানে সিনেমা দেখা হত। এবং উনি যেহেতু ফ্রেঞ্চ বলতেন, জার্মানী বলতেন তো

ঋতবাকঃ রবিশঙ্কর জানতেন ভাষাগুলো

তন্ময় বোসঃ বলতেন তো, কারণ উনি ফ্রান্সেই তো বড় হয়েছেন

ঋতবাকঃ আর জার্মানটাও জানতেন।

তন্ময় বোসঃ জার্মানটাও জানতেন। তো ঐখানে সিনেমা দেখাতেন। আমরাও সিনেমা দেখতাম ওনার সঙ্গে। সিনেমা নিয়ে আলোচনা হত। একটা অল রাউন্ড ব্যক্তিত্ব রবিজীর। এটা আমার মনে হয় একটা কমপ্লিট মিউজিশিয়ান হওয়ার প্রয়োজন আছে। মানে আবার এটাও উনি বলতেন যে মিউজিশিয়ান তৈরি হয় না। মিউজিশিয়ান আর্টিস্ট তৈরি করা যায় না। আর্টিস্ট যার হওয়ার সে হয়ে জন্মায়।

ঋতবাকঃ একশোবার।

তন্ময় বোসঃ একটা কথা এতই সত্যি। আমার যত বয়স বাড়ছে আমি এটা বুঝতে পারছি যে আর্টিস্ট যার হওয়ার সে একটা আর্টিস্ট হয়ে জন্মিয়েছে। তার কপাল ভালো থাকলে সে একটা ঠিক গুরুর কাছে পড়বে। সে বেরিয়ে যাবে।

ঋতবাকঃ আর কপাল খারাপ থাকলে

তন্ময় বোসঃ সেই টাইমটা নষ্ট হবে। সেই গিফটটা নষ্ট হবে। কিন্তু এটা ঠিক কথা পণ্ডিতজী যে একটা অল ফাউণ্ড মিউজিশিয়ান। একটা কমপ্লিট হিউম্যান বিং। বারন্স এন্ড নবেলসথেকে রেগুলার বই কেনা ওনার শখ ছিল। আমেরিকার যে কোন শহরে যাবেন উনি বারন্স এন্ড নবেলস আগে ঢুকেনতুন পাবলিকেশন কি হয়েছে, এত এত বই কিনবেন এবং পড়বেন। তারপরে এস.আর.এফ.এ ফ্রি থাকলেই আমাদের নিয়ে বলতেন চল সেলফ রিলায়জেশন সেন্টার। অটোবায়োগ্রাফি অফ আ যোগী। আমাদের প্রথম বইটা দিয়ে বললেন পড়বে। তারপরে নিয়ে গেলেন ওখানে।

সেলফ রিলায়জেশন সেন্টারে। সামনে সমুদ্র। Pacific Ocean. হ্যাঁ আর ওনার ওখানে গিয়ে আমি এতবছর ওনার সঙ্গে থেকেছি সবসময় আমার মনে হয়েছে দেয়ার ইজ মোর দ্যাট আই হ্যাভ টু লার্ন। ব্যক্তিত্ব। পার্সোনালিটি। সারা পৃথিবীতে অত পপুলারিটি। ভাবনার বাইরে। ওটা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আর এটা উনি বলতেন দেশের লোক কোনদিন জানবে না আমরা কি করলাম। সারা পৃথিবীতে আমাদের সঙ্গীদের জন্যে। আমি বললাম কেন জানবে না। বললেন না বাঙালী কি আর জানবে?

ঋতবাকঃ এটা বোধ হয় শেষের দিকে আরও বেশি

তন্ময় বোসঃ অনেক বেশি ছিল। তিনি সবসময় বলতেন বাঙালী। বাঙালীর সেই মনন আর নেই। আমি বলছি, কেন বলছেন? কাকে মনে রেখেছে বাঙালী।

ঋতবাকঃ খুব সত্যি কথা।

তন্ময় বোসঃ এবং কথাটা আমার মনে হয়েছে যে খুব একটা ভুল নয়। উনি খুব বিরক্তহতেন। নেতাজী ইনডোরে উনি বাজালেন। বাজিয়ে উনি আনন্দবাজারকে বললেন কলকাতার মানুষ ক্ল্যাপ দিতে জানে না। স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। এরম এরম করে ক্ল্যাপ দিচ্ছে। (বাজিয়ে দেখালেন) আর বিদেশে ঐরকম উল্লাস ঐরকম…

ঋতবাকঃ অনকরযখন হয়

তন্ময় বোসঃ অনকর।ওনাকে ৫ মিনিটের জন্য ছাড়ত না লোক ৭ মিনিট দাঁড়িয়ে আছেন। তিনবার চারবার করে ফিরে আসতে হচ্ছে। তো সেইজন্য বলতেন যে বাঙালী, আমি যে কলকাতা দেখেছিলাম, সেই বাঙালীও নেই, সেই কলকাতাও নেই। তাতে খুব সমালোচনা হয়েছিল।

ঋতবাকঃ কিন্তু খুব সত্যি কথা বলেছিলেন

তন্ময় বোসঃ আর উনি কোনদিন, উনি তো আর বাঙালী সেই অর্থে না।কারণ উনি বেনারসে জন্মেছেন। প্যারিসে বড় হয়েছেন। তারপরে দিল্লীতে থেকেছেন। বম্বেতে থেকেছেন। আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড। এই তো কিন্তু তবু মনে প্রাণে বাঙালী ছিলেন। তবু রবীন্দ্রনাথ পড়তেন। এত সাহিত্য পড়তেন। হ্যাঁ,শুক্ত খাওয়া লোক। বাংলা কথা বলতেন আমাদের সঙ্গে।

ঋতবাকঃ শুক্তো খেতেও ভালোবাসতেন?

তন্ময় বোসঃ ছোটো মাছ খেতে ভালোবাসতেন। কিন্তু ঐটা দুঃখ তো ছিল। যে বাংলায়, যে বাঙালী উনি দেখেছিলেন সেই বাঙালী …

উনি আমাকে নিয়ে গেলেন স্যানফ্রান্সিসকো স্টেট হসপিটালে।আমায় বললেন তোমাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি কলকাতার বাঙালী তারা কিস্‌সু জানে না জানো। আমি বললাম কেন?বললেন দেখো সারা পৃথিবীতে কোন বাঙালীরা কি করেছেন তাদের সম্বন্ধে কি কলকাতার বাঙালী জানে?আমি বললাম আপনি কেন বলছেন? তুমি আমার সাথে চলো। সানফ্রান্সিসকোতে ওনার বাজনা ছিল আমায় বললেন দুপুরবেলা, বিকেলবেলা মানে চারটের সময় উনি স্টেট হসপিটালে হাজির। গাড়ি ভিতরে পার্মিশান করান ছিল ওনার গাড়ি। ঢুকে আমাকে একটা বিল্ডিং এর সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন দেখো তন্ময় ওপরে দেখো, ওপরে তাকিয়ে দেখছি লেখা আছে কানু চ্যাটার্জী ডিপার্টমেন্ট অফ কার্ডিওলজি। ওনার সেক্রেটারী গিয়ে ফোন করে দিলেন কানুবাবু নেমে এল।হার্টের ভগবান। ওনার নামে একটা ওয়ার্ড আমেরিকায় ইউনিভার্সিটিতে। ভীষণ পছন্দ ছিল আমেরিকান ওয়ে অফ লাইফ। উনি বলতেন দেখ এই একটা দেশ। যেজন্যউনি বলতেন যে আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সঙ্গীত, একদিন ওদেশে এসে ছেলেদের শিখতে হবে। আমাদের দেশে সেই Awareness নেই। বললেন দেখ এই কানুর নাম, কানুর অবদান দেখ। বলে আমায় দেখালেন। তো কানুবাবু নেমে এল। উনি এসছেন শুনে রবিদা রবিদা। তা আমি প্রণাম করলাম। বললেন দেখ এই আর এক বাঙালী। জানে? কলকাতার ছেলেরা, লোকেরা। বাঙালীর কি অবদান দেখ। আমেরিকার মতো সানফ্রান্সিসকে স্টেট হসপিটালের একটা ওয়ার্ড ওনার নামে। এত বড় ডাক্তার। বললেন দেখ এই বাঙালী। উনি সবসময় আমায় দেখলেই বলতেন তবু মনে রেখো। আমি ওনাকে বলতাম আপনাকে কেউ ভুলবে না বাঙালী ভুলবে না।

ঋতবাকঃ ভোলে কিন্তু নি বাঙালী।

তন্ময় বোসঃ আমরা ভুলিনি।

ঋতবাকঃ আমাদের পরের জেনারেশন ?

তন্ময় বোসঃ সাধারণ লোকের এনাদের যে অবদান সারা বিশ্বের দরবারে মিউজিক নিয়ে, এখনকার ছেলে-মেয়েরা যারা গান-বাজনা করছে, তারা?

মেইন স্ট্রীমে যদি গান-বাজনা করতে হয়, সাহেবরা তোমার গান-বাজনা শুনবে না। একমাত্র ক্লাসিক্যাল মিউজিক। এছাড়া আর কোনো গান-বাজনা ভারত থেকে ওদেশে যায় না। কেউ শোনে না। আমি এত বছর বঙ্গ সম্মেলন যাচ্ছি। গিয়ে দেখছি বাঙালী শিল্পীরা আমি উইথ ডিউ রেসপেক্ট বলছি, কাউকে আমি ছোট করছি না। কিন্তু আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি বাংলার যারা So called star তাদের এক্সপোজার তারা আমেরিকা দেখে শুধু বাঙালীর চোখ দিয়ে। তারা আমেরিকানের চোখ দিয়ে আমেরিকা দেখে না।

ঋতবাকঃ সেটাই দেখা উচিৎ।

তন্ময় বোসঃ সেটা দেখা উচিৎ। তো সেটা একমাত্র ক্লাসিক্যাল মিউজিক যদি কেউ করে তাহলে সেটা সম্ভব। আমেরিকান অর্গানাইজেশনরা ক্লাসিক্যাল মিউজিক অর্গানাইজ করে। বাংলা গান অর্গানাইজ করে না। তো পণ্ডিতজীর সঙ্গে থাকাতে এইটা একটা আমার ভালো হয়েছিল যে I could see the world through his eyes. ওনার চোখে ওনার সঙ্গে থেকে উনি আমায় যেরকম দেখিয়েছেন অত বড় বড় হল ১৫ দিন আগে থেকে হাউজ ফুল কেনেডিহল। কানেডি হল আমেরিকান মিউজিক

ঋতবাকঃ কেনেডি?

তন্ময় বোসঃ হ্যাঁ। আমেরিকান মিউজিশিয়ানদের কাছে কেনেডি হল মানে, তুমি শেষ পর্যায়ের শিল্পী। তারা কেনেডি হলে পারফর্ম করবেন। তো পণ্ডিতজীর সঙ্গে আমি ওতবার কেনেডিতে বাজিয়েছি, তার মধ্যে যে লাইভ অ্যাট কেনেডি, যেটার জন্যও গ্র্যামি পেলেন।

ঋতবাকঃ হুম।

তন্ময় বোসঃ সেটা তো কেনেডিরই লাইভ কনসার্ট। আর হাউজ ফুল। ১৫ দিন আগে থেকে। যে হলেই যাচ্ছেন, ডিজনি, ওয়ার্ল্ড ডিজনি হল হাউজফুল। বস্টন সিম্ফনি হল হাউজফুল। হ্যাঁ…

ঋতবাকঃ তেজেন্দ্রও বলেছেন যে এটা দেখে ভালো লাগত যে সাদা চামড়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে টিকিট পাওয়ার জন্য।

তন্ময় বোসঃ টিকিটের জন্য।

ঋতবাকঃ At any cost.

তন্ময় বোসঃ হুম। একদমই তাই। একদম , আমি সেটাই বলছি যে এখানের লোকদের কোনো ধারণা নেই যে কি অবদান এদের আমাদের সংস্কৃতিকে কোথায় কিভাবে তারা পৌঁছে দিয়েছে।

ঋতবাকঃ আমি জাস্ট একটা ছোট্ট জিনিস দিয়ে শেষ করব সেটা হচ্ছে একটা কোনও পান যেটা উনি বলেছেন।

তন্ময় বোসঃ এরকম কেউ ওনাকে পন্ডিত বললে, বলতেন, পান ডিত।

ঋতবাকঃ হাঃ হাঃ


লেখক পরিচিতি : তবলা বাদক




কালজয়ী শিল্পী রবিশংকর
তীর্থঙ্কর ব্যানার্জি


পন্ডিত রবিশংকরের কর্মকান্ডের ব্যাপ্তী এতটাই বড় যে তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা খুব দূরুহ কাজ। বাল্যকালের কিছু বছর বেনারসে কাটানোর পর তাঁর বেড়ে ওঠা ও যৌবনে পা দেওয়া প্যারিস শহরে। দাদা উদয়শংকরের ব্যালে ট্রুপে তিনি তখন নিয়মিত নৃত্য পরিবেশন করেন। পাশাপাশি যন্ত্র সংগীতের প্রতি উৎসাহ থাকায় ওই ট্রুপের অর্কেস্ট্রার বিভিন্ন যন্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। বিশেষ করে সেতার ও এস্রাজ। এই দুটি যন্ত্র হাতে ওই বয়সের ছবিও আমরা পাই। শোনা যায় বাবা আলাউদ্দিন খান যখন উদয়শংকরের নাচের ট্রুপে যোগ দেন তখন তিনি যুবক রবিশংকরের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করেন। কিন্তু নানান যন্ত্র না বাজিয়ে যেকোন একটি যন্ত্র বেছে নিয়ে তাতেই মননিবেশ করার পরামর্শ দেন। এও বলেন যে মাইহারে এলে তিনি রবিশংকরের তালিমের দায়িত্ব নিতে রাজি। কিন্তু সেই সময় প্যারিসে উদয়শংকরের প্রচন্ড সুনাম। তাঁদের নাচের অনুষ্ঠান রমরমিয়ে চলছে। রবিশংকর সেখানে একজন ব্যস্ত শিল্পী। অতএব প্যারিস ছেড়ে মাইহারে যাবার কোন প্রশ্নই নেই। ঠিক এমত অবস্থায় ইতিহাস এক অদ্ভুত বাঁক নেয়। হিটলার নামক নরপিশাচের কারনে য়ুরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। প্যারিসের পতন অনিবার্য। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই অবস্থায় স্বাভাবিক ভাবেই উদয়শংকর প্যারিস ত্যাগ করে দেশে ফেরা মনস্থঃ করেন। সেইসঙ্গে রবিশংকরের জীবনেও আসে এক নতুন অধ্যায়।

রবিশংকর যখন মাইহারে উপস্থিত হন, তখন তাঁর প্যারিসের হ্যাংওভার কাটেনি। কেয়ারি করা চুল, দামি পোষাক, দামি পারফিউম.... এইসবে তিনি তখন অভ্যস্ত। তাঁকে দেখে বাবা আলাউদ্দিন সন্দেহপ্রকাশ করেন যে প্যারিসের বৈভব ছেড়ে মাইহারের মত গন্ডগ্রামে থেকে সেতার শিক্ষা করা রবিশংকরের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা। ঠিক এইসময় রবিশংকরের মনের এক অন্যরকম পরিচয় আমরা পাই। তিনি নাপিতের কাছে গিয়ে মস্তকমুন্ডন করে তাঁর বাহারের চুল ফেলে দেন। এক মুহূর্ত লাগে প্যারিসের জীবনকে ঝেড়ে ফেলতে। অসম্ভব মনের জোর ও সংগীত শিক্ষার প্রতি তীব্র আকাঙ্খা থাকলে তবেই একটি সতেরো আঠারো বছরের যুবকের পক্ষে এই সঙ্কল্প করা সম্ভব।

বাবা আলাউদ্দীন বীণ অঙ্গের ধ্রুপদ বাজের সঙ্গে জয়পুর ঘরাণার বাজ মিলিয়ে এক নতুন আঙ্গিকের জন্ম দেন। কিন্তু তখনকার প্রথাগত সেতারে এই দুই শৈলীকে একত্রিত করা সম্ভব ছিলনা। বিশেষ করে বীণ অঙ্গের কাজ। এই সমস্যা অতিক্রম করতে তিনি সেতারে খরজ ও পঞ্চমের মোটা তার যোগ করেন। লক্ষ্নৌয়ের সেতারি ও যন্ত্রনির্মাতা ইউসুফ আলি খান তাঁকে এই নতুন যন্ত্র নির্মান করে দেন। প্রথম জীবনে রবিশংকরজী ওই যন্ত্র ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি নদু মল্লিকের তৈরী সেতার বাজাতেন। এইধরনের যন্ত্রে বীণ ও সুরবাহারের ভারী চালের বাজ তিনি অনায়াসে বাজাতে পারতেন। দ্বাদশ অংগের আলাপ ও জোড় যা তিনি বাবা আলাউদ্দিনের কাছে শিখেছিল্ন , তা পরিবেশনের জন্য এই নতুন ধারার সেতার বিশেষভাবে উপযুক্ত। কিন্তু বাবা তাঁকে শুধুমাত্র বীণের তালিমই দেননি। পাশাপাশি জয়পুর ঘরাণার কৃন্তন, জমজমা, ডানহাতের বোলকারীর তালিমও দিয়েছিলেন। ফলে তার-পরণ অংগে ভারী ও বলিস্ঠ বোলের কাজ, আবার আবার বাঁ হাতে কৃন্তন জমজমা তাঁর বাজনার বৈশিষ্ট ছিল। বাবা আলাউদ্দীনের শিক্ষায় জীবনের গোড়াতেই তাঁর বাজনা এমন এক ধারায় প্রবাহিত হয় যা ছিল একেবারে নতুন। অশ্রুতপূর্ব। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। আলাপ পরবর্তী অধ্যায়, অর্থাৎ গতকারীতে তিনি প্রয়োগ করেন কর্ণাটকি রীতি অনুযায়ী ছন্দ ও লয়কারীর কাজ। তার সংগে আসে তেহাই। আজ সব ঘরাণার প্রায় সমস্ত যন্ত্রি তানের শেষে তেহাই বাজিয়ে থাকেন। এই তেহাই বাজানোর বহুল প্রচলন তিনিই প্রথম করেন। আবার , একসময় তিনতালের বাইরে অন্য তাল বাজানোর বিশেষ চল ছিল না। এখানেও তিনি পথিকৃত। অনায়াস দক্ষতায় বিভিন্ন তালে তিনি বাজনা পরিবেশন করে শাস্ত্রীয় সংগীতকে আরো সমৃদ্ধ করে গেছেন।

রাগের শুদ্ধতা বজায় রাখার ব্যাপারে প্রথম থেকেই তাঁর তীক্ষ্ন নজর ছিল। বাবা আলাউদ্দীনের তালিম তো ছিলই। তার সংগে নিজের বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে রাগ-রাগিণীর একটি নির্দিষ্ট রূপ তিনি দিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যা এক বিরাট সম্পদ। রাগের চলনের phrasing করতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ফলে ছোট পরিসরের রাগকেও বড় করে উপস্থাপন করতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম। আবার রাগের চরিত্রটিকে অসম্ভব ভাল ধরতে পারতেন। ফলে তাঁর বাজনায় নবরসের ব্যবহার বারেবারে এসেছে। এদিক থেকে ভাবলে তিনি এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আবার অনুষ্ঠানের শেষে তিনি বিভিন্ন রাগ মিলিয়ে মিশিয়ে রাগমালা বাজাতেন খানিকটা হাল্কা চালে। বাজনার এই অংশটাও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। অবশ্য প্রথমদিকে রাগমালা বাজানোর জন্য তাঁকে যথেষ্ট সমালোচনা সম্মুখীন হয়।

তবলা সংগতের concept তিনি আমূল পাল্টে দেন। শুধুমাত্র ঠেকা বাজানোয় সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি চাইতেন আরো সক্রিয় অংশগ্রহন। ফলে তবলাবাদকদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। তাঁরা ছিলেন পিছনের সারির শিল্পী। রবিশংকরজী তাঁদের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

প্রায় তিরিশটির মত রাগ তিনি সৃষ্টি করেছেন। এরমধ্যে পরমেশ্বরী, নটভৈরব, নটভৈরবী, যোগেশ্বরী, রসিয়া, তিলকশ্যাম, ইমনমাঝ, বৈরাগী, চারুকোষ, পলাশ কাফি প্রভৃতি রাগ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। এই রাগগুলি এখন সমস্ত ঘরাণার গাইয়ে ও বাজিয়েরা উপস্থাপন করেন। কর্ণাটকি রাগ চারুকেশি, জনসম্মোহনী, সিঙ্ঘেন্দ্রমধ্যম’ও তিনি জনপ্রিয় করেছিলেন।

সেতারের বাইরে creative music এর ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সফল। অপু trilogy, গান্ধী প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তাঁর সংগীত ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। প্রচুর নাটকেও তিনি সুরারোপ করেছেন। ব্যালে রচনা করেছেন। তাঁর সুরে ‘ সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ তো প্রায় জাতীয় সংগীতের পর্যায় উঠে এসেছে । বিখ্যাত পাশ্চাত্য সংগীতকারদের সঙ্গে সফলভাবে কাজ করেছেন। আর সত্তরের দশকের বিখ্যাত বীটল’দের জর্জ হ্যারিসন তো তাঁকে গুরুর আসনে বসান ও সেতার শিখতে শুরু করেন। দেশে বিদেশে তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ছিল। নিজের বাজনার বাইরে তিনি শিক্ষাদান করেছিলেন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে দীপক চৌধুরী,উমাশংকর দিক্ষিত, কার্তিক কুমার, জয়া বিশ্বাস, শামীম আহমেদ, বিশ্বমোহন ভাট উল্লেখযোগ্য। সমগ্র ভারত তথা বিশ্বে তাঁরা বিখ্যাত। বর্তমানে তাঁর কন্যা অনুস্কা শংকর একজন পৃথিবী বিখ্যাত সেতারী।

ভারতীয় সংগীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন তিনি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে সমঝদার শ্রোতা তৈরী হয়েছে। যার ফসল আজকের গাইয়ে বাজিয়েরা ভোগ করছেন। সংগীতে তাঁর অবদানের কোন সীমা পরিসীমা নেই। ভাবতে অবাক লাগে যে এত কাজ এক জীবনে তিনি কি করে করলেন?

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আমার গুরু পন্ডিত দীপক চৌধূরীর কাছে একটি চিঠি দেখেছিলাম পন্ডিত রবিশংকরজীর লেখা।৭০ দশকের গোড়ায় লেখা এই চিঠিতে তিনি তাঁর তরুণ শিষ্যকে পরামর্শ দিচ্ছেন বিলায়েৎ খাঁ’সাহেবের মতো তান বাজাতে। পন্ডিত রবিশংকর ও উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর অনেক রেশারেশির কথা আমরা শুনেছি। এই চিঠি কিন্তু অন্য কথা বলে।

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লেখা শেষ করি। ৮০ দশকের মাঝামাঝি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পন্ডিত রবিশংকরের অনুষ্ঠানের পর ওনার কাছে অটোগ্রাফ চাইতে গেলাম। উনি জানতে চাইলেন কোন ভাষায় অটোগ্রাফ দেবেন। ভাবলাম বাংলা বা ইংরেজী ছাড়া তো কিছু হবে না। তাই বললাম আপনার যা খুশি। আমার দিকে তাকিয়ে একটু দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে বললেন তাহলে চাইনিজে দিই। তখন মনে পড়ল যে উনি সদ্য চীনদেশে ঘুরে এসেছেন। পরে বাংলা ও ইংরাজী, দুই ভাষাতেই অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। এখন ভাবি, চাইনিজ ভাষায় অটোগ্রাফ নিলেই হোত। বাংলা ও ইংরাজীতে তো অনেকের কাছেই আছে। চাইনিজে কি আছে?

লেখক পরিচিতি : সেতার বাদক। মাইহার ঘরানার শিল্পী

1 comment:

  1. World's Great Dancer Uday Shankar's birthday 8th December 1900, Idilpur, Rajasthan, India

    ReplyDelete