অণুগল্প - পুলস্ত্য আচার্য
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
চপার
পুলস্ত্য আচার্য
১)
নিঁখুত অ্যাঙ্গেলে গলায় চপারটা চালাল মিন্টু। কিছুদিন ধরে শুক্রবারগুলোয় এইসব কাজ করে করে এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে চোখ বন্ধ করে চালালেও ওই জায়গাতেই কোপটা লাগত। কোপটা বসিয়ে একটু হাসল মিন্টু, ঠিক যেরকম হাসি কঠিন অঙ্ক করে দিয়ে ক্লাসের ফার্স্ট বয় হাসে, সেরকম হাসি।
হেসে চপারটা মুছে নিলো আস্তে করে...
এক/
রাস্তাটা পেরোলেই বড় একটা বাড়ি। বাড়িটার সামনেটা বেশ সুন্দর ছোটখাটো একটা বাগান। বাগান খুব ভালোবাসতো মিষ্টুনি, আমাকে বহুবার বলেছিল বাড়ি তৈরী করলে এরকম তৈরি করবে, যাতে সামনে একটা বড় বাগান থাকে। আমি শুনে হেসেছিলাম, একটা ফুলের টব কেনার টাকা নেই, আবার বাগানের শখ!
মিষ্টুনি আস্তে আস্তে বলেছিল, আজ না হোক, কাল বা পরশু, না হলে তার পরেরদিন, একদিন না একদিন ঠিক বাগান সমেত বড় বাড়ি হবে আমাদের, দেখো…
২)
মিন্টু হাঁটছিল রাস্তা দিয়ে, অনেকটা হেঁটে গেলে তবে একটা পানের দোকান পাওয়া যায়, পান না খেলে ওর আবার দুপুরের ভাত হজম হয়না, কেমন যেন বুকে-পেটে হয়ে থাকে।
পানের দোকানদার চেনা, কিছুক্ষণ কথা বলবেই। মিন্টুর ইচ্ছে করেনা কথা বলতে, কিন্তু তাও বলতে হয়।
মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে পানটা মুখে পুরে চপারটা দুম করে বসিয়ে দেয় লোকটার গলায়, সব বুকনি একবারে বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু পারেনা। অকারণ মানুষ মারতে ভালো লাগেনা মিন্টুর।
আজ পানের দোকানের লোকটা প্রেম নিয়ে পড়েছে, জীবনের প্রথম প্রেম নিয়ে।
দোকানদারের প্রথম প্রেমের কথা শুনতে শুনতে মুচকি হাসলো মিন্টু…
দুই/
মিষ্টুনি আমায় বলতো, আমি নাকি রোম্যান্টিক নই, অন্তত ও যেরকম রোম্যান্টিকতা চায় সেরকম তো নয়ই। আমি শুনে মুখ নামিয়ে নিতাম লজ্জায়। সত্যিতো, কি দিতে পেরেছি আমি ওকে, না যত্ন-আত্তি, না বাগানওয়ালা বাড়ি, আসলে জুট মিলের চাকরি, বেশি আশা করা যায়না সেখান থেকে। সামান্য চাকরি বলেই আমাদের বস্তিতে থাকতে হয়, একটা ছোট্ট পায়রার খোপে জাপটাজাপটি করে- কোনোমতে।
একদিন মিষ্টুনির সাথে তুমুল ঝগড়া হলো। মিষ্টুনি একটা স্কুটার কিনতে বলছিল-সেকেন্ড হ্যান্ড, অথচ আমার টাকা নেই। প্রচণ্ড ঝগড়ার পর মিষ্টুনি রীতিমত রাগ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেছিল, স্পষ্ট মনে আছে আমার সেই রাত-শুক্রবারের রাত, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ভেতর গায়ে চিটে থাকার মতন অন্ধকার...আমি আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছিলাম মিষ্টুনিকে। অনেক পরে খুঁজে পেলাম দূরের ভাঙা ডাস্টবিনটার সামনে, তখনও বুকটা ধুকপুক করছিল মিষ্টুনির, সারা গায়ে অন্ধকারের সাথে রক্ত মাখানো দেহটা তুলে আনতে আনতে ঠিক দুটো কথা বলতে পেরেছিল মিষ্টুনি, ‘কাউকে ছেড়োনা’...
আর বলেই ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে গিয়েছিল ওর।
আমি শান্ত হয়ে দাহ করেছিলাম মিষ্টুনিকে, শ্রাদ্ধের মন্ত্রপাঠের সময়ও কেবল একটা শব্দই শুনেছি- ‘কাউকে ছেড়োনা-’
৩)
মিন্টুর সামনেই দুটো লোক একটা মেয়েকে রাস্তার উপর ডাস্টবিনটার পাশে টেনে শোয়াতে যাচ্ছিল। অন্ধকার গলির ভেতর, কেউ কোথথাও নেই...কিন্তু যার কেউ নেই, তার মিন্টু আছে, আস্তে আস্তে বেড়ালের মতন চপারটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল মিন্টু।
কোপটা যখনই ঘাড়ে বসাতে যাবে, অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠল কিভাবে যেন।
ছোটবেলায় মায়ের সাথে দেখতে যাওয়া বায়োস্কোপের কথা মনে পরছিল মিন্টুর, হঠাৎ করে কেমন আলো জ্বলে ওঠে, ঠিক তেমনি।
কে যেন পেছন থেকে বলল, আচ্ছা করে বেধে ফ্যাল, কাল সোজা কোর্টে চালান দেব…
তিন/
শান্ত হয়ে কাঠগড়াটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।
সামনে কে যেন খুব চিৎকার করে বলছিল, মিন্টু দাস বিনা কারণে ১৩ জনকে খুন করেছে, ধর্মাবতার, ইত্যাদি ইত্যাদি…
একজন চশমা পরা ভদ্রলোক কিছু পরে উঠে এসে কিসব বলছিলেন, অল্টার ইগো না কি...মানে মোদ্দা কথা হলো আমি স্কিজোফ্রেনিক না কি যেন, কোনো এক শুক্রবারে আমার বউ মিষ্টুনিকে কেউ বা কারা রেপ করেছিল, তারপর থেকে নাকি আমি প্রতি শুক্রবারেই বস্তিটার চারপাশের ডাস্টবিন বা কানাগলিগুলোয় মানুষ খুন করি, কল্পনা করি কোনো মেয়েকে রেপ করা হচ্ছে, দিয়ে তাকে বাঁচাতে খুন করি, পুরো উদ্দেশ্যহীন খুনি যাকে বলে।
এসব শুনেই নিজেকে আত্মা-আত্মা মনে হলো, মনে হলো গীতার কথা শুনছি, ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনতাম, মনে হলো আমার কোনো জন্ম মৃত্যু নেই, আমি কেবল শাস্তি দিতে জন্মেছি, ভুল শোধরাতে জন্মেছি…
আমি জোরে হেসে ফেললাম।
বুড়োমত জাজটা ভ্রুকুটি করলো, আমি বললাম, “ধর্মাবতার, আমি নিশ্চয় জেলে থাকবো, আমার সাথে যারা থাকবে তারাও কারো খুনী, ধর্ষক, বা আরো ভয়ানক কিছু…”
কালো কোট পরা একজন চেঁচিয়ে বলল, কি বলতে চাও তুমি?
আমি ফের মুচকি হাসলাম, লোকটা বড্ড কথা বলছে, পানওয়ালাটার মতো।
হেসে বললাম, “আমার চপারটা জেলের ভিতর পাওয়া যাবে, স্যার?”