Next
Previous
Showing posts with label অণুগল্প. Show all posts
0

অণুগল্প - পুলস্ত্য আচার্য

Posted in


অণুগল্প


চপার
পুলস্ত্য আচার্য


১)
নিঁখুত অ্যাঙ্গেলে গলায় চপারটা চালাল মিন্টু। কিছুদিন ধরে শুক্রবারগুলোয় এইসব কাজ করে করে এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে চোখ বন্ধ করে চালালেও ওই জায়গাতেই কোপটা লাগত। কোপটা বসিয়ে একটু হাসল মিন্টু, ঠিক যেরকম হাসি কঠিন অঙ্ক করে দিয়ে ক্লাসের ফার্স্ট বয় হাসে, সেরকম হাসি। 

হেসে চপারটা মুছে নিলো আস্তে করে...


এক/
রাস্তাটা পেরোলেই বড় একটা বাড়ি। বাড়িটার সামনেটা বেশ সুন্দর ছোটখাটো একটা বাগান। বাগান খুব ভালোবাসতো মিষ্টুনি, আমাকে বহুবার বলেছিল বাড়ি তৈরী করলে এরকম তৈরি করবে, যাতে সামনে একটা বড় বাগান থাকে। আমি শুনে হেসেছিলাম, একটা ফুলের টব কেনার টাকা নেই, আবার বাগানের শখ! 

মিষ্টুনি আস্তে আস্তে বলেছিল, আজ না হোক, কাল বা পরশু, না হলে তার পরেরদিন, একদিন না একদিন ঠিক বাগান সমেত বড় বাড়ি হবে আমাদের, দেখো…


২)
মিন্টু হাঁটছিল রাস্তা দিয়ে, অনেকটা হেঁটে গেলে তবে একটা পানের দোকান পাওয়া যায়, পান না খেলে ওর আবার দুপুরের ভাত হজম হয়না, কেমন যেন বুকে-পেটে হয়ে থাকে। 

পানের দোকানদার চেনা, কিছুক্ষণ কথা বলবেই। মিন্টুর ইচ্ছে করেনা কথা বলতে, কিন্তু তাও বলতে হয়।

মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে পানটা মুখে পুরে চপারটা দুম করে বসিয়ে দেয় লোকটার গলায়, সব বুকনি একবারে বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু পারেনা। অকারণ মানুষ মারতে ভালো লাগেনা মিন্টুর। 

আজ পানের দোকানের লোকটা প্রেম নিয়ে পড়েছে, জীবনের প্রথম প্রেম নিয়ে। 

দোকানদারের প্রথম প্রেমের কথা শুনতে শুনতে মুচকি হাসলো মিন্টু…


দুই/
মিষ্টুনি আমায় বলতো, আমি নাকি রোম্যান্টিক নই, অন্তত ও যেরকম রোম্যান্টিকতা চায় সেরকম তো নয়ই। আমি শুনে মুখ নামিয়ে নিতাম লজ্জায়। সত্যিতো, কি দিতে পেরেছি আমি ওকে, না যত্ন-আত্তি, না বাগানওয়ালা বাড়ি, আসলে জুট মিলের চাকরি, বেশি আশা করা যায়না সেখান থেকে। সামান্য চাকরি বলেই আমাদের বস্তিতে থাকতে হয়, একটা ছোট্ট পায়রার খোপে জাপটাজাপটি করে- কোনোমতে। 

একদিন মিষ্টুনির সাথে তুমুল ঝগড়া হলো। মিষ্টুনি একটা স্কুটার কিনতে বলছিল-সেকেন্ড হ্যান্ড, অথচ আমার টাকা নেই। প্রচণ্ড ঝগড়ার পর মিষ্টুনি রীতিমত রাগ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেছিল, স্পষ্ট মনে আছে আমার সেই রাত-শুক্রবারের রাত, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির ভেতর গায়ে চিটে থাকার মতন অন্ধকার...আমি আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছিলাম মিষ্টুনিকে। অনেক পরে খুঁজে পেলাম দূরের ভাঙা ডাস্টবিনটার সামনে, তখনও বুকটা ধুকপুক করছিল মিষ্টুনির, সারা গায়ে অন্ধকারের সাথে রক্ত মাখানো দেহটা তুলে আনতে আনতে ঠিক দুটো কথা বলতে পেরেছিল মিষ্টুনি, ‘কাউকে ছেড়োনা’... 

আর বলেই ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে গিয়েছিল ওর। 

আমি শান্ত হয়ে দাহ করেছিলাম মিষ্টুনিকে, শ্রাদ্ধের মন্ত্রপাঠের সময়ও কেবল একটা শব্দই শুনেছি- ‘কাউকে ছেড়োনা-’


৩)
মিন্টুর সামনেই দুটো লোক একটা মেয়েকে রাস্তার উপর ডাস্টবিনটার পাশে টেনে শোয়াতে যাচ্ছিল। অন্ধকার গলির ভেতর, কেউ কোথথাও নেই...কিন্তু যার কেউ নেই, তার মিন্টু আছে, আস্তে আস্তে বেড়ালের মতন চপারটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল মিন্টু। 

কোপটা যখনই ঘাড়ে বসাতে যাবে, অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠল কিভাবে যেন। 

ছোটবেলায় মায়ের সাথে দেখতে যাওয়া বায়োস্কোপের কথা মনে পরছিল মিন্টুর, হঠাৎ করে কেমন আলো জ্বলে ওঠে, ঠিক তেমনি। 
কে যেন পেছন থেকে বলল, আচ্ছা করে বেধে ফ্যাল, কাল সোজা কোর্টে চালান দেব…


তিন/
শান্ত হয়ে কাঠগড়াটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। 

সামনে কে যেন খুব চিৎকার করে বলছিল, মিন্টু দাস বিনা কারণে ১৩ জনকে খুন করেছে, ধর্মাবতার, ইত্যাদি ইত্যাদি…

একজন চশমা পরা ভদ্রলোক কিছু পরে উঠে এসে কিসব বলছিলেন, অল্টার ইগো না কি...মানে মোদ্দা কথা হলো আমি স্কিজোফ্রেনিক না কি যেন, কোনো এক শুক্রবারে আমার বউ মিষ্টুনিকে কেউ বা কারা রেপ করেছিল, তারপর থেকে নাকি আমি প্রতি শুক্রবারেই বস্তিটার চারপাশের ডাস্টবিন বা কানাগলিগুলোয় মানুষ খুন করি, কল্পনা করি কোনো মেয়েকে রেপ করা হচ্ছে, দিয়ে তাকে বাঁচাতে খুন করি, পুরো উদ্দেশ্যহীন খুনি যাকে বলে।

এসব শুনেই নিজেকে আত্মা-আত্মা মনে হলো, মনে হলো গীতার কথা শুনছি, ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনতাম, মনে হলো আমার কোনো জন্ম মৃত্যু নেই, আমি কেবল শাস্তি দিতে জন্মেছি, ভুল শোধরাতে জন্মেছি…

আমি জোরে হেসে ফেললাম। 

বুড়োমত জাজটা ভ্রুকুটি করলো, আমি বললাম, “ধর্মাবতার, আমি নিশ্চয় জেলে থাকবো, আমার সাথে যারা থাকবে তারাও কারো খুনী, ধর্ষক, বা আরো ভয়ানক কিছু…”

কালো কোট পরা একজন চেঁচিয়ে বলল, কি বলতে চাও তুমি? 

আমি ফের মুচকি হাসলাম, লোকটা বড্ড কথা বলছে, পানওয়ালাটার মতো।

হেসে বললাম, “আমার চপারটা জেলের ভিতর পাওয়া যাবে, স্যার?”
0

অণুগল্প - হিমাংশু চৌধুরী

Posted in


অণুগল্প


সঙ্গী
হিমাংশু চৌধুরী 
 

বাবার ঘরের কাছে আসতেই বাবার শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। "কার সাথে কথা বলছো?" ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম।

"তোর মায় আইসিলো," বাবার চোখমুখ অদ্ভুত চকচক করছে, "আমার পাশে শুইয়া কত্তডি না চক্ষের জল ফ্যালাইলো। কাইন্দা কাইন্দা কইলো, আমার আর একা একা ভালো লাগতেছে না, তুমি জলদি আসো আমার কাছে।"

মা মারা গেছে প্রায় মাসতিনেক হলো। ক্যানসার। লাস্ট স্টেজে ধরা পড়েছিলো। মা চলে যাবার পরে পরেই বাবারও স্ট্রোক হয়ে ডানদিকটা প্যারালিসিস হয়ে যায়।

"কি উল্টোপাল্টা বকছো তুমি?" আমি একটু কড়া ভাবেই বলি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর থেকেই বাবা একটু কেমন যেন হয়ে গেছে।

"বিশ্বাস হয়না? দ্যাখ, আমার ডাইনদিকটা তার চখের জলে ভিইজ্যা গ্যাছে গিয়া।

সত্যিই বাবার গেঞ্জির ডানদিকটা বেশ ভেজা, দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, তাহলে সত্যিই কি... কাছে গিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাঁদিকের বেডসাইড টেবিলে জলের গ্লাসটা উলটে পড়ে আছে।

"ধূর, তুমি নিশ্চয়ই জল খেতে গিয়ে গেঞ্জি ভিজিয়েছো।"

"নারে, সইত্য কইতাছি, এগুলান তর মায়েরই চক্ষের জল। তর সাড়া পাইয়া তাড়াতাড়ি ঐ ফটোর মইধ্যা গিয়া সেঁধাইলো।" অসহায় কন্ঠে বাবা আবার বলে, "আর দ্যাখনা, জল পড়ছে বাম দিকে, কিন্তু আমার ডাইনদিকডাই তার চক্ষের জলে ভিজছে।"

কথাটা অবশ্য যুক্তিপূর্ণ, কিন্তু তাও কি হয়? সত্যি, হতে পারে এমনটা? মা'র কথা মনে পড়ে আমারও চোখে জল চলে আসে। তিনমাস হয়ে গেলো মায়ের স্নেহশীল হাতের পরশ পাইনা, আমারও বুকটা হুহু করে ওঠে। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি ফটো থেকে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মা। মৃত্যুর তিনমাস আগে তোলা। মাথায় একঢাল কালো চুল। এত জীবন্ত, মনে হচ্ছে, এক্ষুণি বলে উঠবে, "আর দুগা ভাত দিমু তকে? ভালো কইরা খাওয়া দাওয়া করস না ক্যান?"

চোখের ভুল কিনা কে জানে, মনে হলো সত্যিই ফটোটা একটু দুলছে।

হঠাৎ ফটোর পিছন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একটা টিকটিকি, এমনভাবে জেট গতিতে সে দেয়ালের কোণের দিকে দৌড় দিলো যে মনে হলো যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে। হাঁফ ছেড়ে আমি বাবার দিকে এগিয়ে যাই। বুড়ো বয়সে একা থাকে সারাদিন, শয্যাশায়ী। চল্লিশ বছরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী মারা গেছে, তার কথা মনে তো পড়বেই। ডিপ্রেশন তো হবেই, ভুল দেখাটাও অস্বাভাবিক নয়।

বাবাকে বসিয়ে বিছানাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি, ওমা, বাবার বালিশের ডানদিকে কয়েকটা লম্বা কালো চুল, প্যারাশুট লাইট হেয়ার অয়েলের হালকা ফুলেল গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

মায়ের খুব যত্নের ছিলো এই চুল। মারা যাবার দিন অবধি একটাও চুল পাকেনি, তবে শেষ তিনমাসে কেমোথেরাপি চলার সময় শীতের পাতা ঝরার মতো চুল পড়ে যাচ্ছিলো। ক্যানসারের থেকে বেশি কষ্ট মা পেয়েছিলো এই চুল পড়ে যাওয়ায়।

বাবা দেখি আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আমায় বললো, "তয়?"
0

অণুগল্প - বন্দনা মিত্র

Posted in


অণুগল্প


কষ্ট
বন্দনা মিত্র 


উদ্যত শিশ্নের মতো এক সারি তীক্ষ্ণ ঋজু পর্বত শিখর আকাশের যোনিচ্ছেদ বিদ্ধ করে সরল সটান।

আকাশের জানুদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কুমারী শোণিত, পাহাড়ের পুরুষ শরীর কুমারী রক্ত মেখে তৃপ্ত হয়।

আর কষ্টে মরে যেতে যেতে দাঁত চেপে আর্তনাদ গিলে নেওয়া হাওয়া চুপিচুপি এই নিষিদ্ধ গল্পটা বলে যায়, যারা শুনতে পায় তাদের কাছে। মেয়েটি শোনে।

এইসব সময়ে মেয়েটির তলপেটে খুব ব্যথা করে, ওক ওঠে, ভীষণ আতঙ্কে নিজেকে বন্ধ করে রাখতে চায় ঘরের সীমানায়। আবছা মনে পড়ে নার্সারি স্কুলে শীতের ছুটি, বাবার বসের বাড়ি পার্টি, হৈ চৈ, কাচের বোতল থেকে গলায় ঢেলে আঙ্কেলরা সবাই কি খাচ্ছে, কি সুন্দর মিষ্টি গন্ধ! বাচ্ছারা চাইলে দিচ্ছে না, বলছে “তোমাদের খেতে নেই, অরেঞ্জ জ্যুস খাও।” 

সিনহা আঙ্কেল চুপিচুপি বলেছে ওই মিষ্টি শরবতটা ওকে একা খাওয়াবে, এখন নয়, একটা মজার খেলার পরে, ছাদে গিয়ে খেলতে হবে খেলাটা।

তারপর সব কেমন অন্ধকার, স্বপ্নের মতো - ছাদের ওপর আবছায়া একটা ঘর, সিনহা আঙ্কেলের আঠালো, ঘাম ঘাম, ঝাঁঝ ঝাঁঝ সুন্দর গন্ধ, দম আটকানো ওজনের ভার, ড্রাকুলার মতো ধারালো দাঁত, আর ঐ জায়গাটায় কি কষ্ট, কি রক্ত - বন্ধ হয় না কিছুতেই। মনে পড়ে সেই নতুন গোলাপী সিল্কের ফ্রক, ছেঁড়া লেস, মায়ের কান্না, বাবার সাবধানী, সতর্ক স্বর – “চুপ চুপ, আমাদের কম্পানীর ডিরেক্টর – জানাজানি হলে চাকরি চলে যাবে। আর কিছু মনে নেই, জানতে চাইলে মা বলে “ ও কিছুনা, তুই রোদ লেগে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলিস, চোট লেগেছিল। 

ফ্রকটা তারপর কি যে হল কে জানে – আর কখনও পরেনি তো !

মধুচন্দ্রিমা যাপনে আসা তরুণ স্বামীটি বুঝতেই পারে না বউ কেন সহ্য করতে পারেনা তার প্রিয় ব্রুট পারফিউম, পরতে চায় না তার কিনে দেওয়া নেট বসানো গোলাপী সিল্কের নাইটি। আর সবচেয়ে আশ্চর্য দার্জিলিং এ এসেও কেন দেখতে যেতে চায় না সানরাইজ! 



0

অণুগল্প - হিমাংশু চৌধুরী

Posted in


অণুগল্প


ক্ষিদে
হিমাংশু চৌধুরী 


স্টেশন চত্বরে হাজার মানুষের ভিড় থাকলেও ঠিক চোখেচোখে কথা হয়ে যায়। কোমড়ের মোচড়ে, চোখের ইশারায়, ভুরুর নাচনে, আর তুলে ধরা আঙুলের সংখ্যায় যে বলছে আর যে শুনছে- দুজনেই বুঝে যায় যা বোঝার।

সামনের জন হাঁটা মারে তারপরে। একটু এদিক ওদিক দেখে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা চেটে নিয়ে পিছনের জনও। জন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে সোজা চলে যায় তারা, জল কেটে বেরিয়ে যাওয়া ছিপ নৌকার মতো, কোন ঘাট বা আঘাটায় গিয়ে যাত্রা শেষ।

অন্ধকার গলির শেষমাথায় একটা ছোট লজ। আলো আঁধারি রিসেপশনে চলতা ওঠা প্লাইউডের টেবিলের পিছনে বসে থাকা নিস্পৃহ টাকমাথা দেখেও না দেখার ভাণ করে, তবে, অবহেলায় ফেলে যাওয়া নোটদুটো ড্রয়ারে ঢুকিয়ে নিতে দেরী করেনা। নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদের উপর ছোট ছোট ঘর পাশাপাশি। কাঠের পার্টিশন। দরজার পিছনে তিনটে হুক। চাইনিজ সি এফ এল ল্যাম্পের সাদা কিন্তু আবছা আলো অন্ধকারটাকেই যেন আরও ঘন করে তুলেছে। একটা টুলের উপর প্লাস্টিকের জলের জাগ। কোণের দিকে একটা দু'ফুট বাই দু'ফুট জায়গা ঘিরে রাখা, ভিতরে এক বালতি জল, একটা হাতল ভাঙা প্লাস্টিকের মগ। তক্তপোষের উপর তেলচিটে বিছানায় অজস্র ছোপ ঢাকা পড়ে আছে সস্তা রঙিন ফুলেল চাদরে। তার উপরে টাইম বাঁধা আদিম খেলা।

কেউ কোনও কথা বলে না, কিছু চাপা শীৎকার ধ্বনি শুধু শোনা যায়। কাজ শেষ হয়। ক্ষিদে মিটলে ছেড়ে রাখা প্যান্টের হিপপকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে টাকা গুণে দিয়ে পুরুষটি বিদেয় হয়। একটু তাড়াতাড়ি পা চালালে নটা বারোর ক্যানিং এখনও পাবে।

নারীটি ধীরে সুস্থে ওঠে। তার জন্য সারারাত পড়ে আছে। তাঁতের মাকুর মতো স্টেশনচত্বর আর এই লজ করতে হবে। কাল সকালে আবার সব গুছিয়ে নিয়ে লক্ষ্মীমন্ত বৌয়ের মতো যেন নার্সিংহোমে আয়ার ডিউটি করে বাড়ি ফেরা। রান্না বান্না। স্কুলে পড়া মেয়েটা বাড়িতে শাশুড়ির কাছে আছে।

পাশের ঘরেও দরজা খোলার আওয়াজ হয়। একটা পায়ের শব্দ নেমে যায় সিঁড়ি দিয়ে। তারপরে আর কোন শব্দ নেই, শুধু দূরাগত কোলাহল, বাসট্রামের চলাচলের অনিবার্য আওয়াজ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো শোনা যায়, অথচ শোনা হয়না। নীরবতা ভেঙে মেয়েটা প্রশ্ন করে, "মালতী, খেয়িচিস? না হলে চল কিছু পেটে দিয়ে আসি এইবেলা। ক্ষিদে পেয়েছে।"
0

অণুগল্প - সৌরভ রায়

Posted in


অণুগল্প


মানত
সৌরভ রায়



ঠাকুরঘরে কৃষ্ণনাম জপ করতে করতেই সুহাসিনীদেবী টের পেলেন যে বিলু চুপচাপ তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বিলুটা বরাবরই বড্ড ন্যাওটা তাঁর। একটু বাদেই পুজো হয়ে গেলে দু’টি বাতাসা বা নকুলদানা যতক্ষণ না তিনি দেবেন, ততক্ষণ বিলু ঐভাবেই চেয়ে থাকবে। তাড়াতাড়ি মন্ত্র জপের গতি বাড়িয়ে দিলেন সুহাসিনীদেবী।

মোহরগঞ্জের দীননাথ মুখুজ্জের বাড়িতে ভাদ্রকালীর পুজো বলে কথা, সারা গাঁ যেন ভেঙে পড়েছে। সকাল থেকে বাড়ির বড়মা অর্থাৎ দীননাথ বাবুর স্ত্রী নিজের হাতে পুজোর সব দেখাশুনা করছেন। তাঁদের একমাত্র নাতি, বংশের সলতে বিশ্বনাথ দু'মাস ধরে প্রবল জ্বরে শয্যাশায়ী। হোমিওপ্যাথি-অ্যালোপ্যাথ-কবিরাজী-তাবিজ-মাদুলি কিছুতেই সে আর সারে না। শেষে কুলপুরোহিত বিধান দিলেন ভাদ্রমাসের অমাবস্যায় দক্ষিণাকালীর কাছে কুচকুচে কালো একটি নধর নিখুঁত পাঁঠা বলি দিলে এই মারণজ্বর থামবে।

কালু ঘোষের ছোট্ট মেয়ে কালিন্দীর খুব মনখারাপ। সকাল থেকেই তাঁদের কেষ্টকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেষ্টর মা কেষ্ট জন্মানোর পরপরই মারা গিয়েছিল। নিজের হাতে খাইয়ে দাইয়ে কেষ্টকে বড় করেছে কালিন্দী। কেষ্ট নামটাও ওরই দেওয়া। ওরকম কুচকুচে কালো রং, টানা টানা চোখ। উফফ কেষ্টকে খাওয়ানো কি চাট্টিখানি কথা! সেই কেষ্ট আজ চারবছরের জোয়ান, অভাবের সংসারেও কেষ্টর জন্য কোনো অসুবিধে হয়নি কোনওদিন, ওর খাওয়ার ব্যবস্থা কালিন্দীই করেছে বরাবর। রোজ সকালে কচি কচি কাঁঠালপাতা নিয়ে আসত কেষ্টর জন্য।

"মা―মা―" রবের মাঝখানে সিঁদুরমাখানো খাঁড়াটা তীব্রবেগে নেমে এল। ধড়টা একবার ঝটকা মেরেই থেমে গেল চিরতরে। এক মুহূর্তের জন্য পাঁঠাটার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন সুহাসিনীদেবী, বড্ড মায়াময় চোখদুটো, কিন্তু ঠাকুরের সামনে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকা বিলুর চোখদুটোর কাছে এর মূল্য কিছুই না।

কালু ঘোষ আজ অনেকদিন বাদে শান্তিতে ঘুমোলেন। দেড়বিঘা জমি সেই বাপের আমল থেকে বন্ধক ছিল মুখুজ্জেদের কাছে। নিজের জমিতেই বাবাকে ভাগচাষী হয়ে থাকতে দেখেছেন জন্মাবধি। নাঃ, আজ থেকে ওই জমির মালিক আবার কালু ঘোষ নিজেই। একেই বলে কপাল, নাহলে পাঁঠার কি আর অভাব গ্রামে? কিন্তু ওই কুচকুচে কালো, বিলুর বয়সী অর্থাৎ চার বছরের, নিখুঁত পাঁঠা আশেপাশের গ্রাম মিলিয়েও ওই একটিই ছিল। মেয়েটা কাঁদছে সকাল থেকে, খায়নি কিছুই, ও দু'দিন বাদে ঠিক হয়ে যাবে সব।

বিলু আর ওঠেনি কোনোদিন। সম্মিলিত "মা―মা―" রবের মাঝখানে তার শেষ "মা―" ডাকটা কারোর কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। ঠাকুরের আশীর্বাদী ফুল নিয়ে বিলুর মাথায় ছোঁয়াতে গিয়ে সুহাসিনীদেবী দেখলেন চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে।

কিন্তু ঠাকুরঘরে রোজ দুপুরে বাতাসা খাবার জন্য তাঁর দিকে চেয়ে থাকে বিলু। তড়িঘড়ি জপ শেষ করে ছোট্ট প্লেটে বাতাসা আর নকুলদানা সাজিয়ে নাতির ফটোর সামনে রাখলেন সুহাসিনীদেবী।
7

অণুগল্প - সরিতা আহমেদ

Posted in


অণুগল্প


মিমির বড় হওয়া
সরিতা আহমেদ


বেলা ৯টায় ঘুম ভাঙতেই মিমি টের পেল বাড়িটা থমথমে। মা-বাবান-দিদুন কেউ নেই, মিতুলটার সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। টয়লেট থেকে বেরিয়ে সোনাদাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মনে পড়ল আজ শনিবার। ইস, যদি আর একঘণ্টা আগে উঠত তবে হয়তো সবার যাওয়াটা সে যে করেই হোক আটকাতে পারত।
মিতুলকে নতুন স্টিকার বক্সটাও না হয় দিয়েই দিত, পোকেমন না দেখে বাবানের দেওয়া সবগুলো অঙ্কও না হয় করেই ফেলত, যত বিচ্ছিরিই লাগুক নাকমুখ টিপে সকালে দুধ আর লাঞ্চে মাছভাত খেয়েও নিত, তাতেও না হলে মিথ্যে মিথ্যে পেট ব্যাথার বাহানা তো ছিলই – তবু ওদের আটকানো তো যেত। ইস, কেন যে এত ঘুমাল সে! আসলে কাল স্কুলের ঘটনাটা নিয়ে মা এত বকাবকি করল যে তার কান্না পেল ভীষণ, আর কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুম এসে গেল বুঝতেই পারল না। হয়েছিল কি, ওদের ক্লাসের কিছু মেয়ে একটা লিফলেট নিয়ে বেজায় হল্লা করছিল। মিমি সেটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে বিচিত্র একটা আবেদন – “শ্রী শনি মহারাজ আবির্ভূত হয়েছেন কোকলামারির মাঠে। প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে এক সিদ্ধপুরুষের আশ্রমে নিয়েছেন ঠাঁই। ভক্তদের সব সমস্যার সমাধান এসে গেছে । তন্ত্রসাধক গাছবাবার কাছে মিলছে ফল। আগামী শনিবার এক বিরাট ধর্মচক্রে সামিল হতে দলে দলে যোগ দিন। হাতেনাতে ফল ১০০% গ্যারান্টি। যত পারেন এই প্রচারে সামিল হন। অবিশ্বাস করলেই শনির প্রকোপ নিশ্চিত, সাক্ষাৎ মৃত্যু...” পড়ার পর মিমি খুব হাসল, তারপর রিদ্ধিমার হাঁ হওয়া মুখের দিকে চেয়ে বলল ‘তোরা এসব ঢপে বিশ্বাস করিস? এই আমি লিফলেট ছিঁড়লাম, দেখি তো কি হয়!’ সবাই হাঁ-হাঁ করে তেড়ে আসার আগেই সে সবক’টা লিফলেট ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলে দিল। রিদ্ধিমার সেকি ভয় ! ঘটনাটা এতটাই চমকপ্রদ যে বাড়ি ফিরে কাকে বলবে ঠিক করতে পারছিল না। মিতুল তো ছোট, বুঝবেই না। এদিকে চেপে রাখাও যাচ্ছে না। অগত্যা মা-কে সবটা বলতেই সেকি বকুনি! বেচারি মিমি কি জানত ওই আশ্রমে যাওয়ার প্ল্যান মা আগেই করে রেখেছে!
জলখাবার খেয়ে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে যাবে এমন সময় জিদানের ফোন। জিদানের সাথে মিমির খুব ভাব। আগে একই পাড়ায় থাকত জিদানেরা, এখন দিল্লীতে। ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের জমানো কথা দুইবন্ধু শেয়ার করে ।মন খারাপের কথা জিদানকে জানাতেই সে কনফারেন্স ক’লে টুবাইকে ডেকে নিয়ে একটা অভিনব প্ল্যান বানাল।
তখন বেলা ১১টা। প্ল্যান মতো টুবাইকে সাথে নিয়ে মিমি সোনাদার চোখ এড়িয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। একটা অটো ধরে সোজা কোকলামারির মাঠ। যথারীতি প্রচুর ভিড় হয়েছে। আশ্রমটা ছোটখাট, তবে ঘুপচি ঘর বেশক’টা। সিদ্ধিপুরুষ ‘গাছবাবা’ ইয়াবড় জটা এবং গেরুয়া বসন পরে ভক্তদের সমস্যা শুনছেন আর একটা কাগজে কিছু লিখে পাশের কামরায় যেতে বলছেন। ব্যাপারটা খানিকক্ষণ লক্ষ্য করে চুপিচুপি সেই ঘরের পেছনের জানলার কাছে মিমিরা পৌঁছে গেল। চারদিকের উচ্চকিত শব্দ ও মন্ত্রধ্বনির চোটে কেউই তাদের খেয়াল করল না। তারপর টুবাইয়ের কাঁধে চেপে জানলার ফাঁক দিয়ে ভেতরের সব দৃশ্য দ্রুত মোবাইল ক্যামেরায় বন্দী করল মিমি ।
দুপুর ২টোয় লাঞ্চে সবাই যখন খেতে বসেছে, তখন মিমি গম্ভীর মুখে বাবানের হাতে মোবাইলটা দিল। বাবান অবাক হয়ে একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগলেন – কোনওটায় বাচ্চাদের দিয়ে রাসায়নিক কিছু মেশাবার আদেশ দিচ্ছে এক সাধু, কোনোটায় এক সাধু দাড়ি-পরচুলা লাগিয়ে সাজছে, কোনোটায় এপ্রোন পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে একজন কেউ বিভিন্ন ওষুধের গুঁড়ো মেশাচ্ছে বাবাজীর ‘জলপড়া’য়, কোনোটায় দুটো বাচ্চা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। দেখতে দেখতে বাবানের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, একে একে সেই গম্ভীরভাব ছড়িয়ে পড়ল সবার মুখে। মায়ের মুখে কথা সরল না। অনেকক্ষণ বাদে মিমি বলল, “মোবাইলটা কিনে দেওয়ার একটা শর্ত ছিল, আমি যেন বাজে কাজে না ব্যবহার করি। কিন্তু আজ তোমরা যে একটা বাজে জায়গায় ভরসা করে গেলে, তার বেলা!”
কথা শেষ হতেই ছোট্ট মিতুল কিছু না বুঝেই ফিক করে হেসে ফেলল, আর সেটা ছড়িয়ে পড়ল বাকিদের মুখেও। তারপর মিমিকে কোলে বসিয়ে বাবান বললেন “প্রাউড অফ ইউ, বেটা।” আর দিদুন তার গাল টিপে বললেন “সত্যি তো, এ আমাদের অন্যায়ই হয়েছে। বুঝতেই পারিনি আমার দিদিভাইটা কত্ত বড় হয়ে গেছে!”
1

অণুগল্প - দেবলীনা দাস

Posted in


অণুগল্প


ম্যাজিকওয়ালা
দেবলীনা দাস




“একটা ম্যাজিক করে দাও তো দেখি।”

লোকটা কেলে হাঁড়ির মধ্যে একটা বাখারির টুকরো দিয়ে ভাত নাড়ছিল। মিনির গলার আওয়াজে মুখ তুলে চেয়ে সাদা দাঁতে হাসে, বলে, “কি ম্যাজিক দিদি?” টিয়া মিনির আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে। এ গাঁয়ে নতুন সে, আজ প্রথম ম্যাজিকওয়ালার নাম শুনেছে। তার কাজেই আজ আসা এখানে। মিনি জোর করে এনেছে - ম্যাজিকওয়ালা নাকি তার বন্ধু।

পাশে উবু হয়ে বসা মিনি তখন বলে চলেছে, “আমার এই বন্ধুটা গো। অংককে কি ভয় পায়। গত বার টেনেটুনে পাশ করে গেছিল। এবার তো এক্কেবারে ফেল!”

লোকটি গোলগোল চোখ করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রতিধ্বনি তোলে - “এক্কেবারে ফেল?” লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে টিয়ার। কিন্তু লোকটা বলে, “আমি ইতিহাসে ফেল করতাম। বাবরের বাবার নাম বিদ্যাসাগর লিখে একবার এইসা মার খেয়েছিলুম!” মিনি মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বলে, “এ:, খুব বোকা ছিলে তো তুমি! বিদ্যাসাগর কারোর বাবা হতে যাবেন কেন? আর বাবরের বাবার নাম তো, বাবরের বাবার নাম - যাকগে, সে ছাড়ান দাও। একটা অংকে পাশ করার ম্যাজিক করে দাও তো।

ভাত টিপে দেখতে দেখতে মাথা নাড়ে লোকটা। বলে, “ও ম্যাজিক খুব কঠিন দিদি। সব চেয়ে কঠিন।”

বন্ধুর সামনে অপদস্থ হওয়ার আশংকায় রেগে যায় মিনি। বলে, “সব চেয়ে কঠিন কি করে হয়? তুমি তো সেদিন বললে, মরা জিনিস বাঁচিয়ে তোলার ম্যাজিকটা সব চেয়ে কঠিন। সেই যে যেদিন পায়রাটা নিয়ে এলাম তোমার কাছে?”

ভাতের হাঁড়ি ধরে নামাতে নামাতে লোকটা ফিরে চায়। কেমন দু:খ দু:খ মুখে হেসে বলে, “মরা মানুষ বাঁচানোর ম্যাজিক জানলে কি আমি এখানে এরকম চালচুলোহীন পড়ে থাকতাম দিদি? আমার আমিনা, ছোট্ট ইমরানকে ফিরিয়ে আনতাম না, ঘর করতাম না সুখে?”

মিনি আর টিয়া ভেবলে যায়। মরে যাওয়ার ব্যাপারটা ধোঁয়াশা তাদের কাছে - কেন মরে যায়, কোথায় চলে যায় মানুষ, তারা জানে না। জানে না আমিনা কে, ইমরান কে, জানে না ম্যাজিকওয়ালার ঘর কোথায়। পুকুরের পাশের এই দরমার কুঁড়েতে নাওয়াখাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু ছাড়া তাকে পাওয়া যায় না। মিনি জ্ঞান হয়ে ইস্তক এরকমই দেখেছে। বড়দের মধ্যে কেউ কেউ রহিমমাস্টার ডাকতেন ম্যাজিকওয়ালাকে, কিন্তু সে নাম হারিয়ে গেছে কবে কোথায়। তারা ছোটরা ডাকে ম্যাজিকওয়ালা। জাদু টুপি, রঙিন রুমাল, জীর্ণ তাসের পাতার ম্যাজিকওয়ালা।

লোকটার চোখ এড়ায় না মেয়ে দুটোর ভেবলে যাওয়া। ভাতের মাড় গালতে গালতে সে বলে, “আমি একটা ম্যাজিক করতে পারি দিদি।

চুপসে যাওয়া মিনি একটু উৎসাহ ফিরে পায়। বলে, “বলো কি ম্যাজিক?”

ভাতের হাঁড়ি পাশে নামিয়ে রেখে গামছায় হাত মুছতে মুছতে লোকটা বলে, “আমি অংক শিখিয়ে পারি দিদি তোমায়। শিখবে?”




টিয়া অংক শিখেছিল ম্যাজিকওয়ালার কাছে। গঞ্জের অফিস থেকে ফিরে বাবা সন্ধেবেলায় তার পড়া নিয়ে বসতেন। তিনি পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতেন টিয়ার উন্নতি দেখে। কিন্তু গোল বাঁধত ক্লাসে। অংকের দিদিমণির মেজাজ আর বকাকে যমের মত ভয় করত টিয়া, আর ভয়েই ভুল করত। ভুল করলে বকা খেত, সেই ভয়ে আরো ভুল। একটা ভুলভুলাইয়ায় আটকে পড়ত সে বারবার। চোখ মুছতে মুছতে একদিন তাই বলে ফেলেছিল ম্যাজিকওয়ালাকে - “আমি স্কুলে গেলেই সব অংক ভুল করে ফেলি ম্যাজিকওয়ালা। তোমার কাছে, বাড়িতে সব অংক পারি, কিন্তু সীমা দিদিমণিকে দেখলেই আমার সব ভুল হয়ে যায়। খুব ভয় করে গো।” 

ঝলমলে হেসে ম্যাজিকওয়ালা এক আঙুল তুলে বলেছিল, “আরে এইটা তো সহজ! ভয় কাটানোর ম্যাজিকটা সব চেয়ে সহজ। দাঁড়াও।”

টিয়ার হাতে একটা ছোট্ট কাগজের পুরিয়া দিয়েছিল ম্যাজিকওয়ালা। বলেছিল, “এ পুরিয়া কক্ষনো খুলবে না দিদি। তোমার বাড়িতে এ জিনিস থাকলে যেখানে যতই ভয় পাও, তোমার অংক - অংক কেন, ইতিহাসও - কক্ষনো ভুল হবে না।” ইতিহাসের নাম শুনে মিনিও নিয়েছিল একটা। বাবর আকবর কে কার বাবা সব তার গুলিয়ে যেত কিনা। সত্যি আর অত ভুল হত না তারপর থেকে। এক সময়ে অংককে ভালবাসতেও শিখে গিয়েছিল টিয়া। সেই পুরিয়ার ভরসায় অংকে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিল কলেজে।

আজ বুজাইয়ের পরীক্ষার সকালে সেই পুরিয়া ছেলেকে ছুঁইয়ে দেয় টিয়া। বলে, “কিচ্ছু ভুল হবে না দেখিস। যতই ভয় পাস।” বুজাই ঢোঁক গিলে বলে, “হবে না মা?” টিয়া দৃঢ় মাথা নাড়ায়, “না হবে না। আমার হয়নি কখনো। এটা ম্যাজিক।”

লাফাতে লাফাতে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে যায় বুজাই। টিয়ার হাতের মুঠোয় ধরা থাকে ম্যাজিকওয়ালার পুরিয়া। খুললে দেখা যাবে, তার মধ্যে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটা নাম - “টিয়া।” তার নিচে নতুন সংযোজন, টিয়ার হস্তাক্ষরে - “বুজাই।” নিজের ওপর বিশ্বাসটাই আসলে সব চেয়ে বড় ম্যাজিক।
1

অণুগল্প - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


অণুগল্প


তন্দুরি
সরিৎ চট্টোপাধ্যায় 



মাজুলির কাসিম আলি বক্সিং করত। শিবা থাপার সঙ্গে শ্যাডো করার জন্য ডাক পড়ত ওর। 

আকাশে একটা শকুন ঘুরছে। ওর নজরে উন্মত্ত জলরাশির মাঝে একখণ্ড জমি। তার ওপর তিনটে একচালা। আর কয়েকটা মানুষ।

আজ চোদ্দদিন ওরা এই দ্বীপটায় আটক হয়ে আছে। ওরা বাইশজন। বেশিরভাগই অক্ষম, জরাগ্রস্ত। আসামের এই জায়গাটা আগেও একটা দ্বীপ ছিল। এখনও তাই আছে। শুধু আয়তনে এখন সেটা আগের মাত্র এক শতাংশ। বাকিটা ব্রহ্মপুত্র ফি-বছরের মতো আত্মসাৎ করেছে। একটা নিমগাছ শুধু ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে। যথার্থ বুদ্ধিজীবির মতো এতকিছুর মধ্যেও তার কোনও হেলদোল নেই।

কাসিম পালাতে পারত। কিন্তু মণিআপা আর আব্দুলদাদানকে ছেড়ে ও যায়নি। 

আজকের রাতটা যেন অশুভ। তার নিঃশ্বাসে বিষ! পাঁচটা ছায়াশরীর অন্ধকারে প্রেতাত্মার মতো কী যেন মন্ত্রণায় ব্যস্ত। বারোদিনের অনাহারক্লিষ্ট পাঁচজোড়া চোখ আজ উন্মাদ, উন্মত্ত।

নিভে আসছে আব্দুলের জীবনপ্রদীপ। কাসিম পাশে বসে বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধ প্রবল শ্বাসকষ্টের মধ্যেও বলছে, যা কইসি তাই করিস কিন্তু দাদুভাই! ... তুদের ... যে করেই হউক ... বাঁচতেই হবে!

চতুর্দিকে দুর্নিবার ফেনিল জলরাশি! সদ্যবিবাহিতা জিয়া নিজের চোখে দেখেছে ওর স্বামীকে ভেসে যেতে। আজ মাঝরাতে অন্ধকারে একলা শুয়ে কাঁদছিল ও। কাসিম ধূমায়িত মাংসের আধপোড়া টুকরোটা নিয়ে পাশে এসে বসল। মৃদু স্বরে বলল, খাই লও! 

রাক্ষুসীর মতো টুকরোটা ছিনিয়ে নিল জিয়া। আজ দশদিন পর মুখে প্রথম কোনও খাবার পড়ল ওর। কিন্তু তিনকামড়েই শেষ হয়ে গেল। দ্বিধামেশানো চোখে ও কাসিমকে জিজ্ঞাসা করল, আর নাই?
: না। 
: কুথায় পেলি?
: ইখানে কুন গরু বা শুয়োর দ্যাখছিস?
: না। 
: ফের সওয়াল করিস নে। শুয়া পড়। 

আরও দু'দিন পর মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত্ বিসওয়াল হেলিকপ্টারে রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতি জরিপ করতে বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে দুই দেহরক্ষীর পাশে গুয়াহাটি দূরদর্শনের দু'জন সংবাদ কর্মী। ছোট্ট দ্বীপটায় ওরা হাত নাড়ছিল। হেমন্ত্ একজনকে মনে হলো যেন চিনতে পারলেন। ঠিক, ছেলেটা পুরস্কার নিয়েছিল ওঁর হাত থেকে। 
: একবার নামা যাবে?
: এক বস্তা আলুও তো নেই স্যার। রিস্ক হয়ে যাবে!
: হোক! ভাবো ন'টার নিউজে যখন দেখাবে তখন কী রেসপন্স হবে। পাইলটকে বলো, আমি নামব। 

ওরা নামতেই এগিয়ে এল উনিশজন। 
হাতজোড় করে মুখে অনাবিল হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলেন হেমন্ত বিসওয়াল। ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটাফট ছবি উঠছে। কাসিমের প্রথম ঘুঁসিটা পড়ল ঠিক ওঁর চোয়ালের ডগায়। প্রথমবারেই নকআউট পাঞ্চ। প্রথম দেহরক্ষী রাইফেলটা উঁচু করারও সময় পেল না। জিয়াসমেত চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। দ্বিতীয়জন বেগতিক দেখে একলাফে উঠে পড়ল হেলিকপ্টারে। পাইলট বিপদ বুঝে টেক-অফ করার পূর্ব মুহূর্তে রিপোর্টার দু'জনও কোনওমতে ঢুকে পড়ল। চিৎকার করতে করতে উড়ে গেল ওটা। 

সেদিন রাতে পেট ভরে খেয়েছিল ওরা। মন্ত্রীর মাংস যে এত সুস্বাদু কে বা জানত। ভোরের আলো যখন ফুটছে তখন নরম মাটিতে পঞ্চম কবরটাতে মাটি চাপা দিচ্ছে ওরা। 

কাসিম জিয়াকে বলল, এবার আসবে ওরা। 
জিয়া পূবের আকাশের দিকে চোখ তুলে বলল, হ, জানি। 

দূরে দেখা যাচ্ছিল ওদের। চারটে গানশিপ। একটার পেটের তলায় দুটো মিসাইল বাঁধা। রক্তে রাঙানো আকাশে ধীরে ধীরে এদিকেই আসছিল ওরা। 

কাসিম জিয়ার মুখের দিকে তাকাল একবার। পেছনে ভয়াবহ ব্রহ্মপুত্র তার দূর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। 
: আমার হাতটা ধর জিয়া!
: কেন?
: এতসহজে হার মানব নি। মণিআপার কসম! আব্দুলদাদানের কসম!
: ই জলের তোড়! মরি যাব তো!
: রইলেও মরবি! চল্!

জোড়া মিসাইলদুটো যখন তাদের লক্ষ্যে এসে ফাটল তখন মোট সতেরোজন ছিল ওই মাজুলি দ্বীপটায়।
0

অণুগল্প - পলাশ কুমার পাল

Posted in


অণুগল্প


ফতনা
পলাশ কুমার পাল


ফতনার ওপর স্থির পলক। হাতটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্থির রাখতে চাইলেও পারছে না। ওদিকে ফতনা যেমন, তেমনই। জলের ওপর ভেসে আছে।

এইভাবেই একটা রবিবার কেটে যাচ্ছে। দু-চারটে মাছ পেলে দুপুরে আঁশের স্বাদ পাওয়া যেত। নাহলে ঐ আলুভাতে-বড়াভাজা-ভাত। উপার্জন তো তেমন করতে পারে না। এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনাই করে গেল কেবল। অন্যদের মতো টিউশনও পড়ায়নি, যে কিছু সঞ্চয়ে থাকবে। বাবার ঘাড়ে বসে খেয়েছে। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর মা-বাবা-নিজের তিনমুখের অন্ন জোগাবার ভার তার একার ওপর। তাও গ্রামে যাদের পড়ায় তারাও সবাই তেমন বেতনও দেয় না। অনেকে তো ফ্রীয়েই পড়ে যায়।

ফতনা নড়ে ওঠে। ঢুবে যায়। টান দেয় ছিপে। না, কোনও মাছ নয়। টোপ লাগিয়ে আবারও ছিপ ফেলে। ফতনাটা ভেসে থাকে।

মা বলেছে- "টোপের নাম করে ঘি-ময়দা নষ্ট করিস না!" মাছ না ধরতে পারলে ঐটুকুও লোকসান। এভাবেই ভেবে চলতে হয় তাদের তিনপ্রাণীকে। এখনও চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে। সেভাবে উপার্জনেও মন নেই। তাই তাকে ভাবতে হয়। অথচ তার সমবয়সীরা এখন প্রচুর রোজকার করছে। কেউ হয়তো মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে। সে? গতকাল প্রাইমারি ইন্টারভিউয়ের ফল বেড়িয়েছে। পাশ করতে পারেনি।

ফতনাটা খাবি খেতে থাকে। সময় নিয়ে জোরে একটান দেয়। না। মাছে টোপটা খেয়ে পালিয়েছে। আবারও টোপ লাগিয়ে ছিপ ফেলে।

ফ্যালফ্যাল করে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে। বয়স হয়েছে অনেকটাই। ছিপ ফেলে সময় নষ্ট করছে না তো? ঘরের দেয়ালটা এই বর্ষাতে পড়ে যেতে পারে। ঘর না করলেও নয়। কিন্তু অত টাকা তো নেই। বাবার জন্য ওষুধও আনার সময় দোকানদারকে বলে কিছু ওষুধ ছেঁটে আনতে হচ্ছে।

ফতনাটা কয়েকবার ঢোবা-ওঠা করতে করতে থেমে যায়। টান দেওয়া আর হয় না। ছিপ তুলে দেখে টোপটা নেই। আবারও টোপ লাগায়।

মনালের মুখটা ভেসে আসে। দু'মাস আগে গ্রামেরই পথে দেখা হয়েছিল। সিঁদুরে রাঙা মুখ। ভালোবাসলেও পাওয়া হয়নি। এখন সে সুখে-শান্তিতে আছে। বরকেও খুব ভালোবাসে। তাই পুরানো দিনের ছ্যাঁকাটা ভুলতে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। বেকার জীবনে এটাই তো স্বাভাবিক ভেবে বুকের কষ্টটাকে জানতে দেয় না কাউকে।

ফতনাটা খাবি খায় আবার। আবার টান দেয়। এবারেও হলো না। মাছ ধরেই কী হবে! মাছ ধরলে তাকেই তো বেছে-ধুয়ে ভাজতে হবে। মা তো জবুথবু। টোপটা জলে ছুঁড়ে দিয়ে ছিপটা গুটিয়ে নেয়। ফতনাতে আটকে রাখে কাঁটাগুলোকে।
1

অণুগল্প - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


অণুগল্প


স্পর্শক
সরিৎ চট্টোপাধ্যায় 


রোববার রোববার ওরা বাপ-ছেলেতে সকালের চা'টা একসঙ্গে খায়। অর্ণব এই সময় শুভ'র গোটা সপ্তাহের সব গল্প মন দিয়ে শোনে। ওর অফিসের খবর, নতুন অ্যাসাইনমেন্টের হাল-হকিকত, তিন্নির সর্বশেষ আবদারের কাহিনি। তিন্নি মেয়েটা বেশ ভালো। ডাক্তারি পাস করে এখন এমডির জন্য পড়ছে। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে চলে আসে, সুমিত্রার সঙ্গেও বেশ হইহই করে আড্ডা দেয়। হবু শাশুড়ি-বউ এখন থেকেই বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। সামনের মাঘে মনে মনে একটা তারিখও ভেবে রেখেছে অর্ণব। 

আজ কিন্তু শুভ কেমন যেন কিন্তু কিন্তু করছিল। অর্ণব শেষে বলেই ফেলল, কী বলবি বলেই ফ্যাল না! 

: বলছি। কিন্তু প্রমিস করো পেটাবে না। 

: তোকে শেষ পিটিয়েছি বোধহয় যখন তুই সেভেনে পড়তিস। নিচের সেনবাবুর গাড়ির সাইলেন্সারে আলু ঢুকিয়ে রেখেছিলি। তা, সেরকম কিছু করেছিস নাকি, আবার?

: উঁহু। 

: তবে?

: আমি আর তিন্নি ঠিক করেছি যে আমরা কিছুদিন এখন লিভ-ইন করব। 

: মানে!

: মানে এখনই বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না কারণ ওর কম করে আরও দেড়বছর লাগবে সেটল ডাউন করতে। এর মধ্যে ও বিয়ে করতে চায় না। 

: কেন? বিয়ে করলে অসুবিধেটা কোথায়?

: ও তুমি বুঝবে না। 

: বোঝাবার চেষ্টা কর। বুঝব না আগে থেকেই ধরে নিচ্ছিস কেন?

: আরে, বিয়ের পর হাজার ঝামেলা বাবা! প্রথমেই তো একমাস ধরে বারোভূতের নেত্য। তারপর নেমন্তন্নের হিড়িক, সব জায়গায় জোড়ে যেতে হবে। তার ওপর দুই বাড়ির আশা দুরাশা হতাশা ভাবাবেগের চাপ। ও পড়বেটা কখন? জাস্ট ইমপসিবল। 

: পয়েন্ট টেকেন। তাহলে বিয়ে করিস না, অপেক্ষা কর!

: অতদিন আমি পারব না। 


"কী নিঘিন্নি ছেলে রে বাবা! বাবার সামনে এইসব কথা কোনো ছেলে বলতে পারে! দ্যাখো, লাই দিয়ে দিয়ে কোথায় তুলেছ ছেলেকে!" সুমিত্রা যে কখন এসে আড়াল থেকে ওদের কথা শুনছিল, কে জানে। এখন আর থাকতে না পেরে একেবারে ফেটে পড়ল। "আর শুভ, লজ্জার মাথা খেয়ে তুই তোর বাবাকে এই কথাগুলো বলতে পারলি?"

: বেশ করেছে বলেছে। দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যে কেনো বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলবে এটাই তো স্বাভাবিক। সব ব্যাপারে বাবা ছেলের সম্পর্ক টেনে আনবে না তো!

: বেশ করব আনবো! অ্যাহ! কী ছিরির বাবা ছেলের সম্পর্ক! জম্মে কোথাও দেখিনি! হ্যাঁ রে, ওর বাড়িতে সবাই মেনে নিয়েছে? কিছু বলেনি?

: ওর বাবা বলেছেন, আগে রেজিস্ট্রিটা করে তারপর যা খুশি করোগে যাও। 

: মানে! রেজিস্ট্রি করার দেড়বছর পর বিয়ে করবি? এসব কী ইয়ার্কি হচ্ছে? যাক গে, সব এখন লায়েক হয়েছ, নিজেরা যা পারো করো, আমি এসবের মধ্যে নেই! 

: আরে, যাচ্ছ কোথায়? বসো বসো। শুভ, যা, তুই আরেকটা চেয়ার নিয়ে এসে বস এখানে। শোনো সুমিত্রা, ওদের কথাটাও ভেবে দ্যাখো। ওরাই বা এই দেড়বছর মিছিমিছি নষ্ট করবে কেন? লুকোছাপা করে করাটার মধ্যে কি কোনো গৌরব আছে? ওবাড়িতে সম্ভব নয়, এখানেও একই ব্যাপার, কোন উল্টোপাল্টা জায়গায় হোটেল-ফোটেল বুক করে ঝামেলায় পড়বে; তার চেয়ে এই বরং ভালো না? 

: তোমার মুখে কিছুই আটকায় না, না?

: দ্যাখো, বেশি চোখ রাঙিও না, বুঝেছ? দেবো ছেলের সামনে হাটে হাঁড়ি ভেঙে, ভালো হবে?

: চুপ! খবর্দার বলছি!

: হুঁ, পথে এস! তোমার সেই বান্ধবী নন্দিনীর শোয়ার ঘরটা মনে আছে তো? সবার কি আর তোমার মতো বন্ধু ভাগ্য হয়? 

: ইস্! চুপ করো প্লিজ! শুভ আসছে!

: আয়, বোস। এবার বল তোদের প্ল্যানটা কী? রেজিস্ট্রি করে নিবি?

: না করলে তোমরা ছাড়বে? আমরা পরস্পরে নিজেদের বিশ্বাস করি কিন্তু তোমরা তা' করো না। 

: বাই 'তোমরা' ইউ মিন দু' সেট মা-বাবা?

: ইয়েস!

: অবিশ্বাস করি কথাটা বোধহয় ঠিক না। বিয়েটা একটা এগ্রিমেন্ট, সেটা খাতায় কলমে না হলেও চলে। বিশ্বাসটাই আসল। 

: তাহলে অযথা রেজিস্ট্রির জন্য চাপ দিচ্ছ কেন?

: আমি তিন্নির কথা ভেবে বললাম। ওর মা-বাবার কথাটা ভাব, কিছু হলে তুই সামলে নিবি কিন্তু সমাজ ওকে সহজভাবে বাঁচতে দেবে না রে। 

: তোমরাই তো সমাজ। 

: হ্যাঁ, দোষটা আমাদেরই। কিন্তু দ্যাখ চেষ্টা তো করছি নিজেদের পাল্টানোর। আমি আমার মত জানালাম। যাক গে, তারপর নেক্সট এজেন্ডা?

: ভাবছি একটা ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাট ভাড়া নেব। ওর হাসপাতালের কাছাকাছি কোথাও। 

: আমি উঠলাম! তোমাদের মতো দু'কানকাটা বাপ-ব্যাটা আমি জীবনেও দেখিনি! চালিয়ে যাও! ছি!

সুমিত্রা রাগ দেখিয়ে ধমধম করে বেরিয়ে গেল। যদিও পেছন পেছন ভেসে আসা অর্ণবের গা জ্বালানো হাসিটা সবার অজান্তে এই বয়েসেও ওর গালদুটোয় ফাগের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। 

রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সুমিত্রা। তারপর কী যেন ভেবে তিন্নির নম্বরটা ডায়াল করে ও ধরতেই বলে উঠল, অসভ্য মেয়ে! তলে তলে এই বুদ্ধি! আমার ঘরেও জুটেছে সব সেইরকম! তুই আয় এবার তারপর দেখিস তোকে আমি কী করি!

: রাগ করেছ?

: হ্যাঁ, খুব!

: এদিকে মা দু'দিন থেকে কথা বলছে না। 

: বলা উচিতও নয়। আমি হলেও বলতাম না। 

: তুমি একটু বোঝাও না, প্লিজ!

: ও! তোর মা'কে বোঝানোর দায়িত্বও আমার! বেশ, বোঝাবো। তবে রেজিস্ট্রি করাটা কিন্তু মাস্ট। 

: কেন?

: সে তোর ছেলেপুলে হলে বুঝবি! 

: তোমরা সব বাবা-মা একরকম। একই ধাতু দিয়ে গড়া। 

: হ্যাঁ, সে জন্যই তো বললাম এখন বুঝবি না। 

: অলরাইট, মেনে নিলাম। আমি কিন্তু সিঁদুর-টিঁদুর পরবো না। 

: পরিস না। আমার নিজেরই পরতে ভালো লাগে না। কিন্তু এতদিনের অভ্যেস, ছাড়তেও পারি না। 

: কবে আসছ?

: দ্যাখ, আমি ছেলের মা। আমার একটা আত্মসম্মান বলে কথা আছে তো! 

: প্লিজ!

: আজ বিকেলে গেলে চলবে?

: দৌড়বে!

: কী খাওয়াবি?

: ম্যাগি?

: ধরে পেটাবো! ভালো কিছু রান্না করে খাওয়াবি। নাহলে, সব ক্যানসেল! বুঝেছিস?

: যো হুকুম শাশুমা! বাট অন ওয়ান কন্ডিশন ... 

: কী?

: ভাড়ার ফ্ল্যাটটা কিন্তু তোমায় এসে গুছিয়ে দিতে হবে। ওক্কে? বাই!


সুমিত্রা হাসতে হাসতে মোবাইলটা রেখে আলু ছাড়াতে বসল। রোববার সকাল মানেই যে সেই লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। মনে মনে ও এ ক'দিন ভেবেছিল, হোক না ডাক্তার মেয়ে, একটু তো হাতে হাতে এগিয়ে দেবে। তাহলেই হলো। 

যাক গে! ভালো থাকুক ওরা।
2

অণুগল্প - অনুষ্টুপ শেঠ

Posted in


অণুগল্প


বাঘ
অনুষ্টুপ শেঠ



স্কুল যাতায়াতের পথের ধারে, ভাঙা গাড়িটা পড়ে আছে আজ কত যুগ হলো। রঙ বহুলাংশে চটে গেছে, তাও বোঝা যায় এককালে মেরুন ছিল। তাতানকে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে ফিরতে ফিরতে মনীষা দেখে তোবড়ানো খাঁচাটার ধূলিধূসরিত গায়ে সদ্যকৃত পক্ষীকর্ম। টায়ারগুলো কবেই খুলে নিয়ে গেছে সুযোগসন্ধানীরা। হেডলাইটের ভাঙা কাঁচে রোদ পড়ে, মনীষার মনে হয় মরণাপন্ন এক বাঘ গুটিসুটি মেরে বসে ওর দিকে চেয়ে আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, চৈত্রের বেলাতেও চোরা শীত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।

মহাবলেশ্বরে প্রবল ঠাণ্ডা নেমে এসেছিল সন্ধ্যার পর। এতটা আশা করেনি দীপম আর মনীষা। সঙ্গে তাই যথেষ্ট গরম জামাকাপড় নিয়ে যায়নি। সুতরাং তড়িঘড়ি ডিনার সেরে ঘিরে ঢুকে জানলা দরজা এঁটে কম্বল-মুড়ি। মনীষার বুক দুরুদুরু করে উঠেছিল অন্য উষ্ণতার আশায়। বিয়ে হয়েছে মাত্র চারদিন, এখনও দুই শরীরের বিশদ পরিচয় হয়নি বললে ভুল হয় না। অনুষ্ঠানের হাঙ্গামা, তারপর বোম্বের ছোট ফ্ল্যাটে আত্মীয়দের ভীড়, কেমন যেন তাড়াহুড়ো হুট করে পেরিয়ে গেছিল প্রথম অভিজ্ঞতা। আজই সেই অর্থে প্রথম, চেনা অচেনা লোকের গণ্ডির বাইরে, শুধু দুজনে। চমৎকার কেটেছে দিনের বেলাটা ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে তুলে। সম্বন্ধ করে এমন লোকের সাথে বিয়ে হলো, যে সুপুরুষ সুচাকুরে ছাড়াও ওরই মতো বেড়াতে ভালবাসে দেখে ব্যাপক খুশি হয়েছিল মনীষা।

এখন, মৃদু রাতের আলোয়, ঘন সান্নিধ্যে, অপেক্ষা যখন অধীর হয়ে উঠেছে শরীর জুড়ে তখন হঠাৎই মনে হলো মুগ্ধতা না, এমনকি কৌতূহলও না, অভ্যস্ত অভিজ্ঞ একজোড়া চোখ তাকে মাপছে। মেপে নিচ্ছে তার সব তরঙ্গের সাইজ। ভূগোলের মৌখিক পরীক্ষার সময়ও রীতাদি এমনি সন্দিগ্ধ চোখে তাকাতেন। এ কি পারবে? প্রশ্নের উত্তর দিতে? চাহিদা মেটাতে?

সেই প্রথম এই বাঘটার সাথে মুলাকাত মনীষার। মরণাপন্ন, গুঁড়ি মেরে বসে খালি থাবা চাটে আর হাভাতে চোখে মেপে যায় খাদ্য-জগৎ, খুঁজে যায় দুর্বল শিকার।

তারপর আরও কতবার দেখে ফেলেছে একে। শপিং ম্যলে, রেস্টুরেন্টে, এয়ারপোর্টে, সিনেমা হলে। রাস্তায়। যখনই কোনও ভরভরন্ত মেয়ে শরীর ধারেকাছে আসে। আজকাল ঘাড় না ঘুরিয়েও মনীষা দেখতে পায় দীপমের অদৃশ্য ল্যাজের ডগা নড়ে উঠছে, আলতো করে জিভ বুলিয়ে নিচ্ছে ঠোঁটে আফশোস ঢাকতে।

যখন দীপম ফোন করে বলেছে ফিরতে রাত হবে অফিসে খুব চাপ, যখন দেরি করে আসবে বলে গিয়েও সময়ে চলে এসেছে, এসে কারণ হিসেবে বলেছে মিটিংটা আজ ক্যানসেল হয়ে গেল বস নেই বলে, কিংবা যখন ফোনের ছবিগুলোয় অলস হাত চালাতে চালাতে হঠাৎ ঝট করে ফোন হাত চাপা দিয়ে আড়াল করেছে আর তড়িঘড়ি পাশ থেকে উঠে গেছে - নিশ্চিত বেঘো গন্ধ পেয়েছে মনীষা। প্রতিবার। এক অসুস্থ জন্তুর শরীর ভরা ঘায়ের গন্ধ। নোংরা। পচা।

তারপর গা গুলিয়ে ওঠা সামলে নিয়ে, নির্বিকার প্রশান্ত মুখে যা বলা হয়েছে সব সত্যি বলে মেনে নিয়েছে। যেন ও ফোনের ব্যাকগ্রাউন্ডে মেট্রোর অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে পায়নি, যেন ও ভুলেই গেছে সকালে যাবার সময় দীপম বলেছিল কোনও স্কুলের বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন আছে বলে দেরি হবে, অথবা যেন ও অন্য কারও সাথে দীপমের অবাঞ্ছিত ঘনিষ্ঠতার ফোটোটা এক ঝলকেই নির্ভুল দেখে ফেলেনি।

আজ এই ভাঙাচোরা গাড়িটা দেখেও সেই বাঘটার কথা মনে হলো কেন কে জানে! পায়ে পায়ে পেরিয়ে গিয়েও, কি এক দোনামনায় পিছন ফিরে তাকাল মনীষা। তাকাতেই, চোখ ধাঁধিয়ে গেল খণ্ড সাইড মিররে রোদের ঝলকানিতে।

বাঘটা এবার সত্যি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল, তারপর ছোট্ট লাফ দিয়ে এসে দাঁড়াল ওর সামনে। আর এই দশ বছরের ভাঙাচোরা সংসারের খাঁচাটাকে ঐ গাড়ির জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে, সমস্ত অভ্যাস, কর্তব্য, টানের ধুলো ঝেড়ে ফেলে অদ্ভুত নির্লিপ্ত একটা হাসিমুখে মনীষা চড়ে বসল তার পিঠে।
1

অণুগল্প - সৌরাংশু সিন্‌হা

Posted in


অণুগল্প


ছাদের সিঁড়ি
সৌরাংশু সিন্‌হা


আজ জাকির চলে যাচ্ছে। জাকির- প্রফেসর জাকির হুসেন। ভাষাতত্ত্বের প্রফেসর জাকির হুসেন। আমার প্রফেসর জাকির হুসেন। আমার জাকির। ছাদের সিঁড়িটা প্রাণপণে ডাকছে আমায়, কিন্তু যেতে গিয়ে যেন ধীরে ধীরে দু হাত ভর্তি বালির মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। কি বলব, কিই বা বলতে পারি? সমাজ ধর্ম সংস্কার সব চুলোয় গেলেও পনেরোটা বছরের পার্থক্য কি দিয়েই বা মুছব! সিঁড়ির নীচের অন্ধকারটাকে আঁকড়ে ধরে বুকের ভিতরের তারা গুনতে থাকি! গত দুটো বছর আমি যে কি পেয়েছি, কি করে বোঝাবো! এক পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের মোড়কে গত দুটো বছরে আমার স্বপ্নের সিঁড়ি এঁকেছি ওই ছাদের সিঁড়ি বেয়ে, কার্ণিশ ছুঁয়ে। কেউ জানেনি, কেউ বোঝেনি! জাকিরও কি বুঝেছে কখনও! না বললেও কি কিছু বলার বাকি থেকে যায়? শুধু ছাদের সিঁড়ির দরজাটা আমার ভিজে যাওয়া চোখের, হুতাশ ভরা বুকের, মাটিতে না পড়া পায়ের সঙ্কেত লিখে রেখেছে পুরনো হয়ে যাওয়া কাঠের অন্দরে অন্দরে। 

মা ডাক দিল হঠাৎ, “অনু খেয়ে যা।” আমি ছুটে চলে গেলাম বাথরুমের ভিতরে নিঃশব্দে উপুড় করে দিলাম আমার না বলা অভিমান, আমার বুক জোড়া সবটুকু বেসিনের কোলে। মা আবার ডাকল, “কি হয়েছে রে অনু?” উত্তর ছিল না কোনও। কিন্তু মায়েরা বোধহয় সব জানে সব বোঝে! মিনিট পাঁচেক পরে বেরিয়ে এলাম খাবার টেবিলে, মা কিছু বলল না! চুপচাপ লুচি আলুচচ্চড়িটা সাজিয়ে দিয়ে মাথার উপর হাত রাখল খালি। ধোঁয়া ওঠা আলুচচ্চড়ির আর ফুলকো ফুলকো লুচির আড়ালে আমার ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটাকে লুকিয়ে নিয়ে চুপচাপ মুখে তুলতে রাখলাম। মা উলটো দিকে গিয়ে বসল চুপচাপ। খাওয়া শেষ হয়ে উঠে যাবার সময় খালি আমার দিকে নরম করে হেসে বলল, “সব গল্প কি মনের মতো হয় রে, পাগলি? যা ছাদে একবার ওকে বিদায় জানিয়ে দিয়ে আয়!”
0

অণুগল্প - উত্তম বিশ্বাস

Posted in


অণুগল্প


ইনহেলার
উত্তম বিশ্বাস


‘ধুলো নেই তো? তাহলে কিন্তু এতটা শ্বাসকষ্ট নিয়ে একদম পা’ কাড়াব না!’
জালাধানের ওপার থেকে কলসছাপানো হাসি, ‘ধুলো? এসেই দেখুন না,---- ধুয়ে একদম ধুলিস্যাত!’ 
সুস্মিতা ডাকলে আমার কোনও অজুহাতই ধোপে টেকে না; বিশেষত ওর চোখের দিকে একবার তাকালেই আমার এই পঁচাত্তর অতিক্রান্ত জীর্ণ হাপরটাতেও নতুন করে হাওয়া ভরে নিতে পারি!

দু’দিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম ওর স্টলের সামনে এক্কেবারে হাবুডুবু অবস্থা! সেদিন সন্ধ্যায় যখন পৌছলাম;---সবাই রীরিমত বানভাসি! জনপ্লাবনে ভাসছিল ঋতবাক! আমিও কখন যেন ভেসে গেলাম, গানে কবিতাপাঠে, আড্ডায়! আমি উদাত্ত স্বরে শুরু করলাম, ‘তোলপাড় সত্তর; পঞ্চাশ পেরিয়ে ফিরে দেখা!’

পাথরে পাথরে নাচে আগুন। আগুন রাতে
দেখো রে মানুষ নাচে; শীতের পাহাড় নাচে
রাতের পাহাড় নাচে। আগুনের মত লাল
হাজার হাজার লাল পতাকা রাত শেষের
বন্দীর চোখে নাচে; নাচে রে স্বপ্ন নাচে---- 

৩৩৩, ঋতবাকে সজ্জিত একটি স্টল। সুস্মিতার সুচারু হাসি, আর আমার ‘তোলপাড় সত্তরের’ অশান্ত আবেগে তখন দারুণ দাবানল!
--‘ফাল্গুণী’দা! আমার বইয়ের থেকে কয়েকটা লাইন প্লিজ----!!’ 

স্বপন’দার রাজকীয় ধমক থামিয়ে দিল চয়নকে, ‘থাম! ‘পোস্টকার্ড’ নিয়ে রাজা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, দেখছো না!?’ আমি চয়নের পিঠে হাত রেখে বললাম, ‘তোমার বইঘর আমি বগলদাবা করে রেখেছি ভায়া! পড়ব পড়ব! আগে আমার নকশাল প্রিয়ডের কথা শেষ করতে দাও; বুড়ো ভাব, দেখো এখনও কত দম!’ আমি বীরের দৃষ্টিতে সুস্মিতার চোখে চোখ রাখতেই, ও আগুন উসকিয়ে বলল, ‘এই তো দারুণ! ইনহেলারটা আজ থেকে আর লাগবে না; এটা আমার কাছেই থাক!’ 

পাশে দাঁড়ানো সতীনাথ’দা।---দেখলাম, মুচকি মুচকি হাসছেন! সিংহী’ বাবু আসতেই সেলফি আর ফটোশ্যুটের হিড়িক পড়ে গেল! কস্তুরী, শ্রীলেখা, গৌতম--- সবার ফ্রেমেই নানান পোজে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আবদার বলে কথা! শুধুমাত্র সুস্মিতার পাশে দাঁড়ালেই আমার যেন মনে পড়ে, হাজার বছর আগেকার কোনও এক সন্ধ্যায় আমাজনের বৃষ্টি অরণ্যে কাটানো কিছুটা মুহূর্তের সুখ-স্মৃতি!

মেট্রোতে, আমাদের সীটে এক আঠারোর ছোকড়াকে বসতে দেখে, আমি ব্যাগ ভর্তি উপহার-বই নিয়ে একপ্রকার ঝুলে ঝুলেই,--- নন্দিনীর ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ পড়তে পড়তে ভিজতে ভিজতে পরিচিত লোকালয়ের পথে যাত্রা করলাম। 

অনেকগুলো পায়ের শব্দ, সিরিয়ালের সংলাপ, কাপ-প্লেটের ঠুং ঠাং-- আমার কলিং বেলের আওয়াজকে দেখলাম, অনেকক্ষণ ধরেই সমানে অগ্রাহ্য করে চলেছে! দরজা খুলল না কিছুতেই। কিছু কিছু সময় কাছের মানুষকে ডাকতে হলেও চেনা কণ্ঠস্বরের প্রয়োজন হয়! চেষ্টা করলাম,----একবার---দুবার----তিনবার---! নাহ! পারলাম না! দম আটকে এল!

অভ্যাস বশত পকেট হাতড়ালাম।-------নেই!

ইনহেলারটা সুস্মিতার টেবিলেই ফেলে এসেছি যে!



কৃতজ্ঞতা স্বীকার
‘ঋতবাক’ সংকলন, ২০১৭
বইমেলার ডায়েরি, ফেসবুক পোষ্ট; সুস্মিতা বসু সিং



5

অণুগল্প - রাজা সিংহ

Posted in


অণুগল্প


অনাবৃত 
রাজা সিংহ


অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে থাঙ্গাম্মা। তারই বয়সী হবে হয়তো, অথচ কি সুন্দর টানটান গায়ের চামড়া। বিদেশিনী সে আগেও দেখেছে অনেক। কিন্ত এ যেন সূর্যের মতো উজ্জ্বল। চারপাশে তার কত পুরুষ। পেছনে হাঁটছে ইতস্তত। ফটো তুলছে খিচিক খিচিক। শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর গারমেন্টস্‌ ফ্যাক্টারির মালিক বিনয়ে বিগলিত, পারলে গায়ের জামা খুলে বিছিয়ে দেয় মাটিতে।

তাই এত সাফসুতরো আজ। গেটে ঢোকার মুখে একটা প্যাকেটে দুটো ইডলি আর চাটনি। বাপের জন্মে হয়নি এমন।

‘কি কাজ করো এখানে?’ স্নিগ্ধ চোখে সেলভীর মুখ চেয়ে চারু হাসেন বিদেশিনী। দোভাষী অনুবাদ করে।

একশ পঞ্চাশটা মাল ঘণ্টা প্রতি। সবে সত্তর হয়েছে। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিয়েছিল ক্লান্তিতে। ঘণ্টাখানেক বাকি বিরতির। সুপারভাইজার মঞ্জুনাথ কখন এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল পেছনে। খেয়াল করেনি সেলভী। সেলভীর পিঠের উপর কাপড় মাপার স্কেলটা বুলিয়ে বলে উঠল মঞ্জুনাথ 'কিরে ব্যথা করছে বুঝি? টিপে দেবো? চমকে উঠে তুরন্ত কাজে লেগেছিল সেলভী। এ তো নৈমিত্তিক ব্যপার। মাস গেলে তিনটি হাজার টাকা। গায়ে মাখলে কি সংসার চলে?

চোখ নামিয়ে বিড়বিড়ায় সেলভী। এগিয়ে যান বিদেশিনী।

লাল টুকটুকে লিপষ্টিক ঠোঁটে ফৌজিয়ার সেলাই পরীক্ষা করেন মেমসাহেব। চার বাচ্চার মা ফৌজিয়া, বর থাকে অন্য আওরাতের সাথে। ফৌজিয়া জোর করে হাসি টানে মুখে। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে তলপেট। রক্তস্রাব ছাপিয়ে যাচ্ছে ন্যাকড়ার আস্তরণ। প্রায় দু-হাজার মহিলার জন্য এই কারখানায় মাত্র দুটো কলঘর। কদর্য, পূতিগন্ধময়। বাইরে পাহারাদার বসানো। পাঁচ মিনিটের বেশী অনুমতি নেই কলঘরে। নিয়ম নেই দুবারের বেশী কলঘরে যাবার। চারটে পেট তারস্বরে অপেক্ষা করছে বাড়িতে।

মুগ্ধ হয় থাঙ্গাম্মা। সোনালী চুল নেমেছে কাঁধ ছাপিয়ে। কেমন টানটান মাথা উঁচিয়ে হাটঁছেন মহিলা। 

মেয়েদের অন্তর্বাস সেলাই করে তারা। বিদেশী মেমসাহেবদের জন্য। তুলোর মতো নরম আর দামী। একখানা স্তনবাঁধুনি নাকি তাদের এক বছরের রোজগারের চেয়েও বেশি। মোম পালিশ বুকে ওঠে এ অন্তর্বাস, এত দামী বুঝি ওদের বুক? তা তো হবেই। 

ঋজু পায়ে মেমসাহেব ততক্ষণে থাঙ্গাম্মার টেবিলে। ঝকঝকে হাসিতে বড় আপন জনের মতো থাঙ্গাম্মার খরখরে হাতে হাত রাখলেন তিনি।

কত মাইনে পান এখানে?

থাঙ্গাম্মা ভূমিকে খোঁজে। আসেনি ভূমি। কোন রকমে শাড়ি দিয়ে দুপাশ টা একটু আড়াল করতে পেরেছিল মাত্র। ভূমি ছটপট করছে যন্ত্রণায়। হাঁফাতে হাঁফাতে থাঙ্গাম্মা মিনতি করেছিল, 

‘সার হাসপাতাল...হাসপাতাল, বিয়োবে মেয়েটা।’ 

'তাতে তোর কি রে শালী। দরখাস্ত দিতে বল আগে। যন্ত্রণায় আকাশ ফাটানো চিৎকার কানে নিয়েও নির্বিকার মঞ্জুনাথ। 

হাপড়ের মতো বুকটা ঠেলে একটা আকাশ ফাটানো চিৎকার ছেড়ে থেমে গিয়েছিল ভূমি। ছুটে এসেছিল হালিমা, ফৌজিয়ারা, পড়িমরি করে থাঙ্গাম্মা। রক্তস্রাবে শুয়ে ভূমি। বেহোঁশ। মাতৃজঠর থেকে পাথর হয়েই বেরিয়েছে শিশুটি। শক্ত মুঠি স্থির বুকের কাছে।

কি অপূর্ব সুবাস মেমসাহেবের গায়ে। টানটান শরীর। নিটোল বুক। অনেকটা দেখা যায় তার। তবু সাহস করে তাকাচ্ছে না কোনও পুরুষ। কেমন কেঁচোর মতো মাটিতে মুখ গুঁজে পাশে পাশে সব।

'এখানে কাজ করতে ভালো লাগে?'

পলিথিন মোড়া ঘরে শুয়ে কচিগুলো খিদের চোটে চিল চীৎকারে আকাশ ফাটায়। হেগে মুতে মাখামাখি করে। সদ্য মায়েদের দুধ ভরা বুক টনটন করে, দুধ ধারায় ভিজে যায় ব্লাউজ। তবু তারা ঘাড় গুঁজে মহার্ঘ অন্তর্বাস বুনে চলে।

‘কেমন লাগে এখানে?’ অকাতর হাসি বিলোন মেমসাহেব আবার।

সহসা সবাইকে হকচকিয়ে একটানে ব্লাউজটা খুলে ফেলল থাঙ্গাম্মা। উন্মুক্ত চল্লিশোত্তর ঝুলে যাওয়া স্তন। নারকোলের মালার আয়তনে কালো স্তন বৃন্তের চারপাশটা। কুঁচকানো, খড়ি ওঠা অনাবৃত মাংসপিন্ড। 

থাঙ্গাম্মার দুচোখ আঁতিপাঁতি খুঁজল ভূমি, সেলভী, ফৌজিয়াদের।

তারপর পাথর হওয়া মেমসাহেবের ভয়ার্ত চোখে চেয়ে খসখসে কফ আটকানো গলায় বলে উঠল- 

‘ল্যাংটো!… একদম ল্যাংটো’। 

(সমাপ্ত) 



2

অণুগল্প - সায়ন্ন্যা দাশদত্ত

Posted in



অণুগল্প


সমীক্ষা 
সায়ন্ন্যা দাশদত্ত 


-দ্যাখ কি দারুণ ওয়েদার!
-আদর্শ ফর ডেটিং। 
-তুই আজ ছুটি পেলি?
-ম্যানেজড ইট। তব ভুবনে মাথা নত করে রবো!!
-বলছিস? বসন্ত এসে গেছে?!
-আর বলতে! বললাম রোড সার্ভে করব পুরো দিন! ফিল্ড ওয়ার্ক!
-গুল দিলি!
-দিলাম। আবার দিলামওনা। ভ্যালেন্টাইন নিয়ে লেখালিখি পুরো মান্থ ধরেই চলবে। পাবলিক খাচ্ছে। 
-আর পাবলিক যেখানে খাচ্ছেনা!?
-কিসব বলছিস?
-নাম শুনিসনি? বহরাশোল ...কমারপড়া ...শাঁখাচূড়া!
-হুম্! নিউজ হয়েছিল। বেশিদিন চলেনি। 
-কেন?
-আর কেন? পাবলিক নেয়নি। 
-আশ্চর্য বল্? কতগুলো মানুষ খেতে পাচ্ছেনা। খাদানে কাজ করে সিলিকোসিসে ভুগছে। দম আটকে মরে যাচ্ছে ছটপটিয়ে আর আমরা বসন্তের প্রাক্কালে উদ্বাহু হয়ে প্রেম দিবস নিয়ে মেতে রয়েছি!
-মেতে রয়েছি! সো? হোয়াট দ্য প্রবলেম?
-এত ইনসেনটিভ তুই?
-নো! নট! অ্যাঙ্গেল চেঞ্জ কর। 
-উই দ্য মিডলক্লাস পিপল ...আছি কি নিয়ে রে? আগুন দামের সবজি, মেডিসিন, ডক্টর, জামাকাপড় অ্যান্ড দ্য ভেরি থিংস! অলমোস্ট সবটাই আনরিচেবল্! চোখের সামনে ব্যুটিক আইটেম দেখছিস ...ফাইভ স্টারের ক্যুজিন দেখছিস ....সিসিডি, মল, বার, ফরেন হলিডে ...সবটাই দেখছিস জাস্ট! বাট নট ওফ ইয়োরস! হাস্যকর। কষ্টকরও! দ্যাট সুকুমার রে’জ খুড়োর কল! দৌড়বে বাট পৌঁছবেনা ডেফনেট্লী!
-তো? তাতে তো ওদের খালিপেটগুলো মিথ্যে হয়ে যাচ্ছেনা!
-যাচ্ছেনাই তো! কিন্তু যে ছেলেটা সিসিডি তে কফি খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল ....হরিপদর দোকানে আড়াই টাকায় বেঁটে, ময়লা গ্লাসে তো তাকেও বেঁচে থাকতে হয়! এতয়েব ভুলে থাকতে হয়!
-ভুলে থাকলেও ....সমাজের অন্ধকারগুলো তো মুছে যাচ্ছেনা!
-তুই ওগুলো মনে রেখে বুক ঠুকে কান্নাকাটি করলেও চেঞ্জ হবেনা; বি সিওর! অন্ধকার দিক থেকে উল্টোদিকে তাকা ...দিব্যি লোকজন প্রেম করছে। চুমু খাচ্ছে। গণ্ডাগণ্ডা আণ্ডাবাচ্চা জন্মাচ্ছে। পেটে দানা না থাকলেও এ দেশের লোক সেক্স করতে পারে! সাংঘাতিক জনসংখ্যাই তার প্রমাণ। 
-ইউ মিন্ বিপ্লব ইজ অ্যা ফুল শিট কনসেপ্ট!!
-নো। নট অবভিয়াসলি!
-দ্যেন?
-শোন, বিপ্লব করতে গেলে নিজেকে ভুলতে হয়। অল দ্যাট নেতাজি, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন ...ডু ইউ থিংক ওরা নিজেদের ব্যপারে কনসার্ন ছিল? আমি ...আমার বৌ ....আমার ছেলেপিলে ....আমার গুষ্টি; এসব নিয়ে ভাবলে ওরা বিপ্লবটা করতে পারত?
-তাহলে? এরকমই কেটে যাবে? এরকমই আবাল্ জীবনযাপন! শুধু নিজের জন্যে?!
-হুঁ। কাটবে। যতদিন না কষ্টের অ্যাকটিংটা অরিজিনাল কষ্টের মতো হচ্ছে ...তদ্দিন অ্যাটলিস্ট চৌদ্দ তারিখ পঞ্চাশের গোলাপ কিনেই রাজা উজির মারতে হবে! উপায় কি বল্?
-দেড়টা বাজল। খাওয়াবিনা কিছু? ক্ষিদে পেলে পেটে ব্যথা হয়!
এরপর ওরা একটি সুদৃশ্য রেস্তোরায় লাঞ্চ করতে গেলো। ছেলেটি হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ পেলো আরেকটি শিশুর অনাহারে মৃত্যু কামারপড়ায়। ওটা নিয়ে পাঁচ'ছ লাইন লিখলেই হবে। কভারপেজে ভ্যালেন্টাইনই যাবে। 
এখন বাতাসে একটা হাল্কা মিঠে শীত; খানিকটা পঙ্কজের গজলের মতই রুচিশীল, ক্লাসি!