7

অণুগল্প - সরিতা আহমেদ

Posted in


অণুগল্প


মিমির বড় হওয়া
সরিতা আহমেদ


বেলা ৯টায় ঘুম ভাঙতেই মিমি টের পেল বাড়িটা থমথমে। মা-বাবান-দিদুন কেউ নেই, মিতুলটার সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। টয়লেট থেকে বেরিয়ে সোনাদাকে জিজ্ঞেস করতেই তার মনে পড়ল আজ শনিবার। ইস, যদি আর একঘণ্টা আগে উঠত তবে হয়তো সবার যাওয়াটা সে যে করেই হোক আটকাতে পারত।
মিতুলকে নতুন স্টিকার বক্সটাও না হয় দিয়েই দিত, পোকেমন না দেখে বাবানের দেওয়া সবগুলো অঙ্কও না হয় করেই ফেলত, যত বিচ্ছিরিই লাগুক নাকমুখ টিপে সকালে দুধ আর লাঞ্চে মাছভাত খেয়েও নিত, তাতেও না হলে মিথ্যে মিথ্যে পেট ব্যাথার বাহানা তো ছিলই – তবু ওদের আটকানো তো যেত। ইস, কেন যে এত ঘুমাল সে! আসলে কাল স্কুলের ঘটনাটা নিয়ে মা এত বকাবকি করল যে তার কান্না পেল ভীষণ, আর কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুম এসে গেল বুঝতেই পারল না। হয়েছিল কি, ওদের ক্লাসের কিছু মেয়ে একটা লিফলেট নিয়ে বেজায় হল্লা করছিল। মিমি সেটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে বিচিত্র একটা আবেদন – “শ্রী শনি মহারাজ আবির্ভূত হয়েছেন কোকলামারির মাঠে। প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে এক সিদ্ধপুরুষের আশ্রমে নিয়েছেন ঠাঁই। ভক্তদের সব সমস্যার সমাধান এসে গেছে । তন্ত্রসাধক গাছবাবার কাছে মিলছে ফল। আগামী শনিবার এক বিরাট ধর্মচক্রে সামিল হতে দলে দলে যোগ দিন। হাতেনাতে ফল ১০০% গ্যারান্টি। যত পারেন এই প্রচারে সামিল হন। অবিশ্বাস করলেই শনির প্রকোপ নিশ্চিত, সাক্ষাৎ মৃত্যু...” পড়ার পর মিমি খুব হাসল, তারপর রিদ্ধিমার হাঁ হওয়া মুখের দিকে চেয়ে বলল ‘তোরা এসব ঢপে বিশ্বাস করিস? এই আমি লিফলেট ছিঁড়লাম, দেখি তো কি হয়!’ সবাই হাঁ-হাঁ করে তেড়ে আসার আগেই সে সবক’টা লিফলেট ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলে দিল। রিদ্ধিমার সেকি ভয় ! ঘটনাটা এতটাই চমকপ্রদ যে বাড়ি ফিরে কাকে বলবে ঠিক করতে পারছিল না। মিতুল তো ছোট, বুঝবেই না। এদিকে চেপে রাখাও যাচ্ছে না। অগত্যা মা-কে সবটা বলতেই সেকি বকুনি! বেচারি মিমি কি জানত ওই আশ্রমে যাওয়ার প্ল্যান মা আগেই করে রেখেছে!
জলখাবার খেয়ে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে যাবে এমন সময় জিদানের ফোন। জিদানের সাথে মিমির খুব ভাব। আগে একই পাড়ায় থাকত জিদানেরা, এখন দিল্লীতে। ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের জমানো কথা দুইবন্ধু শেয়ার করে ।মন খারাপের কথা জিদানকে জানাতেই সে কনফারেন্স ক’লে টুবাইকে ডেকে নিয়ে একটা অভিনব প্ল্যান বানাল।
তখন বেলা ১১টা। প্ল্যান মতো টুবাইকে সাথে নিয়ে মিমি সোনাদার চোখ এড়িয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। একটা অটো ধরে সোজা কোকলামারির মাঠ। যথারীতি প্রচুর ভিড় হয়েছে। আশ্রমটা ছোটখাট, তবে ঘুপচি ঘর বেশক’টা। সিদ্ধিপুরুষ ‘গাছবাবা’ ইয়াবড় জটা এবং গেরুয়া বসন পরে ভক্তদের সমস্যা শুনছেন আর একটা কাগজে কিছু লিখে পাশের কামরায় যেতে বলছেন। ব্যাপারটা খানিকক্ষণ লক্ষ্য করে চুপিচুপি সেই ঘরের পেছনের জানলার কাছে মিমিরা পৌঁছে গেল। চারদিকের উচ্চকিত শব্দ ও মন্ত্রধ্বনির চোটে কেউই তাদের খেয়াল করল না। তারপর টুবাইয়ের কাঁধে চেপে জানলার ফাঁক দিয়ে ভেতরের সব দৃশ্য দ্রুত মোবাইল ক্যামেরায় বন্দী করল মিমি ।
দুপুর ২টোয় লাঞ্চে সবাই যখন খেতে বসেছে, তখন মিমি গম্ভীর মুখে বাবানের হাতে মোবাইলটা দিল। বাবান অবাক হয়ে একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগলেন – কোনওটায় বাচ্চাদের দিয়ে রাসায়নিক কিছু মেশাবার আদেশ দিচ্ছে এক সাধু, কোনোটায় এক সাধু দাড়ি-পরচুলা লাগিয়ে সাজছে, কোনোটায় এপ্রোন পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে একজন কেউ বিভিন্ন ওষুধের গুঁড়ো মেশাচ্ছে বাবাজীর ‘জলপড়া’য়, কোনোটায় দুটো বাচ্চা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। দেখতে দেখতে বাবানের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, একে একে সেই গম্ভীরভাব ছড়িয়ে পড়ল সবার মুখে। মায়ের মুখে কথা সরল না। অনেকক্ষণ বাদে মিমি বলল, “মোবাইলটা কিনে দেওয়ার একটা শর্ত ছিল, আমি যেন বাজে কাজে না ব্যবহার করি। কিন্তু আজ তোমরা যে একটা বাজে জায়গায় ভরসা করে গেলে, তার বেলা!”
কথা শেষ হতেই ছোট্ট মিতুল কিছু না বুঝেই ফিক করে হেসে ফেলল, আর সেটা ছড়িয়ে পড়ল বাকিদের মুখেও। তারপর মিমিকে কোলে বসিয়ে বাবান বললেন “প্রাউড অফ ইউ, বেটা।” আর দিদুন তার গাল টিপে বললেন “সত্যি তো, এ আমাদের অন্যায়ই হয়েছে। বুঝতেই পারিনি আমার দিদিভাইটা কত্ত বড় হয়ে গেছে!”

7 comments:

  1. বাহ্ খুব ভালো আর প্রাসঙ্গিক গল্প।

    ReplyDelete
  2. দারুন। এই রকমের মুখোশ খোলার গল্পই আবার দরকার সাহিত্যে।

    ReplyDelete
  3. দারুন। এই রকমের মুখোশ খোলার গল্পই আবার দরকার সাহিত্যে।

    ReplyDelete
  4. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  5. দারুন। এই রকমের মুখোশ খোলার গল্পই আবার দরকার সাহিত্যে।

    ReplyDelete
  6. Bah .looking forward to more...

    ReplyDelete