কল্পবিজ্ঞান - স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী
Posted in কল্পবিজ্ঞান
বৃত্ত
স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী
‘উপস্থিত মাননীয় বিজ্ঞানীবৃন্দ, আজ আমি আমার গবেষণার যে ফলাফল আপনাদের সামনে উপস্থিত করব, সেটাকে না সফল বলা চলে, না ব্যর্থ বলা চলে।’ এই পর্যন্ত বলে সামনের ডেস্কে রাখা কাগজটা থেকে চোখ তুলে দর্শকদের দিকে একবার দেখে নিল নব্যেন্দু। বার্লিনের এই কনফারেন্সে সারা পৃথিবীর দিকপাল বিজ্ঞানীরা এসেছেন। বেশিরভাগই শ্রোতা হিসাবে। তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন এখানে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পাবেন। যাঁরা সুযোগ পাবেন, নব্যেন্দুর বয়স তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম। অবশ্য শুধু সেটাই নব্যেন্দুকে নিয়ে স্থানীয় খবরের কাগজে লেখালিখি হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। বার্লিনে পা রেখেই নব্যেন্দু সাংবাদিকদের সামনে যে বিস্ফোরক উক্তি করেছে, সেটা স্পটলাইট কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কারণ নব্যেন্দুর দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে বহু নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর থিওরি ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে।
বক্তৃতা দিতে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথাটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল নব্যেন্দুর। একটু হাসিও পাচ্ছিল যেন। গলাটা একটু খাঁকরে নিয়ে ফের বলতে শুরু করল নব্যেন্দু, ‘বিজ্ঞানী বন্ধুরা, আমি জানি আমি যা বলতে যাচ্ছি, সেটা বিশ্বাস করা একটু শক্ত। তবে পুরো ব্যাপারটাই আমি অঙ্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারি।’নব্যেন্দু দেখতে পাচ্ছে গোটা অডিটোরিয়ামে শুরু হয়ে গিয়েছে গুঞ্জন। জার্মানির বিখ্যাত সংবাদপত্র শুদেড্ট বার্লিন গতকালই নব্যেন্দুর ইন্টারভিউ নিয়েছে। সেই খবরের প্রথম লাইনটাই ছিল, ‘হয় এই তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানী উন্মাদ। নয় তো মিথ্যাবাদী।’খোঁচাটা গায়ে লেগেছিল নব্যেন্দুর। সে যে মিথ্যাবাদী নয় এবার গোটা দুনিয়ার সামনে প্রমাণ করে দেবে।
নব্যেন্দু এবার প্রোজেক্টর মেশিন অন করল। ডিসপ্লে–তে ফুটে উঠল তার আটবছর ধরে কষে আসা অঙ্ক। জটিল সেই গণনার একটু একটু করে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে, আর দেখাচ্ছে স্থান কালপাত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একই রাশি কীভাবে পাল্টে যায়।টানা চল্লিশ মিনিট অঙ্ক বুঝিয়ে দেওয়ার পরে যখন যে থামল, তখন তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হাতের তেলোর উল্টোদিক দিয়ে ঘাম মুছে নিল সে। সারা অডিটোরিয়ামে পিন পতনের নিস্তব্ধতা। মাইকের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে মৃদু স্বরে নব্যেন্দু বলল, ‘এতক্ষণ ধরে আপনাদের আমি দেখালাম, বিগ ব্যাংয়ের আগের সময় মাপা অসম্ভব নয়। যদিও কীভাবে সেটা সম্ভব সেইউত্তর আমি এখনও পাইনি। সময় মাপার ক্ষেত্রে তবে এটা গাণিতিকভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি যে, সময়ের জন্ম সময় মাপাটা অসম্ভব নয়। এটা আমার আটবছরের গবেষণা। আশা করছি, আর কয়েকবছর যদি কাজ চালাতে পারি, তাহলে
লক্ষ্যে পৌঁছে যাবো।
একটু থামল নব্যেন্দু। দেখল গোটা অডিটোরিয়াম নিস্তব্ধ।বিজ্ঞানীমহলে উন্নাসিক বলে পরিচিত লুকাস ওয়ারিঙ্কা পিঠ খাড়াকরে বসে আছেন সামনের সারিতে। জাপানি পদার্থবিদ আকেমিইরাতা কড়ে আঙুলের নখ দাঁতে কাটছেন। ইজিপ্টের তরুণগবেষক আম্মান নেনেত তো রীতিমতো খাতা বের করে নোটনিতে শুরু করে দিয়েছেন। সকলেই উত্তেজিত। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ফের বলতে শুরু করল নব্যেন্দু, ‘আপেক্ষিকতাবাদ আলোর বেগে চলমান বস্তু সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের আগের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। ফলে আমাদের পরিচিতসুত্র গুলো দিয়ে আমরা জানতে পারি যে ১৫০০ কোটি বছরআগে বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমেই দেশ কাল বা সময়ের উৎপত্তি হয়।এই বিস্ফোরণের আগে কী ছিল এবং কীভাবে কোন অবস্থায় ছিল— এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব হয় না। কারণ দৈর্ঘ্য,প্রস্থ,উচ্চতার সাথে সময়কে মিলিয়ে যে চার মাত্রার জগতকে কেন্দ্র করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত তার সাহায্যে মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের আগের কোনও ঘটনা সম্পর্কে তথ্য দেওয়া সম্ভব না । এর জন্য দরকার নতুন কোনও তত্ত্বের। আমি সেই তত্ত্বেরই সন্ধান দেবো।’
—‘এক্সকিউজ মি ইয়াংম্যান!’ স্পষ্ট, গম্ভীর গলায় শব্দটা ভেসেএল অডিটোরিয়ামের ভিআইপি সিটের একদম শেষ সারি থেকে। নব্যেন্দুর কথা সকলে এতটাই মন দিয়ে শুনছিল, আর যে কারও কিছু বলার থাকতে পারে সেটা চিন্তাতেই আসেনি। সকলেই যেন চমকে উঠল একটু। এবার নিজের চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তেএগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। অডিটোরিয়ামের হাল্কা আলোয় ভদ্রলোককে দেখতে পেল নব্যেন্দু। ভদ্রলোক ইউরোপীয়। প্রায়ছ’ফিট লম্বা। পরনে কালো স্যুট। বাঁ পায়ে সম্ভবত কোনও চোট বা সমস্যা রয়েছে। তাই একটা লাঠি আস্তে আস্তে ঠকঠক করতেকরতে এগিয়ে আসছেন। নিস্তব্ধ অডিটোরিয়ামে লাঠির ঠকঠক শব্দটা বেমানান রকমের জোরে শোনাচ্ছিল।
—‘প্রফেসর আলেকসান্দো মাভরোতিস!’ স্টেজের পাশ থেকে কে যেন চাপা গলায় বলে উঠল নামটা। এঁর নাম আগেও শুনেছেনব্যেন্দু। শেষবার শোনা যায় ১৯৯৯ সালে। অবশ্য সেটা মনেরাখার মতো কোনও কারণে নয়। ব্রিসবেনে পদার্থবিদদের এক সম্মেলনে এক বিজ্ঞানীর বক্তব্য রাখার সময়ে তাঁকে মূর্খ, অপদার্থসহ আরও কিছু বাছা বাছা বিশেষণে গালিগালাজ করেছিলেনমাভরোতিস। বলাই বাহুল্য তাঁকে থামতে অনুরোধ করা হয়। না থেমে নাগাড়ে গালিগালাজ করে যাচ্ছিলেন মাভরোতিস। শেষে তাঁকে চ্যাংদোলা করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি মাভরোতিসকে। ইনি যে বেঁচে আছেন, সেটাই জানত না নব্যেন্দু। কিন্তু মাভরোতিস কেন থামাতে গেলেন নব্যেন্দুকে? তিনি কি এবারও গালাগাল করার উদ্দেশ্য নিয়েএসেছেন? ভাবতে ভাবতে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল নব্যেন্দু।ততক্ষণে মঞ্চে উঠে এসেছেন মাভরোতিস। হাত বাড়িয়ে নব্যেন্দুর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ‘এক্সেলেন্ট! আমি ভাবতে পারিনিযে জিনিস নিয়ে আমি এতদিন কাজ করেছি, সেই একই টপিক নিয়ে আর কেউ এতটা এগোতে পারে।’ নব্যেন্দুর তখনও থতোমতো খেয়ে আছে। মাভরোতিস এবার মাইকের দিকে এগিয়েগেলেন। বললেন, ‘সকলের অনুমতি নিয়ে আমি এবার কিছু বলতে চাই। এই তরুণ ভারতীয় বিজ্ঞানী অবিশ্বাস্য মেধারঅধিকারী। যে অঙ্ক উনি মাত্র আট বছরে কষে দেখিয়েছেন, আমিও সেই একই অঙ্ক কষে যাচ্ছি, তবে ৩০ বছর ধরে!’
এবার নব্যেন্দুর অবাক হওয়ার পালা। তাহলে তার মতো আরওকেউ ভাবছে! মাভরোতিস এদিকে বলেই চলেছেন, ‘এই ইয়াংম্যান সময়কে মাপার চেষ্টা করেছেন বস্তুর নিরিখে। ধরে নেওয়া যাক আমরা এক সেকেন্ড সময়কালকে মাপতে চাই। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, সিজিয়াম পরমাণুতে ইলেকট্রন উচ্চশক্তিস্তর থেকে নিম্নশক্তিস্তরে নেমে যায়। আবার যখন সে উচ্চশক্তিস্তরে ফিরে আসে তখন সে আলোকশক্তি বিকিরণ করে। ফলে তাদের মধ্যেএকটা স্পন্দন দেখা যায়। এইভাবে ৯ বিলিয়নবার স্পন্দনটা হতেযে পরিমাণ সময় লাগে সেটাকেই বলে ১ সেকেন্ড। কি ঠিক বললাম তো?’ পাশে দাঁড়িয়ে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে নব্যেন্দু। তারদিক থেকে চোখ না সরিয়েই মাভরোতিস একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড এবার বলো তো, তেজস্ক্রিয়তা বা ওইরকম কোনও পারিপার্শ্বিক কারণে যদি এই স্পন্দনের সংখ্যা একটু গোলমাল হয়ে যায় তাহলে তো সময় মাপাটাও গণ্ডগোল হয়ে যাবে। তাই না?’
—‘আপনার বক্তব্যটা কী? আমার হিসাবে গোলমালটা কোথায় হচ্ছে?’ মুখে কুলুপ আঁটা শ্রোতাদের দিকে না তাকিয়েই অস্থির সুরে প্রশ্নটা করল নব্যেন্দু।
—‘কোত্থাও না। তোমার হিসাবে তুমি ঠিক। আর আমার হিসাবে আমি।’
—‘আপনার হিসাব?’
—‘ইয়েস মাই ফ্রেন্ড, যে হিসাব আমি কষে চলেছি বিগত ৩০বছর ধরে। অবশ্য তোমার মতো আমি বস্তু দিয়ে সময় মাপার পক্ষপাতী নই। কারণ পরিস্থিতি বদলালে বস্তুর ধর্মও বদলে যাবে।আমি সময় মাপার চেষ্টা করছি ভাবনা দিয়ে।’
লোকটা সম্পর্কে তাহলে ভুল শোনেনি নব্যেন্দু। পাগলই হয়ে গেছেলোকটা। নব্যেন্দুর কুঁচকে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত শান্তহাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেছেন মাভরোতিস। এবার তিনি বললেন, ‘ভাবনা বলতে যদি তুমি কল্পনা ধরে নাও তাহলে মুশকিল। এইভাবনা হল দৈর্ঘ্য, প্রস্থ উচ্চতা এবং সময়ের মতো আর একটা ডাইমেনশনের অন্তর্ভুক্ত কিছু একটা।’
—‘যেমন?’
—‘যেমন ধরো দৈর্ঘ্য তুমি মাপো মিটারে। আবার প্রস্থও মাপো মিটারে। আবার উচ্চতাও মাপো মিটারে। এবার একটা লোহাররড রোদে এক ঘণ্টা রাখলে তার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা তিনটেইবেড়ে যায়। এখানে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা তিনটেই সময় নামকচতুর্থ একটা মাত্রার ওপরে নির্ভরশীল। আবার সময় নির্ভরশীলতাপের ওপরে। এক ঘণ্টায় এক এক রকম জায়গায় তুমি এক একরকমের তাপ পাবে। আমার মতে ভাবনা হল এমন কিছু যেটা ওইআলাদা আলাদা সময় ও তাপের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছে।এবার এই নতুন ডাইমেনশনটা যে কী, সেটা আমরা কোনও বস্তু দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব না। সেটার জন্য আপাতত একটা কাল্পনিক নাম ধরে এগোচ্ছি আমরা। সে নামটাই ভাবনা, ইম্যাজিনেশন। আমাদের ইন্দ্রিয় বা আমাদের কোনও যন্ত্রে এই নতুন ডাইমেনশনকে মাপা বা অনুভব করার কোনও ব্যবস্থা নেই।সেটা বুঝতে গেলে তোমাদের দেশের প্রাচীন মুনিঋষিদের মতো অতীন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। তোমরা যাকে ধ্যান বলো, আমি সেটাকে বলি মেডিটেশন। যা বৈজ্ঞানিক উপায়ে আমাদের ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্কের অনুভব ক্ষমতা শতগুণে বাড়িয়ে দেয়। সেটা নাবাড়লে নতুন এই মাত্রাকে অনুভব করা সম্ভব নয়। সম্ভব একমাত্রগণিত দিয়ে। তাই গাণিতিকভাবে প্রমাণ করতে পারলেও আমিহাতেকলমে প্রমাণ করতে পারব না।’
—‘কী আবোল তাবোল বকছেন আপনি!’ উত্তেজনায় থরথরকরে কাঁপছে নব্যেন্দু।
শান্ত হেসে মাভরোতিস বললেন, ‘একটা উদাহরণ দিই? টিভির পর্দায় যা দেখো, সেগুলো তো টু ডাইমেনশনাল। কারণ, টেলিভিশনের পর্দার ক্ষমতা নেই থ্রি ডাইমেনশনাল ছবি দেখানোর। এদিকে চোখে যা দেখতে পাও, সেটা তো ত্রিমাত্রিক। কারণ আমাদের মস্তিষ্কের ত্রিমাত্রিক ছবি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে। উদাহরণ তো আমাদের শরীরেই রয়েছে। তাহলে এতো অবিশ্বাস কেন?’
—‘বাজে কথা ছাড়ুন। যা বলছেন সেগুলো অঙ্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন?’ হিসহিসিয়ে বলে উঠল নব্যেন্দু।
—‘অফকোর্স মাই ফ্রেন্ড।’ কোটের পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে প্রোজেক্টরের ল্যাপটপে গুঁজে দিলেন মাভরোতিস।
ফের শুরু গাণিতিক বিশ্লেষণ। ফের জটিল অঙ্ক।অডিটোরিয়ামের দর্শকরা বুঁদ হয়ে গেলেন দুই বিজ্ঞানীর গাণিতিকডুয়েলে। প্রোজেক্টর মেশিনের পর্দায় ফুটে উঠতে লাগল একের পরএক অতিজটিল গাণিতিক হিসাব। আর সেই পর্দার সামনে তখনদুই যুযুধান বিজ্ঞানী আর এক অডিটোরিয়াম ভর্তি বোবা মেরে যাওয়া দর্শক।
—————————————————————
পরের দিন সকালে বার্লিন জুড়ে একটাই আলোচনা। খবরের কাগজে শিরোনাম, ‘তাহলে কি এতদিন ধরে ভুল গবেষণার জন্য নোবেল দেওয়া হয়েছে পদার্থবিদদের?’ নব্যেন্দু আর মাভরোতিসের গবেষণা হইচই ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে। আরবার্লিন সেই ‘ভূমিকম্পের’ উৎকেন্দ্র। বিজ্ঞানীদের রাখা হয়েছে যে হোটেলে, তার সামনে বসাতে হয়েছে কড়া পুলিসি প্রহরা। কারণ কাল সন্ধে থেকে যেভাবে সাংবাদিকরা হামলে পড়ছেন নব্যেন্দু আর মাভরোতিসের সঙ্গে কথা বলার জন্য, সেই ভিড় সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীদের।
হোটেলের লবির বড় ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক সাড়ে দশটা বাজল, সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নব্যেন্দু। মুখে তৃপ্তির হাসি। তাকে দেখেই সাংবাদিকদের ভিড়ের মধ্যে একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন উঠল— ‘ওই তো! দ্যাট ইন্ডিয়ান জিনিয়াস।’
ভিড়ের সামনে এসে দাঁড়াল নব্যেন্দু। তারপরে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘আমি জানি, আমাকে নিয়ে আপনাদের অনেক প্রশ্ন আছে। প্রোফেসর মাভরোতিস–ও আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। আসুন, হোটেলের কনফারেন্স রুমে উনি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
কনফারেন্স রুমে ঢুকে দেখা গেল একদম কোণের একটা চেয়ারে বসে আছেন প্রফেসর মাভরোতিস। সাংবাদিকদের বসতে বলে বেশ উঁচু গলায় বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘সুপ্রভাত...’
—‘প্রোফেসর, আপনাদের অঙ্ক সত্যি প্রমাণ হলে তো সৃষ্টির ইতিহাসটাই...’ অধৈর্য সুরে প্রশ্ন করছিলেন সাংবাদিক। তাঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন
মাভরোতিস। বললেন, ‘শান্ত হন। আগে আমি যা বলছি, শুনে নিন। আশা করছি তারপরে আপনার আর কোনও প্রশ্ন থাকবেনা।’
ফের একটু গলা খাঁকরে নিয়ে বলতে শুরু করলেন মাভরোতিস, ‘আপনারা কালই দেখেছেন আমি এবং নব্যেন্দু একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছি। হয়ত আমাদের পথটা আলাদা। কিন্তু লক্ষ্যটা এক। কিন্তু খারাপ খবরটা হল এই যে, আমি এবং নব্যেন্দু ঠিক একই জায়গায় এসে আটকে গেছি।’
—‘কোন জায়গায়’, উৎসাহের চোটে একটু বেশি জোরেই চেঁচিয়ে প্রশ্নটা করলেন ‘দাই ওয়ারিখ্ত’ খবরের কাগজের সাংবাদিক আন্দ্রেয়া অ্যাকেনবাখ্ট।
—‘আমরা একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে গিয়েছি। নব্যেন্দুর থিওরি ধরে এগোলে আমার থিওরিতে এসে আটকে যাচ্ছি। আর আমার থিওরি ধরে এগোলে নব্যেন্দুর থিওরিতে এসে আটকে যাচ্ছি।এইভাবে একই পথে আমরা বারবার ঘুরে যাচ্ছি। অথচ জানেন, প্রতিবারই এগনোর সময় মনে হচ্ছে, এই বোধহয় নতুন রাস্তার সন্ধান পেলাম। কিন্তু না, শেষে দেখা যাচ্ছে, যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানেই শেষ করছি।’
—‘মানে?’
—‘মানেটা হল এই যে, ধরে নিন আমার আর নব্যেন্দুর গন্তব্যহল একটা বৃত্তের কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রের একদিকের পরিধিতে রয়েছে নব্যেন্দু। আর অন্য দিকের পরিধিতে রয়েছি আমি। কেন্দ্রে যাবোবলে দু’জনেই পাগলের মতো হেঁটে চলেছি। কিন্তু আখেরে এগোতে পারছি না একফোঁটাও। শুধু অবস্থান বদল করছি মাত্র। সময় আমাদের সঙ্গে একটা বিশ্রী রসিকতা করছে। আমাদের একটাইনফিনিটি লুপের মধ্যে ফেলে দিয়েছি। প্রতি মুহূর্তে উত্তর খুঁজেপাওয়ার আশায় আমরা কলুর বলদের মতো ঘানির চারপাশে ঘুরে চলেছি।’
— ‘নতুন কোনও রাস্তা বেরোচ্ছে না?’
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল মাভরোতিসের। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আরে ধুর ধুর, নতুন রাস্তা না ছাই! অঙ্ক কষতে কষতে কী মনে হচ্ছে জানেন?’
—‘কী?’
—‘দেঁজাভু বোঝেন? মানে, ধরুন আজ আপনার সঙ্গে একটাঘটনা ঘটল। ঘটা মাত্রই আপনার মনে হলো, যেন এই একই ঘটনা বহুকাল আগেও ঘটেছিল। আমাদেরও অঙ্কের এক একটা স্টেপেএসে মনে হচ্ছে সময় যেন আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছে। যেন বলছে, আমার বয়স মেপে দেখবে? এত স্পর্ধা তোমার? নাও তোমার সমস্ত হিসাব গুলিয়ে দিলাম। ফের এনে দাঁড় করালাম একই জায়গায়,’ ম্লান হেসে বললেন মাভরোতিস।
—‘তাহলে? এখন উপায়?’
মুখের হাসিটা এবার মিলিয়ে গেল প্রফেসর মাভরোতিসের। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। তারপরে নব্যেন্দুর দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘বাকিটা ওর হাতে। ৬৮ বছর বয়স হয়েছেআমার। আর ক’দিনই বা বাঁচব? হার্টের রোগ ধরা পড়েছে।চোখেও দেখি না ভাল। গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পুরোদমে থাকলেও শরীর সায় দিচ্ছে না।’
এবার মুখ খুলল নব্যেন্দু। একটু গলা খাঁকরে নিয়ে সে বলল, ‘প্রফেসর মাভরোতিস আমাকে তাঁর পুরো গবেষণার কাগজপত্রই তুলে দিয়েছেন। ওঁর অনুরোধ আমার ফর্মুলার সঙ্গে ওঁর ফর্মুলা মিলিয়ে যদি কোনও নতুন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়।’
—‘আপনার কী মনে হয়, কাজ হবে? সময়ের উৎপত্তির রহস্যভেদ করতে পারবেন আপনি?’
প্রশ্নটা নব্যেন্দুকে করা হলেও উত্তর দিলেন মাভরোতিস। সামনের টেবিলের ওপরে এত জোরে চাপড় মারলেন যে কাঁচের গ্লাসটা পর্যন্ত থরথরিয়ে কেঁপে উঠল।
—‘আলবাত পারবে। হি ইজ ইয়াং অ্যান্ড দ্য সেম টাইম হি ইজহার্ডওয়ার্কিং টু। লেট্স হোপ ফর দ্য বেস্ট। এখন ২০১৭। নব্যেন্দুর যা মেধা, তাতে আশা করছি ২০২৭ না হোক অন্তত ২০৩৫ সালের মধ্যে আমাদের অসমাপ্ত অঙ্কের উত্তর ও খুঁজে বের করবেই।’
—————————————————————
হোটেল থেকে বেরিয়ে রোবোক্যাবে উঠে বসল নব্যেন্দু। এই ২০৪৭সালে এসে আর মানুষে গাড়ি চালায় না এখন। ভারতে অবশ্য এখনও এসব চালু হয়নি। তবে সুইডেনের রাস্তায় এখন রোবোক্যাবের ছড়াছড়ি। লোকেশন বলে দিলে নিমেষে ট্যাক্সি পৌঁছে যায়। গাড়ির চালক সুদর্শন রোবট হাসিমুখে দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে বসতে অনুরোধ করে। নব্যেন্দুর গাড়ির রোবট চালকটি ইঞ্জিন স্টার্ট করেই বলল, ‘সুপ্রভাত। আপনি কি শারীরিক ভাবে কোনও সমস্যা বোধ করছেন?’ মাথা নেড়ে এবং অল্প হেসে নব্যেন্দু বুঝিয়ে দিল কোনও সমস্যা নেই। নব্যেন্দু জানেতাকে এই প্রশ্ন কেন করা হচ্ছে। কারণ আরোহীর কোনও অস্বাভাবিক শারীরিক আচরণ লক্ষ্য করলে তাকে যত দ্রুত সম্ভব কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম এই রোবোড্রাইভারদের মগজে পুরে দেওয়া আছে। নব্যেন্দু আসলে হাঁপাচ্ছিল। পায়ের চোটের কারণে সে আর বেশি হাঁটতে পারে না আজকাল। আর চোটটা যেভাবে লেগেছিল, সেটাও খুব দুর্ভাগ্যজনক।
বছর চারেক আগে মাঝরাত পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। খুব ক্লান্ত হলে যেটা হয়, ঘুমই আসতে চায় না। তাই সে ভেবেছিল একটু রাস্তায় হেঁটে আসাযাক। সেই রাতেই একটি মদ্যপ বাইক আরোহীর ধাক্কায় রাস্তারপাশে ছিটকে পড়ে সে। প্রাণে বেঁচে যায় ঠিকই। তবে ভাঙে পাঁজরের একটি হাড় এবং বাঁ পা। ফলে বাকি জীবনের জন্য তার সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় একটি ওয়াকিং স্টিক। সেটায় ভর দিয়ে হাঁটার কাজটা চলে যায় ঠিকই, তবে কাজটা পরিশ্রমসাধ্য। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে পড়ে সে। স্টকহোমের এই বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে তাকে অতিথিহিসাবে এনে এমন একটা পাঁচতারা হোটেলে রেখেছেন সম্মেলনের আয়োজকরা, যেখানে লিফট পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। ভাগ্য ভাল এবার আর তাকে বক্তৃতা দিতে হবেনা। বরং তাকে ডাকা হয়েছে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য।
গাড়ির তুলতুলে নরম সিটে মাথা এলিয়ে দিল নব্যেন্দু। শুয়ে ভাবতে লাগল বিগত ৩০ বছরের কথা। এই ৩০ বছরে সব ছেড়েনিজেকে গবেষণায় ডুবিয়ে দিয়েছে সে। মাভরোতিসের থিওরির সঙ্গে নিজের থিওরি মিশিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে গিয়েছেএগোনোর। তাতে না সফল হয়েছে, না ব্যর্থ। কারণ, প্রতিবারই সে নতুন একটা করে পথের সন্ধান পেয়েছে। কিন্তু তাতেও আটকে গিয়েছে সেই একই জায়গায় গিয়ে। ফলত সে খাতায় কলমে একপা–ও এগোতে পারেনি। শুধু সম্ভাব্য নতুন পথ আবিষ্কার করেগিয়েছে মাত্র। এসব কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নব্যেন্দু। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে সে। মাথাটা বড্ড ভারী লাগছিল ওর। তাই মনে মনে ঠিক করল, এসব নিয়ে আজ আর ভাববে না সে। বরং সংবর্ধনা নিতে গিয়ে কী বলবে, সেটা ঠিক করে নেওয়া যাক। খসড়া মোটামুটি ঠিকই করা আছে।‘আমাকে এই পুরস্কারের যোগ্য মনে করায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কিন্তু আদৌ কি আমি এই পুরস্কার পাওয়ার মতো কোনও অবদান বিজ্ঞানে রাখতে পেরেছি? আমার নিজের কিন্তু সেটা মনে হয় না। কারণ, লক্ষ্যের উদ্দেশে চলতে শুরু করে সামান্য কয়েক পা এগিয়েছি মাত্র। কিন্তু লক্ষ্যে না পৌঁছতে পারলে আমার কাছে কোনও পরিশ্রমেরই কোনও দাম নেই। তাছাড়া সময়ের সৃষ্টির ইতিহাসের একদম আদিস্তর খুঁজে বের করার জন্য বিগত ৩০ বছর ধরে আমি যে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি...’
নব্যেন্দুর চিন্তাসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কারণ গাড়ি ব্রেক কষেছে।রোবো ড্রাইভার পিছনে মুখ ঘুরিয়ে আলতো হেসে বলল, ‘আপনিগন্তব্যে পৌঁছে গেছেন স্যার। আপনার দিন শুভ হোক।’
অডিটোরিয়ামের ভিতরে ঢুকতেই আয়োজকদের এক প্রতিনিধি এগিয়ে এলেন। মধ্য ত্রিশের মার্গারিটা। ইনিই যোগাযোগ রেখেছিলেন নব্যেন্দুর সঙ্গে। হাসিমুখে মার্গারিটা বললেন, ‘স্বাগতম প্রোফেসর দত্ত। এখন পর্তুগালের বিজ্ঞানী আন্তোনিও দামাসিও বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর মিনিট পনেরো। তার পরেই আপনার সংবর্ধনা। আর হ্যাঁ, আন্তোনিও–র বক্তৃতাটা মিস করবেন না যেন।’
—‘কেন?’ একটু কৌতূহলী হয়েই প্রশ্নটা করে ফেলল নব্যেন্দু।
—‘আরে, আন্তোনিওর গবেষণার সাবজেক্টও তো আপনার মতোই।’
—‘আমার মতো?’
—‘বছর তিরিশের বিজ্ঞানী, বুঝলেন? আপনার মতো সময়ের উৎপত্তি নিয়ে কাজ করছে আন্তোনিও,’ নব্যেন্দুকে তার নির্ধারিত আসনে বসিয়ে দিয়ে চলে যেতে যেতে বলে গেল মার্গারিটা। ওদিকে স্টেজের ওপরে বক্তৃতা দিয়ে চলেছিলেন আন্তোনিও। সেই একইদৃপ্ত ভঙ্গি, সেই একই বাচনভঙ্গি! আন্তোনিওর মধ্যে যেন নিজের ছায়াই দেখতে পাচ্ছিল নব্যেন্দু। মনে পড়ে যাচ্ছিল তিরিশ বছর আগের বার্লিনের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের কথা। সেও তো ঠিক একইভাবে...
চমক ভাঙল আন্তোনিওর কথায়। আন্তোনিও বলছিলেন, ‘মাননীয় বিজ্ঞানী বন্ধুরা, আমি জানি আমার এই থিওরি অনুযায়ী সময় সৃষ্টির একেবারে আদিতে পৌঁছনো কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু আমি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে আটকে গিয়েছি। আমার ধারণা, এই থিওরিতে দরকার নতুন কোনও ইনপুটের। যা পেলে আমি একেবারে সময় সৃষ্টির আদিতে চলেযেতে পারব।’
দেঁজাভু! ঠিক এই একই কথা তো নব্যেন্দু বলেছিল বার্লিনের সভায়। উত্তেজনায় আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ডান হাতটা তুলে আন্তোনিওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নব্যেন্দু চেঁচিয়ে উঠল, ‘এক্সকিউজ মি ইয়াংম্যান! আমি কিছু বলতে চাই।’ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীমহলে নব্যেন্দুর খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। আন্তোনিও কি তাকে চেনে? নিশ্চয়ই চেনে। না হলে কেনই বা মাইকের সামনে মুখ নামিয়ে এনে সে বলবে, ‘আপনার যা বলার এখানে এসে বলুন। আমি নিশ্চিত সকলেই আপনার কথা শুনতে চাইবে।’
ওয়াকিং স্টিকে খটখট শব্দ তুলে ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগিয়েগেল নব্যেন্দু। গোটা অডিটোরিয়াম নিস্তব্ধ। স্টেজে উঠতেই নব্যেন্দুকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে একটু পাশে সরে দাঁড়াল আন্তোনিও। সকলের চোখ এখন নব্যেন্দুরই দিকে। ঠিকএই সময়ে তার চোখ পড়ল স্টেজের পাশে রাখা জায়ান্ট স্ক্রিনেরদিকে। যে স্ক্রিনে এতক্ষণ আন্তোনিওকে দেখা যাচ্ছিল, এবার সেখানে নব্যেন্দুর ছবি।
সেই ছ’ফিট দীর্ঘ চেহারা!
সেই ধবধবে সাদা চুল!
সেই বাঁ হাতে ধরা ওয়াকিং স্টিক!
মুখের সাদৃশ্য না থাকলেও এই চেহারা দেখে কার কথা মনে পড়ছে নব্যেন্দুর? একে কোথায় দেখেছে নব্যেন্দু? মনে করা আদৌ কঠিননয়। কারণ এই লোকটাকে নব্যেন্দু খুব ভাল করে চেনে। প্রফেসর মাভরোতিস! তিরিশ বছর আগে ঠিক একই ভাবে যিনি তরুণ বিজ্ঞানী নব্যেন্দুর বক্তৃতার মাঝখানে উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছিলেন। তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের গোটা জীবনের গবেষণার ফলাফল।
কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম নেমে আসছিল নব্যেন্দুর। তার হাঁটু কাঁপছে। নব্যেন্দু বুঝতে পারছে, যে সময়ের পিছনে তাড়া করেছে সেই সময়ই সারা জীবন ধরে, একটা বিশ্রী রসিকতা করছে প্রফেসর মাভরোতিস আর নব্যেন্দুর সঙ্গে। যত সে সময়ের রহস্যসন্ধানে ছুটে যাবে, ততই তাকে একটা ‘ইনফিনিটি লুপ’–এরমধ্যে ফেলে দেবে সময়। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবে অজস্র গবেষণা, থিওরি, অঙ্কের জটিল কুটিলসূত্র। আর সময়? সে সেই সমস্ত গবেষকদের নাকে দড়ি দিয়ে একইবৃত্তে ঘুরিয়ে যাবে। নিজে ধরা দেবে না কিছুতেই।
মিনিট খানেক চুপ করে মাইকের সামনে দাঁড়িয়েছিল নব্যেন্দু।সকলে তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। নব্যেন্দু বুঝল, এখানে আসল কথা বলে কোনও লাভই নেই। কোনও লাভ নেই আন্তোনিওর হাতে তার নিজের ও প্রফেসর মাভরোতিসের গবেষণার ফলাফল তুলে দিয়ে। কারণ সময়ের সৃষ্টির উৎস আন্তোনিও কোনওদিনই খুঁজে পাবে না। তার চেয়ে বরং এই রিসার্চএখানেই শেষ হোক। তাতে অন্তত আন্তোনিওর জীবনটা নব্যেন্দুর মতোই এক অলীক লক্ষ্যের পিছনে ছুটে নষ্ট হবে না। উৎস খুঁজেনা পাওয়া যাক, উৎসের উদ্দেশে দৌড়নোর এই দৌড়টা সে অন্তত থামিয়ে দিতে পারবে। সময়ও বুঝে নেবে, মানুষকে সবসময় বোকা বানানোর ক্ষমতা তার হাতে নেই।
তাই কোনও মতে ভাঙাভাঙা গলায় নব্যেন্দু বলল, ‘আমিও একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। এই তরুণ গবেষককে আমার অভিনন্দন জানাতে চাই।’ তারপরে একটু দম নিয়ে বলল, ‘এক্সেলেন্ট।’ অবশ্য আন্তোনিওকে নয়, কথাটা সে বলল নিজেকেই। কারণ নব্যেন্দু জানে সময়ের কাছে হেরেও জিতে যাওয়ার জন্য নিজেকে নিজে ছাড়া আর কেউই তাকে অভিনন্দন জানানোর নেই।
অসাধারণ একটা গল্প পড়লাম। খুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteভাগ্যিস!খুব বাঁচা বাঁচল... সময়।
ReplyDelete