অনুবাদ সাহিত্য - অর্পণ শেঠ
Posted in অনুবাদ সাহিত্য
অনুবাদ সাহিত্য
দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য সিলড্ রুম
স্যর আর্থার কনান ডয়েল
অনুবাদ - অর্পণ শেঠ
আমি পেশায় একজন উকিল হলেও আর পাঁচজনের মতো নই, বেশ চটপটে স্বভাবের এবং অ্যাথলেটিক্সে এখনও আমার বেশ ঝোঁক আছে। পেটের তাগিদে অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে দশটা - পাঁচটা বন্দী হয়ে থাকতে হয় বলেই সন্ধ্যের দিকে একটু শারীরিক কসরতের সুযোগ খুঁজি। অ্যাবচার্চ লেনের দূষিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে হ্যাম্পস্টেড্ বা হাইগেট এলাকার দিকে যখন রাতের বেলায় ঘুরতে যাই তখন নির্মল বাতাস সেবনে আমার শরীর আর মন দুই-ই তাজা হয়ে ওঠে। এরকমই এক সন্ধ্যেবেলা এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে আমার সাথে ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের প্রথম মোলাকাত হয় আর এই দেখা হওয়া থেকেই পরবর্তীতে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই।
সালটা ১৮৯৪, এপ্রিল অথবা মে মাসের শুরুর দিক হবে, সন্ধ্যের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে লণ্ডনের একেবারে উত্তর সীমায় পৌঁছে গেছি। যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তার দুধারে ইঁটের তৈরি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। এমনধারার বাড়ি এখন আর মূল লণ্ডন শহরে দেখতে পাওয়া যায় না। বসন্তের মনোরম পরিবেশ, পরিস্কার রাত্রি আকাশ; চাঁদের উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে রাস্তায়। বেশ অনেকটা রাস্তা হেঁটে আসায় আমার গতি শ্লথ, চারপাশ উপভোগ করতে করতে ধীরে-সুস্থে চলেছি। একমনে হাঁটছি -- এমনসময় হঠাৎ পাশের বাড়িটার দিকে নজর গেল।
বাড়িটা বেশ বড়। সামনে অনেকটা ফাঁকা জমিসহ মূল রাস্তা থেকে একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে। বাড়িটা যদিও বেশ আধুনিক কেতায় বানানো তবুও আশেপাশের বাড়িগুলোর তুলনায় জৌলুসহীন। রাস্তার ধারের বাকি বাড়িগুলো সব এক লাইনে দাঁড়িয়ে কেবল এই অন্ধকার, মনমরা, বিরাটকায় বাড়িটাই সামনে লরেল গুল্মের লন সহ বেখাপ্পাভাবে পিছিয়ে পড়েছে। দেখেই বুঝলাম এটা কোন বড়লোক ব্যবসায়ীর বাগানবাড়ি ছিল। বাড়িটা যেসময়ে বানানো তখন হয়ত রাস্তাটাও বেশ দূরেই ছিল আর লণ্ডন শহরও তার লাল ইঁটের দেওয়াল তুলে তুলে অক্টোপাসের মতো জায়গাটা দখল করে ফেলেনি। এরপরেই আমার মনে হল, আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত শহুরে নাগপাশ বাড়ির সামনের জমিটুকুও দখল করে নেবে আর বছরে বছরে আশি পাউণ্ড ভাড়ার একডজন ছোট ছোট বাড়ির জঙ্গল মাথা তুলে দাঁড়াবে। আমি যখন একমনে এসব ভাবছি ঠিক তখনই আচমকা একটা ঘটনা আমার চিন্তাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল।
লণ্ডন শহরের আপদ --- একটা চারচাকার ঘোড়ায় টানা নড়বড়ে গাড়ি ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করতে করতে ছুটে আসছিল, আর উল্টোদিক থেকে একটা সাইকেলের হলুদ মলিন আলো কেঁপে কেঁপে উঠছিল। চাঁদের আলোয় আলোকিত সেই লম্বা রাস্তায় কেবলমাত্র এই দুটি সচল বস্তুরই উপস্থিতি ছিল সেই রাতে। তবুও যেমন বিস্তৃত আটলান্টিকের মাঝে অনেক সময় দুটো জাহাজের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ঠিক তেমন করেই আশ্চর্য নিপুণতায় গাড়িটার সাথে সাইকেলটার ধাক্কা লাগল। দোষটা অবশ্য সাইকেল আরোহীরই ছিল। গাড়িটার ঠিক সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে দূরত্বের ভুলচুকে ঘােড়ার ধাক্কায় ছিটকে পড়ল সে। পরক্ষণেই উঠে পড়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গাড়োয়ানের দিকে তেড়ে গেল। গাড়োয়ানটাও তাকে পাল্টা কথা শোনাতে ছাড়ল না, তারপরেই সে যখন বুঝল যে, তার গাড়ির নম্বর এখনও নোট করা হয়নি, তখনি সে গাড়ি হাঁকিয়ে পিঠটান দিল।
সাইকেল আরোহী সাইকেলটা ধরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে 'ওরে বাবা রে' বলে কাতর আর্তনাদ করে বসে পড়ল। আমি এক দৌড়ে রাস্তাটা পেরিয়ে ওর পাশে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম - 'খুব লেগেছে?'
'গোড়ালিতে', সে বলল, 'মনে হয় মুচকেছে! বেশ ব্যাথা করছে। হাতটা দেবেন প্লিজ?'
ওকে তুলে দাঁড় করাতে গিয়ে সাইকেলের ম্লান হলুদ আলোয় দেখলাম বেশ ভদ্রঘরের অল্পবয়স্ক যুবক। হালকা গোঁফ উঠেছে। বড় -- বাদামী চোখ, সংবেদনশীল কিন্তু নার্ভাস ফ্যাকাশে মুখে পরিশ্রম ও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আমি হাত ধরে টেনে দাঁড় করাতে সে একটা পা মাটি থেকে ওপরে তুলে রাখল, তারপর সেই পাটা নাড়াতে যেতেই তার মুখ দিয়ে গোঙানীর মতো শব্দ বেরোতে লাগল।
'পা ফেলতে পারছি না', সে বলে উঠল।
'তোমার বাড়ি কোথায়?', আমি জানতে চাইলাম।
'ঐ তো', বলে সে সেই বিরাট অদ্ভুত বাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করল, 'আমি বাড়িতে ঢুকব বলে রাস্তা পেরোতে গিয়েই তো ঝামেলাটা ঘটল। আমায় একটু ঐ অবধি পৌঁছে দেবেন প্লিজ!!'
বেশ সহজেই গোটা কাজটা করা গেল। আমি প্রথমে তার সাইকেলটাকে বাড়ির ভেতরের লনে রেখে এলাম, তারপর ছেলেটির হাত ধরে তাকে আস্তে আস্তে রাস্তা পার করিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে পৌঁছলাম। বাড়িটার কোথাও কোন আলো নেই! চারিদিকের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর চরম নিস্তব্ধতা যেন বলেই দিচ্ছিল যে এই বাড়িতে কেউ কখনও থাকেনি!!
'ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ', বলে ছেলেটি ঘুরে দরজার তালায় চাবি লাগানোর চেষ্টা করতে লাগল।
আমি বললাম, 'না না, চল, তোমায় বাড়ির ভেতরে ভালো করে পৌঁছে দিই।'
প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও ও এটা বুঝল যে আমাকে ছাড়া ওর সত্যিই চলবে না। দরজাটা খুলতে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হলঘর দেখা গেল। ছেলেটা টলমল পায়ে এগোচ্ছে, আমার হাত তখনও ওর বাহু ধরে রেখেছে শক্ত করে। 'ভেতরের ঘরের দরজাটা ডানদিকে', অন্ধকারে অস্ফুটে বলে উঠল ও। আমি দরজাটা খুলে ফেলালম, ছেলেটাও একটা দেশলাই জ্বালল। টেবিলের ওপর একটা লণ্ঠন পড়ে থাকতে দেখলাম। লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে সে বলল, 'এখন আমি ঠিক আছি, এবার আপনি আসতে পারেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।' কথাগুলো শেষ করেই একটা আরামকেদারার কোলে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল। আমার জন্য স্বভাবতই একটা বিশ্রী অবস্থার সৃষ্টি হলো। ছেলেটাকে এমন ভয়াবহ বিবর্ণ লাগছিল যে, আমার মনে হলো সে বুঝি মরেই গেছে। তার ক্রমাগত কম্পমান ঠোঁট আর বুকের ওঠানামা দেহে প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ দিলেও আঠার মতো সেঁটে থাকা ফ্যাকাশে দুই চোখ আর বিবর্ণ মুখমণ্ডল আমার মনে ভয়ের সঞ্চার করছিল। এই অবস্থায় ছেলেটিকে ওভাবেই ফেলে রেখে চলে আসা আমার মতো দায়িত্ববান মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। ঘরের একদিকে একটা ঘন্টার দড়ি দেখে আমি সেটা ধরে জোরে জোরে টান মারলাম, মনে হলো বাড়ির ভেতরে বহুদূরে কোথাও ঘন্টাধ্বনি হল। খানিকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও কেউ এল না। ঘন্টার আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার পর আবার গোটা বাড়িটাকে নিস্তব্ধতা গ্রাস করল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ঘন্টা বাজালাম। আমি কেবল ভাবতে লাগলাম ভেতরে কি সত্যিই কেউ নেই? এই ছেলেটা এত বড় বাড়িটায় একদম একা থাকে এটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। ওর এই অসুস্থতার খবর ওর নিজের লোকদের এখনি জানানো দরকার। ঘন্টার আওয়াজ শুনেও যদি কেউ বেরিয়ে না আসে তবে অগত্যা আমাকেই তাদের খোঁজে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হয়। আমি হাত বাড়িয়ে লণ্ঠনটা নিলাম। দেখি বাড়ির ভেতরে কারোর সন্ধান পাই কিনা!
বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে যা দেখলাম তাতে শুধু আশ্চর্য নয়, ভীষণ রকম চমকিত হলাম বলাই ভালো। গোটা প্যাসেজটা ফাঁকা। ফাঁকা সিড়িগুলো ধুলো পড়ে হলদু হয়ে আছে। একদিকে তিনটে বড় বড় ঘর। প্রত্যেকটা ঘরের মেঝেয় পুরু ধুলো, সিলিং থেকে মাকড়শার জাল নেমে এসেছে। বহুদিনের অব্যবহারে দেওয়ালগুলোয় শ্যাওলা আর নোনা ধরে গেছে। ওই নির্জন, নিস্তব্ধ, দমবন্ধ করা ঘরগুলোতে থাকতে পারলাম না। বেরিয়ে এসে দালান ধরে সামনে এগিয়ে চললাম, উদ্দেশ্য রান্নাঘরের খোঁজ করা। রান্নার দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই রান্নাঘরের আশেপাশে বা তার এক কামরার ঘরে পাব এমনটাই আমার বিশ্বাস। কিন্তু না! সেই নির্জন খাঁ খাঁ বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরেও কারোর টিকির দেখা পর্যন্ত পেলাম না। এবার একটা করিডর মতো চোখে পড়ল। নূন্যতম সাহায্যের আশায় আমি এক দৌড়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এখানে যা দেখলাম সেটাই পরবর্তীকালে আমায় আমার জীবনের অন্যতম আশ্চর্যজনক ঘটনাটির মুখোমুখি করেছিল।
করিডরটা একটা বড়, বাদামী রঙয়ের দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে। দরজায় একটা বড় তালা, আর তালাটাকেও লাল মোম দিয়ে সিল করে বন্ধ করা। দেখেই বুঝলাম সিলটাও বহুদিনের পুরনো, কারণ তার ওপর ধুলো জমে সিলটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আমি সিলটার দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, মনে মনে ভাবছি এই বন্ধ দরজার ওপারে কী এমন গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে! হঠাৎ বাড়ির বাইরের দিক থেকে কে যেন আর্তনাদ করে উঠল।
এক দৌড়ে বাইরের ঘরে ফিরে এসে দেখি সেই যুবক ইতিমধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেয়ে আরামকেদারায় উঠে বসেছে আর অন্ধকারে কিছুটা অসহায়, হতচকিত হয়ে পড়েছে। আমায় দেখেই সে বলে উঠল - 'লণ্ঠনটা নিয়ে কোথায় গেছিলেন?'
'বাড়ির মধ্যে সাহায্য করার মতো কেউ আছে কিনা খোঁজ করছিলাম।'
'বাড়িতে কাউকে পাবেন না। গোটা বাড়িটায় আমি একা।'
'এমন অসুস্থতা নিয়ে এতবড় বাড়িটায় একা একা থাকোই বা কেন!'
'আমি এমন হঠাৎ হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে যাই। মায়ের ধাত পেয়েছি বুঝলেন, ব্যথা যন্ত্রণা বা অতিরিক্ত আবেগে এমনটা হয়। মায়ের মতো আমিও একদিন এই কারণেই মরব। আচ্ছা, আপনি কি ডাক্তার?'
'না না, আমি একজন উকিল। আমার নাম ফ্র্যাঙ্ক অ্যালডার।'
'আমি ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ড। কেমন মজার দেখুন আমি ক'দিন ধরেই একজন উকিলের খোঁজ করছিলাম। আমার পরামর্শদাতা মি. পার্সিভাল আমায় বারবার বলছেন। কেন তা অবশ্য জানি না।'
'বাহহ্..... তবে তো আমার দেখা পেয়ে নিশ্চয়ই তুমি খুশি।'
'তা বলতে পারি না মশাই। সে মি. পার্সিভাল জানেন। আচ্ছা লণ্ঠন হাতে আপনি গোটা একতলাটা ঘুরে ফেলেছেন?'
'হ্যাঁ।'
'পুরোটা?' বেশ জোর দিয়ে প্রশ্নটা করল ফেলিক্স তারপর একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
'আমার তো তাই-ই মনে হয়। আসলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা সেই ভেবেই গোটা তলাটায় চক্কর কাটছিলাম।' আমি বলে উঠলাম।
সে একইরকম কঠিন দৃষ্টিতে বলল, 'সব কটা ঘরে ঢুকেছিলেন?'
'যে ক'টা ঘর খোলা পেয়েছি ঢুকেছি।' আমি পাল্টা জবাব দিলাম।
'ওহহ! তাহলে তো আপনি দেখেই ফেলেছেন!' এই বলে ও কাঁধটা ঝাঁকালো, ভাবখানা এমন যেন যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
'কি দেখেছি?'
'কেন? সিল করা দরজাটা আপনি দেখেননি?'
'হ্যাঁ, তা দেখেছি বটে।'
'বন্ধ দরজার ওপারে কী আছে জানার প্রবল ইচ্ছা হচ্ছে, তাই না?'
'তা ব্যাপারটা একটু রহস্যময় লেগেছে তো বটেই!'
'আচ্ছা আপনিই বলুন, এই এত বড় বাড়িতে বছরের পর বছর একটা বন্ধ দরজা আর তার ওপারে কী আছে তা জানার তীব্র আগ্রহ নিয়ে আপনি দিন কাটাতে পারতেন?'
'মানেটা কী!' আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, 'তুমি সত্যি জান না ঐ বন্ধ দরজার ওপারে কী আছে?'
'আপনি যা জানেন তার চেয়ে এক বর্ণও বেশি না.....'
'তাহলে দরজা ভেঙে ঢুকে দেখলেই তো পার।'
'না আমি তা পারি না, বারণ আছে।'
ছেলেটি এমন ভাবে কথাগুলো বলল যে আমার মনে হল আমার এতটা কৌতুহল দেখানো উচিত হয়নি। আমিও শেষ পর্যন্ত আমার প্রতিবেশীদের মতোই অতি উৎসুক হয়ে পড়েছি ভেবে নিজের প্রতি কেমন একটা বিতৃষ্ণা জন্মালো। যাই হোক, ফেলিক্সের জ্ঞান ফিরে এসছে আর সে খানিকটাও সুস্থও কাজেই আমার আর ওখানে থাকার কোন মানেই হয় না। আমি যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতে যাব এমন সময় ফেলিক্স আমায় জিজ্ঞেস করল, 'আপনার কি ফেরার তাড়া আছে?'
'নাহহ্, আমার এখন কোন কাজ নেই।' আমি বললাম।
এবার ছেলেটি বলল, 'আচ্ছা তাহলে আপনি যদি আমার সঙ্গে এখন কিছুটা সময় কাটান তবে আমার খুব ভালো লাগবে। গোটা লণ্ডন শহরে আমার চেয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তি বোধহয় আর দুটি নেই। কথা বলার লোকই পাই না আমি।'
আমি সেই ছোট্ট ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি বোলাতে লাগলাম; এই সোফা-কাম বেডটা ছাড়া আর তেমন আসবাব নাই গোটা ঘরে। কিন্তু এই বিশাল খাঁ খাঁ বাড়ি আর ঐ রহস্যময় বন্ধ দরজা আমায় এমনভাবে আকর্ষণ করছে যে আমার মনে হলো ছেলেটির সঙ্গে আরও কিছুটা সময় কাটালে হয়ত এই রহস্যের কিনারা হতেও পারে! আমি সানন্দে ওর সাথে সময় কাটাতে রাজি হয়ে গেলাম।
'ঐ যে পাশের টেবিলটায় মদের বোতল আছে; আমার অবস্থা দেখে বুঝতেই পারছেন আমি অতিথি আপ্যায়নের পরিস্থিতিতে নেই। কাজেই আপনাকেই একটু কষ্ট করে সব ব্যবস্থা করে নিতে হবে আরকি! ওখানে ঐ কেসে সিগার রাখা আছে, আমাকেও একটা দিন। আচ্ছা, আপনি তো একজন উকিল, তাই তো মি. অ্যালডার?'
'হ্যাঁ', আমি জবাব দিলাম।
'আর আমায় দেখুন! মিলিওনেয়ার বাবার একমাত্র সন্তান, কিন্তু উপার্জনহীন! একটা বিশালাকার বাড়ির বোঝা কাঁধে নিয়ে অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছি। এই বাড়ির বদলি একটা কুঁড়েঘরের মালিক হলে বোধহয় বেশি স্বস্তিতে থাকতাম।'
আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে আগ বাড়িয়েই বললাম, 'এতই যখন সমস্যা আর এত বড় বাড়ি দেখভাল করাও তো চাট্টিখানি কথা নয়, তাহলে বাড়িটা বেচে দিচ্ছ না কেন!'
'বাড়ি বেচা সম্ভব না।'
'তাহলে বরং ভাড়া দিয়ে দাও, ভাড়া বাবদ ভালোই রোজগার করবে।'
'ভাড়া দেওয়ারও কোন উপায় নেই উকিলবাবু।'
ছেলেটার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত সমস্যাতেও বাড়িটা বেচতে বা ভাড়া দিতে রাজি নয় কেন এই ভেবে আমি ভীষণই আশ্চর্য হলাম।
ছেলেটি এবার হাসল তারপর বলল, 'আপনি যদি বোর না হন তবে আমি আপনাকে আমার এই মনোভাবের কারণ বিস্তারিত বলতে পারি।'
আমি বললাম, 'বোর হওয়ার কোন প্রশ্নই নেই, উল্টে আমার মধ্যে একটা বিশ্রী কৌতূহল মাথাচাড়া দিচ্ছে!'
ফেলিক্স বলতে শুরু করল:
'আপনি আজ আমার যে উপকার করলেন তারপর আপনার মনে আমার সম্পর্কে কোন ধোঁয়াশা বা সন্দেহ থাকুক তা আমি চাইনা। আমার বাবার নাম স্ট্যানিসলাস স্ট্যানিফোর্ড, একজন বিখ্যাত ব্যাঙ্কার।'
'স্ট্যানিফোর্ড! সেই ব্যাঙ্কার!' আমি বিস্মিত গলায় বলে উঠলাম, 'ও নাম তো আমার চেনা। বছর সাতেক আগে তাঁর দেশ ছেড়ে পালানো নিয়ে অনেক কেচ্ছা কেলেংকারি রটেছিল।'
ফেলিক্স বলল, 'বুঝতে পারছি আপনি বাবাকে চিনতে পেরেছেন। তিনি তাঁর বন্ধুদের জমানো টাকা নিয়ে ফাটকা খেলেছিলেন। টাকা ডুবে যাওয়ায় বন্ধুদের হাত থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালান। আমার বাবা নরম স্বভাবের সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। আইনত কোন অপরাধ না করলেও বন্ধুদের বিশ্বাসের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। গোটা ঘটনায় তিনি এতটাই মর্মাহত হন এবং ভেঙে পড়েন যে, নিজের পরিবারের কাছেও মুখ দেখাতে চাননি। পরে বিদেশের কোন অপরিচিত অজ্ঞাত স্থানে নির্বান্ধব অবস্থায় অনাত্মীয়দের মাঝে মারা যান।'
'তিনি মারা গেছেন!' আমি আবারও অবাক গলায় শুধোলাম।
'আমার পক্ষে বাবার মৃত্যু প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ফাটকার সব টাকা উদ্ধার হয়েছে। আর তো তাঁর মুখ লুকিয়ে থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। তিনি সসম্মানেই ফিরে আসতে পারতেন; আমার ধারণা বিগত দুবছরের মধ্যে কোনও এক সময়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।'
'গত দু'বছরের কথাই কেন মনে হচ্ছে তোমার?'
'দু'বছর আগে ওঁর শেষ চিঠি পেয়েছি।'
'চিঠিতে ওঁর ঠিকানা জানাননি?'
'চিঠিটা প্যারিস থেকে এসেছিল এটুকুই বলতে পারি, কোন ঠিকানা ছিল না। এইসময়ই আমার মা মারা যান। চিঠিতে আমার ওঁর কিছু নির্দেশ ও পরামর্শ ছিল। এরপর বিগত দু বছরে আর যোগাযোগ করেননি।'
'এর আগে তুমি বাবার খবর পেয়েছিলে?'
'হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। বাবার প্রথম চিঠি থেকেই বন্ধ দরজার রহস্যের সূত্রপাত। ঐ টেবিলটা আমার দিকে একটু এগিয়ে দিন।'
আমি টেবিলটা ওর দিকে ঠেলে দিতে ও টেবিল হাঁতড়ে কী একটা বের করল তারপর বলল, 'এইযে বাবার লেখা প্রথম চিঠি, মি. পার্সিভাল ছাড়া আপনিই একমাত্র এই চিঠির কথা জানলেন।'
আমি আর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা এই মি. পার্সিভাল টি কে?'
'মি. পার্সিভাল ছিলেন আমার বাবার একান্ত সচিব। বাবার অবর্তমানে তিনি প্রথমে আমার মায়ের এবং পরে আমার প্রধান উপদেষ্টা এবং একমাত্র বন্ধু। উনি না থাকলে আমরা এতদিনে ভেসেই যেতাম। সাতবছর আগে বাবা যেদিন দেশ ছাড়েন সেদিন এই চিঠিটি হাতে পাই..... আপনি নিজেই পড়ে দেখুন।'
চিঠিটি নিম্নরূপ:
প্রিয়তমা,
এতদিন আমার ব্যবসাপত্তর সম্পর্কে তোমায় কিছু বলিনি। বিশেষ করে স্যর উইলিয়াম আমায় বলেছিলেন তোমার হার্ট খুব দুর্বল। যে কোন ধরনের উত্তেজনা তোমার পক্ষে ক্ষতিকারক। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই ঝুঁকিও আমায় নিতে হচ্ছে। আমার ব্যবসার অবস্থা ভালো না। এমতাবস্থায় আমায় তোমার সঙ্গ ত্যাগ করে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে হচ্ছে। তবে খুব শীঘ্রই যে আমরা আবার পুর্নমিলিত হব সেব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমাদের এ বিচ্ছেদ নেহাতই অতি অল্প সময়ের জন্য। কাজেই এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে মন আর শরীর খারাপ কোরো না; তাহলে দূরে গিয়েও আমি খুব মানসিক যন্ত্রণায় থাকব।
এখন আমি তোমায় যা যা বলব তুমি সেই নির্দেশ মেনে চলবে, আমাদের এতবছরের সম্পর্কের জোরে এটাই আমার একান্ত অনুরোধ। বাগানের শেষপ্রান্তে আমার যে ডার্করুমটা আছে, যেখানে আমি আমার ফটোগ্রাফির কাজকর্ম করি, সেই ঘরের ভিতর কী আছে তা আমি কাউকেই জানতে দিতে চাইনা। একথা বলছি বলে ভেবো না যে, ঐ ঘরে এমন কিছু আছে যার জন্য আমায় পীড়িত বা লজ্জিত হতে হবে। তা সত্ত্বেও আমি চাইনা যে, তুমি বা ফেলিক্স ঐ ঘরে ঢোক। ঘরটা এখন তালাবন্ধ আছে, এই চিঠি পাওয়ামাত্র ঐ তালা গালা দিয়ে সিল করে দেবে। এই বাড়ি কোনমতেই বিক্রি করা বা ভাড়া দেওয়াও চলবে না, কারণ তাহলেই ঐ ঘরের রহস্য প্রকাশ হয়ে যাবে। তুমি আর ফেলিক্স যতদিন এই বাড়িতে থাকবে, আমি নিশ্চিন্ত থাকব। ফেলিক্সের একুশ বছর বয়স হলে, ও ঐ ঘর খোলার অধিকার অর্জন করবে... তার আগে কিছুতেই নয়!!
বিদায়, হে প্রিয়তমা! আমাদের এই স্বল্পমেয়াদী বিচ্ছেদের দিনগুলোয় যেকোন প্রয়োজনে মি. পার্সিভালের পরামর্শ গ্রহণ কোরো, ওঁর ওপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা আছে। তোমায় ও ফেলিক্সকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বলে আমি নিজের ওপরই বারবার ধীক্কার জানাচ্ছি কিন্তু আর কোন উপায়ও নাই।
তোমার একান্ত আপন ও ভালোবাসার
স্ট্যানিসলাস স্ট্যানিফোর্ড
৪ঠা জুন, ১৮৮৭
আমার চিঠি পড়া শেষ হতে ফেলিক্স বলে উঠল, 'আমাদের পরিবারের এইসব ব্যক্তিগত তথ্য আপনাকে দেখিয়ে হয়ত কিছুটা বিব্রতই করলাম। আপনার পেশাগত গণ্ডির মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা হয়ত নতুনও নয়। আমি বহু বছর ধরেই এগুলো বলতে পারার মতো আস্থাভাজন কাউকে খুঁজছিলাম।'
'তোমার আস্থাভাজন হতে পেরে আমার বেশ ভালোই লাগছে', আমি বললাম, 'আর এই অদ্ভুত বিষয়টি আমার মধ্যেও এক গভীর আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।'
আবার ফেলিক্স বলল, 'জানেন, আমার বাবা সত্যনিষ্ঠ ও নীতিবাগীশ মানুষ ছিলেন। উনি লিখে রেখে গেছেন যে, উনি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবেন আর ঐ বন্ধ ঘরের মধ্যে এমন কিছু নেই যাতে তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হতে হয়। এ ব্যাপারে আমি ওঁকে অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস ও ভরসা করি।'
'তাহলে উনি ফিরলেন না কেন?' প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতোই আমার মুখ দিয়ে কথাগুলো সহসা নিক্ষিপ্ত হলো।
'আমি বা আমার মা এ রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারিনি। আমরা ওঁর চিঠির নির্দেশ মতো দরজায় লাগানো তালাটিকে সিল করে দিই। আজ এত বছর ওটা ওভাবেই আছে। মায়ের হার্টের অবস্থা একদমই ভালো ছিল না। তবু বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর মা আরও বছর পাঁচেক বেঁচে ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর কয়েকমাসের ব্যবধানে মা দুটি চিঠি পান; চিঠি দুটিতেই প্যারিসের পোস্টমার্ক কিন্তু কোনও ঠিকানা ছিল না। দুটো চিঠিই খুবই সংক্ষিপ্ত এবং প্রথম চিঠিরই পুনরাবৃত্তি বলা চলে। তারপরে দীর্ঘদিন আর কোন চিঠি নেই। এই নীরবতা চলল আমার মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। মা মারা যাওয়ার পর একটা চিঠি এল আমার নামে। এই চিঠিটা এতটাই ব্যক্তিগত যে তা আমি আপনাকেও দেখাতে পারব না। চিঠিতে বাবা আমাকে ওঁর সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করেন। আমাকে জীবনে সঠিক পথে চলার পরামর্শ দেন। এছাড়াও চিঠিতে লেখা ছিল যে, আমার মায়ের মৃত্যুর কারণেই ঐ বন্ধ ঘরটি তার আগের গুরুত্ব হারিয়েছে। তথাপি সেই মুহূর্তে ঐ ঘর খোলা হলে তা অন্যদের পক্ষে সুখকর নাও হতে পারে...... কাজেই আমার একুশ বছরের জন্মদিনে আমি ঐ ঘর খোলার অধিকার লাভ করব। বাবা ঐ ঘরের গোপনীয়তা রক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব আমায় অর্পণ করেছেন। এবার বুঝলেন তো মি. অ্যালডার আমি কেন এই এত বাড়িটাকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি? না পারছি বিক্রি করতে, না পারছি ভাড়া দিতে!!'
'তুমি তো বাড়িটাকে বন্ধক দিতে পার।'
'বাবা আগেই বাড়ি বন্ধক রেখেছেন।'
'গোটা ব্যাপারটাই কী ভীষণ অদ্ভুত আর গোলমেলে!'
'আমরা একে একে সব আসবাবপত্র বেচে দিতে বাধ্য হই, চাকর-বাকররাও চলে যায়। আর এখন আমি একা! নিঃসঙ্গ! তবে আর মাত্র দু'মাসের অপেক্ষা।'
'মানে?'
'আর দু'মাস পরে আমার একুশ পূর্ণ হবে। আমি সবার আগে এই ঘরটা খুলব তারপর বাড়িটা বেচে দেব।'
'আচ্ছা ফাটকায় লাগানো টাকা উদ্ধার হয়ে যাওয়ার পরেও উনি আর ফিরে এলেন না কেন?'
'বাবা নিশ্চয়ই মৃত।'
'মি. স্ট্যানিফোর্ড দেশ ছাড়ার সময় কোনও ফৌজদারী অপরাধ করেননি, এব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?'
'হ্যাঁ।'
'তাহলে তোমার মাকে সঙ্গে নিলেন না কেন?'
'আমি জানি না।'
'নিজের ঠিকানাই বা গোপন করলেন কেন?'
'এটাও বলা কঠিন।'
'দেখো ফেলিক্স, একজন পেশাদার উকিল হিসেবে আমার মনে হয়, তোমার বাবার দেশ ছাড়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোন গূঢ় কারণ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ ছিল না কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁকে থানা-পুলিশের চক্করে ফাঁসতে হবে। সেই ভয়েই তিনি দেশ ছেড়ে পালান। এছাড়া আর কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আমার মাথায় আসছে না।'
ফেলিক্সকে দৃশ্যতই বেশ ক্ষুব্ধ লাগল, ঠাণ্ডা গলায় সে বলল, 'দেখুন মি. অ্যালডার, আপনি আমার বাবাকে চিনতেন না। তিনি যখন আমাদের ছেড়ে চলে যান তখন আমি খুব ছোট, তবুও বাবাই আমার আদর্শ। তাঁর দোষ একটাই ---- তিনি ভীষণ স্পর্শকাতর আর নিজের স্বার্থের কথা কখনও ভাবেননি। তাঁর জন্য কারোর আর্থিক ক্ষতি হবে এটা মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাঁর আত্মসম্মানজ্ঞানও ছিল অত্যন্ত প্রখর। বাবার নিরুদ্দেশের কারণ বা উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁর এই চারিত্রিক গুণগুলি ভুলে গেলে চলবে না।'
বাচ্চা ছেলেটির আত্মবিশ্বাস আমায় মুগ্ধ করলো, কিন্তু বাস্তব যুক্তি ওর বিপক্ষে। পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি এসময় করা সম্ভবও নয়।
'দেখো, আমি সত্যিই বাইরের লোক', আমি বললাম, 'যাই হোক, এবার উঠি, অনেকটা হাঁটতে হবে। তবে তোমার গোটা ব্যাপারটা এতই অদ্ভুত ও রহস্যাবৃত যে শেষটা জানার এক অদম্য কৌতুহল অনুভব করছি।'
'আপনার কার্ডটা রেখে যান।' ফেলিক্স বলল।
আমার কার্ড রেখে ছোকড়াকে শুভরাত্রি জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
বেশকিছুদিন আর ওদিক থেকে কোন খবর পেলাম না। এ এমন এক ঘটনা যার কোনও সঠিক ব্যাখ্যাও হয়ত পাব না। এই অভূতপূর্ব ঘটনা আশা আর আশঙ্কার মাঝে দোদুল্যমান হয়েই চিরকাল আমার মনের কোণে গেঁথে থাকবে বোধহয়। এমন সময় একদিন বিকেলে আমার অ্যাবচার্চ লেনের অফিসে বসে আছি, আমার বেয়ারা একটা কার্ড এনে আমায় ধরাল; কার্ডটায় লেখা : 'মি. জে. এইচ. পার্সিভাল'। বেয়ারাকে বলতে তার পেছন পেছন এক পঞ্চাশোর্ধ, বেঁটেখাটো, উজ্জ্বল চোখের মালিক আমার ঘরে এসে ঢুকলেন।
'আমার মনে হয় আপনি এর আগে আমার নাম অবশ্যই শুনেছেন। আমার ছোট্ট বন্ধু মি. ফেলিক্স স্ট্যানিফোর্ডের সাথে এক রাতের মোলাকাতের কথা কি আপনার স্মরণে আছে মি. অ্যালডার?' চেয়ারে গুছিয়ে বসে বললেন ভদ্রলোক।
'নিশ্চয়ই! আমার প্রতিটা মুহূর্তের কথা স্মরণ আছে।' আমি জবাব দিলাম।
'তাহলে আমার প্রাক্তন কর্তা মি. স্ট্যানিসলাস স্ট্যানিফোর্ডের নিরুদ্দেশ হওয়া এবং তাঁর বসতবাটিতে একটি বন্ধ দরজার কথাও আশাকরি আপনি জানেন।'
'জানি বইকি!'
'গোটা ঘটনায় আপনি যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে পড়েন।'
'এই অদ্ভুত ঘটনাটি আমায় ভীষণই আকৃষ্ট করে।'
'মি. স্ট্যানিফোর্ডের ছেলের একুশতম জন্মদিনে ঐ দরজাটি খোলার অনুমতি তিনি দিয়ে গেছেন, একথাও নিশ্চয়ই আপনাকে ফেলিক্স বলেছিল!'
'ওয়েল মি. অ্যালডার! সেই একুশতম জন্মদিনটি আজ।'
'আপনারা সেই দরজা খুলে ফেলেছেন?' আমি উত্তেজানায় চেয়ার ছেড়ে যেন লাফিয়ে উঠলাম।
'না... আমার মনে হয় আমাদের গোটা কাজটা একজন সাক্ষীর সামনে করা উচিত', বললেন মি. পার্সিভাল, 'আপনি একজন উকিল এবং গোটা বিষয়টা জানেন, কাজেই আপনার চেয়ে ভালো সাক্ষী আমরা পাব না! আপনি রাজী আছেন?'
'সানন্দে রাজি মি. পার্সিভাল।'
'কাজকর্ম সেরে আমরা তাহলে ঐ বাড়িতে রাত ন'টায় মিলিত হচ্ছি।'
'আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।'
মি. পার্সিভাল উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন এবং গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
সেই বিচিত্র বাড়িটির উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথায় গোটা ঘটনাটি ঘুরপাক খেতে লাগল আর মনে মনে এই আশ্চর্য রহস্যের অগুণতি সমাধান ভেবে চললাম। মি. পার্সিভাল ও ফেলিক্স বাইরের সেই ছোট্ট ঘরটায় আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফেলিক্সকে স্বভাবতই ভীষণ উদ্বিগ্ন ও বিবর্ণ লাগছিল। কিন্তু মি. পার্সিভালে উদ্বেগ ও চিন্তাকুল মুখ এবং তা চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আমায় বেশ অবাক করে দিল। তাঁর গালে যেন রক্ত নেই, থরথর করে হাত কাঁপছে, এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকা তাঁর পক্ষে যেন অসম্ভব!!
ফেলিক্স আমায় অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো, তারপর পার্সিভালের দিকে ফিরে বলল, 'চলুন, সবাই যখন এসে গেছে তবে আর দেরি নয়, যত তাড়াতাড়ি পারি ঐ ঘরের ভূত আমি ঘাড় থেকে নামাতে চাই।'
পার্সিভাল আলোটা তুলে নিয়ে আগে আগে চললেন। বন্ধ ঘরের সামনের প্যাসেজে পৌঁছে তাঁর হাতের কাঁপন দ্বিগুণ গতিতে বেড়ে গেল, ল্যাম্পের আলো শূন্য, স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল বেয়ে দ্রুত গতিতে ওপর-নীচ ধাবিত হতে লাগল। পার্সিভাল ফেলিক্সের দিকে ফিরে ভাঙা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, 'মি. স্ট্যানিফোর্ড..... মন ও স্নায়ুকে শক্ত করুন! সিল ভেঙে দরজা খুলে তেমন কিছু যদি পাওয়া যায় তবে আপনি সামলে উঠতে পারবেন সহজে।'
'কী এমন থাকতে পারে মি. পার্সিভাল...... আমায় এমন ভয় দেখাচ্ছেন কেন?' ফেলিক্স বলল।
'না মি. স্ট্যানিফোর্ড.... ভয় না..... আপনি সংযত করুন নিজেকে..... সংবৃত করুন!!' কাঁপা কাঁপা অদ্ভুত স্বরে ওঁর কথাগুলো শুনে আমার মনে হচ্ছিল উনি খুব ভালো করেই জানেন বন্ধ দরজার ওপারে কোন ভয়াবহতা আমাদের পথ চেয়ে ওঁত পেতে বসে আছে। কথাক'টি শেষ করে কাঁপাকাঁপা হাতে তিনি ফেলিক্সের হাতে একটা চাবির গোছা ধরিয়ে দিলেন। ফেলিক্স এক ঝটকায় চাবির গোছাটা নিয়ে নিল। তারপর একটা ছুরি ঢুকিয়ে সেই বিবর্ণ লাল সিলটাকে তালার ওপর থেকে উপড়ে তুলে ফেলল। পার্সিভালের হাতে আলোটা তখনও থরথর করে কাঁপছে, আমি আলোটা নিয়ে তালার গর্তের কাছে বাগিয়ে ধরলাম। চাবির গোছা থেকে একটার পর একটা চাবি লাগিয়ে ফেলিক্স তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হঠাৎ 'খুট' শব্দে তালাটা খুলে গেল! দরজাটাও এক দমকায় দুহাট করে খুলে হা হয়ে গেল! ফেলিক্স ঘরের মধ্যে এক পা বাড়ালো...... পরমুহূর্তেই এক ভীষণ আর্তনাদ করে সে অজ্ঞান হয়ে ঘরের মেঝেতেই পড়ে গেল।
আমি যদি মি. পার্সিভালের সাবধানবাণী না শুনে সতর্ক হয়ে ঐ ঘরে প্রবেশ না করতাম তবে হয়ত ভয়ে ও আতঙ্কে আমার হাত থেকে আলোটা পড়ে যেতই। ঘরটা জানলাবিহীন এবং প্রায় ফাঁকা, ফটোগ্রাফিক ল্যাব যেমন হয় তেমনি একটা কল ও বেসিন আর চারদিকে বিভিন্ন কেমিকাল ছড়ানো। ঘরটা থেকে একটা শ্বাসরোধকারী অদ্ভুত কেমিকাল ও পাশবিক মিশ্রিত অদ্ভুতুড়ে গন্ধ ছাড়ছে। আমার ঠিক সামনেই একটা চেয়ার আর টেবিল। সেই চেয়ারে আামাদের দিকে পিছন ফিরে একজন মানুষ লেখার ভঙ্গিমায় বসে আছেন। তাঁর বসার ভঙ্গিমা কী ভীষণ জীবন্ত! কিন্তু আমার হাতের আলো যখন ওঁর ওপর গিয়ে পড়ল তখন আমি সভয়ে দেখলাম তাঁর গোটা ঘাড় কালো কুচকুচে, চামড়াগুলোও কুঁচকে গেছে আর ঘাড়টি চওড়ায় মাত্রই আমার কব্জির সমান! তাঁর চুল.... তাঁর কাঁধ.... তাঁর পিঠ.... তাঁর রোমশ হাত সর্বত্র পুরু হলুদ ধুলোর আস্তরণ পড়ে গেছে!! তাঁর মাথা সামনের দিকে হেলে পড়েছে। তাঁর পেনটি তখনও এক বিবর্ণ কাগজের টুকরোর ওপর পড়ে আছে।
'আমার হতভাগ্য মালিক!' এক বুকফাটা আর্তনাদ করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন মি. পার্সিভাল।
আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম... 'কি বলছেন কি!! ইনিই মি. স্ট্যানিসলাস স্ট্যানিফোর্ড!'
'বিগত সাত বছর ধরে উনি এই চেয়ারেই বসে আছেন! আমি কত অনুনয় বিনয় অনুরোধ করলাম... কত কাকুতি মিনতি করলাম!! কিন্তু উনি আমার একটা কথাও শুনলেন না। ঐ যে চাবিটা দেখছেন টেবিলের ওপর... এই ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন! টেবিলের ওপর একটা কাগজ দেখা যাচ্ছে... উনি বোধহয় কিছু লিখে রেখে গেছেন।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ কাগজটা নিয়ে পালাই চলুন...' আমি বিস্ফারিত গলায় বলে উঠলাম, 'ঘরের বাতাস বিষাক্ত! ফেলিক্স চল চল... উঠে পড়।'
তারপর ফেলিক্সকে হাত ধরে কতকটা টেনে হিঁচড়ে কতকটা বয়ে নিয়ে ওর বাইরের ঘরে এসে ঢুকলাম।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে ফেলিক্স 'বাবাআআআআ' বলে ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, 'পার্সিভাল তুমি সব জানতে তাই না? সেই জন্যই ঘরে ঢোকার আগে তুমি অমন করে সাবধান করছিলে!'
পার্সিভাল বললেন, 'হ্যাঁ ফেলিক্স আমি সব জানতাম, এই ভয়ানক সাতটা বছর ধরে আমায় যে কী ভীষণ মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে... আমি প্রথমদিন থেকেই জানি মি. স্ট্যানিফোর্ড ঐ ঘরে ঐ চেয়ারে বসে বসে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন।'
'আপনি সব জেনেও আমাদের কিচ্ছু বলেননি!' ফেলিক্স চিৎকার করে উঠল।
'আমার ওপর রাগ করবেন না... প্লিজ... স্যার... আমি যাঁর নুন খেয়েছি মৃত্যুর মুহূর্তে আর পরেও তাঁর আজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি মাত্র!'
ফেলিক্সের হাত পা থরথর করে কাঁপছিল... ব্র্যাণ্ডির বোতল থেকে খানিকটা গলায় ঢেলে সে স্থির হয়ে বসল তারপর বলল, 'আমার মা আর আমাকে লেখা বাবার চিঠিগুলো কোথা থেকে এল? সেগুলো কি তবে জাল?'
'না... চিঠিগুলো আপনার বাবারই লেখা। উনি লিখে ওগুলো আমার কাছে রেখে যান আমি ওঁর নির্দেশ মতো সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ে পোস্ট করি।'
'মি. পার্সিভাল আপনি আমায় সব কথা খুলে বলুন... কিচ্ছু বাদ দেবেন না। সবকিছুই এখন আমি সহ্য করতে পারব।'
মি. পার্সিভাল গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন...
'ফেলিক্স... তুমি জানো একসময় তোমার বাবার ব্যবসায় ঘোর দুর্যোগ ঘনিয়ে এল। আমরা বুঝতে পারলাম তাঁর ফাটকা কারণে বহু পরওবার সর্বস্বান্ত হবে। ওঁর মতো নির্মল হৃদয় মানুষের পক্ষে এই ভার বহন অসহনীয় ছিল। এই চিন্তা ওঁকে কুরেকুরে খেতে লাগল। সকলের কাছে কী করে মুখ দেখাবেন এই দুশ্চিন্তায় বহু বহু রাত বিনিদ্র কাটানোর পর উনি চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। ওঁর কাছ থেকে ওঁর আত্মহননের সিদ্ধান্তের কথা শুনে আমিও ভীষণ ভেঙে পড়লাম। আমি বারবার হাজারো অনুনয় বিনয় করেও কিছুতেই ওঁকে ওঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারলাম না। মি. স্ট্যানিফোর্ড আমার ওপর ভরসা করতেন, ওঁর মৃত্যুর পথ যাতে সুগম হয় তার জন্য আমায় নিযুক্ত করলেন। আমি বুঝলাম যে আমি এখন ওঁর পাশে না দাঁড়ালে উনি এমন ভয়ংকর কিছু করবেন যাতে আমাদের সবার আরো মুখ পুড়বে!!
এই সময় ওঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিলেন তোমার মা। ডাক্তাররা প্রত্যেকেই বলেছিলেন তোমার মায়ের হার্টের অবস্থা ভালো না। মি. স্ট্যানিফোর্ডের কোনো খারাপ খবরের যে শক তা হয়ত তোমার মায়ের দুর্বল হার্ট নিতে পারবে না। এদিকে মি. স্ট্যানিফোর্ড নিজেও বাঁচার সমস্ত ইচ্ছে ত্যাগ করে বসে আছেন। তাই তিনি চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। চিঠিতে উনি একবর্ণ মিথ্যাও লেখেননি। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে চিঠিতে উনি সাময়িক বিচ্ছেদের কথা লিখেছেন কারণ উনি জানতেন তোমার মা হয়ত আর বড়জোর কয়েক মাস মাত্র বাঁচবেন এবং পরলোকে খুব শীঘ্রই ওঁরা দুজন পুর্নমিলিত হবেন। এই বিষয়ে উনি এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে দুটির বেশি চিঠি লেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। উনি ওঁর মৃত্যুর পর কবে কবে চিঠিদুটি পাঠাতে হবে তাও নির্দিষ্ট করে গেছিলেন। তোমার মা বছরপাঁচেক বেঁচে ছিলেন, কিন্তু আমার কাছে পাঠানোর মতো চিঠি আর একটাও ছিল না।
উনি আমায় আর একটিই চিঠি দিয়েছিলেন, যা তোমায় উদ্দেশ্য করে লেখা এবং তোমায় মায়ের মৃত্যুর পরই কেবল ঐ চিঠিটা আমার পক্ষে পাঠানো সম্ভব ছিল। তুমি সেই চিঠিও পেয়েছ। আমি নিজে প্যারিস গিয়ে তিনবার তিনটি চিঠি পোস্ট করে আসি যাতে তোমরা এবং বাকি সকলেই ওঁর বিদেশে থাকার মিথ্যেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস কর। ওঁর শেষ ইচ্ছা ছিল আমি যেন সব জেনেও আমার মুখ বন্ধ রাখি... আর দেখো ফেলিক্স দীর্ঘ সাত সাতটা বছর ধরে এই দুঃসহনীয় ভার বুকে নিয়েও আমি ওঁর শেষ নির্দেশ পালন করে চলেছি!'
মি. পার্সিভাল থামলে দীর্ঘক্ষণ আমরা কেউই কোনও কথা বলতে পারলাম না। তারপর ফেলিক্স ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে বলল, 'মি. পার্সিভাল আমি আপনাকে দোষ দিতে পারি না। অসহনীয় ব্যাথা বুকে নিয়েও আপনি কেবলমাত্র আমার বাবার শেষ ইচ্ছা পালনের জন্য যা করেছেন তাতে আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করছি। আপনি শুধু আমাদের মাথায় ছাতাই ধরেননি, আমার মায়ের প্রাণ রক্ষাও করেছেন। বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনলে মা তৎক্ষণাৎ আমায় অনাথ করে চলে যেতেন। যাই হোক, এবার বলুন আপনার হাতের ঐ কাগজখানা কী?'
'এই লেখাটি সম্ভবত তোমার বাবা মৃত্যুর সময় লিখছিলেন... পড়ে শোনাব?'
'হ্যাঁ পড়ুন।'
'আমি বিষ খেয়েছি, আমার শিরায় উপশিরায় এই বিষের দুঃসহ উপস্থিতি টের পেতে শুরু করেছি। আমার সব নির্দেশ ঠিকভাবে পালিত হলে এই লেখা যখন পড়া হবে তখন আমি বহু বছরের মৃত একজন মানুষ! যাঁরা আমার কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন তাঁরা এতগুলো বছর বাদে আর হয়ত আমার প্রতি শত্রুভাব বা বৈরিতা-বিদ্বেষ পোষণ করেন না। আর ফেলিক্স... আশাকরি তুমি তোমার এই হতভাগ্য বাবাটাকে ক্ষমা করে দেবে। যাঁরা যাঁরা এই লেখা পড়ছেন তাঁদের কাছে আমার শেষ অনুরোধ..... এই হতভাগ্য, অশান্ত, অতৃপ্ত আত্মাটির জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা জানাবেন। '
আমরা তিনজনে সমস্বরে বলে উঠলাম, 'আমেন!'
উফ ফাটাফাটি .... হেব্বি হয়েছে ... খুব মজা পেলাম ... আরও চাই ...
ReplyDeleteশান্তনু ...
ধন্যবাদ ভাই....
Delete