2

রম্যরচনা - স্বাতী ব্যানার্জ্জী

Posted in


রম্যরচনা


সাগ্নিকবাবু
স্বাতী ব্যানার্জ্জী 


সাগ্নিকবাবু বিজ্ঞানী হতে পারতেন, বিজ্ঞানচর্চা করার সমস্ত গুণই তার মধ্যে ছিল। কেবলমাত্র মায়ের অনিচ্ছা এবং ক্রমাগত বাধাপ্রদানে দেশ এক প্রতিভাশালী বিজ্ঞানীকে হারালো। ঘটনা তাহলে খুলেই বলা যাক। সাগ্নিকবাবুর বিজ্ঞানীলগ্নে জন্ম। ছোটবেলায় দুধের বোতল তিনি হাত দিয়ে না ধরে দুই পা দিয়ে ধরে মুখে পুরতেন, ফলে দুটি স্বাধীন হাত অন্য গবেষণামূলক কাজে ব্যস্ত থাকতো যেমন নিজের কাঁথা টেনে ফেলে দেওয়া, ছোট্ট মশারি উল্টে ফেলে দেওয়া বা নিজের হিসুর শাওয়ারে নিজে স্নান করা ইত্যাদি। এরপর তিনি হামাগুড়ি দিতে শেখেন এবং নতুন স্হান আবিষ্কারের নেশায় বা সেরেল্যাক খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে খাটের তলায় ঢুকে সেখানেই নিদ্রা দিতেন। কেউ খাটে পা ঝুলিয়ে বসলে ফোকলা মুখে তাদের পা কামড়ে নতুন স্বাদ গ্রহণের তীব্র কৌতূহল ছিল তার। এইবয়সেই তিনি আত্মরক্ষার উপায় শেখেন এবং সারা গায়ে ডলে ডলে তেল মাখানোর প্রতিবাদ হিসেবে তিনি ঠাকুমার চশমা বা মায়ের কানের দুল টেনে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। সামান্য হাঁটতে শিখে সাগ্নিকবাবুর কৌতূহল (বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান) বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি টলটলে পায়ে আলনা, খাট, আলমারি, শোকেস ধরে ধরে বিশ্বভ্রমণে বের হন। প্রায়ই তাকে আলনার পিছনে বা সিঁড়ির মুখে পাওয়া যেত। এই ভ্রমণ বৈচিত্র্যময় করতে তিনি প্রতিটি পাপোষে হিসু করতেন।একদিন মা এবং ঠাকুমাকে শোকেস গুছাতে দেখে তিনি ভীষণ অনুপ্রাণিত হন এবং গোছানোর জন্য কোন শো পিস না পেয়ে অগত্যা নিজের শক্ত পটি শো কেসে সাজিয়ে রাখেন। তার এই আশ্চর্য প্রতিভায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মা মাঝেমধ্যে খুব চেঁচামেচি করতেন বটে, কিন্তু ঠাকুমার ভয়ে বেশি কিছু বলতে পারতেন না।

এরপর তিনি রসায়ণবিদ্যায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একটি হাতলভাঙা কড়াইতে নিজের ঝুমঝুমি, চটি, জনসন্স ক্রিম, চুষিকাঠি নিজের বোতলের জলে গুলে রান্না করতেন। একথা সকলেই জানেন রান্নাবান্না মানেই কেমিস্ট্রি অর্থাৎ বিজ্ঞানচর্চা। এছাড়া তার পুতুলখেলার কাপে মিছিমিছি গ্যালন গ্যালন চা সকলকেই খেতে হত। কেউ না খেলেই সাগ্নিকবাবু নিমেষে বুথ সাহেবের বাচ্চার মতো চিল চিৎকার জুড়ে দিতেন।এরপর সবার মতোই তিনিও সোফা থেকে জানলায় উঠে গ্রীল ধরে দাঁড়াতে শেখেন এবং আধো আধো বুলিতে রাস্তা দিয়ে যাওয়া সকল ফেরিওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে মাম (মাছ) মামসো (মাংস) দিতে হুকুম করতেন। অনেকেই হেসে চলে যেতেন আবার কেউ কেউ বিক্রির আশায় দাঁড়িয়ে পড়তেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই দাদুকে তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু কিনতে হতো।

এরপর সাগ্নিকবাবু বড় হয়ে যান এবং দুইপায়ে উল্টো পচ্চল (হ্যাঁ বানান ঠিকই আছে, উনি এই উচ্চারণই করতেন) সারাবাড়ি টহল দিতে শুরু করেন। মাঝেমধ্যে বাবার জুতোয় পা গলিয়ে বিকট ঠকাস ঠকাস শব্দ করে তিনি বাবা কিংবা ঠাকুরদার অফিসে যেতেন। এইসময় তিনি একাধিক গবেষণামূলক কাজে জড়িয়ে পরেন যেমন ফুটন্ত ডালে পিংক ক্রেয়ন ফেলে ডালের রঙ পরিবর্তনের গবেষণা বা চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে খড়ম তৈরির চেষ্টা। আরেকটু বড় হয়ে তিনি কাঁচি ও ধূপকাঠির বিভিন্ন উপযোগীতা আবিষ্কার করেন; যেমন ঘুমন্ত ঠাকুমার বিনুনি কেটে ফেলে কাঁচির ধার পরীক্ষা করা বা মায়ের ছাদে মেলা শাড়িতে ধূপকাঠি দিয়ে ফুটো করা। সব প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি, কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যর্থতাই উন্নতির প্রথম ধাপ। সুতরাং দুপুরবেলা গল্প বলতে বলতে দাদু ঘুমিয়ে পড়লে তিনি দাদুর নাকের ফুটোয় পেনসিল ঢুকিয়ে নিশ্চিত হতে চাইতেন যে দাদু সত্যিই ঘুমিয়েছেন কিনা !

আরেকটু বড় হয়ে তিনি সিগারেট খান। না, নিজে কেনেননি, বাবার প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট নিয়ে কাঁচাই চিবিয়ে খান, কারণ আশেপাশে দেশলাই খুঁজে পান নি। শেষ অবধি গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে মা বমি করান এবং তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন কিল চড় কি জিনিস। যাইহোক বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে এমন বাধা একটু আধটু এসেই থাকে। অন্যদিকে এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাকে সাবধানী করে তোলে। তাই যেদিন আলুপটলের তরকারিতে অল্পস কালো ফিনাইল দিয়ে সাদা হয় কিনা পরীক্ষা করছিলেন সেদিন মা'কে তেড়ে আসতে দেখেই তিনি ঠাকুরদার পিছনে লুকিয়ে পড়েন।

এরপরে বিজ্ঞানচর্চার গতি বেড়ে গেল। একমাত্র মা তার কাজে বিঘ্ন ঘটাতেন। একদিন ঠাকুমা পুজো দিয়ে আসার পর তিনি সিল্কিকে (স্পিৎজ কুকুর) নিয়ে ঠাকুরঘরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সিল্কি নিমেষের মধ্যে সমস্ত বাতাসা খেয়ে ফেলে। বিকালে ঠাকুমা বারবার করে বাড়ির সবাইকে, বিশেষ করে মা বাবাকে বললেন যে ঈশ্বর যে আছেন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। কেবলমাত্র তাকে এবং সিল্কিকে ঘেঁটি ধরে ঠাকুরঘরের থেকে বার করে আনা মা যে কেন সারা সন্ধ্যা ফিক ফিক করে হাসছিলেন, তা কেউ বুঝতে পারেনি। মা অবশ্য নানারকম অদ্ভুতকাজ করে থাকেন। সেদিন সাগ্নিকবাবু খুন্তির বদলে জেল পেন দিয়ে ডাল নেড়ছিলেন কড়াইতে। মা রেগে মেগে নোংরা বলে সব ডাল ফেলে দিলেন। অথচ আরেকদিন যখন সারাদিন কাদা ঘেঁটে তিনি দুটো গাছ লাগালেন তখন নোংরা ঘাঁটা সত্ত্বেও মা তাকে কোলে নিয়ে চুমা দিলেন। অদ্ভুত মহিলা। বাবা লোকটা আরও আশ্চর্যের। কখন আসে, কখন যায় কিছুই বোঝা যায় না। বাবা বাড়িতে থাকলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে মা বাবা গল্প করেন।তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন ভেবে বাবা মা কে জিজ্ঞেস করেন, "ব্যাটা কি আমার মত দেখতে হবে?" মা হাসি চেপে বলেন, "না, শাহরুখ খানের মতো দেখতে হবে।" তারপর দুজনেই হেসে ফেলেন আর ঘুমন্ত সাগ্নিকবাবুর কপালে চুমো দেন। পরদিন কি কি গবেষণা করবেন ভাবতে ভাবতে মায়ের গায়ে পা তুলে সাগ্নিকবাবু ঘুমিয়ে পড়েন।

2 comments:

  1. বড্ড মিষ্টি গল্প, আর তার থেকেও বেশি মিষ্টি গল্পের শেষ কটা লাইন।

    ReplyDelete
  2. ব্যাপক গবেষক! সাগ্নিক! 'পচ্চল' মনে থাকবে.. অনেকদিনই মনে হচ্ছে। :)

    ReplyDelete