1

ছোটগল্প - রিয়া ব্যানার্জ্জী

Posted in

ছোটগল্প


পেটে খেলে পিঠে সয় না
রিয়া ব্যানার্জ্জী



ফুলকপিটা ধাঁ করে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো। ওরে বাবা! মা তো একদম যাকে বলে রেগে আগুন তেলে বেগুন। আর হবেন নাই বা কেন? একে তো সারা রাত গনেশের কোঁককোকানিতে তিন চোখের পাতা এক করতে পারেননি, তারপর সকালে উঠে সবার জন্য লুচি ভেজেছেন। লুচি বলে লুচি - যা সব খানেবালা! এক একজন প্রায় দু'ডজন করে উড়িয়ে দেয়। মা দুর্গা যতই মা কালী, মা চণ্ডী ,অগলা, বগলা সবাইকে কাজে বসান, তাও সময় তো লাগেই। ব্রাহ্মণী ছিল পরিবেশনে। ওমা! কাজ সেরে এসে দেখেন একটা লুচিও ওঠেনি। সব এক ভাবে পরে আছে। ব্যাস! আর যায় কোথায়। আবার? য়্যাঁ আবার! 

আবার সব ওই ছাইপাঁশ গিলেছে। ছেলে মেয়েগুলো নয় ছোট, বুড়োগুলোও কম যাচ্ছে না। এত ভালো গাওয়া ঘিতে ভাজা লুচি আর সাদা আলুর তরকারি বাবুদের মুখে রুচলো না। সেই ওই আলপ্পেয় টার থেকে খাবার এনেছে। এদিকে পৃথিবীতে কাঁড়িকাঁড়ি ভক্ত কিলো কিলো ঘুষ চড়াচ্ছে,সেগুলো যে ফেলা যাচ্ছে সে বেলা হুঁশ নেই। নোলা বটে! বেচারা লক্ষ্মীর এত অপমান, মা হয়ে কি করে সহ্য করা যায় শুনি। প্রথম প্রথম ঠিক আছে, নিজে ও খেতেন, ভালোই লাগতো । বেশ নিত্য নতুন জিনিস। কিন্তু কদিন ধরে উনি যা ভোগার ভুগছেন গনেশ, কার্তিকদের নিয়ে, উফ! তাছাড়া নিজেও বা কম ভুগছেন? পেটে ভুটভাট কুটকাট তার ওপর চলতে ব্যথা নড়তে ব্যাথা। সব দোষ ব্যাটা নারদের। বয়েসের না আছে পাথর আর না গাছ তবু লোভ দেখো। তা নিজে খাবি খা তা না বাবু সবাই কে দিয়ে খাবেন। ব্যাটা ডেলিভারি বয় হয়েছে। 

"- ফের যদি এদিকে আসতে দেখেছি মুখপোড়া, গায়ে অংক ভূত ছেড়ে দেবো, সাতদিন ধরে বসিয়ে তোদের পাটিগণিতের অংক করাবে। যা দূর হয়ে যা! " 

হিইইইইইইইক! সাতদিন ধরে বসে শুধু অংক। শুনেই নারদ মুনি যা যা এনেছিলেন সব নিয়ে 

"- ও বিষ্ণু জি, ও লক্সমী মাইয়া। আমাইরে বাঁচান। অংক ভূত হামকো খা লেগা। আমি অংক করবো না রে!" বলে কৈলাশে ঢেঁকি স্টার্ট দিয়ে সোজা থামলেন একদম বিষ্ণুলোকে। বেচারা নারদ মুনি, এসেছিলেন ভালোবেসে কৈলাশে সবার জন্য ভালো ভালো খাবার নিয়ে, আর তাকে কিনা পালাতে হলো তাও রীতিমত ভয়ে নিজের মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে! নামটা ভোলেন এই ভাগ্য। 

কিন্তু মা দুর্গা এত রেগেই বা আছেন কেন? শুধু কি মা দুর্গা! সবার ঘরে ঘরে এই হাল। 

সকাল সকাল ইন্দ্রদেবের সাথে শচীমাতার এক চোট হয়ে গেছে। শচীমাতা তো সেই যে রেগে মেগে দোর দিয়েছেন, আর খুলছেনই না। ইন্দ্রের মাথায় হাত! কেন যে তিনি ঘিয়ে ভাজা লুচি মোহনভোগ না খেয়ে বললেন -,এখন যা বুঝছেন কিছুই জুটবে না। খবর পেয়েছেন নারদ সব ছেড়েছুড়ে কোথায় যেন পালিয়েছেন, তার সাথে নাকি কেউ যোগাযোগ করতে পারছে না । এদিকে ঘরে ছেলে মেয়েগুলো সেই থেকে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। এত মহা জ্বালা! 

ওদিকে সরস্বতী ঠাকুরের ভীষণ মন খারাপ। আজ বিকেলের দিকে প্রায় বছর তিনেক পরে ব্রহ্মদেব তপস্যা থেকে উঠেছেন। সরস্বতী তো খুব খুশি। স্নানটান সেরে নতুন শাড়ী পরে ব্রহ্মার পছন্দ মতো পদ্মফুলের রেণু দিয়ে সুন্দর করে পায়েস বানিয়ে দিয়ে বললেন 

"- প্রভু, দেখুন তো মিষ্টি ঠিক আছে। " ব্রহ্মা মিষ্টি টেস্ট করবেন কি সরস্বতীকে দেখে ফট করে বলে বসলেন 

"- তুমি কে গো মা? " 

য়্যাঁ! একি অলুক্ষুণে কথা। নিজের স্ত্রী কে বলে মা! কি লজ্জা কি লজ্জা। 

"- ও মা গো, ও দাদা গো! ও বাবা - না বাবা না, দিদি, ও দিদি গো, দেখো তোমার জামাই কি বলছে গো। জানতাম, এরকম হবে। লং টার্ম তপস্যা করতে গিয়ে সব ভুলে গেছে,এত শর্ট টার্মে ফিরবে না গো ও ও! এবার আমার কি হবে গো ও ও ও! বলে সরস্বতী ভ্যাঁ এ এ এ করে কেঁদে ফেলেলেন। 

"- এই দেখো! করো কি করো কি, কাঁদছো কেন? কি কান্ড। ব্রহ্মা তো ভারী অপ্রস্তুত। 

কোনমতে হেঁচকি তুলে কান্না থামিয়ে হাঁসের পালকে নাক টাক মুছে বললেন 

" - চোখ টা কি একদম গেছে, নাকি? বুড়ো বয়েসে ইয়ার্কি করছো। এসব মস্করা আমি মোটেই পছন্দ করি না, হ্যাঁ! " 

ব্রহ্মা দেব তো একেবারে হ। কে এই মহিলা টি। হ্যাঁ, সরস্বতীর সাথে গলার আওয়াজের মিল আছে বটে। তাছাড়া সরো ও এরকম কথায় কথায় নাকের জলে চোখের জলে করে। কিন্তু যতদূর মনে আছে তপস্যাতে বসার আগে সরস্বতী ছিলেন রোগাসোগা তরুণী, তিন বছরের মধ্যে এরকম সু স্বাস্থবতীর অধিকারিণী কি করে হয়ে গেলো? এক চামচ পায়েস খেয়ে ব্রহ্মা সব জানার জন্য আবার তপস্যায় বসে গেলেন। 

মোট কথা স্বর্গে বেশ ডামাডোল চলছে। 

********************* 

"- দেখে নেবো, বড় বলে পাড় পেয়ে যাবি ভাবিস না, বুঝে নিস। 

"-হুম! বুঝে নিলাম। স্বচ্ছন্দে দেখে নিস । বলে চোখটা টিপে দিলেন শান্তিময়। 

"- উউউউউউউফ! তু তু তুই - তো তো তো কে - স্নেহময় প্রচণ্ড রাগে তোতলাতে থাকে । 

"- থাক, থাক! জিভ টাকে বিশ্রাম নিতে দে। একটু পরেই তো আবার দোকানে লোক ডাকতে হবে। এ নে জল খা। বলে এক গ্লাস জল ভাই এর হাতে ধরিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে গেলেন শান্তিময়। 

ব্যাস, ওই লেগেছে আবার খণ্ড যুদ্ধ। তবে যুদ্ধ মানে গলার আওয়াজ তো একজনের ই পাওয়া যায়। অন্যজন তো মিচকে তবে শয়তান নয়। কে বলবে এদের দুজনেরই বয়েস প্রায় পঞ্চাশের কোটায় এবং সম্পর্কে দুই ভাই। সারাক্ষণ কুট্টাকুট্টি লেগেই আছে। এদিকে কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতেও পারে না। 

হ্যাঁ, রমাপদ শিকদারের পরে দুই যমজ ভাই শান্তিময় আর স্নেহময়। নামের সাথে ক্রোশ যোজন দূরে কোথাও মিল নেই। না তবে দুই ভাই-এ মিল আছে কিন্তু সাথে রয়েছে তেমনি ঝগড়া। কোন পালা পাব্বনে তা যেন আরো ছগুণ বেড়ে যায়। অবশ্য দোষ বেশী শান্তিরই। কিছুদিন শান্তি শান্ত থাকা মানেই মাথায় প্যাঁচ কষছে কি করে ভাই এর পেছনে লাগবে। আজ থেকে নয়, সেই ছোটবেলা থেকে। কখনও কখনও দাদা রমাপদ খুব রেগে গেলে কিছুদিন চুপ থাকেন বটে, তারপর যেই কে সেই। 

রমাপদ বাবুর এই দুটো ভাই এর জ্বালায় অতীষ্ট। পঁচাত্তর বয়েসের রমাপদ বাবু নাম করা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তবে এখন তেমন আর পসার নেই। এখন কে আর তেতো পাঁচন গিলতে চায়। সবাই আজকাল টপ করে নিয়ে ঢক করে গিলে ফেলাতে বিশ্বাসী। তা সে নিয়ে অবশ্য এখন আর তেমন আফসোস নেই তাঁর । নিজেই মরছেন নিজের জ্বালাতে। ভাই দুটো এমনি তে ভালো কিন্তু ওই একটা জিনিষ - আমি বড় না ও। সেই করতে গিয়ে সবার লাইফ হেল করছে। বৌমারা নাতি নাতনীরা বুঝিয়েও এদের ক্ষান্ত করতে পারে নি । যত মিল ঠিক যেন ততই ঝগড়া। আর তারপর শান্তির লেগ পুল। 

আরও মুশকিল দুজনের কর্মক্ষেত্র এক - দুজনেই মানুষের মনের থুড়ি পেটের কাছে থাকেন আর এমন বদমাস, দেখে দেখে ভাইএর দোকানের ঠিক উল্টোদিকে নিজের দোকান বানিয়েছে শান্তি। তবে ভাগ্যিস খাবার আইটেম দুজনের আলাদা। নয়ত নিউ আলিপুরে শিকদার বাড়িতে রোজ খণ্ড যুদ্ধ নয় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হতো। 

নিজের ঘরে হুম হাম করে পায়চারী করছিলো স্নেহময়। এত বড় সাহস দাদার, আমি মানুষের ক্ষতি করছি। আর নিজে কি করছে? কিছু বললে বলবে তুই বেচিস জাংক ফুড আর আমি বানাই হেলদি ফুড। হেলদি ফুড! মাই ফুট। নিজের মনেই দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বিড়বিড় করছিলো স্নেহময়। 

"- বুল্টাই! যাই বল বাপু, যতই জাঙ্ক ফুড হোক, খেতে কিন্তু একঘর। তবে আমার মতো রেগুলার খাওয়ার জিনিস নয়! এই যা। উম্মম্মম্ম! আর হ্যাঁ এই শোন তোর জন্য ক্ষিরের পুতুল রাখলাম, খেয়ে নিস। বলে ফিচেল হাসি হেসে শান্তিময় হাতে ধরা ' কর্ণ পোর্ক সসেজ ব্রেড পাফ' এ একটা বড় কামড় দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। 

ঘস ঘস ঘস। 

উফ! কথা তো নয় যেন বিছুটি পাতা! গা পিত্তি জ্বলিয়ে দিয়ে গেলো। এখনি যেতে হবে বৌদির কাছে নালিশ করতে। দাদার সাহস টা দিন দিন বাড়ছে। নিজের বৌকে তো কিচ্ছু বলার জোটি নেই, ভাসুরকে উনি দাদার আসনে বসিয়ে নিত্য পুজো করেন। বৌদিই যা একটু বোঝে। হচ্ছে তোমার দাদাই 

দাঁতগুলো বোধহয় এবার খুলেই চলে আসবে স্নেহময়ের। 

রমাপদ নিজের হিয়ারিং এডের ব্যাটারি খুলে রেখে দিলেন, সাত দিন ছোঁবেন না। 

********************** 


মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন মা দূর্গা। আর কিছুদিন পরেই মা দূর্গা বাবার কাছে যাওয়া তার মধ্যে এই সব কাণ্ড। বাচ্চাগুলো তো কোন ছাড়, বুড়োগুলো অব্দি মজে আছে ওই সব চামড়া মতো খাবারে । 

এমনিতে স্বর্গে সব খাবার ই উত্তম কোয়ালিটির পাওয়া যায়! তবে দেবতাগণ ভক্তদের থেকে এতকিছু খান যে বহুকাল হলো স্বর্গের রান্নাঘরে তালা ঝুলছে। তবে নিজের ইচ্ছে হলে যে কেউ খাবার বানাতে পারে। মা যেমন খুউউউউব ভালোবাসেন রান্না করে খাওয়াতে। 

তবে আজকালকার ছেলে মেয়েরা, যা দেখবে তাই শিখবে। ভালো মন্দ জিনিস তো এদের মুখে রচে না। আর ছেলেমেয়ে কেন, এদের বাপ কাকারা কি কমযায় নাকি। এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনা। দুপুরে খিচুরি ভোগ খেয়ে সবে একটু ভাতঘুম দেবেন বলে কম্বলের তলায় ঢুকেছেন। শুনলেন বাইরে থেকে শিব ঠাকুর ডাকছেন। বিরক্ত মুখে গুহা থেকে বেরিয়ে দেখলেন একজন লম্বাপানা লোককে নিয়ে এসেছে নারদ। 

-" বলি ব্যাপারখানা কি য়্যাঁ! সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনি, ভূতদের সামলাও, ভক্ত দের সামলাও, ভূত - ভক্তদের হেড অফিস কে সামলাও - আমি দেবতা তো নাকি? বিশ্রাম তো নিতে দেবে। মা ধমকে উঠলেন শিব ঠাকুরকে। শিব ঠাকুর কিছু বলার আগেই নারদ মুনি বলে উঠলেন 

"- মা, আবার খাবো - 

"- কি, আবার খাবি ? একবার খেয়ে হয়নি? যত্তসব - কি চাই কি? হঠাৎ ভর দুপুরে জ্বালাতে এলি কেন? 

বকা খেয়ে নারদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল 

"- মা শান্তি! ময় 

"- ময় আবার কি করলো? ও আমার ভালো ছেলে - দানব তো কি হয়েছে? দানব বলে কি মানুষ নয়? 

"- না, না মা, কালা 

"- কি! আমি কালা - তোর এত বড় সাহস। আ উম্মম্মম 

সবে মা দূর্গা রেগেমেগে নারদ কে শাপ দিতে যাবেন শিব ঠাকুর মা এর মুখে দিয়েছে একটা কালাকাঁদ গুঁজে। 

আসলে হয়েছে কি, স্বর্গে কদিন আগে একজন খুব বিখ্যাত মিষ্টির দোকানের মালিক কে নিয়ে এসেছে দেবদূতরা। সে আবার খুব ভালো ময়রা, ময়রা কাদের বলে বলোতো,হ্যাঁ, যারা মিষ্টি বানায়। কথায় বলে স্বভাব যায় না মলে। প্রথম কদিন তো স্বর্গের যে বাড়িতে তাকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেখানে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে আর আশেপাশে ঘুরে সময় কাটালেন। কিন্তু যারা শিল্পী মানুষ, তারা কাহাতক আর চুপ করে বসে থাকতে পারে তাই একদিন ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গের নন্দন কাননে কামধেনুকে দেখেই তার শিল্পীস্বত্ত্বা জেগে ওঠে। সে করলো কি, কটা বালতি জোগাড় করে বসে গেলো দূধ দুইতে। কামধেনুর তো অফুরন্ত দূধ, বেশ কয়েক বালতি দূধ নিয়ে প্রথমে বানালো কাঁচাগোল্লা, রাঘবসাই, তারপর বানালো রসোগোল্লা। এইভাবে চমচম, ক্ষীরকদম, কালাকাঁদ, আবার খাবো সব বানালো। টাটকা দূধ জাল দেওয়ার গন্ধে সারা স্বর্গ ম ম। নারদ সারাদিনে বার ছয়েক স্বর্গের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চক্কর মারেন। সব খবর তার নখ দর্পণে। ব্যাস আর কি, যেই তার নাকে গন্ধ গেছে ওমনি তিনি গন্ধ গন্ধে ঠিক হাজির, 

"- কে রে ব্যাটা তুই? আর কি বানাচ্ছিস? 

সে লোকতো যাকে বলে আহ্লাদে ষোলোখানা হয়ে নারদ মুনিকে একখান জবরদস্ত ভক্তিপূর্ণ পেন্নাম ঠুকে বললেন 

"- আজ্ঞে প্রভু, আসুন আসুন। সব আপনাদের আশীর্বাদ। এতদিন মর্ত্যবাসীদের সেবা করেছি, এখন এখানেএসেছি, যদি দয়া করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেন তাহলে আমি ধন্য হই - হেঁ হেঁ হেঁ। 

নারদ ও বেশ প্লিজড। তিনি তো লোকটির মুখ দেখেই ঠিকুজিকোষ্ঠী পড়ে ফেলেছেন। 

"- অ, তুই। তা তোর হাতযশের কথা শুনেছি বটে, তা কই দেখি কিছু নমুনা দেখা - চেখে, পরখ করে বুঝি। বলে সুরুৎ করে নাল টা টেনে নারদ নিজের বাহন ঢেঁকির ওপর আয়েশ করে বসলেন। 

"- হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়।" 

বলে লোকটি নারদ মুনিকে একে একে কচুরি, নিমকি, জিলিপি, গজা, কাঁচাগোল্লা, রাঘবসাই - দুধের চমচম, গরম রসোগোল্লা, আবার খাবো সব এক এক করে প্লেটে ফেলতে লাগলো। 

আহা কি অপূর্ব তার স্বাদ, কি সুন্দর গন্ধ। 

নারদ মুনি তো চোখ বন্ধ করে একের পর এক মিষ্টি খেয়ে চলেছেন।সব মিলিয়ে ডজন পাঁচেক মিষ্টি খেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বললেন 

"- না হে! তোমার এলেম আছে। তুমি জাত শিল্পী। আগে এসব খেতে মর্ত্যে যেতুম, কিন্তু আজকাল সব খুব সেয়ানা - চাদ্দিকে খালি ক্যামেরা। লুকিয়ে চুরিয়ে যে খাবো,তার উপায় নেই। 

ইয়ায়ায়ায়ায়াম! সশব্দে ঢেকুর তুলে আবার বললেন ওহ! কতদিন পর এত ভালো মিষ্টি খেলাম। আহা! প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। এককাজ করো কামধেনুকে তোমার কাছেই রাখো, দুধ, দই, মাখন অনেক খেয়েছি - মুখে চড়া পরে গেছে। এখন থেকে রোজ এসে তোমার কাছে মিষ্টি খেয়ে যাবো। 

"- আজ্ঞে নিশ্চই স্যার - ইয়ে বাবাঠাকুর রোজ আসবেন, আমি এই তো চাই। আপনাদের উৎসাহ পেলে আরো অনেক কিছু বানাবো। খাওয়াবো - হেঁ হেঁ হেঁ। 

তারপর সে মাথাটা একটু চুলকে আমতা আমতা করে বলল 

"- বলছিলাম কি ইয়ে স্যার, আমাকে একটু যদি সাহায্য করেন তাহলে বড় বাধিত হতুম । " 

নারদ তখন অত খেয়ে দেয়ে হাঁসফাস করছেন। ঢেঁকি ও তাকে ধরে রাখতে পারেনি, ঘরের উঠোনে আধশোয়া হয়ে শুয়ে ছিলেন, কোনমতে উঠে বসে চিঁ চিঁ করে বললেন 

"- কি সাহায্য শুনি! সাধ্যের মধ্যে হলে চেষ্টা করে দেখবো। 

"- আমার খুব ইচ্ছে দেবাদিদেব মহাদেব কে নিজে হাতে কিছু মিষ্টি খাওয়াই। আপনি যদি একটা ব্যবস্থা করে দেন। 

নারদ মুনিও স্বভাবমত বললেন 

"- তা বাছা শুধু দেবাদিদেব কেই বা কেন? বাকিরা কি দোষ করলো শুনি? " 

"- আজ্ঞে সেই সৌভাগ্য কি আমার হবে। তা হলে তো আমি ধন্য হই। 

কোনমতে নিজেকে ঢেঁকীর ওপর ফেলে নারদ মুনি বললেন 

"- আমি আছি কি করতে! ওনাদের এই অপূর্ব স্বাদ থেকে বঞ্চিত করতে পারি না। আমি সব ব্যবস্থা করবো। তুমি বানাতে থাকো। 

এমনিতে মর্ত্যে দেবতারা ভোগ হিসেবে কখনো সখনো ভালো মিষ্টি টিষ্টি পান কিন্তু সাধারণত বেশীর ভাগ সময় নকুলদানা আর নয়ত ভেজাল দুধের গুজিয়া বড়জোর দানাদার। উৎসব টুৎসবে যাও পান তাতে দুধ থাকে কিনা - বড়ই সন্দেহ। তাই যা আবার তাই হলো। 

রোজ সকাল দুপুর রাত স্বর্গের ঘরে ঘরে সব নেশায় বুঁদ - কিসের নেশা? রাবড়ীর নেশা - পান্তুয়ার নেশা- কালোজাম, জলভরা, রাজভোগ, সীতাভোগ, মিহিদানা, সড়ভাজা আরো কত কি? 

নারদ সাপ্লায়ার। 

এদিকে মর্ত্যে ঘোর বিপদ। দেবতারা সব অফ ডিউটি। ডাকাডাকি বেড়ে গেছে - ভোগ আর দানের পরিমাণ ও অথচ কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। কি করে হবে? দেবতারা খালি খাইখাই করছে - করেই যাচ্ছে। এদিকে শরীরে চিনির হার বাড়চ্ছে এক্কেরে হুহু করে। 

সেই ক্রেজ বেশ কিছুদিন চলল। সবে মা দুর্গা করলার রস, নিমপাতার চাটনী, উচ্ছের শরবত খাইয়ে ভয় দেখিয়ে সবদিকটা একটু সামাল দিয়েছেন, এখন আবার আরেকটা উটকো বিপদ। মিষ্টিমাষ্টা তাও এত বাচ্চাদের পছন্দ না কিন্তু এবার যে এসেছে তার বানানো জিনিস তো আবালবৃদ্ধ সবার কাছে অসম্ভব প্রিয় হয়ে উঠেছে। 

মা দুর্গা নিজেও খেয়েছেন। সত্যি, মর্ত্যে যে এরকম উপাদেয় খাদ্য পাওয়া যায় তা তো তিনি জানতেন না। মনে হয় খেয়েই যাই - খেয়েই ইইই যাই। 

মাস ছয়েক ধরে এই হচ্ছে। সকালে গার্লিক ব্রেড টোস্ট, মেয়ো সসেজ স্যাণ্ডুইচ, দুপুরে চিকেন হ্যাম প্যান ফ্রায়েড পিজ্জা উইথ এক্সট্রা চিজ। রাতে হ্যাম চিজ বার্গার, চিকেন ড্রাম স্টিক, হট ডগ আরো কত কি? যাস্ট একবার মনে মনে ভাবতে হবে,ব্যাস তুরন্ত এসে উপস্থিত। সারা স্বর্গের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গেছে এদের নাম। একদিকে " মন হরণ " অন্যদিকে " পিজ্জা বাঙলো"। 

মা এর মাথায় আবার হাত। বাচ্চা বুড়ো খাচ্ছে আর ফুলছে। ফুলছে তাও খাচ্ছে। আগে রক্তে ছিল চিনি এখন চর্বি। এই তো গনেশটা কি ভুগছে। বেচারার একটা দাঁত একেই ভাঙা, তার ওপর তাতে আবার পোকা লেগেছে। ওদিকে সরস্বতী এত ফুলে গেছে যে ব্রহ্মদেব চিনতে অব্দি পারেছেন না তাকে। শুধু সরো নাকি নিজের ও তো এক দশা। নন্দী ভৃঙ্গী উইথ তাদের হেড মাস্টার অব্দি ফুটবলাকৃতি রূপ ধারণ করে ঢুলছেন। শচীর ঘরে ও বাচ্চাগুলো কদিন ধরে পেটের সমস্যাতে ভুগছে। তাও যেন কাউকে থামানো যাচ্ছে না। 

অগত্যা মা দুর্গা হাঁক পাড়লেন 

" না আ আ আ র র র দ" 

************************* 

আমরা দুটি ভাই/ শিবের গাজন গাই। 

নাহ! এখন আর তারা শিবের গাজন গাইছে না। আর তাদের মধ্যে ঝগড়াওও নেই। 

নারদ মা এর থেকে থ্রেট পেয়েই ছুটেছিলেন রমাপদ বাবুর কাছে। কিন্তু উনি তো হাত সরি হিয়ারিং এডের পাঠ তুলে দিয়েছিলেন। নিজের বাড়িতে তাও কোনমতে এসব জাংক ফুডের থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নারদ প্রথমে নিজের আইডেন্ডিটিডি ক্রাইসিস কাটিয়ে নেই খাদ্যের প্রভাব থেকে কিভাবে রক্ষা পাবেন জিজ্ঞেস করাতে হাতে একটা বোতল ধরিয়েছিলেন উনি। আর সাথে গনেশের দাঁত ব্যাথার দাওয়াই ও দিয়েছিলেন। ফিরে এসে সেটা মা দুর্গার হাতে ধরিয়ে সরে পড়েন নারদ বাবাজী। বোতলটা খোলাতে গন্ধে শিব ঠাকুরের আপন দেশে ওনার সাঙ্গপাঙ্গদের নাম ভুলিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। কার্তিক গনেশকে তো বটেই বাকিদের ধরে মা এক চামচ করে সেই খাওয়াচ্ছেন আর মুখ টিপে বসে আছেন। এত বমি পরিষ্কার কে করবে? গন্ধই এমন - খেতে যে কি হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। রমাপদ বাবুর কথামতো মা সবাইকে হুমকি দিয়েছেন আর ওই ছাইপাঁশ পাউরুটির আঁশ কুমড়োর সস খেলে রোজ এই জিনিস গেলাবেন। ব্যাস! ওষুধ কি আর গাছে ফলে উহু ' কড লিভার অয়েলের ' এ বোতলে ধরে। 

" ত্রিরুচেল্লাপল্লি আট্টাপট্টি মহাবালেশ্বরম উক্কুটি জ্ঝিক্কুটি কুচিপুরি উদয়ম উত্তাপম ধোসায়ম উরুপম কেরালম ত্রিবান্দম কন্যাকুমারীয়ম " 

মড় মড় মড়। যাক পঁচিশ বারেই কাজ হয়েছে। গনেশ এর পোকা খাওয়া দাঁত টা রমাপদ বাবুর দেওয়া নামের গুঁতোতে ভেঙে পড়েছে। এবার রোজ কলগেট দিয়ে দিনে দুবার দাঁতন, ব্যাস প্রব্লেম সলভড। মা দুর্গা কিছুটা রিলিফ পেয়েছেন বটে কিন্তু পুরোপুরি না। কি করা যায়? 

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ব্যাস,কেল্লা জয়। 

ডাক পড়লো দুই অবতার স্নেহ শান্তি ও তাদের কুরিয়ার বয় নারদ ঠাকুরের। 

********************* 

"- দেখ আমারটা স্যার কত ভালোবেসে খেলেন। 

"- আর আমারটা দেখলি না? কত কিলো প্যাক করে নিলেন দেখেছিস? 

"- সত্যি স্বর্গে সবাই কেমন যেন করছিলো। এখানে দেখ। আসলি কদরদান এতদিনে পেয়েছি। 

"- সত্যি রে! হ্যাটস অফ টু আওয়ার স্যার। 

স্নেহ আর শান্তি দোকান বন্ধ করে গলা জড়াজড়ি করে চলে গেলো। 

না,স্বর্গে আর সমস্যা নেই। বছর খানেকের ধাক্কা সামলাচ্ছে এই যা! দুই ভাই এর পরপর আগমন এবং সেবার চোটে দেবীরা কদিন খুব নাজেরহাল হয়েছিলেন। এখন সব আন্ডার কন্ট্রোল। সবাই এখন মর্ত্যবাসীদের দেওয়া খাবারে তুষ্ট,বাধ্য হয়ে। মাঝেসাঝে মনে হয় বটে, যাই একটু খাই কিন্তু - নাহ! চতুর্থ ইন্দ্রিয়ের চরকায় 'কড লিভার অয়েলের' তেলদান, যাস্ট ইম্পসিবল! 

তবে নারদ এখন আর কুটকাচালিতে নেই। হি ইজ নাও বিজনেস ম্যান। ' নারদ এন্ড কোং'! ফুড সাপ্লায়ারের বিজনেস তবে দুঃখ এই যে স্বর্গে তিনি ব্ল্যাক লিস্টেড। এখন এই সব খাবার যায় নরকে। যম দক্ষিণ দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকেন - প্যাকেটগুলো নেন আর খুপরিতে খুপরিতে সাপ্লাই করেন। আহা! খাক। এদের সবার পাপী পেট - পাপী মন। যতই মিষ্টি আর চিজ যাক - কিস্যু হবে না। 

এযাত্রায় নারদকে রক্ষা করেছেন স্বয়ং মহিষাসুর, যমের সাথে পরামর্শ করে। মা দুর্গাকে সাহায্য করার চান্সটা কি করে আর মিস করেন মহিষাসুর। তার ওপর যখন স্বয়ং দুর্গা মা নিজেই সাহায্য চেয়েছেন। এদিকে নরক একদম গুলজার। রোজ পার্টি উহু নো পলিটিক্স। সারাদিন তেলে ভেজে জলে পুড়ে আগুনে জ্বলে বটে - কিন্তু পেটে যা পড়ে তাতে দিল তাদের একদম গোলাপ খাসের বাগান হয়ে যায় । শুনেছি ইদানীং নরকের ভিড়টা বাড়ছে। 

এদিকে দুই ভাই, শান্তি স্নেহ ও খুব খুশি। রোজ মন্ত্র জপে 

" লং লিভ মহিষাসুর। " 

" যুগ যুগ জ্জিও যম ঠাকুর" 

" নরক বাসী অমর রহে" 

" নরক আমাদের স্বর্গ।" 

1 comment:

  1. অমর রহে, অমর রহে। এত লোভ কেউ দেখায় গল্পে!!! আমি নরকের টিকিট কেটে রাখলাম।

    ReplyDelete