প্রবন্ধ - সৌভিক চক্রবর্তী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
ফ্যান্টাসি, নারনিয়া ও বাইবেল
সৌভিক চক্রবর্তী
“ফ্যান্টাসি আর স্বপ্ন একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে, সেই প্রথম দিন থেকেই। ঘুমোতে না চাওয়া ছোট্ট বাচ্চাকে তাই স্বাভাবিক অভ্যেসেই তার মা সুরেলা গলায় গল্প শোনান – আকাশের, চাঁদের, দূরদেশের পক্ষীরাজের। দুচোখের পাতা এক করামাত্র সে পৌঁছে যায় স্বপ্নের দুনিয়ায়, অবচেতন জগতটার সঙ্গে অনায়াসে মেতে ওঠে হাসি-খেলায়।”
হ্যাঁ, এখানেই ফ্যান্টাসির সার্থকতা, তার অপরিসীম জনপ্রিয়তা। একের পর এক উদাহরণে দেখানো যায়, কীভাবে ফ্যান্টাসি ভেঙেছে দুর্ভেদ্য দেয়াল, রুক্ষ, কঠোর বাস্তবের হাত থেকে ক্ষণিকের স্বস্তি উপহার দিয়েছে পাঠককে, জুড়েছে হৃদয়, দিয়েছে আশ্রয়। আর এই কারণেই বোধহয় ইউরোপ এবং আমেরিকায় বিশেষ সমাদর পেয়েছে হাই ফ্যান্টাসি, সোর্ড অ্যান্ড সর্সারী, কনটেম্পোরারি ফ্যান্টাসি, মিথিক্যাল ফ্যান্টাসি, ডার্ক ফ্যান্টাসি এবং ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতো উপধারা। একটু পেছনে ফিরলে দেখব, সুমেরীয় ‘এপিক অফ গিলগামেশ’ দিয়ে ফ্যান্টাসি সাহিত্যের যাত্রা শুরু। তারপর চলার পথে মাইলফলকের মতো এসেছে গ্রীক মহাকবি হোমারের ‘ওডিসি’, ভার্জিলের রোমান মহাকাব্য ‘এনিড’, মধ্য-প্রাচ্যের ‘আ থাউজ্যান্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস’, ওল্ড ইংলিশে লেখা ‘বেউলফ’।উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের শুরুর দিকে যখন উইলিয়াম মরিস, অস্কার ওয়াইল্ড, জে. এম. ব্যারী, রুডইয়ার্ড কিপ্লিং, লর্ড ডানসানিরা ইংরেজি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ততদিনে ফ্যান্টাসির খোলনলচেই পালটে গেছে। বিংশ শতাব্দী নিঃসন্দেহে স্পেকুলেটিভ ফিকশনের নবজাগরণের যুগ; টলকিন, লুইস, রোলিংদের বেস্টসেলারগুলো ছাড়াও এই শতকে আমরা পেয়েছি টেরি ব্রুকসের ‘দ্য সোর্ড অফ শানারা’, রবার্ট সিলভারবার্গের ‘মাজিপুর ক্রনিকলস’, ফিলিপ পুলম্যানের ‘হিজ ডার্ক মেটিরিয়ালস’, টেরি প্র্যাচেটের ‘ডিস্কওয়ার্ল্ড’, স্টিফেন কিংয়ের ‘ডার্ক টাওয়ার’, রবার্ট জর্ডনের ‘দ্য হুইল অফ টাইম’এর মতো দুর্ধর্ষ সব ফ্যান্টাসি সিরিজ। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ যুগে লেখা অ্যাঞ্জি সেজের ‘সেপটিমাস হিপ’, রিক রায়ার্ডনের ‘পার্সি জ্যাকসন’, ক্যাসানড্রা ক্লেয়ারের ‘সিটি অফ বোনস’ সিরিজগুলোর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আমাদের অবাক করে।
ডঃ সিউস বলছেন, “Fantasy is a necessary ingredient in living, It's a way of looking at life through the wrong end of a telescope. Which is what I do, and that enables you to laugh at life's realities.”ফ্যান্টাসির এরচেয়ে উপযুক্ত বিশ্লেষণ মনে হয়না আর কিছু হতে পারে বলে। ম্যাজিক, কাল্পনিক জগৎ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব, অলৌকিক জীবজন্তু জাতীয় নানা মোটিফ আমাদের পাঠকসত্তার কাছে ‘সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ’ দাবী করে, বাস্তবের সীমারেখার বাইরের বিষয়গুলোকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। কখনও লেখক তাঁর চারপাশের জটিল সামাজিক সমস্যাগুলোকে ফ্যান্টাসির রূপকে মুড়ে তুলে ধরেন পাঠকের সামনে, আবার কখনও বা মানুষের মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারতম্যগুলো তাঁর সুদক্ষ লেখনীতে খুঁজে পায় ভাষা।টলকিন সাহেবের ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’এ সমস্ত রকম বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে খুদে হবিট ফ্রোডো ব্যাগিন্সের অসীমসাহসী অভিযান, হ্যারি পটারে বর্ণিত অত্যাচারী, ক্ষমতালোভী শক্তির বিরুদ্ধে এক অনাথ কিশোরের মরণপণ সংগ্রাম – এ সবই মন কেড়ে নেয় আমাদের। আর মন কাড়ে সি এস লিউইসের ‘ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া’। এক অপূর্ব জগৎ, একের পর এক মায়াবী অভিযান, পরতে পরতে মিশে থাকা বিব্লিক্যাল অনুষঙ্গ আর অনেকখানি ভালোবাসার উপাদান।
বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে আমরা জানতে পারি ক্রিয়েশনের কথা, দিন আর রাতের কথা, আলো আর অন্ধকারের কথা, প্রথম মানব মানবীর কথা। আরো জানি, ঈশ্বরের জগতে অশুভর প্রথম আগমনের রহস্য। নার্নিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। পেভেন্সি পরিবার ওয়ারড্রোবের ওপারের দুনিয়ায় প্রথমবার পা রাখার অনেক অনেক আগের নার্নিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটান লিউইস, তাঁর ‘দ্য ম্যাজিশিয়ানস নেফিউ’ উপন্যাসের মাধ্যমে।ডিগরি আর তার বন্ধু যাদু আংটির প্রভাবে পৌঁছে যায় এক অন্য মায়াজগৎ ‘উড বিটউইন দ্য ওয়ার্ল্ডস’, এবং তারপর মৃত্যুপথযাত্রী মহানগর চার্ণে। চার্ণেই আমরা পাই অশুভের মূর্ত প্রতীক, হোয়াইট উইচ জেডিসকে। ঘুম থেকে জেগে উঠে বিশ্বকে নিজের পদতলে করার আকাঙ্ক্ষা জাগে জেডিসের অন্তরে। এ যেন সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সেই ‘ভেনগ্লোরি’ যা স্বর্গ থেকে লুসিফারের পতন ডেকে এনেছিল। এরপর এগোতে থাকে গল্প, অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর মুগ্ধ বিস্ময়ে আঁধারঘেরা মহাশূন্য থেকে আসলান নামক এক অসীম ক্ষমতাশালী চরিত্রের হাতে নারনিয়া সৃষ্টির সাক্ষী হই আমরা।
আসলানকে যীশু খ্রিষ্টের রূপক হিসেবে কল্পনা করে নেওয়া পাঠকের পক্ষে খুব একটা পরিশ্রমসাধ্যহবেনা হয়তো।কিন্তুমনে রাখতে হবে, বিষয়টা অতটাও সরল নয়।নার্নিয়াসেইঅর্থেকোনও ‘নেভার-নেভারল্যান্ড’ নয়, বরং আমাদের জগতেরই বিকল্প রূপ। আরসেই পটভূমিতে মসীহা আসলানের অবতরণ ততটাই বাস্তব যতটা ভার্জিন মেরীর কোলে ‘সন অফ ম্যান’এর অলৌকিক আবির্ভাব। আসলান সম্বন্ধে লিউইসের নিজের বক্তব্যকেই এক্ষেত্রে আমরা প্রামাণ্য ধরতে পারি–“He is an invention giving an imaginary answer to the question, ‘What might Christbe come like if there really were a world like Narnia, and He chose to be incarnate and die and rise again in that world as He actually has done in ours?’This is not allegory at all.” নিউ টেস্টামেন্টের রিভিলেশন ৫:৫’এ‘লায়ন অফ জুডাহ’ রূপে বর্ণিত যীশু যে আক্ষরিক অর্থেই পশুরাজ সিংহ হয়ে নার্নিয়ার জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন সে বিষয়ে যেমন কোনও সন্দেহ নেই, তেমনই সন্দেহের অবকাশ নেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ উচ্চতা ছোঁয়া আসলানের ঈশ্বরত্ব সম্বন্ধেও। সিরিজের প্রথম উপন্যাস‘দ্য লায়ন, দ্য উইচ অ্যান্ড দ্য ওয়ারড্রোব’ উপন্যাসে এডমান্ডকে বাঁচাতে আসলানের আত্মবলিদান এবং তৎপরবর্তী পুনরুত্থান আমাদের মনে খ্রিষ্টের ক্রুশিফিক্সন এবং রেজারেকশনেরই প্রতিধ্বনি জাগায়। সাময়িক পথভ্রান্ত এডমান্ডের উত্তরণথেকে শুরু করে হোয়াইট উইচের অভিশাপ থেকে নার্নিয়াকে মুক্ত করা – সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বরের পুত্রের অমর, অক্ষয় হস্তাক্ষর স্পষ্ট।
ক্যাথলিক খ্রিষ্টান থিয়োলজিতে ব্যাপ্টিজমের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষত জন দ্য ব্যাপটিস্ট প্রণীত ওয়াটার ব্যাপ্টিজম। এই পরিপ্রেক্ষিতেই লিউইসের তৃতীয় উপন্যাস,‘ভয়েজ অফ দ্য ডন ট্রেডার’, আমাদের উপহার দেয় নার্নিয়া সিরিজের অন্যতম শক্তিশালী রূপকধর্মী দৃশ্যকল্প, যেখানে স্বার্থপর, লোভী, সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার অধিকারী ইউস্টেস স্ক্রাব রূপান্তরিত হয় এক কদাকার ড্রাগনে। এই ড্রাগন অবশ্যই কুখ্যাত ফলে নএঞ্জেল লুসিফারের ইঙ্গিতবাহী, বাইবেলে একাধিকবার ‘সারপেন্ট’ এবং ‘ড্রাগন’রূপে বর্ণিত অ্যাডভার্সারি শয়তানের প্রতিমূর্তি হিসেবে পাঠকের সামনে আসে। আমরা দেখি, বারবার চেষ্টা করেও ড্রাগনের খোলস ছেড়ে নিজের আসল রূপে ফিরতে সফল হয়না ইউস্টেস। শেষ পর্যন্ত আসলান তাঁর ধারালো নখের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করতে থাকে ড্রাগনটাকে, এবং বেরিয়ে আসে রক্তাক্ত, যন্ত্রণাকাতর ইউসটেস। ওই অবস্থায় ইউস্টেসকে জলে ডুবিয়ে দেয় আসলান। ডুব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুছে যায় তার মনের ক্লেদ-কলুষ, জল থেকে উঠে শুদ্ধ, পবিত্র এক নতুন জীবন লাভ করে সে।
এরকম আরও অনেক অনেক আলোচনা করা যায় বিশ্ব ফ্যান্টাসি, নারনিয়া এবং বাইবেল নিয়ে। কিন্তু সময়ের অভাবে আজ থামতে হচ্ছে এখানেই। আশা রাখি, অন্য কোনও দিন সম্পূর্ণতা পাবে এই আলোচনা। পাঠক, সত্যি বলছি, আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও অধীর অপেক্ষায়।
0 comments: