0

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


মানিক জ্বলে মনে
চয়ন


মানিকবাবুর ছোটদের জন্য লেখা তুমি পড়েছ? 'মশাল'? 'পাশ ফেল'? 'চোর সাধুচরণ'? কী বলছ? এগুলো মানিকবাবুর লেখাই নয়? ওহো! তুমি মানিক রায় ভাবছ বুঝি? আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলছিলাম। 

হ্যাঁ, তিনিও ছোটদের জন্য লিখেছেন। তবে, তিনি ছোটদের জন্য লেখা বলতে একটা বিশেষ ধরণের লেখাকে বুঝতেন। 

ছোটদের জন্য লেখা কাকে বলে? অনেকে বলেন, এই সাহিত্য হবে সহজ, সরল, উপভোগ্য। জটিল জীবনের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেওয়ার দায় এ সাহিত্যের নয়। কিন্তু এই সংজ্ঞাটা একেবারে সঠিক বলা যায় না। ভেবে দেখ, 'মহেশ' বা 'ছুটি' কি ছোটদের কথা ভেবে লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ? অথচ এই দু'টো গল্পই ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে থাকে। 'ভোম্বল সর্দার' স্বীকৃত কিশোর সাহিত্য। ক্লাসিক বলে এর খ্যাতি। সেখানেও দেখি এই ভাগাভাগি খুব একটা মানা হয়নি। ভোম্বলের অস্থিরতা, বড়দের ওপর তার রাগ, জীবনকে দেখার তার দৃষ্টিকোণ আর সবার ওপর এ বই এর ভাষার চলন --কোনওটাই ঠিক সরল নয়! এ বই আসলে দুই ধরণের পাঠকের সাথে কথা বলে। এক, যারা শুধু গল্পটা পড়বে, মানে ছোটরা; আর দুই, যারা এর রচনা কৌশলও নজর করবে সঙ্গে সঙ্গে, অর্থাৎ বড়রা। এই দুই স্তরে কথোপকথন বহু সার্থক ছোটদের জন্য লেখা সাহিত্যের মূল শক্তি। এটা বারবার দেখা যায় যে সত্যিকারের শিশু কিশোর সাহিত্য রচয়িতারা কখনও তোমাদের বোধশক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন না। অবনীন্দ্রনাথ করেননি, লীলা মজুমদার করেননি আর করেন নি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ সাহিত্যের এই শাখায় তাঁর অবদানের কথা অনেকে জানেনই না। 

মানিক একবার লিখেছিলেন, 'বড়দের জন্য লেখা এমন গল্প যদি বেছে নেওয়া যায় যাতে কিশোর মনকে বিগড়ে দেবার মতো কিছুই নেই। বরং গল্প পড়ে বড়দের জীবন সংঘাতের কমবেশি পরিচয় পেয়ে কিশোর মন নাড়া খাবে, বিস্ময় ও অনুসন্ধিৎসা জাগবে,সেরকম গল্প কিশোরদের পড়তে দিলে দোষ কি?' বুঝতেই পারছ, তিনি খোকাপনা বাদ দেওয়া, মানুষের গন্ধ মাখা, জীবনের তাপে উত্তপ্ত লেখার কথা বলছেন - যা ছোট-বড় সবার। এই বোধ সম্বল করেই তিনি তোমাদের জন্য উপন্যাস লিখতে গিয়েছিলেন। 

একটা উপন্যাসের নাম শুরুতেই করেছি। 'মশাল।' 'রংমশাল' পত্রিকায়, ১৩৫১ -এর শ্রাবণ সংখ্যায় আরম্ভ হয়ে কিছুদিন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায় সেটি। ১৩৫২ এর ভাদ্র সংখ্যায় ছাপানো এক বিজ্ঞপ্তিতে লেখক জানান,

'অসুখ, হাঙ্গামা, দাঁতের শত্রুতা এইসব অনেককিছু আমায় সাময়িকভাবে কাবু করেছে। ... সুস্থ হলেই মশাল লেখার চেষ্টা করব।' 

সে চেষ্টাটা আর করতে পারেননি মানিক। কেন, কেউ জানে না। 

একই পরিণতি হয়েছিল 'মাটির কাছে কিশোর কবি' উপন্যাসটিরও। 'আগামী' পত্রিকার আশ্বিন -কার্তিক ১৩৫৯ সংখ্যায় এর প্রকাশসূচনা। পরের বছর মাঘ সংখ্যা পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে সাতটি পর্ব প্রকাশ পায়। তারপর, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৬০ সংখ্যায় সম্পাদক প্রতিশ্রুতি দেন, 'অনিবার্যকারণে এবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস মাটির কাছে কিশোর কবি প্রকাশ করা গেল না। সামনের মাস থেকে আবার সঠিকভাবে প্রকাশিত হবে।' সে সামনের মাস আর আসেনি। 

কেন যে তিনি মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলেন এই উপন্যাস কারোর তা জানা নেই। যেমন জানা নেই 'রাজীবের লম্বা ছুটি' খাতার পাতায় অসমাপ্ত পড়ে রইল কেন। 'কিশোর কবির' পরিণতি মানিক ভেবে রেখেছিলেন। উপন্যাসটা যতদূর ছাপা হয়েছিল তার মধ্য থেকেই বোঝা যায় কবিতার শক্তিতে খিদে, অভাব, রোগ, অবিচারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কাহিনী এটা। মূল সুরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, মানিক থেমে যাওয়ার পাঁচ বছর পর, ১৩৬৫-এর 'আগামী'-এর শারদ সংখ্যায় উপন্যাসটি শেষ করেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র।

আসলে, তোমাদের জন্য লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটাই সম্পূর্ণ উপন্যাস আছে। 'মাঝির ছেলে'। ধারাবাহিক ভাবে এ লেখা বেরোয় 'মৌচাক' -এ। শ্রাবণ ১৩৪৯ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩৫০ পর্যন্ত। পড়লেই দেখা যায় অন্যান্য ছোটদের লেখা থেকে এ উপন্যাস কতটা আলাদা। ভাল মন্দ, সাদা কালোর সোজা-সাপটা ফারাককে বেমালুম অস্বীকার করে এ বই। বার বার জানাতে চায় জীবন ঠিক অতটা সরল নয়। 

যাদববাবু অভিজাত বংশে জন্মেছেন, কিন্তু মাঝির ছেলেকে নাগার প্রতি তাঁর কোনও তাচ্ছিল্য নেই। তাঁর মায়া আছে, মমতা আছে। আবার, তিনিই চোরাচালানকারী! নাগা এঁর কাছ থেকেই বিবেক আর ন্যায় এর ওপর আস্থা রাখতে শেখে। অন্যদিকে যাদববাবুর ভাই মাধববাবু কোনও বেআইনি পেশায় যুক্ত না থাকলেও, অর্থলোভে কত নীচে যে নামতে পারেন তার সীমা নেই। তাহলে এ গল্পের দুষ্টুলোক কে? নাগা যাদববাবুর সঙ্গী হয়; কিন্তু, তার মনে সদাই সংশয় আর দ্বিধা। সে বারবার দেখে, ভালো মন্দ সব ছাড়িয়ে মানুষ শুধু মানুষ। ডাকাত উদার হৃদয়, পুলিশের খোচর বন্ধুবৎসল। অথচ, সমাজ অস্বীকৃত পেশাও তো অস্বস্তি জাগায়। তাই নাগা বিশালের স্বপ্ন দেখে। সে সাগরে যেতে চায়। তারপর একদিন তুফানে উত্তাল নদীর বুকে জলপুলিশের তাড়ায় বিপথে ছোটা লঞ্চের বুক থেকে 'বড় একটা ঢেউ এসে.. নাগাকে.. তুলে নিয়ে চলে যায়।' আর নাগার মনে হয় এতক্ষণে তার সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ হলো যার শেষ হবে 'একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে'।

কাহিনীর এই রূপরেখায় মাঝির ছেলের পরিচয় কিছুই পাবে না তুমি। বুঝবে না কেমন করে এ উপন্যাসের প্রতি ছত্রে জেগে থাকে দপদপে প্রাণ। কি বলিষ্ঠ জীবনবোধ প্রকাশ করে লেখকের অননুকরণীয় রচনাশৈলী। তাই এ লেখা তোমাকে পড়তে হবে। 

পত্রভারতীর তৈরী করা বইটা পড়ে নাও। তারপর প্রশ্ন করো। প্রশ্ন করো, কেন এ লেখার তেমন পরিচিতিই নেই? মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ কেন তেমনভাবে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন না এর সম্বন্ধে? প্রশ্ন করো, কেন 'মাঝির ছেলে' ক্লাসিক বলে নাম করেনি? 'মৌচাক'-এ ধারাবাহিক শেষ হওয়ার পর আরও তের বছর বেঁচে ছিলেন মানিক। এর মধ্যে কেউ 'মাঝির ছেলে' বই করে ছাপায়নি কেন? কিসের বাধা ছিল, বা আছে? প্রশ্ন করো। উত্তর পেলে আমাকে জানিও।

0 comments: