5

ভূতের গল্প - অনুষ্টুপ

Posted in



ভূতের গল্প


দৃষ্টি
অনুষ্টুপ


"মাম্মা! দেখো দেখো কি পেইছি!"

মিসেস বসু মুখ তুলে হেসে ফেললেন দেখে। একটা বেশ বড় সামুদ্রিক ফেনার টুকরো। তাঁর পাশের টেবিলে আরো টুকরো টাকরা সম্পত্তির সাথে সেটা রেখে দিয়ে মেয়ে আবার দৌড়োলো বালি মাড়িয়ে। দুদিকে দুটো বিনুনী করে দিয়ে মেয়েটাকে আস্ত পুতুলের মত সুন্দর লাগছে। গোয়ার সমুদ্র যেমন নীল, তেমনি ঝকঝকে নীল আকাশ। তেমনিই হাল্কা নীল ফ্রক পুপুর গায়ে, সাদা লেসের ফ্রিল দেওয়া গলায় হাতে বুকের কাছে। খুব আনন্দ পেয়েছে আজ সারা সকাল জলে দাপিয়ে।

বিকেলের আলো পড়ে আসছে। সূর্যাস্তটা দেখে, ঘরে ফিরে যাবেন। পুপুর অল্পেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। তাছাড়া খায়ওনি কিছু। গিয়ে একটা চীজ স্যাণ্ডউইচ বলবেন? না হট মিল্কের গ্লাস? দেখা যাক, বুবুনদাদা যা খাবে মেয়েও সেটাই চাইবে।

"মাম্মায়ায়ায়া!"

নাচতে নাচতে আসছে। আবার কী পেল কে জানে!

মেয়ের বাবাও আসছে ছবি তোলার পালা সেরে। মিসেস দত্ত উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে।

------

আশিস আর রজতাভ সেই কলেজ লাইফ থেকে বন্ধু। একসাথে সপরিবারে ঘুরতে আসাটা মাঝে মাঝেই হয়, ফলে দুই মিসেসও যেমন বন্ধু হয়ে গেছেন, পুপু আর তার বুবুনদাদাও পিঠোপিঠি খেলার সঙ্গী। সন্ধেবেলা বাবা মায়েদের আড্ডায় বসে বড়দের গল্প শুনতে তাদের ভারি বয়েই গেছে, দুজনে লাফাতে লাফাতে পাশের হলটায় দৌড়য় খেলবে বলে।

বড় হলটা ডাইনিং এর জানলা দিয়ে পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। তবু মিসেস বসু মনে করিয়ে দেন, "একদম সামনেই থাকবে, চোখের আড়াল হবে না!"

খেলা জমেছিল খুব। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছিল দুজনে। এসির মধ্যেও ঘামে গলা পিঠ ভিজে গেছে। পুপু এমনিতেই চঞ্চল, হাতে পায়ে দুরন্ত। হাঁপাতে হাঁপাতেও তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল সে এক পায়ে।

"লুকোচুরি খেলবি?"

এখানে? খেললেই হয়। এত চেয়ার টেবিল সোফা, দরজার আড়াল...ভালই জমবে।

"তুই যা লুকো, আমি টেন কাউন্ট করে আসছি।"

বুবুন দেওয়ালের দিকে ফিরতেই পুপু ধাঁ করে দৌড়য়। এই সোফাটার পিছনে? না দেখে ফেলবে এক্ষুণি। ওদিকের দরজাটার আড়ালে...এই রে ফাইভ অবধি বলে ফেলেছে...ছোট্ ছোট্...

দরজাটা একটা করিডোরে খুলেছে। পাশে বিশেষ জায়গা নেই, দরজার পাল্লা সোজা না রাখলে তো ধরে ফেলবে....

আরে, পাশের এই দরজাটার পিছনে অনেকটা জায়গা তো! ছোট্ট অ্যান্টিরুম একটা মনে হচ্ছে। কিন্তু অন্ধকার যে...

"নাইন...টেন...কা-মিং!" বুবুনের গলা ভেসে আসতেই সুট্ করে দরজাটা খুলে ঢুকে পড়ে পুপু। উত্তেজনায়, আর হাসি চাপার প্রবল চেষ্টায় কাঁপতে থাকা ছোট্ট মেয়েটার কানে মৃদু 'ক্লিক্' আওয়াজটা পৌঁছয় না।

----------

গল্পগুলো ক্রমশঃ মুচমুচে হচ্ছিল। আপাতত মিসেস দের ভাই আর ভাই-বৌয়ের ইউরোপ ট্যুরের ধারাবিবরণী হাঁ করে গিলছিলেন মিসেস বসু। পাশের টেবিলে দ্বিতীয় পেগের সাথে সাথে গল্প গিয়ে পৌঁছেছিল কমনরুমের বজ্জাতি আর থার্ড ইয়ারের কমলিকার নামে প্রচলিত জোকে।

বুবুনের ধরা গলার 'মা' ডাকটা তৃতীয় বারে শুনতে পেলেন মায়েরা। ফ্যাকাশে ভীতু মুখটা দেখেই সবাই ধড়মড় করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন; "পুপুকে পাচ্ছি না" শোনামাত্র হুলুস্থূলু পড়ে গেল।

আধ ঘন্টার মধ্যে হোটেল তোলপাড় হয়ে গেল, কিন্তু পুপুকে পাওয়া গেল না।

-------------------

দরজা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ফিকে আলো আসছে ঘরটার পিছন দিক থেকে। প্রাথমিক উত্তেজনা কমলে, চারদিকে চোখ চালায় পুপু।

দুদিকে দেওয়াল জোড়া তাক। রাশি রাশি শিশি বোতল। থরে থরে তোয়ালে ভাঁজ করে রাখা। একটা কোণায় গাদাখানেক মপার। চেনে পুপু, ওটা ওদের বাড়ির বাথরুমেও আছে। চারটে বালতি। আরো কিছু কার্ডবোর্ডের বাক্স।

মোক্ষম লুকিয়েছে! বুবুন কিছুতেই ওকে খুঁজে পাবে না। এইত্তো কতক্ষণ হয়ে গেল, সাড়াশব্দই নেই।

অনেকক্ষণ হয়ে গেল না?

একা একা ভয় করছে যে পুপুর এবার! বেরিয়ে দেখবে? আচ্ছা পুরো না হোক একটু মুখ বার করে দেখে নিক?

দরজাটা কি ভারী! ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত টেনে খুলতেই পারছে না। প্রাণপণে টান দেয় পুপু। দরজা এক বিন্দুও নড়ে না।

আরো খানিকক্ষণ টানাটানি করার পর পুপু টের পায় দরজাটা ভিতর থেকে খুলবে না। ওটা লক হয়ে গেছে।

সারা গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা মাম্মা বই পড়ে শুনিয়েছিল। আজ টের পেল।

মাম্মা! মাম্মা! মাম্মা!

চীৎকার করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ। পুপু কখন যে উবু হয়ে বসে পড়েছে এক কোণায় নিজেও খেয়াল করেনি।

পাশের তাকের রাশি রাশি ফিনাইলের বোতলগুলো আবছা অন্ধকারে একদম সৈন্যের মত লাগে। যেন এক্ষুণি কেউ বলবে "আগে বাড়ো" আর তারা জয়দাদাদের বাড়ির অসভ্য কুকুরটার মত ঝাঁপিয়ে পড়বে পুপুর ওপর।

ঠেস দিয়ে রাখা মপারটা হ্যারি পটারের ঝাঁটার মত লাগছে। উড়ে আসে যদি!

ও মাম্মা! পুপুর গালে শুকনো জলের দাগ বেয়ে আবার জলের ফোঁটা গড়ায় এঁকাবেঁকা।

ঠকাস!

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার জবুথবু বসে পড়ে পুপু। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে আওয়াজটার সঙ্গে সঙ্গে। না, আওয়াজটা দরজায় হয়নি যেমন ও ভেবেছিল।

ঘরের ভিতর দিকে হয়েছে।

এখন, আরও খচমচ করে কিছু আওয়াজ হচ্ছে ঘরের মধ্যে। মাগো!

মুখে দুহাত চাপা দিয়েও অস্ফুট চীৎকারটা পুরো থামাতে পারল না পুপু। ওর গায়ে মাথায় পিঠে যেগুলো এসে পড়েছে, সেগুলো সেই ফিনাইলের বোতল।

হালকা একটা আওয়াজ। একটা মৃদু আলো। একটা ভয়াবহ দানবাকৃতি চেহারা, গা মাথা ঢাকা কালো আবরণ, ঝুঁকে ওর দিকে চেয়ে আছে...

নিথর দৃষ্টিতে...

----------

বুবুন খবর দেবার আধ ঘন্টা পর দরজাটা ভেঙেছিল হোটেলের লোকজন। ছোট অ্যান্টিরুমটার এক দিকের দেওয়ালের তাক লণ্ডভণ্ড, গড়াগড়ি খাওয়া ফিনাইলের বোতল আর মপারের মধ্যে ছোট্ট পুপু অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল।

না, কোন চোট আঘাত লাগেনি। মায়ের কোলে অল্প শুশ্রূষাতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল পুপুর। ইশ্, ওই নোংরা কাদা কাদা ছাপ, কাদামাটির ডেলা পড়ে থাকা মেঝের মধ্যে মেয়েটা এতক্ষণ শুয়ে ছিল! মিস্টার শিন্ডে কড়া ম্যানেজার, ডিউটিতে থাকা দেওকী আর সায়না খুব বকুনি খেয়েছিল কাজে ফাঁকি দিয়েছে বলে।

------------

ছোটবেলার এই ঘটনাটা পুপু, মানে মণিদীপার জীবনে ভয়ংকর প্রভাব রেখে গেছে। শুরুতে ছিল ভয়। বন্ধ জায়গার ভয়। একা ঘরে থাকার ভয়। লিফটে উঠতে আতঙ্ক।

তারপর ভয় পেতে পেতে কেমন বিরক্ত ধরে গেল। হয় না, সীমা পেরিয়ে গেলে?

একইসাথে অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়া আর সিনেমা দেখার নেশা চেপে বসল। তার সাথে অলৌকিকতার অবাস্তবতা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার সাহস। যুক্তি দিয়ে সব তুচ্ছ করে দেবার জেদ।

এসব নিয়ে মুখে মুখে তর্ক করে আধা জীবন কেটে গেছিল। এই মাঝবয়েসে ট্রান্সফার নিয়ে আত্মজনহীন শহর পুনে আসার পর, এরকম এক আড্ডায় বস মোহিত পাঞ্চাল খেপে উঠে বলে বসলেন, ভূতপ্রেত নেই তো তাঁর শখ করে কেনা চারতলার ফ্ল্যাট খালি ফেলে রেখে তিনি কি এমনি এমনি গ্রাউন্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাটে এত ভাড়া গুনছেন এখনো! কিছু যদি নেই তো রাত কাটাতে পারে না কেন কেউ, সব ভাড়াটেই রাত্রে উল্টাসিধা আওয়াজ শুনে ভয়ে পালায় কেন!

যুক্তি সাজাচ্ছিল মণিদীপা। বাইরের আওয়াজ কোনভাবে ঘরে আসে, কোন ফল্টি গ্যাজেট, হাওয়া চলাচলের কোন অদ্ভুত রাস্তা..

লোকটার এমনিই গোঁয়ার বদনাম আছে। তায় ভাড়া দেবার শোক উথলোচ্ছিল। দুম করে চ্যালেঞ্জ করল, মণিদীপা এক রাত ঐ ফ্ল্যাটে কাটিয়ে দেখাক।

ঝোঁকের মাথায় চ্যালেঞ্জটা নিয়েও নিয়েছিল মণিদীপা। রকেটকে সদ্য কিনেছে তখন। তাগড়া তেজী অ্যালশেসিয়ান। তাকে নিয়ে বেলাবেলি পৌঁছে গেল ফ্ল্যাটে।

ব্যাপারটাকে মণিদীপা এখনো স্রেফ লাক বলে। জানলা বন্ধ করার সময়েই একটা কাক পাল্লায় এসে বসতে যাচ্ছিল। ঝট করে হাতটা টেনে নিতে গিয়ে হাতের পাতলা রিস্টলেটটার খোঁচামুখটায় আটকে উঠে না এলে, ফ্রেম বরাবর সেঁটে আটকানো অত সরু তার চোখেও পড়ত না।

তার ধরে ধরে ছোট্ট লুকোনো স্পীকারটা, আর পাশের ফ্ল্যাটের জানলা গলে তার উৎসমুখ বার করাটা তারপর স্রেফ জলভাত হয়ে গেছিল। স্পীকারটা খুলে রেখে আরামসে এক ঘুমে রাত কাবার করে, সকালে মিস্টার পাঞ্চালকে ফোন করে ডেকে এনে, ব্যাপার দেখিয়ে বুঝিয়ে রকেটকে নিয়ে কেটে পড়েছিল মণিদীপা। ফ্ল্যাটটা বাধ্য হয়ে কম দামে বেচলেই কেনার জন্য মুখিয়ে ছিল পাশের ফ্ল্যাটের মালিক, কাজেই মোটিভ খুঁজতেও বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি।

এর ফলে, ওর বেশ একটা নামডাক হয়ে গেছিল অফিসে। সাহসী বলে। ভূত তাড়াতে পারে বলে। উদ্ভট সব আবদারও আসছিল ওর কাছে। কার মামার বাড়িতে রাতে ঢিল পড়ছে। কার গ্রামের বটগাছের নিচে রাত কাটালে নির্ঘাৎ মৃত্যু। কোথায় নাকি রাত বিরেতে আগুন জ্বলে উঠছে। ভয়ংকর হানাবাড়ি। গা হিম করে দেওয়া শ্মশান। ভুলভুুলাইয়ার মাঠ।

এমনই কপাল, রকেট আর মণিদীপার পাল্লায় পড়লেই সব গল্পের সত্যনাশ যাকে বলে। ঢিল না কচু, হাওয়ায় ছাতে গাছের ডাল লাগছে, মামাবাবুর নতুন বৌ রোজ তাতেই মুচ্ছো যাচ্ছে। ডাল কেটে দিতেই তিনি নিশ্চিন্তে রান্নাবাড়ি করে বাঁচলেন। বটগাছটা তো নেহাৎ সময় নষ্ট, না ওদের না, ওরা আর অফিসের দুই ষন্ডা জনতা মিলে সেরাত গাছতলায় কাটানোয় নেশাখোর গেঁজেলগুলোর সে রাতের আড্ডা মাটি আর কী! আগুনটা যাবার দরকারও হল না, অফিসে বসেই বলে প্রমান করে দিল আলেয়া। হানাবাড়িটায় যা সাপের আখড়া দেখল চারদিকে, সেখানে মারা যাওয়া লোক দুটোকে যে সাপে কেটে থাকতেই পারে সেটা গ্রামের কেউ অস্বীকার করতে পারল না। শ্মশানটা অবশ্য যাবার সুযোগ হয়নি, তবে হাতে কম্পাস থাকলে ভুলভুলাইয়া যে ট্যাঁ ফোঁ করতে পারে না সেটা বেশ করে প্রমাণ করে এসেছে।

কেমন একটা উদ্দীপনা এসে গেছিল। এদ্দিন ধরে বাড়ী অফিস নিজের বই পড়া গান শোনার বাইরে একার জীবনে খুব একটা কিছু ছিল না। ঐ রকেটের সাথে খেলা কি মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখতে যাওয়া। এই ঘটনাগুলো, দু বছর ধরে টুক টুক করে কেমন একটা আলাদা পরিচিতি, বাঁচার আলাদা নেশা এনে দিল। এখন মন খোঁজে কখন কোথায় আবার এমন ছুটে গিয়ে রহস্যভেদ করা যায়।

তবে ঝোঁকের মাথায় আজ রকেটকে বাদ দিয়ে আসাটা বেশ ভুল হয়েছে, মানতে বাধ্য মণিদীপা।

-----------------

এটার খবর জানলে অবশ্যই রকেটকে নিয়ে আসত। সে ভেবে তো আসেনি! এসেছিল তো টিমমেট মীনাল পাটীলের বিয়ে খেতে। মেয়েটা ওর থেকে অনেক ছোট হলেও, খুব ন্যাওটা মণিদীপার। এত করে বলেছিল, না করতে ইচ্ছে করেনি। দুই রাত্রের তো ব্যাপার , রত্নাগিরি থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে মীনালের গ্রাম । মণিদীপার প্রতিবেশী জোহান আঙ্কল কুকুর ভালবাসেন, এরকম এক দু রাত মণিদীপা অফিসের কাজে বাইরে গেলে উনি রকেটকে সুন্দর সামলে রাখেন।

কাল রাত্রে অফিস সেরে বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছে। প্রচণ্ড আপ্যায়ন করেছে মীনালের বাড়ির লোকে। পরদিন বিয়ে, তা সে তো মারাঠী বিয়ে, দিনের আলো থাকতে থাকতেই অনুষ্ঠান মিটে গেছে। রাত্রে স্বাভাবিকভাবেই আর কেউ যেতে দেয় নি, কাল সকালের বাস ধরে ফিরে যাবে। গোল বাঁধালো বরবাবাজীর চালিয়াতি স্বভাব।

মীনাল স্বভাবসিদ্ধ প্রগলভতায় সব্বার সামনেই মণিদীপার কীর্তির কথা শোনাচ্ছিল। মীনালের বাড়ির লোক হয়তো আগে শুনেছে, তারা চমকায়নি। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ব্যাপারটা তাজ্জব লাগছিল, ফলে এক সময় দেখা গেল উপস্থিত মহিলামহল মণিদীপার চারদিকে গল্প শোনা আর প্রশ্ন নিয়ে এতই মত্ত, যে বর যে একা বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছে সেটাও তাদের হুঁশ নেই। বরের যদি এরপর বর্বর রাগ উপস্থিত হয়েই থাকে, দোষ দেওয়া যায় কি! দুম করে সে বলে বসল এসব ঝুট, একজন বংগালী আওরতের এত সাহস হতেই পারে না।
সত্যি সাহস থাকলে করে দেখাক, নইলে সে বিশ্বাস করবেই না।

ছোকরার সাইজ মণীদীপার অর্ধেক, বলতে নেই সে চিরকালই একটু শক্তপোক্ত ভারী চেহারার। তার ডেঁপোমি দেখে মণিদীপার মাথা থেকে পা জ্বলে গেছিল। কিন্তু বিয়ের বর বলে কথা, তাই মিষ্টি করেই জানতে চাইল খালি, কী করতে হবে?

কেন, আজ রাতটা কাটিয়ে আসুক না তাদের গ্রামের ডিসুজা হাউসে। এই তো পাশেই! অত বড় একটা প্রপার্টি, সাহেবী আমলে বানানো, সে ছোটবেলায় শুনেছে বিশাল বড়লোকের বাড়ি ছিল, অনেক দোকান হোটেল রেস্টুরেন্টের মালিক, তা সে মারা যেতে কিসব মামলা মকদ্দমা হয়ে টয়ে আর কেউ আসেনি পড়ে আছে, আর কেউ রাত কাটাতেও পারেনি - যে-ই যেত সে-ই গায়েব হয়ে যেত! গত বিশ বছরে আর কারো হিম্মত হয় না পা রাখতে!

মীনাল শুরুতে ফোঁস করে উঠতে গেছিল। কিন্তু ডিসুজা হাউসের নাম শোনামাত্র সেও কেমন চুপসে গেল। আর তাতেই গোঁ চেপে গেল মণিদীপার।

মীনাল ওর এত কিছু জেনেও ভরসা পাচ্ছে না? তবে তো যেতেই হয়!

লোকে বাধা দিতে চেয়েছিল। মীনালের মা তো কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বর বেচারাও অপ্রস্তুতে পড়ে গেছিল। কিন্তু সবাইকে বলে বুঝিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে, লাঠি, টর্চ, কম্বল আর খাবার জল নিয়ে, মোবাইল ফুল চার্জ করে বরযাত্রী কয়েকজনের সঙ্গে সেই অভিশপ্ত ডিসুজা হাউসে এসে হাজির হল মণিদীপা।

বাড়িটা দেখে অট্টহাস্য করতে ইচ্ছে করছিল। এটা ভূতের বাড়ি? হ্যাঁ, পরিত্যক্ত, অযত্নের আগাছা লাঞ্ছিত, নোংরা, একটু ভাঙাচোরাও। কিন্তু তাও কি রাজকীয় বাড়ি। সারিয়ে নিলে অনায়াসে একটা রিসর্ট হতে পারে।

একটা ঘর দেখেশুনে বেছে নিয়ে মণিদীপা আস্তানা গেড়ে বসল। সঙ্গী ভদ্রলোকেরা একটু তা না না না করেই বিদায় নিলেন, পোঁ পাঁ পালালেন বলাই উচিত!

তার মিনিট দশেক পর রকেটের জন্য মন কেমন করতে লাগল। বড্ড একা একা লাগছে জায়গাটায়। এসব পুরোনো বাড়িতে যেমন হয়, এলোমেলো হাওয়া বইছে ফাটল ফোকর দিয়ে। অনভিজ্ঞ লোক সেইসব আওয়াজেই নিতান্ত কাতর হয়ে পড়তে পারে।

সেই সঙ্গে রাতজাগা কোন একটা পাখির আচমকা আচমকা ক্যাঁ ক্যাঁ। প্যাঁচাই হবে।

টপ টপ টপ...

এটা আবার কি শুরু হল? জল পড়ছে কোথাও থেকে। কোন কল টল হবে। রাত্রে হয়ত জলের প্রেশার বেড়ে এতক্ষণে জল এল।

কম্বলটা পেতে শুয়ে পড়ে মণিদীপা। টর্চ আর লাঠি হাতের একদম নাগালে নিয়ে। সাপের সময় নয় এখন, কাজেই সে চিন্তা নেই। ঘরটা মোটের ওপর পরিষ্কারই ছিল, বিছে টিছেও থাকবে না। দরজাটা আধভেজা করে রেখেছে সেটা একটা চিন্তা, কিন্তু পুরো বন্ধ করে দিলে একা বন্ধ ঘরে...

ধ্যাত্তেরি! বহুকাল বাদে আবার এই চিন্তাটা এল। আসে আসলে মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে, রাত্রে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে পড়ে এখনো। রকেটের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হয়।

ঘুমে ডুবে যায় মণিদীপা। বেশ ধকল গেছে সারাদিন।

টপ টপ টপ...

আরে দূর বাবা! কলটা কেউ বন্ধ কর না!

কে আর করবে। নিজেকেই উঠতে হয়। উঠতেই টের পায় ভীষণ শীত করছে। এত ঠাণ্ডা পড়ে এখানে রাতের দিকে কে জানত! কম্বলটাই তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় অগত্যা, সঙ্গে আর কিছু নেই। এবার কি যেন? ও হ্যাঁ সেই জল পড়া। কিন্তু সে আওয়াজ তো আবার বন্ধ হয়ে গেছে! অদ্ভুত অন্ধকার হয়ে গেছে, কিচ্ছু আন্দাজ পাচ্ছে না। পা বাড়াতেই পায়ের এক ধাক্কায় টর্চটা গড়গড় করে বেড়াতে চলে গেল। ধুত্তোর!

দরজাটা এদিকেই ছিল, ওটা বোধহয় হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে, খুলে দিলে একটুও আলো আসবে না কি?

আন্দাজে আন্দাজে ঠিক তিনটে কদম এগিয়েছিল, তারপরই পায়ের নিচের মাটি একদম আচমকা নেই হয়ে যায়।

------------

হুড়মুড় করে যেখানটায় এসে পড়ল, সেটা ভাগ্যিস বাঁধানো চাতাল নয়। হাড়গোড় ভেঙে একশা হত তাহলে! ভেজা ভেজা নরম মাটি। বদ গন্ধ। লেগেছে, কিন্তু মারাত্মক নয়।

মাথার ওপর একটা অদ্ভুত ফ্যাঁশশশ আওয়াজ হয়ে অন্ধকার হয়ে গেল।

না, পুরো অন্ধকার না। হাল্কা আলো আছে। একটা জল ফুরোনো কুয়োর তলায় দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে। চারদিকে পাথরের দেওয়াল। শ্যাওলা পড়া।

দেওয়ালের গায়ে ব্যস্তভাবে হাতড়াতে থাকে ও। বড্ড বদ্ধ জায়গা। শ্বাসকষ্ট শুরু হবে জলদি বেরোতে না পারলে। বুকের ধুকপুক নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে, মানে প্যানিক অ্যাটাকটা আসতে আর দেরি নেই।

উফ কী ঠাণ্ডা এখানে, কম্বলটা কষে মাথা মুড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে নেয় মণিদীপা - কেন যে পাকামি মেরে এক্ষুণি আসতে গেল! পরে রকেটকে নিয়ে এলে হত। ভাবতে ভাবতেই একজায়গায় পাথরের বদলে হাতে কাঠ ঠেকে। আলগা, ঠেলতেই ভেতর দিক ফাঁক হয়।

ওর গলে বেরোনোর পক্ষে যথেষ্ট বড় ফাঁক। জয়ত্তারা!

ভেবেছিল গলে, পা ঝুলিয়ে বসে দেখে নেবে বাইরে কী আছে। কিন্তু কিছুটা এই বদ্ধ জায়গার আতঙ্কে তাড়া করতে গিয়ে, কিছুটা ফাঁকের ধারটা পিছল থাকার ফলে ব্যালেন্স রাখতে না পেরে হুড়মুড় করে বস্তার মত পড়ল আবার। পড়তেই একটা ধাতব লাঠি সোজা এসে ওর মাথার মধ্যিখানে আঘাত করল।

---------------

রীতিমত ব্যথা লেগেছিল। আততায়ী কে বোঝার কোন সুযোগ নেই, কিন্তু ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল ধারে কাছে আরও কেউ আছে।

নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে, কান খাড়া করে আরেকটা শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু শব্দ শুনতে শুনতেই পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে ফেলল মণিদীপা। যে-ই হোক, সে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে। নইলে এমন নিখুঁত ভাবে মাথার ঠিক পিছনে মারতে পারত না। যেকোন মুহূর্তে হয়তো দেখবে একজোড়া আগুনের মতো চোখ জ্বলে উঠছে কোন অশুভ অশরীরীর।

অশরীরী না কচু! বদমাইশ কেউ হবে।

কিন্তু, একই সঙ্গে, সে ওকে ভয়ও পাচ্ছে। সেইজন্যই আচমকা আক্রমণ করে আহত করে ফেলেও, সামনে আসছে না। নিশ্চয় দূর থেকে নজর করছে। খুব আস্তে আস্তে, একটুও আওয়াজ না করে উঠে দাঁড়ায় মণিদীপা। রকেট নেই, কিন্তু ক্যারাটেটা এমনি এমনি শিখে রাখেনি তো! অন্ধকারেই, আন্দাজে কয়েক পা এগোয় আরো।

ধাক্কা খাবার কপাল আজ। এরকম আচমকা শূন্যে ঝুলন্ত কিছু আশা করেনি ও। গাছ টাছ এত অন্ধকারেও ঠাওর করা যায়। কিন্তু এটা একটা জমাট বাঁধা অন্ধকারের মত কী জানি, কাঁধে ধাক্কাটা লাগতেই দুম দাম করে কিসব ভেঙেচুরে পড়ল। আর লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ নেই, ওর অবস্থান আততায়ীর কাছে খুব পরিষ্কার এখন। চট করে মোবাইল বার করে আলোটা ফেলে সামনে।

যা দেখে, তাতে বহুকাল আগের এক সন্ধ্যার হিমেল আতঙ্ক মণিদীপার সারা শরীর বেয়ে শুঁয়োপোকার মত চলাচল করতে থাকে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে, বুকের মধ্যে বোমার মত ফেটে পড়তে থাকে অবর্ণনীয় আর্তনাদ।

কুয়ো থেকে বাইরে বেরোনো না - সে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট অ্যান্টিরুমের মধ্যে, ঘরটার দেওয়াল জোড়া তাক, তার ধাক্কার চোটে এপাশের তাক থেকে পড়ে যাওয়া মেঝেতে থরে থরে সাবান ফিনাইল, একটা শুয়ে থাকা মপার।

না!
হতে পারে না!
চীৎকারটা কানের মধ্যে বাজে খালি, কান ঝাঁ ঝাঁ করে, গলা দিয়ে এত্তটুকুও আওয়াজ হয় না। মন উন্মাদের মত বোঝাতে থাকে এটা স্বপ্ন, এটা হচ্ছে না...সত্যি হচ্ছে না...

কোণা থেকে একটা চাপা আওয়াজ ভেসে এল না? শকের চোটে আর কারো উপস্থিতির কথা ভুলেই গেছিল মণিদীপা। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে আলো ফেলে সেইদিকে।

মুখে দুহাত চাপা, দৃশ্যত থরথর করে কাঁপতে থাকা বছর সাতেকের মেয়েটার পরণে সাদা লেসের আকাশনীল ফ্রক, দুদিকে দুটো বিনুনি। যে চোখ দুটো একরাশ আতঙ্ক নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে, বিস্ফারিত হলেও তাদের খুব ভাল করে চেনে মণিদীপা।

আজন্ম আয়নায় এ দুটো চোখই দেখে এসেছে সে।

5 comments:

  1. Raat 3:30 e goppo ta porchi.. olpo ektu bhoi bhoi korche kintu !!

    ReplyDelete
  2. ক্লাইম্যাক্সটা সাংঘাতিক। দুর্দান্ত গ্রিপিং গল্প। এক মুহূর্তের জন্যও মনোযোগ অন্যদিকে যায় না। কাজ ফাঁকি দিয়ে ভূতের গল্প পড়া সার্থক।

    ReplyDelete
  3. ভূতের "গল্প" লিখতে হলে এমনই ঠিক! এটি একটি ঠিক ভূতের গল্প, ভয়=ভূত চিরকাল জেনেছি। ভয় পাবে তো ভূতেও পাব্বেই!

    ReplyDelete
  4. দারুণ লাগল, টান টান গল্প

    ReplyDelete
  5. দুর্ধর্ষ! দারুণ উপভোগ করলাম গল্পটা। পরের গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete