প্রবন্ধ - অনির্বাণ ঘোষ
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
যেখানে মৃতেরা ভীড় করে আছে
অনির্বাণ ঘোষ
কঙ্কাল দেখলেই বেশ একটা ভয় ভয় লাগে না? স্কুলের বায়োলজি ল্যাবে ঝোলানো কঙ্কালটা দেখেই কতবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ভুতের গল্পের বই মানেই তার মলাটে একটা হাড়গিলে কঙ্কাল বা খুলির ছবি থাকবেই। কিন্তু এক ঘর ভর্তি চল্লিশ হাজার মানুষের কঙ্কাল! তাও যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, সে আবার হয় নাকি! হয় তো বটেই, না হলে বলছি কেন? তবে এই রহস্যের কিনারা করতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় সাড়ে আটশ বছর।
সালটা ১২৭৮, এখন যে দেশের নাম চেক রিপাবলিক, তখন সেই দেশকে বলা হতো বোহেমিয়া। সেই দেশের রাজা ওটাকারের খ্রীষ্ট ধর্মে খুব বিশ্বাস। সেই রাজার একদিন শখ হলো যীশুর জন্মস্থানের ছোঁয়া পাওয়ার। কিন্তু সে তো সেই জেরুজালেমে, অনেএএক দূরের পথ। রাজা থোড়াই যাবেন এতটা রাস্তা মাড়িয়ে। তাই সেলডেক নামের একটা গ্রামের পাদরীকে পাঠানো হলো জেরুজালেমে। নাম তার হেনরি।
তা এই জেরুজালেমের ঠিক বাইরেটাতেই একটা ঢিপি মতো আছে, দেখতে অনেকটা মাথার খুলির ওপরের অংশের মতো। এর নাম গলগথা। এই গলগথার নাম শুনলেই কিন্তু যে কোন খ্রিশ্চানের মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে। কেন? এখানেই যে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়! পাদরী হেনরি জেরুজালেম ঘুরে ফেরার পথে গলগথাও ঘুরে গেলেন, আর নিজের সাথে একটা ছোট থলিতে করে নিয়ে এলেন গলগথার একটু মাটি।
কিছুটা মাটি বোহেমিয়ার রাজাকে দিলেন, তিনি তো খুব খুশি, ঘরে বসে বসেই পরমপিতার সন্তানের ছোঁয়া পেয়ে গেলেন যে! বাকিটা হেনরি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন সেলডেক গ্রামের নিজের ছোট্ট গীর্জাতে। তা কি করা যায় এই পবিত্র জিনিসটা নিয়ে? চার্চের গায়েই ছিল একটা কবরখানা। হেনরি মশাই সেই ঝুরো ঝুরো মাটি ছড়িয়ে দিলেন কবরখানার চারিদিকে। যারা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তারা ঈশ্বরের আরেকটু কাছে এল।
খবরটা কিন্তু দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে!
বেঁচে থাকার সময় যতই পাপ করুক না কেন, মৃত্যুর পরে প্রভু যীশুর কাছে থাকা যাবে, এই ভেবে গোটা মধ্য ইউরোপ ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই এক রত্তি কবরখানাটার ওপরে, সবাই চায় যে তাকে যেন সমাধি দেওয়া হয় ওখানেই। তারপরে আরও দুশো বছরে হাজারে হাজারে মানুষ মারা গেল হুসাইটের যুদ্ধে আর প্লেগে, তাদেরও ঠাঁই হল সেলডেকের কবরখানাতে।
একটু একটু করে জায়গা বাড়ালেও একসময় এমন অবস্থা হলো যে আর কাউকে ওখানে সমাধি দেওয়াই সম্ভব নয়! সেটা ১৫১১ সাল, সমাজের ওপরতলা থেকে তখনও চাপ এসে যাচ্ছে, সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিই চাইছেন তাদের শেষ ঘুমের জায়গাটি ওখানেই হোক। তা কি করা যায় এই অবস্থাতে? মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলা হলো সব দেহাবশেষ, যাতে কেউ রাগ না করে তাই তাদের জায়গা হলো সেলডেক চার্চেরই গর্ভগৃহে। কিন্তু প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের কঙ্কাল জমা রাখার দায়িত্ব যাকে দেওয়া হলো সে কিনা আবার এক কানা পাদরী। তাই অনাদরে মাটির নিচের ঘরটাতে ডাঁই করে রাখা হল হাড়গোড় গুলোকে, সেই ঘর কেউ আর খোলে না। ফিরেও তাকায় না ওই দিকে কেউ।
এর পর কেটে গেছে আরো ৩০০ বছর, সেলডেকের মাথায় এখন সোয়ার্জেনবার্গ বংশ। এরাই এখন রাজ্য শাসন করছে। প্রবল প্রতাপ তাদের। রুপোর খনির খোঁজ পাওয়া গেছে সেখানে, সোয়ার্জেনবার্গদেরও প্রতিপত্তি তাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাদেরই এক উত্তরাধিকারের মাথায় একদিন অদ্ভুত একটা চিন্তা এল। আচ্ছা ওই চার্চের নিচে নাকি এক গাদা কঙ্কাল জমে আছে, ওগুলো দিয়ে কিছু একটা বানালে হয় না?! যেমনি ভাবা অমনি কাজ, ওই সব হাড় দিয়েই বানিয়ে ফেলতে হবে একটা আস্ত গীর্জা! কিন্তু এই দুঃসাহসিক কাজটা করবে কে! রাজ্যের সব কারিগর তখন ভয়ে মুখ লোকাচ্ছে।
শেষে এগিয়ে এলেন ফ্রতিসেক রিন্ত নামের একজন অনামী ছুতোর, দু’কুলে কেউ নেই তার। টুকটাক কাঠের কাজ করেই দিন গুজরান হয়। সেই মানুষটা হয়ত বুঝেছলেন ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকার এই সুযোগ। তাই তার হাত একটুও কাঁপেনি। ধীরে ওই হাজার হাজার অস্থির স্তূপ থেকে তৈরী হলো সেলডেকের মাটির নিচের চার্চ।
এই গীর্জার প্রায় সব রকম অলংকরণ হাড় দিয়ে তৈরি। ঘরটার মাঝেই সিলিং থেকে ঝুলছে একটা বিশাল ঝাড়বাতি, যাতে মানব শরীরের প্রত্যেকটি হাড় অন্তত একবার করে ব্যবহার করা হয়েছে। দেওয়ালে গায়ের নকশা তৈরি হয়েছে শিঁড়দাঁড়ার হাড় দিয়ে, মাটির ওপরে এক মানুষ সমান উঁচু পিলসুজ তৈরি হয়েছে মাথার খুলি আর হাতের হিউমেরাস দিয়ে। সোয়ার্জেনবার্গ বংশের কোর্ট অফ আর্ম বা লোগোটাও বানানো হাড় দিয়ে, এমনকি চার্চের দেওয়ালে রিন্ত বাবু নিজের নামটাও বানিয়েছিলেন মানুষের হাড় জুড়ে জুড়ে!
এই গীর্জা কিন্তু আজও ঘুরে দেখা যায়। চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ থেকে বাসে বা ট্রেনে মাত্র দেড়ঘন্টার রাস্তা, চার্চের ঘরটাতে পা রাখলে মনে হয় টু’শব্দও বুঝি ভয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেল। একটা অদ্ভুত গন্ধ ঘরটাতে। আর হাজার হাজার খুলির চোখ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। ঘরের ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ের রক্তও যেন জল হয়ে আসে!
চারিদিক এমনিতেই খুব ফাঁকাফাঁকা। সূর্য ডুবে গেলে শুধু বিশাল বড় কবরখানাটাকে জড়িয়ে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে সেলডেকের চার্চ। রাত কাটানো জন্য জায়গাটা মন্দ নয়, কি বলো?
0 comments: