প্রবন্ধ - সোমেন দে
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বাঙালি পদবীর সৃষ্টিমূল সন্ধান
সোমেন দে
জনৈক সত্যভুষণ সেন একসময় রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি দিয়ে বিয়ের পরে বাঙালি মেয়েদের পদবী পরিবর্তন সম্মন্ধে তাঁর মত জানতে চেয়েছিলেন।
এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধে বাঙালিদের নামের সঙ্গে পদবী ব্যবহার করার যৌক্তিকতা সম্মন্ধেই কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর মতে বাঙালির কাছে সামাজিক ভাবে তার জাতের পরিচয় একসময় খুব গুরুত্বপুর্ণ ছিল। মানুষের পরিচয় তার জাতের মধ্যে দিয়ে পাওয়া ব্যাপারটা সমাজে প্রচলিত ছিল। তাই মানুষের পদবীর একটা গুরুত্ব ছিল। কিন্তু ক্রমশ যখন বৈঠক মজলিশে, সভা-সমিতিতে, ইস্কুলে কলেজে, অপিসে আদালতে আগেকার মতো পংক্তি বিভাগের দাগটি লুপ্ত হয়ে গেছে তখন পদবী ব্যাপারটাও এখন বাহুল্য হয়ে গেছে। তাঁর মতে ভারতবর্ষে বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সকল প্রদেশেই পদবীহীন নাম বিনা উপদ্রবেই চলে আসছে। তাই –
‘আমার প্রস্তাব হচ্ছে, ব্যক্তিগত নামটাকে বজায় রেখে আর-সমস্ত বাদ দেওয়া’ -
- ‘ব্যাঙাচি পরিণত বয়সে যেমন ল্যাজ খসিয়ে দেয় বাঙালির নামও যদি তেমনি পদবী বর্জন করে আমার মতে তাতে নামের গাম্ভীর্য বাড়ে বৈ কমে না।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন বটে তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনও উদ্যোগ তিনি নেননি। তাঁর নামের সঙ্গে যে পদবীটি বাঙালির তথা বিশ্বের কাছে পরিচিত সেই পদবীটিও তাঁর পূর্ব পুরুষ নীলমণি কুশারিকে দিয়েছিলেন কলকাতা বন্দরের শ্রমিকরা। তিনি যখন ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতা বন্দরে যাতায়াত করতেন তখন সেখানকার শ্রমিকরা, যারা প্রধাণত অন্তজ শ্রেণীর মানুষ ছিলেন, তাঁরা ব্রাহ্মণ নীলমণি কুশারীকে ‘ঠাকুর’ বলেই ডাকতেন। সাহেবরা ঠাকুরকে তাদের সুবিধে মতো টেগোর করে নেয়। তবু এই পদবী বহন করতে তিনি বিশেষ আপত্তি করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
এক সময় শনিবারের চিঠির সম্পাদকমশাই পদবী বর্জনের পক্ষে মতামত গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। সে চেষ্টায় বিশেষ কেউ সাড়া দেননি। তাই বাঙালি নামের সঙ্গে পদবী আপাতত লেজুড় হয়েই থাকবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
বরং বুঝে নেওয়া যাক কি ভাবে আমাদের পদবিগুলি জুড়ে গেল আমাদের নামের সঙ্গে।
হিন্দু বাঙালিদের ঠিক কত রকমের পদবী আছে সেটার সঠিক পরিসংখ্যান করা খুব কঠিন কাজ। সে বড় বিচিত্র এক জগৎ।
ঠিক কবে থেকে বাঙালিরা প্রত্যেক ব্যাক্তির নামের সঙ্গে নিয়ম করে একটা করে পদবী জুড়ে দেওয়া শুরু করেছিল তার সঠিক কোনও ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। তবে এটা ঠিক একদা বাঙালির নামের সঙ্গে কোনও পদবীর ব্যাবহার ছিল না। অনেকটা জাত পাত নির্ভর বিভাজনেরই আর একটা নতুন উপায় হিসেবেই সম্ভবত পদবীর উদ্ভাবন হয়েছিল।
পদবীর উৎস খুঁজতে গিয়ে যদি আমরা চলে যাই বেদ পুরাণ, জাতক, কথাসরিৎ এর সময়ে চলে যাই তাহলে দেখব, সে সময় পদবী বলে কিছু ছিল না। সেখানে নামের মধ্যেই কখনও পিতার কখনও মাতার পরিচয় আছে। যেমন পিতা অরুণের পুত্রের নাম আরুণী আবার মাতা জাবালার পুত্রের নাম সত্যকাম জবলী। মহাভারতের যুধিষ্টির, অর্জুন, দুর্যোধন, দুঃশাসন এদের পদবী ছিল না। মহাভারতের একই দ্রৌপদীর ‘দ্রৌপদী’ নামটি পিতার নাম থেকে এসেছে, পাঞ্চালী এসেছে জন্মস্থানের নামের ইঙ্গিত বহন করে, আবার জন্ম ইতিহাসের পরিচয়ে হয়েছিল যাজ্ঞসেনী। কিন্তু বিয়ের পর তাঁর নাম পরিবারের পদবী বহন করে দ্রৌপদী পাণ্ডব হয়নি।
পরবর্তী কালে আমরা যে সব নাম পাই তার মধ্যে বিষ্ণুশর্মা, কৃষ্ণস্বামী, চন্দ্রবর্মা এই জাতীয় নাম ছিল। এর মধ্যে থেকে নামের শেষ ভাগ, মানে শর্মা, স্বামী বা বর্মা হয়ত এক সময়ে পদবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এতে যদি আমরা মনে করি আমাদের মিত্র পদবী বিশ্বামিত্র ঋষির নামের থেকে এসেছে, তাহলে এটাও মেনে নিতে হয় টড সাহেবের বইতে গুহায় বাস করা এক শ্রেণীর মানুষদের গোহো বলে ডাকা হতো, আমাদের গুহ পদবীও সেখান থেকে এসেছে। আসলে আমাদের পদবীর ইতিহাস মোটেই ততটা প্রাচীন নয়। সেটা খুব বেশি হলে দুশো আড়াইশো বছর হতে পারে। এবং তার উৎপত্তির মধ্যে জাতপাত, জীবিকা এবং সমাজপতিদের দাদাগিরির অনেকটা ভূমিকা আছে।
প্রথমে জাতপাতের ব্যপারটায় যাওয়া যাক। আমরা যতই ইংরেজদের দায়ী করি এদেশে Divide and rule কায়দায় শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্যে আসলে আমাদের দেশে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী মানব জাতির আদি পুরুষের নাম মনু। এ রকম একটি বিশ্বাস চালু আছে তিনি ব্রহ্মার শরীর থেকে উদ্ভূত হয়ে ছিলেন। তিনিই মনুসংহিতা রচনা করেন। কিন্তু মনু আসলে একজন নয়। আমাদের বেদ গীতা মহাভারতের মতোই মনুসংহিতা রচিত হয়েছে একটা বিশাল সময় জুড়ে অনেকের যোগদানে। শেষ মনু সম্ভবত তৃতীয় শতাব্দীতে। এই মনুসংহিতাই মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে বর্ণাশ্রমের প্রচলন করার পথটি প্রথম দেখান। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে ঈশ্বরের বিধান অনুযায়ী মানুষের চারটি বর্ণ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য, শুদ্র। ব্রাহ্মণ অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যাগ, যজ্ঞ ইত্যাদি কর্মে নিযুক্ত থাকবে। ক্ষত্রিয়রা প্রজাদের রক্ষা করবে। বৈশ্যরা পশুপালন, কৃষিকাজ এবং ব্যবসা বাণিজ্য করবে। আর শুদ্রদের কাজ হলো আগের তিন শ্রেণির মানুষদের সেবা করা।
এই ব্যাবস্থাকে আমরা যদি Division of labour এর পটভুমিতে দেখি তাহলে, শাসন ব্যাবস্থা পরিচালনার স্বার্থে খানিকটা যুক্তি খুঁজে পাই। কিন্তু গণ্ডগোলটা হলো এর মধ্যে ঈশ্বরের বিধানকে নিয়ে আসা। যার ফলে এই ব্যবস্থায় শুদ্ররা কোনওদিন অধ্যাপনার সুযোগ পাবেনা, কারণ তাতে ঈশ্বরের সমর্থন নেই।।
মেগাস্থিনিসের লেখায় যে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায় সেখানে বলা আছে চতুবর্ণের পরিবর্তে বৃত্তি অনুযায়ী সমাজে মানুষের শ্রেণী বিভাগ হতো। তখন সাতটি শ্রেণী ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষক, কৃষক, পশুপালক, কারুশিল্পী, বণিক, সৈনিক, রাজকর্মচারী।
কালের অগ্রগতির সঙ্গে এই বিভাজন দূর হওয়া তো দূরের কথা চার বর্ণ থেকে এটা বেড়ে দাঁড়ালো তিন হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণদের শ্রেণীই তিনশোর বেশি।
আমাদের পদবীগুলির কোনও নির্দিষ্ট উৎস নেই বা তা সবসময় কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেও সৃষ্টি হয়নি। কখনও তা গাঞী, মানে গ্রাম থেকে বা অঞ্চল থেকে এসেছে, কখনও এসেছে রাজপুরুষের দেওয়া উপাধি থেকে, কখনও বৃত্তির ধরন থেকে, কখনও ব্যাবসার বিশেষ সামগ্রী থেকে, কখনও শিক্ষার মাপকাঠি থেকে, আবার কখনও কোনও ঘটনার সূত্র থেকে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের একটি গ্রন্থে লিখেছেন ‘আমাদের কুলজী গ্রন্থে আছে যে মহারাজ আদিশূরই প্রথম বাংলাদেশে কয়জন ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের নিয়ে আসেন তাঁদের বংশধরেরাই পরে কুলিন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের মর্যাদা পান। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অক্ষয় কুমার মৈত্র এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেননি।
কিন্তু যত দিন গেছে এই বর্ণ বিভাজন ক্রমশ আরও বেড়ে গেছে। নানা রকমের উপবর্ণ সৃষ্টি হয়েছে। চোদ্দ শতকে স্মৃতি শাস্ত্রকার উদ্যোগে যে সব কুলজী গ্রন্থ রচিত হয় তাতে তৎকালীন কৌলিন্য প্রথা এবং জাতপাতের বিভাজনের কিছু ধারণা পাওয়া। তবে এই সব কুলজী রচনার মধ্যেই অনেকটাই জনশ্রুতি, কল্পনা, অর্ধ এবং আংশিক সত্যের উপর নির্ভর করে রচিত হয়েছিল। কারণ মুসলমান-পূর্ব যুগের বাংলার সামাজিক কাঠামো এবং বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট কোনও প্রামাণ্য গ্রন্থ ছিলনা। তাই কুলজী গ্রন্থের রচয়িতাদের মধ্যে অনেক অস্পষ্ট ধারণা ছিল যা তাদের প্রভাবিত করেছিল। এর ফলে বর্ণহিন্দু মানে ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথার নাম করে ছোটো ছোটো গোষ্ঠী এবং বড় জাত ছোটো জাতের ধারণা তৈরি হতে শুরু হলো।
তবে বাংলায় ক্ষত্রীয় বা বৈশ্য বর্ণের প্রভাব তেমন ভাবে পড়েনি। এখানে বিভাজন ছিল মূলত ব্রাহ্মণ, শুদ্র এবং অন্তজদের মধ্যে।
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত না হলেও প্রচলিত ধারণা এই যে বাংলার কৌলীন্য প্রথার সঙ্গে সেনরাজারা এবং রাড়ীয় ব্রাহ্মণদের কুলজীর সঙ্গে আদিসূর যুক্ত ছিলেন।
আসলে একসময় বাংলায় দুই বর্ণের বিবাহ প্রচলিত ছিল। একাদশ দ্বাদশ শতকে এই বাংলায় পাল বংশের শাসনকে অপসারণ করে কর্নাটকের সেনরা এবং চন্দ্র বংশের শাসন সরিয়ে কলিঙ্গের বর্মনরা শাসন ভার নেন। এর ফলে বাংলার সামাজিক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিরাট পরিবর্তন হয়ে যায়। পাল এবং চন্দ্ররা বৌদ্ধঘেঁষা ছিলেন বলে তাঁরা হিন্দু ধর্মীয় আচার আচরণের ব্যাপারে অনেকটা উদার ছিলেন। তাঁদের আমলে শাক্ত এবং শৈব্য তন্ত্রের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান মিলে মিশে এক উদার ছন্দের সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। কিন্ত সেন এবং বর্মণ রাজারা ছিলেন উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী। তাঁরা এসে শুরু করলেন যাগ যজ্ঞ পূজাপাঠের অনুশাসন। বর্ণাশ্রম প্রথা কঠোর ভাবে পালন করা হতে থাকল।
বল্লাল সেন সম্মন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি এক স্ত্রী বর্তমান থাকা সত্বেও তিনি বেশি বয়সে এক সুন্দরী ডোম রমনীকে বিয়ে করেন। তাঁর প্রজারা এই বিয়ে সহজে মেনে নেয়নি। বল্লাল সেন প্রজাদের অসন্তুষ্টিকে ঠাণ্ডা করার জন্যে এক বিশাল ভোজের আয়োজন করে সব সম্প্রদায়ের প্রজাদের নিমন্ত্রণ করেন। নমঃশুদ্র এবং আরও কিছু সম্প্রদায় এই ভোজ বয়কট করলেও অনেক সম্প্রদায় ভোজে যোগদান করে রাজার সুনজরে থাকার চেষ্টা করে।যারা ভোজসভায় এসেছিল রাজা সেই সব সম্প্রদায়কে ইচ্ছে মতো কৌলীন্য এবং পদবী দান করেন। সম্ভবত এই সময়ে ছত্রিশটি জাতি বা উপজাতির সৃষ্টি হয়। অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য এই গল্পকে স্বীকৃতি দেন না।
স্বয়ং নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন – ‘অথচ এই রাজার (বল্লাল সেন) আমলে যে সব স্মৃতি ও ব্যবহারগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, ইহাদের নিজেদের যে সব লিপি আছে তাহার একটিতেও এই প্রথা সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিত মাত্র নাই, উল্লেখ তো দূরের কথা। বল্লাল ও লক্ষ্ণণের নাম কৌলীন্য প্রথা উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত থাকিলেও তাঁহারা নিজেরা কেহ উল্লেখ করিলেন না ইহা খুবই আশ্চর্য বলিতে হইবে। ’
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শক হুণ মোগল পাঠান দ্রাবিড়, নেপালি, দক্ষিণ ভারতীয়, উত্তর ভারতীয় সব রকম রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে বাঙালির রক্তের সঙ্গে। ঠিক কখন কি ভাবে এই রক্তের সংমিশ্রণ হয়ে কোনও জাতি বা উপজাতির সৃষ্টি হয়ে তা আজ আর নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। আর এই রক্তের সংমিশ্রণের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের পদবির ইতিহাস।
বাঙালি ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচুর শাখা উপশাখা আছে। পদবীও আছে প্রচুর। কনৌজী ব্রাহ্মণদের পদবী পাঁড়ে, দুবে, তেওয়ারী, চৌবে, সুকুল, দীক্ষিত, পাঠক, ওঝা, বাজপেয়ী ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু পদবী বাঙালিদের মধ্যেও দেখা যায়।
গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে আছে সপ্তশতা, বারেন্দ্র, রাড়ী, বৈদিক, মধ্যশ্রেণী, শাকদ্বীপী ইত্যাদি।
ব্রাহ্মণদের আদি পদবিগুলি সম্ভবত আসে তাদের বাসস্থান, অঞ্চল বা গ্রাম থেকে। এগুলিকে গাঞী পদবি বলা হয়ে থাকে। যেমন বন্দো, ভট্ট, চট্ট ইত্যাদি।
জানা যায় গাঞী নামের বাইশটি এসেছে বর্ধমান জেলা থেকে, চারটি বাঁকুড়া থেকে, বীরভুম থেকে নটি, মুর্শিদাবাদ থেকে নটি, মানভুম থেকে একটি, হুগলি থেকে পাঁচটি এবং সাতটির উৎস জানা যায় না।
দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে বেশি গাঞী পদবী এসেছে বর্ধমান জেলা থেকে। তাই মনে করা যেতে পারে রাড়ী ব্রাহ্মণরা বর্ধমান জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
অনেকে মনে করেন গোত্রের সঙ্গে পদবীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু কিছু পণ্ডিতরা মনে করেন গোত্র শব্দটি এসেছে গোষ্ঠ বা গো সম্পদের সাথে যুক্ত। আর্যরা যেহেতু প্রাথমিকভাবে পশু পালক ছিল এবং তাদের সম্পদ বলতে ছিল গো সম্পদ তাই তাদের গো সম্পদকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার জন্যে গরুর গায়ে গরম কিছু দিয়ে তাদের গোষ্ঠির নাম দেগে দেওয়া হতো। সেখান থেকেই গোত্র ব্যাপারটি উৎপত্তি হয়। তাই পদবীর সঙ্গে গোত্রের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।
বৃত্তি থেকে পদবী গৃহীত হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। রাজশেখর বসুর মতে চৌধুরী পদবী চতুর্ধুরিণ শব্দের অপভ্রংশ। যার মানে চতুঃসীমানার অন্তরগত শাসক। সে কারণেই সম্ভবত বেশিরভাগ জমিদারদের পদবী হত চৌধুরী। আবার অন্য মতে চৌধুরী এসেছে চৈথহারী শন্দ থেকে এসেছে যার মানে যারা চৌথ (কর) আদায় করে। হাজারী পদবী মোগল আমলে প্রচলিত হয়। মনসবদারী থেকে অপভ্রংশ হয়ে হাজারি পদবী এসেছে। বিশ হাজারি, দশ হাজারি মনসবদার থেকে হাজারিটুকু রয়ে গেছে। তেমনি চাকরী সূত্রে মজুমদার, তালুকদার, চাকলাদার তরফদার, খাসনবীস, মহলানবীশ, পত্রনবীশ, বক্সি, মুস্তাফী, মুন্সী ইত্যাদি।
মজুমদার হয়েছে যারা মজমা বা মৌজার হিসেব রাখত, তালুকদার তালুক-এর অধীকর্তা, সোহনবীশ দৈনিক হিসেব রাখত, শিকদার ছিল শান্তিরক্ষক। ফৌজের কাজে যারা হিসেব রাখত ফার্সীতে তাদের বলা হত বখসী। সেখান থেকেই হয়েছে বক্সী।
এরকম ভাবে, হাড়ি, ঢেঁকি, ঢাকি, ঢুলি, কড়াই, ঘড়া, খাঁড়া, হাতা, উকিল, গায়েন, তন্তুবায়, কর্মকার, মোদক, যোগী, স্বর্ণকার, মালাকার, ঘটক, পাঠক, জ্যোতিষী, কবিরাজ, ঘরামি, বৈদ্য, বণিক ইত্যাদি পদবীগুলি পেশাভিত্তিক বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
হাবিলদারের কাজ যাঁরা করতেন, তাঁদের বলা হতো ‘লস্কর’। দশজন সেনার উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘পদিক’। অপভ্রংশে যা হয়ে দাঁড়ায় ‘শতিক’। দশ শতিকের উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘সেনাপতি’। দশ সেনাপতির উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত ‘নায়ক’। ‘দলুই’ পদবী এসেছে সম্ভবত দলপতি থেকে। অনুরূপ “চাকলাদার”, চাকলা মানে কতকগুলি পরগনার সমষ্টি। এই পরগনা সমষ্টির রক্ষাকর্তা চাকলাদার।
কিছু পদবী আবার অন্তনাম থেকে উঠে এসেছে। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে অন্তনাম থেকে উঠে আসা পদবী হলো দত্ত, পাল, নন্দী, বর্মন, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুন্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, দাম, ভুতি, বিষ্ণু, যশ, শিব, রুদ্র।
এগুলি সবই কায়স্থ বা বর্ণহিন্দুদের পদবি। ব্রাহ্মণদের পদবী নয়।
আবার ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘চিন্ময় বঙ্গ’ বইতে লিখেছেন যে বসু, মিত্র, দত্ত, দেব, চন্দ্র, সেন, নন্দী, ধর, ভদ্র, শূর এই সব পদবিতে জৈন সংস্রবের পরিচয় পাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণদের যেমন তিনশোর বেশি শ্রেণী আছে কায়স্থদের মধ্যেও বহু শ্রেণী ভাগ আছে। দক্ষিণ রাড়ী, উত্তর রাড়ী, বঙ্গজ ও বারেন্দ্র কায়স্থ ছাড়াও করণত-কায়স্থ, বাহাত্তর ঘর, রাজু-কায়স্থ প্রভৃতি অনেক শ্রেণীর কায়স্থ আছে।
তূলনামূলকভাবে বৈদ্যদের শ্রেণী ভাগ কম। বৈদ্যদের চারটি মতান্তরে পাঁচটি শ্রেণী আছে।
বৈদ্যদের মধ্যে যুগ্ম পদবী ঠিক কি ভাবে এসেছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। ষষ্ঠ শতকে রচিত দামোদর লিপিতে মহাসেনগুপ্ত নামটি পাওয়া যায়। তবে এখানে সেনগুপ্ত মোটেই পদবী নয়। তেমনি আর একটি ঐতিহাসিক নাম আদিত্য সেনগুপ্ত। এই নামের আদিত্য, সেন এবং গুপ্ত তিনিটি অংশই বাঙালির পদবী হয়েছে। এই ধরণের আরও কিছু নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়, যেমন দেবরায়, নাগসেন, চন্দ্রগুপ্ত, রুদ্রসেন, যশবর্মন ইত্যাদি।
কিছু পদবী ইংরেজ শাসনকালে সৃষ্টি হয়েছে অথবা সাহেবদের উচ্চারণের সুবিধের জন্যে পরিবর্তিত রূপ নিয়েছে। পাল থেকে Paul, দাঁ থেকে Dawn, বোস থেকে Basu, মিত্র থেকে মিটার, চন্দ্র থেকে চন্দর, সিংহ থেকে সিনহা, রায় থেকে রয় অথবা রে ইত্যাদি।
নানারকমের বিচিত্র পদবী আছে বাঙালিদের সেগুলি কোথা থেকে এসেছে তা অনুমান করা যেতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্তে আসা যায় না।
সাহা পদবী এসে থাকতে পারে সিন্ধু প্রদেশের পদবী সাহানি থেকে।পটল এসেছে সম্ভবত গুজরাটের প্যাটেল থেকে। আটা পদবী এসে থাকতে পারে আট থেকে। হয়ত অষ্টপ্রহর কীর্তন গাইয়ে থেকে। ভঞ্জ পদবী এসে থাকতে পারে ভঞ্জদেব থেকে। ওয়াদ্দেদর পদবী এসে থাকতে পারে ওয়াদাদার থেকে। ওয়াদাদার একটি পদ, মানে যিনি আদালতে শপথ গ্রহণ করাতেন। কেরানি থেকে মুনশী, মহাজনী কারবার করা ব্যাক্তি হয়েছেন পোদ্দার, দলপতি থেকে দলুই। কুশো গ্রাম থেকে কুশারি, বোড়ো গ্রাম থেকে বড়াল, গড়গড়ে গ্রাম থেকে গড়গড়ি, পোষলা থেকে পুষালি, ঘোড়ুই এসেছে ঘড়াই বা ঘরামী থেকে, বসাক এসেছে বস্ত্র সম্বন্ধীয় থেকে, ইত্যাদি।
অতয়েব দেখা যাচ্ছে আমাদের বেশির ভাগ পদবীর উৎপত্তি পুরোপুরি ভাবে কোনও নির্ধারিত পদ্ধতি, নিয়ম, ঐতিহ্য, পরম্পরা, বংশানুক্রম ইত্যাদি মেনে সৃষ্টি হয়নি। বাসস্থান থেকে, বৃত্তি থেকে, বিদ্যা থেকে, শাসকের দেওয়া পুরস্কার থেকে বা শাস্তি থেকে, শব্দের অপভ্রংশ থেকে, অথবা অনেক সময় হয়েছে নেহাতই সমাজপতিদের খেয়ালখুশি মতো।
তাই যারা এই সময়ে দাঁড়িয়েও কোনও ব্যাক্তির পদবীর মধ্যে দিয়ে তার জাত খুঁজবার চেষ্টা করে থাকেন তিনি একেবারেই ভুল রাস্তায় হাঁটেন। কারণ একই পদবী কত ব্যাপকভাবে বিভিন্ন জাতের মধ্যে দেখা যায় তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো।
যেমন বিশ্বাস পদবী আছে কায়স্থ, মাহিষ্য, নমঃশুদ্র এবং আরও তিরিশ রকম জাতের মধ্যে। সেন পদবী আছে কায়স্থ, বৈদ্য ছাড়াও প্রায় ২৪ রকম জাতের মধ্যে। গোস্বামী পদবি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, বৈষ্ণব, মাহিষ্য, সদগোপ, মালি, নমঃশুদ্র, এবং আরও কয়েকটি জাতের মধ্যে। অধিকারী পদবী আছে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব মাহিষ্য, সদগোপ, কর্মকার, মালাকার, নমঃশুদ্র ইত্যাদি জাতের মধ্যে।
জাতপাতের ধন্দে না গিয়ে আমরা যদি একটু পিছিয়ে গিয়ে বাঙালি জাতের উৎপত্তি নিয়ে একটু মাথা ঘামাই, তাহলে দেখব অতি প্রাচীন কালে যাদের আদি-অস্ট্রেলীয় বলা হতো তাদের নাম এ দেশে পরে হয়ে যায় ‘ভেড্ডিড’। কেউ কেউ যাদের দ্রাবিড়, আর্য এই ভাবে নরগোষ্ঠীগুলিকে ভাগ করবার চেষ্টা করেন, নীহার রঞ্জন রায় মশাই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন এইগুলি আসলে ভাষাগোষ্ঠীর নাম। একই নরগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠীর অবস্থান থাকতে পারে অঞ্চল হিসেবে। তাই এগুলি নরগোষ্ঠি নয়।
গবেষকরা বাঙ্গালির জনপ্রকৃতির মধ্যে এ পর্যন্ত যে সব উপাদান পেয়েছেন তা থেকে বলা যায় ভেড্ডিড উপাদানই বাঙলার জনগঠনের প্রধান উপাদান। পরে কম বেশি ইন্দো-আর্য , মঙ্গোলীয়, শক ইত্যাদি উপাদান এসে মিশেছে। পাঁচমেশালী জাত হয়েও কালক্রমে বাঙালির একটা নিজস্ব গড়ন দাঁড়িয়ে গেছে। মিশ্রিত বলেই বাঙালির শরীরের গঠন সবই মাঝামাঝি। শরীরের উচ্চতা, মাথার গড়ন, নাকের উচ্চতা, গায়ের রঙ এ সবই মাঝারি। আদি কাল থেকে নৃতাত্বিক ভাবে বাঙালিরা এই সব নানা রকমের মিশ্রিত উপাদান গ্রহণ করে এবং এই বাংলাদেশের নদীজপমালাধৃতপ্রান্তরে বাস করতে করতে এক ধরণের টিপিক্যাল বাঙালি চেহারা অর্জন করেছে। যা দেখে সাধারণত কোনও বাঙালিকে বাঙালি বলে আমরা চিনতে পারি। তাই সহস্র বছরের প্রবহমান জীবনধারা বাঙালির শরীর ও মস্তিস্কে যে সব উপাদান নিহিত করেছে তার মধ্যে পদবীর ভুমিকা নেহাতই অর্বাচীন। পদবীর মধ্যে বাঙালির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রভাব খুব সামান্য।
তাই রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা মতো বাঙালি পরিণত হবার প্রমাণ হিসেবে কোনওদিন যদি ব্যাঙ্গাচির অস্থায়ী ল্যাজটির মতো আমাদের নামের পিছনে লেগে থাকা পদবীটি বর্জন করে দিতে পারে তাহলে সেটা হয়ত জাত হিসেবে আমাদের গৌরব বৃদ্ধিই করবে।
সোমেনবাবু,
ReplyDeleteকেন জানি না অনেকদিন ধরে আমি এই প্রবন্ধটির তল্লাশে ছিলাম ! এটা কাক্তালিয়বত ! কারন আমার একটা উৎসাহ ছিল মানুষের পদবী সম্বন্ধে !
কারনটা বলি, অনেক কাল আগে একসময়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় এই পদবীর ওপর একটা নিবন্ধ বের হতো ক্রমশ দিয়ে ! প্রবন্ধকারের নাম বা কিছুই মনে নেই ! - তাই এই প্রবন্ধতা দেখে বেশ উতসাহী হয়েছিলাম ! কিন্তু আমার আশা একটু বেশি !
তবু আপনার এই প্রবন্ধটার মুল্য অনেক বেশি !
মনোজ
অনেক ধন্যবাদ মনোজবাবু ।
Deleteবেশ ভাল লাগল।
ReplyDeleteঅসাধারণ!
ReplyDeleteবাঙালিদের গোত্র সমূহ নিয়ে একটা লিখুন। কোন গোত্রের অধিকারী কোন জাতি।
ReplyDeleteকিছু লেখার আগে সে বিষয়ে ভালো ভাবে জেনে নেয়া উচিত ।
ReplyDeleteবৈষ্ণব না মাহিষ্য কে উঁচু জাতি,?
ReplyDeleteগুপ্ত আর গুপ্তা পদবীর তফাৎ কি ইংরেজ আমলে? গুপ্তযুগের রাজাদের নামের শেষে গুপ্ত শব্দটি থাকার অর্থ কি?
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteভট্টাচার্য হল খাঁটি ব্রাহ্মণ।
ReplyDeleteGotra originated from the name of guru or teacher.
ReplyDeleteনমস্কার! 'পাতার'(Patar) পদবী টির ইতিহাস জানতে পারলে সমৃদ্ধ হতাম। আসলে আমার এক নিকটাত্মীয়ের পদবী এটি। তারা পশ্চিম বর্ধমানের বাসিন্দা। আমার মতোই তিনিও তার পদবীর রহস্য/ইতিহাস জানতে উৎসুক। তাই, লেখকের কাছে এই অনুরোধ টি রইল।
ReplyDeleteসমেন বাবু লেখাটি খুবই ভালো লাগলো। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে একটু সাহা পদবীর ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে পারবেন।
ReplyDeleteনমস্কার সোমেন বাবু আপনার লেখাটা খুবই ভালো লাগলো। আপনি সাহা পদবীর উৎস সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানাতে পারবেন। প্লিজ।
ReplyDelete