প্রাচীন কথা - অভীক সরকার
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
একটি প্রাচীন পাপ ও তার প্রায়শ্চিত্ত
অভীক সরকার
আমরা পৃথিবীর ইতিহাস বলতে যা বুঝি তা একদিকে যেমন পুরাণকারের কলমে, লোককথায়, বিভিন্ন প্রস্তর ও তাম্রশাসনে বা কবির কাব্যে লিখিত পরম ভট্টারক শ্রীমন্মহারাজদের বীরগাথা, তেমনই মানুষের নিজের সীমিত ক্ষমতা অতিক্রম করে সভ্যতার উচ্চতর ক্রমে উত্থানের ইতিবৃত্ত। এই উত্থানের ইতিহাসে মাঝেমধ্যেই একেকজন ক্ষণজন্মা পুরুষ এসে মানুষকে আলোর দিশা দেখিয়ে গেছেন, ভালোবাসার কথা বলে গেছেন, প্রতিবেশী তথা পরমতাপেক্ষীদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা বলে গেছেন। বলে গেছেন হিংসা ও যুদ্ধের পথ, সে যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, সে পথ ত্যাগ করতে। এঁদের নাম কখনও যীশু খ্রীষ্ট, কখনও কনফুসিয়াস, কখনও শ্রীচৈতন্যদেব, আবার কখনও বা পরমকারুণিক, মর্যাদাপুরুষোত্তম ভগবান তথাগত বুদ্ধ।
মানুষের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মানব গৌতম বুদ্ধের জীবনী আমরা সবাই কম বেশি জানি। যে অপার করুণার সাগর তিনি এই দীনদুনিয়াতে এনেছিলেন, তার তুলনা নেই। বিনা রক্তপাতে, বিনা তরবারির ঝনঝনানিতে, বিনা দস্যুবৃত্তি তথা পরসস্বাপহরণের ডাক দিয়ে, শুধু মাত্র মানুষের মঙ্গলকামনা করে দুনিয়াতে অমন প্রভাব বিস্তার আর কোনও ধর্মপুরুষ করেননি। এ এক লোকোত্তর, ঐশ্বরিক প্রতিভার করুণাবিস্ফোরণ। ঈশ্বর নয়, পরলোক নয়, বংশপরিচয় নয়, শুধুমাত্র নিজের কৃত কর্মফলের ওপর মানুষের অধিকার ন্যস্ত করে ধর্মজগতে তিনি যে বিপ্লব এনেছিলেন, তা তুলনারহিত।
গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন শাক্য সংঘে, কপিলাবস্তুতে। জায়গাটা বর্তমান নেপাল ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমসীমানার কাছে। এই পুণ্যভূমির নামকরণ, শাক্যদের বংশেতিহাস, উত্থান ও পতন এইসব কিছুর মূলে একটি চমৎকার দীর্ঘ কাহিনী আছে। এই কাহিনীটি খুলে বলবো বলেই আজকের এই বাগ্বিস্তার।
সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ শাক্যমুনি বা শাক্যসিংহ নামেও প্রসিদ্ধ। এই গৌতম নামেই শাক্যদের ইতিহাসের একটা ছোঁওয়া পাওয়া যায়, যে এঁরা গৌতম গোত্রজাত। সত্যি কথা বলতে কি, এই গৌতম বা গৌতমমুনি বা গৌতমী ধরণের শব্দ শাক্যবংশের ইতিহাসে বিভিন্ন রাজপুরুষ বা রাজকন্যাদের নামের মধ্যে বারবার ফিরে এসেছে। কারণ শাক্যবংশের ইতিহাস অনুযায়ী, এটি অত্যন্ত স্পষ্টরূপে স্বীকৃত যে এই বংশ গৌতমমুনিপ্রণীত সূর্যবংশের একটি শাখা, এবং সেই বংশ যেনতেন বংশ নয়, জম্বুদ্বীপমধ্যে বংশশ্রেষ্ঠ ইক্ষ্বাকুবংশ! এই ইক্ষ্বাকুবংশে আরও বিখ্যাত রাজন জন্মেছেন, যাঁদের নাম ভারতবাসী মাত্রেই শ্রদ্ধাসহ জানেন, যথা যুবনাশ্ব, মান্ধাতা, হরিশ্চন্দ্র, সগর, ভগীরথ এবং তাবৎ হিন্দুদের কাছে অবতারশ্রেষ্ঠরূপে পূজিত শ্রীরামচন্দ্র।
সেই বৈদিকযুগে গুরুর নামেই গোত্রের নাম হতো, 'বুদ্ধচরিত' রচয়িতা অশ্বঘোষ বলছেন,
"একপিত্রোর্থাভ্রাতোঃ পৃথক গুরুপরিগ্রহহাৎ|
রামএবাভৎ গার্গো, বাসুভদ্রোপি গৌতমঃ||"
মানে এক বাপের দুই ছেলে, রাম ও বসুভদ্র। আলাদা আলাদা গুরু স্বীকার করায় রাম গার্গ্য হলেন এবং বাসুভদ্র হলেন গৌতম!
শুরুয়াৎ
এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ইক্ষ্বাকুর ছিলো চার ছেলে এবং পাঁচ মেয়ে। বুড়ো বয়সে ভদ্রলোক আরেকটি মেয়ের প্রেমে পড়েন। সেই মেয়েটির বাবা বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিলেন, বিয়ে দেওয়ার আগে রাজাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেন যে এই কন্যাজাত সন্তানটিই পরবর্তী রাজা হবে! সত্যযুগের কথা, গণতান্ত্রিক সভ্য সুসংস্কৃত কলিযুগের ইউপি বা বিহার তো নয়, যে রাজারাজড়ারা মেয়ে পছন্দ হলেই টকাটক নিয়ে বিছানায় তুলবেন। তেনার কিঞ্চিদধিক নিয়মকানুন মেনেটেনে চলতেন।
এখানে পাঠকসমাজের মহাভারতের শান্তনু এবং সত্যবতীর কাহিনী মনে পড়তে বাধ্য। এখন ইক্ষ্বাকুকাহিনীর এই পরিবারটিও জেলে/কৈবর্ত ছিলো কিনা জানিনা। তবে ভারতের ইতিহাসের খুব ইম্পর্ট্যান্ট সময়ে এই মাছধরা জাতিদের কথা বারবার ফিরে আসে, কিসের মোটিফ হিসেবে বলা মুশকিল। সে ধীবরকন্যা সত্যবতী হোন, নাথ সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ মৎস্যেন্দ্রনাথ হোন, বাপালযুগের কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্বোক, ধীবর বা ধীবরকন্যারা চিরকালই ভারতেতিহাসের নির্ণায়কশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।
এই বৃদ্ধ নৃপতিস্য তরুণী ভার্যা থেকে যখন একটি অনিন্দ্যসুন্দর ছেলে জন্মায় (নাম রাজদণ্ড), মহারাজ ইক্ষ্বাকু পত্রপাঠ বাকি চার ছেলে এবং পাঁচ মেয়েকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেন। কাজটা মোটেই ভালো করেননি সে কথা বলা বাহুল্য, তবে ছেলেমেয়েরাও দমবার পাত্র ছিলেন না। তাঁরাও অনুগত লোকলশকর নিয়ে দিব্যি গঙ্গার কিনারা ধরে ধরে নতুন দুনিয়ার খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।
এই করে করে বেশ কিছুদিন পর তাঁরা এমন এক জায়গায় পৌঁছন, যেখানে গঙ্গা দক্ষিণাবর্তী। সেখানে তাঁরা এক যোগীপুরুষের সন্ধান পান, যাঁর নাম কপিল।
মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ইনিই সাংখ্যদর্শনের প্রবাদপ্রতিমপুরুষ কপিলমুনি। মহর্ষি কপিলই তাঁদের হিমালয়ের পাদদেশে এক জায়গায় স্থান বা বাস্তু নির্দিষ্ট করে দেন, সেই কপিল নির্দেশিত বাস্তুস্থানটির নামই কপিলাবস্তু।
তা এই ইক্ষ্বাকুবংশজাতরা নিজেদের বংশের গরিমা নিয়ে ভারি অহংকারী ছিলেন, তাই স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে বিবাহাদির কথা ভাবতেও পারেননি। অথচ তাঁরা শ্রেষ্ঠতম বৈদিক বংশাদির মধ্যে অন্যতম, দশবিধ সংস্কার তাঁদের মজ্জাগত। তাছাড়া মহর্ষি ফ্রয়েড মানব জীবনে সেক্স জিনিসটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ সে কথা পইপই করে বলে গেছেন। অবশেষে কপিলমুনিই সেই সঙ্কট থেকে তাঁদের উদ্ধার করেন, তিনি নিদান দেন যে, সহোদরা নয় এমন দূরসম্পর্কের ভগিনীদের বিবাহ করা এঁদের পক্ষে বৈধ।
সেই থেকে শাক্যদের মধ্যে দুটি নিয়ম বজ্রাদপি কঠোরতার সঙ্গে বলবৎ হয়, (১) যেহেতু বহুবিবাহের কুফলস্বরূপ এঁদের এমম্বিধ দুর্ভাগ্য, সেইহেতু শাক্যদের মধ্যে একটি ছাড়া অন্য দারপরিগ্রহ নিষিদ্ধ হয়। সে আপনার যদি সন্তানাদি না হয়, বা তার আগেই পত্নীবিয়োগ হয়, তাহলেও আপনার পক্ষে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা নিষিদ্ধ। একমাত্র, মাত্র একবারই সেই নিয়মের ব্যত্যয় হয় শাক্যবংশে, সিদ্ধার্থের বাবা শুদ্ধোদনের ক্ষেত্রে, সে গল্প একটু পরেই জানাচ্ছি। আর (২) বংশের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই বিয়ে হবে সদাসর্বদা, রক্তের বিশুদ্ধতা ধরে রাখার জন্যে। না অন্য বংশে মেয়ে দেবো, না অন্য বংশ থেকে মেয়ে আনবো, সে যতই স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি হোক না কেন!
এই দ্বিতীয় কঠোর সামাজিক বিধিনিয়মটিই এই জাতির সর্বনাশের কারণ হয়ে নেমে আসে, ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
তা এই ইক্ষ্বাকু থেকে শুদ্ধোদন অবধি এই বংশধারাটির একটি লম্বা লাইন আছে। এই বিস্তারের মধ্যে গপ্পগাছা কতটা আর ঐতিহাসিক সত্য কতটা বলা মুশকিল, তবে মহাবংশ আর অম্বষ্ঠসুত্তে উল্লেখিত সেই বংশধারা অনুযায়ী, এই বংশের প্রথম পুরুষ ওক্কাকা বা ওক্কাকু। পালি ভাষায় ওক্কাকু মানে ইক্ষ্বাকু। তাঁর বিতাড়িত চার পুত্রের নাম হলো উল্কামুখ বা ওক্কামুখ, কারণ্ডক বা কারকর্ণ, হস্তিকশীর্ষ বা হস্তিনাজক এবং নূপুর বা নিপুরা।
একের পর এক ওক্কামুখ, কারকর্ণ এবং হস্তিনাজক রাজা হন, কিন্তু কারোরই কোনও সন্তান ছিলো না, আর একপত্নীক নীতির জন্যে আর কেউ অন্য কোনও বিয়েও করতে পারেননি। ফলে শেষে পুত্রবান নিপুরা বা সুনূপুর রাজা হলে বংশধারা অক্ষুণ্ণ থাকে। এই নিপুরা থেকে আসেন চণ্ডিমা, তার থেকে চণ্ডমুখ, সেখান থেকে শিবসঞ্জয়। শিবসঞ্জয় থেকে বেসসনতারা, বেসসনতারা থেকে জালি, তার থেকে শিববাহন এবং শিববাহন থেকে সিহসসরা। সিহসসরা শব্দটি পালি, সংস্কৃত শব্দটি হলো সিংহশ্রী। ভদ্রলোকের শ্রী সম্ভবত বিশ্রীরকমের বেশি হয়ে থাকবে, কারণ অম্বষ্ঠসুত্তানুযায়ী এঁর সন্তানসন্ততির সংখ্যা ছিলো বিরাশি হাজার!
কথাটা যে সম্পূর্ণ ভুয়ো বা অতিরঞ্জিত, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেযুগে রাজারা মেরেকেটে কুড়ি থেকে তিরিশ বছর রাজত্ব করতেন, এবং তদন্তে ফৌত হতেন। এঁদের বয়ঃসীমা কোনরকমভাবেই পঞ্চাশের কোঠা পার হতে পারতো না, ফলে 'অবশেষে শত্রুপাতন করে চক্রবর্তী সম্রাট হাজার বছর রাজত্ব করলেন' ধরণের কথাবার্তার আদৌ কোনও ভিত্তি নেই। ফলে এর মধ্যে বিরাশিহাজার সন্তানসন্ততির বায়োলজিক্যাল ব্যাপারটা স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা আর ষষ্ঠীঠাকুরুণ মিলে যৌথ প্রচেষ্টায় সমবায় সমিতি খুললেও এক্সপ্লেইন করা অসম্ভব। এর আরেকটি অর্থই হতে পারে, তখন ঝাড়েবংশে শাক্য বংশ ওই সাইজে পৌঁছেছিলো।
এর ফলে বাধ্য হয়েই 'দেবজাতি' এসে এই ক্রমবর্ধনশীল জনজাতির জন্যে কপিলাবস্তুর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রোহিণী নদীর ওপারে আরেকটি স্থান নির্দেশ করে দেন। দেবজাতি কথাটা বলাবাহুল্য অতিশয়োক্তি, তৎকালে রাজাদেরই দেব বলা হতো। আর শাক্যজাতি ছিলো গণরাজ্যমাত্র, গণমুখ্যই রাজা নামে আখ্যায়িত হতেন। ফলে গণপ্রধানরা মিলে এই বর্ধিষ্ণু জনসমদায়কে ভাগ করে নিয়েছিলেন বললেই ঠিক বলা হয়। তা সেই দেবনির্দিষ্ট স্থানটির নাম দেওয়া হয় দেবদহ। এঁরা নিজেদের নাম নেন কোলিয়, কোলিয়শাক্য।
রাজাদের এই কল্যাণমুখী দায়িত্ববদ্ধ রূপটি বৌদ্ধকাহিনীর মধ্যে নানাভাবে দেখা যায়। বৌদ্ধশাস্ত্রানু মতে, মানবসভ্যতার উন্মেষকালে জনগণ তাদের উৎপাদিত ফসলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে একজন দারোয়ান ঠিক করে, উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠাংশ সেই দারোয়ানবাবু পাবেন স্যালারি হিসেবে, এই চুক্তিতে। এই দারোয়ানই হলেন রাজা। এই নিয়ম বা এই বিশ্বাস তৎকালীন কোশল বা মগধে না চললেও শাক্যদের মধ্যে চলতো। ক্রমে এই মত বৌদ্ধদের মধ্যেও চালু হয়, যে রাজা ঈশ্বরের অংশাবতংস নয়, বরং প্রজানুরঞ্জনের জন্যেই রাজার উৎপত্তি। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পঞ্চম শতকে বৌদ্ধপণ্ডিত চন্দ্রকীর্তি বলছেন,
"গণদাসস্য তে গর্ব্বঃ ষড়ভাগেন ভৃতস্য কঃ?" (উৎপাদিত ফসলের ছয়ভাগের একভাগ যার প্রাপ্তব্য, সেই গণদাসের এই গর্ব কিরূপের?)
যাই হোক। সিহসসরার ছেলে হলেন জয়সেন। এইখান থেকে আমাদের কাহিনীর শুরু।
গৌতম বুদ্ধের ফ্যামিলিচিত্র
জয়সেনের তিন ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের নাম যশোধরা (ইনি বুদ্ধপত্নী যশোধরা নন, সিদ্ধার্থের দিদিমা), আর ছেলেরা হলেন হর্য্যঙ্ক, ব্রহ্মত্ত্ব আর সিহহনু বা সিংহহনু।
একই সময়ে কোলিয়দের মধ্যে রাজা ছিলেন দেবদত্তশাক্য। তাঁরও একটি ছেলে ও একটি মেয়ে ছিল, নাম অঞ্জন এবং কাচ্চনা বা কাত্যায়নী।
পালটিঘর ঘর হলে যা হয়, দুই রাজা ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে বদলাবদলি করে নিলেন। অঞ্জনের সঙ্গে বিয়ে হলো যশোধরার। আর কাচ্চনার সঙ্গে বিয়ে হলো সিংহহনুর।
কাচ্চনা-সিংহহনুর পাঁচটি ছেলে এবং দুইটি মেয়ে হয়। মেয়েরা হলেন অমিতা ও পমিতা, অর্থাৎ প্রমিতা। ছেলেরা হলেন শুদ্ধোদন, শুক্লোদন, শাক্যোদন, ধৌতদন এবং অমিতোদন। ওদন মানে অন্ন, এঁদের প্রত্যেকের নামে অন্ন কেন জুড়ে থাকতো বলা মুশকিল, উচ্চফলনশীল ধানের ক্ষেতটেত ছিলো বোধহয়। আগেই বলেছি, এঁরা রাজা ছিলেন না, বড়সড় জমিদার বলতে পারেন। সর্বসম্মতিক্রমে একজন গণমুখ্য নির্বাচিত হতেন, ফার্স্ট অ্যামং দ্য ইকোয়ালস, তাঁকেই রাজন টাজন বলে খাতির করা হতো। সিদ্ধার্থ রাজপুত্র ছিলেন না, জমিদারপুত্র ছিলেন মাত্র।
ওদিকে যশোধরা আর অঞ্জনের কোল আলো করে দুই কন্যা এবং এক পুত্র এলেন, কন্যারা হলেন মহামায়া, এবং গোতমী (পরে পরিচিত হন মহাপজাবতি, মানে মহাপ্রজাবতী গোতমী নামে) এবং ছেলে হন সুপ্পবুদ্ধ।
ভদ্রমহিলা দুইজনের নাম কি চেনা চেনা লাগছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ভগবান তথাগতকে গর্ভে ধারণ করার ঐশ্বরিক আশীর্বাদটি যাঁর মাথায় নেমে এসেছিলো, তিনিই মহামায়া। আর যিনি অপার মাতৃস্নেহে পালন করেন সিদ্ধার্থকে, তিনিই মহাপ্রজাবতী গোতমী।
বুঝতেই পারছেন, সিংহহনুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শুদ্ধোদন এই দুই বোনকে বিয়ে করেন। আগেই বলেছি, এটা শাক্যদের নীতিবিরুদ্ধ, ভদ্রলোক গণমুখ্যদের রীতিমতো কোর্ট বসিয়ে এই স্পেশ্যাল স্যাংশনলেটারটি ইস্যু করান। কিন্তু কি করে?
গল্পটা এইরকম। সিংহহনু তখনও রাজা বটে কিন্তু মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন, গোলযোগ বিশেষ সইতে পারেন না। এমন সময় পাণ্ডবদের বংশধর কোনও এক পার্বত্যজাতি এসে 'হাল্লা চলেছে যুদ্ধে ' বলে কপিলাবস্তুতে দরজায় এসে হাজির!
(টীকাঃ মাঝেমধ্যে টীকা না দিলে আমার আবার এমনিতেই মন কেমন করে। যাগগে যাক, এই পাণ্ডবদের বংশধর পার্বত্য জাতিটি কারা, সেটা এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। পাণ্ডবরা বলবীর্যে দৃপ্তপুরুষ ছিলেন, তাছাড়া সে আমলে লোকজনের শখ আহ্লাদ কিঞ্চিৎ বেশি ছিলো, সহজে বোরড হতেন না। এই পাঁচ ভাইয়ের কে পার্বত্য অঞ্চলে কি করে গেছে জেনে আপনারই বা কাজ কি মশাই? লোকজনের ব্যাপারে চারটি কুচ্ছো না গাইলে চলে না, না? যত্তসব..)
তা কপিলাবস্তুর লোকজন ভয়ে থরহরি কম্পমান। শাক্যরাও দুর্ধর্ষ বীর ছিলেন বটে, কিন্তু চাতুরি ও নৃশংসতায় এই পার্বত্যজাতির কোনও তুলনা ছিলো না। গণমুখ্যরা এসে রাজকুমার শুদ্ধোদনকে ধরে বসলেন, এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যে।
শুদ্ধোদন মস্ত বড় বীর ছিলেন, শত্রুদের একধার থেকে পেটাতে পেটাতে বোধহয় এভারেস্টের ওপারে ফেলে দিয়ে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে গণনায়কদের কাউন্সিলে এসে সলজ্জ মুখে জানালেন যে তাঁর দুটি কথা বলার ছিলো। গণনায়কদেরও বয়েস হয়েছিলো, তাঁরা এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যারপরনাই খুশি। স্বস্তিবাচনটাচন উচ্চারণ করে বললেন "বলো হে ছোকরা, কি চাও?" শুদ্ধোদন ঘাড়ফাড় নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে অদ্বিতীয় মনোবাঞ্ছাটি প্রকাশ করলেন, তিনি মায়া ও গৌতমী, এই দুইবোনকেই ঘরে তুলতে চান!
শাক্যপ্রমুখেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বললেন, তথাস্তু! এই প্রথম আর এই শেষ।
মহামায়া তো সিদ্ধার্থের জন্মের পর সাতদিন বাদে মারা যান। মাসি গোতমী সিদ্ধার্থকে নিজের সন্তানসম স্নেহে মানুষ করেন। গোতমীর গর্ভে, শুদ্ধোদনের ঔরসে আরও দুটি সন্তান জন্মায়, নন্দ এবং রূপানন্দা।
এদিকে শুদ্ধোদনের বোন প্রমিতার সঙ্গে বিয়ে হয় অঞ্জন যশোধরার ছেলে সুপ্পবুদ্ধ বা দণ্ডপাণির। এঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম দেবদত্ত। ইনি বহু বৌদ্ধকাহিনীর উপজীব্য। এঁর প্ররোচনাতেই অজাতশত্রু তাঁর পিতা বিম্বিসারকে বন্দী করেন। শেষে ভগবান বুদ্ধ এঁর বিয়ের দিন প্রায় তুলে নিয়ে এসে এঁকে ভিক্ষু বানান, সেও আরেক চমৎকার গল্প, আরেকদিন সময় পেলে বলবো'খন।
আর মেয়েটির নাম যশোধরা বা গোপা। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সশ্রদ্ধায় বলেন রাহুলমাতা।
বুঝতেই পেরেছেন ইনি কে। সিদ্ধার্থ গৌতমের অর্ধাঙ্গিনী।
কেউ কেউ বলেন সিদ্ধার্থের দুই স্ত্রী ছিলেন, একজনের নাম গোপা, আরেকজনের নাম যশোধরা। কথাটা সর্বৈব ভুল, কারণ আগেই বলেছি যে শাক্যদের মধ্যে একপত্নীক নিয়মটি বড় প্রবল ছিলো। আর যশোধরা বা গোপা, দুটোই যাকে বলে এঁর নিকনেম বা ডাকনাম। এঁর ভালোনাম হচ্ছে ভদ্দকাচ্চনা বা ভদ্রকাত্যায়নী।
(টীকাঃ ঘাবড়াবেন না, জয়সেন থেকে শুরু করে রাহুল অবধি ফ্যামিলি ট্রি স্পষ্টাক্ষরে এঁকে দিয়ে দিচ্ছি। পরে চোখ বুলিয়ে নেবেন না হয়)।
শুদ্ধোদনের বাকি ভাইবোনদের থেকে পাঁচটি সন্তান জন্মায়। অমিতার ছেলে তিষ্য বা কল্যাণবর্ধন, অমিতোদনের ছেলে আনন্দ, আর শুক্লোদনের দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের নাম রোহিণী। দুইছেলের একজনের নাম অনিরুদ্ধ, আরেক জনের নাম মহানাম।
এই মহানামই আমাদের কাহিনীর প্রধান চরিত্র। এঁর পাপেই শাক্যবংশ ধ্বংস হয়। কিন্তু ঘোর সঙ্কটসময়ে স্বজাতীয়দের বাঁচাবার জন্যে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে যে আত্মত্যাগটি করে যান, তারও তুলনা নেই।
আরেকটা কথা, এই অমিতোদনপুত্র আনন্দই বুদ্ধের প্রধান সহচর আনন্দ।
সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম নিয়ে অনেক অলৌকিক গল্প আছে, বেশিরভাগই মহাযানপন্থীদের বানানো, তারা তখন বুদ্ধকে লোকোত্তর দেবতা হিসেবে বানাতে বদ্ধপরিকর। কথিত আছে, যেদিন শাক্যবংশে সিদ্ধার্থ জন্ম নেন, ঠিক সেই দিনই কোশলনৃপতি প্রসেনজিৎ এবং মগধ নরেশ বিম্বিসার জন্ম নেন। এবং এই তিন রাজবংশের ভাগ্য এক অনির্দেশ্য লিখনে সেইদিনই বাঁধা পড়ে যায়।
কোশল, মগধ এবং একটি জোচ্চুরি
কোশল রাজ্য ছিল বর্তমান উত্তর প্রদেশের মধ্য ও পশ্চিমপ্রান্ত নিয়ে, গঙ্গার উত্তরদিকে। অযোধ্যা, সাকেত আর শ্রাবস্তী এই গণরাজ্যটির প্রধান তিনটি নগর।
রাজধানী ছিল শ্রাবস্তী, 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য' মনে আছে? সেই শ্রাবস্তী।
আর মগধ ছিলো বর্তমানে বিহার রাজ্যের মধ্য, পশ্চিম এবং উত্তর অংশ নিয়ে, রাজধানী ছিল রাজগৃহ বা রাজগীর। মহাভারতীয় মহাপরাক্রান্ত নরপতি জরাসন্ধ এই মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন।
আগেই বলেছি, যেদিন সিদ্ধার্থ জন্ম নেন সেইদিনই কোশলনৃপতি প্রসেনজিৎ (পালি ভাষায় পসেনদি) আর মগধের রাজা বিম্বিসার জন্ম নেন।
বিম্বিসার যে বংশের রাজা ছিলেন, তার নাম হর্য্যঙ্ক। একে পিতৃহন্তাদের বংশ বললেও চলে, কারণ এই বংশের প্রত্যেক রাজা, ইচ অ্যান্ড এভরিওয়ান, তাঁর পিতৃদেবের বুকে তলোয়ার, অভাবে ছুরি বা তদভাবে কাঁচিটাঁচি গুঁজেই রাজা হয়েছেন।
কোশলরাজ প্রসেনজিৎ তাঁর বোন কোশলদেবীর সঙ্গে বিম্বিসারের বিয়ে দেন, এবং যৌতুক হিসেবে কাশীরাজ্য দান করেন।
এর পরেও বিম্বিসারবাবু আরও তিনটি বিয়ে করেন, (রাজা রাজড়াদের ব্যাপার মশাই, হিংসে করে লাভ নেই। তাছাড়া সামলাতে পারবেন কিনা সেটাও ভেবে দেখতে অনুরোধ করি!) লিচ্ছবিদের রাজকন্যা চেল্লনা, বিদেহ রাজকন্যা বাসবী এবং মদ্ররাজকন্যা ক্ষেমা।
এর মধ্যে চেল্লনার গর্ভে জন্মান রাজপুত্র অজাতশত্রু। তিনি বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে বাবা বিম্বিসারকে গৃহবন্দী করেন। এঁর প্রধান কুমন্ত্রণাদাতা ছিলেন সুপ্পবুদ্ধ ও প্রমিতার ছেলে, সম্পর্কে সিদ্ধার্থের শ্যালক দেবদত্ত!
কথিত আছে বন্দী বিম্বিসারকে সামান্য কিছু খেতে দেওয়া হতো, আর হাতে পায়ে কেটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে ক্ষত বিষিয়ে উঠে ভদ্রলোকের দ্রুত এন্তেকাল হয়। স্বামীর দুঃখে প্রধানা মহিষী কোশলদেবীর বুক ফেটে যেত, তিনি নাকি চুলের মধ্যে খাবার লুকিয়ে নিয়ে যেতেন বন্দী বিম্বিসারের সঙ্গে দেখা করতে। জানতে পেরে অজাতশত্রু কোশলদেবীর কারাগারে যাতায়াত বন্ধ করেন।
গল্প আছে, এরপর নাকি কোশলদেবী অজাতশত্রুর সঙ্গে দেখা করে স্বামীর মুক্তি ভিক্ষা করেন। অজাতশত্রু নাকি কান্নাকাটি দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি, নিজের হাতে কুঠার হাতে রওনা দিয়েছিলেন বাবার শৃঙ্খলমোচন করে মুক্তি দেবেন বলে। ছেলেকে কুঠার হাতে আসতে দেখে বিম্বিসার উলটো বোঝেন (খুবই স্বাভাবিক!) এবং আতঙ্কে হার্ট অ্যাটাক হয়ে (মতান্তরে লুকোনো বিষপাত্র থেকে বিষপান করে) মারা যান।
শোকে দুঃখে উন্মাদিনীপ্রায় কোশলদেবী প্রাণত্যাগ করেন।
বলাবাহুল্য, রাজা প্রসেনজিৎ বোনের মৃত্যু ভালোভাবে নেননি। তিনি সসৈন্যে মগধের দিকে রওনা দেন।। দুইপক্ষের মধ্যে দুই থেকে তিনবার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে মতান্তর আছে, তবে বেশিরভাগের মতে অজাতশত্রুই জিতে যান। এরপর প্রসেনজিৎ নিজকন্যা বজ্জিরাকে অজাতশত্রুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কাশীরাজ্য পুরোপুরিভাবে মগধের হাতে সমর্পণ করেন।
(টীকাঃ একই যৌতুক দুইবার দেওয়ার মধ্যে কি বাহাদুরি বুঝি না বাপু। যদি দিবিই তো আরও কিছু এলাকা ধরে দে! যেমন পর্তুগীজরা মুম্বই শহরটা যৌতুক হিসেবে ইংরেজদের দিয়ে দিয়েছিল!)
এই প্রসেনজিৎ যুবাবয়সে মৃগয়া করতে গিয়ে যখন রাজধানীতে ফিরে আসছিলেন, তখন রাস্তা হারিয়ে কতকটা বাধ্য হয়েই এক উদ্যানপালকের ঘরে আশ্রয় নেন। সেই উদ্যানপালকের একটি অসামান্য বুদ্ধিমতী কন্যা ছিলো, নাম মল্লিকা। তার গুণবত্তার পরিচয় পেয়ে ভদ্রলোক খুবই ইম্প্রেসড হন, এবং তারপর রাজারা যা করেন, ইনি মল্লিকাকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন।
শকুন্তলা দুষ্মন্ত রিভিজিটেড!
কিন্তু এসব পরের গল্প। আগের গল্পটা এখন বলি, কিভাবে শাক্যবংশের শেষের শুরু।
সিদ্ধার্থ তখন গৌতম বুদ্ধ হয়েছেন। মারদমন করে, বোধিচিত্ত হয়ে তিনি মৃগদাবে এসে ধর্মচক্রপ্রবর্তন করেছেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যাগযজ্ঞের ভারে ক্লান্ত ভারতবাসী অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে একনতুন করুণাসূর্যের উদয়। আরও অনেকের মতন কোশলনরেশ প্রসেনজিতও বুদ্ধের অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। কথিত আছে তিনি ষোলদিন ধরে ষোলটি ভয়ানক স্বপ্ন দেখেন। রাজব্রাহ্মণদের কাছে সেই স্বপ্নগুলির ব্যাখ্যা চাইতে তারা যথারীতি "এই স্বপ্ন আপনার ভাগ্যে আসন্ন অশনিসম্পাতের অত্যন্ত গম্ভীর ঈঙ্গিত ছাড়া আর কিচ্ছু না প্রভো। কোষাগার খুলে দিন, শ'খানেক পশুবলি দিয়ে, যাগযজ্ঞ করে ব্যাপারটার নিবৃত্তি না করলে আপনার জীবনের গ্যারান্টি দিতে কিন্তু পারবো না" বলে গাদাগুচ্ছের টাকাপয়সা ম্যানেজ করেছে। প্রসেনজিতের কি জানি কি মনে হলো, ভাবলেন যে ভদ্রলোক মার্কেটে নতুন এসেছেন, তাঁকেও একটু বাজিয়ে দেখাই যাক। কথিত আছে, ভগবান বুদ্ধ স্বপ্নগুলির ব্যাখ্যাসমেত রাজার মনে শান্তি ফিরিয়ে আনেন এবং সেই থেকে প্রসেনজিৎ বুদ্ধের যারপরনাই ভক্ত হয়ে উঠলেন।
প্রসেনজিতের পয়লা বিবি ছিলেন মগধের এক রাজকন্যা। তখনকার কালে সম্পর্ক টম্পর্ক বাড়ানোর জন্যে রাজারাজড়ার হামেশাই অন্য রাজ্যের রাজবংশের মেয়ে বিয়ে করতেন।
(টীকাঃ ব্যাপারটা খারাপ নয় বলুন? ধরুন আপনারও টুক করে এই সুযোগে চারটে বিয়ে হয়ে গেলো। মন্টুবাবুর সঙ্গে বাড়ির পাঁচিল নিয়ে ব্যাপক বাওয়াল হচ্ছিলো, ফলে আপনি কতকটা বাধ্য হয়েই মন্টুবাবুর সেজো বোন বুঁচকিকে বিয়ে করলেন। তারপর অফিসে অডিটের মিস্টার ঝুনঝুনওয়ালা গতবছরের বাজেট ফাইলটা নিয়ে অন্যায় সব প্রশ্ন তুলছেন, আপনি ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধনের জন্যে তার বড়মেয়ে মিস চম্পাকলিকে ঘরে না তুলে পারলেন না। এদিকে পাশের পাড়ার হাতকাটা বলাই বহুদিন ধরে আপনার সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে, আপনি আপনার মেজো মেয়ে চিংড়ির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করলেন, এই আর কি!
বা ধরুন আমাদের শাকাহারী নরেন্দ্রবাবু বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নতির খাতিরে শেষ পর্যন্ত চিনের পলিটব্যুরোর চিফের মেয়ে কুমারী নিন ফ্যাচাংকে ঘরণী হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ভদ্রলোক বিয়ে শাদি করে এসে সবে শান্তিতে একপিস খাখরা বা ফাফড়া চায়ে ডুবিয়ে খেয়েছেন কি খাননি, এমন সময়ে নবলব্ধা বহুরাণীটি সুললিত কন্ঠে বললেন, "মিত্রোঁ, চাট্টি কচি দেখে আরশোলা এনে দাওনা প্লিজ, পকৌড়া খেতে মুঞ্চায়!")
তা প্রসেনজিৎ এর ইচ্ছে হলো যে বংশে অমন মহাপুরুষ জন্মেছেন, সেই রাজবংশের একটি রাজকন্যাকে ঘরণী করে ঘরে আনবেন। ফলে তিনি শাক্যদের রাজসভায় মনোবাসনা প্রকাশ করে দূত পাঠালেন।
শাক্যদের মধ্যে তখনও শুদ্ধোদন রাজা, তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন আমাদের কাহিনীর নায়ক, শুক্লোদনপুত্র মহানাম। প্রসেনজিতের অনুরোধ শুনে শাক্য গণমুখ্যরা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। আগেই বলেছি যে শাক্যদের মধ্যে দুটি নিয়ম বড় কড়া ছিল, একটি ছিল একপত্নীব্রত নিয়ে, আরেকটি ছিল বিয়েশাদি নিজেদের মধ্যেই হওয়া নিয়ে। ফলে কেউই প্রসেনজিতকে নিজের মেয়ে দিতে চাইলেন না। আর তাছাড়া শাক্যবংশের অহঙ্কার ছিলো খুব। শাক্যবংশ ছিলেন দুর্দান্ত যোদ্ধৃবংশ, তীরন্দাজি আর হস্তিচালনায় এঁদের প্রতিভা ছিলো প্রবাদপ্রতিম।
(টীকাঃ হস্তিচালনা, মানে হাতি পোষ মানানো শেখান নাকি এক বাঙালি ঋষি, তাঁর নাম পালকপ্য। আসাম, মানে প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে শুরু করে নেপাল ও তরাই অঞ্চলের অধিবাসীদের হস্তিচালনায় দক্ষতা ছিলো প্রশ্নাতীত। পুরাণেতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক মাত্রেই জানেন মহাভারতের কালে শ্রেষ্ঠত্ব অনুযায়ী যোদ্ধাদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো, রথী, মহারথী এবং অতিরথ, অতিরথ হলেন বীরত্বের শেষ সংজ্ঞা। মহাভারতের যুদ্ধে মোটমাট পাঁচজন অতিরথ ছিলেন। এঁদের মধ্যে চারজন হলেন উত্তরপশ্চিম ভারতের বীরশ্রেষ্ঠ বীরোত্তম চতুর্বীরাঃ, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, অর্জুন ইত্যাদি। তাদের মধ্যে একমাত্র অড ম্যান আউট ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুর সম্রাট ভগদত্ত। পারলে তিনি একাই পাণ্ডবদের পিণ্ডি পাকিয়ে চটকে গয়াতে পিণ্ডদান করে দেশে ফিরতে পারতেন, পারেননি সে নেহাতপক্ষে গ্রহের ফের। মহাবীর অর্জুন নিজেই স্বীকার করেছেন - 'মহাবীর ভগদত্ত গজযান বিশারদ ও পুরন্দর সদৃশ। উনি এই ভূমণ্ডলে গজযোধীগণের প্রধান। উঁহার গজের প্রতিগজ নাই। ওই গজ কৃতকর্মা, জিতক্লম (মানে সহজে ক্লান্ত হয় না আর কি) এবং অস্ত্রাঘাত ও অগ্নিস্পর্শ সহনক্ষম। ওই গজ একাকী সমুদয় পাণ্ডব সেনানী সংহার করতে সক্ষম'। এতে বোঝা যায় সেই সময়ে আসাম, নেপাল, নর্থ বেঙ্গল ইত্যকার এলাকাতে হাতি পোষা আর তাদের কাজে লাগানোতে এই সমস্ত লোকজনেদের কোনও তুলনা ছিলো না।)
তাছাড়াও শিক্ষিত শাক্যবংশ 'কোসালান'দের বর্বর এবং অসংস্কৃত বলে মনে করতো। বর্বর ফ্যামিলিতে কেই বা আর প্রাণে ধরে নিজের মেয়ে বিয়ে দেয় বলুন?
কিন্তু কোশলদেশ মহাপরাক্রান্ত দেশ, আর প্রসেনজিতও কোনও হেঁজিপেঁজি রাজা নন। একমাত্র মগধরাজ বিম্বিসার ছাড়া ভদ্রলোকের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার কেউ নেই, চাইলে উনি ইচ্ছামাত্রে শাক্যদেশ ধ্বংস করতে পারেন। এখন কোশলরাজ প্রসেনজিতকেও চটানো হবে না আর শাক্যদের নীতি এবং অহঙ্কারও দৃঢ়নিশ্চয় থাকে, তার উপায় কি?
তখন এই শুক্লোদনপুত্র মহানাম, শুদ্ধোদনের খুড়তুতো ভাই এবং প্রধান সেনাপতি, তিনি একটি পথ বাতলালেন। তাঁর বাড়িতে অগণিত দাসদাসী ছিলো, তাদের মধ্যে নাগমুণ্ডা নামের দাসীর গর্ভে, মহানামের ঔরসে একটি অতিসুন্দরী কন্যা জন্মায়, নাম বাসবক্ষত্রিয় বা বাসবক্ষত্তা। রূপের ঘটায় সে শাক্যরাজকুমারীদের থেকে কম কিছু যায় না। মহানাম তাকেই শাক্যরাজকন্যা বলে প্রসেঞ্জিতের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। প্রসেনজিতও বোকাসোকা লোক, এসব প্রবঞ্চনার কিছুই বুঝলেন না, তিনি শাক্যবংশের মেয়ে বিয়ে করেছেন ভেবে ভারি খুশি হয়ে দেশে ফিরে গেলেন।
রাজনীতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে মহানাম যা করেছিলেন তা বিশুদ্ধ জোচ্চুরি ছাড়া আর কিছুই না। এবং এই কারচুপির মূল্য শাক্যবংশকে একদিন কড়ায়গণ্ডায় চুকিয়ে দিতে হয়েছিলো। তখনকার দিনে রক্তের শুদ্ধতা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস ছিলো, সন্দেহ নেই। হ্যারি পটারের ভাষায় বাসবক্ষত্তা ছিলেন মাডব্লাড! ফলে তাঁকে শাক্যরাজকন্যা বলে চালিয়ে দেওয়াটা সেযুগের ইন্টারন্যাশনাল প্রটোকলের সাপেক্ষে ছিলো নেহাতই অন্যায় এবং প্রতারণা। ভগবান বুদ্ধের লড়াই ছিলো এর বিরুদ্ধেই, তিনি কর্মফলকেই মানুষের নির্বাণ বা মোক্ষলাভের পথে একমাত্র যোগ্যতা বলে মনে করতেন, জাতিভেদ বা রক্তের বিশুদ্ধতা তিনি মান্য করতেন না। এই বাসবক্ষত্তা ক্রমে প্রসেনজিতের পট্টমহিষী বা পাটরানি বলে স্বীকৃত হন। অন্যরানী মল্লিকা প্রথম থেকেই বুদ্ধের অনুরক্তা ছিলেন। ইনি শেষজীবনে বুদ্ধের সংঘে ভিক্ষুণী হিসেবে যোগদান করেন।
প্রসেনজিৎ একটি অত্যন্ত অন্যায় পাপকাজ করেছিলেন। বন্ধুল বলে তাঁর একটি অতি বুদ্ধিমান ও উপকারী সেনাপতি ছিলেন। স্বরাষ্ট্র থেকে বৈদেশিক, বিভিন্ন কাজে বন্ধুলের মতামতই কার্যকারী হয়ে ওঠে। তারপর যা হয়, বন্ধুলের খ্যাতি ও প্রতাপ দেখে রাজদরবারের বাকি অমাত্যদের মধ্যে ষষ্ঠতম রিপুটি প্রবল হয়ে ওঠে। খেয়াল করে দেখবেন যে সংসারে নীচমনা প্রাণীরা নীচতর স্বার্থের খাতিরে সচরাচর চট করে একজোট হয়ে পড়ে, যথা হায়েনা বা শেয়াল। এখানেও রাজদরবারের হায়েনারা একজোট হয়ে প্রসেনজিৎকে বোঝালেন যে বন্ধুল যে রকম ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছেন, প্রসেনজিৎকে উৎখাত করে নিজে রাজ্যভার নিতে কতক্ষণ?
এই জন্যেই চাণক্য বলেছেন যে রাজার পক্ষে কানপাতলা হওয়াটা প্রায় ক্রিমিনাল অপরাধ। শুধু রাজা কেন, যে কোনও ক্ষমতাবান পুরুষের পক্ষে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, শুধুমাত্র শোনাকথার ওপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ক্ষমার অযোগ্য ভুল। প্রসেনজিৎ সেই ভুলই করলেন, তিনি লোকের কথা শুনে বন্ধুলকে সপরিবারে কচুকাটা করলেন।
পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে তিনি অনুতপ্ত হয়ে বন্ধুলের ভাগ্নে দীঘকারায়ণকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। কিন্তু রাজার ভুলটাই লোকে মনে রাখে, অনুতাপ মনে রাখে না। দীঘকারায়ণ মামার অত্যন্ত অনুগত ছিলেন, তিনি প্রসেনজিতের ওপর শোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। এবং সেই সুযোগ তাঁর সামনে মূর্তি ধরে এলেন প্রসেনজিতের পুত্র বিরূঢক বা বিড়ুঢ়ক বা বিরুধকের বেশে।
বাসবক্ষত্তার গর্ভে, প্রসেনজিৎের ঔরসে দুটি সন্তান জন্মায়, বজ্জিরা আর এই বিরুধক। বজ্জিরাকে, আগেই বলেছি, যুদ্ধে হেরে সন্ধির শর্ত হিসেবে অজাতশত্রুর সঙ্গে বিয়ে দেন প্রসেনজিৎ। আর এই বিরুধককে তিনি কপিলাবস্তু পাঠান শাস্ত্র আর শস্ত্রবিদ্যা শিখতে।
আর সেটাই হলো কাল!
যুদ্ধের কাড়ানাকাড়া
বিরুধকের তখন আট বা নয় বছর বয়েস, দিব্যি মামাবাড়িতে সমবয়সীদের সঙ্গে হেসেখেলে বড় হচ্ছেন। এমন সময়ে শোনা গেলো শাক্যসিংহ কপিলাবস্তুতে ফিরে আসছেন। বুদ্ধ হওয়ার পর এই তাঁর প্রথম মাতৃভূমি দর্শন, ফলে স্বভাবতই চারিদিকে সাজো সাজো রব। শাক্যবংশের ছেলে তখন সদ্ধর্মের আলোকে ভারতবাসীর প্রাণে দয়া ও করুণার জ্যোতি জ্বালিয়ে এক নতুন ধর্মের খোঁজ দিয়েছেন। তাঁকে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে বরণ করে নিতে হবে না? সেই জন্যে তৈরি হলো উঁচু উঁচু তোরণ, বাঁধা হলো মস্ত ম্যারাপ, আনা হলো মহার্ঘ সিংহাসন। চারিদিকে ছিটোনো হলো গন্ধবারি, সারা শহর রাঙানো হলো নতুন রঙে, ফুলে মালায়, হৃদয়ে শ্রদ্ধার অর্ঘ্যটি সাজিয়ে কপিলাবস্তু উজ্জ্বল মুখে প্রস্তুত হলো বংশের শ্রেষ্ঠতম সন্তানকে বরণ করে নেওয়ার জন্যে।
আর এর মধ্যেই ঘটে গেলো এক অঘটন! দুরন্ত বালক বিরুধক সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ধুলোমাখা পায়ে সেই অভ্যর্থনা মণ্ডপে উঠে সে কি মাতামাতি!
মণ্ডপসজ্জা ও রক্ষণাবেক্ষণ যাঁর দায়িত্বে ছিলো, সেই প্রবীণ গণমুখ্যটি তো রেগে কাঁই! তিনি এ ছোঁড়াকে বিলক্ষণ চেনেন, তাই বজ্রগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, "এই দাসীপুত্রটাকে এখানে ঢুকতে দিলো কোন অর্বাচীন? দেখো দেখো, নীচরক্তের ছেলেটা বুঝি সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো। ওরে কে কোথায় আছিস, দাসীপুত্রটাকে কান ধরে বের করে দে। যেখানে যেখানে এর অপবিত্র হাত বা পা পড়েছে, সেখানে নতুন রঙ লাগা, চারিদিকে গন্ধরস ছিটিয়ে দে..." ইত্যাদি প্রভৃতি।
হায় রে ধর্ম! যে মহাপুরুষের প্রধান লড়াই ছিলো জাতিনিয়মের নিগড়ে বাঁধা অচলায়তনটির বিরুদ্ধে, তাঁরই রাজঅভ্যর্থনার প্রস্তুতিপর্বে শুধুমাত্র দাসীপুত্র হওয়ার অপরাধে অবোধ বালকের কি অন্যায় হেনস্থা!
হাজার হোক রাজপুত্র বলে কথা, বিরুধকের সেই অহঙ্কার ছিলো পূর্ণমাত্রায়। তাছাড়া রাজ্য হিসেবে কোশল আয়তনে, মর্যাদায় ও সম্পত্তিতে শাক্যদের থেকে বহুগুণে বড় রাজ্য ছিলো। বড়লোকবাড়ির বাচ্চা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল এবং অহঙ্কারী মামাবাড়িতে বিনা কারণে বেহুদ্দ বেইজ্জত হলে তার রাগ হওয়াটাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।
তা ছেলে রাগে তো ফুঁসতে লাগলোই, কিন্তু তার মধ্যেও তার কানে লেগে রইলো ওই 'দাসীপুত্র' শব্দটি। বলি ব্যাপারটা কি? কোশলরাজ্যের উত্তরাধিকারীকে এই প্রগলভ শাক্যবৃদ্ধটি 'দাসীপুত্র' বলে অপমান করার সাহস পায় কোত্থেকে শুনি, হ্যার ঘাড়ে কয়ডা মাথা?
তা সে ছোকরা ছানবিন করে শেষাবধি তার মায়ের জন্মবৃত্তান্ত সবিস্তারে জানতে পারে, এবং খবরটা নিশ্চয়ই তার মনঃপূত হয়নি। সেযুগের এক বিখ্যাত রাজবংশের পক্ষে সেটা একটা কেলেঙ্কারিমার্কা শকিং নিউজ তো বটেই! এবং বালক বিরুধক তদ্দণ্ডেই এই প্রবঞ্চনা ও অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিজ্ঞা করে যে এই প্রতারক এবং জাতিগর্বে উদ্ধত শাক্যবংশ সমূলে ধ্বংস না করে সে ছাড়বে না, ছাড়বে না, ছাড়বে না!
এই বলে সে নিজের রাজ্যে ফিরে আসে।
এরপরের ঘটনা কোন খাতে ঘটে তার দুইটি ভাষ্য আছে। প্রথমটি হচ্ছে সত্য জানতে পেরে প্রসেনজিৎ ছেলে বিরুধক আর পট্টমহিষী বাসবক্ষত্তা, দুইজনকেই রাজপ্রাসাদ থেকে বার করে দেন। বিরুধক মা বাসবক্ষত্তাকে বুদ্ধের সংঘে ভিক্ষুণী হিসেবে রেখে বনে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে সে কোশলরাজ্য দখল করে এবং পিতৃদেবকে রাজ্যচ্যুত করে।
এই কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নয়, তার প্রমাণ আছে। একে তো গল্পটা দক্ষিণী সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতই অবাস্তব ও আষাঢ়ে। আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, ততদিনে বৌদ্ধবিহারে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো।
কবে থেকে বৌদ্ধবিহারে ভিক্ষুণীদের প্রবেশ শুরু হয়? তারও গল্প আছে, একটু পরেই বলছি। এও আমাদের কাহিনীর নায়ক মহানামের আরেকটি মহাপাপ।
আসল গল্পটা অন্য। কথিত আছে, বিরুধক যেদিন জন্ম নেন, সেইদিনই কোশলের রাজপুরোহিতের একটি ছেলে হয়। জন্মদাত্রীকে অশেষ কষ্ট দিয়ে প্রসবিত হয় বলে এই পুত্রের নাম রাখা হয় অম্বরীষ। অনুমান, এই কুবুদ্ধিপূর্ণ বালকটিও বিরুধকের সঙ্গেই কপিলাবস্তু যায়, এবং বিরুধকের জন্মবৃত্তান্ত অবগত হয়। বয়েসকালে এইই হয়ে ওঠে বিরুধকের প্রধান বয়স্য।
রাজা প্রসেনজিতের তখন বয়েস হয়েছে, রাজকার্যে আর মন নেই, বুদ্ধের উপাসনায় দিন কাটে তাঁর। এমনসময় তিনি খবর পেলেন যে মগধ ও কোশলের সীমান্তে এক উপবনে ভগবান তথাগত এসেছেন। তিনি লোকলশকরসহ, সেনাপ্রধান দীঘকারায়ণকে নিয়ে, মহিষী বাসবক্ষত্তাসহ বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
দীঘকারায়ণ এই সুযোগই খুঁজছিলেন বহুদিন থেকে। যুবক বিরুধক এবং তার প্রধান বয়স্য অম্বরীষের সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই ষড়যন্ত্র আঁট হয়ে ছিলো। বুদ্ধের উপাসনা শেষে, দেশনা শ্রবনান্তে প্রসেনজিৎ বাসবক্ষত্তাকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখেন কোথায় সেই বিশাল দেহরক্ষীর দল আর কোথায় সেনাপতি দীঘকারায়ণ? শুধুমাত্র একটি রথ আর একজনমাত্র অনুচর সাশ্রুলোচনে দাঁড়িয়ে!
দুঃসংবাদটা সেই অনুচরই দিলো। প্রসেনজিৎকে ত্যাগ করে সেনাপতি দীঘকারায়ণ গেছেন নতুন রাজা বিরুধককে রাজপদে অভিষিক্ত করতে। আর এও বলে গেছেন, প্রসেনজিৎ যদি কোশলরাজ্যে প্রবেশের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন, তবে যেন তিনি তাঁর পরম উপকারী প্রাক্তন সেনাপ্রধান বন্ধুলের পরিণতি স্মরণ করেন!
হাহাকার করতে করতে প্রসেনজিৎ, কোশলরাজ্যেন্দ্র প্রসেনজিৎ ছুটে যান মেয়ে বজ্জিরা, অর্থাৎ জামাতা অজাতশত্রুর কাছে। বোধহয় সেদিন তিনি অজাতশত্রুর সঙ্গে যাবতীয় শত্রুতা বিস্মৃত হয়েছিলেন। কিন্তু বিধির বিধান! যখন অনুচরটি রথ চালিয়ে রাজগৃহ পৌঁছলো, তখন নগরের প্রধান দরজা বন্ধ। মগধরাজ্যে রাজার কড়া আদেশ ছিলো, স্বয়ং ইন্দ্র বা বরুণ এলেও যেন রাত্রে নগরের প্রধান দরজা খোলা না হয়, গেম অফ থ্রোনসের ভাষায় "ডেসার্টারস উইল বি বিহেডেড"।
পরদিন সকালে যখন নগরীর দরজা খোলে, অজাতশত্রু জানতে পারেন যে প্রবলপরাক্রান্ত কোশলাধিপতি প্রসেনজিৎ, তাঁর প্রধানা রাণী বজ্জিরার বাবা প্রসেনজিৎ, পরম বুদ্ধানুরক্ত প্রসেনজিৎ বিদেশাগত সামান্য পথচারীর মতন নগরের সদর দরজার বাইরে একটি দরিদ্র পর্ণকুটিরে শ্রমে, উদ্বেগে, ক্লান্তিতে এবং হতাশায় প্রাণত্যাগ করেছেন!
রাজাই হোন বা সাধারণ নাগরিক, আপৎকালে লোক নিজের মাতৃরূপা মেয়েটির কাছেই শেষ আশ্রয়ের জন্যে বারবার ফিরে যেতে চায়!
প্রসেনজিতের পর বিরুধক মহাসমারোহে রাজা হলেন। মন্ত্রী হলেন প্রধান বয়স্য অম্বরীষ। এবং রাজা হয়েই বিরুধক বললেন, চমৎকার, ধ্বংস করা যাক শাক্যবংশ এবার!
যুদ্ধ শুরু হলো
যখন বিরুধক রাজা হন, তখন শুদ্ধোদন প্রয়াণ করেছেন । ফলে সর্বসম্মতিতে সেনাপতি মহানাম হয়েছেন শাক্যপ্রধান, যদিও তিনিও তখন প্রৌঢ়।
রাজা হয়েই মহানাম একটি ঘোর অন্যায় করলেন। পত্রপাঠ তিনি জ্যেঠিমা মহাপ্রজাবতী গোতমী, গোতমীকন্যা রূপানন্দা, বৌদি যশোধরা এবং ভাইপো রাহুল সহ আরও কয়েকজনকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন। এই হলো তাঁর দ্বিতীয় মহাপাতক! অথচ তার কিন্তু কোনও দরকার ছিলো না। মহানামকে সরিয়ে কিশোর রাহুল রাজা হবেন, এমন ইচ্ছে খুব সম্ভবত যশোধরার মনেও ছিলো না। কিন্তু নিয়তে কেন বাধ্যতেঃ, নিয়তিদেবী বোধহয় নিজেই উদ্যোগ নিয়ে মহানামকে দিয়ে এই অপ্রয়োজনীয় পাপ সিদ্ধান্তটি নেওয়ালেন।
নিরুপায় গৌতমী পায়ে হেঁটে আর সবাইকে নিয়ে বৈশালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বেশ কিছুকাল পর গোতমী এবং তাঁর সঙ্গিসাথীরা বৈশালীর কুক্কুটারামে এসে উপস্থিত হন, এবং বুদ্ধের কাছে আশ্রয়ভিক্ষা করেন।
এইখানেই বৌদ্ধসংঘের ইতিহাসে একটি গভীর পরিবর্তন ঘটে যার ফল ছিলো সুদূরপ্রসারী। এইখানে তা আলোচনা করার সুযোগ নেই, অন্য কোনওদিন পারলে বলবো। মোটমাট ঘটনা এই যে, বুদ্ধ প্রথমে কিছুতেই মহিলাদের সংঘে নিতে রাজি হননি। শেষে আনন্দের পীড়াপীড়িতে (হাজার হোক, এঁরা তো আনন্দেরও জ্যেঠিমা, বউদি, ভাইপো ইত্যাদি) রাজি হন। কিন্তু কথিত আছে এরপরে তিনি আক্ষেপোক্তি করে বলেন যে, "হে আনন্দ, যদি আমাদের ধর্মে নারীকে সন্ন্যাস দেওয়া অনুমোদন না করা হতো তাহলে এই ধর্ম এক হাজার বছর স্থায়ী হতো। কিন্তু যেহেতু এখন সংঘে নারীদেরও প্রবেশ ঘটলো, সেই কারণে এই সদ্ধর্ম মাত্র পাঁচশো বছর স্থায়ী হবে"!
(টীকাঃ নারীবাদীরা, বা নিরীশ্বরবাদীরা এই মন্তব্যটিকে ভগবান বুদ্ধের (এবং সেই সূত্র ধরে ততটা-দস্যুটাইপ-নয় এমন ধর্মপ্রচারকদেরও) নারীবিদ্বেষের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত করতে চান। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় উক্তিটি প্রক্ষিপ্ত, মানে পরে বুদ্ধের মুখে বসানো হয়েছে। এমনিতে বৌদ্ধধর্মের অভাবনীয় সব ভ্যারিয়েশন আছে (হীনযান, মহাযান, বজ্রযান, মন্ত্রযান, কালচক্রযান প্রভৃতি), সেসব লিখতে গেলে একটা নয়, খান দশেক মোটা বই লিখতে হয়। সেই সব নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভার অধিকারী বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা কোথায় কি লিখে থুয়ে গেছেন সে দিয়ে ভদ্রলোককে বিচার করাটা ঠিক নয়, এ তো ইসলাম নয় যে চোদ্দশ বছর আগে হজরত মুহম্মদের উক্তি বলে যা লেখা হয়েছে তাই আপনি মানতে বাধ্য, তার আর নড়চড় হয়নি। বুদ্ধের জন্মকাহিনীতেই মহাযানপন্থী বৌদ্ধপণ্ডিতদের যেসব স্থূল হস্তাবলেখ আছে যে সে আর কহতব্য নয়। ফলে এই উক্তিটিও প্রক্ষিপ্ত হতেই পারে। কারণ এছাড়া ভগবান তথাগতের মুখে আর কোনও নারীবিরোধী উক্তি শোনা যায়নি, বরং জাতিভেদ বিরোধের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের সমানাধিকারের জন্যেও অনেক মূল্যবান কথা তিনি বলে গেছেন। বৌদ্ধধর্মগ্রন্থে ভূরিভূরি নারীবিরোধী কথা আছে বটে, কিন্তু সেসব কে কিভাবে কি লিখেছে আর ইন্টারপ্রেট করেছে সে দায়িত্ব গৌতমবাবুর নয়।
তবে স্বীকার করতেই হবে অন্তত একবার একটি অমানবিক কাজ তিনি করেছিলেন। সে অবশ্য আমাদের মতো সংসারীদের মনে অমানবিক মনে হতে পারে, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের পক্ষে তা হয়তো নয়!
ভগবান বুদ্ধ যখন কপিলাবস্তুতে ফিরে আসেন, তাঁর জন্যে প্রস্তুত সমস্ত আয়োজন তিনি ঘুরেও দেখেননি। তিনি যখন 'ভিক্ষে করে ফিরতে ছিলেম গ্রামের পথে পথে', তখন একদিন কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে রাজপথে দেখতে পেয়ে যশোধরা ছেলে রাহুলকে ডেকে বলেন, "ওই দেখো তোমার বাবা, যাও, তাঁকে ঘরে ডেকে আনো"। কিশোর রাহুল তার বাবাকে ডেকে তো আনে, কিন্তু সেই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী নিজের বাড়ির মধ্যে কোথাও নাকি বসেননি। শুধু হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে দেখেছেন তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতিবিজড়িত সেই ভবনখানি। ইতিহাস আমাদের জানায়নি সেইদিন নিজের ছোটবেলার কথা মনে করে করুণাঘন তথাগতের চোখের দুই কোণ ভিজে উঠেছিলো কিনা। শুধু এটুকু জানি যে যখন তিনি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, স্বামীসোহাগহীনা অভিমানিনী যশোধরা, দুঃখিনী যশোধরা অবুঝ মেয়ের মতন নিজের স্বামীকে ঘরে ধরে রাখার শেষ চেষ্টা হিসেবে দরজার সামনে নতজানু হয়ে নিজের মাথার চুল বিছিয়ে দিয়েছিলেন।
আর প্রেম ও করুণার সাগর বুদ্ধদেব, যিনি কিনা সর্বজীবের দুঃখতারণে ব্রতী হয়েছেন, তিনি সন্ন্যাসীসুলভ নিঃস্পৃহতার সঙ্গে সেই দেবপূজ্য কেশরাশি পায়ে মাড়িয়ে বেরিয়ে আসেন।
বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা!
বিরুধক যখন শাক্যবংশ ধ্বংস করার জন্যে সৈন্যসামন্ত জড়ো করছেন, তখন ভগবান বুদ্ধ যোগবলে সবই জানতে পারেন। বুঝতেই পারছেন যে 'যোগবলে' শব্দটা আলঙ্কারিক। রাজা লোক নিচ্ছেন সৈন্যবাহিনীতে, রোজ কুচকাওয়াজ হচ্ছে, রাজপ্রাসাদ থেকে বিভিন্ন নিম্নশ্রেণীর রাজকর্মচারী মারফৎ নানা মুখরোচক খবর বাইরে এসে কালিপটকার মতন ফেটে পড়ছে, এসব বাজারের ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা অবধি জানেন আর ভগবান বুদ্ধের অনুগত বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজনেরা এসব খবর তাঁকে দিয়ে যায়নি, সে হতে পারে না।
বুদ্ধের প্রধান ভিক্ষুদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন শাক্য, যেমন মৌদ্যগোলায়ণ বা মোগগোলায়ণ। তাঁরা এই খবর শোনামাত্র বিচলিত হলেন, এবং যথারীতি এসে গৌতম বুদ্ধের শরণাগত হলেন, "প্রভু, শাক্যবংশ রক্ষা করুন"।
ভগবান বুদ্ধ প্রথমে রাজি হননি, তিনি কর্মফলে ঘোর বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে শাক্যদের নিজেদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিজেদেরই করতে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু শাক্যবংশীয় ভিক্ষুদের পীড়াপীড়িতে তাঁকেও নড়েচড়ে বসতে হলো।
বিরুধক যখন সৈন্যসামন্ত নিয়ে মাঝরাস্তা অবধি এসেছেন, তখন দেখেন যে একটি ন্যাড়া, মৃত গাছের নীচে তথাগত বসে। তখন তথাগত দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ, তাঁকে উপেক্ষে করে যাওয়া যায় না। বিরুধক রথ থেকে নেমে এসে কৃতাঞ্জলিপুটে জিজ্ঞেস করলেন, ভগবন্, আপনি বোধিদ্রুম ছেড়ে এই মৃত শুষ্ক গাছের নীচে কেন?
ভগবান বুদ্ধ নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, পৃথিবী থেকে যখন দয়া আর করুণা অন্তর্ধান করেছে, তখন তাঁর জন্যে বোধিবৃক্ষই বা কি, আর এই মৃতবৃক্ষই বা কি!
সেযুগে যুদ্ধের কিছু রীতিনীতি ছিলো, রাজারাজড়ারা মানতেন টানতেন। তার একটি নিয়ম ছিলো যে রাস্তায় কোনও সাধুপুরুষ বা মহাপুরুষ দেখলে বহর ফিরে যেত। বিরুধকও ফিরে গেলেন।
এর পর মাসখানেক বাদে ফের সসৈন্যে যাত্রা করেছেন, আবার মাঝপথে একই দৃশ্য। একই কথোপকথন, এবং একই উত্তর। বিরুধক ফের ফিরে এলেন।
এবং এই ঘটনা আরও একবার ঘটলো। পরপর তিনবার ভগবান বুদ্ধ বিরুধককে ফিরিয়ে দিলেন।
চতুর্থবার আর দিলেন না!
ফের শাক্যবংশীয় শিষ্যরা এসে কেঁদে পড়লেন, অলৌকিক শক্তির প্রভাবে বিরুধকের সৈন্যদের দূরে কোথাও রেখে দিয়ে আসতে বললেন। কিন্তু তথাগত বুদ্ধ নিজ সঙ্কল্পে অটল, তাঁর একটিই কথা, শাক্যবংশকে তার কর্মফল ভোগ করতেই হবে।
শেষে মোগগলায়ণের আর সহ্য হলো না। তিনি নিজেই চললেন শাক্যবংশের উদ্ধারে। কথিত আছে যে তিনি অদৃশ্য হয়ে কপিলাবস্তুতে উড়ে যান এবং নিজের ভিক্ষাপাত্রের মধ্যে পাঁচশো শাক্যকে মন্ত্রবলে লুকিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। কিন্তু যে মুহূর্তে নাকি তিনি কপিলাবস্তুর বাইরে এসে মাটিতে নামেন, সেই মুহূর্তেই দেখেন যে ভিক্ষাপাত্রের মধ্যে শুধু রক্ত!
ভগবান বুদ্ধ এরপর তাঁকে কর্মফলের অলংঘনীয়তা নিয়ে উপদেশ দেন, এবং চিত্তে শান্তিবিধান করেন। জানি না প্রৌঢ়টি তাঁর স্বজাতির সমূহ ধ্বংস আসন্ন জেনে কিরকমের শান্তি পেয়েছিলেন। মানুষ সাধনমার্গের কোন পর্যায়ে উঠলে অসংখ্য মানুষের হাহাকার আর্তনাদকে শুধুমাত্র কর্মফলের দোহাই দিয়ে নির্বিকারচিত্তে মেনে নিতে পারে!
কত হাজার মরলে পরে মানবে তুমি শেষে/ বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে!
সংগ্রাম ও বীরত্বের কাহিনী
যুদ্ধের প্রথম দিনেই কোশলসেনারা একটা জিনিস বুঝে গেছিলো যে শাক্যদের তূল্য ধনুর্ধর আর যোদ্ধা তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। কিন্তু তা সত্বেও তারাই এ যুদ্ধে জিতবে।
তার কারণ আছে!
শাক্যরা ততদিনে বুদ্ধের শরণ নিয়েছে, প্রাণীহিংসা তাদের পক্ষে নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা বীরের বংশ, বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্রমেদিনী তো দূরস্থান, সূচটিও তারা ছেড়ে দেবার পক্ষপাতী নয়। তারাও কোশলদের যুদ্ধের শখ মিটিয়ে দিতে পুরোদমে প্রস্তুত। কিন্তু তার উপায়?
শাক্যসৈন্যদের মধ্যে আদেশ বলবৎ হলো শত্রুবধ করা চলবে না, এমনভাবে তীর চালনা করতে হবে যেন কোশলসেনাদের কুণ্ডলসহ কান দুটি খসে পড়ে!
শুধু কি কান? শাক্যদের যেমন দ্রুত অশ্বচালনা, তেমন অব্যর্থ শরসন্ধান! নিখুঁত লক্ষ্যে তীর গিয়ে কোশলসেনার তূণীরের বন্ধন কেটে দিচ্ছে, ধনুকের ছিলা কেটে দিচ্ছে, কেটে দিচ্ছে সারথির হাতে ধরা ঘোড়ার বল্গা। তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলে তারা ঢাল দিয়ে আটকাচ্ছে বটে, কিন্তু ফিরে আক্রমণ করে প্রাণে মারছে না, শুধু কান কেটে নিচ্ছে!
ফলে আর কি, মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র শাক্যসেনাদের কয়েকটি মৃতদেহ এবং কোসালানদের কাটা রক্তাক্ত কানে ভর্তি। শীতের শেষে যেমন ঝরাপাতায় মাঠঘাট ছেয়ে থাকে, মনে হলো তেমনই যেন রক্তবর্ণ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্র। শুধু যদি উৎসাহী কেউ কাছে গিয়ে দেখতো, তবে বুঝতে পারতো যে ফুল নয়, ওগুলো কোশলসেনার কাটা কান!
আর তারই সঙ্গে হাসিমুখে মৃত্যুর কোলে শুয়ে অকুতোভয় শাক্যসেনা!
"হাজারে হাজারে বুদ্ধের জ্ঞাতি
চলেছে মরণ ভেটে,
হাস্যবদনে মরিছে শাক্য
মৃত্যুর কান কেটে।"
('মহানামন্', সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রবাসী, পৌষ ১৩২৩)
সেদিন যুদ্ধের শেষে নিজের কানকাটা পল্টন দেখে বিরুধকের মনের অবস্থা কিরকম হয়ে ছিলো বলা মুশকিল, তবে খুশি যে হননি, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়!
পরেরদিনও এইরকম প্রবলযুদ্ধ চলছিলো বটে, কানহীন কোশলসৈন্যে আর প্রাণবান শাক্যযোদ্ধাদের মধ্যে অদ্ভুতুড়ে লড়াই, তবে তার মধ্যেই এক আজব কাণ্ড ঘটে গেলো।
শম্পক নামে এক শাক্যবীর বোধহয় মাসখানেক হিমালয়ের একটু ভেতর দিকে গেছিলেন কোনও কাজে, তিনি এসব হ্যাঙ্গামের কিছুই জানেন না। ফেরার পথে শোনেন এই কাণ্ড! তিনি ক্ষত্রিয়, সশস্ত্র হয়েই গেছিলেন, ব্যাপারস্যাপার দেখে রাগে গা'টা রি রি করে উঠলো। তিনি আর কপিলাবস্তু ফিরলেন না, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে এক্কেবারে হা রে রে রে করে একেবারে খড়্গ ঢাল নিয়ে কোশলসেনার মধ্যে গিয়ে পড়লেন। আরে নেমেই মার মার কাট কাট করে মুণ্ডু ওড়ানো শুরু করে দিলেন।
কিন্তু যেহেতু তিনি কপিলাবস্তু ফেরেননি, তাই শাক্যসেনাদের মধ্যে জারি হওয়া প্রাণহরণের বদলে কানহরণের কানুনটি স্বাভাবিক ভাবেই জেনে উঠতে পারেননি। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম দেশরক্ষা ও শত্রুসংহার, ফলে তিনিও বীরের ধর্ম অনুযায়ী দুটি কানের বদলে কর্ণধারীর মুণ্ডুটি নামানোই শ্রেয় মনে করলেন, তাতে সময় ও পরিশ্রম দুটোই বাঁচে!
আগেই বলেছি, শাক্যরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধৃজাতি ছিলেন, শম্পক সেই কথাটাই হাড়ে হাড়ে শত্রুদের সমঝে দিতে লাগলেন। এবং এই প্রথম শ্রাবস্তীরাজ অনুভব করলেন যে যদি এই একটি মানুষের সংহারমূর্তি দেখেই তাঁর সৈন্যদলের মধ্যে ত্রাহিমাম রব ওঠে তাহলে শাক্যরা সবাই মিলে যদি ভুলেও কোশলসেনার কানের বদলে গলার দিকে মনোযোগ দেয়, তাহলে নিজের দুটি ঘোড়া ছাড়া বোধহয় আর কোনও প্রাণী নিয়ে উনি রাজধানীতে ফিরে যেতে পারবেন না। এবং সেক্ষেত্রেও বোধহয় সাধের কানদুখানি এখানে সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবেই জমা রেখে যেতে হবে!
সেদিন প্রবল যুদ্ধের শেষে ভগ্নমনোরথ কানকাটা সেপাইয়ের দল তো কোশলশিবিরে ফিরে গেলো। আমাদের ওয়র হিরো শম্পক অভ্যর্থনা পাবেন ভেবে গর্বিত একটি হাসি মুখে ঝুলিয়ে নিজেরশহরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন, দরজা বন্ধ! বলা বাহুল্য, প্রথমে ভেবেছেন বোধহয় ভুল করেই এরা দরজা বন্ধ করে ফেলেছে। যা হোক, তারপর তো খুব হাঁকডাক করে প্রহরীদের ডেকে এসবের কারণ কি জানতে চেয়ে শুনলেন যে, যেহেতু তিনি শাক্যদের ঘোষিত নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রাণহন্তারক হয়েছেন, তাই তিনি শাক্যবংশ থেকে নির্বাসিত! কপিলাবস্তুতে তাঁর প্রবেশ নিষেধ!
সেইদিন মহাবীর শম্পক ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে, হতাশায় আর রাগে নিজের জাতিকে কি অভিসম্পাত দিয়েছিলেন সে আজ আর জানার উপায় নেই। শুধু এটুকু জানা যায় তিনি দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে ভগবান বুদ্ধের চরণবন্দনা করে যান, এবং আশির্বাদ হিসেবে তথাগত নিজের ক'গাছি চুল আর উপরের পাটির একটি দাঁত উপড়ে দান করেন। সেই নিয়ে শম্পকবাবু বহুদূরে নিজের শহর প্রতিষ্ঠা করেন!
(টীকাঃ যুদ্ধের সঙ্গে ধর্মকে জড়িয়ে, মিসপ্লেসড আইডিয়া অফ হোলি ওয়র-এর জন্যে, যুদ্ধের মধ্যেও আভিজাত্য ও ঔদার্যের ছোঁওয়া আনার নামে অনেক নির্বোধ জাতিই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এদেশের প্রাচীন হিন্দু রাজারা তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ওরে, ধর্মযুদ্ধ বলে কিছু হয়না, যুদ্ধের মধ্যে শুধু মারকাট, রক্তারক্তি আর হানাহানি আছে, ধর্ম বলে কিচ্ছুটি নেই! যদি যুদ্ধ করবি তোযাবতীয় নখ দাঁত বার করে, সমস্ত আগ্রাসন, হিংস্রতা, রক্তলোলুপতা, শঠতা আর নীচতা দিয়েই যুদ্ধ করিস বাপ। যুদ্ধবাজ হলে অ্যাটিলা আর চেঙ্গিজ খাঁকে আদর্শ করিস, ভগবান বুদ্ধ বা শ্রীচৈতন্যকে না। আর নিজের দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে তো স্বয়ং শয়তানের সঙ্গেও হাত মেলানো যায়! ধর্মযুদ্ধ নামক এই ন্যাকামি দিয়ে মহম্মদ ঘোরীকেও আটকানো যায়নি, রবার্ট ক্লাইভকেও না!)
এরপর বেশ কয়েকদিন যুদ্ধ বন্ধ থাকে। রোহিণী নদীর একদিকে কোশলসেনা থানা গেড়ে বসে আছে, আর আরেকপক্ষে দুর্গের ভিতর শাক্যসিংহরা, দুপক্ষেই চাপা উদ্বেগ, আগে কে চাল দেয়। কপিলাবস্তু দুর্ভেদ্য পাহাড়ী দুর্গ, তাকে চট করে জয় করা শুধু মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়। আবার দুপক্ষেরই রসদ ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। তবে আক্রমণকারীদের থেকে আক্রান্তদেশরক্ষকদের নৈতিক জোর কিঞ্চিৎ উন্নত থাকে, থার্মোপাইলির যুদ্ধ (যা নিয়ে 300 নামের চমৎকার সিনেমাটি তৈরি) তার প্রমাণ। ৩০০ নির্ভীক স্পার্টান যোদ্ধা আর শ'দুয়েক মতন গ্রীসের অন্যান্য শহরের বাসিন্দারা দশলাখের ওপর সুশিক্ষিত পারস্য সৈন্যকে সাতদিন এক সরু গিরিখাতের সামনে অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে আটকে রেখেছিলো, নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার খাতিরে। ফলে এদিকে দাঁতে দাঁত চিপে অপেক্ষা করা, বউবাচ্চার ভয়, কান্না আর খিদের জ্বালা সহ্য করা শাক্যযোদ্ধারা, আর ওদিকে দুকানকাটা ভয়ভীত শ্রাবস্তী সৈন্যরা, লড়াইটা দাঁড়ালো কে আগে চোখের পলক ফেলে!
আগে পলক ফেললো বিরুধকের সৈন্যরাই!
ধীরেধীরে কোশলসৈন্যদের মধ্যে বিরূপভাব বাড়তে বাড়তে প্রায় বিদ্রোহের রূপ নিতে লাগলো। সেযুগে সাধারণ প্রশিক্ষিত সৈন্য ব্যতিরেকে অতিরিক্ত সৈন্য দরকার হলে কৃষকদের মধ্যে থেকেই সৈন্য নেওয়া হতো। তারা এসেছিলোই চট করে কপিলাবস্তু লুটে চাট্টি পয়সাকড়ি ট্যাঁকে গুঁজে বাড়ি ফিরবে বলে। এসে দেখে সে আশায় শুধু বালি নয়, শাক্যরা পুরো উত্তরপাড়া থেকে চন্দননগর ঢেলে দিয়েছে, ফলে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে কতক্ষণ! তার ওপর ভাঁড়ারে ধান নেই, যুদ্ধে মান নেই, এমনকি বডিতেও কান নেই!
ক্ষোভ জমা হতে হতে যখন কোশলশিবির যখন প্রায় জালিওয়ানওয়ালাবাগ, তখনই উত্তরীয়বস্ত্রে কানমাথা চেপে কোশলসেনামুখ্যরা এসে বিরুধককে সবিনয়পূর্বক জানালেন যে এইবার এসপার বা ওসপার করে না ফেললে সৈন্যদের ধরে রাখা মুশকিল হবে, খুবই মুশকিল!
এই আলোচনা নিয়ে যখন কোশলশিবিরের মন্ত্রণালয় উত্তাল, তখনই শেষ চাল চাললেন বিরুধকের মন্ত্রী, কূটকৌশলসিদ্ধ মন্ত্রী অম্বরীষ! তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন যে, যে যুদ্ধ সরাসরি জেতা অসম্ভব, তা জিততে কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া শাস্ত্রসম্মত! আর তিনি এবার সেই কৌশলই প্রকাশ করবেন।
এরপর যে প্ল্যান ছকা হয়, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে তার তুলনা নেই, কোথায় লাগে ট্রোজান হর্স!
রক্তস্রোত ও প্রায়শ্চিত্ত
শাক্যগণমুখ্যদের কাছে যখন সন্ধির বার্তা নিয়ে কোশলদূত এল, তখন উদ্বিগ্ন শাক্যরা নিজেদের ভাগ্য বিশ্বাসই করতে পারেনি! দূতে এসে সেলাম টেলাম ঠুকে ভারী বিনীতভাবে বিরুধকের চিঠিখানি এগিয়ে দিলো।
তাতে বিরুধক জানিয়েছেন যে নেহাতই ভুল করে নিজের মামাবাড়ি আক্রমণ করে ফেলেছেন। এ ভুল উনি আর করবেন না, নিজের ভুল উনি উপলব্ধি করেছেন, এবং সে জন্যে কোশল নৃপতি বিরুধক যারপরনাই লজ্জিত। ফলে উনি সৈন্য নিয়ে ফিরেই যাচ্ছেন, শুধু যাওয়ার আগে যদি একবার ভগবান তথাগতের পুণ্যজন্মভূমি, নিজের শৈশবের ক্রীড়াক্ষেত্র কপিলাবস্তু নগরটি একবার স্বচক্ষে দেখে, তার ধুলোবালি নিজের কপালে লেপে যেতে পারতেন তো আর কোনও দুঃখ থাকতো না! অতএব সেই শখ পূরণ করার জন্যে যেন একবার অন্তত কপিলাবস্তুর দুর্গের দরজা খুলে দেওয়া হয়! অতি সকরুণ নিবেদন, চিঠির পাতায় পাতায় নির্বিষ আর্তি ফুটে ফুটে উঠেছে বললেই চলে!
সেই নিয়ে গণমুখ্যদের মধ্যে একটা বিপ্লবই হয়ে গেলো প্রায়! একদল এতদিনের এইসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশার আলো দেখামাত্র এই প্রস্তাবে সায় দিতে রাজি। আরেকদল স্বভাবতই সন্দিগ্ধ লোকজন, তারা এর মধ্যে কোনও লুকোনো চাতুরি খুঁজে পেয়ে সটান না বলে দিলেন। এখন কপিলাবস্তু একটি গণরাজ্য, ট্রাম্পের আমেরিকা বা খোমেইনির ইসলামিক রিপাব্লিক নয়। শাসকরা কয়েকটি সভ্য সমাজোপযুক্ত নিয়মাদি মেনে চলতেন। প্রবল কথা কাটাকাটি, তর্কবিতর্কের মধ্যে স্থির হলো ভোট নেওয়া হবে।
কি করে? না গুটি চালনা করে।
মহাযান মতে, এইসময়ে মার, যিনি নাকি সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্বপ্রাপ্তির সময় নানাভাবে তাঁকে উত্যক্ত করেন ও পরাজিত হন, (জয়মঙ্গলের অটঠগাথায় আর অবনঠাকুরের নালকে যে গল্প অমর হয়ে আছে) সেই মার এসে সিদ্ধার্থের হাতে পরাজিত হওয়ার শোধ নিতে, শাক্যবংশ ধ্বংস করার জন্যে দুর্গের দরজা খোলার পক্ষে অদৃশ্যভাবে একটি এক্সট্রা গুটি চেলে দেন।
ফলে গণমুখ্যদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কপিলাবস্তুর দুর্গের সদরদরজা খুলে দেওয়া হলো, যাতে করে সেই কোশলসম্রাট বিরুধক তাঁর শৈশবের মামাবাড়ি, মানে শাক্যরাজধানীটি দেখে যেতে পারেন!
এর পরের দৃশ্য বর্ণনার জন্যে আপনার শক্ত কল্পনাশক্তি চাই হে পাঠক! ধরুন আপনি কোনও শাক্যযুবা। গণমুখ্যদের আদেশ অনুযায়ী আপনি ও আপনার সুন্দরী অর্ধাঙ্গিনী বরণডালা হাতে কপিলাবস্তু নগরের দরজার ভেতরে সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত। এমন সময়ে সম্রাট বিরুধক সসৈন্যে প্রবেশ করে নিজেদের সেনাপ্রধানদের চোখ টিপে বললেন, "ঢুকে পড়েছি, চ্যল বে, লুটে নে"! আপনি দেখলেন কোশলশান্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী সেনারা আপনার পেটে একটা তলোয়ার গুঁজে, আপনারই বউয়ের হাত ধরে সোল্লাসে বললো, "উফফ, রসালো মাল মাইরি, চল বে, আজ এটাকেই খাই!"
কপিলাবস্তুতে সেদিন ঠিক তাইই হয়েছিলো। উন্মত্ত, হিংস্র, দুকানকাটা নির্লজ্জ কোশলসেনারা বোধহয় তাদের কাটা কানের হিসেব নিতে রক্তলোলুপ ক্ষুধার্ত হায়েনার মতন কপিলাবস্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। এহেন কাপুরুষিক আক্রমণের আশঙ্কা শাক্যদের মাথাতেও ছিলো না। ফলে তারা পড়লো মহা ধর্মসঙ্কটে, মেয়েবউয়ের ইজ্জত আর সন্তানদের প্রাণ বাঁচাবে না শত্রুদের কান কাটবে? তাদের পক্ষে তো শত্রুদের হত্যা করাও নিষেধ! ফলে শাক্যরা পালাতে লাগলো, পালাতে লাগলো খাণ্ডবদাহনের সময়কার উদভ্রান্ত ভীত জন্তুদের মতন। দুর্বৃত্ত কোশলসেনা, যারা সামনাসামনি লড়াইয়ে শাক্যসৈন্যদের হাতে কানকাটা হয়ে মরমে মরে ছিলো, তারা এখন প্রতিশোধ নেওয়ার পৈশাচিক উন্মাদনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কপিলাবস্তুর লুটতরাজে আর শাক্যনারী ধর্ষণে মেতে উঠলো। বাদ গেলো না শিশু ও বৃদ্ধরাও, তাদের কেটে কেটে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হতে লাগলো। রাজপরিবারেরই হোক বা সাধারণ পরিবারের, নারীদের ওপর নেমে এল যেন সাতচল্লিশের অন্ধকার নোয়াখালি!
চারিদিকে নরকের হাহাকার, অর্ধেক কপিলাবস্তু তখন জ্বলছে। মৃত্যু নগ্ন উল্লাসে চারিদিকে নেচে বেড়াচ্ছে উন্মত্ত শয়তানের মতন। তার দুহাতে দুই তরবারি, হিংসা আর প্রতিশোধ, চারিদিকের আগুনের লেলিহান শিখায় ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে তার হিংস্র নারকীয় চোখদুটি। ধর্ষিতা শাক্যনারীর আর্তনাদে, মৃত্যুভয়ে ভীত শিশু ও বৃদ্ধদের কান্নায়, পলায়নপর শাক্যপুরুষদের অসহায়তার আর্তিতে তখন কপিলাবস্তুর আকাশ ভারী! এমন সময় দেখা গেলো এক বৃদ্ধ গুটিগুটি পায়ে বিরুধকের সেনাশিবিরের দিকে চলেছেন!
বিরুধক আর অম্বরীষ, পাপের দুই মূর্তিমান যমজ সন্তান তখন বোধহয় শেষ অবধি শাক্যবংশ ধ্বংস শুরু করতে পেরে অশ্লীল ও বিকৃত আনন্দে উদ্বেল! তাঁরা প্রথমে খেয়ালই করেননি ইনি কে। বৃদ্ধ করজোড়ে প্রণত হয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর জানা গেলো ইনি শাক্যসংশের গণমুখ্য, হতভাগ্য মহানাম।
ক্ষমতার মদে অন্ধ বিরুধক চোখ লাল করে জিজ্ঞেস করলেন, "এই বুড়ো, কি চাই তোর? আরও মৃত্যু আর ধ্বংস দেখার জন্যে বেঁচে আছিস? এই মুহূর্তে দূর হয়ে যা চোখের সামনে থেকে, যদি বাঁচতে চাস। নইলে তোকে উলঙ্গ করে কেটে এই পাপ নগরীর রাজপথে ফেলে রাখবো, সেটাই কি চাস তুই?"
বৃদ্ধ করজোড়ে চোখের জলে বুক ভিজিয়ে বললেন, "হে রাজন, আপনি মহান কোশলরাজ্যের মহাপ্ররাক্রান্ত নৃপবর। আমি সামান্য শাক্য গণমুখ্যমাত্র। তবুও হে রাজন, আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে আপনার গর্ভধারিণী আমার নিজের কন্যা, সম্পর্কে আপনি আমার পৌত্র। এই শাক্যদেশ আপনার নিজের মাতুলগৃহ, এই নগরের পথে পথে খেলাধুলো করে আপনি বড় হয়েছেন, আপনার অস্ত্রশিক্ষা, শস্ত্রশিক্ষা, শাস্ত্রশিক্ষা, সবই শাক্যশিক্ষকদের কাছে। রাজন, সবিনয়ে নিবেদন করি শাক্যগণমুখ্য মহানাম আপনার চরণসকাশে উপস্থিত। দয়া করে আমার মুণ্ডচ্ছেদ করুন, আমার দেহ সর্বসমক্ষে খণ্ডখণ্ড করে রাজপথে ফেলে রাখুন। কিন্তু হে প্রসেনজিৎপুত্র বিরুধক, কপিলাবস্তু ধ্বংস করার মতন, শতসহস্র নিরপরাধকে হত্যা করার মতন, অগণিত হতভাগ্য শাক্যনারীর সতীত্বহরণের মতন পাপকার্য থেকে বিরত হতে আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই"।
বিরুধক আরও একপাত্র উৎকৃষ্ট আসব গলায় ঢেলে বললেন, "বুড়োর মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি, অ্যাঁ! এখন তো বিনয়ে গদগদ, বলি আমার বাবাকে প্রতারণা করার সময় এসব মনে ছিলো না? আমাকে দাসীপুত্র বলে অপমান করার সময় মনে ছিলো না কিছু? নাকি পাপ কোনওদিন শাক্যসিংহের বংশকে ছুঁতে পারবে বলে বিশ্বাসই করিসনি তোরা? শোন বুড়ো, তোর ওই মিষ্টি স্তোকবাক্যে ভুলবার লোক এই বিরুধক নয়। রক্তের সম্পর্কের কথাই যখন তুললি তখন শুনে নে, তোর আর তোর পরিবারের প্রাণ ভিক্ষা হিসেবে উপহার দিলাম। এইদণ্ডে দৌড়ে যা, যা পারিস সংগ্রহ করে, তোর পরিবারের লোকজনদের নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যা এখান থেকে। কপিলাবস্তুর রাস্তা শাক্যরক্তে না ধুইয়ে আজ আমি ছাড়বো না।"
খানিক্ষণের নৈশব্দের পর যখন বৃদ্ধ মহানাম চোখ তুললেন, তখন তাঁর চোখে এক পাগলাটে উজ্জ্বল আলো। ঘোলাটে চোখে সেই উজ্জ্বল আলো জ্বেলে বৃদ্ধ সবিনয়ে নিবেদন করলেন, "হে রাজন, রক্তের সম্পর্কের খাতিরে যখন একটি অনুগ্রহ এই অধমকে দিতেই চেয়েছেন, তখন অধমকেই সেই অনুগ্রহটি বেছে নিতে দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করি।"
ঠোঁটের প্রান্ত ঈষৎ বাঁকিয়ে বিরুধক বললেন "আচ্ছা বল, কি চাস তুই।"
তখন সেই অশীতিপর বৃদ্ধ বিরুধকের চোখে চোখ রেখে তাঁর ডানহাত তুলে নগরের বাইরে, কপিলাবস্তুর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রোহিণী নদীর দিকে নির্দেশ করে অকম্পিত স্বরে বললেন "তাহলে রাজন, আমি এইক্ষণে ওই নদীতে স্নান করতে চললাম। অনুমতি করুন, যতক্ষণ আমি দমবন্ধ করে ওই নদীতে ডুবে থাকতে পারবো, ততক্ষণ যেন আপনার সৈন্য কপিলাবস্তু ধ্বংস থেকে বিরত থাকে। ততক্ষণই যেন কপিলাবস্তুর নাগরিকদের ইচ্ছে মতন পালাতে দেওয়া হয়। স্থানটি যত্ন করে লক্ষ্য করবেন হে রাজন, একটি মৃত শালগাছ সেখানে জলের মধ্যে অর্ধেক প্রোথিত হয়ে আছে।"
শুনে তো বিরুধক এবং অম্বরীষ হো হো করে হেসেই ফেললেন। এই বৃদ্ধ, যিনি চিতায় ওঠার জন্যে ডান পা এগিয়েই রেখেছেন, তিনি নাকি তাঁর জলের নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখার ক্ষমতা দেখিয়ে শাক্যপুরী ধ্বংসে সাময়িক বিরতি আনবেন! হবেও বা, মহানাম ছিলেন দুর্ধর্ষ সমরনায়ক, শাক্যপ্রধান শুদ্ধোদনের সেনাপতি ছিলেন তিনি। ফলে সেই প্রবীণ সেনানীর বুড়ো হাড়ে কিছু প্রাচীন ভেলকি লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে, তাতে যদি কয়েকটি হতমান শাক্যপ্রাণ বাঁচে তো তাইই সই! বিরুধক বিকৃত উল্লাসের সঙ্গে বললেন, "তথাস্তু!"
মহানাম যে মুহূর্তে বুদ্ধনাম স্মরণ করে রোহিণীর বরফঠাণ্ডা জলে ঝাঁপ দিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে কোশলসেনা তাদের মহারাজের আদেশানুসারে রক্তাক্ত জিঘাংসা আর বিকৃত কামনার প্রজ্জ্বলিত আগুন নিজেদের কৃষ্ণতামস হৃদয়ে সাময়িকভাবে রুদ্ধ রেখে দাঁতে দাঁত ঘষে পরবর্তী আদেশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। এই খবর ততক্ষণে সমগ্র কপিলাবস্তুতে ছড়িয়ে গেছে। শাক্যরা আর মালের পরোয়া করলো না, জান আর ইজ্জত নিয়ে যে যেদিকে পারলো উদভ্রান্তের মতন পালাতে লাগলো।
এদিকে মহার্ঘ পৈষ্ঠী গলায় ঢেলে বিরুধক পায়চারি করতে লাগলেন। অস্থায়ী তাঁবুর সামনে প্রহরী খাড়া, দণ্ডে দণ্ডে সে খবর জানাচ্ছে মহানাম জলের উপর উঠে এলেন কি না, আর কপিলাবস্তু কতটা খালি হলো। এই করে করে যখন দেখা গেলো কপিলাবস্তু প্রায় খালি হয়ে এসেছে, কিন্তু তখনও সেই বৃদ্ধের নদী থেকে ওঠার নাম অবধি নেই, তখন ক্রুদ্ধ বিরুধক আদেশ করলেন গিয়ে দেখতে, ব্যাপারটা কি!
এইখানে, হে পাঠক, বাকিটা লিখতেও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। অস্ত্রহাতে শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়াটা দেশপ্রেম বলে জানি। কিন্তু সবদিক থেকে পরাজিত একজন হতাশ্বাস মানুষ যখন স্বজাতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হয়ে সর্বোত্তম আত্মবিসর্জনটি দেন, তখন তার তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার হয়। তখন আত্মোৎসর্গের সঙ্গে মেশে ভক্তি, ভক্তির সঙ্গে মেশে নিবেদনের আর্তি। সেই দান মহাপুণ্যদান, দেশমাতৃকাও বুঝি শতাব্দী ধরে বসে থাকেন এমন একটি নিবেদনের জন্যে, যখন তাঁর সন্তানের রক্তনিবেদন তাঁর কপালে পরিয়ে দেয় একটি চন্দনচর্চিত গৌরবটীকা!
বিরুধকের দূত ফিরে এসে ভগ্নহৃদয়ে জানালো যে মহানাম আর বেঁচে নেই। নিজের পাপস্খালন করতেই হয়তো মহাপ্রাণ মহানাম নিজের গলায় একটা পাথর বেঁধে রোহিণীর জলে ডুব দিয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য নিজের একটা পা রশি দিয়ে সেই জলের মধ্যে অর্ধেক প্রোথিত মৃত শালগাছটির সঙ্গে বেঁধে রাখতে ভোলেননি, শুধুমাত্র এই বোঝাতে যে তিনি পালিয়ে যাননি, বিরুধকের সম্মতিক্রমে সম্পাদিত চুক্তিটির একটি যৌক্তিক ছিদ্রের সুবিধা নিয়ে নিজ জাতির প্রাণরক্ষা করেছেন মাত্র!
দেশবিদেশের শতশত বীরোত্তমের আত্মত্যাগের ইতিহাস আমরা জানি। তবুও তারই মধ্যে দোষেগুণে মানুষ এই বৃদ্ধটির আত্মোৎসর্গের কাহিনীটি কোথায় যেন আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। একফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ে এই সাহসী বৃদ্ধটির জন্যে, তাঁর নাম মহানাম।
না, মহাপ্রাণ মহানাম, বীরকেশরী মহানাম।
বলাবাহুল্য খবরটা বিরুধকের কাছে খুব একটা সুখশ্রাব্য মনে হয়নি। ক্রোধোন্মত্ত বিরুধক তদ্দণ্ডেই আদেশ দেন বাকি যেসব হতভাগ্য শাক্যরা তখনও নগর থেকে পালাতে পারেনি, তাদের যেন ধরে ধরে কপিলাবস্তুর প্রধানপথের ওপরেই জবাই করা হয়, যেন মনে হয় কপিলাবস্তুর রাজপথে রক্তের নদী বইছে। কপিলাবস্তুর প্রধান দরজার সামনে নির্মিত একটি উঁচু কাঠের সিংহাসনে বসে কোশলনৃপতি বিরুধক ঘোষণা করলেন, যতদূর তাঁর চোখ যায়, ততদূর পর্যন্ত তিনি যেন রক্তের নদী দেখতে পান কপিলাবস্তুর রাজপথে, নইলে কোশল সেনাপতিদের রক্তই সেই অভাব পূরণ করবে!
কোথায় লাগে অ্যাটিলা, চেঙ্গিজ খাঁ আর কোথায় লাগে বানু কুরাইজা গোত্রের গণহত্যা!
শোনা যায়, তার কয়েক ঘন্টার মধ্যে নাকি পালাতে না পারা বাকি সাতাত্তর হাজার হতভাগ্য শাক্য নারীপুরুষশিশুবৃদ্ধকে প্রধান রাজপথের ওপর কোতল করা হয়। তাতেও নাকি রক্তলোভী বিরুধকের মনে হয়ে রাজপথ যথেষ্ট রক্তে লাল হয়নি! শেষে কোশল সেনাপতিরা বাধ্য হয়ে শাক্যদের সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ লাক্ষা গলিয়ে দূরের রাজপথে ঢেলে দেন। যাতে সন্ধ্যার আঁধারে দূরের রাজপথের দিকে তাকিয়ে মদ্যাসক্ত, রণোন্মাদ নৃশংস রাজার যেন মনে হয় যে কপিলাবস্তুর রাস্তা শেষাবধি লালরঙে লহুলোহান!
তথাগতর অভিশাপ
কপিলাবস্তু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে বিরুধক যখন শ্রাবস্তীতে ফিরলেন, তখন বেঁধে নিয়ে গেছিলেন পাঁচশো শাক্য যুবক ও যুবতী। ইচ্ছে ছিলো রাজধানীতে পৌঁছে সবার সামনে এদের জবাই করে বাকিদের একটা শিক্ষা দেবেন, যাতে দুনিয়া বুঝতে পারে যে কোশলসম্রাট বিরুধকের সঙ্গে শত্রুতার ভয়ঙ্কর পরিণাম কি!
পিছমোড়া করে হাত পা বাঁধা অর্ধোলঙ্গ শাক্য যুবকযুবতীদের যখন প্রথমে শ্রাবস্তীর রাজপথে ছেড়ে দেওয়া হয়, ভীত জন্তুর মতন সন্ত্রস্ত সেই নিরপরাধ মানুষেরা দেখলো যে রাস্তার দুপাশে অগণিত রক্তলোলুপ উল্লসিত জনতা। তারা এসেছে গর্বিত শাক্যজাতির নারীপুরুষদের সম্মান আর প্রাণ নিয়ে লোফালুফি খেলার সাক্ষী হতে, তারা এসেছে এক অশ্লীল উত্তেজনার আগুন পোহাতে। হাজারো লোলুপ চাউনির হাত থেকে কোনওমতে নিজেদের আব্রু বাঁচাতে বাঁচাতেই তারা আরও ভীত হয়ে তারা দেখলো যে তাদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মদস্রাবী হস্তীযূথ, তাদের হাতির পায়ের নিচে পিষে মেরে ফেলার জন্যে। স্বয়ং সম্রাট এসেছেন অমাত্যসমভিব্যহারে এই হত্যা উৎসবে শামিল হতে। শাক্যজয়ী সম্রাটের হাতে মহার্ঘ মাধ্বী, ঠোঁটের কোণে অহঙ্কারের হাসি।
কিন্তু সে হাসি উবে যেতে বেশিক্ষণ দেরি হলো না। আগেই বলেছি, তরাই অঞ্চলের অধিবাসীদের হস্তিচালনায় দক্ষতা ছিলো প্রশ্নাতীত। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো হাতিরা সেই হতভাগ্যশাক্যদের পায়ের নীচে ফেলে পিষে দলে দেওয়ার বদলে অত্যন্ত আদর ও যত্নের সঙ্গে শুঁড়ে তুলে তাদের নিজেদের পিঠের ওপর বসিয়েছে। শুধু তাইই নয়, এই হতাশ্বাস শাক্যদের নিজেদের কাছে পেয়ে রীতিমতো আমোদ ও আহ্লাদই যেন প্রকাশ করছে সেই গজরাজের দল। অন্যদিকে দেখা গেলো শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশালদেহী হস্তিবাহিনী, আর তাদের শুঁড়ে ও গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে দুর্ভাগা শাক্যযুবকযুবতীরা। এবং সেই সর্বহারা নিরপরাধ মানুষগুলির আব্রু রক্ষার জন্যেই যেন তাদের নিজের শুঁড়ে জড়িয়ে রেখেছে সেই মহতী শান্ত মাতঙ্গের দল!
ভালোবাসা পেলে পশুরা যতটা মানবিক হতে পারে, মনুর সন্তানেরা তার কণামাত্র পেলে পৃথিবী বর্তে যেতো!
বাকরুদ্ধ এবং চমৎকৃত শ্রাবস্তী জনসাধারণ এই দেখে মোহিত হয়ে পড়ার আগেই ক্রোধান্ধ বিরুধক নিদান দেন এদের উত্তপ্ত (মতান্তরে গলানো) লোহার নিচে ফেলে হত্যা করার জন্য।
এরপরের কাহিনী লিখতে দস্তুরমতো নৈর্ব্যক্তিক নিষ্ঠুরতা দরকার। তবু সত্যের খাতিরে বলতেই হয় যে, সেই উদ্দেশ্যে শ্রাবস্তীনগরীর মধ্যিখানে এক বিশাল বড় পুকুর খোঁড়া হয়। জানিনা কবিরকল্পনার শ্রাবস্তীর মুখের কারুকার্য তাতে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কতটা কদর্য দেখিয়েছিলো সেই মৃত্যুলোভী ডাইনীর মুখমণ্ডল। শুধু এইটুকু জানি, শেষের সেই মুহূর্তে ভগবান বুদ্ধ নাকি স্বয়ং এসেছিলেন এদের রক্ষা করতে। কিন্তু যখন তিনি পৌঁছন, তখন সেই গহ্বরের মধ্যে হস্তপদবদ্ধ করে শায়িত শাক্যদের চাপা দেওয়া হচ্ছে গলন্ত লোহার পাত ও শিক দিয়ে। এবং কথিত আছে, সেই গহ্বর সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে, উত্তপ্ত রক্তলাল লৌহপাতের মধ্যে দিয়ে করুণাঘন তথাগতকে দেখে মৃত্যুঞ্জয়ীর দল সোল্লাসে বলে ওঠে, "হে শাক্যসিংহ, জীবন আর মৃত্যু তো কর্মচক্রে বারংবার ফিরে আসা মাত্র। তবে তোমার পুণ্য শরীর দেখতে দেখতে মহামৃত্যু বরণ করলাম, দোহাই তোমার বুদ্ধত্বের, আমাদের এই কর্মচক্রের পেষণ থেকে রেহাই দিও"।
তারপর শুধু মৃত্যুর হাহাকার, পোড়া মাংসের গন্ধ আর শ্মশানের স্তব্ধতা!
ভগবান বুদ্ধ নাকি এই দৃশ্য দেখে সাতিশয় বিচলিত হন, এবং ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন যে, "অকারণ নৃশংসতার শিকার এই সহস্র শাক্যজন এই দণ্ডেই স্বর্গের সর্বোচ্চ স্থানে আজীবনের জন্যে স্থায়িত হলো। আর এই মহাপাপের জন্যে আমি, শুদ্ধোদন ও মহামায়াপুত্র সিদ্ধার্থ, অভিশাপ দিচ্ছি যে প্রসেনজিৎপুত্র বিরুধক ও তার মন্ত্রী অম্বরীষ, এই দুই পাপমূর্তি আজ থেকে সাতদিনের মধ্যে অসহায়ের মতো আগুনে পুড়ে মরবে, এবং এই দুই পাপাত্মা নরকের নিম্নতম তলে নিক্ষিপ্ত হবে, এদের কোনওদিন মোক্ষপ্রাপ্তি হবে না। এই পাপভূমি কোশলসাম্রাজ্যের চিহ্নমাত্র থাকবে না।"।
(টীকাঃ এই গল্পটা যে সম্পূর্ণ প্রক্ষিপ্ত, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বুদ্ধের জীবনে অভিশাপদানের ঘটনা আর একটিও নেই, ফলে গল্পের এই অংশটুকু অবশ্যই মহাযানী ভিক্ষুদের বানানো । আর তাছাড়া যিনি এসব শুরুর আগেই "শাক্যরা তাদের কর্মফল ভোগ করুক " বলে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন, তিনি হঠাৎ নিজেরই নিদান অমান্য করে এদের মৃত্যুসমারোহ দেখতে আসবেন কেন, তাও একটা বড় প্রশ্ন।
অথবা বলাও যায় না। যে বুদ্ধ, "শাক্যরা কর্মফল ভোগ করুক" বলে হাত গুটিয়ে তিনিও তো সেই যুগেরই লোক, যে যুগে লোকে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখে, শত্রুর অস্ত্রাঘাতে মৃত্যুকে দেখে মহান আত্মবলিদান হিসেবে। যে যুগে লোকে ভাবতো রাজ্যজয়ের পর রাজা তাঁর বিজিত জনজাতিকেও "সবে মুনিষে পজা মম" বলে সন্তানস্নেহে লালনপালন করবেন। যুদ্ধের সেই ঔদার্য মিশ্রিত অভিজাত মানবিক মুখটুকুই হয়তো ভগবান বুদ্ধ মনে রেখেছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে রাজকুমার সিদ্ধার্থ কিন্তু কোনওদিন যুদ্ধ করেননি, চাক্ষুষ করেননি যুদ্ধের নৃশংসতা, যেমন করেছিলেন তাঁরই মহাপথানুগামী মহামতি অশোক। যখন শাক্যদের তিনি তাদের কর্মফলের হাতে ছেড়ে দিয়ে উদাসীন ছিলেন তখন হয়তো এই ধরণের বিকৃত মাংসগন্ধী বর্বরতা হয়তো তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
আর আজ যখন তিনি মনুষ্যকৃত এই নারকীয় সংহারলীলা প্রত্যক্ষ করলেন, অনুভব করলেন যে যুদ্ধ এমন এক সর্বনাশ যার মধ্যে কোনও গৌরব নেই, রোমান্স নেই, মহান আত্মদানমূলক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি নেই, তখনই হয়তো মুহূর্তেকের জন্যে তিনি তাঁর ঐশ্বরিক ভাবজগত থেকে নেমে এসে ক্রুদ্ধ মানুষী রূপ পরিগ্রহ করেছেন, অভিশপ্ত করেছেন বিরুধক এবং অম্বরীষকে!
কে জানে, হয়তো বা তাইই হয়েছিলো!)
অভিশাপ শুনে বিরুধকের মনে ভয় এল, প্রবল মৃত্যুভয়। ভগবান তথাগত তখন বৃদ্ধ, এবং প্রায় ঈশ্বরের পর্যায়ে উন্নীত। তাঁর অভিশাপ বিফলে যাওয়ার নয়। তাহলে উপায়?
ফের ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থিত হলেন মহামন্ত্রী অম্বরীষ, তিনিই বাতলালেন পথ। অম্বরীষের পরামর্শ অনুসারে বিরুধক সপরিবারে আশ্রয় নিলেন শ্রাবস্তীর বাইরে এক জলাশয়ের মধ্যে বানানো জলটুঙ্গিতে, তাকে ছোটখাটো এক কাষ্ঠনির্মিত প্রাসাদ বললেই চলে। সঙ্গে আশ্রয় নিলেন বিরুধকের প্রিয়তমা পত্নীরা, সঙ্গে আরও রইলো নগরের শ্রেষ্ঠতম নর্তকী আর গায়কবাদকদের দল, এবং উৎকৃষ্টতম আসবসমূহ। সঙ্গে আশ্রয় নিলেন অম্বরীষ নিজেও।
সেই কাঠের তৈরি জলটুঙ্গিতে কোনওরকম আগুন জ্বালানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলো, নিষিদ্ধ করা হলো রাত্রিতে প্রদীপ, মশাল বা অন্য কোনও আলো জ্বালানো। জলটুঙ্গির সম্পূর্ণ এলাকা, প্রাসাদের দেওয়াল, ছাদ সমস্তভাবে অগ্নিনিরোধক পদার্থে লেপে দেওয়া হলো, যাতে এক ইঞ্চি ফাঁক না থাকে। কোনওভাবে আগুনের সন্ধান পাওয়া মাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কঠোর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলো। রোজকার খাওয়ার আসতো রাজপ্রাসাদ থেকে। যদি কারও অনবধানতায় আগুন লাগেই, তাকে দ্রুত আয়ত্বে আনার জন্যে মোতায়েন করা হলো বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত রক্ষীবাহিনী। মোটমাট লখিন্দরের জন্যে যেমন যত্নে লোহার বাসরঘরটি তৈরি করা হয়েছিলো, তার দ্বিগুণ সতর্কতার সঙ্গে পরের সাত দিনের জন্যে সেই জলটুঙ্গিতে তৈরি করা হলো এক অগ্নিনিরোধক দুর্ভেদ্য দুর্গ। সমস্ত ব্যবস্থাপনার আয়োজনে রইলেন কুটিলবুদ্ধি ধূর্তশিরোমণি অম্বরীষ স্বয়ং।
যদিও বিরুধক সেই জলবেষ্টিত প্রাসাদে প্রবেশ করে বুঝলেন যে এত সতর্কতার কোনও দরকারই ছিলো না। কারণ প্রবেশের দিন থেকেই প্রবল বৃষ্টিতে চারিধার অন্ধকার, একহাত দূর অবধি দেখা যায়না। সেই শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটার সময়ে শাক্যবিজয়ী প্রবলপরাক্রান্ত সম্রাট বিরুধক মহার্ঘ আসব আর সেরা নর্তকীদের কোমল আলিঙ্গনের মধ্যে নিজের ক্লান্তি অপনোদন করতে লাগলেন। আহা, চাতুরি করে কপিলাবস্তুতে ঢুকে এত এত নিরপরাধ মানুষ মেরে কি কম পরিশ্রম হয়েছে মহারাজাধিরাজের?
ছয়টি দিন এইভাবেই গেলো, প্রবল বৃষ্টিতে যেন চরাচর ভেসে যাচ্ছে। সপ্তমদিনে ভোরবেলা উঠে বিরুধক আদেশ দিলেন সবাইকে প্রস্তুত হতে, সূর্যের অস্তাচলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি সেই জলবিহার ত্যাগ করতে চান। ইশশ, ফালতু একটা ভয়ে কয়েকটা দিন অকর্মণ্যের মতন জলে গেলো। আজ আর নিশ্চয়ই কিছু হবে না। আরও কত দেশ আছে জয় করার, কত রক্ত আছে ঝরাবার...
চারিদিকে তখন হুড়োহুড়ি, সবাই দ্রুত তৈরি হতে চায়, সবারই ঘরের জন্যে মন কেমন করছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে চারিদিক ঝলমল করে, গত সাতদিনে এই প্রথম সূর্যদেব প্রবল প্রতাপে উদিত হয়ে চারিদিক যেন পুড়িয়ে দিতে লাগলেন। বাপরে, কি তেজ রোদের, চারিদিকে তাকানো অবধি যায়না! সেই ভোরবেলাতেই যেন মধ্যাহ্নসূর্যের তীব্রতায় চোখ ঝলসে যেতে লাগলো সবার।
ধীরে ধীরে মধ্যাহ্ন এলো। সূর্য তখন মাথার ওপর, প্রখর অগ্নিকিরণে ছয়দিনের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব এক্কেবারে উধাও। চারিদিকে ব্যস্ততা চলছে পুরোদমে। পুরনারীদের ঘরে মহার্ঘ বস্ত্র আর বহুমূল্য হিরেজহরতের গয়না ছড়িয়ে আছে। দেবনিন্দিত অঙ্গে তাঁরা তুলে নিচ্ছেন সুদূর পূর্বদেশ থেকে আমদানি করা সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র, তার ভেতর থেকে যেন ফেটে পড়ছে উদ্ধত যৌবনদুটি। সেই পদ্মফুলের পাপড়ির মতন চোখ, পদ্মের ডাঁটির মতন হাত, কাঁচা সোনার মতন গায়ের রং, সুবর্তুল স্তনদুটি, ক্ষীণকটি গুরুনিতম্বিনীদের দেখলে মুনিদেরও মতিভ্রম হয়, মানুষ তো কোন ছাড়!
তা সেই বরবর্ণিনীদেরই একজন বোধহয় হাসতে হাসতে তাঁর গলায় পরবার মহামূল্য জড়োয়া হারখানি ঠিক জানালার পাশে রাখা নরম তুলোর তৈরি বালিশের ওপর ছুঁড়ে রাখলেন, পরে পরবেন বলে। জড়োয়ার হারটির মধ্যিখানে ছিলো একটি বড় আকারের দুর্মূল্য হিরে।
ঠিক সেই সময়েই মধ্যাহ্নের সূর্যরশ্মি জানালা দিয়ে এসে পড়লো সেই হিরেটির ওপর। এবং বিচিত্র ভাবে পলকাটা সেই হীরকখণ্ডটির বিভিন্ন স্তরে ও আন্তর্দেওয়ালে প্রতিসৃত হয়ে সমস্ত সূর্যরশ্মি একটি বিন্দুতে সংহত হলো, যেমন ঘটে আতশকাঁচের ক্ষেত্রে!
ব্যস, আর কি, মুহূর্তে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো সেই পশমে মোড়া তুলোর বালিশ, মুহূর্তে গ্রাস করে নিলো আশেপাশে ছড়িয়ে দামী মসলিন বস্ত্রসমূহকে। যে অন্তঃপুর একটু আগেও কোশলনারীদের কলকাকলিতে মুখরিত ছিলো, পলকের মধ্যে সেখানে জায়গা করে নিলো ভীত সন্ত্রস্ত আর্তচিৎকার। আর্তনাদে দিগ্বিদিক বিদীর্ণ করে কোশলকন্যারা পালাতে লাগলো সেই ঘরছেড়ে। যোগ্য সমিধ পেয়ে তৃপ্ত হুতাশন আক্রমণ করলেন পাশের ঘরগুলিকে। সারা প্রাসাদে হইহই রব পড়ে গেলো, গৌতম বুদ্ধের অভিশাপ ফলতে চলেছে ভেবে কেউ আর আতঙ্কে আগুন নেভাবার চেষ্টা করলো না, পালাতে লাগলো উর্ধ্বশ্বাসে!
যেমন পালাতে বাধ্য হয়েছিলো শাক্যরা! ত্রস্ত্র জন্তুর মতন তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিলো কোশলসেনার দল!
অগ্নিদেবও আর দেরি না করে গ্রাস করতে শুরু করলেন সেই কাষ্ঠনির্মিত প্রাসাদটিকে। ভয়ের আর্তনাদে, আতঙ্কের কোলাহলে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রহরীরাও প্রাণ হাতে পালাতে লাগলো এই সর্বগ্রাসী আগুনের হাত থেকে।
আগুন যখন লাগে, বিরুধক সম্ভবত তখন মহামাত্য অম্বরীষের সঙ্গে অন্য কোনও রাজ্যজয়ের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রথমে এত হইচই শুনে যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হন, প্রহরীকে আজ্ঞা দিতে গিয়ে দেখেন যে কেউ সাড়া দিচ্ছে না! শেষমেশ নিজেই ক্রুদ্ধ আরক্ত চোখে বেরিয়ে দেখেন যে সেই সুবিশাল জলটুঙ্গির বৃহদংশ ততক্ষণে সম্পূর্ণরূপে অগ্নিগ্রস্ত!
এই প্রথম বিরুধক ভয় পেলেন।
মহাভয়, মৃত্যুভয়!
তাহলে কি ভগবান সুগতর অভিশাপ সত্যিই ফলতে চলেছে? সত্যিই কি তিনি এবার আগুনে পুড়ে ভয়াবহ মৃত্যু বরণ করতে চলেছেন? তার মানে কি সত্যিই তাঁর ঠাঁই হবে অনন্ত নরকের নিম্নতম স্তরে? কিন্তু এসব ছাড়িয়েও তাঁর মনে বড় হয়ে উঠলো অন্য দুটি প্রশ্ন, অগ্নিরোধী তরলে সমস্ত প্রাসাদ লেপে দেওয়া সত্বেও এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে কি করে? তার চেয়েও বড় কথা, আগুন লাগলো কি করে? অত সতর্কতার পরেও?
আগুন লাগার কারণটা না জানলেও, এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণটা বিদ্যুচ্চমকের মতই তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো, বৃষ্টি!
গত ছয়দিনের অবিরল বৃষ্টিতে সেসব অগ্নিরোধী লেপন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। আর হয়তো বা তার যোগ্য সঙ্গত করতেই আজ ভোর থেকে সূর্যদেবের অমন প্রবল প্রতাপ, তাই দুপুরের মধ্যেই সমগ্র কাঠের প্রাসাদ আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার মতন শুষ্কপ্রস্তুত! যেন বিরুধককে এই ধ্বংসযজ্ঞের সমিধ হিসেবে অর্পণ করার জন্যে এই খাণ্ডবদাহনের আয়োজন!
কথিত আছে সেদিন সেই অগ্নিগ্রাসে পতিত প্রাসাদ ছেড়ে সবাই প্রাণ হাতে করে পালাতে পেরেছিলেন, পারেননি শুধু মাত্র দুইজন, তাঁদের সামনে নাকি যাবতীয় ঘরের দরজা কোনও অলৌকিক উপায়ে দেওয়াল হয়ে উঠেছে বার বার। আর তাঁরা নাকি হাহাকার করতে করতে, কাঁদতে কাঁদতে সারা প্রাসাদ জুড়ে ছুটে বেরিয়েছেন একটি দরজা খুঁজে ফিরে। তাঁরা বার বার ক্ষমা চেয়েছেন উচ্চৈস্বরে, প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছেন নিজেদের যাবতীয় কৃতকর্মের জন্যে। বিনিময়ে চেয়েছেন শুধু একটিমাত্র ভিক্ষা, প্রাণ!
জানিনা সেদিন লক্ষ সহস্র নিরপরাধ মৃত শাক্যদের আত্মা এসে এই দুই পাপবুদ্ধির কানের কাছে খল খল শব্দে হেসে উঠেছিলো কিনা! তবে শেষে দেখা যায় সেই পুড়ে যাওয়া প্রাসাদের নিচের তলায়, মহাতঙ্কে বিস্ফারিত দুই চোখ খুলে শুয়ে আছেন দুই দগ্ধ ও মৃত নৃশংস শয়তান!
আশা করি বলে দিতে হবে না তাঁরা কারা!
পৃথিবীতে বহু মহান রাজবংশের নিধনের ও উচ্ছেদের গল্প আমরা শুনেছি। তবুও তাদের মধ্যে আত্মত্যাগের মহিমায়,সর্বহারার বুকফাটা কান্নায়, হানাহানির নৃশংসতায় আর বিচিত্র যুদ্ধকৌশলের প্রয়োগে সমুজ্বল রয়ে যাবে মহান শাক্যবংশের পতনের ইতিহাস। রয়ে যাবে সময়ের কপালে একটি রক্তরাগ টীকার মতন।
বিরুধকের মৃত্যুর খবর শোনামাত্র বিম্বিসারপুত্র অজাতশত্রু প্রায় বিনা পরিশ্রমে কোশলরাজ্য দখল করে নেন, ও তাকে মগধ সাম্রাজ্যের অঙ্গীকৃত করেন। তথাগতের অভিশাপের শেষ অংশটুকুওফলে গেলো।
তবে কিনা সে আরেক গল্প। আরেকদিন সময় পেলে জমিয়ে বলা যাবে না হয়, কেমন? ততদিনের জন্যে না হয় কলমটি বুদ্ধের নামে তুলে রাখলাম।
Bibliography :
1. The life of the Buddha, and the early history of his order: William WoodVille Rockhill.
2. AMBATTHA SUTTA.
3. Mahavamsam
4. Mahanaman . SatyendraNath Dutta. Probasi,
5. Bouddha Dharma: Haraprasad Shastri
স্তব্ধবাক বিশেষণটা গল্পে উপন্যাসে পড়লেও নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা কোনোদিন ভাবিনি, কিন্তু আজ এই লেখা পড়ে ঠিক সেটাই হলাম।
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখা। ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তী সব যেন চোখের সামনে ফুটে উঠল। লেখাটা চালিয়ে যান দয়া করে।
খুব তথ্যভিত্তিক অথচ সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। অসাধারণ। আপনি বাচ্চাদের ইতিগাস বই লিখুন তো মশাই, ওরা একটু পড়ে বাঁচবে!
ReplyDeleteখুব তথ্যভিত্তিক অথচ সুখপাঠ্য প্রবন্ধ। অসাধারণ। আপনি বাচ্চাদের ইতিগাস বই লিখুন তো মশাই, ওরা একটু পড়ে বাঁচবে!
ReplyDeleteদুর্দান্ত শৈলী। অনবদ্য।
ReplyDeleteঅসাধারণ।বাকরুদ্ধ হয়ে শুধুই পড়ে গেলাম। বহুদিন পর এইরকম ইনফরমেটিভ অথচ অসম্ভব ইন্তারেস্টিং কোন সাবলীল লেখা পড়ার সুযোগ পেলাম। ধন্যবাদ এইরকম একটি লেখা আমাদের উপহার দেবার জন্য।
ReplyDeleteঅসাধারণ।বাকরুদ্ধ হয়ে শুধুই পড়ে গেলাম। বহুদিন পর এইরকম ইনফরমেটিভ অথচ অসম্ভব ইন্তারেস্টিং কোন সাবলীল লেখা পড়ার সুযোগ পেলাম। ধন্যবাদ এইরকম একটি লেখা আমাদের উপহার দেবার জন্য।
ReplyDeleteআপনার ইতিহাসভিত্তিক লেখা প্রথমবার পড়লাম। পড়ে ধারণাও করতে পারছি না যে এতদিন কী মহামূল্য সম্পদ আমার অগোচরে থেকে গেছে। কামনা করি আপনার এই লেখা যেন যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের প্রতি মানুষের আকাঙ্খা বাড়িয়ে তোলে। পেন্নাম!
ReplyDeleteঅপূর্ব !!
ReplyDeleteএকই সাথে যেনো শরদিন্দু আর পরশুরাম পড়ছিলাম !♥♥
Bhison bhalo laglo pore... sudu koyekta kotha...Suklodon er putro Mohanaam...tahole Suddhdon er bhaipo.. Mohanaam I to prodhan senapoti... Tahole ei ta mone hoy ektu thik korte hobe .. jekhane lekha aache 'Takhon ei Shuklodonputro Mohanaam, Suddhodon er khurtuto bhai enong prodhan Senapoti, Ekti poth batlalen' ..
ReplyDeleteঅসাধারন, এরকম লেখা আরও চাই।
ReplyDeleteঅসাধারন, এরকম লেখা আরও চাই।
ReplyDeleteএই লেখাটা পড়ে, তথাকথিত ফেসবুকের লেখকরা প্রচণ্ড ক্ষার থাবে।
ReplyDeleteপিগলেট
ReplyDelete