0

প্রবন্ধ - সুমন মাইতি

Posted in


প্রবন্ধ


সেন্ট ফ্রান্সিসের মেষপালক

এবং ইওরোপীয় নবজাগরণ


সুমন মাইতি





মধ্যযুগে ফ্রান্সিস্কান সন্ন্যাসীরা জুতো পরতেন না, কর্দমাক্ত পুতিগন্ধময় রাস্তা দিয়ে এই সন্ন্যাসীরা যখন হেঁটে কারুর বাড়ী যেতেন দূর থেকেই তাঁদের আসার “গন্ধ” পেত লোকে। দারিদ্র্যের অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্যই এ বন্দোবস্ত। প্রতিষ্ঠাতা সেন্ট ফ্রান্সিস অফ অ্যাসিসি জীবনব্যাপী কৃচ্ছসাধন, কৌমার্যপালন আর জনসেবার ব্রত মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কালক্রমে জনসেবা করাটাই ফ্রান্সিস্কানদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এর কারণও ছিল। ত্রয়োদশ শতকে চার্চের আভ্যন্তরীণ রেষারেষি চরমে পোঁছয়। স্প্যানিশ রাজপুরুষ ডোমিনিক দে গুজমান স্থাপিত কট্টরপন্থী ডোমিনিকানদের সঙ্গে ভক্তিবাদী ফ্রান্সিস্কানদের মতাদর্শগত সংঘর্ষ একরকম অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে যার ফলে চার্চের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়ে। “ঈশ্বরের সারমেয়” (Domini Canes) বলে খ্যাত ডোমিনিকানদের হেরেটিক হান্টার বলা যায়। আচার ব্যবহারে নিজেদের এলিটিস্ট ভাবমূর্তি বজায় রাখতে পছন্দ করতেন তাঁরা। তাঁদের সাথে পাল্লা দিতে জনবান্ধব ভাবমূর্তিকেই প্রধান অবলম্বন করেন ফ্রান্সিস্কানরা। বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে যে আখেরে চার্চেরই প্রাসঙ্গিকতা গৌণ হয়ে পড়বে এটা বুঝতে ভুল করেননি ফ্রান্সিসকানরা ফলত ডোমিনিকানদের তুলনায় নিজেদের ব্যতিক্রমী হিসেবে তুলে ধরতে বিশষভাবে সচেষ্ট ছিলেন ফ্রান্সিস্কান সন্ন্যাসীরা। ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রখ্যাত দার্শনিক অগাস্টিন অফ হিপোর ধ্রুপদী গ্রীক আর জুডেইজমের মিশেলে গড়ে তোলা খৃষ্টীয়ধর্মের মূল কাঠামোয় চিড় ধরতে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকে। গ্রেনাডার মুর শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হেলেনিস্টিক দর্শনের পুনর্ন্মেষ হওয়ায় তৎকালীন চার্চের নেতৃত্ব প্রমাদ গোণেন। ডোমিনিকান দার্শনিক টমাস অফ অ্যাকুইনাস নিজের লেখায় অ্যারিস্টটলীয় দর্শন আর চার্চের ঘোষিত অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি - টমাসের মৃত্যুর মাত্র তিন বছরের মধ্যে ১২৭৭ সালে অ্যারিস্টটলীয় দর্শনকে হেরেটিকাল ঘোষণা করেন বিশপ এতিয়েন তঁপিয়ে। কিন্তু এই নির্বিকল্প কট্টরবাদ যে মানুষকে চার্চের প্রতি আরো বিরূপ করে তুলবে সেটা বুঝতে পারছিলেন অনেকেই। সেজন্য দরকার হলো নতুন জন সংযোগনীতির। “le jongleur de Dieu” বা “God’s Tumbler” নামে খ্যাত ফ্রান্সিস মনে করতেন ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার মানুষকে কাছে টানার মাধ্যম। জনসমর্থনের সাথেই জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক চেতনা, ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের অবাধ অধিকার। ফ্রান্সিসকে পপুলিস্ট অভিধা দিলে অতিশোয়ক্তি হবে না। এই রাজনীতি একুশ শতকেও প্রাসঙ্গিক যেখানে উগো চ্যাভেজ গসপেলের সাথে সাম্যবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজপরিবর্তনের স্বপ্ন ফিরি করেন! কাজেই জনসমর্থন উদ্ধারে ফ্রান্সসিকানদের মতামতটাই প্রাধান্য পেল তৎকালীন চার্চে। উচ্চশিক্ষিত দার্শনিক টমাসকে সরিয়ে “অতি সাধারণ” ফ্রান্সিসই চার্চের যোগ্যতম মুখপাত্র হয়ে উঠলেন যিনি বাস্তবের আঙ্গিনায় হাতের নাগালে নামিয়ে আনলেন ধর্মকে। মৃত্যুর তিন বছর আগে ১২2৩ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেইচ্চো (Greccio) শহরে ক্রিসমাসের প্রাক্কালে নেটিভিটি উদযাপনের সময় চার্চে হাজির করলেন দৈনন্দিনতার অতিপরিচিত মনুষ্যেতর প্রাণী- গাধা, ষাঁড় যাতে বেথলেহেমের আস্তাবলের “বাস্তবসম্মত” রূপ দেওয়া যায় – রূপক নয় ঘটমান বাস্তব সৃষ্টি করলেন দর্শকের জন্য। “I wish to make a memorial of that child who was born in Bethlehem and as far as is possible behold with bodily eyes the hardship of his infant state, lying on hay in a manger with ox and the ass standing by.” পূর্ববর্তী বাইজান্টাইন শিল্পীরা ঈশ্বরকে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন দূরতর মাত্রায় - রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতায় বিস্তার লাভ করা ধর্মে সময়ের সাথে এই দূরত্ব তৈরি করে নেওয়াটা হয়ত প্রয়োজন ছিল কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের গিল্ডনির্ভর উচ্চাশী বণিককূল সেই কাঠামোয়টায় যে ধাক্কাটা দিচ্ছিল সেটাকে সামলে উঠতে না পারলে মূল কাঠামোটাই ভেঙে পড়তে পারত। ফ্রান্সিস সেই প্রতিঘাত সামলে ওঠার রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন - রহস্যের দোরগোড়া থেকে বোধগম্যতার সন্ধিক্ষণে উপস্থিত করলেন দর্শককে - জন্ম হলো রিয়ালিজমের। গত শতকের স্টুডিওর সেট থেকে বেরিয়ে ৩৫ মিমি লেন্সে ঘটমান বাস্তবতা ধরতে চাওয়া রোজেলিনি, ভিত্তোরিও ডি সিকা নিওরিয়েলিজমের যে ধারা তৈরি করেন তার সূচনা হয়ত গ্রেইচ্চোতেই হয়েছিল। ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর মঠে যোগ দেন রজার বেকন -আধুনিক বিজ্ঞানের আদিগুরু। যদিও বেকন বিশুদ্ধতাবাদী ফ্রান্সিস্কান মতবাদে আজীবন বিশ্বাসী ছিলেন কিন্ত স্বভাব দার্শনিক বেকনের কাছে অন্তহীন নিয়মানুবর্তিতা আর বৌদ্ধিক স্বাধীনতার মধ্যে দ্বিতীয়টিকে প্রেয়তর মনে হয়েছিল। তাঁর মতে পরিদৃশ্যমান এই জগতের একটি হচ্ছে আমাদের জগত, সদা উদ্ভ্রান্ত, আবেগনিত্য বাসনাভূমি; অন্যদিকে রয়েছে বিশুদ্ধ, শাশ্বত, ধ্রুবক সত্য। এই জগতের অপ্সৃয়মান ছায়ায় নিত্যতার অন্বেষণের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে রহস্য। ফ্রান্সিসের মতোই বেকন মনোনিবেশ করলেন সেই রহস্যের উন্মোচনে - অন্ধকার থেকে আলোর আধোদীপ্ত উত্তরণের এপথ ধরেই ভাববাদী দর্শন থেকে বস্তুবাদী জিজ্ঞাসার উন্মেষ, জন্ম আধুনিক বিজ্ঞানের। বেকনের রাস্তাটা সহজ ছিলনা যদিও – ফ্রান্সিস্কান মাস্টার বনাভঁশ্যিওর চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি যাতে বেকনের বই প্রকাশ হয়। তৎকালীন চার্চের মূলভাষ্য;- ঈশ্বর নির্দিস্ট জগতে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই – অজ্ঞেয়বাদী প্রশ্ন করলেই সে হেরেটিক, ইনক্যুজিশানের উপযুক্ত। উপরন্ত একজন ফ্রান্সিস্কান ফ্রায়ারের পক্ষে প্রশ্ন তোলা ব্ল্যসেমীর সমতুল – এই বই প্রকাশিত হলে চিরপ্রতিদ্বন্দী ডোমিনিকানদের হাতে সেটি যে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠবে না সে নিশ্চয়তাই বা কে দেবে! কাজেই বনাভঁশ্যিওর আপত্তির কারণ বুঝতে অসুবেধে হয় না। কিন্তু বেকন চার্চ নেতৃত্বকে বোঝাতে সক্ষম হন এই উত্তরের অন্বেষণই ঈশ্বরসৃষ্ট এ জগতের প্রতি মানুষকে আরো মনোযোগী করে তুলবে, তাতে স্রষ্টাই মহিমান্বিত হবেন, জনমানসে আরও গভীর হবে বিশ্বাস। শেষপর্যন্ত পোপের সম্মতি মিলল। বেকনের লেখা ওপাস মায়ুস প্রকাশিত হয় ১২৬৭ সালে। বিশ্বাসের জগত ছেড়ে যুক্তিবাদের পথে একধাপ এগোল ইতিহাস। এই বই প্রকাশের কয়েকদশক পর আরেকটি বিপ্লব ঘটাবেন অন্য এক ফ্রান্সিসকান। 

ফ্লোরেন্স থেকে ছোট্ট শহর ভেস্পিন্যিন্যানো যাচ্ছিলেন প্রখ্যাত
ইতালীয় ভাস্কর সিমাব্যুয়ে - পথিমধ্যে চোখে পড়ল একটি ছেলে আত্মমগ্ন হয়ে পাথরের ওপর ছবি আঁকছে, সামনের মাঠে চরতে আসা ভেড়ার পাল অবয়ব পাচ্ছে নির্মোহ মর্মরে। বছর দশেকের ছেলেটিকে মনে ধরল সিমাব্যুর – শিক্ষানবীশ হিসেবে নিজের কাছে নিয়ে এলেন। সময়টা সম্ভবত ১২৭০-৭৫। কয়েক বছরের মধ্যেই আপন স্বাতন্ত্র্যে নিজের জাত চেনালো ছেলেটি। গুরুর ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজস্ব ঘরানার জন্ম দিল। ছেলেটির নাম জিয়েত্তো ডি বনদুন। ইতালির বাণিজ্য নির্ভর নগররাষ্ট্রগুলিতে ততদিনে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মুক্ত অর্থনীতির সুফল মিলতে শুরু করেছে। অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে ব্যবসায়িক মেলবন্ধনে লাভবান হচ্ছে ফ্লোরেন্স, জেনোয়া, পাদুয়া। শিল্প-স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন ইতালীয় বণিকশ্রেণী।
এই প্রাক-রেনেসাঁ যুগে জন্ম জিয়েত্তোর। নিজের ক্ষর্বাকৃতি নিয়ে স্বভাব সচেতন শিল্পী অনুপম দক্ষতায় ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তুলতেন সাধারণ মানুষের রূপ। শুধুই হেলেনিস্টিক যৌনতার বাহ্যিক উপাচার বা বাইজেন্টাইন অনমনীয় কঠোরতা নয় (ষষ্ঠ শতকের সেন্ট অ্যাপোলিনারে ন্যুয়েভো ব্যাসিলিকায় আঁকা ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড দ্রষ্টব্য)- জিয়েত্তো শিল্পসত্তায় আনবেন মানবীয় নির্ভাষ, চরিত্রের দোলাচল, ঋজুরেখ নয় কোমল বাস্তবতায় মূর্ত হয়ে উঠবে সে সৃষ্টি। উত্তরকালে এর ছায়া পড়বে সাহিত্যে, কবিতায়, নাটকে, ছবিতে - মানবীয় হয়ে উঠবে শিল্প। 

স্ক্রোভেন্নি চ্যাপেলের দেওয়ালে আঁকা জিয়েত্তোর কিস অফ জুডাস গ্রোটেক্সের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশে অনন্য। গার্ডেন অফ গ্যেথসেমনিতে দাঁড়িয়ে জিসাস – চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ইয়াওয়ের পবিত্রতা রক্ষায় উন্মক্ত একদল ধর্মান্ধ মানুষ, কেইনের মতোই তাদের হাতে ঘাতক অস্ত্র, মশালের আলোয় জ্বলছে চোখগুলো, অবদমিত হিংস্রতা সে চোখে – “কে এই প্রতারক যে নিজেকে ঈশ্বরপুত্র বলার দুঃসাহস দেখায়!” মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিসাস আর জুডাস, একটু আগেই জুডাস এগিয়ে এসে চুমু এঁকে দিয়েছেন র‍্যাবাইয়ের গালে। জিয়েত্তো এখানে নিজেকেও ছাপিয়ে যাছেন –– জিসাসের বিপ্রতীপে উদগ্র জিঘাংসায় অসূয়ার অপাংক্তেয়তায় পরাভূত ক্যুব্জ জুডাস, যে নিজেও জানে অপরিমেয় এই ধ্বংসের খেলার অন্তে তার পরিণতি কিন্তু এক অমোঘ আগ্রাসনে নিয়তির কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে সে। জুডাসের মুখমণ্ডল জুড়ে রিক্ত সর্বগ্রাসী ঘৃণা, রক্তের ভেতরে চারিয়ে যাওয়া অস্ত্বিত্ব বিনাশক কদর্যতা ফুটিয়ে তুলছেন জিয়েত্তো। ছবিতে কদর্যতা এবং আত্মিক সংকট যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। নিরন্তর আত্মরতির সাধনায় মগ্ন আমরা নিজেরাই কোন না কোন সময় জুডাস হয়ে উঠি – জিয়েত্তো আর্শি তুলে ধরেন, আত্মপ্রত্যয়ের এই অন্তহীন স্খলনে, নিজেরাই সচকিত হয়ে তাকাই, অস্ত্বিত্বের দোহাই দিয়েও সেখান থেকে মুক্তি মেলে না।

জিয়েত্তো ফ্রান্সিকান অর্ডারের সদস্য ছিলেন। গুরুতর্পণে অকৃপণ। সেন্ট ফ্রান্সিসসের নামে উৎসর্গীকৃত ব্যাসিলিকায় করা তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্রেস্কোগুলিতে ফ্রান্সিসের অনুষঙ্গ এসেছে বারেবারে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা সন্তকে দেখতে এসেছেন ক্লে’য়ার (Saint Francis Mourned by Saint Clare)– ফ্রান্সিসের সাথে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব, সাধন পথের সহযাত্রী - একাধিক জায়গায় ফ্রান্সিস নিজেই বলেছেন সেকথা। জিয়েত্তো সন্ত নয়, মানবী ক্লে’য়ার ছবি আঁকছেন – অনেকটা পথ উজাড় করে বন্ধুকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছেন
তিনি - অপরিসীম মমতায় ধরে আছেন ফ্রান্সিসের হাতখানি –নিষ্প্রাণ সে দেহ তবু এত সহজে কি যেতে দেওয়া যায় তাকে? ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ক্লে’য়ার। অস্তিত্বের সমস্ত গ্লানি আর গৌরব মিশে আছে এই নশ্বর দেহে – ফ্রেস্কোর আঁচড়ে অমূল্য সেই অসহায়তা ফুটিয়ে তুলছেন জিয়েত্তো। বহুদিন আগের গ্যালিলিতে হেঁটে ছিলেন যে ঈশ্বরপুত্র, ভাগ করে নিয়েছিলেন মানুষের কান্না, হাসি, যন্ত্রণা, শিল্পের মধ্যে ধরা দিচ্ছে সেই দ্যোতনা। জিয়েত্তোর দেখানো পথ ধরেই একে একে আসবেন ঘিবার্তি, দোনাতেল্লো, মন্তেগন্না, কারাভাজ্জো - নীরব নতমস্তক হবেন রেনেসাঁ যুগের তিন মহারথী মিকেলাঞ্জেলো, রাফ্যেল এবং ভিঞ্চি; এঁদের প্রত্যেকের সৃষ্টিতে জিয়েত্তোর শিল্পঘরানার প্রভাব সুস্পষ্ট।


শিল্পী জিয়েত্তো একে একে সামাজিক প্রথাগুলো ভাঙছেন – চিত্রে ইঙ্গিতময়তার (অনু)প্রবেশ ঘটছে। এরকম আরেকটি সৃষ্টি Renunciation of Worldly Goods। ব্যপ্টিজমের পর সেন্ট ফ্রান্সিস এসেছেন পিয়েজ্জায় – উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আপন পিতা, সম্ভ্রান্ত বস্ত্র ব্যবসায়ী; একমাত্র পুত্রের সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি তিনি, উন্মক্ত ক্রোধে আরক্ত পিতা পুত্রকে আঘাত করতে উদ্যত।
ছবিতে পিতাপুত্রের মাঝে নিঃসীম তমিস্রা, ঘন নিশ্চিত, শীতল অব্যর্থ এই বিভাজন – পার্থিবের সাথে অপার্থিবের। পিতার উদ্যত হাত নিবৃত্ত করছেন আরেক বৃত্তিজীবি– সন্তান মাত্রেই পিতার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাস নয়, নিজের পছন্দ অপছন্দ বেঁচে নেবার অধিকার রয়েছে তারও। ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর তৈরি করছেন জিয়েত্তো। এই সন্ত সুদূর আধ্যাত্বিক জগতের বাসিন্দা নন – আমাদের খুব কাছাকাছি একদম পাশের বাড়ীর ছেলেটির মতোই সে। রাজার প্রাসাদে নয়, নির্লিপ্ত নিরালার উপান্তে কোন উপাসনালয় নয়, তিনি নেমে আসছেন গণিকা, ভবঘুরে, বাউণ্ডূলে অধ্যুষিত হাটে-বাজারে; সম্ভ্রান্ত, পবিত্রতার মোড়ক খুলে আধ্যাত্বিকতার আগমন ঘটছে ধুলিধুসরিত মানব জমিনে। 

সচেতনভাবেই হেলেনিস্টটিক প্রেক্ষিতকে প্রকট করে তোলেননি জিয়েত্তো বরং অবাঙমানসগোচর পেরিয়ে দারিদ্র্যে ভরা ভুবনে নামিয়ে এনেছেন আপন চরিত্রদের – স্রষ্টা হিসেবে এটা তাঁর অর্জন। যদিও আজীবন নিষ্ঠাবান ক্যাথলিকের মতোই নিজের কৃতিত্বের পুরোটাই ঈশ্বরের দান বলেছেন কিন্তু তাঁর বাস্তবতা কেবল সন্ত নিরূপিত চার্চের একরৈখিক ভাষ্য নয় – সেখানে জিয়েত্তোর চরিত্রদের নিজস্ব হতাশা, দ্বেষ, অসহয়তা, আশা, অপত্যভাব, দূরত্বের বিস্তার এই সামগ্রিকতার ছাপ পড়েছে তাঁর ছবিতে।
জিয়েত্তোর সৃষ্ট ওনিস্যান্তি ম্যাডোনা আর নেটেভিটি অফ জিসাস ফ্রেস্কোদুটিতে এর প্রকাশ খুব স্পষ্ট। ম্যাডোনার চেহারায় ইতালীয় প্রভাব স্পষ্ট, নশ্বর মানবী। সদ্যজাতের মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ যেন মা জানেন ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁর সন্তানের জন্য কি পরিণতি অপেক্ষায়। স্বর্গীয় আভার সাথে জীবনের অনিশ্চয়তায় বিম্বিত হয় সে ম্যাডোনা। নেটিভিটি অফ জিসাস ফ্রেস্কোটিতে মেরি এবং ম্যাজাইয়ের মাঝখানের স্পেসটিতে আপেক্ষিক ত্রিমাত্রিকতায় বিন্যস্ত জোসেফ গর্দভ অজ, মেষ, আর গোশাবক – বলতে চাইছেন এই সৃষ্টি কেবল মানুষের নয়, মনুষ্যেতর প্রাণীরাও এই সমগ্রতার অংশ। নশ্বর জগতের সঙ্গে অবিনশ্বরের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন তিনি, শিশু নোয়েল সেই মধ্যবর্তিকার সেতুবন্ধন। ইউক্রাইস্টের ভিত্তিভূমি। 

একনিষ্ঠ আনুগত্যের পরিবর্তে মনের গহীনের এই আলোছায়ার পরিস্ফুরণ ঘটিয়েছেন জিয়েত্তো। রেনেসাঁর আদিপর্বের বেকনের রহস্যবাদীতার পুনর্জন্ম ঘটাচ্ছেন শিল্পে। ইউক্রাইস্টের সিম্বলিজমের সাথে সম্পৃক্ত ভৌম বস্তুজগত আর আধ্যাত্বিক চেতনার মধ্যবর্তী অদৃশ্য সোপানসারি দর্শকের সামনে তুলে ধরছেন –প্রশ্ন তৈরি করছেন – যে রহস্যের মোড়কে একটুকরো রুটি ঈশ্বরের অংশ হয়ে ওঠে, আপাত জড় পদার্থে প্রাণ সঞ্চার হয় তার স্বরূপ কি? কেনই বা তার ভিন্ন প্রকাশভঙ্গি? এই রূপান্তর কি সার্বজনীন নাকি ক্ষেত্রভাবউদ্ভূত? প্রশ্নগুলো চার্চের নীরব পালপিটে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত তুলছে বিশ্বাসীর মনে, স্থাপিত হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর – এই পরিপ্রশ্নেন সংস্থিতা দার্শনিক চিন্তার ছাপ পড়বে ভাস্কর্যে, চিত্রকলায়, বিজ্ঞানে – চার্চের অজান্তেই ধীরে ধীরে নবজাগরণের দরজাটা উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন জিয়েত্তো। 

ক্ষর্বকায়, শালপ্রাংশু, উচ্ছল, বিনয়ী এভাবেই জিয়েত্তোর বর্ণনা দিয়েছেন গুণমুগ্ধ কথাকার ফ্লোরেস ডি আর্কেইস যদিও সমসাময়িক স্বভাব রসিক জিওভান্নি বোকাচ্চিও তাঁর দৈহিক রূপকে শ্লেষে বিদ্ধ করতে ছাড়েননি “...amazing genius is often found to have been placed in the ugliest of men...” - বোকাচ্চিওর বর্ণণায় জিয়েত্তো এক কুদর্শন, খর্বকায়, গাঁট্টাগোঁট্টা মেষপালক। মধ্যযুগের আভিজাত্যের শ্রেষ্ঠত্বের অভিমান আর ফিউডাল ফিয়েফডমের পূর্বনির্দিষ্ট নিয়তিরবাদের কোনটাই তিনি বংশগরিমায় অর্জন করেননি – ভাগ্যিস করেননি। ছাত্রদের মুখে মায়েস্ত্রো সম্ভাষণ শুনলে বিরক্ত হতেন, সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতেন উপাধি বা পদবীর গরিমা – এটা তাঁর নীরব প্রতিবাদ। সামান্য এক মেষপালকের কাছে চিত্রশিল্প শিখতে আসছে রাজপুরুষরা এটাই তো এক বিস্ময়! স্ক্রোভেন্নি চ্যাপেলেই রয়েছে আরেকটি ফ্রেস্কো – লাস্ট জাজমেন্ট। বহুজনের ভীড়ে দাঁড়িয়ে জিয়েত্তো, পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে তাঁর মুখ – আপন হাতের জাদুতে যিনি ভেঙে দিয়েছেন শতাব্দীলালিত ধারণগুলো, যাঁর প্রদর্শিত পথে আসবে রিয়ালিজম, স্যুরিয়ালিজম, ম্যাজিক হার্মোনিকায় সুর তুলবেন পিটার গ্যাব্রিয়েলের স্যলসবুরী হিল - জীবনের ম্যাগনাম ওপাসে সেই ভাস্কর শিল্পী বড়ই বিনম্র, স্থিতধী, আনতচোখে যেন প্রভুর অপক্ষায়। তাঁর কাজ শেষ। প্রাকরেনেসাঁ এই ভগীরথের হাত ধরেই চার্চের বস্তসর্বস্ব উপাচারের ভেতর থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে হিউম্যানিজম – মাধ্যম, রূপক, ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ফেলেছেন জিয়েত্তো;- মিক হ্যাজ ইন্ডিড ইনহেরিটেড দ্য আর্থ। 






তথ্যপঞ্জীঃ

St. Francis of Assisi by G.K. Chesterton
Giotto: The Complete Works by Luciano Bellosi 
Giotto by Francesca Flores d’Arcais 

0 comments: