ছোটগল্প - উত্তম বিশ্বাস
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
পার্টি লাইন
উত্তম বিশ্বাস
‘‘গায়ের ওপর সাইকেলটা উড়ে এসে পড়ল কিভাবে! তবে কি বাবা আজও ওতে লাথি মেরেছে?’’ ঘুমচোখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিপুল। মানিকের বড় ছেলে। একটা পা অর্ধেকটা বিকলাঙ্গ তার। ভাবতে ভাবতে শুনতে পেল মায়ের চাপা চিৎকার, ‘‘মাঝরাতে বাতিক চাপলে চোখদুটো কি উবদো হয়ে যায়? সাইকেলটা তোমার কী করল? এত বাহাদুরী তা এতদিনে তো একখানা কিনে দিতে পারতে। খোঁড়া ছেলেমেয়ে দুটো আমার বুকে হাচড় দিতে দিতে পাঁচকিলো পথ ঠ্যেঙ্গিয়ে পড়তে যেতো; তখন পেরেছিলে ওদের জন্যে কিছু করতে? সরকারের দেওয়া একটা সাইকেল, তার ওপর তোমার এত বীষ?’’ মানিক একদম চুপমেরে যায়। বিপুল দরজার পর্দা সরিয়ে কিছু একটা দেখবার চেষ্টা করল,--- দেখল--- বাবার উরু বেয়ে তাজা লাল রক্তের ধারা বইছে; আর মা তার আঁচল দিয়ে পরম মমতায় মুছে বোরোলিন লাগাবার চেষ্টা করছে। সহসা অতি গোপন প্রদেশে হস্তসঞ্চালনে শিউরে ওঠে মানিকের শরীর। মানিক খপ করে শ্যামলীর হাতখানি ধরে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। বিপুল আর তাকাতে পারল না বাবা মায়ের দিকে। মনে মনে শুধু আফসোস হয়, ‘‘সাইকেলটা যাওয়া-আসার পথে এভাবে রাখা ঠিক হয়নি। এহ! কতদিন পরে বাবা আমার দুঃখিনী মায়ের কাছে যাচ্ছিল, আর এইভাবে তাতে বাধা পেয়ে আঘাত! ইস!!’’
আজকাল অন্ধকারে মানিক ভাল পথ হাঁটে। কিন্তু কেন? কিসের জন্যে তার এই মন পোড়ান অস্তাচল অভিসার!? মানিক শিক্ষিত, রুচিশীল, ভদ্র মার্জিত--- যদিও সে বেকার; কিন্তু তার পোশাকি পারিপাট্যে, কথার শ্রীছাঁদে দারিদ্রতার কৃষ্ণ-কুটীল গহ্বরগুলো তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবুও যে অন্তরে বাহিরে বাকলমোচন হয় না, এমন নয়। মানিক জানে, মানুষের জন্যে লড়াই করতে নেমে ব্যক্তি স্বার্থের কথা চিন্তা করা মোটেও উচিৎ নয়; কেননা এটা তার পার্টি আদর্শের পরিপন্থী। তাই সে যখন ইটভাঁটার কর্মীদের কাছে এসে, এক টুকরো পোড়া-বিড়ি ওদেরই কানের পাশ থেকে খসিয়ে নিয়ে তাতে নতুন করে আগুন দেয়, তখনও নতুন পোড়া ইটের মতো কী অদ্ভুতরকম লাল হয়ে ওঠে মানিকের মুখখানি! তখন জিতেনের বৌ হরিবালাও ইটের পাঁজার মতো মনে মনে তেতে ওঠে, আর মানিকের সুদৃশ্য মোচড়ানো গোঁফে হাত বুলোনোর আকাঙ্ক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠে। চৈত্রদহনে শুষ্ক নায়ানজুলির মতো চোখ-দুটি সহসা চিকচিক করে ওঠে! গলার শ্লেষ্মা সরিয়ে শ্রমিক মিটিংয়ে বুক চাপড়ে মানিক ভাষণ দেয়,---‘‘শোনো! শোনো! তোমরা কান খুলে একটা কথা শোনো, দু’টাকার চাল খাবার জন্যে কী তোমরা জন্মেছো? ভাবো! ভাবো! আরও একটু শান্ত মাথায় ভাবো, তোমরা কী তোমাদের ন্যায্য অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা রাখো না? তোমাদের জন্য এই চিরকাল এই আমরা, আমরা ছাড়া আর কারা এমন ভাবতে পেরেছে বলো?’’
পোড়া পোড়া মানুষগুলো আগুনমুখো হয়ে ওল্টানো ঝুড়ির ওপর বসে মানিকের ভাষণ শোনে। হাততালি দেয়। মানিক ও তার সহযোদ্ধারা উৎসাহিত হয়ে খাদির পাঞ্জাবি ঝেড়ে সভা শেষ করে আশ্বস্ত হয়, ‘‘এবার আমরা জিতবোই! মানুষ কিন্তু এত দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়নি কোনও কালে।---কী ঠিক বলছি না?’’ শ্রমিকেরা আর সময় নষ্ট করে না। যে-যার কলোনীর উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। ঘরে ফিরে তাদের অনেক কাজ। সন্ধ্যা বাতি জ্বালতে হবে, রেশন তুলতে হবে, ‘বেদ্দভাতার’ ফরম ফিলাপ করতে হবে, গমকলে আটা ভাঙাতে হবে।---- ছোট ছোট মাথা ওদের; কিন্তু অনবরত হাস্কিং মেসিনের চাকার মতো কত উদ্দেশ্যই না গুড়ো হতে থাকে ওদের মাথার ভেতর। ক্রমশ রাত্রি ঘনিয়ে আসে। মোটা চালের ভাত পেট পুরে খেয়ে সিরিয়াল দেখতে দেখতে বিছানায় এলিয়ে পড়ে শরীর। শুতে শুতে যেটুকু সময়, এর মধ্যে ভেবে নেয় আগামী কাল সরকার তাদের জন্যে কোন কোন অনুদান ঘোষণা করতে চলেছে। এইসব নিয়ে ওরা দুপুরে কর্মবিরতির ফাঁকে কৌতূহলী খোশগল্পে মাতিয়ে তোলে কর্মক্ষেত্রের চারপাশ।
ঝলসানো গাছের মতো হতশ্রী হয়ে গেছে মানিকের চেহারা। হতাশায় হতাশায় চোখ-দুটোর চাহনি যেন আরও ভয়ঙ্কর রকম করুণ দেখাচ্ছে। শুতে বসতে এখন সবসময় একটাই চিন্তা তার,--‘‘কী করে এমন হলো; এতবড় অঙ্কের বিপর্যয় তো হবার কথা নয়!’’ যে মানুষগুলোর সাথে মাঠে-ময়দানে, হাটে-বাজারে, ঘাটে-পথে নিত্য নিবিড় সখ্য---সেই রোদে পোড়া মানুষগুলোকে আজও চিনতে পারল না মানিক!?---‘‘বেইমান! বেইমান! সব শালারা বেইমান! বছরের পর বছর শুধু হাত পেতে নেবে আর চেঁচাবে!’’ একা একাই আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে মানিক। সুদীর্ঘ পরাজয়ের পথ জুড়ে এখন সবুজ আবীরের ছড়াছড়ি। ওই পথ ধরেই মানিক প্রতিদিন পাঁচ মাইল পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরে। আগে তো ফিরতই না। কোনওদিনবা মধ্যরাতে, কিম্বা এমনও হতো পার্টি-অফিসের বিড়ির পেছন আর চপ-মুড়ির উচ্ছিষ্ট নিয়ে এক আসন্ন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ত মানিক। কিন্তু সেই সুখ-নিদ্রা আজ একদম উধাও। এ তল্লাটে তাদের অধিকাংশ পার্টি-অফিস জ্বলে পুড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, নতুবা নতুন তালাচাবির দায়িত্ব পেয়েছে অন্য কেউ। ঘোষেদের আমবাগান পার হয়ে, মিঞাপাড়ার রহমত মোল্লার দলুজের কাছে এসে একটা বিড়ির নেশা চেপে বসল মানিকের। দেশলাই কাঠি ফোঁস করে উঠতেই মানিকের মুখটা দপ করে জ্বলে ওঠে। কিছু একটা চিন্তা করে, দেশলাই কাঠিটা চপ্পলে মাড়িয়ে; তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে দিয়ে টনপায়ে হাঁটা শুরু করে আবার। মাথার ওপরে বাঁকা চাঁদ, দু’একটি তারা--- সবাই যেন সমবেত ভোটার লাইনে দাঁড়ানো ইনট্রোভারট জনতার মতো বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে মানিকের উদ্দেশ্যে।
মাঝে মাঝে দুর্গামন্দিরে রাতজাগা মানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, ‘‘হেই আজ রাতে কাত্তিকের ফোনে ম্যাসেজ ঢুকেছে শুনলাম? ও তো এট্টা ইস্কুলে চাকরী করছে; তাহলে? তাছাড়া চাকরিবাকরির মতো একটা ব্যাপার রাতে রাতে কেন?’’ পুণ্যচরণের কথায় খেকিয়ে ওঠে কমল, ‘‘গুজব ছড়িও না তো বাপু! যা বোঝো না সেসব নিয়ে রাতের ঘুম কামাই কর কোন দুঃখে!’’ পায়ে পায়ে উঠে আসে মানিক। কাঁধের গামছা দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে পায়ের মশা তাড়ানোর ভান করে শুনতে চেষ্টা করে ওদের বক্তব্য। কিন্তু মানিককে দেখেই কমল ও পুণ্যচরণ কথা থামিয়ে দেয়। ওরা ঘৃণাভরে মানিককে প্রত্যাখ্যান করে যে-যার মতো ঘরে গিয়ে বিছানা নেয়। মানিকের বুকের মধ্যে যেন শুকনো বাঁশপাতার আগুন জ্বলে ওঠে! শিক্ষিত নির্বিবাদী মানুষের প্রতি সমাজের এহেন ঘৃণাবর্ষণ মানিক মেনে নিতে পারে না। রাত গভীর হয়। অন্যের জন্যে দুঃখ পাওয়া নেশা যাদের, তারাও মাঝে মাঝে নিজের জন্য; আপন ঘরের জন্য রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে! টিনের পাতলা চালের ওপর দু’এক ফোঁটা শিশির পতনের শব্দ অনুভব করে মানিক। মনে পড়ে শ্যামলীর মুখখানি। কত দিন হলো মানিক তার সাথে ভালো করে দুটো কথা বলার সময় পায় না। দু’দুটো প্রতিবন্ধী সন্তান। আর পার্টি-পাগল স্বামী; আজ সবকিছুকেই নিয়তি বলে মেনে নিতে শিখেছে শ্যামলী। পুরুষের ঔদ্ধত্ব গগনচুম্বী। রাজনৈতিক ভাবাবেগ এসব কিছুর আতিশয্যে শ্যামলীর গোলগাল, বেঁটেখাটো শরীরটাকেও নিতান্ত শামুকের খোল বলে মনে হতো মানিকের। কিন্তু আজ যখন মানিকের মতো মানুষেরা হতচ্ছাড়া খড়কুটোর মতো ঘূর্ণিঝড়ের মুখে উড়ছে; তখনই একমাত্র শীতলকুচির পুকুর বলে মনে হলো শ্যামলীর শরীরটাকে। যাকে জাপটে ধরে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলা যায়; আশ্লেষের পর ব্যর্থতার দায় নিয়ে একে অন্যের দোষারোপ করা যায়! তখন আর কিছু না থাক, ক্লান্ত বালিশের পাশে একজন নীরব শ্রোতা অন্তত থাকে!
আজকাল রোজ বেলা করে ঘুম ভাঙে শ্যামলীর। শত হলেও স্বামী তার একটু সংসারমুখী হয়েছে। মোটা চালের ভাত, সেই সাথে স্বামীর সোহাগ!--- এটুকু পেলেও সব মেয়েরাই চন্দ্রমুখী হয়ে ওঠে যে! কিন্তু বিপুল জানে মায়ের গোপন সুখের ইতিহাস। মায়ের ছোটোখাটো রান্নার জায়গাটা একটা গোপন জুতো কারখানায় পরিণত হয়েছে। বিপুলের পড়ার খরচ জোগাতে মা তার রাত জেগে লরির টায়ার কেটে চটির ছোল তৈরি করে ডাইসে। ঠুকঠাক করে আওয়াজ হয় সারারাত। বিপুল দামী এনজিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। স্বামী সম্মানীয় রাজনৈতিক কর্মী। পড়শিরা শুধু শুধু উপযাচক হয়ে স্বামীর ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে যাক, এটা শ্যামলী কেন চাইবে জেনে বুঝে? মাম্পীর একটা হাত সম্পূর্ণ বাঁকা। সে বসে বসে দ্যাখে, আজকাল দাদা সাইকেলটিকে খুব ঘষে মেজে পরিষ্কার করে ধা ধা করে চাকরি খুঁজতে যায়। প্রথমে পেপার কর্নারে, তারপরে ব্যাঙ্কের লম্বা লাইনের পেছনে, তারপর বিকেলের দিকে বন্ধ সুতো মিলের দরজার কাছে সাইকেলটিকে দাঁড় করিয়ে কী সব কাগজ বিড়বিড় করে পড়ে, আর খাতায় নোট করে রাখে। হাইওয়ের ধারে ফাঁকা জমি দেখলেও মোবাইলে ফটো তুলে সেটাকে বর্গফুটে ভাগ করার চেষ্টা করে। এরপর পুরোনো সাবেক আমলের লজঝরে ব্রিজটার ওপর দাঁড়িয়ে নদীর দিকে চেয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। কচুরিপানার দামগুলি সরতে গিয়েও সরে না; মরতে মরতেও মরে না। মাঝে মাঝে বিপুলের খুব ইচ্ছে হয়, ব্রিজটাকে একেবারে খুলে ওলোট পালোট করে এক এক করে তার নাটবল্টুগুলো সে সাজাবে। কিন্তু এদেশের একটাই রোগ, পুরোনো জিনিসের প্রতি মোহ একেবারে আঠার মতো!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বিপুল ঘরে ফেরে। টিউশান আছে। বোম্বেটো ছেলেদের বাবা পছন্দ করে না; এটা জানে বিপুল।
‘‘বলতো মাম্পি, এই সাইকেলটা ওয়েলেক্সে বেচলে, কত দেবে? জানিস, আজকাল ঘড়ি সাইকেল, পুরোনো আসবাব সবই ওয়েলেক্সে বিক্রি হয়?’’
‘‘ক্যান আমি ওটা নিয়ে রেশন তুলতে যাই বলে, তোর হিংসে হয়? তিন কিলো পথ ঠ্যেঙ্গিয়ে চাল আটা গম এনে খাওয়াই; তুই গবগব করে খাস, লজ্জা করে না? এবার তুই যাবি। আমি এক হাতে এত এত ভারী বোঝা আর কত টেনে টেনে খাওয়াবো তোদের?’’
মানিক বসে বসে খবরের কাগজে চোখ পুঁতে দিয়ে শুনতে থাকে ছেলে-মেয়ের কথাগুলো। হঠাৎ কী মনে হতেই হনহন করে উঠোনে নেমেই বিপুলের গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে বলে, ‘‘ক্যান, যোগ্যতা থাকলে চাকরী বাকরি করে দ্যাখা! সরকারি সাইকেল বিক্রি করে বাপের সংসারে কে দিতে বলেছে? মুখে চুনকালি লাগাবার জন্যে এতটা লেখাপড়া শিখিয়েছি তোমাকে? একজন রং মিস্ত্রির ছেলেও এমন বুদ্ধি ধরে না! দূর কর আমার চোখের সামনে থেকে ওই আপদ! না হলে, স্কুলের জিনিস স্কুলে ফেরত দিয়ে আয়!’’
মানিক আজকাল অতি সামান্য কথা, অতি তুচ্ছ কারণেও কেমন যেন খেকিয়ে উঠছে। কেউ হয়তো খালি একটা ফর্ম এনে বলল, ‘‘বাবা এটা একটু ফিলাপ করে দে না, রেশন কার্ডখানা নষ্ট হয়ে গেছে!’’ কিম্বা ‘‘কতদিন হলো বেদ্দভাতা পাইনি! বইটা একটু দেখে দে তো বাপ!’’ অমনি মানিক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘‘তোমরা সরকার গঠন করতে পারো; এত বুদ্ধি তোমাদের!---আর এই সামান্য কাজের জন্য এই অপদার্থ লোকটাকে এত দরকার? যাও তো বাপু, পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে যাও! তারাই দ্যাখো হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করেছে তোমাদের জন্য!’’ আজকাল ভিখারি বা কোনও সাহায্যপ্রার্থীকে দেখলেও রে রে করে তেড়ে আসে মানিক। দূর দূর করে উঠোন থেকে তাড়িয়ে দেয় তাদের। বলে, ‘‘যা শালারা! দু’টাকার চাল গিলে সারাদিন তাস পিটিয়ে আড্ডা মেরে মাচা গরম করগে যা!---- ভিক্ষে করে ব্যাঙ্কে টাকা জমানোর ধান্দা? শালার ছোটলোক!’’ ঘর থেকে কখনও সখনও মৃদু ভর্তসনার আওয়াজ ভেসে আসে, ‘‘উহু! নিজে কত আমীর! সংসারে হাঁড়ি চড়াতে যার ঘরের মেয়েমানুষকে দু’বেলা জুতোর তলা পেটাতে হয়, তার আবার আমীর উজিরের মতো নেকচার! এত নীতি না কপচে দুটো উপার্জনের চেষ্টা করলেও তো বুঝতাম কতখানি মরদ!’’ শুকনো পানাপুকুরের মতো চোখদুটো নিয়ে মানিক চেয়ে থাকে শ্যামলীর মুখ পানে। সেও কি আজকাল মানিককে ঘৃণা করে? ঘরের বাইরে দু’কদম এগোতেও মানিকের খুব কুণ্ঠা আজকাল। তবু মাঝে মাঝে দাসপাড়া, কলোনীপাড়া, সাহাপাড়া, মল্লিকপাড়ার মানুষের জন্যে মনের ভেতরটা তার হু হু করে ওঠে! মানুষগুলো ওখানে আজও ঘরছাড়া! হরেন, জিতু, নগেন---এদের সাথে কতকাল হলো আড্ডা দেওয়া হয়ে ওঠেনি মানিকের। পার্টি অফিসটা খুলতে না পারলে মাসোহারা তো দূরের কথা! সদস্যপদ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যেতে পারে মানিকের! সহসা চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে তার। ডাকে, ‘বিপুল----! তোর সাইকেলটা কোথায় রে?’ বিপুল ধড়মড়িয়ে ওঠে। ভাবে, আজকেও বুঝি বাবা ওটাতে হোঁচট খেয়েছে। সে আমতা আমতা করে বলে, ‘‘বোন আড্ডা দিতে রোজ রোজ ব্রিজে যায়। একদল ছেলের সাথে আজ ওকে গোঁ গোঁ করে সাইকেল নিয়ে ছুটতে দেখলাম। এইবার ঠ্যাকাও? আমি এট্টু বকি বলে, মা রোজ শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘তুই তাড়াতাড়ি নাইন পাশ দে মাম্পি। তুইও তাহলে আলাদা একখান সাইকেল পাবি!’’
সন্ধ্যার আগে সাইকেলের কেরিয়ারে করে গরুর জন্যে একবোঝা ঘাসপাতা নিয়ে ঝড়ের মতো ঘরে ফেরে মাম্পি। মানিক মেয়েকে কিছুই বলে না। শুধুমাত্র কটমট করে সাইকেলটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ঘরের প্রেম ভালোবাসা ওলা গুড়ের মতো আবারও উজিয়ে ওঠে মানিকের দেহ মনে। জুতোর তলা পেটানো বৌটাকে আর এত সময় দিয়ে কী লাভ? কতদিন হলো পার্টিলাইনে যোগাযোগ নেই। মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে আসা পাপ! এটা বোঝে মানিক। দেশের সব লোক সরকারের বগলের নীচে থাকে না; আরও অনন্ত খাপছাড়া মানুষের সমাহার নিয়েই তো দেশ! কুলি বৌটার কথা মনে পড়ে। ওর কটর কটর কথা; তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হালকা পাতলা রাজনৈতিক উস্কানি,-----এগুলো পাওয়ার জন্যে আবারও ব্যাকুল হয়ে ওঠে মানিকের জনমোহিনী হৃদয়!
মাঝরাতে শ্যামলীর খিল খিল আওয়াজে বিপুলের ঘুম ভেঙে যায়। মায়ের হাসি আর মোটে থামে না! সে কী হাসি! ‘‘উঁহু! মেয়েমানুষের ঘাড়ে চড়া, আর সাইকেল চড়া এক নয় বাপু! এবার নামো! আমি আর ধরে দাঁড়াতে পারছিনে! একটা প্যাডেল ঘুরোতে হাঁটু কেঁপে হাঁপিয়ে পড়ছো; বোঝো তো ইট ভাঁটার রাস্তাটা কদ্দুর?---- উনি নাকি পর ভুলানে মদ্দামানুষ!’’
বিপুল লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। বাবা তার সাইকেল চড়া শিখছে রাতদুপুরে! মা বেড়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে বাবার শরীরের ব্যালান্স। কী হাস্যকর! কী হাস্যকর! বিপুল পাশ ফিরে শোয়। সকাল হলে বাড়ি বাড়ি মেট্রো ডেয়ারীর প্যাকেট পৌঁছে দিতে হবে। উচ্চ শিক্ষিত ছেলে। সে জানে প্রতি প্যাকেট সেল হলে হাত খরচের টাকা উঠে আসে। তাছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে ইলেকট্রিকের বিল সংগ্রহ করে অফিসে জমা দিয়ে আসে সে। বিল পিছু পারিশ্রমিক পাঁচ টাকা। সাইকেলের চাকা এমনিই বনবন করে ঘুরতে থাকে। বিপুল এক পায়ের পাতা দিয়ে ধাক্কা দেয় প্যাডেলে। পাক খেয়ে ফিরে এলে আবার ধাক্কা; রাস্তা এগোয় দারুণ! অবসরে কর্মক্ষেত্রে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়, কাজের খবর আছে কিনা; নাহ! নেই। প্রতি পাতায় স্টে অর্ডার!
প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে দ্যাখে, একটি প্রতিবন্ধী ছেলে কী অদ্ভুত সাইকেল চালায়! শ্যামলী গর্বে ফুলে ওঠে; আর ঘন ঘন দু’হাত জোড় করে কপালে ঠ্যাকায়। শ্যামলী চায়, ছেলে বিপুল তার আরও দূরে, আরও দূরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ুক। যেখানে কল আছে, যেখানে কারখানা আছে,----- যে দেশে পড়ালেখা জানা ছেলেরা লাইনে দাঁড়ানোর আগেই চাকরি পেয়ে যায়,----ঠিক সেই দেশে! শ্যামলী মাঝে মাঝে আঁচল দিয়ে পরম মমতায় সাইকেলটির ধুলো ঝেড়ে দেয়; আর পুজো শেষে লুকিয়ে লুকিয়ে ওর ব্রেকের মাথায় একটি চন্দনের টিপ পরিয়ে ভাবে, ‘‘আর যাই হোক, বাজার করা, রেশন তোলা, গরুর ঘাসপাতা বয়ে আনা---এগুলো তো সাইকেলটার দৌলতে করা যাচ্ছে! এটাই বা আমার সংসারে কম কী!’’
মানিকের পাতে রেশনের মোটা চালের ভাত পড়লে, নাক মোটা মোটা হয়ে ওঠে। মুখে কিছু না বললেও শ্যামলী বুঝতে পারে, এটুকু মুখে তুলতেও তার প্রবল ঘেন্না! কিন্তু বাধ্য হয়ে তাকে পেটে দুটো ফেলতেই হয়। একদম ফাটা বাঁশে! কিচ্ছুটি করার নেই তার! মুখ খুললেই বিপদ! শ্যামলী চেঁচাবে; তখন পাড়ার লোক এসে হাতে তালি দেবে। এমনিতেই বিরোধী পক্ষের মানুষজনকে সহ্য করা পশ্চিমবঙ্গের গণসংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না।---এটা মানিকও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে! ‘‘মেয়েটি লাউডগার মতো ধ্যাড়ধ্যেড়িয়ে বেড়ে উঠছে। বাবা হয়ে এসব চিন্তা আছে তার!’’ শ্যামলী এসব একাএকা ভাবে আর নিমপাতার মতো ভাজাভাজা হয়ে ওঠে!
মানিক আজকাল শুয়ে শুয়ে সাইকেল চালায়! দু’পা উঁচু করে প্যাডেল ঘোরায়। শ্যামলী ঘুমের মাঝে তিতিবিরক্ত হয়ে চড় থাপ্পড় কষিয়ে দেয়! মানিকের ঘুম ভাঙে না। ও ভাবে বয়সকালে মেয়েমানুষেরা এভাবে আদর করে, কিম্বা মশা মারতেও অমন হাত চালায়। মাঝে মাঝে মশারীর দড়িও ছিঁড়ে পড়ে। মানিক তবুও থামে না। রাত শেষ হয়ে আসে; মানিকের গতি আরও বেড়ে যায়। আধ-ঘুম, আধ-জাগরণে সে স্পষ্ট অনুভব করে, ‘সত্যিই তো দিব্যি সাইকেল চালাতে শিখে গেছি! সকাল হলেই বিপুল হয়তো ইন্টারভিউ এর গল্প ভাজতে ভাজতে সাইকেলটা নিয়ে উধাও হয়ে যাবে! কিন্তু তার আগেই ওর গালে একটা থাপ্পড় কষিয়ে সাইকেলটা কেড়ে নেওয়া চাই’ই চাই! ছেলে ভ্যারেণ্ডা ভেজে বেড়াক গিয়ে; তাতে আমার কী! অনেক করেছি ওদের জন্যে! কিন্তু আর না! এভাবে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। যে কোনও মূল্যে আমাকে মানুষের কাছে পৌছতেই হবে। ম্যান টু ম্যান, ডোর টু ডোর! এটাই যে আগামী দিনের-পার্টি লাইন!’’
0 comments: