0

ধারাবাহিক - সুবোল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবোল দত্ত


॥১০॥


বিপন্ন ধাতুর পাতে ভেষজের আত্মসমর্পণ 


পেরো

হুঁশে ফিরে আসতে যে নিজেরই শরীরের সাথে এমন লড়াই লড়তে হয়, এটা পেরো কখনোই জানতো না। ওকে নিয়ে কেউ যেন শূন্যে লোফালুফি খেলছে। পুরো শরীরটা যেন বরফের গোলা। তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক নিজেকে নিজের মধ্যে ফিরে পাওয়ার মানসিক লড়াই পেরোর নতুন নয়। কিন্তু তবু টেনে হিঁচড়ে চেতনায় আসতেই শুরু হলো পেটে ও তলপেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। যেন নাড়ীভুঁড়ি অবাধ্য সাপের মতো ফণা তুলে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনেক চেষ্টা করেও সে এখানে কি করে এল আর কিইবা হয়েছিল কিছুতেই মনে করতে পারছে না সে।

শেষমেষ চোখের পাতা একটু খুলতে পারলো। খুলেই দেখলো উজ্জ্বল সিঁদুর রঙের বাঁশের বেতে ছাওয়া একটা চালার নিচে শুয়ে। সিঁদুর রঙএর বাঁশ! পেরোর কেমন অদ্ভুত লাগলো।দৃষ্টি আরএকটু ফর্সা হতে পেরো দেখল ঠিক বাঁশ নয় তবে বাঁশের মতোই অদ্ভুত ধরনের লাল কাঠ, গাঁঠগুলো চওড়া মসৃণ আর হরেকরকম সুন্দর কারুকাজ করা। সেগুলোর উপরে বড়বড় তালপাতার মতো সিঁদুর রঙএর শুকনো পাতা দিয়ে ছাওয়া ঘরের ভিতরে সে শুয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই সে মনে করতে পারছিল না সে কে আর কেনই বা তার এই দশা। ধীরেধীরে শরীরের সাড় ফিরে আসতে পেরোর মনে হলো সে যেন একটা সর্ষে আর হাওয়া ভরা খুব নরম ঠাণ্ডা একটা গদির ভিতরে ডুবে আছে। একটু মাথা তুলে ভালো করে দেখেই পেরো হয়রান হয়ে গেল। বিছানাটা কোনও তোষক নয়। মস্ত বড়বড় পদ্মপাতায় হালকা করে তার পুরো শরীরটাই মোড়া। আর পুরো শরীরটাই ঘৃতকুমারীর রসের মতো হলুদ পিছল রসে মাখামাখি। এতো ঠাণ্ডা আর গুড়ের মতো এমন গাঢ় চ্যাটচ্যাটে রস যে আঙুল পর্যন্ত নড়াতে পারছে না পেরো। একটু নড়াচড়ার অসফল চেষ্টার পর পেরো চুপচাপ পড়ে রইল। হাতপা এর সাড় নেই। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। পেরো অন্য যেকোনও মানুষ থেকে একটু আলাদা এ কথাটা সাবজী বারবার বলেন। যন্ত্রণা সইবার অসম্ভব ক্ষমতা পেরোর। মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোয় না। ওইভাবে যন্ত্রণা সহ্য করে কিছুক্ষণ পড়ে থাকতে থাকতেই একটা আরো তীক্ষ্ণ ব্যাথা তার সারা দেহ কাঁপিয়ে মুখ দিয়ে বার হলো। মুখ দিয়ে শুধু চিত্কার বেরলো না, একটা কালো পিচের মতো তরল ঝলকে ঝলকে বার হতে লাগলো। চোখের সামনে লাল বাঁশের চালা বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে লাগলো। ঠিক তখনই একটা মেয়েলি রিনরিন কণ্ঠ শুনে তার সব কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু আবার অজ্ঞান হয়ে গেল।

দুর্গম পাহাড়ী জঙ্গলে পেরোর অনায়াস বিচরণ এবং সে এত সতর্ক থাকে যে ছোটো চোরা গর্তও তার নজর এড়ায়না। কিন্তু পেরোর মাথায় কি দুর্বুদ্ধি এসেছিল, দৌড়ে গিয়ে ওই লুকনো গভীর ফাটলের হাঁ মুখে পড়েছিল। আসলে ওই গর্তটা হলুদ স্বর্ণলতার ঘন জাল ও বনখেজুরের ঝোপে ঢাকা ছিল। পেরো ভেবেছিল একটা লম্বা লাফ দিয়ে পার হয়ে যাবে। কিন্তু সেই ফাটলের হাঁ মুখ দিয়ে সরাসরি গলে গিয়ে একটা প্রায় তিনশ মিটার ন্যাড়া দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়ের নিচে খাদে পড়ে গিয়েছিল। সেই অতল খাদ আসলে একটা পাঁকে ভর্তি জলাভূমি।পাহাড় বেয়ে পড়তে পড়তে দু চারবার পাথুরে দেওয়ালে পেরোর শরীর ধাক্কা খায়। একটা বাবলা গাছের লম্বা লম্বা কাঁটার ঘায়ে তার পেট ও হাত পা কোমর চিরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তারপর তার শরীরের প্রায় অর্ধেকটাই পাঁকে ডুবে যায়। পেরো এমন খাড়া ভাবে পড়েছিল যে তার বুক অব্দি জল ও কাদাতে ডুবে ছিল। ওই অবস্থাতে পেরো প্রায় দু তিন ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে রয়েছিল। ওই অবস্থাতেই যখন জ্ঞান ফিরলো তখন পেরো দেখল তার চারপাশে উজ্জ্বল নীল আর হলুদ রঙের বড়ো বড়ো পদ্মফুল। আর মোটা মোটা ডাঁটার উপরে মস্ত বড় বড় পদ্মপাতা উঁচু ছাতার মতো তাকে অদল করে আছে। প্রচুর ছোটো ছোটো মাছির মতো কিছু তার মাথার চারপাশ ঘিরে উড়ছে। একটু মাথা ঘুরিয়ে দেখল তার খুব কাছে একটা বড় পদ্মপাতার নিচে একটা ছোটো মৌচাক থেকে বেরিয়ে ওগুলো উড়ছে। তার মানে ওগুলো মৌমাছি! ওই মৌচাকে পদ্মমধু আছে! মৌমাছিগুলো ওর গায়ে মুখে বসছেনা। সেও কিন্তু কোনওমতেই নড়তেচড়তে পারছিল না। তবে তার চেতনা ফিরে আসাটা ছিল ক্ষণিক। শরীরের নিচের ভাগ আছে কি না বা আদৌ কি ছিল সেটা মনে করতে করতেই আবার জ্ঞান হারিয়েছিল। আবার দীর্ঘসময় পর যখন তার জ্ঞান ফিরলো দেখল চারপাশে আর সেই পদ্মফুলের বন নেই। মাথার উপরে পরিষ্কার নীলাকাশ। সে মস্তবড় নরম সবুজ পদ্মপাতায় শুয়ে। হাত দুটো কোনও খুঁটিতে বাঁধা। খুব কাছে এক নারী তাকে ছুঁয়ে আছে। আর দুজন খালি গায়ে বয়স্ক মানুষ তার শরীর কাটা ছেঁড়ায় ব্যস্ত। শরীরে কোনও সাড় নেই আর ওরা কেন আর কি জন্যে এইসব করছে আর এরজন্যে তাকে কি করতে হবে সে কোনওমতেই বুঝতে পারছিল না। একবার শরীর মোচড় দিয়ে হাতের বাঁধন খুলতে চাইল কিন্তু ওই মেয়েটি তার মুখে বুকে হাত বুলিয়ে দিতে সে স্থির হয়ে অবোধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার জ্ঞান হারালো।

আবার যখন জ্ঞান ফিরলো পেরো শুনল তার খুব পরিচিত মাতৃভাষা। সেই মেয়েটি আর তার পাশে সেই দুটো লোক। ওরা তারই খেড়িয়া শবর ভাষায় কথা বলছে। কিন্তু ওদের গায়ের রঙ এত স্নিগ্ধ আকাশী নীল আর গোলাপী রঙের! পেরো দেখল মেয়েটি তার খুব কাছে ঘেঁষে রয়েছে। উঁচু সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসা কপাল। থ্যাবড়ানো নাক। পুরু ঠোঁট। চেহারার গঠনে ও খেড়িয়া শবর কিন্তু গায়ের রঙ নীলচে গোলাপী। আর স্বাস্থ্য! এইরকম সুঠাম নীরোগ শরীর পেরো আগে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। কথা বলছে যেন মধু ঝরে পড়ছে। এমন সুন্দর ঝকঝকে সাদা দাঁত পেরো আগে কখনও দেখেনি। এতো মনোরম স্বর্গীয়! তবে কি স্বর্গে এসে গেছি আমি? পেরো দেখল তার গা থেকে পদ্মপাতার মোড়ক খোলা হচ্ছে। মেয়েটি তার খুব কাছে বসে একটা নারকেলের খোলে রাখা মধুর মতো কিছু তার ঠোঁটের কাছে আনলো। একহাত দিয়ে পেরোর ঠোঁট খুলে হাঁ মুখে সেই তরল ঢালতে লাগলো। দুই বয়স্ক মানুষ তখন তার শরীরের ক্ষতের উপচারে ব্যস্ত। তিনজনেই নীচুস্বরে কথা বলে চলেছে।

ওদের কথাবার্তা শুনে পেরো বুঝল ওকে জড়িবুটির ওষুধ পদ্মমধুর সাথে খাওয়ানো হচ্ছে। পেরোর পেটের অনেকটা জুড়ে সেলাই করা হয়েছে। সেটা করা হয়েছে বিশেষ ধরনের মিহি রেশম সুতো দিয়ে। বমির সাথে পেটের ভিতর থেকে কালো কালো তরল বেরিয়ে আসাই নাকি পেটের ভিতরের মারাত্মক ক্ষতে জমে থাকা বদরক্ত। তবে এখন অনেকটাই আরোগ্যের মুখে। এছাড়াও শরীরের অনেক জায়গায় গভীর ক্ষত। সেগুলোতেও ছোটোখাটো সেলাই করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা শুনল পেরো। ওর এখানে থাকা আজ তিনদিন হলো। মেয়েটি ওকে ওষুধ খাওয়ানোর পর পেরোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শরীরে ব্যাথা থেকে থেকে ফুঁসে উঠছে। কিন্তু পেরোর ভীষণ ভালো লাগছে। এই অসাধারণ ভালো লাগা জীবনে কোনওদিন আসেনি। এই অসম্ভব ভালোলাগার আমেজে পেরো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

0 comments: