0

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য

Posted in


প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক
মিথিল ভট্টাচার্য্য



চতুর্থ পর্ব
প্রথম আক্রমণ তিনি শুরু করেন অনার্য গুপ্তঘাতিকা পুতনাকে দিয়ে, কিন্তু গোকুলের সদা সতর্ক লেঠেল বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকায় নাকি সুপ্রসন্ন ভাগ্যের কারণে শেষ পর্যন্ত সেই আক্রমণ থেকে বেঁচে যায় যাদবদের একমাত্র নির্ভর স্থল সেই ছোট্ট শিশু।

এরপর একের পর এক আক্রমণের স্রোত এসে ভিড়তে থাকে গোকুলের ভূমিতে শুধুমাত্র সেই অবোধ বালককে হত্যার প্রচেষ্টায়। কিন্তু বারংবার কোনও এক অজানা শক্তির পরিহাসে ব্যর্থ হতে থাকে মথুরাধিপতির সমস্ত প্রয়াস। গোকুলে নন্দ সর্দারের গৃহে পরম যত্নে বড় হতে থাকে তার সব থেকে বড় শত্রু। বরং এই একের পর এক আক্রমণ সেই অবোধ বালককে তার জীবনের সর্ব শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রদান করেছিল। সদা সজাগ ও সতর্ক থাকার শিক্ষা, নিজের শত্রুর ক্ষমতাকে কখনও অবহেলা না করার শিক্ষা, অজান্তে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে আশা গুপ্ত আক্রমণকে ঠেকানোর শিক্ষা।

এরপর একসময় নন্দ সর্দার এই গুপ্ত ঘাতকের আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেতে গোকুল গ্রাম থেকে আরও দূরে সরে যান বৃন্দাবনের নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু এই বৃন্দাবনেই কংসের সব থেকে বড় অস্ত্র হয়ে কিশোর কৃষ্ণের প্রাণ হরণ করতে আসেন নাগ জাতির এক পরাক্রান্ত নেতা কালিয় সর্দার। নিজের রাজ্যকে গরুড় জাতির আক্রমণ থেকে মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে অনিচ্ছা সহকারেও মথুরাধিপতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এই নাগ সর্দার।

কংসের সব থেকে বড় শত্রুর প্রাণ হরণের ইচ্ছা নিয়ে তার আগমন হয়েছিল বৃন্দাবনে। কিন্তু যে হত্যাকারীর মন নিয়ে মানুষটির আগমন হয়েছিল বৃন্দাবনের ভূমিতে, কৃষ্ণের বদলে নিজের হাতে নিজের সেই হত্যাকারীর সত্বাকে হত্যা করে এক নব রূপে পরিত্যাগ করছিলেন তিনি বৃন্দাবন। তাকে বধ করতে আসা এই নিরুপায় মানুষটি কখন যেন নিজের অজান্তেই নিজের অন্তরে প্রদান করেছিলেন একাধারে শিষ্য ও পুত্রের গভীর স্থান। নাগ জাতির বহু গোপন কৌশল ও যুদ্ধ নীতির প্রথম পাঠ এই মানুষটির কাছ থেকেই পেয়েছিলেন সেই দিনের সেই কিশোর কৃষ্ণ।

আর তার ফিরে যাওয়ার পরেই অকস্মাৎ আগমন মহাসামন্ত অক্রূরের। মহাসামন্তের বক্তব্য, তার মাতুল মথুরাধিপতি মহারাজ কংস নাকি অবশেষে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তার করা অন্যায় ও পাপের গুরুত্ব। কৃষ্ণের পরাক্রম, চতুরতাকে দীর্ঘ দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে তিনি শেষ পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে তার অবর্তমানে মথুরার সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী যদি কেউ থেকে থাকে তবে তা একমাত্র কৃষ্ণ। কালিয় সর্দারের প্রেরিত একটি বিশেষ পত্রও নাকি তার এই বিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করেছেন। আর সেই কারণেই তিনি মহাসামন্তকে বৃন্দাবনে পাঠিয়েছেন মথুরার ভবিষ্যৎ নায়ককে সসম্মানে তার জন্মভূমিতে নিয়ে আসার জন্য।

কিন্তু মহাসামন্তের এই আগমন মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিয়েছিল একাধিক জীবন, আর তার সঙ্গেই নিয়তির পরিহাসে এক মুহূর্তে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছিল মাত্র পনের বছরের এক কিশোরের জীবন, সেই দুর্ভাগা কিশোরকে সেদিন সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে। স্তম্ভিত, রুদ্ধবাক সেই কিশোরকে বাধ্য হয়ে সেদিন জানতে হয়েছিল তার জীবনের এই তিক্ত ইতিহাস। এরপর এই তিক্ততাকে স্বীকার করতে না করতেই এসেছিল কর্তব্যের আহ্বান, নিজের জন্মদাতা পিতা মাতার ও বৃদ্ধমাতামহের প্রতি কর্তব্য, মথুরার প্রতি কর্তব্য এবং সর্বোপরি যাদব গোষ্ঠির প্রতি কর্তব্য। সমস্ত ঋণশোধের নীরব আকুতি নিয়ে যাদব গোষ্ঠির এক প্রতিনিধি সেদিন এসে দাড়িয়েছিল তার সামনে। আর সেই আকুতিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ছিলনা সেদিন সেই পনের বছরের কিশোরের। কিন্তু সেই আকুতি আর কর্তব্যের আহ্বান একদিকে যেমন তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিল মথুরার পথে, তেমনি অন্যদিকে এক ব্যাকুল পিছুটান প্রাচীর হয়ে তার জীবন পথের এই অধ্যায়ের সামনে এসে দাড়িয়েছিল। মা যশোদার অলংঘনীয় ভালবাসার প্রাচীর, বৃন্দাবনের প্রতিটি মানুষের আন্তরিক টানের বন্ধন আর সব শেষে নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়ানো সেই একজনের অনুচ্চারিত দাবিহীন ভালবাসার প্রাচীর। একে এড়িয়ে যাবার সাধ্য ছিলনা তার সেই দিন, মাতা যশোদাকে কোনক্রমে শান্ত করে এই কর্তব্যের দুর্বার বোঝা থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজতে এক মুহূর্তে চন্দ্রালোকিত রাত্রেই সে ছুটে গেছিল যমুনা নদীর ধারের সবুজ গাছের ছায়ায় তাদের চিরপরিচিত সেই নিভৃত প্রিয় স্থানে, সেই একজনের সন্ধানে। না, কোনও বারের মতো এবারও তাকে নিরাশ করেনি সেই নিঃশব্দচারিণী। তাদের চির পরিচিত স্থানে বরাবরের মতোই হাসি মুখে তার অপেক্ষায় ছিল সে, তার শান্ত আয়ত চোখদুটি তুলে। কৃষ্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছিল সেই দৃষ্টির সামনে পরে, মহাসামন্ত অক্রুরের আগমনের উদ্দেশ্য বৃন্দাবনের প্রতিটি গৃহে আজ পৌঁছে গেছে, যমুনা নদীর ধারের প্রতিটি প্রান্তকে আজ ছুঁয়ে গেছে এক ভাষাহীন বেদনার ছায়া। কিন্তু মাতা যশোদা ভিন্ন যাকে এই বেদনা সবথেকে বেশি স্পর্শ করা উচিত তার মুখের কোথাও এই বেদনার ছায়াও খুঁজে পেলনা সে। কোনও অসহণীয় কষ্টের ছাপ নেই তার ওই দুটি আয়ত চোখে, নেই কোনও অভিমান কোনও অভিযোগ বা নিজের সব থেকে কাছের মানুষকে হারানোর কোনও সীমাহীন আশংকা। তার জীবনে আসা প্রতিটি মানুষকে স্তব্ধ করে দেওয়া কৃষ্ণ আজ জীবনে প্রথমবার নিজে স্তব্ধ হয়ে গেছিল তার চিরপরিচিতার এই অপরিচিত সত্বার মুখোমুখি হয়ে। কিছুক্ষণ সব কিছু ভুলে গিয়ে ওই শান্ত সমাহিত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েছিল সে, তারপর ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এসে ওই শান্ত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বলে উঠেছিল "মথুরা থেকে মহাসামন্ত অক্রুর এসেছেন বৃন্দাবনে, তিনি এক অদ্ভুত সংবাদ নিয়ে এসেছেন, তিনি বলছেন, তিনি --" আর কিছু সে কোনওমতেই বলে উঠতে পারেনি, জীবনে প্রথমবার এক অদ্ভুত সংকোচ এবং দ্বিধা তাকে মূক করে দিয়েছিল। সে ভেবেছিল হয়ত কোনওভাবে এই সংবাদ এখনও এসে পৌঁছয়নি তার এই ছায়া সঙ্গিনীর কাছে, কিন্তু একটা তীক্ষ্ণ অথচ মধুর হাসিতে তার এই ভ্রম ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিতে এক মুহূর্ত দেরী করেনি সেই একজন। একটা মধুর কৌতুকে ভরা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠেছিল "তুমি কি সত্যি মনে কর বংশীধারী, বৃন্দাবনের হৃদয়ের রাজত্ব করে যে তার জীবনের এত বড় একটি সংবাদ বৃন্দাবনের একটি মানুষেরও এখনও অব্দি জানতে বাকি থাকবে? না কি তুমি মনে কর তোমার জীবনের বিষয়ে এতটাই উদাসীন আমি?"

স্তম্ভিত কৃষ্ণ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে, তারপর বিহ্বল স্বরে সে বলে উঠেছিল "তুমি জানো এই সত্য, কিন্তু সব জেনেও এতটা সহজে কিভাবে একে গ্রহণ করেছ তুমি? তুমি কি আগে থেকে জানতে এই ইতিহাস আমার পিতার মতো?"

আগের মতোই এক মুখ শান্ত মধুর হাসি নিয়ে সে বলে উঠেছিল " না বংশীধারী আক্ষরিক সত্য আমি সত্যি আজকের আগে জানতাম না। কিন্তু ভবিষ্যতে যে বৃন্দাবনের এই ছোট্ট গ্রামের সীমারেখায় তোমাকে কোনদিনও ধরে রাখা যাবেনা তা আমার থেকে ভালো আর কেই বা জানতে পারে ?"

(ক্রমশ)

0 comments: