ছোটগল্প - সুমিত নাগ
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
চিকেন কষা ও কয়েকটা পকোড়া
সুমিত নাগ
।।১ম, অন্তিম।।
বলটা উঁচু হয়ে গিয়ে পড়ল ঝোপের মধ্যে যেখানে মাটিটা ঢালু হয়ে গিয়ে সামনের ডোবাটায় মিশেছে। সবাই ‘হাঁই হাঁই’ ক’রে উঠল। ওদিকে বল গেলে, খুঁজতে খুঁজতেই অনেক সময় চলে যায় এত আগাছা, কাঁটাগাছ, ছোটছোট দূর্বা-র জঙ্গল, তার ওপর এখন কিছুটা অন্ধকার হয়ে এসেছে, কালো সন্ধ্যে নামতে দেরি নেই। পান্তু অপরাধীর মতো ব্যাটটা হাতে নিয়ে, এর-ওর বেজার মুখ দেখতে-দেখতে এগিয়ে গেল সেই দিকে। নিয়ম, ঐ দিকে যে বল মারবে, সেই নিয়ে আসবে খুঁজে। পান্তু ব্যাট দিয়ে আগাছাগুলো মারতে-মারতে, আন্দাজ মতো যেদিকে বলটা প’ড়ে থাকতে পারে, সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগল। কিছুটা এগোতেই দেখতে পেল বলটা প’ড়ে আছে কয়েকটা কুমড়োর পচা ফালি, আনাজের খোসা, পিঁয়াজ, পেঁপের টুকরো- এইসবের মধ্যে। স্টাম্পার বলের রঙটা বেশ গাঢ় বেগুনি, কালো মতো দেখাচ্ছে সন্ধ্যের মুখে। এখানে তো কেউ বাড়ীর আনাজ কুটে ফেলতে আসবে না? একথা বারো বছরের পান্তুর মাথায় এলো না। তার মাথায় তখন বল ঘুরছে। সে লম্বা লাফ দিয়ে কাঁটাগাছ ডিঙিয়ে বলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আর নিচু হয়ে তুলতে হাত বাড়াল। বলটা তুলতেই তার আঙুলে বিদ্যুৎ শক লাগল যেন, নিয়েই হাত থেকে ফেলে দিল ছিটকে, শিউরে উঠে। এত নরম, ভিজে ভিজে কেন? সে কোনও মতে মুখ নামাল হাত থেকে নিজের পায়ের কাছে প’ড়ে যাওয়া জিনিসটা দেখতে। বিশেষ কিছু না, একটা কালো বেড়ালের মাথা গলা থেকে কাটা, মনে হচ্ছে যেন একটা কালো রঙের বল! পান্তু আর্তনাদ করে উঠল।
কিছুটা দূর থেকে রমিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখছিল। বিকেলের দিকে বিশেষ কোনও কাজ থাকে না ওর, চিরুনি হাতে নিয়ে, এসময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোকে খেলতে দেখে। কিছুই না, কেবল সময় কাটানো। পান্তু বলে ছেলেটা যখন বলটা ওদিকে মারল আর ব্যাট হাতে বলটার খোঁজে আগাছা পেটাতে পেটাতে গেল, রমিতার মাথায় তখনও কিছু আসেনি। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটার আর্তনাদ রমিতার বুকটা যেন খাঁ খাঁ করে বেরিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রমিতার চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন চক্কর দিয়ে উঠে অন্ধকার হয়ে গেল আর ‘ওয়াক’ দিয়ে উঠল সারা গা, আরও একবার।
।।২য়, চতুর্থ।।
অনেক দিন পর সুজুর শরীরে সেই বিদঘুটে গন্ধটা আর পেল না ও। প্রাণটা যেন জুড়োল। শান্তি! শান্তি! শান্তি! ও ধীরে ধীরে অনুভব করল, সুজু আরও নিচে নামছে, হাতটা আবার সেই প্রথম দিনগুলোর মতো, খোসা ছাড়িয়ে নিচ্ছে যেন। ওর মনে ছিল না, কিন্তু অনেকদিন পর দেখে পার্থক্যটা সুজুর চোখ এড়িয়ে গেল না স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু পরম আশ্লেষের মুহূর্তে সুজু কিছু বলল না, কিন্তু একবারের জন্য হলেও অবাক হয়ে রমিতার মুখের দিকে দেখে নিল। সুজুর ইচ্ছে হলো না কিছু জিজ্ঞেস করতে এই মুহূর্তে আর, তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুকে আরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যেখানে সে কিছুকাল আগেও খরখরে, ঘন, কালো লোমের আবরণ দেখেছিল, আজ যার চিহ্ন মাত্র নেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রমিতা একবার বমি করল। তারপর দুপুরের দিকে আরও একবার। রঞ্জা, ওর শাশুড়ি, বলল, ‘কী হলো তোমার রমি? শরীর খারাপ নাকি?’
রমিতা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না মা, আসলে একটু অম্বল মতো হয়ে গেছে। কাল খাওয়াটা তো একটু অনিয়ম হলো...।’
রঞ্জা বলল, ‘কী হলো আবার! রাতে ব’সে ব’সে তুমি ঐ পকোড়াগুলো খেয়েছিলে নাকি?’
রমিতা কিছু উত্তর করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পকোড়ার কথা মনে আসতেই আবার ভেতর থেকে শরীরটা আনচান করে উঠল। ‘ওয়াক’ তুলতে তুলতে ছুটল বাথরুমের দিকে। যেটা বলল না, বলবেও না, যে পকোড়াগুলো সে সকালেই বাইরে ফেলে দিয়ে এসেছে।
বিকেলে শরীরটা আরও খারাপ হলো রমিতার। কাল সারাদিন বেশ খাটাখাটনি গিয়েছিল। সকালে সুজু চিকেন এনেছিল, দুবেলা খাওয়া হলো সেটা। আবার কিছু পকোড়াও ভেজেছিল রমিতা আলাদা করে। বাড়ীতে লোক বলতে স্বামীস্ত্রী, শাশুড়ি, এক দেওর আছে রমিতার- শমি, এক ননদ- মুনু, এদের দুজনেই ছোট রমিতার চেয়ে, কলেজে পড়ে আর এক সারাক্ষণের কাজের লোক, সন্ধ্যাদি। যদিও সন্ধ্যাদি কয়েকদিন নেই, দেশের বাড়ী গেছে। রাতে বাড়ী ফিরে সুজু দেখল, বউয়ের পাঁচবার বমি হয়েছে, ক্লান্ত লাগছে মুখ দেখে।
রঞ্জা বলল, ‘সুজু, ওকে ডাক্তার দেখিয়ে আন। কী থেকে কী হয়ে যায়!’
রমিতা শুয়ে শুয়ে বলল, ‘না না, এখন ডাক্তার লাগবে না। এখন অনেক ভাল আছি আমি।’
শমি বলল, ‘আমি বরং একটা ওষুধ কিনে আনি দোকানে ব’লে, কী বল?’
সুজু বলল, ‘তাই কর। নাহলে কিছু দেখিয়ে আনব,’ বলে ও পার্স থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে শমিকে দিল।
রাতে রমিতার শরীরটা একটু ভাল হলো ওষুধ খেয়ে। রমিতা বলল, ‘দেখলে, বলেছিলাম কিনা! কিছুই হয়নি।’
সুজু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো একবার। বলল, ‘আচ্ছা, তুমি লেবুকে কোথাও দেখছ? এসে থেকে তো দেখলাম না।’
রমিতা মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।
ও শুনল সুজু বাইরে গিয়ে রঞ্জাকে একই কথা জিজ্ঞেস করছে। রঞ্জা উত্তর দিচ্ছে, ‘যা যাচ্ছে সকাল থেকে আর অত খেয়াল আছে নাকি? দ্যাখ, কোথায় মটকা মেরে বসে আছে, মর্জি হলে বেরোবে তখন।’
এমন সময় রমিতা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো, আর ঘরের সামনেই হড়হড় করে বমি করে দিল।
পরের দিন অফিস বেরোল না সুজু। বেলার দিকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেল রমিতাকে। কিছুই তেমন নেই। ডাক্তার বললেন, ‘খাওয়া-দাওয়া থেকেই হয়েছে ব্যাপারটা। তবে একটা ইউএসজি ক’রে রাখা ভাল! সেফ থাকা, আর কিছুই না,’ বলে প্রেসক্রিপশন ছিঁড়ে প্যাড থেকে সুজুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
বিকেলের দিকে রমিতার শরীরটা বেশ ভাল লাগল। ওষুধ খেয়ে ঝরঝরে লাগছে। ও অভ্যাস মতো ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনিটা বের করল, তারপর চুলে বোলাতে বোলাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সুজু ভাতঘুমে তখনও কাদা। রমিতা রেলিঙে হাত রেখে দেখল বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে ইতিমধ্যে, সন্ধ্যে নামতে বেশি দেরি নেই। ছেলেগুলো এখনও খেলছে যদিও। দেখতে দেখতে পান্তু ব’লে ছেলেটা বলটা উঁচু করে মারল। ছেলেটা পাশের দুটো বাড়ী পরেই থাকে। তারপরেই ও দেখল পান্তু ব্যাট হাতে আগাছা গুলো পেটাতে পেটাতে বলটার খোঁজে সেই ডোবার ধারের জঙ্গলটার দিকে যাচ্ছে।
।।৩য়, তৃতীয়।।
সকালে সুজু মাংস নিয়ে এসেছে। রঞ্জা দেখে বলল, ‘আজ কেন আবার মাংস আনলি সুজু? একা রমি কী করে সব করবে? তোর না বুদ্ধি কিছু হবে না কোনওদিন। সন্ধ্যা দুদিন হলো গেছে, একটা রবিবার মাংস নাহলে কি আর হচ্ছিল না নাকি?’
সুজু বেজার মুখে বলল, ‘তুমি আমায় বেকার বকছ মা। রমিই বলল কাল রাতে, মাংস করবে, তাও নিজে হাতে। আমি তো বারণই করেছিলাম।’
রমিতা ঘর থেকে বলল, ‘মা, কোনও সমস্যা হবে না দেখুন না। আমি সব গুছিয়ে করে নেব।’
- ‘সেটা হ’লে ভাল। আমাকে আবার যেন কিছু বলো না। আমি আর এই বুড়ো বয়েসে মাংসের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারি না।’
- ‘না মা, কোনও সমস্যা হবে না। আমি ঠিক করে নেব।’
সুজু ঘরে ঢুকতে রমিতা বলল, ‘একটু বেশি করে এনেছ তো? আমি রাতে কষা করব কিন্তু।’
-‘এনেছি তো। বললে তো রাতে। মনে থাকবে না?’
-‘আর মায়ের জন্য ফুলকপি এনেছ তো? মা তো আবার...।’
-‘হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ, সব এনেছি...।’
রমিতা সুজুর দিকে তাকিয়ে হাসল। সুজু হাসি ফিরিয়ে দিল না। রমিতা বুঝল ব্যাপারটা কী। ও মনে মনে বলল, ‘নাহ, আমাকে করতেই হবে। আর কোনই উপায় নেই এছাড়া।’ কথাটা মনে অনেক জোর আনল ওর।
সন্ধ্যের দিকে সুজু, শমি, মুনু সবাই বেরিয়ে গেছে। রমিতা চুপিচুপি মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল রঞ্জা সন্ধ্যের জপে বসেছে। তার মানে একঘণ্টা নিশ্চিত। রমিতা ধীর পায়ে ছাদের সিঁড়ির সামনে গিয়ে ডাকতে লাগল ‘লেবু, লেবু।’ ডাকটা এমন যেন শব্দটা মায়ের কানে না পৌঁছয়। সে আগে থাকতে দেখে রেখেছিল লেবু ছাদের সিঁড়ির কাছে ঘুপটি মেরে শুয়েছিল।
রঞ্জা জপ সেরে বাইরে বেরিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখল, রমি ইতিমধ্যে রাতের রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। রঞ্জা একটু অবাক হলো দেখে।
- ‘কী ব্যাপার রমি, আজ তুমি এত তাড়াতাড়ি রান্না বসিয়ে দিলে?’
- ‘আসলে চিকেন কষা করব রাতে।’
-‘এখন কী করছ?’
-‘এই কয়েকটা পকোড়া ভেজে রাখছি’- রমিতা ইতস্তত ক’রে বলল, যেন ইচ্ছে নেই বলার তাও বলতে হয় ব’লেই বলল। তার নিজের ওপর অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করছিল। মা জপ এত তাড়াতাড়ি শেষ করল আজকেই? সে পকোড়ার প্রথম টুকরোটা কড়ায় ছাড়ল, ‘ছ্যাত’ করে আওয়াজ হলো গরম তেলে পড়ে, ওর বুকটাও ‘ছ্যাত’ ক’রে উঠল।
-‘এখন থেকে পকোড়া ক’রে রাখছ? নরম হয়ে যাবে।’
-‘না মা। রাতে গরম করে দিলেই হবে। তখন আর সময় পাবো না, কষা করতেই সময় চলে যাবে।’
রঞ্জা আর কিছুই বলল না। ও বেরিয়ে যেতেই রমিতা বঁটিটা ঝট করে একবার দেখে নিল। বেশ বড় আকারের বঁটি, ভাল করে ধোয়া হয়ে গেছে, আর কোনও চিহ্ন নেই, কিছুরই।
খেতে বসে দেখা গেল চিকেন কষা এত ভাল হয়েছে যে সবাই ওটাই চেটেপুটে খেলো।
রঞ্জা এসে বলল, ‘একী! রমি তুমি যে পকোড়া করলে ওদের দাওনি?’
সুজু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল, ‘সেকী! তুমি দিলে না আমাদের?’
রমিতা যেন চমকে উঠল কথাটা শুনে- ‘নাহ, একদম ভুলে গেছলাম,’ ব’লে দাঁড়িয়ে রইল। রঞ্জা বলল, ‘কী আনবে তো?’
রমিতা ধীর পায়ে রান্না ঘরের ভিতরে গেল। পকোড়াগুলো সে যে খাবার জন্য করেনি তা বলবে কী করে? কিন্তু এছাড়া লুকনোর আর কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু মা দেখে ফেলল। নিজের ভুলে ওর গা ‘রি-রি’ করতে লাগল। কিছু করার নেই, ও পকোড়াগুলো নিয়ে এলো, কী অজুহাতে সেগুলো সবাইকে খেতে দেবে না, সেটাই ভাবছিল ও।
মুনু বলল, ‘আমি আজ আর খাব না বউদি। খাওয়া তো শেষই।’ শমির খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল।
রমিতা তাড়াতাড়ি বলল, ‘সেই ভাল। রেখে দেবো, কাল খেও।’
রঞ্জা বলল, ‘কেন তোর শরীর খারাপ নাকি?’
-‘শরীর খারাপ কেন হবে? ইচ্ছে নেই আর।’
রঞ্জা গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেল নিজের।
রমিতা সুজুকে আসতে করে বলল, ‘তুমি খাবে?’
সুজু ওর দিকে স্থির চোখে দেখল। তাতে যে অভিমান জমা আছে তা পড়া যাচ্ছিল। রমিতার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
-‘তুমি ‘না’ বললে খাব না।’
-‘আমি সেটা বলিনি। রাত হয়ে গেছে, কালকে বরং রেখে দিই।’
সুজু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তাতে সম্মতি অসম্মতি কিছুই ছিল না।
রমিতা ধীরে ধীরে রান্না ঘরে গেল। তারপর সমস্ত পকোড়াগুলো আনাজের খোসার সঙ্গে ডাঁই করে ঝুড়ির মধ্যে ঢেলে দিল। বুক থেকে বিশাল ভার নেমে গেল ওর।
কিন্তু খেতে বসেই রমিতার গা’টা সেই প্রথমবার গুলিয়ে উঠল। পাতে চিকেনের পিসগুলোর কষা গ্রেভি না রক্তে মাখামাখি মাংসপিণ্ডসব? ও কোনওমতে খাবার ফেলে উঠে ভালো করে গার্গল করে নিয়ে ঘরে চলে গেল।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রমিতা আস্তে আস্তে চুলে চিরুনি বোলাচ্ছিল। ওর এই চুল আঁচড়াবার একটা বিশেষ ধরণ আছে, চিরুনিটা যেন পালকের মতো ব্যবহার করে ব’লে সুজুর মনে হয়। সুজু ওকে দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনটা ওর অভিমানে ভ’রে আছে অনেকদিন ধ’রে। রমিতা কি ওকে আদৌ পছন্দ করে? ভালবাসে? কিছুই বুঝতে পারে না ও। প্রথম প্রথম যেমন ছিল, কেন কে জানে অতটা আর রমিতা ওর কাছে আসে না। রাতের বিছানায় কোনও উৎসাহ দেখে না আর রমিতার। কী হয়েছে ওর? ওর যা বলে তা-ই করতে কোনও দ্বিমত করে না। তাহলে? বলতে বলতে রমিতার সঙ্গে চোখাচোখি হলো ওর, আয়নার মধ্যে দিয়ে। লাজুক হাসল রমিতা। এক মুহূর্ত ভাবল সুজু। তারপর আর অসুবিধা হলো না ওর চোখের ভাব বুঝতে। বিছানা থেকে উঠে ছোঁ মেরে ও রমিতাকে বুকে টেনে নিল আর আজকে কিছু করার আগেই রমিতা ওর ঠোঁটে একটা নরম চুমু খেল। শিরশির করে উঠল সুজুর সারা শরীর। ইস, কী ভুলভাল ভাবছিল এতদিন ও রমিতা আর ওর সম্পর্ক নিয়ে। ও রমিতাকে বিছানায় ফেলে নাইটিটা খুলতে লাগল, চুমু খেতে খেতে শুনতে পেল, রমিতার বুক ভেঙে আলতো শীৎকার বেরিয়ে আসছে। ও আলোটা নেভাবার কথাও মনে হলো না, এই অবস্থায় ইচ্ছে হলো রমিতাকে দেখতে। কোমরের কাছের আবরণটা সরিয়ে দিতেই একটু অবাক হলো সুজু। খোলা বিচের মতো লাগছে রমিতার সমস্ত শরীরটা। ও একবার রমিতাকে দেখেই, কিছু বলতে গিয়েও বলল না, ইচ্ছে করল না, ও সম্পূর্ণ ভাবে ডুবে গেল।
রমিতার মাথায় তখন আর কিছু নেই। এতক্ষণ সে ড্রেসিং টেবিলের কাছে বসে ভাবছিল আনাজের খোসাগুলো ‘সব’ সুদ্ধু কাল সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই সামনের ডোবাটার কাছে যে জঙ্গলটা, সেটাতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে, ডাস্টবিনে ফেললে হবে না, কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে, গোটা মাথাটা নিয়ে কুকুরে না টানাটানি করে। কিন্তু এখন আর সেটা ওর মাথায় আনতে ইচ্ছে হলো না, একটুকুও না।
।।৪র্থ, দ্বিতীয়।।
রমিতা বুঝতে পারছে ঠিক হচ্ছে না, কিছু ঠিক হচ্ছে না। সুজু মাথা গোঁজ করে অন্য দিকে মুখ রেখে শুয়ে পড়েছে পাশেই, কিন্তু দুজনের মাঝে দূরত্ব অনেক বেশি। রমিতা বুঝতে পারল সুজু এখনও ঘুমোয়নি। ওর একবার মনে হলো ঘুরে একবার কথা বলে সুজুর সাথে, ও দুঃখ পাচ্ছে, ওকে সঙ্গ দেওয়া দরকার। কিন্তু ওর মনে হলে সেই দুর্গন্ধটা সুজুর গা থেকে এখনও ছাড়ছে, সুজুর গা থেকে, হ্যাঁ কোনও সন্দেহ নেই, গায়ে গা লাগিয়ে শোয়াই কষ্টকর– অন্যকিছুর প্রশ্নই ওঠে না। বরং রমিতা মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে চাইল ঘুমের কথা কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসতে চাইল না। মনে হচ্ছে, আজকেও এই গন্ধ আর আতঙ্ক ওর পিছু ছাড়বে না। সুজুর সাথে থাকা, শোয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে এভাবে চলতে থাকলে। চোখের পাতা বন্ধ করতে করতেই ও ভাবতে লাগল, ভাবতে লাগল কী কী করবে আর...কী করা উচিত ওর, এর থেকে কি কোনও পরিত্রাণ নেই? চোখের পাতা একটু লেগে গিয়েছিল হয়ত, তন্দ্রা মতো এসে থাকবে, হঠাৎ ঘুমের মধ্যে চমকে উঠল ও। আবার আবার সেই স্বপ্ন ও দেখছে। ওহ, কী যন্ত্রণা! কখনও কি ও চোখ বুজে ঘুমতেও পারবে না আর? আজকাল খুব বেশি স্বপ্নটা দেখছে ও, সেটা অস্বাভাবিকও না, সারাক্ষণ যদি চোখের সামনে জন্তুটা ঘোরাফেরা করে...। রমিতা চোখটা খুলে পাশে ঘুরেই দেখে সুজু ওর দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ লাল।
-‘কী হলো তোমার?’
-‘কী...কী হবে? কিছু না।’
-‘তুমি কেমন একটা করলে ঘুমের মধ্যে? গোঙানির মতো?’
-‘ধুর... ভুল শুনেছ ঘুমের মধ্যে?’
-‘ভুল শুনেছি! আমি ঘুমোইনি রমি, ভুল কেন শুনব?’
-‘না গো, ও কিছু না।’
-‘ওহ...।’
সুজু শুয়ে পড়ল পাশ ফিরে। রমিতা স্পষ্ট বুঝল, সুজু রাগ ক’রে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। রমিতার বুকটা আরও একবার ‘হুহু’ করে উঠল। এরকমই একটা দুপুর কেটেছিল কয়েকদিন আগেও। যেদিন ঘরে ঢুকতে গিয়ে রমিতা দেখল সুজু লেবুকে নিয়ে খেলা করতে করতে বিছানায় হুটোপুটি করছে। এই বুড়ো বয়েসে এই কী খেলা রমিতা বুঝতে পারে না। সে বেশি আপন না লেবু? রমিতার মাথাটা গরম হয়ে যায়। মনে হয় বলে এটাকে বিদায় করো নয় আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু এটা কি কোনও কথা হলো? কেউ কি মানতে চাইবে ওর এই দাবি? লেবু সুজুর অনেক দিনের সঙ্গী, কোথাও থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল তার পর থেকে একেবারে সুজুর পেয়ারের হয়ে গেছে। রমিতা গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে ওর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। নাহ, এই বিছানায় আর সে শুতে পারবে না। এমনিতেই ওর শরীর কেমন করছে। সুজু ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হলো, দাঁড়িয়ে কেন? কিছু বলবে?’
-‘শোব তো, নাকি?’
-হ্যাঁ, শোও না...।’
রমিতা গম্ভীর মুখে বলল, ‘ওটা?’
-‘কী ‘ওটা’ রমি? এটা তো লেবু। একে নিয়ে তোমার কিসের এত সমস্যা?’
-‘ওকে আগে বাইরে রেখে এসো। তারপর...।’
-‘আশ্চর্য তো! ওকে নিয়ে তোমার এত কী হয়? তোমার জন্য তো ওকে এখন আমি রাতে ঘরেও রাখি না। তাতেও?’ সুজুর গলায় স্পষ্ট বিরক্তি আর রাগের আভাস শোনা গেল।
রমিতা কিছু না বলে মুখ বিকৃত করে দাঁড়িয়ে রইল, কিছু বলল না।
-‘ঠিক আছে তুমি একাই শোও, আমি আর এখানে থাকব না। নিকুচি করেছে...।’, সুজু লেবুকে কোলে নিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে চলে গেল, তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল রাগের পরিমাণটা।
আসলে সুজু রাগ করেনি, করেছিল অভিমান, মনে হয়েছিল এত অপমান কেন? নতুন বিয়ের পর যে প্রেমিক তার মনে জেগে উঠেছিল, তার কিছু আর অবশিষ্ট থাকল না হয়ত। একদিন না, অনেকদিন ধরে সে দেখছে, কী অদ্ভুত ব্যবহার করছে রমি ওর সঙ্গে। সুজুর চোখে জল চলে এলো।
ওদিকে সুজু চলে যেতেই রমিতা ঝাঁটা দিয়ে আগে বিছানাটা ভাল ক’রে ঝেড়েছিল, নাহলে এর ওপরে শোয়া ওর পক্ষে অসম্ভব। তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে, বালিশে মাথা গুঁজে, ক্লান্ত ভাবে শরীরটা ছেড়ে দিল। ভাবছিল এই কি সে চেয়েছিল? কত স্বপ্ন ছিল তার সংসার জীবন নিয়ে। আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও খারাপ না, সুজু তো খুবই ভাল, কিন্তু...। রমিতার হঠাৎ কান্না পেয়ে গিয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল সব না নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কী করতে পারে ও? সুজুকে খুলে বললে ওকে না সুজু পাগল ভেবে বসে আর সকলের মতো। উফ, কী করবে ও!
আজকের রাতও সেই একইরকম।
পরের দিন বেলা বারোটা। সন্ধ্যাদির হাতে হাতে রান্নায় সাহায্য করছে রমিতা, এমন সময় লেবু রান্না ঘরে ঢুকে একেবারে গ্যাসের ওভেনের পাশে ওঠে বসল। দেখেই রমিতার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল।
-‘এই হ্যাট, যা এখান থেকে?’
-‘কী হলো, ওকে বকছ কেন?’
-‘রান্না হচ্ছে এখানে বসে থাকবে নাকি?’
-‘তো কী হবে? থাকুক না। কত সময়ই তো আসে।’
-‘না না, নোংরা করবে সব, যা যা হ্যাট...।’
-‘আহ, এরকম করো না বউদি। দাঁড়াও তো’, বলে মাছের ডিমের বড়া ভাজতে ভাজতে একটা বড়া সন্ধ্যা মাটিতে ফেলে বলল, ‘এই যা, বাইরে নিয়ে গিয়ে খা।’
রমিতার মনে হলো সে একটা বড়াও আজ আর খেতে পারবে না। বড়াটা নিয়ে লেবু সুড়সুড় ক’রে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যাদি একটা করে মাছের ডিমের বড়া বেসমে ডুবিয়ে, কড়ার ভিতর ছাড়ছে আর গরম তেলে পড়ে সেগুলো ‘ছ্যাঁত ছ্যাঁত’ করে উঠছে। সেটা ও দেখতে দেখতে সন্ধ্যাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কবে দেশের বাড়ী যাচ্ছ, সন্ধ্যাদি?’
-‘পরশু’, উত্তর দিল সন্ধ্যা।
‘পরশু’, মনে মনে বলল রমিতা, ‘মানে শুক্রবার, বেশ।’ মনে হলো ও এতদিন পরে কোনও একটা কিছুর উপায় খুঁজে বের করতে পেরেছে।
কাল রবিবার। রমিতা শুতে যাবার সময় সুজুকে বলল, ‘কাল চিকেন এনো বরং। একটু বেশি ক’রেই।’
- ‘এখন ওসব ঝক্কি নেবার কোনও মানে নেই। সন্ধ্যাদি নেই। এলে কোরো, এই উইকটা থাক।’
রমিতা রেগে উঠে বলল, ‘সন্ধ্যাদি নেই তো কী? আমি কি কেউ না নাকি?’
সুজু অবাক হয়ে ওর দিকে দেখল। এমন কী কথা হলো রেগে ওঠার মতো? সুজুর মধ্যে আবার সেই অভিমানটা ফিরে এলো। ও কাঠ কাঠ করে জবাব দিল, ‘ঠিক আছে, চিকেনই আনব,’ বলে শুয়ে পড়ল।
রমিতা ড্রেসিং টেবিলে বসে ছিল। চুলে চিরুনি বোলাতে ও অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কালকে ওর বড় পরীক্ষা। এটা ওকে করতে হবেই, নাহলে ধরা পরে যেতে হবে ঘরের বা বাইরের কারও কাছে নিশ্চিত ভাবে। হাজার হোক ঐ রক্ত মাখা অবস্থায় তো আর প্যাকেটে মুড়ে বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে আসতে পারবে না। এছাড়া আর উপায় নেই। রমিতা একটা বড় শ্বাস নিল।
সকালে উঠে যখন রমিতা বিছানা গোছাচ্ছে তখন শুনল সুজু বাজার থেকে চলে এসেছে আর রঞ্জা ওকে মাংস আনার জন্য বকুনি দিচ্ছে।
।।৫ম, প্রথম।।
একটা কালো জানোয়ার যখন তখন যে কোনও জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। রান্না ঘরে রান্না করার সময়, রাতে শুতে যাবার সময়, সর্বত্র তার বিচরণ। কখন যে সে আসবে, কখন যে সে কোথায় থাকবে কেউ জানে না, কখনও কখনও উধাও হয়ে থাকবে কয়েকদিন তারপর আবার ঠিক চলে আসবে জায়গা মতো। কালো জানোয়ার ব’লে সমস্যা না, সমস্যা না সে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় ব’লে, সমস্যা কী সে রমিতাই কেবল জানে। তাড়াতে পারে না চাইলেও, এতদিনের পুষ্যি, আদরের ধন সুজুর। কিন্তু ভয়ানক অস্বস্তি হয়, সেই ভয়, সেই ভয়টা আরও একবার ফিরে এসেছে ওর শরীরে- মনে। আবার সেই স্বপ্নগুলো দেখতে শুরু করেছে, আবার সেই বিকৃত, ধ্বস্ত শরীরটা সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, যখনই সে এই কালো ভয়ানক জানোয়ারটাকে আসে পাশে চলে ফিরে ঘুরতে দেখে। আরও ভয়ানক হলো সেই প্রাণী যখন সুজুর কোলে বসে দুধ খায়, সে প্রাণী যখন সুজুর খালি গায়ে মাখামাখি করে, কী ভয়ানক, কী ভীষণ এই ঘটনা! সুজু আজকাল কাছে এলেই রমিতা একটা বিদঘুটে গন্ধ পায়, সেই গন্ধ যা সে পেয়ে পেয়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়েছিল, বহুদিন আগে, আবার এসেছে ফিরে।
প্রথমে অবশ্য জানা ছিল না। যেদিন বিয়ের পর যেদিন এ বাড়ীতে এসে প্রথমবার সেই কালো জানোয়ারকে দেখল, হাত থেকে তরকারির বাটিটা প্রায় প’ড়ে যাচ্ছিল ওর। খাবার টেবিলের ওপাশে সুজুকে বাটিটা বাড়িয়ে দেবার সময় দেখল কালো জানোয়ারটা, উঠে পড়ছে সুজুর গা বেয়ে, খাবার পাতের সামনে এসে বসল, সুজু আদর করতে করতে ওকে বলল, ‘এ লেবু’, ব’লে ওর দিকে তাকাল, দৃষ্টিতে এই ভাব যেন রমিতা লেবুকে এই পরিবারের একজন মনে করে। পাতের মাছের একটা টুকরো সুজু লেবুর মুখে এগিয়ে দিল। তবে সেইদিন না, আরও কয়েকদিন রাত পরে রমিতা সুজুর গায়ে প্রথমবার সেই গন্ধটা পেল। সেই দিন সবার আগে লেবুকে কোলে নিয়ে সুজু, খালি গায়ে টি ভি দেখছিল, আর সারা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই প্রাণী। সেদিন রাতে কোনওমতে সে সুজুকে কাছে নিয়ে শুয়েছিল, তারপর থেকেই রমিতার শুরু হলো প্রচণ্ড ভয় আর ঘৃণা। সুজু রাতে খালি গায়ে কাছে এলেই সেই অদৃশ্য গন্ধের আর ভয়ের আভাস সে পেতে আরম্ভ করল। দিনের পর দিন সে দূরে যেতে লাগল সুজুর থেকে, সুজুর কাছে ও বিশেষ আসে না, বিশেষ করে লেবু সঙ্গে থাকলে সে কিছুতেই না, অনেক রাতেই সুজুর ঘরেই শুতো লেবু, খাটের নিচে, রমিতা জেদাজেদি করে রাজি করিয়ে তাকে বাইরে করেছে। রঞ্জা এটা দেখে অবশ্য রাগ করেছিল, নতুন বউ এসেই বুঝি নতুন নিয়ম চালু করল? সুজু সেসব বোঝেনি, বলেছিল তোমার অসুবিধা থাকলে ও নাহয় এটুকু সময় বাইরেই থাকুক। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল রমিতা, অন্তত রাতের ঘুমটা নিজের ঘরেই সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু সুজুকে কোনও না কোনও ভাবে রোজই কাটিয়ে দেয় রমিতা, নিজের ইচ্ছেকেও দমিয়ে রাখে, কিছু করার নেই। অভিমানে আজকাল সুজু কাছে আসছে না, এটাও সে লক্ষ্য করেছে।
রাতে খেতে বসে একটা ঝামেলাই হয়ে গেল আজ। অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই সুজুর মনমেজাজ আজকাল ভাল থাকে না, রমিতা জানে কেন সে আর কেউ না জানুক। হঠাৎ কী নিয়ে রঞ্জার সাথে সুজুর টুকিটাকি লেগে গেল, রমিতার মনে হলো যেন সব দোষ এসে পড়ল ওর ঘাড়ে। রঞ্জা রেগে গিয়েছিল, নিজের ঘরে গজগজ করতে করতে বলল, ‘এই হয়! বউ হ’লে মা পরই হয়।’ বাকি কোনও কথা রমিতার আর শোনা হলো না, সে ঘরে ঢুকে দেখল সুজু বালিশে মুখ চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। কাঁদছে নাকি? রমিতার মনে হলো একবার ওকে গিয়ে সান্ত্বনা দেয়, বাচ্চা ছেলে একেবারে, রমিতার সুজুর ব্যবহার দেখে অনেকবার তাই মনে হয়েছে, আজও তাই মনে হলো। রমিতা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। মনটা ভেঙে গেছে যেন, ওর জন্যই তো আসলে ঝগড়া হলো আজ। দোষটা আর কারও না, ওর, ওর কারণেই সুজুর মনমেজাজ ভাল থাকে না আজকাল, তাই হঠাৎ কী কথায়, মা-ছেলের রাগারাগি! অন্য দিকে পাশ ফিরে শুয়ে, রমিতা চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করল বিয়ের পর প্রথম কয়েকটা দিন। মন পড়ল, প্রথম সুজুর চোখে আবিষ্কৃত হবার ক্ষণগুলো, সেই আশ্লেষ মুহূর্তগুলো। ওদের দেখাশোনা ক’রে বিয়ে, মনে মনে ভয় ছিল কেমন কী হবে সব, কেমন হবে ‘ও’! ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ওর মনে পড়ল, ওকে সম্পূর্ণ দেখে প্রথমবার সুজু বলেছিল, ‘ইসস! তোমার এখানটা পুরো লেবুর গায়ের মতো মিশমিশে আর ওমনি নরম, হাহাহহাহাহা’- ভাবতেই রমিতার চোখ দুটো খুলে গেল। মনে পড়ল, গা ঘিনঘিন ক’রে উঠেছিল এই কথা শুনে, মনে পড়ল ও কী করেছিল পরদিন। সুজুর শেভিং কিটটা পরদিন দুপুরে বাথরুমে গিয়ে...। নাহলে মনে হচ্ছিল সারা শরীরে একটা উদ্বেগ, অস্থিরতা- সহ্য করতে পারছে না নিজের শরীরটাকেই। রমিতার মনে আবার একটা ভয় এলো, ভয়, সুজু ওপাশে শুয়ে আছে, তার মনের খবর ও বুঝেও কিছু করতে পারছে না, সুজুর নিশ্চয় অভিমান হচ্ছে, মায়ের ওপর, তবে সবচেয়ে বেশি তারপর, কী করবে ও? এভাবে চললে ওর সংসার ভেঙে যেতে বেশি দেরি নেই। এখন আরও বেশি করে যেন গন্ধটা সুজুর শরীর থেকে আসছে, কাল্পনিক সেই গন্ধ। ওকে সান্ত্বনা দেবে কী, নিজেরই পরিত্রাণ নেই ওর এই যন্ত্রণা থেকে। কী করবে রমিতা? কী করবে? কী করে তাড়াবে ঐ ‘লেবু’কে, যাতে কেউ বুঝতেও না পারে অথচ ‘জিনিসটা’ দূরও হয়? ভাবতে ভাবতে রমিতার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আবার তন্দ্রায়, আচমকা সেই স্বপ্নে আবার ওর ঘুম ছুটে গেল।
চোখ খুলে পাশে ঘুরে দেখে সুজু ওর দিকে চেয়ে আছে, ওর চোখ দুটো লাল, বিষণ্ণ লাল।
।।৬ষ্ঠ, আদি।।
রাতে সুমনা বিছানায় শুতে শুতে বলল, ‘এবার কিন্তু ওকে ডাক্তার দেখানো দরকার। মেয়ে বলে কথা, বিয়ে ক’রে পরের ঘরে যাবে, শেষে কি শুনব, মেয়ে পাগল?’
-‘তুমি না বড্ড বাজে কথা বলো’, অ্যাস্ট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলল দীপক। হাতে একটা বই, চোখে চশমা।
-‘তুমি দেখতে পাচ্ছ না, ও কী ধরনের ব্যবহার করছে আজকাল? চারদিকে যেন ভয়, রাতে স্বপ্ন দেখছে ভয়ের, পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ভাবছে ওসব সত্যি সত্যি ঘটেছে, জিজ্ঞেস করলে সব খুলে বলছেও না... জানবে কী ক’রে, সারাদিন বাড়ী থাক কতক্ষণ? সেই তো অফিস আর ক্লাব, হয় তাসের আড্ডা নয় কফি হাউসের পাণ্ডিত্য...।’
-‘ওসব কিছু না। বাচ্চা মেয়ে, একটু ভিতু টাইপের, আর কিছু না, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে, এই তো বারো সবে।’
-‘বড় হলে মানে? যদি না হয়? এটা ওর মনে বসে যায়? আগে ছিল এসব? হাসিখুসি কী সুন্দর ছিল...।’
-‘ঠিক আছে, কাউকে কন্সাল্ট করতে হবে, সাইক্রিয়াটিস্ট কাউকে দরকার হলে, এখন বকো না, পড়তে দাও।’
-‘তোমার তো ঐ আছে। সবটা এড়িয়ে যাওয়া...।’
-‘আরে, এড়িয়ে কোথায় যাচ্ছি? বলছি তো...।’
এই ঘরে যখন কথা চলছে, তখন অন্য ঘরে তাদের আদরের রমি ঘুমের ঘোরে। তার শরীরে প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে, সে হয়ত চিৎকার করে উঠতে পারে। সে এখন স্বপ্নে দেখছে, একটা কালো বেড়ালের লাশ, রাস্তার ওপর, দেহটা চেপ্টে গেছে একেবারে ভারী গাড়ীর চাকার তলায়। কেবল মুখটা অবিকৃত, যেন আলাদা কোনও সুন্দর, স্বাস্থ্যবান বেড়াল দেহের, কিন্তু বাকিটা বীভৎস, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে, রক্ত বেরিয়ে জমে গেছে শানের রাস্তার ওপর। তারপর সে সত্যিই চিৎকার করে উঠবে, মা-বাবা ছুটে আসবে ওঘর থেকে। সে এখনও জানে না, তার মা-বাবা তাকে কোনও সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাবে আগামী সপ্তাহে, কিন্তু কিছুই সে মুখ ফুটে বলতে পারবে না; জানে না, এই ভয় তার কমে যাবে ধীরে ধীরে বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু কোনওদিন একেবারে ছেড়ে যাবে না; আবার ফিরে আসবে বিয়ের পরে, যখন সে দেখবে আবার সেই কালো এক বেড়াল, যা তার স্বামীরই পোষ্য, অনেক চেষ্টা করবে ভয়কে কাটানোর, বেড়ালটাকে তাড়িয়ে দেবার; কিন্তু কিছুই যখন হবে না, তখন কিছুই ‘লেবু’কে পকোড়া হবার থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
***********************
একটা বাচ্চা মেয়ে বাড়ীর সামনের মাঠের পাঁচিলের ধারে বসেছিল। মাঠে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছে। হঠাৎ সে দেখল একটা বেড়াল আসছে এদিকে। তাকে সে চেনে, এর নাম ‘কেলো’, মিশমিশে কালো শরীর, আর চোখ দুটো রাতে ভাঁটার মতো জ্বলে। মেয়েটা এই বেড়ালটাকে দেখলেই, উত্যক্ত করে মারে, ঢিল ছোঁড়ে, বা পিছনে ধাওয়া করে, একটা খেলা এটা, নিদারুণ খেলা। আজ সে ওকে দেখেই ‘দুম’ করে পাঁচিল থেকে নেমেই ওর পিছনে ধাওয়া করল। বেড়ালটা ওকে দেখেই চোঁচোঁ করে দৌড় দিল উল্টোদিকে কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। গলির মুখটা দিয়ে বেরবার সময় রায়দের বড় গাড়ীটা ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা মারল ওকে, থেঁতলে গেল শরীরটা। এবার বাচ্চা মেয়েটা সামনে গিয়ে দেখবে সেই বীভৎস দৃশ্য, কেউ জানবে না যে তার তাড়া খেয়েই বেড়ালটা এমন ভাবে ছুটে ছিল, এমন ভাবে থেঁতলে গেল, কিন্তু জানবে সে নিজে, দেখেই ভরভর করে বমি করে দেবে রাস্তায়, অবশ্য তখনও সে জানত না যে এই দৃশ্য, এই ‘খুন’, তার মাথায় চিরকালের জন্য গাঁথা হয়ে থাকল।
0 comments: