0

ছোটগল্প - সুষমা ব্যানার্জী

Posted in



ছোটগল্প


সহোদরা
সুষমা ব্যানার্জী



বাইরের ঘরে চা নিয়ে ঢুকতে গিয়ে পা আটকে গেল ঝুমির। পর্দার ওপারে ফিসফিস রুমি আর সৌমেনদার,
- কাল ছাদে দাঁড়ালি না কেন?
- রোজ রোজ ছাদে দাঁড়ালে মা কি ভাববে?
- আজ দাঁড়াবি কিন্তু, নইলে....
- নইলে কি?
- সেদিনকার মতো শাস্তি!
- ধ্যাত!
বাইরে দাঁড়ানো ঝুমির চোখ একবার জ্বলেই নিভে গেল। পর্দা সরিয়ে একটু সময় নিয়েই ঢুকল। তারপর চা রেখে বাধ্য ছাত্রীর মতো বই খুলে বসে পড়ল।
সেইদিন গভীর রাত্রে ঝুমির গোপন ডায়েরীতে লেখা হলো,
৩.১২. ২০০৩.
"আজ সৌমেনদা আমায় প্রোপোজ করেছে। আমি হ্যাঁ বলেছি।"

রুমি আর ঝুমি দুই যমজ বোন। কিন্তু দুজনে যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। বিধাতা অনেক সময় নিয়ে রুমিকে তৈরী করেছেন, একথা সবাই বলে। রূপে উজ্জ্বল, প্রাণে চঞ্চল রুমি তাই শুধু বাড়ির কেন পাড়ার চোখের মণি। অন্যদিকে ঝুমির মুখের দিকে তাকালে মায়ের দীর্ঘনিঃশ্বাস বাঁধ মানেনা। রোগা, কালো, ছোটোখাটো, স্বল্পভাষী দশমিনিটের ছোট মেয়েটিকে মা একটু বেশী স্নেহের চোখে দেখেন।
সেদিন যেমন ননদের সাথে একচোট কথাকাটাকাটি হয়ে গেল প্রায়। দীপ্তি একবেলার জন্য গড়িয়াহাটে কেনাকাটা সেরে বৌদির সাথে শেষদুপুরে দেখা করতে এসেছেন, হাতে রুমির জন্য চেরি লাল রঙের একটি ফ্রক নিয়ে। রুমি ঝুমির মা দিপালী অবাক হয়ে বলল,
- আর ঝুমির? 
-তোমার কি মাথা খারাপ হলো বৌদি? এই রঙ এই জামা ঝুমিকে মানাবে?
- কাজটা তুমি ঠিক করনি দীপ্তি। ওরা দুজনেই ছোট।
সেদিনে বিকেলের চা না খেয়েই গজগজ করতে করতে রওনা দিল দীপ্তি। পুরো ব্যাপারটা ঝুমির নজর এড়ালো না।
রুমি যখন পাড়াতে একগাদা বন্ধু নিয়ে খেলা করত, ঝুমি বাড়িতে বসে চাঁদমামা বা হাঁদাভোদা পড়ত। সে তার চারিপাশে বই আর কল্পনার একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছিল। আরও ছোটতে মা যখন দুই মেয়েকে নিয়ে বেরোতেন, রুমির গাল টিপে আদর করে অনেকেই বলত, 
-তোমার বড় মেয়েটা কি সুন্দর দিদি! ওমা! যমজ নাকি?

কাজেই ছোটোমেয়েটা যে কুৎসিত তা বুঝতে তার বেশীদিন লাগেনি। সে প্রায় কোথাও যেতে চাইতনা কেবল স্কুলে ছাড়া। একমাত্র সেখানেই তার গুণের অর্থাৎ বিদ্যানুরাগের কদর হতো। কিন্তু স্কুলের প্রোগ্রামে রুমি যখন প্রজাপতির মতো পাখা মেলে "মায়াবন বিহারিণী হরিণী..." র সঙ্গে অথবা চিত্রাঙ্গদা সেজে নাচত, ঝুমি সেখানে লুকোনোর জায়গা খুঁজত। কারণ তার বন্ধুরা তখনও কথায় পালিশ লাগাতে শেখেনি, তাই তাকে স্পষ্টই বলত 
-তোরা যমজ? বোঝাই যায়না। হাসপাতালে বদলে যাসনি তো?
তাদের হাসি, তাদের বিদ্রূপ ঝুমির কোথায় লাগত বলা যায়না, তবে পরবর্তীকালে সেই দিনগুলিতে ঝুমির স্কুলে অনুপস্থিতি নিশ্চিত ছিল। সেই সময়ে সে পাটিগণিত অথবা বীজগণিতের সমস্যা সমাধানে বেশী উৎসাহবোধ করত। কিন্তু ঝুমি যখন উজ্জ্বল মার্কশীট নিয়ে স্কুলে প্রথম হয়ে বাড়ি ফিরত, রুমিও সেই আনন্দে সামিল হতো। অবশ্য ঝুমির প্রতি তার ভালোবাসায় সিকিভাগ অবহেলার খাদও ছিল।
ক্লাশ টেনের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার পর একদিন স্কুলের বড়দি ঝুমিকে ডেকে পাঠালেন তাঁর ঘরে। কম্পিত ঝুমি যখন বড়দির ঘরে পৌঁছলো, সেখানে তার ক্লাশটিচার মীরাদি হাসিমুখে উপস্থিত। হাত ধরে বড়দির সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন,
- এই যে দিদি, এই সংঘমিত্রা, এর কথাই বলেছিলাম।
সেবারে অঙ্ক পরীক্ষায় ঝুমি একশয় একশ পেয়েছে। বড়দি বললেন,
-তোমার বাবা কি করেন?
- যাদবপুর বয়েজ স্কুলের টিচার।
- কোন সাবজেক্ট?
- ইংরেজী।
-তোমার অঙ্ক খুব ভালো লাগে?
- হ্যাঁ, দিদি।
-বাড়িতে কে পড়ান?
- বাবা। 
বিজ্ঞান বিভাগের জন্য রাখা প্রাইভেট টিউটরের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে সে কথা আর ঝুমি জানায় না।
-তোমার বাবাকে বলবে, একবার যেন সময় করে আমার সাথে দেখা করেন। স্কুলে বা বাড়িতে, যেখানে সুবিধা।

এহেন কথোপকথনের দিন কয়েক বাদে বাবা রাত্তিরে বড়দির বাড়ি দেখা করে হাসিমুখে ফিরলেন। ঝুমি নিজের ঘরে পড়ছিল, রুমি দৌড়ে এসে ঝুমিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-জানিস বড়দি বাবাকে কি বলেছেন?
-ঝুমি বিরক্ত হয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
-কি বলেছেন?
-বলেছেন আপনার মেয়েটি তো রত্ন। একটু যত্ন করলে মাধ্যমিকে র‍্যাঙ্ক করবে। আই আম সো প্রাউড অফ ইউ, ছুটকি।
আনন্দে ঝুমির চোখে জল আসে। ছোটো থেকে আজ পর্যন্ত এহেন স্বীকৃতি তার জীবনে প্রথম। সে রুমির সকল অনিচ্ছাকৃত অপরাধ ক্ষমা করে দিত যদি না সৌমেনদাকে নিয়ে এক অসম প্রতিযোগিতায় দুজনে লিপ্ত হতো।
ঝুমির জীবনে প্রথম বাইরের পুরুষের প্রবেশ ঘটল যেদিন সৌমেনদা তাদের পড়াতে এল। সে এমনিতেই বাধ্য ছাত্রী, তারপরে সৌমেন দার উৎসাহে সে আরও ভালো করছিল। সৌমেনদা তাকেও স্নেহ করত ভীষণ।

অন্যদিকে রুমি আর সৌমেনের প্রেম দানা বাঁধতে শুরু করে। এ'বস্থায় ঝুমির এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায়। 
সে রুমিকে নানান অজুহাতে সৌমেন দার সঙ্গে একা ছেড়ে দিয়ে আড়াল থেকে দুজনকে লক্ষ্য করে আর তার গোপন ডায়েরী ভরে ওঠে ধীরে ধীরে।
১৫.১২.২০০৩
"আজ প্রথম সৌমেনদা আমায় স্পর্শ করেছিল।"
৩১.১২.২০০৩
"সৌমেনদা পার্ক অ্যাভেনিউ এর লোশন ব্যবহার করে। কি সুন্দর গন্ধ! "
৪.১.২০০৪
"ও সিগারেট খায়। আমি গন্ধ পেয়েছি। ছেলেদের গায়ে সিগারেটের গন্ধ আমার দারুণ লাগে।"
১০.১.২০০৪
"আজ দাড়ি কেটে আসেনি সৌমেনদা। আমার গাল জ্বালা করছিল।"
১২.১.২০০৪
"আজ সৌমেনদা জোর করে আমায়.... আমি মুখে হাত চাপা দিয়ে বাধা দিয়েছি। বলেছি বিয়ের আগে এগুলো আমি পছন্দ করিনা।"
এইরকমের কিছু কথ্য আর কিছু অকথ্য কথা তার ডায়েরীর পাতায় জায়গা করে নেয়।
টেস্ট-এর পর রুমি বেশ মনযোগী ছাত্রীর মতোই পড়াশোনা শুরু করে, কারণ সৌমেনের সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। ব্যাপারটা ঝুমির নজর এড়ায় না।
মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন দশেক আগে রুমি ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে দেখে ঝুমি বই এর টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। রুমি অবাক হয় কারণ রাত জেগে পড়াশোনা করা ঝুমির স্বভাব, ভোরে সে উঠতে পারেনা। তবে কি সারারাত পড়েছে?
তাকে ডেকে বিছানায় তুলে তার বইপত্রগুলো সরাতে গিয়ে ডায়েরীটা হাতে পায় রুমি। ঝুমি ডায়েরী লেখে? বাসিমুখেই পড়তে শুরু করে রুমি। বিছানায় ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকা ঝুমি মুচকি হাসে। 
ঝুমি ঘুম থেকে ওঠার পর রহস্যজনকভাবে ডায়েরী উধাও হয়ে যায়। যতবার রুমি ডায়েরীর লেখাগুলো সত্যি কিনা জিজ্ঞাসা করে, ঝুমি মুখের একটা রেখাও পরিবর্তন না করে বলে, 
-কোন্ ডায়েরী?
রুমির মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বাবার মোবাইলে হাত দেওয়া যাবেনা এখন। বাইরে বেরোনো বন্ধ। সৌমেন বলেছে শেষ পরীক্ষার দিন দেখা হবে। সে কাউকেই কিছু বলতে পারেনা। বলাই বাহুল্য রুমির পরীক্ষা আশানুরূপ হয়না। ঝুমির মাধ্যমিক নির্বিঘ্নে কাটে। তারপরে সে কলকাতার নামী স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার খোঁজখবর শুরু করে।

পরীক্ষার পরও রুমি সৌমেনকে এড়িয়ে চলছিল। হঠাৎ একদিন সৌমেনের দিদি নিবেদিতা প্রায় জোর করেই রুমিকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। ঝুমি সেদিন মীরাদিদিমণির সঙ্গে দেখা করতে লেকগার্ডেন্স গেছিল।

সৌমেনের বাবা মা নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছেন শ্রীরামপুর। সৌমেনের অনার্স পরীক্ষা সামনে এই অজুহাতে যায়নি। সে দিদিকে হাতেপায়ে ধরে রাজী করেছে। নিবেদিতা প্রায় জোর করে ছাদে নিয়ে যায় রুমিকে। দুপাশে আগুন যথেষ্টই ছিল। কাছে যেতেই বিস্ফোরণ!
- কি হয়েছে তোর? দরকার মিটে যেতেই পাত্তা নেই আর!
- লজ্জা করেনা তোমার? যা করেছ তুমি, তারপরে মুখ দেখাতে লজ্জা করছে না তোমার?
- আমি! আমি কি করলাম?
- তুমি ঝুমির সাথেও...
- কি? ঝুমির সাথে কি? 
- কি? আবার বলছ কি?
সৌমেন বিচক্ষণ ছেলে। বোঝে কোথাও বড়সড় গণ্ডগোল আছে। অনেক কথাকাটাকাটি, সাধ্যসাধনার পরেও রুমিকে বোঝাতে অক্ষম হয়। যাওয়ার সময় শুধু বলে, 
-তুই শুধু আমাকে একবার ডায়েরীটা দেখাতে পারবি? 
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে আসে রুমি। বাড়ি ফিরে দেখে ঝুমি ফেরেনি তখনও। সৌমেনের ডায়েরীর কথাতে তার মনে হয়, ডায়েরীতে নতুন কিছু লেখা আছে কিনা খুঁজে দেখা যাক।

পরীক্ষার পরে ঝুমি বইপত্র গুছিয়ে তুলে রেখেছে। আজ রুমিকে বই গোছাতে দেখে তাদের মা খুশি হন। রুমি গোছানোর ফাঁকে খুঁজতে থাকে। দুজনের একটাই ঘর। পরিত্যক্ত একটি স্কুল ব্যাগ এ ডায়েরীটি পাওয়া যায়। সঙ্গে আরও কিছু যা দেখে রুমি আর্তনাদ করে ওঠে,
"মা!"
মা এসে চারিপাশের ছড়ানো জিনিষ দেখে রুমিকে বকতে শুরু করেও তার মুখ দেখে থেমে যান। রুমির হাতে ওটা কি?

চেরি লাল রঙের সেই পুরনো ফ্রকটা না! আড়াআড়ি ভাবে চেরা! রুমির খুব পছন্দের একটা পুতুল, গলাটা কাটা! এটা হারিয়ে রুমি সারাদিন খায়নি। রুমির পায়ের একটা ঝুমুর যার অভাবে তার নাচ কিছুদিন বন্ধ ছিল। সৌমেনদার দেওয়া পেনটা পর্যন্ত। হঠাৎ দরজায় শব্দ পেয়ে দেখে ঝুমি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

এ ঘটনারও কেটে গেছে দুবছর। এই দুই বছর ধরে ঝুমির কাউন্সিলিং হয়। সাইক্রিয়াটিস্ট ডঃ মজুমদার একদিন বিজনবাবু আর দিপালীদেবীকে আলাদা ডেকে অনেক কথা বলেন।

- আপনারা সংঘমিত্রার খেয়াল রাখেন না?
- না না, কেন রাখব না?
- জানেন ও রুমি সেজে থাকে?
- মানে?
- এই তো! কিচ্ছু জানেন না! ও রুমির জামা পরে ওর ঘুঙুর পরে রুমির মতো হবার চেষ্টা করে। যখন সেটা পারেনা, তখন প্রচণ্ড আক্রোশ জন্মায় রুমির ওপর। আপনাদের ভাগ্য ভালো, রুমির জিনিষগুলোর ওপর দিয়েই গেছে রাগটা, রুমির ক্ষতি হয়নি।
বিজন আর দিপালী মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
- আচ্ছা, সৌমেন নামের ছেলেটির সাথে আপনাদের আরেক মেয়ের একটা গোপন সম্পর্ক আছে, জানেন?
দিপালীরা এবার আকাশ থেকে পড়লেন।
- কোনো মেয়ের সম্পর্কেই খোঁজখবর রাখেননা দেখছি। যাইহোক, এখানেও ঝুমি রুমির জায়গায় নিজেকে ভাবত আর সেগুলো ডায়েরীতে লিখত।
-আচ্ছা, এবারে বিজনবাবু মুখ খোলেন, ও এতকিছু করত, কিন্তু পড়াশোনাটা করত কিভাবে?
হেসে বলেন ডঃ মজুমদার,
- বিজনবাবু, আপনার মেয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। সে হয়ত তার পড়াশোনাকেই রুমিকে হারানোর হাতিয়ার করেছে। 
- এখানে হারজিতের প্রশ্ন আসছে কেন? ও কি রুমিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবত?
- কেন ভাববেনা বলুন? একই বয়সী দুটো মেয়ে, একই বাবামায়ের সন্তান, শুধু দেখতে ভালো নয় বলে জন্ম থেকে অপমান সহ্য করছে!
-কিন্তু সবার কি এমন হয়?
- সবারই হয় দিপালীদেবী, কিন্তু শতকরা দু তিনজন রিয়্যাক্ট করে। ঝুমি তাদের মধ্যেই একজন!

ঝুমির বিজ্ঞান পড়া হয়নি। সেদিনের পর অসুস্থ ছিল বহুদিন। রুমি আর ঝুমি দুজনেই এবছর উচ্চমাধ্যমিক দেবে। রুমি নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তার আর সৌমেনের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। সৌমেন বি টেক করছে।



ঝুমি পড়তে পড়তে উঠে পড়ে। এখন সে মায়ের সাথে ঘুমোয়। বিছানায় মা ঘুমিয়ে কাদা। ডাইনিং এ পা টিপে আসে। রুমির মোবাইলটা চার্জ থেকে তুলে হাতে নেয়। 
" সৌমেনদা, তোমার সাথে আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। ঝুমি খুব কষ্ট পাচ্ছে। আর ফোন বা মেসেজ কোরোনা।"
মেসেজ টাইপ করে মোবাইল সুইচ অফ করে ঝুমি শুয়ে পড়ল।
ঘড়িতে রাত তখন দুটো।

0 comments: