ছোটগল্প - বিভাস রায়চৌধুরী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
রিয়্যাক্টর-এ হামলা
বিভাস রায়চৌধুরী
দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় কলকাতাতে প্রায় ৫০০০ ইহুদী সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তাদের মধ্যে আজ মাত্র হাতে গোনা কয়েক জন আছেন। ইজরায়েল নামের এক নতুন দেশ তৈরি হলে এই ইহুদী সম্প্রদায় চলে যান সেই দেশে। কেমন আছেন তারা?
______________________________________________
-দাদু! উঠে পরো!
-উফ! কি হয়েছে , দাদুভাই?
-চলো, আজ যাবে না?
সিয়াম রাসবে, একবার আড়মোড়া ভেঙে উঠে পরল।
মনে পড়ল আজ গ্যালিলী সী বীচে যাওয়ার কথা। ডেভিডকে অনেক দিন আগেই বলে রেখেছিল। সিয়াম বুঝতে পারছে, বয়স হয়ে যাচ্ছে। কিছু কথা ভুলে যাচ্ছে, কিছু মনে থাকলেও, সেটা করতে ইচ্ছে করছে না।
-চলো, দাদুভাই। রেডি হয়ে নাও।
-আমরা কিন্তু ওখানে গিয়ে লাঞ্চ করব
-সে, দেখা যাবে।
নাজারেথ শহর ছেড়ে পূর্বদিকে ৩০ কিমি গেলেই সী অফ গ্যালিলী। টিবেরিয়াস শহরের পাস দিয়ে অনেকগুলো বীচ রিসর্ট। ইজরায়েলের অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। রবিবারের সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা একদমই পছন্দ না সিয়ামের।
ছোটবেলাতে বাবা সকালে নিয়ে যেতেন ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে, বাঙালী বন্ধুরা বলত গড়ের মাঠ। সকালের নদীর দিক থেকে আসা হিম ধরা বাতাসে শ্বাস নিয়ে বাবা ফিরে আসতেন। সিয়াম ফিরত দৌড়ে। স্বপ্ন ছিল অলিম্পিকে যাওয়ার। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে ওঠাটাই ছিল সমস্যা।
রেডি হয়ে রাস্তায় এসে ট্যাক্সি পেতে দেরি হলো না। নাজারেথ ইলিট এ আধুনিক সুযোগ সুবিধা যে কোনও ইউরোপীয়ান শহরকে লজ্জা দেবে। সিয়াম আর ডেভিড রাসবে, দাদু নাতি দুজনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। ড্রাইভার একবার শুধু জিজ্ঞেস করে নিল
-টিবেরিয়াসে কোথায় যাবেন?
-হট ওয়াটার স্প্রিং
-কোন রুট দিয়ে যাবেন?
-সাতাত্তর নম্বর রুট। কাফার কান্নাতে একটু দাঁড়াবে। একটু চা খেয়ে নেব।
পুরাতন নাজারেথ শহরে ইজ্রায়েলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আরব জনজাতির বাস। তার মধ্যে ৭০ শতাংশ মুসলিম, আর বাকিরা আরব খৃষ্টান। তাই ৫৭ সালে ইহুদিদের সেটল করতে নাজারেথের পূর্ব দিকে ইলিট টাউনশিপ তৈরি করে ইজরায়েলি সরকার। সেই সময় থেকেই সরকার টাউন প্ল্যানিং এ জোর দিয়েছিল।
কাফার কান্নাতে চা খেয়ে নিয়ে গাড়ি আবার এগোল। চা খাওয়ার অভ্যাস সিয়ামের সেই কলকাতা থেকেই। কলকাতার ইহুদি সমাজ মূলত ব্রিটিশ কালচারকেই অনুসরণ করত, যদিও নিজেদের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে। চা খাওয়াটা হয়ত সেখান থেকেই এসেছে। যে ইহুদিরা স্পেন আর পর্তুগাল থেকে ইজরায়েলে এসেছে তারা যেমন পানীয় হিসাবে কফিটাই বেশি পছন্দ করে।
ট্যাক্সি তখন তুরান শহরের কাছাকাছি। সিয়াম একটু চোখ বুঁজেছিল। চার পাসে মরুভূমি। তার মধ্যেই ছোটো ছোটো গ্রাম, তাতে ড্রিপ ইরিগেশন করে চাষ হচ্ছে। এক সময় যে মাঠে বেদুইন ছাগল চড়াতেও যেত না, সেখানে এখন টম্যাটো ফলছে। দেখেও বেশ আরাম লাগে। ইজরায়েল আর্মি থেকে রিটায়ার করার পরে সিয়াম যখন এগ্রিকালচার ইঞ্জিনীয়রিং নিয়ে পড়েছিল তখন তাকে মাঝে মধ্যেই তুরানে আসতে হতো। চোখ বুজে সেই সব ভাবতে ভাবতেই আকাশ কাঁপিয়ে চারটে ফাইটার প্লেন উড়ে গেল।
-কি প্লেন দাদু?
-এগুলো ফাইটার প্লেন দাদুভাই। F-16, আমাদের এয়ার ফোর্সের।
-তুমি কি করে বুঝলে?
-বোঝা যায় দাদুভাই, বড় হও, তুমিও বুঝবে।
-বলো না! বড়ো হবো কবে ?
-আর ৭ বছর। তোমার বয়স আঠারো হলেই তুমি মিলিটারিতে চলে যাবে। সব চিনতে পারবে।
-তুমি কি দেখে চিনলে সেটা তো বলো!
-দেখ ডেভিড, ইঞ্জীনের আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে যে ওটা ফাইটার জেট। তাতে একটা ইঞ্জিন, মানে F-16। আমাদের তো F-15ও আছে, কিন্তু তার দুটো ইঞ্জিন।
ডেভিড জানলা দিয়ে মুখ বাইরে বের করে প্লেন গুলো দেখার চেষ্টা করলো।
-আর কি তফাৎ আছে ?
-আর কি? প্লেনের পাখার নীচে দেখলেনা, আমাদের ইনসিগনিয়া? স্টার অফ ডেভিড, মানে ইজরায়েল এয়ার ফোর্স।
-প্লেনের গায়ে ইনসিগনিয়া কেন থাকে দাদু?
-এটা তো আমাদের সিম্বল। এই দেখেই তো আমরা চিনতে পারি আমাদের দেশের প্লেন, ট্যাঙ্ক, ফ্রিগেট জাহাজ। ইনসিগনিয়া সব দেশেরই থাকে। এই দেখ আমরা তো এখন জর্ডন বর্ডারের দিকে যাচ্ছি। যদি দেখি প্লেনের গায়ে একটা ঈগল, তার দুদিকে দুটো পাতা, উপরে একটা মুকুট, তার মানে প্লেনটা জর্ডন এয়ার ফোর্সের। প্লেনে একটা রাউন্ডাল থাকে। আমাদের রাউন্ডাল হচ্ছে সাদার উপর নীল স্টার।
-জর্ডনের রাউন্ডাল কেমন?
-সবুজ সাদা আর কালো। তার মধ্যে আবার ৪৫ ডিগ্রি লাল, তাতে সাদা স্টার। -ওদের কাছেও কি F-16 আছে?
-হ্যাঁ, দাদুভাই। আমেরিকা আমাদের দুই দেশকেই F-16 বিক্রি করেছে।
-কেন?
-সেটাই তো ব্যবসা, তুমি বুঝবে না।
-উফ! আবার! তুমি প্রথম কবে F-16 দেখেছ?
-অনেক দিন আগে। আর্মি থেকে রিটায়ার করার পরে।
বৃদ্ধ সিয়াম, তার পাকা গোঁফে হাত বুলিয়ে নাতিকে সহজ ভাবে বোঝাতে লাগল
-ইজরায়েল F-16 কেনে ১৯৭৯-৮০ সালে। তখন ইরানের শাহকে তখৎ থেকে নামিয়ে ফান্ডামেন্টালিস্ট আয়াতুল্লা খোমেইনি ইরানের ক্ষমতা দখল করেছে। তার আগে আমেরিকা ইরানকে F-16 দেবে বলে চুক্তি করেছিল। কিন্তু এই নতুন সরকারকে ততটা ভরসা করতে না পেরে, ততদিনে তৈরি হয়ে যাওয়া প্লেন ইজরায়েলকেই দিয়ে দেয়। আর ইজরায়েল তখন ভীষণভাবে এই লং রেঞ্জের প্লেন খুঁজছিল।
-কেন? আমাদের তো ছোট দেশ, লং রেঞ্জ দিয়ে কি হবে?
মৃদু হেসে ১১ বছরের নীল চোখের নাতিকে বোঝাতে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সিয়াম। গাড়ি তখন তুরান ছেড়ে গিভাতের কাছাকাছি। গাড়ির ড্রাইভার আরব খৃষ্টান। উৎসুক চোখে সেও তাকালো সিয়ামের দিকে।
-আমাদের, মানে ইহুদীদের শত্রু অনেক। ঘরে, বাইরে, সর্বত্র। ভেবেছিলাম ইন্ডিয়া থেকে ইজরায়েলে এসে নিজের দেশ পাবো। বাবা, খুব অল্প বয়সে মা বাবা মারা গেলে কলকাতাতে নিজেকে কেমন একা একা লাগতে লাগল। কলকাতাতে আমাদের ব্যবসা প্রায় ২০০ বছর। সব ছেড়ে চলে এলাম।
-কেন দাদু? কলকাতাতে কি ইহুদীদের থাকতে দিচ্ছিল না? জার্মানদের মতো? আমি বইয়ে পড়েছি। হলোকাস্ট!
- না, দাদুভাই, কলকাতাতে আমাদের কোনও হলোকাস্ট ছিল না। ব্রিটিশরা চলে গেল। আমরা ওদের ছত্রছায়াতেই ব্যবসা করতাম। ব্রিটিশ আমাদের বলেছিল ইজরায়েল বানিয়ে দেবে। আমেরিকার সাপোর্টও ছিল। আমরাও ভাবলাম, নিজেদের দেশ হবে। চলেই যাই।
-তারপর?
-তারপর তো দেখতেই পাচ্ছ। চারিদিকেই শত্রু।
-আমরা কিন্তু ইহুদীদের শত্রু না, স্যার।
ড্রাইভার আর চুপ না থাকতে পেরে মুখ খুললো।
-না, সে কথা বলছি না। যাকগে, সেই সময় ইজরায়েল প্রধান মন্ত্রী মেনাখিন বেইগিন আর ইরাকের সাদ্দাম হুসেন। ডিক্টেটর হিসেবে দুর্নাম ছিলো সাদ্দামের। তার পেছনে সোভিয়েটের সাপোর্ট ছিল প্রচুর। ঠিক যেমন আমেরিকার সাপোর্ট ছিল ইরানের প্রতি।
একটু দম নিল সিয়াম,
-আমাদের কাছে খবর ছিল ইরাক অ্যাটম বোম বানাচ্ছে। উদ্দেশ্য ইজরায়েলকে পৃথিবীর ম্যাপ থেকে মুছে দেওয়া।
অবাক চোখে ডেভিড, দাদু সিয়ামকে জিজ্ঞাসা করলো,
-কি করে বুঝলে ইরাক অ্যাটম বোম বানাচ্ছে? নিউক্লিয়ার এনার্জিও তো বানাতে পারত।
-আসলে ইরাকের তো নিউক্লিয়ার এনার্জির দরকার ছিল না। ওরা এমনিতেই খনিজ তেলে সমৃদ্ধ। তবুও ইরাক নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম শুরু করে ১৯৬০ সাল থেকে। কিন্তু ইরাকের পারমানবিক অস্ত্র বানানোর যন্ত্র আর বিজ্ঞানী কোনটাই ছিল না। ছিল শুধু প্রচুর তেল আর সেই তেল বেচা কয়েক’শ বিলিয়ন ডলার। সেই নিয়ে সাদ্দাম হুসেন রিয়াক্টার কিনতে বাজারে নেমে পরে। আর তাকে রিয়্যাক্টর বেচতে রাজী হয় ফরাসী প্রেসিডেন্ট জ্যাক সিরাক। তার অনেক দিনের বন্ধু।
-আমেরিকা কেন ফ্রান্স কে বারণ করেনি ?
-চেষ্টা যে করেনি তা না, কারণ আমেরিকা জানত এই বোম ইজরায়েলের উপরেই ব্যবহার হবে। সাদ্দাম আরব নেতাদের সেই রকম হিন্টস দিয়েছিল। আমেরিকান হিসাব মতে তিনটে বোম ফেলতে পারলে ইজরায়েলের অর্ধেক পপুলেশন আর বড় শহরগুলোকে ধ্বংস করা যেতে পারত। ফ্রান্স আসলে সেই সুযোগে ইরাককে ওদের আরও কিছু মিরাজ জেট প্লেন আর মিলিটারি হার্ডওয়ার বিক্রি করে। ভালোই বিজনেস প্ল্যান ছিল সেটা। প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের ডিল। শুধু আমেরিকা না, ইজরায়েল বিদেশ মন্ত্রী নিজেও চেষ্টা করেছিলেন যাতে এই ডিল না হয়। কিন্তু সাদ্দাম ভীষণ দ্রুত এই প্রজেক্টে কাজ শুরু করে। প্রজেক্টের নাম দেয় ‘তামুজ’
-তামুজ কি দাদু?
-ব্যবিলনিয়ান ক্যালেন্ডারের একটা মাস, যে মাসে নেবুকডনেজার ৫৮৬ খৃষ্ট পূর্বাদে ইহুদীদের উপর অত্যাচার করা শুরু করেছিল। ব্যাপারটা অন্য দেশ এড়িয়ে গেলেও আমাদের নজর ছিল।
-তারপর কি হলো? কারটা ততক্ষণে টিবেরিয়াসের কাছে এসে গেছে। ট্রাফিক বেশি হওয়াতে ড্রাইভার ধীরে চালাচ্ছে, কানটা যদিও দাদু নাতির গল্পের দিকে আছে।
-ইয়েভস গিরার্ড, ফরাসী ডিজাইনার এই ৪০ মেগা ওয়াটের ‘আসিরাক’ রিয়্যাকটার বানিয়েছিল ।
-আসিরাক মানে? আগে যে বললে আসিরিস?
-আসিরিস হচ্ছে রিয়্যাক্টারের ক্লাস, আর যেহেতু সেটা ইরাককে দেওয়া হয়েছিল, তাই তার নাম দেওয়া হয়েছিল আসিরাক।
-ও, তারপর ?
-বাগদাদ থেকে ১৭ কিমি দূরে তুয়াইথা নিউক্লিয়ার সেন্টারে কাজ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। ইজরায়েল সরকার প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছিল যাতে ইরাক একে চালু না করতে পারে। আর সেই দায়িত্ব দেওয়া হোল মোসাদকে।
-মোসাদ, ভীষণ ডেঞ্জারাস গ্রুপ, স্যার! সরি, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড!
ড্রাইভার আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল।
-হুম, মোসাদকে রাখাই হয়েছে এস্পায়োনেজ, ব্ল্যাক মেইল আর দেশের শত্রু’দের খতম করার জন্য। আর এই কাজে আমাদের সাহায্য করেছিল ইরান!
-ইরান?
-হ্যাঁ, সে পরে বলছি, মোসাদ প্রথমেই, ফ্রান্সের এক গোডাউন যেখানে রিয়্যাক্টরের কোর শিপমেন্টের জন্য রাখা ছিল, সেটা বোমা মেরে বাইরের একটা অংশ উড়িয়ে দিল। কিন্তু তাতে সাদ্দাম দমার পাত্র না। কাজ চলতে থাকল। ফ্রান্সে’র এজেন্সি থেকে খবর পাওয়া গেল ইজিপ্টের এক নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট ইয়াইয়া আল মাসাদ, প্যারিসে বসে ইরাকের এই প্রজেক্টে কাজ করছে। তাকে একদিন, হোটেলের রুমে মোসাদ খুন করে, এমনকি এক কল গার্ল সেটা হোটেলের লবি থেকে দেখে ফেলেছিল, তাই তাকেও পুলিসের কাছে কিছু বলার আগেই একটা ব্ল্যাক মার্সিডিজ চাপা দিয়ে মারে।
-কল গার্ল কি দাদু?
একটুক্ষণ চুপ করে থাকল, সিয়াম।
-বড়ো হও তখন বুঝবে।
-উফ! ঠিক আছে, আগে বলো।
সিয়াম একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করল,
-এদিকে ততদিনে ইরানের সাথে যুদ্ধ লেগে গেছে। ইরাকি এয়ারফোর্স ইরানকে নাস্তা নাবুদ করে রেখেছে। তার মধ্যেই একদিন, ইরান এয়ারফোর্সের এফ-৪ ফ্যান্টম ফাইটার প্লেন এই রিয়্যাক্টর আক্রমণ করে। সেটা ১৯৮০’র অক্টোবর মাস। ওদের কাছেও খবর ছিল, জুলাই মাসে সাড়ে বারো কেজি ইউরেনিয়াম ইরাকে এসে গেছে। ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি ছিল, ইরাক কখনও ২৪ কেজির বেশি ইউরেনিয়াম স্টক করতে পারবে না। ইরানের ভয় তো আমাদের থেকেও বেশি, কারণ তখন তো ওরা রীতিমত ইরাকের সাথে যুদ্ধ লড়ছে।
ওদিকে আমেরিকান প্রাইভেট ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি স্ত্রাটফর ইরানকে জানিয়েছিল যে, ওই ইউরেনিয়াম থেকে প্লুটোনিয়ম তৈরি হতেই পারে।
-উফঃ, একদম জেমস বন্ডের সিনেমার মতো, তাই না দাদু?
-হ্যাঁ, কিন্তু একদম সত্যি ঘটনা। ইরানের আক্রমণে রিয়্যাক্টরের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। ইরানি পাইলটদের ভয় ছিল, রিয়্যাক্টরে বোমা মারলে নিউক্লিয়ার রিয়্যাকশনে ঐ এলাকার মাটি, বাতাস যদি দূষিত হয়। তাই তারা পাশের বিল্ডিং, কন্ট্রোল রুম আর প্ল্যান্ট কুলিং মেকানিজমে বোমা মেরে ফিরে যায়। এই আক্রমণের ফলে ইটালি আর ফ্রান্সের ইঞ্জিনিয়ররা দেশে পালিয়ে গেলে কিছু দিন কাজ বন্ধ থাকে।
-ব্যাস, তাহলে তো হয়েই গেল!
-না, কিছুদিন পরে ওরা আবার ফিরে এলে পুরো উদ্দমে কাজ শুরু হয়। আর এইবার ইজরায়েল নড়েচড়ে বসে। ডিপ্লোম্যাটিক রাস্তাতে কাজ হয়নি, মোসাদকে দিয়েও কাজ হলো না, তাই প্রধান মন্ত্রী মেনাকেন বেগিন একটা ফুল স্কেল রিয়্যাক্টর মডেল বানিয়ে এয়ার ফোর্সের পাইলটদের প্র্যাকটিস শুরু করতে বলেন। এত কঠিন সেই প্র্যাক্টিস, তাতেই তিনজন পাইলট ক্র্যাশ করে মারা যায়।
-যাহ!
গাড়িটা ততক্ষণে একটা হট ওয়াটার রিসর্টের পাস দিয়ে যাচ্ছিল। জানলা দিয়ে মুখ বের করে ডেভিড অবাক চোখে তাকিয়ে। রঙিন ছাতার নীচে স্বল্পবাস সুন্দরীরা গায়ে রোদ লাগাচ্ছে। ওদিকে গরম জলের ফোয়ারা। সিয়ামের ঘোলাটে চোখে ভেসে উঠল, বহুদূরে বহুদিন আগে ফেলে আসা গোয়ার সী বীচের একটা ছবি। বাবা মা’র সাথে গোয়া গেছিল। তখন সেটা পর্তুগীজ কলোনি। দূর সম্পর্কের কাকা’র কাজু বাগান, সাথে ফেনি’র ডিস্টিলেশন প্ল্যান্ট, আর নারকেল গাছের মধ্যে দিয়ে দূরে জুয়াড়ি নদী। সেখানেই দেখা মিশেলের সাথে। ১৪ বছরের মিশেল, ওরা ছিল স্প্যানিশ ইহুদী। দুই পুরুষ আগে পর্তুগীজদের সাথে গোয়াতে এসেছিল ব্যাবসা করতে।
-দাদু!
ঘোর কাটল ডেভিডের ডাকে।
-দাদু, আমরা কিন্তু এখানে স্নান করবো।
-হ্যাঁ দাদুভাই, গ্যালিলী’র জল মিস্টি। স্নান করবো।
দাদু আর নাতি, গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে একটা একটা আটলান্টিক পেস্তা গাছের নীচে ব্যাগটা নামিয়ে কস্টিউমে চেঞ্জ করে নিতে নিতে ডেভিড আবার ফিরে গেল গল্পে।
-দাদু, পেস্তা গাছটা দেখেছ, কি বিশাল, তাই না ?
-হ্যাঁ, আমাদের এই মরুভূমিতে পেস্তা গাছ ভালো হয়। আর গোলান হাইটের শুকনো গরম কাল, আবার শীত কালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তাই এই গাছ ফলন প্রচুর দেয়। আর এই সব নিয়েই তো গোলান হাইট নিয়ে আমাদের সাথে সিরিয়ার এত যুদ্ধ।
রিসর্ট থেকে ওয়েটার এসে জানতে চাইল কিছু চাই কিনা। ডেভিড তার ফেভারিট ফালাফাল খেতে চাইল। সিয়াম নিজের জন্য একটা বীয়ার আর এক প্লেট মধুতে ডোবানো আপেল স্লাইস দিতে বলে জলে নামলে, ডেভিড একটা রাফট নিয়ে দাদুর পাসে শুয়ে বললো,
-ওহ, তুমি আগে ইরাকের গল্পটা বলো। ইরানের এয়ার অ্যাটাকে তো কিসসু হলো না। তারপর? - ৮১’র মে মাসে আমাদের এক ইজরায়েলি অফিসার, ইরানের খোমেইনি সরকারের এক প্রতিনিধির সাথে দেখা করে। সেই মিটিঙে ইরান তার এক বছর আগের অ্যাটাকের সমস্ত তথ্য আমাদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু...
-কিন্তু কি?
-ইরান আর ইরাক তো প্রতিবেশী দেশ। আর আমাদের দেশ থেকে ইরাকের এই নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট প্রায় ১০০০ কিমি দূরে। এত দূর থেকে ফাইটার প্লেনের পক্ষে গিয়ে রিয়্যাক্টারকে মেরে আসা অসম্ভব। তেলের ট্যাঙ্ক ভরে নিয়ে গেলেও ফুরিয়ে যেতে পারে। তাই ইরানের সেই অফিসার, ইজরায়েলকে ইরানে তাদের তাব্রিজ এয়ার বেস থেকে রিফুয়েলিং করার, মানে তেল ভরে দেবার প্রস্তাবও দেয়।
বুক জলে নেমে সিয়াম হালকা করে মাথায় একটু জল দেয়। ছোটোবেলার কথা মনের কোণে উঁকি মারে। কলকাতার বাবুঘাটে বিহারী কুলিদের দেখত, স্নান করতে নামার আগে মাথায় আর বুকে একটু করে জল দিয়ে থাবা মারতে। বেশ লাগত দেখতে।
-বুঝলে দাদুভাই, ইরানের সরকার নীতিগত ভাবে আমাদের বিরুদ্ধে, কিন্তু ইরাক পারমানবিক বোম পেলে ইরানের উপরেও ব্যবহার করবে এই ভয়েই আমাদেরকে এতটা সাহায্য করতে রাজী ছিল।
-আচ্ছা দাদু, ধর্ম আগে না জান আগে?
শিশুর মনে এক অদ্ভুত প্রশ্ন জেগে ওঠে।
-বুঝলে দাদুভাই, ধর্ম, জাতি, মাটি, দেশ এসবই থাকবে, যদি জান বাঁচে। ৪৭ সালে, আমি কলকাতাতে দেখেছি, পাকিস্তান থেকে ধর্মের ভয়ে বাড়ি, জোত, জমি ছেড়ে হিন্দুরা ইন্ডিয়াতে পালিয়ে এসেছে। তারপরেও সবাই যে প্রাণে বেঁচেছে, তাও না।
-ধর্মের ভয়ে মানে? কেউ কি ধর্ম কেড়ে নিতে পারে?
-না, ওখানে খুনোখুনিটা ধর্ম-ভিত্তিক ছিল। আমাদের মতো জাতি-ভিত্তিক না।
-তুমি তাহলে কেন ইন্ডিয়া ছেড়ে ইজরায়েলে চলে এসেছিলে? তোমাকে কি ওরা মারবে বলেছিল?
-না, আমি তো ইহুদীদের নিজের দেশ, ইজরায়েল পাবো বলে এসেছিলাম। সে এক অন্য গল্প দাদুভাই। যাকগে, ইরানের সেই প্রস্তাব কিন্তু আমরা নিইনি। আমাদের প্ল্যান ছিল কিভাবে ইজরায়েলের কোনও এয়ারবেস থেকে গিয়ে ইরাকের রিয়্যাক্টার আসিরাককে উড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসা যায়।
- কেন দাদু? আমরা ইরানের তেল নিলাম না কেন?
-এটা শুধু তেল ভরার সমস্যা ছিল না দাদুভাই। এই ধরনের আক্রমণে গোপনীয়তা একটা ভাইটাল ব্যাপার। একটা বিদেশী শক্তি, যে নিজেও আমাদের শত্রু, তার এয়ারবেসে একসাথে আট দশ খানা ইজরায়েলি প্লেন ল্যান্ড করা মানেই আক্রমণের খবর গোপন সূত্রে লিক হয়ে যাওয়া। এয়ার ফোর্সের ফাইটার প্লেন নিয়ে আক্রমণ করতে গেলে রিয়্যাক্টরের ছবি চাই। সেই কাজের ভার দেওয়া হলো ইরান এয়ার ফোর্সকে। ওদের এয়ার ফোর্সের একটা F-4 ফ্যান্টম বিমান রেকি করে রিয়্যাক্টরের ছবি তুলে আনল। আর সেই ছবি ইজরায়েলে চলে এল এক টপ সিক্রেট মেটাল বাক্সে করে। ইরানের কাছ থেকে আমরা রিয়্যাক্টারের সঠিক অবস্থান, সাইজ আর কিছু ছবি পেয়ে গেলাম, সেগুলো দিয়েই আমাদের এয়ার ফোর্সে প্র্যাকটিস করতে শুরু করল।
-রেকি মানে কি দাদু?
-ফরাসী শব্দ, মিলিটারি ভাষায় রেকি বা রেকনেশাঁ মানে শত্রু এলাকাতে গিয়ে তার অবস্থান, অস্ত্রসস্ত্র, রসদের স্টোর এই সব দেখে ছবি তুলে নিয়ে আসা। কিন্তু বাধ সাধল আমাদের পার্লামেন্ট মানে ‘কেনেসেট’ এ ক্যাবিনেটের কিছু সদস্য।
-কেন? কেনেসেট কি ভয় পাচ্ছিল?
-তখন এই আক্রমণ নিয়ে ইজরায়েলি সরকার দ্বিধা বিভক্ত। আক্রমণের বিরুদ্ধে যারা ছিল তাদের যুক্তি ছিল, এরকম করলে আন্তর্জাতিক স্তরে ইজরায়েল বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হবে। আরবদের ইজরায়েল সম্বন্ধে যে ভয়, সেটা বেড়ে গেলে শান্তির সুযোগ কমে যাবে। আর ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবেই, কারণ আকাশ পথে অতর্কিত হামলা হলে ওখানে কাজ করছে এরকম কিছু ফরাসী নাগরিক তো মারা যাবেই।
-তাহলে কি হবে দাদু?
-কি আবার হবে, ক্যাবিনেটে ভোটাভুটি হলো। আক্রমণের পক্ষে ১০ জন আর বিপক্ষে ৬ জন ভোট দিলে আক্রমণ ফাইনাল। কিন্তু ঠিক কোন সময়, আর কিভাবে আক্রমণ হবে সেটা ঠিক করার দায়িত্ব দেওয়া হলো কেবল মাত্র প্রাইম মিনিস্টার মেনাখিন বেগিনকে।
ওয়েটার এসে এক প্লেট ফালাফাল পাসে রাখতেই ডেভিড প্লেট হাতে একটা ফালাফাল তুলে দাদুর মুখে দিলো।
-জানো দাদুভাই, কলকাতাতে আমরা মাঝে মধ্যেই কাবাব খেতাম।
-কাবাব কি?
-এই যে, ফালাফালের মতোই। খুব টেস্টি। যাকগে তারপর অসামরিক সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর, প্রধান মন্ত্রী বেগিনের হাতে আক্রমণের ডেট আর টাইম নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। রিয়্যাক্টর চালু হয়ে যাওয়ার পর আক্রমণ করলে রেডিও অ্যাক্টিভ বিচ্ছুরণ বাগদাদ পর্যন্ত ছড়িয়ে পরতে পারে। আশেপাশে যারা থাকবে তারাও আক্রান্ত হবে।
-তা হলে তারিখ কি করে ঠিক করবেন?
-প্রধান মন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসে। মোসাদের মতো আরও অনেক এজেন্সি আছে, যারা শুধু তাকেই সমস্ত ইনফরমেশন দেয়।
-বুঝেছি! জেমস বন্ড’এ ‘কিউ’ আন্টি’র কাছেও অনেক খবর থাকে।
-হুম, তেমনি মোসাদ খবর এনে দিলো। ৮১’র জুন মাসের মধ্যেই রিয়্যাক্টর ক্রিটিক্যাল হবে।
-ক্রিটিক্যাল মানে কি দাদু? -নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর চালু করা। আমাদের ভয় ছিল, চালু হওয়ার পরে তার উপরে বোম মারলে নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন এ আশেপাশের এলাকা দূষিত হতে পারে। তাতে ইন্টারন্যাশনাল রাজনীতিতে আমাদের দুর্নাম বেশি হবে।
-আচ্ছা মোসাদ এই সব খবর কি করে পেত?
-ওরা এই খবর আমেরিকান উপগ্রহ ‘কেনান’ এর ছবি চুরি করে পেয়েছিল। আর তাছাড়া আরোও অনেক সোর্স থাকে। পরবর্তিতে অবশ্য ফ্রান্সের এক টেকনিশিয়ান বলেছিল, রিয়্যাক্টার ক্রিটিকাল করার প্ল্যান ছিল নভেম্বর এ।
-তারপর?
-ইজরায়েল এয়ার ফোর্স প্র্যাকটিস শুরু করলো। ইরানের শাহকে উৎখাত করে আয়াতুল্লা খোমেইনি তখন ইরানের প্রেসিডেন্ট। সেই সময় আমারিকা, ইরানকে যে নতুন F-16 ফাইটার প্লেন দেবে বলে ঠিক ছিল। কিন্তু নতুন ফান্ডামেন্টালিস্ট সরকারের মতিগতি ভালো না ঠেকার ফলে সেই ডিল ক্যান্সেল হয়ে গেল। এদিকে লকহীড কোম্পানি প্লেন বানিয়ে ফেলেছে। সেগুলো কি হবে? আর সেই মুহূর্তে এই ধরনের প্লেন খুঁজছিল ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স, ব্যাস, প্লেন পেয়ে গেল ইজরায়েল। ঠিক হলো এই F-16 দিয়েই আক্রমণ হবে।
-কেন? F-16 প্লেন দিয়ে কেন? একটা ইঞ্জিন বলে? দুটো ইঞ্জিন হলেই তো ভালো! বেশি শক্তি হবে, তাই না?
-F-16 এর অনেক অ্যাডভান্টেজ আছে। যেমন ধরো এর থ্রাস্ট টু ওয়েট রেশিও এক এর চেয়ে বেশি। মানে এই জেট ইঞ্জিনের ক্ষমতা তার ওজনের থেকে বেশি।
-তাতে কি হবে? প্লেনটা আকাশ থেকে পড়বে না?
একটু হেসে, বীয়রে এক চুমুক মেরে সিয়াম বলল,
-না, যে প্লেনের এই থ্রাস্ট টু ওয়েট রেশিও এক এর চেয়ে বেশি, তার নাক বরাবর ওঠার ক্ষমতা বেশি। ধরো, প্লেনটা মাটির খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, টার্গেটের কাছে এসে ওকে অনেক উঁচুতে গিয়ে ডাইভ মেরে রিয়্যাক্টরের উপরে নেমে এসে হিট করতে হবে। F-15 এর থেকে F-16 এই কাজটা অনেক ভালো করতে পারে। F-16 ‘র স্পীডও বেশি, সী লেভেলে ১.২ ম্যাক, আর হাই অল্টিটিউডে ২ ম্যাক।
-ম্যাক মানে? তুমি তো একদিন নট বলেছিলে!
-না, নট মানে দূরত্ব। কিলোমিটারের চেয়ে বেশি। ম্যাক হচ্ছে প্লেনের স্পীড, মানে এক ঘন্টায় কত কিমি যেতে পারে। এক ম্যাক মানে শব্দের স্পীড, ঘন্টায় প্রায় ১২০০ কিমির কাছাকাছি। যে প্লেন শব্দের চেয়ে দ্রুত উড়তে পারে তাকে বলে সুপারসনিক প্লেন।
-আচ্ছা দাদু, সী লেভেলে প্লেনের স্পীড কম কেন?
-অনেক কারণ আছে। যেমন ধরো, মাটির কাছাকাছি বাতাসের ঘনত্ব বেশি, তাই ফ্রিকশন বেশি। যাকগে, একটা ইজরায়েলি ফ্যান্টম রেকি প্লেন একবার সৌদি আরবের উপর দিয়ে ইরাকে ঢুকেও পরে, তাকে অবশ্য এক ইরাকি Mig-21 তাড়িয়ে দেয়, কিন্তু তাড়া করতে গিয়ে মিগের তেল ফুরিয়ে গেলে বেচারি পাইলটকে ইমারজেন্সি ইজেক্ট করে প্যারশ্যুট নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়। কিন্তু সেই মিশন থেকে ইজরায়েল বুঝতে পারে ইরাকের রাডার সিস্টেমে একটা ব্ল্যাক হোল আছে। মানে যেখান দিয়ে প্লেন ইরাকে ঢুকলে ইরাকের কোনও রাডার ধরতে পারবে না। আর সেটা যেহেতু সৌদি আরবের সাথে বর্ডারে, আর সৌদির সাথে ইরাকের যুদ্ধের চান্স কম, তাই ইরাক সেই প্যাচটা কভার না করেই ছেড়ে রেখেছে।
-আচ্ছা দাদু, সৌদির সঙ্গে ইরাকের যুদ্ধ হবে না কেন? তুমি তো বলেছিলে, কুয়েত যুদ্ধে আমেরিকা সৌদি এয়ার বেস থেকে ইরাকে আক্রমণ করেছিল।
-সৌদি সরকার সব সময় নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে আমেরিকার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। এগুলো সব আন্তর্জাতিক রাজনীতি। তুমি এখন সব বুঝবে না। আমাদের কাছে আসলে ইরাক এয়ার ফোর্স একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু ওরা তখন ব্যস্ত ইরানের সাথে যুদ্ধে। এপ্রিলের শুরুতেই ইরান একবার ইরাকের H-3 এয়ারবেস আক্রমণ করে। এই বেসটা ইরাক-জর্ডন বর্ডারের কাছে। এতে ইরানের চারটে F-4 ফ্যান্টম ফাইটার লং রেঞ্জ বম্বিং করে প্রায় ৪৮ খানা ইরাকি মিগ আর Tu-22, Tu-16 বিমান ধ্বংশ করে দেয়। এই রাসিয়ান Tu-22, Tu-16 লং রেঞ্জ বম্বার প্লেনগুলো ইজরায়েল পর্যন্ত ধাওয়া করে বোম ফেলে আসতে পারত। ইজরায়েলী ‘রেকি’ প্লেন ইরাকের এয়ার ফোর্সকে নজরে রেখে বুঝতে পারছিল যে ওদের শক্তি অনেকাংশেই কমে গেছে। আমাদের পাইলট ছিল জেভ রাজ, আমোস ইয়াদলিন, ডব্বি ইয়াফফে, হাগাই কাটজ, আমির নাচুমি, ইফতাছ স্পেক্টর, রেলিক সাফির, ইলান রামোন।
-ইলান রামোন! আমি ওর ছবি দেখেছি!
-হ্যাঁ, রামোন আমাদের প্রথম মহাকাশ যাত্রী। তখন ২৬ বছর বয়সী এই মিশনের সবচেয়ে কম বয়সী পাইলট। পরে অবশ্য ও কলম্বিয়া স্পেস সাটল অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিল। জেভ ছিল মিশনের কম্যান্ডার। পরে অবশ্য ও 'চীফ অফ স্টাফ' ডেকোরেশন পেয়েছিল।
-তুমি ওদের কাউকে চেন দাদু?
-রেলিক সাফির আর আমি ৭৩ এ ‘ইয়ম কপুর’ যুদ্ধে সিরিয়া বর্ডারে ছিলাম। ওর দাদু ছিলেন জার্মান ইহুদী। হিটলারের গ্যাস চেম্বারে মারা গেছিলেন। রেলিক মাঝে মাঝেই বলতো, দাদুর গ্যাস চেম্বারের ঋণ আছে, যেটা ওকে শোধ করতে হবে। ইজরায়েলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোনোও ভাবেই আরেকবার হলোকাস্ট এ মরতে দেবে না।
আমাদের আক্রমণের মুখ্য ভূমিকাতে ছিল ৮ খানা F-16 ফাইটার, প্রত্যেক প্লেনে দুটো করে ২০০০ পাউন্ডের ‘মার্ক-৮৪’ বোম। তার সঙ্গে ছিল ৬ খানা F-15 ফাইটার প্লেন ঐ প্রধান বোমারু গ্রুপকে কভার দিয়ে রাখার জন্য।
-প্রাইম মিনিস্টার কবে অ্যাটাক করতে বললেন?
ডেভিডের চোখে মুখে একটা উদ্বেগের চিহ্ন।
-না, সৌদি আর ইরাকের বর্ডারে, যে ব্লাইন্ড স্পট আগেই দেখে রাখা ছিল, সেইখান দিয়ে ইজরায়েলী অ্যাটাক স্কোয়াড্রন মাটি থেকে মাত্র ৩০ মিটার উঁচুতে ফ্লাই করে এগিয়ে গেল বাগদাদের দিকে যাতে ইরাকি রাডারে ধরা না পরে। ততক্ষণে দুটো F-15, ইরাকি ফাইটার প্লেনের আক্রমণের প্রতিরক্ষায় F-16 গুলোর সাথে থেকে গেলেও, বাকিরা ফিরে আসে। ১ ঘন্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে স্কোয়াড্রন ‘আসিরিক’ এর ২০ কিমি দূরত্বে এসে হাইট বাড়িয়ে ২১০০ মিটারে উঠলে নীচে দেখতে পায় রিয়্যাক্টর ডোম। জে’ভ রাজ লিড করছিল, তার প্লেন এবার সেই ২১০০ মিটার থেকে প্রায় ৩৫ ডিগ্রিতে গোঁত্তা মেরে ১১০০ মিটারে নেমে এসে টার্গেটে হিট করতে গেলে বুঝতে পারল, টার্গেট মিস করে যাচ্ছে। জেভ এর উইং ম্যান ছিল ইয়াদলিন।
-উইং ম্যান কি করে?
-একটা প্লেন যখন টার্গেটে আক্রমণ করতে যায়, তখন তার উইং এর থেকে একটু পেছনে আরও একটা প্লেন থাকে যে, ওই মেন প্লেনকে গ্রাউন্ড বা এয়ার অ্যাটাক থেকে কভার করে। জেভ নিজের ক্যাল্কুলেশনে ভুল বুঝতে পেরে আবার আকাশে সার্কেল কেটে উপড়ে উঠে গেলে, উইং ম্যান ইয়াদলিন নেমে এসে প্রথম বোম দুটো একদম রিয়্যাক্টারের ডোমে ড্রপ করে।
তার পর এক এক করে প্রত্যেকটা প্লেন তাদের 'পড' থেকে দুটো করে মার্ক -৮৪ বোম ড্রপ করতে থাকে।
-বোমগুলো ঠিক টার্গেটে পরেছিল?
-১৬ টার মধ্যে ২ টো বোম ফাটেনি, আর বাকি ১৪ টার মধ্যে ৮ খানা বোম রিয়্যাক্টারের ডোমের উপরে গিয়ে হিট করে। পুরো অ্যাকশন দুই মিনিটে শেষ। সবগুলো প্লেন ডাইভের পরে কম হাইটে কিছুটা উড়ে অ্যান্টি এয়ার ক্রাফট গানের রেঞ্জের বাইরে চলে আসে।
-তারপর কি হলো? ইরাকি এয়ার ফোর্স কিছু করল না?
-না, ওদের রাডার সেই সময় শিফট চেঞ্জের জন্য অফ ছিল। বিমান বিধ্বংসী কামান কিছুক্ষণ এদিক ওদিকে ফায়ার করেছিল, ‘সার্ফেস টু এয়ার’ মিসাইল মানে, সোভিয়েত রাশিয়ান স্যাম মিশাইলগুলোও ফায়ার করতে পারেনি রাডার ওয়ার্ম আপ হতে পারেনি বলে। ওদের আসল নজরটা ছিল পূর্বে ইরানের দিকে। ইরাক ভাবতেও পারেনি পশ্চিম দিক থেকে ইজরায়েল এসে এই নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট আক্রমণ করতে পারে।
-অনেক লোক মরেছিল?
-না, প্ল্যান অনুযায়ী রবিবার সন্ধ্যেবেলা আক্রমণ হয়েছিল, তাই মাত্র একজন ফ্রেঞ্চ টেকনিশিয়ান মারা গেছিল।
-ফ্রান্স কিছু বলেনি?
-তার ফ্যামিলিকে ইজরায়েল কম্প্যানসেশন দিয়েছিল। আর জনা দশেক ইরাকি সৈন্য মারা গেছিল, তাও আবার নিজেদের ফায়ারিং এই।
-আর আমাদের প্লেনগুলো ফিরে আসতে পেরেছিল?
-হ্যাঁ, প্রায় লাস্ট ড্রপ তেলে ল্যান্ড করে। ল্যান্ড করার পরে, প্রত্যেক পাইলট নিজদের জড়িয়ে ধরে। নিজেদেরই বিশ্বাস করতে সময় লেগেছিল যে সবাই ফিরে আসতে পেরেছে।
-আর আমেরিকা, রাশিয়া এরা কিছু বলেনি ?
-অনেক দেশ তাদের বক্তব্য রেখেছিল। আমেরিকান সেক্রেটারি অফ স্টেট আলেক্সেন্ডার হেগ যখন প্রেসিডেন্ট রেগনকে খবরটা দেন, রেগন চোখ বড়ো করে চীৎকার করে বলেন, ‘হোয়াট!’ কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুস এর তীব্র নিন্দা করেন। এমন কি United Nations এর সাধারণ সভাতে আমাদের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবও পাস হয়।
-তো আমরা কি বলেছিলাম?
-আমাদের প্রাইম মিনিস্টার পরিস্কারভাবে বলে দিলেন, ‘আমাদের নিজেদের দেশের সীমা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে আমাদের এই স্বতপ্রণোদিত আক্রমণ। আর সেইখান থেকেই ইজরায়েল, “আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণ” এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
অন্য অনেক দেশের মিলিটারি লিডাররা অবশ্য আলাদা করে আমাদের আক্রমণের অ্যাকিউরেসি আর গোপনীয়তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯১ সালে ইরাক কুয়েত দখল করে, আর আমেরিকার নেতৃত্বে অপারেশন ‘ডেজার্ট স্টর্ম’ শুরু হয়, তখন সেই সময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ নিজেই প্রেসিডেন্ট। আর আমাদের চীফ, জেনারেল ইভ্রি তখন United Nations এ ইজরায়েলের রাষ্ট্রদূত। সেই ইভ্রি সাহেবের হাত ধরে আমেরিকান সেক্রেটরি ডিক চেনি বলেছিলেন, ‘সেদিন যদি ইরাকের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম আপনারা উড়িয়ে না দিতেন, তাহলে এত সহজে আমরা কুয়েতকে ইরাকের হাত থেকে মুক্ত করতে পারতাম না।’
একটু হেসে ডেভিড দাদুকে জিজ্ঞেস করে,
-ইন্ডিয়া কি বলেছিল?
-ইন্ডিয়া তার নিজের সমস্যা নিয়ে আছে, দাদুভাই। নিজের মুসলিম ভোটারদের সামনে প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করে। ইয়াসের আরাফতকে ডেকে সরকারি আর বিরোধী দল সম্বর্ধনা দেয়। কিন্তু আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে মিলিটারি সাপোর্ট দরকার, তাই আমাদের সাথে অস্ত্র আর টেকনলজি এক্সপোর্ট এগ্রিমেন্টও করে রেখেছে।
চলো এবার ঘরে ফেরা যাক।
অনেকদিন পর গল্প পড়লাম। অন্যরকম লাগল। কিন্ত দারুন।
ReplyDeleteঅনেকদিন পর গল্প পড়লাম। অন্যরকম লাগল। কিন্ত দারুন।
ReplyDelete