Next
Previous
Showing posts with label প্রাচীন কথা. Show all posts
0

প্রাচীন কথা - সৌহার্দ্য সেন ও ঋত্বিক ঘটক

Posted in

মহাভারত কালের খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থান:

অনেক খুঁজে না পাওয়া তথ্য, মেলাতে না পারা অঙ্ক আর ভুলে যাওয়া সময়ের সাক্ষী একটি ব‌ই- মহাভারত। কবিগুরুর ভাষায়, "একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।" 'ইতিহাস', কারণ মহাভারত শুধুই যুদ্ধ, খুনোখুনি আর রাজনীতির কথা বলে না; বরং আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পুরোনো জনজাতির সংস্কৃতি, জীবনযাপন, আচার-ব্যবহার, ভৌগলিক তথ্য, বিজ্ঞান চর্চা সমস্ত কিছুর এক বিরল সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু মহাভারত তো শুধুই ইতিহাস লেখার জন্য লেখা কোনো টেক্সট বই নয়। এটি গল্পের ছলে বলা এক সময়ের ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত এনসাইক্লোপিডিয়া।

মহাভারতের কবি বলতে বেদব্যাসের নাম পরিচিত হলেও পণ্ডিতরা বলেন, বছরের পর বছর বহু কবির হাতে সামাজিক, রাজনৈতিক নানা কারণে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে মহাভারত। আর তাই মহাভারতের পাতায় এক‌ই সঙ্গে প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। এতবার এডিট হ‌ওয়া কাহিনীটি গল্প প্রিয় পাঠকের জন্য বেশ জটিল হলেও তথ্যপ্রেমী পাঠক বেশ মজাই পান এতে। মহাভারতে প্রতিটি চরিত্রের জীবনযাপন, আচার আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ লৌকিক বর্ণনা দেখা যায়। বর্তমানে বিদ্যুৎ আর ইন্টারনেট নামক দুটি নতুন জিনিসের আগমন ঘটলেও, তৎকালীন সময়ে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থানের বেশি আর কিছু প্রয়োজন ছিল না। আজ আমরা সেই খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থান নিয়েই গল্প করবো.. হ্যাঁ, কিছু বিশিষ্ট গবেষক মহাভারতে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের উপস্থিতির কথা বললেও, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আমরা এই লেখা থেকে সেগুলো বাদ দিয়েছি।

গত কয়েক বছরে বাজারে আসা বেশ কিছু পৌরাণিক টিভি ধারাবাহিকে আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, চরিত্রগুলো বেশ বড়োসড়ো ডাইনিং টেবিলে রাজকীয় খাবার সাজিয়ে বসে আছে! তন্দুরি থেকে শুরু করে বিরিয়ানী-পোলাও কি নেই সেখানে.. এইসব দেখে আর পাঁচটা খাদ্যরসিকের মতোই আমরাও প্রতিটা পর্ব বেশ খুঁটিয়ে দেখলাম। তারপর চিলি চিকেন, মোমো কিম্বা চাউমিন খুঁজে পাওয়ার আশায় মহাভারত ও সমসাময়িক গ্রন্থগুলি ঘাঁটতে বসলাম। ..যে মহাভারতে চিনা লোকজনের এত আনাগোনা, সেখানে চিনা খাবার খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ও না..

যাইহোক, খুঁজতে গিয়ে ব‌ই খুলে তো চক্ষু চড়কগাছ! চাউমিন-মোমো তো নেই ই, বরং রান্না করা উপমহাদেশীয় খাবার‌ই ভালো করে খুঁজে পাওয়া গেল না। চারিদিকে শুধুই ফলমূল, শাকসবজি আর পোড়া মাংসের উল্লেখ! রান্না করা খাবারের মধ্যেও মশলার ব্যবহার প্রায় বিরল; সময়কালের বিচারে যা স্বাভাবিক বলেই ধারণা করা যায়। প্রিয় পাঠক বন্ধু, আমাদের ধারণা, আর্যরা ভারতে আসুক বা আদি অধিবাসী হোক, মহাভারত যদি আজ থেকে কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগেও ঘটে থাকে, তাহলে ওই সমাজে রান্না করা মশলাদার খাবারের অস্তিত্ব কম থাকাটাই স্বাভাবিক। ওই সময় মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। রাজা প্রজা সবাই প্রয়োজনে নিজের খাবার সংগ্রহ করে খেত। অথবা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সংগ্রহ করা খাবার একসঙ্গে ভাগ করে খেত। কালক্রমে সমাজে পুঁজির উদ্ভব হলে, খাদ্য উৎপাদক-সংগ্রাহক ও নেতাদের মধ্যে বিভেদ প্রকট হয়, কিন্তু এই সময়েও মাঝেমধ্যেই নেতাদের শিকার অথবা চাষের কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

মহাভারতের শুরুর দিকেই সত্যবতীর বর্ণনায় তাঁকে মৎসগন্ধী বলা হয়, তাঁদের সম্প্রদায়কে জেলে বলে উল্লেখ করেন কবি। ভেবে দেখুন, একজন জেলে অথবা জেলেনীর গায়ে মাছের গন্ধ পাওয়ার অর্থ কিন্তু ওই ব্যক্তি সবসময় মাছের আশেপাশেই থাকেন। অর্থাৎ ধারণা করা যায়, মাইমল সম্প্রদায়ের মধ্যে মাছ ধরা, স্টোর করা ও বিক্রি করার প্রচলন ও ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মাছ বাজারের অস্তিত্বও হয়তো অলীক কল্পনা নয়।

বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বৃহদশ্ব মুনির দেখা হলে, তিনি যুধিষ্ঠিরকে নিষাদ রাজ নল ও তাঁর স্ত্রী দময়ন্তীর গল্প বলেন। এখানে দেখা যায়, কলির প্ররোচনায় পুষ্কর নলকে রাজ্যছাড়া করলে, বনবাসী হয়ে তিনি খাদ্যের প্রয়োজনে পাখি শিকার করেন। ভাবুন, যিনি একবস্ত্রে রাজ্য ছাড়া হয়েছেন, তিনি নিশ্চ‌ই শিকার করা পাখি পুড়িয়েই খাবেন, রান্নার সামগ্রী পাবেন না। হ্যাঁ, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সবাই মাংস খেতেন‌। অশ্বমেধ, গোমেধ প্রভৃতি যজ্ঞের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় ঘোড়া ও গোরুও খাদ্য হিসেবে গৃহীত হতো। কামধেনু জাতীয় গোরুর সুরক্ষা ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায়, দুগ্ধবতী গোরু খাদ্য হিসেবে বিবেচ্য না হলেও মহিষ, বলদ প্রভৃতি খাওয়া হতো। মহাভারতের প্রায় প্রতিটি চরিত্র‌ই কিন্তু মাংসভোজী। রাজা‌ রন্তীদেবের রান্নাঘরে প্রতিদিন নাকি প্রায় দু'হাজার গোরু কাটা হতো। তিনি সেই মাংস রাজ্যবাসীর মধ্যে বিতরণ‌ও করতেন।

উদ্যোগ পর্বে যখন কৃষ্ণ দূতিয়ালি করতে কুরু বাড়িতে গেলেন, কৌরব ভাইরা তাঁকে দারুণভাবে সম্বর্ধনা দিয়ে, আলোচনার পর রীতিমতো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করেন। এখানে দেখা যায় তাঁরা কৃষ্ণকে গোমাংস, মধুপর্ক ও জল দান করছেন- "তস্মিন গাং মধুপর্কঞ্চাপ্যুদকঞ্চ জনার্দনে।" গো-নির্ভর সমাজ হ‌ওয়ায় দুধ, দ‌ই, ঘোল ইত্যাদির গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক ছিল এই সময়। পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতে 'মধুপর্ক' নামক একপ্রকার খাদ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও, এটি দুধ বা দ‌ই ও মধুর মিশ্রণ বলেই মনে হয়।

খাদ্যরসিক হিসেবে খাদ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে মদ্যরসিকদের কথা না বললে অবিচার করা হয়। ভাবছেন পৌরাণিক গল্পে মদ এলো কেন? বন্ধু, আজ মদ খেয়ে বিষ্ণু মন্দিরে ঢোকা না গেলেও স্বয়ং বিষ্ণুই কিন্তু বেশ মদ্যরসিক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রিয় মদ ছিল 'বারুণী'। এই বারুণীর প্রতি বিষ্ণুর টানের কথা বিষ্ণুপুরাণে বেশ ভালোভাবেই বলা হয়েছে- "তৃষ্ণা চৈনং বিবেশাশু বারুণী প্রভবা।" মহাভারতেই কখনো অর্জুনকে আবার কখনো দুর্যোধনকে আমরা মদমত্ত অবস্থায় থাকতে দেখেছি। কিন্তু পুরাণের সবচেয়ে বিখ্যাত সুরাপ্রেমী মধ্যে শিবের পরেই যাঁর উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি বলরাম। আর তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেক পৌরাণিক মদের নাম, 'কাদম্বরী।' কদম গাছের বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হতো এই কাদম্বরী- "কদম্ব কোটরে জাতা নাম্মী কাদম্বরীতি সা।" এটি আবার বেশ উৎকৃষ্ট কিছু মদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কবি বলেছেন, একবার যে কাদম্বরী খেয়েছে, অন্য খাবারে তার রুচি থাকে না- "কাদম্বরী রসজ্ঞানাম্ আহারোহপিন রোচতে।"

মহাকবি কালিদাস তো 'শকুন্তলা'য় কাব্য রচনার আগে শুঁড়িখানায় গিয়ে কাদম্বরী ভজনার উপদেশ দিয়েছেন- "কাদম্বরী শব্দিকে কখু পঢমং আস্মাণাং শোহিদে ইসচীঅদি। তা শুন্ডিকাগালং যেব গশ্চস্ম।" লক্ষ্য করুন, এখানে কিন্তু 'শুঁড়িখানা'র উল্লেখ করা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে মদ তৈরী, বিক্রি ও খাওয়ার আলাদা আলাদা জায়গা থাকলেও, গ্রামের দিকে এখনো বহু জায়গায় এক‌ই সঙ্গে মদ তৈরী, বিক্রি ও খাওয়া হয়; এগুলিই শুঁড়িখানা। হরিবংশে বলরামের মদিরা প্রেমের বর্ণনাতেও শুঁড়িখানার আভাস পাওয়া যায়। কবি বলছেন, বলরাম বাতাসে মদের গন্ধ পেলেন- "মদ্যসংস্পর্শজো গন্ধঃ সংস্পৃশন্ ঘ্রাণমাগতঃ।" গ্রামাঞ্চলে আজ‌ও বেশ কিছু জায়গায় রীতিমতো কারখানা বানিয়ে চোলাই মদ তৈরী হয়। এই এলাকার আশপাশের বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত মদের গন্ধ পাওয়া যায়, এখানে বলরাম‌ও ঠিক তেমনি গন্ধ পেয়েছেন।

দেখুন তো.. কারণ সুধার চক্করে আসল জায়গা থেকে কতটা সরে গেছি! এ গল্প না হয় পরে বলা যাবে, আপাতত মহাভারত কালে প্রচলিত পোষাক আশাকের বিবরণে আসা যাক। এই সময় প্রধানত গাছের ছাল ও তন্তু এবং পশুর চামড়া বস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সম্ভ্রান্ত পরিবারে ও শহরাঞ্চলে সুতোর পোষাক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

আদিপর্বে জন্মেঞ্জয়কে কুরুবাড়ির ইতিহাস বলতে মহাভারতের কবি শান্তনু ও ভীষ্মের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করেন। এঁদের জন্মকাহিনী আমাদের প্রয়োজন নেই বটে, তবে এই আলোচনায় স্বর্গবাসী গঙ্গার পোষাকের‌ বর্ণনাটি বেশ উল্লেখযোগ্য। এখানে কবি বলছেন, হঠাৎ বাতাস এসে গঙ্গার গোপনাঙ্গ থেকে তাঁর সূক্ষ্ম বস্ত্রটি সরিয়ে দিলো!- 

"তস্যা গঙ্গায়াঃ, শশীপ্রভং চন্দ্রকিরণতুল্যং সূক্ষ্মম্, বাসো বস্ত্রম্,
মারুতেন বায়ুনা, সমুদ্ধূতং সঞ্চাল্য গুপ্তাঙ্গাদপসারিতম্ ।।"

লক্ষ্য করুন, এখানে গঙ্গার বস্ত্রটিকে সূক্ষ্ম বলা হয়েছে। রামায়ণের কিছু উপজাতীয় ভার্সনে সীতাকেও এরকম সূক্ষ্ম বস্ত্র পরতে দেখি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত শাড়ি 'মসলিন'ও কিন্তু সূক্ষ্ম বস্ত্র হিসেবেই বিখ্যাত। এটি কিন্তু মহাভারত কালেও সম্ভ্রান্ত রমণীদের পরিধানের উৎকৃষ্টতার পরিচায়ক।

হরিবংশে আবার সুতোর তৈরী রঙিন কাপড়ের উল্লেখ ও পাওয়া যায়। এখানে কবি বলছেন, কৃষ্ণ হলুদ আর বলরাম নীল ধুতি পরতেন। গোপীনিদের পরিধেয় নিয়ে বলতে গিয়ে আবার রসিক কবি বললেন, যুবতী গোপীরা যখন কোমরে কলসী ও মাথায় ঘট নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তখন তাদের নীল হলুদ ও লাল শাড়িগুলি স্তনের অগ্রভাগে উঁচু হয়ে আছে।- "নীল-পীতারুণৈস্তাসাং বস্ত্রৈর গ্রস্তনোচ্ছিতৈঃ।" এখানে কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার যে, মহিলা ও পুরুষ উভয়েই একখণ্ড বস্ত্রকেই শাড়ি অথবা ধুতি হিসেবে ব্যবহার করতেন।

তবে দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই বস্ত্র হিসেবে পশু ও গাছের ছালের প্রচলন ছিল। বনবাসী অর্জুনকে আমরা গাছের ছাল তুলে পোশাক বানাতে দেখি। হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে বলাই যায়, পাণ্ডবরা তো জীবনের প্রথম ভাগটা বনেই কাটিয়েছে, তাই অর্জুন ওরকম পোশাক বানাতে জানতো। কিন্তু সমাজে এরকম পোশাকের প্রচলন থাকলে তবেই না একজন মানুষ গাছের ছাল তুলে পোশাক বানানোর কথা ভাববে..

আজ আমরা মহাভারতীয় সভ্যতাকে প্রাচীন বলতে শিখেছি, কিন্তু এই সমাজেরই বেশভূষা আধুনিক সমাজকেও হার মানায়। আমাদের বর্তমান সমাজে ছেলেরা কানে দুল বা হাতে বালা পরলে 'রকবাজ' বলে গণ্য হয় বটে, তবে আমরা যাঁদের ভগবান বলে পুজো‌ করি, সেই ভগবানদের কিন্তু অঙ্গ সজ্জার প্রধান সাধন ছিল এই কানের দুল। প্রায় প্রত্যেক দেবতার কানে দুল দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এঁদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ছিলেন সংকর্ষণ বলরাম। ভদ্রলোক এক কানে কুণ্ডল পরতেন! মণিমুক্তো খচিত গয়নার উল্লেখও পাওয়া যায় এই সময়- "জাতরূপময়ং চৈকং কুন্ডলং বজ্রভূষিতম্।"- বলরাম বজ্রমণি অর্থাৎ হিরে বসানো সোনার কুণ্ডল পরতেন। গোমন্ত পর্বতে আয়োজিত নাচগানের আসরে যোগ দেওয়া বলরামের এক কানে দুল আর গলায় বৈজয়ন্তী ফুলের মালা দেখা যায়- "স্রগী-এককুন্ডলো মতো বৈজয়ন্তো চ মালয়া।"

তবে শুধুই ধাতব কুণ্ডল অলঙ্কার না, হরিবংশে গোপপল্লীর নারী পুরুষদের মাথায় গাছের পাতায় তৈরী মুকুট আর ময়ূরপুচ্ছের তৈরী অঙ্গসজ্জা ব্যবহার করতে দেখা যায়- "ময়ূরাঙ্গদকর্ণো তু পল্লবাপীড়ধারিণৌ।"

এই গোপ-গোপিনীদের বিচরণস্থল কিন্তু মোটেও শহুরে ছিল না। এখানকার পরিবেশ ছিল একান্ত গ্রাম্য। আর এই গ্রাম্য পরিবেশেই বড়ো হয়েছিলেন কৃষ্ণ, বলরাম প্রমুখ। গ্রামগুলো প্রধানত জঙ্গল কেটে বা পুড়িয়ে তৈরী হতো। বনাঞ্চলের মধ্যে সমতল ও মনোরম জায়গা দেখে বাড়িঘর বানানো হতো। হিংস্র জানোয়ার, শত্রু গোষ্ঠী প্রভৃতির আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে এখানকার লোকজন গ্রামের চারপাশে গাছের গুঁড়ি ফেলে বেড়া দিত - "পর্যন্তেষ্বাবৃতং বনৈর্বৃহদ্ভিঃ পাতিতৈদ্রুমৈঃ।" এভাবেই খাণ্ডবদহন কালে পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থের জঙ্গল পুড়িয়ে ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপন করেন। এই ধরণের গ্রামগুলোতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোনো স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় না। এগুলো ছিল বাঁশ, খড় ও‌ চাঁচের তৈরী অস্থায়ী ঘর - "কটচ্ছন্ধকুটীমঠম্।"

আপনারা হয়তো ভাবছেন পাণ্ডবরা গেল আর বন জ্বালিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়ে ফেললো, কিম্বা ব্রজভূমির লোকজন ইচ্ছা হতেই একদিন আদি বাসস্থান ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে গেল। আমরা বলবো, না, আজকের মতো জমি অধিগ্রহণ আর সেই সংক্রান্ত ঝামেলা তখনো ছিল। আজকাল আকছার দেখতে পাবেন অমুক বস্তি অধিগ্রহণ করে শপিং মল কিম্বা আবাসন তৈরী করা হবে, আর সেই নিয়ে বস্তিবাসীদের সঙ্গে আবাসন কর্তৃপক্ষের ঝামেলা। প্রাথমিক আলোচনায় ঝামেলা মিটলে ভালো, ন‌ইলে কদিন পর খবর আসে, শট সার্কিট বা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বস্তিতে আগুন লেগেছে। তার‌ও কিছুদিন পর ছাই সরিয়ে আবাসনের ভীত পুজো হয়.. খাণ্ডবপ্রস্থেও এক‌ইভাবে জঙ্গলে আগুন দিয়ে স্থানীয় নাগ জনজাতির লোকজনদের মেরে পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপন করেন।

আরেকবার বর্তমানে ফিরে আসা যাক। ধরে নিলাম ওই বস্তিটিতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগেই বাসিন্দারা আলোচনা করে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিল। কিন্তু এরপরেও কয়েকজন বিদ্রোহী লোক থাকেন, যাঁরা সরাসরি আক্রমণের পথ বেছে নেন ও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজের আদিভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করেন।

ঠিক একই রকম লোক দেখি বৃন্দাবনের আশপাশের এলাকায়। ব্রজবাসীরা যখন নিজেদের পুরোনো আশ্রয় ছেড়ে যমুনাতীরে বৃন্দাবনে বসতি স্থাপন করলেন, ধেনুকাসুর, প্রলম্বাসুর প্রমুখের থেকে তাঁরা বাধা পান। এঁদের ভয়ে তাঁরা বৃন্দাবনের বাইরের এলাকায় যেতে ভয় পেতেন। আর তাই, বলরামের হাতে ধেনুকাসুর নিহত হলে হরিবংশে বলা হচ্ছে, "বিপ্রমুক্তভয়ং শুভ্রং বিবিক্তাকারদর্শনম্ চরন্তি স্ম সুখং গাবং..।" অর্থাৎ, বলরাম ধেনুকাসুরকে মারার পর সেখানে লোক যাতায়াতের আর কোনো ভয় ও অসুবিধা থাকলো না।

কবি সব্যসাচী দেব তাঁর 'কৃষ্ণা' কবিতায় কৃষ্ণার মুখ দিয়ে অর্জুনকে বলিয়েছেন, "... তোমার পূর্বপুরুষেরা যেমন একদা এক তৃণপ্রান্তরকে নিঃশেষ করে চলে যেতেন বনান্তরে।" কথাটি দ্ব্যর্থক বটে.. এক অর্থে যেমন দ্রৌপদীর জীবনের করুণ পরিণতির পরিচায়ক, অর্থান্তরে তেমনি অর্জুনের পূর্বপুরুষের যাযাবর হ‌ওয়ার আভাস দেয়। হ্যাঁ, তৎকালীন সমাজে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যাযাবর‌ই ছিলেন। তাঁরা খাদ্যের সন্ধানে হোক বা হিংস্র জন্তুর নিশানা হ‌ওয়া থেকে বাঁচতে মাঝেমধ্যেই নিজেদের বাসস্থান পরিবর্তন করতেন, আর এই ঘটনার বর্ণনা মহাভারতে বলাও হয়েছে দারুণভাবে।

ডঃ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি মহাশয় তাঁর 'মহাভারতের ছয় প্রবীণ' ব‌ইতে লিখেছেন, কুরু পিতামহ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বনবাস করার জন্য বেশ কিছু নিয়ম তৈরী করে দিয়েছিলেন। ব্যাস এখানে বনবাসী পাণ্ডবদের বনের এক জায়গায় বেশিদিন না থাকার উপদেশ দিচ্ছেন। তিনি গাছপালা, পশুপাখি, বনজ ঔষধ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে চিন্তিত। ব্যাস বলছেন, এক‌ই বনে চিরকাল থাকলে বৃক্ষ, ঔষধ, পশু সবের‌ই বিনাশ হয়, তাই তোমরা অন্য বনে যাওয়ার কথা ভাবো-

"একত্র চিরবাসো হি ন প্রীতি জনকো ভবেৎ.. 
মৃগাণামুপয়োগশ্চ বীরুধোষধিসংক্ষয়ঃ
বনাদস্মাচ্চ কৌন্তেয় বনমন্যদ বিচিন্ত্যতাম্।।"

গ্রামে তো নয়ই, গোটা মহাভারতের কোথাও স্থাপত্য শিল্পের কোনো পোক্ত নিদর্শন পাওয়া যায় না। শহরাঞ্চলের বাড়িগুলো পোড়ামাটির ইঁট, মাটি বা কাঠের তৈরী হতো। আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা? মহাভারতে তো রাজপ্রাসাদের কথা বলা হয়েছে..; আমরা বলবো, অবশ্যই রাজপ্রাসাদ ছিল, তবে সেটাও তৈরী হতো ইঁট, কাঠ ও মাটি দিয়ে। এখানে বিপক্ষ যুক্তি আসে, ইন্দ্রপ্রস্থে ময় দানব পাণ্ডবদের জন্য মণিমুক্ত খচিত ত্রিভূবনবন্দিত একটি মহল বানিয়ে দেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, এই মহল যদি এতই ঐশ্বর্য মণ্ডিত হতো, তাহলে পাণ্ডবদের রাজ্যছাড়া করে দুর্যোধন বা অন্য কোনো কৌরব ভাই এখানে থাকলেন না কেন? তাঁরা মহলটি দ্রোণাচার্যকে দিয়েছিলেন। আর শুধু কৌরবরাই কেন, স্বয়ং যুধিষ্ঠির‌ই তো রাজা হওয়ার পর এই প্রাসাদে থাকেন নি..

বারণাবতে জতুগৃহ তৈরীর সময় ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী পুরোচনকে আদেশ দেন- যাও, পাণ্ডবদের জন্য একটি নয়নাভিরাম বাড়ি তৈরী করো। বাড়ির প্রতিটি স্তম্ভ হবে শাল জাতীয় বৃক্ষে নির্মিত। শন, ধুনো প্রভৃতি যা কিছু আগ্নেয় দ্রব্য জগতে আছে, সমস্তটাই বাড়ি তৈরীর উপাদানে মিশিয়ে দিও। তারপর আবার তেল, ঘি, চর্বি ও গালার মিশ্রণ মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ালে লেপন কোরো।–

"শনসর্জ্জরসাদীনি যানি দ্রব্যাণি কানিচিৎ।
আগ্নেয়ান্যুত সন্তীহ তানি তত্র প্রদাপয়।।
সর্পিস্তৈলবসাভিশ্চ লাক্ষায়া চাপ্যনল্পয়।
মৃত্তিকাং মিশ্রয়িত্বা ত্বং লেপং কুড্যেষু দাপয়।।
..শনং তৈলং ঘৃতষ্ণৈব জতু দারূণি চৈব হি।"

লক্ষ্য করুন, রাজা রাজপুত্রদের থাকার ঘর বানাতে বলছেন শাল, শন গাছ দিয়ে। ঘরটি তৈরী হবে রাজকোষের টাকায়; স্থাপত্য শিল্প অত উন্নত হলে ধৃতরাষ্ট্র ইঁটের বাড়ি তৈরীর কথা বলতেন না কি? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, ঘরটি যাঁদের জন্য তৈরী হয়েছিল, তাঁরা কিন্তু বিনা আপত্তিতে সেখানে থাকতে রাজি হন। অভ্যস্ত না হলে তো এমনটা করতেন না পাণ্ডবরা। এই ঘটনা কিন্তু ওই সমাজে বাঁশ-বেত-শনের তৈরী বাড়ির অস্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেয়।

মহাভারতে মানুষের গুহাতে বাস করার প্রমাণ‌ও পাওয়া যায়। বিদুর যখন জানতে পারলেন, ধার্তরাষ্ট্ররা পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য জতুগৃহ নির্মাণ করেছেন, তখন তিনি পাণ্ডবদের বাঁচাতে গুহাঘর বানানোয় এক্সপার্ট একটি মিস্ত্রী পাঠান। ইনি খুব তাড়াতাড়ি মাটি খুঁড়ে বসবাসযোগ্য ঘর বানানোয় পারদর্শী ছিলেন। ভাবুন, সমাজে প্রচলন না থাকলে এক্সপার্ট লোক এলো কি করে? এছাড়াও হরিবংশে বলা হয়েছে সমন্তক মণি উদ্ধার করতে কৃষ্ণ জাম্বুবানের গুহায় যান।

পাণ্ডবরা শুতেন কুশাসনে; অর্থাৎ কুশ ঘাস বিছানো শয্যা। মহাভারত বলছে, পাণ্ডবরা শুতেন পাশাপাশি, তাঁদের মাথা ও পায়ের দিকে যথাক্রমে কুন্তী ও দ্রৌপদী আড়াআড়িভাবে শুতেন। এরকম বিছানা কিন্তু মাটিতেই সম্ভব। এছাড়াও বনপর্বে কুন্তী বলেন, এখানে আমার ছেলেরা তো হরিণের চামড়ার কোমল শয্যায় শুতে পাবে না..- "রাঙ্কযাজিন শায়িনঃ বঙ্কু মৃগচর্ম্মশয়নশীলাঃ" অর্থাৎ ওই সময় পশুচর্মের উপর শোওয়ার প্রচলন‌ও ছিল।

মহাভারতের গৌরবময় স্মৃতি আজ মুছে গেছে মানুষের মন‌ থেকে। গোকূল-হস্তিনা-ইন্দ্রপ্রস্থের মানুষের পদচিহ্ন মুছে গেছে নবাগতের পদক্ষেপে। কয়েক হাজার বছর আগে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে যে সামাজিক নাটকের অভিনয় হয়েছিল, এবং যারা অভিনয় করেছিল, তারা সকলেই মিলিয়ে গেছে কুরুক্ষেত্রের মাঠে ওড়া শেষবেলার ধুলোয়। তার উপর জমেছে অন্ধভক্তির ধুলো। পরে সেই ধুলোপড়া পাণ্ডুলিপিতে চেপেছে অলৌকিকতার মলাট; তাই আসল ইতিহাসটা আর জানা হয়নি কারো। তবু কোনো কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে যদি কোনো ব‌ই খুলে দেখেন, লেখা আছে, "কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বিরচিত মহাভারত", মনে রাখবেন সেই ব‌ই গল্প শোনায় নিচু স্বরে। পাতায় পাতায় জীবন্ত স্মৃতিকথা, কত চরিত্র, তাদের জীবনযাত্রার না‌ শোনা গল্প, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম, বিরহ, জন্ম মৃত্যুর রক্তাক্ত ইতিহাস.. তার বিন্দুমাত্রও ভুলে যায়নি "মহাভারত"।


মহাভারতের নারী:

মহাভারতের প্রতিটি ঘটনার সাথেই নারীর ভূমিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহাভারতের কবি নারীচরিত্রগুলিকে অতি যত্নে এঁকেছিলেন। তৎকালীন আর্যাবর্তের সমাজে নারীর স্থান ও ভূমিকা একটি একক আলোচনার বিষয় হওয়ার যোগ‍্য, এখানে স্থানাভাবে কয়েকটি ঘটনা, চরিত্র এবং সমাজের ওপর নারী ও নারীর ওপর সমাজের প্রভাবের সংক্ষিপ্ত আলোচনার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই দেখবো যে মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিতে নারীর প্রভাব কতটা। মহাকাব‍্যের শুরুতেই যদি সুরেশ্বরী বালিকাবেশে মহারাজ প্রতীপের কোলে এসে না বসতেন তবে মহাভারত লেখাই হতো না হয়তো। মহারাজ প্রতীপের পুত্রবধু হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গঙ্গাদেবী মহাভারতের মহীরুহের বীজটি বপন করেন। পরে মহারাজ শান্তনুর সাথে বিবাহের পূর্বে নিজের স্বাধীনতার ব‍্যপারটিও শর্তের মাধ‍্যমে সুনিশ্চিত করেন। সাত সন্তানের মৃত‍্যুশোক সহ‍্য করার পর শান্তনু যখন শেষ সন্তানটির প্রাণরক্ষার্থে গঙ্গা দেবীকে আটকালেন, তখন দেবী রাজাকে ত‍্যাগ করলেও সন্তানকে ত‍্যাগ করেননি, মাতৃস্নেহে নিজের সাথে নিয়ে যান এবং কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আর বেদজ্ঞ বানিয়ে রাজাকে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান ফিরিয়ে দেন। এই গঙ্গাপুত্র পরবর্তীতে কুরুবৃক্ষের মূল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষণীয়ভাবে স্বামীত‍্যাগী মাতার পরিচয় অত‍্যন্ত গর্বের সাথে বহন করেছেন দেবব্রত। শান্তনু পুত্র নয় গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম নামে আর্যাবর্ত কম্পিত হতো। এমনকি ভীষ্মের রথধ্বজাও ছিলো গঙ্গাবাহন মকর চিত্রিত। মহাভারতের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রটির ওপর তার মায়ের প্রভাব ছিলো অনেক।

মহারাজ শান্তনুর দ্বিতীয় পত্নী সত‍্যবতী ছিলেন মৎসজীবী সমাজের প্রধান দাসরাজের কন‍্যা। কন‍্যা হলেও পুত্রের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না তিনি। পিতার অনুপস্থিতিতে উত্তাল গঙ্গায় পারাপারের কাজ করতেন এবং প্রয়োজনে প্রশাসনিক কাজেও সাহায‍্য করতেন পিতাকে। জীবিকার তাগিদেই তাকে হতে হয়েছিলো বাকপটু। কামার্ত পরাশরকে পারাপার কালে যুক্তিজালে নিবৃত্ত করার চেষ্টা দেখে মনে হয়, তার হয়তো কিছু বৈদিক শিক্ষা থাকাও অসম্ভব নয়। যদিও পরাশর সত‍্যবতীর শর্তপূরণের পরিবর্তে তার গর্ভে এক মহাজ্ঞানী পুত্রলাভ করেন। সমাজের ভয়ে সত‍্যবতীর পক্ষে সম্ভব হয়নি কুমারী মাতা হয়ে পুত্রকে গ্রহণ করা, পুত্র দ্বৈপায়ন পিতা পরাশরের সাথে যাওয়ার আগে প্রয়োজন হলেই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয়।

এরপর সত‍্যবতীর জন‍্যই ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেন সিংহাসন ত‍্যাগের আর সত‍্যবতীকে মাতা ও কুরুবংশের মহারাণী রূপে বরণ করে হস্তিনার রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন।

শান্তনুর মৃত‍্যুর পর দুই নাবালকের মধ‍্যে প্রথমজন, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদকে রাজা করার পেছনেও ছিলো সত‍্যবতীর প্রচ্ছন্ন অঙ্গুলী হেলন। পরে চিত্রাঙ্গদের মৃত‍্যু হলে অসুস্থ বিচিত্রবীর্য রাজা হলে, সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন রাজমাতা সত‍্যবতী। ভীষ্মের সাহায‍্যে কুরুবংশের সীমা বাড়িয়ে দিতে থাকেন চারিদিকে। তার নির্দেশেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ভীষ্মকে কাশীর তিনজন রাজকুমারীকে হরণ করে আনতে হয় বিচিত্রবীর্য্যের জন‍্য। আবার তার নির্দেশেই শাল্বরাজের অনুরক্তা অম্বাকে ফেরত পাঠানো হয় তাঁর কাছে। 

অপুত্রক অবস্থায় বিচিত্রবীর্য্যের অকালমৃত‍্যু হলে, নিয়োগ প্রথার মাধ‍্যমে ক্ষেত্রজ পুত্র গ্রহণের মতো অপ্রিয় অথচ প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও সর্বপ্রথম ভীষ্মকে বলেন সত‍্যবতীই। ভীষ্মকে অনুরোধ করেন বিধবা ভাতৃজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন‍্য। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে অপারগ ভীষ্মকে এরপর নিজের প্রথম সন্তান দ্বৈপায়নের কথা বলেছেন সত‍্যবতী। ভীষ্ম রাজি হলে দ্বৈপায়নকে রাজবাড়িতে স্মরণ করেন সত‍্যবতী। সত‍্যবতীই বহু কষ্টে, বহু অনুরোধে এবং যুক্তিতে দ্বৈপায়নকে রাজি করান। লক্ষণীয় যে ভীষ্মকে বোঝানোর সময় পুত্র সন্তানের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, সিংহাসনে রাজার আবশ‍্যকতা এই সব যুক্তি দিলেও, ধর্মজ্ঞানী ঋষি দ্বৈপায়নের কাছে দেওয়া তার যুক্তিগুলো ছিলো সম্পূর্ণ মানবিক। অল্পবয়ষ্কা বিধবাদের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ও কুরুবংশ রক্ষার্থে নিজপুত্রকে নিয়োগ প্রথার অনুরোধ করেছেন তিনি। এমনকি তাকে এও বলতে দেখা যায় যে, তার জন‍্যই ভীষ্ম অকৃতদার, তার সন্তানেরা মৃত, কুরুবংশলোপের জন‍্য লোকে তাকেই দায়ী করবে। তিনি জানতেন, ঋষির কাছে ধনরত্ন, সিংহাসন, রাজত্ব এসবের থেকেও মানবিকতার দাম অনেক বেশী, মাতৃঋণ শোধ তপস‍্যা অপেক্ষাও গুরুতর কর্তব‍্য। দ্বৈপায়ন রাজি হলেও একবছর প্রিপারেশনের শর্ত রাখলেন, না হলে তার তেজ সহ‍্য করা রাজবধূদের পক্ষে অসম্ভব। আসলে তিনি চেয়েছিলেন রাজবধূদের হঠাৎ নিয়োগের ধর্ষণতুল‍্য অবস্থার মধ‍্যে না ফেলতে। অন্তত মানসিক প্রস্তুতির জন‍্য তাদের কিছু সময় দিতে চেয়েছিলেন। এখানেও সত‍্যবতী পুত্রের অনুরোধ উপেক্ষা করেন, তিনি জানতেন ব‍্যস আর বৈরাগ‍্য সমার্থক। একবছর পরে দ্বৈপায়নের মত পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর জন্ম হলে একত্রে দুই উদ্দেশ‍্য সিদ্ধ হয় সত‍্যবতীর। কুরুকুল রক্ষা পায় এবং তার জারজ প্রথম সন্তান দ্বৈপায়ন অপরিহার্য হয়ে ওঠে কুরুবংশের কাছে। লক্ষণীয় যে, সত‍্যবতীকে কখনোই তার প্রথম পুত্রের জন‍্য লজ্জিত মনে হয়নি, বরঞ্চ তিনি তার প্রথম সন্তানকে গর্বের সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর এখানেই সত‍্যবতী রাজমাতা হিসেবে কুন্তীর তুলনায় অনেক এগিয়ে।

গান্ধাররাজ সুবলের রাজ‍্যটি ছিলো পাহাড় ঘেরা। উৎকৃষ্ট পশম আর গন্ধকের রপ্তানীর ফলে গান্ধারের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়ে। গান্ধার রাজ সুবলের একশো পুত্র ও এক কন‍্যা। কন‍্যার নাম গান্ধারী, তবে সম্ভবত এটি আসল নাম নয়, গান্ধার রাজপুত্রী তাই গান্ধারী। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের উপযুক্ত কন‍্যা হিসেবে ভীষ্মের কাছে গান্ধারীর নাম প্রস্তাব করেন সত‍্যবতী। জামাই হিসেবে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সুবলের অপছন্দ হলেও হস্তিনাপুর আর ভীষ্মের মিত্রতার কথা চিন্তা করে তিনি বাধ‍্য হন গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্রের বধূ হিসাবে মেনে নিতে। সুবল ছাড়াও এই বিয়ে মানতে পারেননি সুবলের ছোট ছেলে শকুনিও। সত‍্যনিষ্ঠ গান্ধারী পতির কাছে কিছু গোপন করতে চাননি। তাই প্রথম দিনেই ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেন তাঁর পূর্বের ছাগ বিবাহের কথা। মাঙ্গলিক গান্ধারীর সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী ছিলো যে তার অকাল বৈধব‍্য অবসম্ভাবী। তাই সুবল গান্ধারীর সঙ্গে একটি ছাগের বিবাহ দেন ও পরে ছাগটিকে দেবীর কাছে বলি দেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ঘটনাটিকে নিজের সাথে প্রতারণা বলে মনে করেন এবং শত পুত্রসহ সুবলকে বন্দি করেন। সেখান থেকে শকুনি কিভাবে ছাড়া পেলেন সে সব অন‍্য গল্প কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে এরপরেও গান্ধারীর পতিপ্রেম ছিলো অক্ষুন্ন। গান্ধারী হস্তিনার মহারাণী। বিপুল তার প্রতিপত্তি, একশো মহাবল পুত্রের মাতা; অথচ তার জীবনের একমাত্র সম্বল ছিল সত‍্য আর ধর্ম। ধার্মিক পরিবৃত হয়ে ধর্মাচারণ করা হয়তো সহজ, কিন্তু অধার্মিকদের মধ‍্যে থেকে ধর্মাচারণ করতে প্রয়োজন প্রভূত মানসিক দৃঢ়তার, যা গান্ধারীর ছিলো। ধর্মের জন‍্য, সত‍্যের জন‍্য গান্ধারীকে আমরা মাঝেমধ্যেই পতি ও পুত্রের আচরণের প্রতিবাদ করতে দেখেছি। বাসুদেবের কাছে তাকে আক্ষেপ করতে দেখেছি বারবার। পতিব্রতা গান্ধারীর তপস‍্যা ছিলো তার সংযম ও ত‍্যাগ। তিনিই মনে হয় একমাত্র, যিনি সত‍্যিই চাননি যুদ্ধ হোক। যুদ্ধ শেষে তার শতপুত্র হারানোর শোক ছাপিয়ে উছলে পড়ে ক্রোধ। প্রথমবার আর শেষবারের মতো আমরা গান্ধারীকে দেখি সংযম হারাতে। বাসুদেবকে বংশনাশের শাপ দেওয়ার আগের তার প্রতিটি অভিযোগ ছিলো যুক্তিযুক্ত। বাসুদেবের পরিকল্পনা একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন গান্ধারীই। এরপর যুধিষ্ঠিরের নখ দগ্ধ করার পরে তার মধ‍্যে জেগে ওঠে অনুশোচনা। এতবড় শোক সহ‍্য করেও গান্ধারী নির্বিকার, যেমন তিনি নির্বিকার তিনি ছিলেন অধর্মের মাঝে ধর্মচারণে।

ধৃতরাষ্ট্রের ভাই এবং হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর জন‍্য শূরসেনের কন‍্যা পৃথাকে মনোনিত করেন সত‍্যবতী। পাণ্ডু জন্মগত হৃদরোগী হলেও, অত‍্যন্ত সুপুরুষ আর দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন, তাই হস্তিনার প্রতিপত্তির কথা মনে রেখে কুন্তীভোজ পৃথাকে পাণ্ডুর হাতে তুলে দেন। কুন্তীভোজের কাছে বড়ো হ‌ওয়ায় হস্তিনাপুর নববধূকে কুন্তী নামে সম্বোধিত করে। হস্তিনার সকল রাজবধূদের মতোই পৃথারও ছিলো এক গোপন অতীত। 

শান্ত, ধৈর্য্যশীলা পৃথা সেবার মাধ‍্যমে মহর্ষি দুর্বাসাকে প্রসন্ন করে এক গুপ্তমন্ত্র লাভ করেন, যার পাঠ মাত্র মনোস্থিত দেবতা স্বয়ং সামনে উপস্থিত হয়ে পাঠককে সন্তান দান করবেন। কিশোরী পৃথা অবিশ্বাসবশত মন্ত্রপাঠ করে সূর্যদেবকে আবাহন করলে, সূর্যদেবের দয়ায় কুমারী পৃথা গর্ভবতী হন এবং এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। সত‍্যবতীর মতোই পৃথাও সমাজের ভয়ে প্রথমপুত্রকে গঙ্গাবক্ষে ত‍্যাগ করেন। এই ঘটনাটি মহাভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির মধ‍্যে একটি। পরবর্তীতেও পৃথা তার প্রথম সন্তানকে চিনতে পেরেও তার প্রকৃত পরিচয় গোপন করেন। কে বলতে পারে রঙ্গমঞ্চে যদি পৃথা কর্ণকে প্রথম সন্তান হিসেবে স্বীকার করতেন, তবে হয়তো মহাযুদ্ধের প্রয়োজন হতোই না। সে সব অনেক পরের কথা।

পাণ্ডু মৃগবেশে সঙ্গমরত কন্দম ঋষিকে হত‍্যা করলে সঙ্গম কালে তার মৃত‍্যু হবে শাপিত হন। অনুতপ্ত পাণ্ডু দুই পত্নী সহ বনগমন করেন। পৃথা রাজকন‍্যা, রাজবধূ হলেও অত‍্যন্ত আনন্দের সাথে আশ্রমিক জীবন অতিবাহিত করছিলেন। পাণ্ডুর পুত্রহীনতার কষ্ট দেখে তিনি পাণ্ডুর অনুমতিক্রমে তিনবছরে তিন দেবতাকে তুষ্ট করে তিন পুত্রলাভ করেন এবং পাণ্ডুর দ্বিতীয়া পত্নী মাদ্রীও তার কাছে পুত্র লাভের ইচ্ছা জানালে, পৃথা মাদ্রীকেও সেই মন্ত্রদান করেন। মাদ্রীর সাথে সঙ্গমকালে পাণ্ডুর মৃত‍্যু হলে কুন্তী সহমরণে যেতে চান, কিন্তু মাদ্রী নিজের সন্তানদের কুন্তীর কাছে রেখে সহমরণে যান। মৃত‍্যু কালে মাদ্রী বলেন কুন্তীর মতো সমানভাবে তিনি হয়তো সতীনপুত্রদের স্নেহ করতে পারতেন না, ...তার সেই উদারতা নেই তাই কুন্তীর জীবিত থাকা আবশ‍্যক।

নিজের পাঁচ সন্তানদের নিয়ে হস্তিনা ফেরার সময় থেকেই কুন্তী জানতেন যে, এবার তাকে আর তার পুত্রদের রাজবাড়ির রাজনীতির মধ‍্যে জড়িয়ে পড়তে হবে, অরণ্যের স্বাধীনতা এখানে নেই। তাই প্রথমেই কুন্তী যোগাযোগ করেন হস্তিনায় তার পরম বিশ্বস্ত এবং পাণ্ডুর অতিপ্রিয় ভাই বিদূরের সাথে। বিদূর আর কুন্তীর মধ‍্যে মহাভারতের শেষ অধ‍্যায় পর্যন্ত সম্পর্ক ছিলো অত‍্যন্ত মধুর। এই বিদূরের গৃহে কুন্তী একাধিকবার আশ্রয় নিয়েছেন। বিদূর স্বয়ং শাপভ্রষ্ট ধর্ম আর যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র এই প্রসঙ্গ টেনে অনেকেই যুধিষ্ঠিরকে বিদূরপুত্র অবধি বলেন।

দ্রোণের গুরুকুলে অস্ত্রশিক্ষার শেষদিন রঙ্গমঞ্চে অস্ত্রপ্রদর্শনের সময় অর্জুনকে কর্ণ যুদ্ধের আহ্বান জানালে, তার জন্মগত কবচ আর কুণ্ডল দেখে কুন্তী কর্ণকে চিনতে পারেন অথচ কর্ণের সুতপুত্র অপবাদ শুনেও এর প্রতিবাদ করেননি। একে অনেকেই কুন্তীর দোষ হিসাবে দেখেন, কিন্তু রাজবাড়িতে যখন তার নিজের ও তার স্বীকৃত পুত্রদের অধিকার সুরক্ষিত নয়, সেখানে নুতন করে আরো এক সমস‍্যা টেনে আনা হয়তো তার কাছে যুক্তিযুক্ত ছিলো না। কিন্তু এই যুক্তিও কুন্তীকে দোষমুক্ত করে না। কারণ কুন্তীর কাছে পরবর্তীতে অনেকবার সুযোগ ছিলো কর্ণের পরিচয় প্রকাশ‍্যে আনার, কিন্তু তিনি তা কর্ণের মৃত‍্যু অবধি প্রকাশ করেননি।

বিদূরের থেকে যুধিষ্ঠির জানতে পারেন জতুগৃহ নিয়ে দুর্যোধন আর শকুনির ঘৃন‍্য পরিকল্পনার কথা। জতুগৃহ দাহ হলে কুন্তী পাঁচপুত্র সহ দ্বিতীয়বার বনে আসেন, যেখানে তার সাথে দেখা করতে আসেন মহাভারতের কবি স্বয়ং। ব্যাস আর কুন্তীর কথোপকথনের অংশটুকু থেকে আমরা বুঝতে পারি কুন্তী কেবল স্নেহশীলা মাতা বা ধর্মপরায়ণা মহিলা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে প্রতিপালিত একজন রাজকন‍্যা, রাজবধূ ও ভবিষ‍্যতের রাজমাতা। কুন্তী ব‍্যাসকে বলেন তার এবং তার পুত্রদের এখন উভয়সঙ্কট, তারা হস্তিনায় গেলে আবার দুর্যোধনের কুটিলতার শিকার হবেন, আর বনে আছেন জানলে তাদের গুপ্তহত‍্যা করা হবে। তাদের প্রয়োজন কোনও বলবানের সহায়তা। গান্ধারীর মতো কুন্তী ধর্ম বা সত‍্যনিষ্ঠ হয়তো ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন দক্ষ কূটনিতীজ্ঞ। দ্রুপদ রাজার কন‍্যার সয়ম্বরের খবর পেয়ে পাণ্ডবরা দ্রুপদ রাজ‍্যে গেলে তাদের আশ্রয় দেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। সেখানে বক রাক্ষসের অত‍্যাচার থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন‍্য কুন্তীই ভীমকে বককে বধ করতে পাঠান। আবার হিড়িম্বা ভীমকে বিয়ে করতে চাইলে সবার আগে সম্মতি দেন কুন্তীই। সয়ম্বরে অর্জুন দ্রৌপদীকে লাভ করলে কুন্তীই ভুলবশত(?) তাকে পাঁচভাইকে বিয়ে করতে নির্দেশ দেন। এই সময় প্রথমবার বাসুদেবের আবির্ভাব হয় মহাভারতের মঞ্চে। বাসুদেবের পিসি ছিলেন কুন্তী। এরপর বাসুদেব জড়িয়ে পরেন পাণ্ডবদের সাথে। ইন্দ্রপ্রস্থের মতো রাজধানী, রাজমাতার সম্মান, পঞ্চপুত্রের সঙ্গ সব ছেড়েও যখন তাকে বিদূরের গৃহে আশ্রয় নিতে হয়, তখনো তিনি নির্বিকার থেকেছেন। যুধিষ্ঠিরের হঠকারিতাকে দোষারোপ করেননি। শুধু চেয়েছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র সহদেব তার কাছে থাকুক। সতীনপুত্রের প্রতি বিমাতার এই স্নেহ দুর্লভ। ভাবতে অবাক লাগে একই মহিলার মধ‍্যে এ কেমন পরস্পর বিরোধী চরিত্র। কর্ণ আর সহদেব দুজনের জন‍্য পৃথক আচরণ তার চরিত্রটিকে বড় অদ্ভুত বানিয়ে দেয়। আজ্ঞাতবাস শেষ হলে যখন দূত মুখে কুন্তী খবর পান তার পুত্ররা বিরাট রাজ‍্যে আছেন তখন তিনি দূতকে বলেন যুধিষ্ঠিরকে বলতে, তিনি সমর্থ পাঁচপুত্রের জননী হয়েও পরগলগ্রহ, পরান্নভোজী। যুধিষ্ঠিরের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজ‍্য উদ্ধার করে মাতৃঋণ শোধ করা।

যুধিষ্ঠির যুদ্ধ এড়াতে পাঁচটি মাত্র গ্রাম চাইলে কুন্তী তাঁকে নপুংশক স্বভাব ত‍্যাগ করে বল ও বীর্য প্রকাশ করে অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। দ্রৌপদীর মতো কুন্তীও বাসুদেবকে বারবার বলেছেন যেন যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের আগে কুন্তী কর্ণের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন... কর্ণ অবশ্য তার অনেক আগেই জানতেন নিজের আসল পরিচয়। কুন্তী তাঁকে পাণ্ডবপক্ষে আহ্বান করেন, জেষ্ঠপুত্র হিসেবে সিংহাসনের প্রলোভন দেন এবং অবশেষে অর্জুন ছাড়া বাকি চারপুত্রের জীবন সুরক্ষিত করে ফেরেন। সেদিন মাতা কুন্তী নয়, কূটনিতীবিদ কুন্তী গিয়েছিলেন শত্রুপক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে।

মহাযুদ্ধ চলাকালীন কুন্তী ছিলেন বিদূরের আশ্রয়ে। যুদ্ধের শেষে সকল কুরুনারীদের সাথে তিনিও এসেছিলেন রণভূমিতে। মৃত যোদ্ধাদের সৎকারের সময় তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেন কর্ণের পরিচয়। গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র, বিদূরের সাথে কুন্তীও বানপ্রস্থে যান। রাজমাতার সুখভোগের থেকেও স্বীকৃতিলাভ তার কাছে মুখ‍্য ছিলো।


ক্রমশঃ
0

প্রাচীন কথা - ঋত্বিক ঘটক ও সৌহার্দ্য সেন

Posted in











শিক্ষা পর্ব

মহাভারতের সমাজ ব‍্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো শিক্ষা ব‍্যবস্থা। সমাজে গুরুকুলের একটি সম্মানজনক অবস্থান ছিলো। এই গুরুকুলগুলি মূলত একজন বিখ‍্যাত গুরুর নামে হলেও শিক্ষা একজন গুরু দিতেন না। বিভিন্ন গুরুকুলগুলি বিভিন্ন প্রকার বিশেষ শিক্ষা ব‍্যবস্থার জন‍্য প্রসিদ্ধ ছিলো। কয়েকটির তো একান্ত নিজস্ব এবং গোপনীয় শিক্ষাও ছিলো। বিভিন্ন প্রদেশের শাসনব‍্যবস্থার ছাপ তাদের গুরুকুলগুলির ওপরেও পড়তো। পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও গুরুকুলগুলির ওপর রাজার অধিকার ছিলো না। বরঞ্চ রাজসভায় গুরুকুলগুলির প্রভাব যথেষ্ট ছিলো।
শিক্ষার ধরণ অনুসারে ত‍ৎকালীন গুরুকুলগুলিকে মূলত তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলি যথাক্রমে বৈদিক শিক্ষার গুরুকুল, অস্ত্র শিক্ষার গুরুকুল, ও উভয় শিক্ষার গুরুকুল একত্রে। এছাড়াও অপ্রচলিত গোপন শিক্ষার জন‍্যও কিছু কিছু সম্প্রদায়ের নিজস্ব গুরুকুল ছিলো।
বৈদিক শিক্ষার গুরুকুলগুলি সাধারণত নগর থেকে দূরে বনমধ‍্যে হতো। এই গুরুকুলগুলি প্রধানত ব্রাহ্মণদের মধ‍্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এখানে বেদের গভীরতর ও সূক্ষতম বিষয়গুলি ছাত্রদের অধ‍্যয়নের বিষয় ছিলো। মহাভারতের লেখক স্বয়ং এমনই এক গুরুকুলের প্রধান অধ‍্যাপক ছিলেন। এই গুরুকুলগুলিতে একাধিক ঋষি একত্রে ছাত্রদের বৈদিক জ্ঞান দান করতেন।
মনে রাখতে হবে যে, তখনও বেদ লিপিবদ্ধ হয়নি তাই এই সব ঋষিদের স্মৃতির মধ‍্যে দিয়ে বেদ গুরু শিষ‍্য পরম্পরায় প্রবাহিত হতো। ব‍্যস স্বয়ং বেদ বিভাজনের পর তা নিজের চার শিষ‍্যর মধ‍্যে ভাগ করে দেন যার মধ‍্যে একজন আবার তার পুত্র স্বয়ং। অর্থাৎ গুরুর জ্ঞান কেবল তার উপযুক্ত শিষ‍্যদের মধ‍্যে দিয়েই যেন সমাজ জীবনে প্রয়োগ হয়, এ ব‍্যপারে গুরুরা যথেষ্ট সচেতন থাকতেন। শিষ‍্যদের তার জ্ঞান বহনের উপযুক্ত কিনা তার জন‍্য কঠোর পরীক্ষা নেওয়া হতো। এই পরীক্ষা এখনকার নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট বিষয়ের পরীক্ষা নয়। এই পরীক্ষা, শিষ‍্যের চরিত্রের পরীক্ষা, বিশ্বাস ও আনুগত‍্যের পরীক্ষা।
ঊদ্দালকের ঘটনা প্রমাণ করে যে, একজন উপযুক্ত শিষ‍্য কেমন হবেন। শুধু উদ্দালকই নয়, এরকম পরীক্ষার মধ‍্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সকলকেই। তা সে দ্রোণের কাছে অর্জুনই হন বা সন্দীপনীর গুরুকুলে বাসুদেব, প্রত‍্যেককে শিক্ষার গূঢ়তম পর্বের জন‍্য নিজের বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হয়েছে।
বৈদিকগুরুকুলগুলি মূলত ব্রাহ্মণদের মধ‍্যে জনপ্রিয় হলেও এখানে উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয়রাও বেদ শিক্ষার জন‍্য আসতো। গুরু তার শিষ‍্যদের মধ‍্যে থেকেই বেছে নিতেন পরবর্তী গুরু কে হবেন। গুরুকুলগুলিতে শুধু বেদ শিক্ষাই দেওয়া হতো না, এর পাশাপাশি চলতো চরিত্রগঠনের কাজ। রাজপুত্রকেও দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানের সাথে কাঠ সংগ্রহ, গুরুর সম্পত্তি রক্ষা, গোচারণ, এমনকি প্রয়োজনে ভিক্ষাও করতে হতো। শিক্ষা সম্পন্ন হলে গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিষ‍্যরা নিজ নিজ কর্ম করতে পারতো। শিষ‍্যরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রদেশে নিজস্ব গুরুকুল শুরু করে বৈদিক শিক্ষা ও পূর্বতন গুরুর দর্শনের প্রসার করতো। এভাবেই অনেকগুলি গুরুকুল একত্রে অনেকটা এখনকার বৈঠকের কায়দায় বিভিন্ন বিতর্কিত ধর্মীয় ও সামাজিক ব‍্যাপারের সিদ্ধান্ত নিতো। আবার বিভিন্ন গুরুকুলের মধ‍্যে বর্তমান ছাত্র আদান প্রদানের মতো শিষ‍্য আদানপ্রদানেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক গুরুকুলগুলির মধ‍্যে পরস্পরিক প্রতিদ্বন্দিতাও চলতো। রাজারা বিশেষ বিশেষ পর্ব বা যজ্ঞ উপলক্ষে বিতর্ক সভা আয়োজন করতেন। এই বিতর্ক সভাগুলি যেমন বিজয়ীকে শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিকের স্বীকৃতি দিতো, তেমনই উক্ত রাজার অনুষ্ঠানকেও অমর করে রাখতো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গুরুশিষ‍্য পরম্পরায়। মহাভারতের বিভিন্ন সময় আমরা বৈদিক পাঠশালাগুলির বারংবার উল্লেখ পাই।
অস্ত্রশিক্ষা তৎকালীন সমাজের জন‍্য অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই অস্ত্র শিক্ষার জন‍্য আলাদা গুরুকুল ছিলো। এই গুরুকুলগুলি নগরের আশেপাশেই হতো সাধারণত। কারণ, পর্বতশিখরে বা অরণ্যমধ্যে অস্ত্রের যোগান দেওয়া কষ্টসাধ‍্য ছিলো। এই গুরুকুলগুলিতে শিক্ষার প্রধান বিষয় হতো সাধারণত ধর্নুবেদ, অসিকলা, মল্লযুদ্ধের রীতিনীতি ও বিভিন্ন দৈবাস্ত্র।
মহর্ষি অগ্নিবেশ ছিলেন এই ধারার গুরুকুলের মধ‍্যে শ্রেষ্ঠ।মহাভারতের দুই স্থানে তাঁকে ধর্নুবেদের শ্রেষ্ঠ অধ‍্যাপক এই উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ‍্য দুটি ঘটনার সাথেই জড়িয়ে আছেন মহর্ষি অগ্নিবেশের সবচেয়ে প্রিয় শিষ‍্য ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের নাম। মহাভারতের আগে(?) রামায়ণেও আমরা এই ধরণের বিশেষ অস্ত্র শিক্ষার গুরুকুলের উল্লেখ পাই দুইবার। প্রথমবার শ্রীরাম ঋষি বিশ্বামিত্রর সাথে ওঁর আশ্রমে যাওয়ার প্রাক্কালে ঋষি বশিষ্ট দশরথকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে উপনীত হওয়া এই ঋষি একজন শ্রেষ্ঠ অস্ত্রবিদ ও অস্ত্রগুরু তাই দশরথ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। দ্বিতীয়বার এর উল্লেখ পাই চর্তুদশ বর্ষব‍্যপী বনবাস কালে। এখানে শ্রীরাম ঋষি অগস্তের আশ্রমে আশ্রয় নেন, যেটি আসলে ছিলো এক এরকমই অস্ত্র শিক্ষার কেন্দ্র। ঋষি অগস্তের আশ্রম শুধু অস্ত্র শিক্ষার কেন্দ্রই ছিলো না, সাথে অস্ত্র তৈরির কারখানাও ছিলো এবং সম্ভবত সেটাই স্বাভাবিক ছিলো; কারণ, গহীন বনের মধ‍্যে বাইরে থেকে অস্ত্র সংগ্রহ সম্ভব ছিলো না। এখান থেকেই শ্রীরাম তাঁর কোদণ্ড ধনুক সংগ্রহ করেছিলেন এবং ঋষি অগস্তের থেকে বল-অতিবল নামক এক বিদ‍্যা শিখেছিলেন যার প্রভাবে নিজের সমস্ত অস্ত্রজ্ঞান একটি মাত্র অস্ত্রে কেন্দ্রীভূত করা সম্ভব হতো। অগস্তের গুরুকুলের শিষ‍্যদের পরাক্রমের ফলে বনের সেই বিশেষ অংশে রাক্ষসদের অত‍্যাচার কম ছিলো। রামায়ণ ছেড়ে মহাভারতের ওপর নজর ঘোরালে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে গুরুকুলটি আমাদের নজরে আসে, তা হস্তিনাপুরে দ্রোণাচার্যের গুরুকুলটি। এটি প্রথমে কৃপাচার্যের গুরুকুল থাকলেও পরে তার ভগ্নীপতি এর প্রধান অধ‍্যাপক নিযুক্ত হন ভীষ্মের আদেশে। এখানে লক্ষণীয় গুরু দ্রোণ প্রধান গুরু হলেও কৃপাচার্যের ক্ষমতা হ্রাস হয়নি, তিনি পূর্ববৎ গুরুর সম্মান পেতেন শেষ দিন অবধি এবং পাণ্ডবদের বেদ শিক্ষা দিতেন। দ্রোণাচার্যের গুরুকুলের বিশেষত্ব ছিলো ধর্নুবেদ। তিনি নিজেও যত দক্ষ ধনুর্ধর ছিলেন, ওঁর শিষ‍্যরাও ছিলেন ততই পরাক্রমী। 
বিভিন্ন অস্ত্রগুরুকুল প্রসিদ্ধ ছিলো বিভিন্ন বিশেষ গোপনীয় অস্ত্রবিদ‍্যার জন‍্য। হস্তিনাপুরের এই গুরুকুলটির স্পেশালাইজেশন ছিলো ব্রহ্মগ্রোত্রের অস্ত্র সমূহ এবং এই গোত্রের সর্বোচ্চ অস্ত্র ছিলো ব্রহ্মশির। গুরুকুলগুলির শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুলি সবার শেষে শ্রেষ্ঠ শিষ‍্যদের হাতে তুলে দেওয়া হতো। তার আগে নেওয়া হতো পরীক্ষা। দ্রোণের গুরুকুল থেকে নিজ যোগ‍্যতায় এই অস্ত্র লাভ করেন একমাত্র অর্জুন। দ্রোণ পুত্রস্নেহে অযোগ‍্য অশ্বত্থামাকে এই অস্ত্র দেওয়া পরে এত বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলো, যা যোগ‍্য শিষ‍্যের হাতেই শিক্ষা সম্প্রদানের যুক্তিকেই দৃঢ় করে। মহাভারতের ঘটনা পরম্পরায় আরো অনেক অস্ত্র শিক্ষার গুরুকুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন দ্বারকায় বলরামের নিজস্ব গুরুকুল ছিলো গদাযুদ্ধের কৌশল শেখানোর, মদ্র ও কাশীর অস্ত্র শিক্ষার কেন্দ্রগুলির স্পেশালাইজেশন ছিলো অসি যুদ্ধ, বিরাট রাজ‍্যের গুরুকুলগুলিতে ভল্ল ও মল্লযুদ্ধের কৌশল শেখানো হতো।
বৈদিক শিক্ষা এবং অস্ত্রশিক্ষা একসাথে শেখানোর মতো গুরুকুল সংখ‍্যায় কম হলেও বেশ কয়েকটি ছিলো। এই ধারার গুরুকুলগুলির মধ‍্যে প্রধান ছিলো ভগবান পরশুরামের ভার্গব গুরুকুল। এই জাতীয় গুরুকুলগুলিতে অস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি বৈদিক শিক্ষাতেও জোর দেওয়া হতো। নগর জনবসতি থেকে সাধারণত অনেক দূরে এই শ্রেণীর গুরুকুলগুলি স্থাপিত হতো। শ্রীকৃষ্ণের গুরু সন্দীপনী ঋষির আশ্রমটিও এরকমই মিশ্র শিক্ষার গুরুকুল ছিলো। ভগবান পরশুরাম তার গুরুকুলটি শুধু ব্রাহ্মণদের জন‍্য সীমাবদ্ধ রাখলেও যোগ‍্যতা বিচারে কয়েকজন ক্ষত্রিয় তার শিষ‍্যত্ব পেয়েছিলেন। এই গুরুকুলগুলিতে বিভিন্ন দৈবাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হতো। গুরু দ্রোণ ঋষি অগ্নিবেশ এর কাছে ধর্নুবিদ‍্যা শিক্ষা করলেও দিব‍্যাস্ত্রগুলির শিক্ষা লাভ করেন ভগবান পরশুরামের কাছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে দ্রোণাচার্য তার পরশুরামের থেকে সব দিব‍্যাস্ত্র পেলেও ভার্গব গুরুকুলের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ভার্গবাস্ত্র পাননি। তিনি দক্ষ ধনুর্ধর এবং ব্রাহ্মণ হলেও যেহেতু তিনি এই গুরুকুলের ছাত্র ছিলেন না তাই তাঁর চরিত্র সম্পর্কে পরশুরাম নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। ঋষি সন্দীপনী ছিলেন দক্ষ বেদজ্ঞ। তার গুরুকুলে বেদ শিক্ষা দেওয়া হতো প্রাথমিকভাবে কিন্তু অব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শিষ‍্যদের তিনি ধর্নুবেদের পাঠ ও দিতেন। সন্দীপনীর গুরুকুল থেকে বাসুদেব, বলরাম ছাড়াও সাত‍্যকি, কৃতবর্মার মতো বীর যোদ্ধাও এসেছিলেন। যদিও সাত‍্যকি পরে অর্জুনের থেকে দিব‍্যাস্ত্র শিক্ষা সম্পন্ন করেন। সন্দীপনীর গুরুকুল ছাড়াও যাদবদের বেশ কিছু নিজস্ব গোপন গুরুকুল ছিলো।
উপরিউক্ত তিনপ্রকার প্রধান গুরুকুল ছাড়াও বেশ কিছু অপ্রচলিত শিক্ষার, গোপন শিক্ষার গুরুকুল ছিলো। এদের মধ‍্যে উল্লেখযোগ‍্য নিষাদ ও রাক্ষসগনের নিজস্ব গুরুকুল। হতভাগ‍্য একলব‍্যকে দ্রোণাচার্যের কাছে প্রত‍্যাখ‍্যাত হতে দেখে আমাদের মনে হতেই পারে নিষাদরা অস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো বা তাদের গুরুকুল ছিলো না; কিন্তু আদপেই তা নয়। নিষাদগণের কাছে ধর্নুবেদ না থাকলেও এরা ধর্নুবিদ‍্যায় বিশেষ দক্ষ ছিলো। এরা ধাতু নির্মিত বিশেষ নারাচ বাণের আবিস্কার করেছিলো। পরে এই নারাচ বাণ দিয়েই অর্জুন দ্রোণকে কুম্ভীর মুক্ত করে পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়েছিলেন। ধনুক অস্ত্রটির প্রয়োগ ও আর্যরা এই নিষাদগণের কাছেই শিখেছিলেন বলেও অনেকে মনে করেন। যাই হোক এই নিষাদ গুরুকুলগুলি প্রধানত মগধ রাজ‍্যের আশেপাশে ছিলো কারণ মগধরাজ জরাসন্ধ এই নিষাদকুলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই গুরুকুলগুলিতে সাধারণ ধর্নুবিদ‍্যার পাশাপাশি বিভিন্ন গোপন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো; যেমন, বিষবিদ‍্যা, আয়ুর্বেদ, অশ্বহৃদয় প্রভৃতি। এছাড়াও ছিলো রাক্ষসগণের নিজস্ব গুরুকুল এই গুরুকুল প্রচলিত অস্ত্র শিক্ষাতো দিতোই, তার সাথে গুপ্ত বিদ‍্যা হিসেবে দিতো সম্মোহন এবং মায়া রচনার জ্ঞান। এইগুরুকুল গুলি সাধারণভাবে বেদবিরোধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো। তবে ব‍্যতিক্রম ও লক্ষ‍্য করা যায়।
গুরুকুলগুলি বৈদিকশিক্ষার হোক বা অস্ত্রশিক্ষার আশ্রমের মধ‍্যে গুরুর ক্ষমতা ছিলো সর্বোচ্চ। গুরুকুলগুলি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের জন‍্যই সীমাবদ্ধ ছিলো। কোন শিষ‍্য কতদিনে শিক্ষা সম্পূর্ণ করবে অর্থাৎ গুরুর থেকে সম্পূর্ণ শিক্ষা লাভ করবে তা নির্ভর করতো সম্পুর্ণভাবে গুরুর ওপর । শিক্ষা দানের সময় ধনী- দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বিচার করতেন না গুরু। এছাড়াও গুরুর আশ্রম থেকেই নৈতিক চরিত্র গঠনের কাজ শুরু হতো। যে ব‍্যক্তি ভবিষ‍্যতে বিভিন্ন শক্তিশালী অস্ত্র ও প্রভাবশালী জ্ঞান বহন করবেন তার জন‍্য এই চরিত্র গঠন খুব প্রয়োজনিয় ছিলো। একজন রাজপুত্রও এই গুরুকুলে থাকার সময়েই শিখতো কিভাবে সাধারণ প্রজারা জীবন ধারণ করেন, কিভাবে খাবার ভাগ করে নেয় পরিবারের সাথে। এই শিক্ষাগুলিই পরবর্তীতে সিংহাসনে বসার পর তাকে দক্ষ রাজা বানাতো। এই শিক্ষাগুলি মনে রেখে কৃষ্ণ সুদামাকে চিনতে ভুল করেননি তাই শাসক হিসেবে কৃষ্ণ মহান, অথচ এই শিক্ষা ভুলে গিয়ে দ্রুপদ ডেকে আনেন রাজ‍্যের ওপর বিপদ। 
গুরুকুলে শুধু গুরু না গুরুপত্নীও সমান ভাবে সম্মানীয় হতেন। তাঁরা মাতৃসম্বোধিত হতেন এবং শিষ‍্যদের পুত্রবৎ দেখতেন। গুরুর অবর্তমানে গুরুপত্নীই আশ্রমের সর্বেসর্বা ছিলেন। কখনো কখনো এই গুরুপত্নীদের ও শিক্ষয়ত্রীয় আসনে দেখা যেত, যেমন অরুন্ধতি।
গুরুকুলগুলিতে নিয়ম বানানো হতো গুরুর ইচ্ছানুসারে এখানে রাজার কোনো নিয়ম না খাটলেও একটা প্রভাব অবশ‍্যই পড়তো। গুরু দ্রোণ কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং রাজসন্তানদের শিক্ষা দিতেন। পরশুরামের গুরুকুল ছিলো কঠোরভাবে ব্রাহ্মণদের জন‍্য। গঙ্গার অনুরোধে পরশুরাম ক্ষত্রিয় দেবব্রতকে অস্ত্র শিক্ষা দিলেও তার সবচেয়ে প্রিয় শিষ‍্য হওয়া সত্ত্বেও ভার্গবাস্ত্র দেননি। কর্ণকেও ভগবান পরশুরামের শিষ‍্য হতে মিথ‍্যা পরিচয় দিতে হয়েছিলো। তাঁর নিষ্ঠা, দক্ষতা দেখে এবং প্রকৃত পরিচয় না জানার জন‍্য ব্রাহ্মণভ্রমে পরশুরাম তাকে ভার্গবাস্ত্রের জ্ঞান দান করেছিলেন। তবে মগধের ও কাশীর গুরুকুলগুলিতে সবার শিক্ষাগ্রহণের অধিকার ছিলো। মগধের গুরুকুলে নিষাদ, সুত ও শূদ্র শিষ‍্যের সংখ‍্যা লক্ষণীয় ছিলো। তবে এই সব গুরুকুলগুলিতে বৈদিক শিক্ষা দেওয়া হতো না। কাশী মর্ত‍্যের শিবলোক হওয়ায় এখানে কোনও জাতিভেদ ছিলো না, এখানেই একমাত্র অব্রাহ্মণদের বেদ শিক্ষার অধিকার ছিল। মহাভারতের কবি স্বয়ং এই বিষয়ে কাশীবাসিদের বিরোধিতা করেন এব‌ং নিজেই নাকাল হন। কাশীর গুরুকুলে বেদ ছাড়াও বিভিন্ন গুপ্তবিদ‍্যা, গুপ্ত উপাচারের শিক্ষা দেওয়া হতো। যাদবদের মধ‍্যে সন্দীপনীর গুরুকুল প্রসিদ্ধ হলেও এদের কিছু নিজস্ব ও রহস‍্যময় গুরুকুল ছিলো যেখানে নারায়ণী সেনাদের শিক্ষা দেওয়া হতো। ভয়ঙ্কর এই গোপযোদ্ধাদের শেখানো হতো চাকা জাতিয় অস্ত্র চালনার বিশেষ কৌশল, বিভিন্ন ব‍্যুহ রচনার কৌশল, রথচালনা, অশ্বহৃদয় প্রভৃতি। অপ্রচলিত অস্ত্রচালনার শেখানোর জন‍্য এবং গদাযুদ্ধের কৌশল শেখানোর জন‍্য বলরামের একটি আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিলো। ভীম, দুর্যোধন ছাড়াও শাম্বও বলরামের কাছে গদাযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধ শেখেন। তবে মল্লযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন‍্য সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলো মগধ। ভীম কীচকের লড়াইয়ের সময় দুই পৃথক কৌশলের মল্লযোদ্ধার লড়াই দেখা যায়। মগধের কৌশল বিরাটের কৌশলের থেকে অনেকবেশি আক্রমণাত্মক হতো। 
গুরুকুলগুলি যে গোত্রেরই হোক গুরু হতেন সাধারণত ব্রাহ্মণরাই। একমাত্র নিষাদ আর রাক্ষসদের গুরুকুলগুলিই এর ব‍্যতিক্রম ছিলো। গুরুকুলে নারীদের সাধারণত শিক্ষা নিতে দেখা যেত না, তবে এর অনেক ব্যতিক্রমও ছিলো। মণিপুর, প্রাগজ‍্যোতিষ, গান্ধার প্রভৃতি অঞ্চলের আশ্রমগুলিতে নারীরাও অস্ত্র, রাজনীতি ও সমাজনীতির পাঠ নিতো। তবে মহাভারতে নারীদের বেদপাঠের উল্লেখ পাওয়া যায় না। 
গুরুকুলের শিক্ষাসম্পন্ন হলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈদিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিতর্ক সভা ও অস্ত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে রঙ্গমঞ্চে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো যেখানে শিষ‍্যরা নিজেদের জ্ঞান ও বাহুবল প্রদর্শন করতো। এটি একাধারে গুরু শিষ‍্য উভয়ের প্রতিভার বিজ্ঞাপন ছিলো। গুরুকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিষ‍্যরা গুরুগৃহ ত‍্যাগ করতো। এই গুরুদক্ষিণা ব‍্যপারটি ছিলো বেশ গোলমেলে। গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে গুরু যা কিছু চাইতে পারতো। লেজকালো শরীর সাদা একহাজার ঘোড়া থেকে শুরু করে শিষ‍্যের বৃদ্ধাঙ্গুলি পর্যন্ত এই তালিকায় আছে। তবে সাধারণত গুরু নিজে যে সব অর্জন করতে পারেননি সেগুলিই শিষ‍্যদের অর্জন করার আদেশ দিতেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এগুলি ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার ও প্রথা প্রচলিত ছিলো। গুরুদক্ষিণা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় সম্ভবত দ্রোণ ও একলব‍্যের ঘটনাটি। দ্রোণের কুরুকুলের কাছে চাওয়া গুরুদক্ষিণার ঘটনাটিও উল্লেখযোগ‍্য, এই ঘটনার মধ‍্যেই ভবিষ‍্যতের মহাযুদ্ধের বীজ লুকিয়েছিলো। দ্রোণশিষ‍্যদের কাছে পরাস্ত দ্রুপদ দ্রোণবধের জন‍্য পুত্রলাভ করেছেন জেনেও সেই পুত্রকেও অস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন দ্রোণ স্বয়ং। এই ঘটনা একজন গুরুর কর্তব‍্য পরায়ণতার পরিচয় বহন করে। 
পরিশেষে বলা যেতে পারে শস্ত্র হোক বা শাস্ত্র গোপন ও শক্তিশালী শিক্ষাগুলি গুরুশিষ‍্য পরম্পরায় প্রবাহিত হওয়াই গুরুকুলগুলির ভূমিকা উপেক্ষা করে মহাভারত পর্ব লেখা একেবারেই সম্ভব নয়।
শাসন
এ এমন এক দেশের গল্প, যেখানে গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র সবাই থাকতো এক ছাতার তলায়। এমন এক সময়ের গল্প, যখন ঘরে ঘরে তৈরী হতো 'রাজা'। যখন সামান্য কাঠুরে থেকে শুরু করে জেলে গোষ্ঠীর প্রধান, এমনকি দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত সবাই রাজা। এদেশে অনার্য মাইমল রাজা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে নির্দ্বিধায় শর্ত দেন আর্য রাজা শান্তনুকে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখতে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র যুদ্ধের ফাইফরমাস খাটেন। এ গল্প মহাভারতের।
কবি বলেছেন, "মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাশ কহে শোনে পূণ্যবান।" তবে আমি মনে করি, যেই বলুন না কেন, শুধুমাত্র পূণ্যবান না, 'অমৃত সমান' এই কথা শোনার জন্য ধৈর্য্যবান হ‌ওয়াও একান্ত আবশ্যক।
ক্লাস ইলেভেনে যখন প্রথমবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরব‌ই হাতে নিই, আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, রামায়ণ-মহাভারতের মতো ধর্মগ্রন্থগুলো ধৈর্য্য ধরে পড়লে এইসব বিরক্তিকর পাঠ্যপুস্তক পড়ার কোনো প্রয়োজনই হয় না। সদ্য পাখনা গজানোর বয়সে সে কথায় কান না দিলেও উড়তে উড়তে যখন এক জায়গায় থিতু হলাম, বুঝলাম সেই মহাভারতের বিশাল বৃক্ষশাখাতেই আশ্রয় পেয়েছি। তাই আজ মহাভারতের রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসে পাকেচক্রে পড়ে গিয়ে সেই শিক্ষকের কথা মনে পড়লো।
যাইহোক, কাজের কথায় আসি।
মহাভারতের রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসে, ওই সময়ের সমাজ ও জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ করে আমরা কিন্তু শুধুই রাজতন্ত্র পাই না। বরং ওই ঘরে ঘরে রাজা জন্মানোর যুগেও বেশ কিছু সমৃদ্ধশালী, বিখ্যাত ও সামরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উল্লেখ ও পাওয়া যায়। বিশিষ্ট পণ্ডিতরা অবশ্য এগুলির শাসনতন্ত্র বিচার করে, এদের 'গণতন্ত্র' না বলে 'প্রজাতন্ত্র' বা Republic বলার পক্ষপাতি। আমরাও তাই এখানে প্রজাতন্ত্র‌ই বলছি। তবে রাজনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা রাজতন্ত্র থেকেই শুরু করবো।
বাবার মৃত্যুর পর ছেলে রাজা হয়। ছেলে না থাকলে রাজ্য পায় মেয়ে বা মেয়ের স্বামী। কোনো ব্যতিক্রমী রাজা অপুত্রক অবস্থায় বা‌ ছেলের অযোগ্যতার কারণে ইচ্ছামতো পছন্দের পাত্রকে ‌রাজ্যপাট সঁপেন। আর পুত্র যদি ব্যতিক্রমী হন, তাহলে বাবাকে হত্যা বা বন্দী করে রাজত্ব হাতে নেন। ক্ষমতা, বুদ্ধি আর লোকবল থাকলে রাজা আশপাশের রাজ্যকে দখল করে, সম্রাট হন।
রাজতন্ত্রের এই চিরকালীন ও সহজ নিয়মেই মহাভারত-পূর্ব সমাজ চলে আসছিল। সেযুগে হাজারে হাজারে রাজা ছিল। অনার্য মাইমল, কাঠুরে, কিরাত, নাগ, এমনকি আর্য্য কুরু, পাঞ্চাল সবাই রাজা। মানব উগ্রসেন, কংস, জরাসন্ধ যেমন রাজা, দেবতা ইন্দ্র, বরুণ, যম‌ও তেমনি রাজা। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বুদ্ধের সময় শুধুমাত্র বৈশালীতেই সাড়ে সাত হাজারের বেশি রাজা ছিলেন!‌ এ থেকে একটা কথাই ধারণা করা যায়, সেযুগে প্রতিটি ছোট ছোট গোষ্ঠীপতিকেই 'রাজা' নামে অভিহিত করা হয়।
মহাভারতে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সময় বলেন, এ ভারতের ঘরে ঘরে রাজা আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ রাজ্যের হিত সাধন করে থাকেন- “গৃহে গৃহে হি রাজানঃ স্বস্যস্বস্য প্রিয়ঙ্করাঃ।” এ কথা প্রমাণ করে, শুধু মহাভারত পূর্ব সমাজেই না, যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকালে ও ছোট ছোট গোষ্ঠীপতিরা রাজার সম্মান‌ই পেতেন। আর তাই রাজারাও নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় একাই দেশভ্রমণে বেরোতে পারতেন।
যেমন শান্তনু বেরিয়েছিলেন। আর এই শান্তনুর হাত ধরেই কুরু বাড়িতে কূটিল রাজনীতির প্রবেশ হয়েছিল। দেশভ্রমণ করতে গিয়ে মাইমল সুন্দরী সত্যবতীর প্রেমে পড়েন শান্তনু, বিয়ের প্রস্তাব‌ও দেন। আর এখানেই রাজনীতির কূটিল চালটি চালেন সত্যবতীর বাবা। যুবরাজ দেবব্রতকে দিয়ে সিংহাসন না চাওয়া ও বিবাহ না করার ভীষণ প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে মেয়ের ও ভবিষ্যৎ নাতি-পুতির জীবনের ভিত শক্ত করে দেন মাইমল রাজ। এখানে লক্ষণীয় যে, মাইমল রাজ বুঝেছিলেন, ক্ষমতাশালী কুরুরাজ শান্তনুকে না চটিয়ে একইঙ্গে নিজের মেয়ের ও সর্বোপরি গোটা মাইমল সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না। তাই তিনি এই কঠিন শর্ত রাখেন। এখানে রক্তপাতহীন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত পাওয়াযায়।
যাইহোক, এ গল্পের পরবর্তী ঘটনা বলার জায়গা এটা নয়, তবে এখানে এই কাহিনী বলার কারণ হলো, লক্ষ্য করুন, বিখ্যাত আর্য রাজা শান্তনু বা তাঁর চেয়েও বিখ্যাত যুবরাজ দেবব্রত কিন্তু এক অখ্যাত মাইমল রাজার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়েছেন। এটি শুধুমাত্র মাইমল সম্প্রদায়কে হাতে রেখে রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছাই প্রকাশ করেনা, বরং সামনে আনে আরেকটি সত্য- প্রতিটি গোষ্ঠীপতিই রাজা হ‌ওয়ায় তাঁরা তখনো রাজকীয় সম্মান লাভ করেননি। আসলে সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের ধারণা তখন‌ও প্রচলিত না হ‌ওয়ায়, রাষ্ট্র শাসকের ব্যাপক সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা জনমানসে স্থান পায়নি।
বেশ কিছু প্রাচীন গ্রন্থে রাষ্ট্রকে সমাজ বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক কালে কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস্ প্রমুখ এই মতকে সমর্থন করে বলেছেন, অনন্তকাল ধরে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলনা। রাষ্ট্র ছাড়াই অনেক সমাজ চলতো। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে সামাজিক শ্রেণীবিভাগ তৈরী হলে, রাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিগঠিত হয়। মহাভারতে ক্ষুদ্রক মালব, উত্তর মদ্র প্রভৃতি স্থানে এরূপ রাজ্য দেখা যায়।
মহাভারতের শান্তি পর্বে, অর্থশাস্ত্রে বা বৌদ্ধ দর্শনে রাষ্ট্রকে সম্মিলিত চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট এক স্বেচ্ছামূলক সংগঠন হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ এই সময় সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট রাষ্ট্রে বহুরাজার অস্তিত্ব অস্বাভাবিক ছিল না। আধুনিক কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রল্সের মতো ব্যক্তিত্ব এই মতবাদকে সমর্থন করেছেন। তবে সমস্ত দেশের সর্বময় কর্তার ধারণা সর্বপ্রথম ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পায় ভীষ্মের সেনাপতিত্বের সময়।
এই সময়ের কৌরব সাম্রাজ্যকে আজকের ভারত বা ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই দেশগুলিতে যেমন একজন রাষ্ট্রপতি বা রাজা-রাণী শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে আসীন থাকেন, কিন্তু রাজ্য আসলে চালান প্রধানমন্ত্রী। তেমনি বিচিত্রবীর্য্য বা পাণ্ডু, রাজা যেই হোন, রাজ্য চালাতেন সেই ভীষ্ম। ধৃতরাষ্ট্র রাজা হ‌ওয়ার পর‌ও শুরুর কিছুদিন ভীষ্ম ও বাকি সময়টা দুর্যোধন এই পরোক্ষ রাজার ভূমিকা পালন করেন। এরকম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরস্থ করদ রাজ্যগুলির রাজারা সম্রাটকে নির্বাচন করতেন। সম্রাট নির্বাচনের অধিকার জনগণের ছিল না। যেমন আধুনিক ভারতে প্রধানমন্ত্রী জনতার দ্বারা নির্বাচিত না হয়ে, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের দ্বারা নির্বাচন‌ লাভ করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কয়েক হাজার বছরের পুরনো কয়েকটি রাজতন্ত্রের সঙ্গে কয়েকটি অত্যাধুনিক গণতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের তুলনা কেন করছি? উত্তরে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা ধার করে বলা যেতেই পারে, গণতন্ত্রের মধ্যেও কিন্তু প্রভাবশালীর রাজতন্ত্র বর্তমান। আজকের বিশ্বে একটি সুস্থ গণতন্ত্র বা জনদরদী রাজতন্ত্রের সন্ধান করা আর সাম্যবাদী বিশ্বের স্বপ্ন দেখা প্রায় সমান।
তৎকালীন রাজতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে বর্তমান যুগের শাসনব্যবস্থাগুলির প্রধান তফাৎ হলো এগুলির অন্তর্গঠনে। আজকের শাসনব্যবস্থায় রাজা ও তাঁর সহকারী মন্ত্রীসভা যেমন শুধুই গণভোটে বিজয়ী দল থেকে নির্বাচিত হন, মহাভারতের সমাজে এর বিপরীত এক অবস্থা পরিলক্ষিত হয়, এখানে রাজার সহকারী মন্ত্রী সভার মধ্য তাঁর Supporter ও Opposition দুই দল‌ই স্থান পেতেন। কখনো আবার ওই মন্ত্রীসভার মধ্যে থেকেই কেউ কেউ অন্তর্দ্বন্দ্বের দ্বারা রাজাকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করতেন। 
তবে এই বিরোধীদের খোঁজ পেলে, তাদের সরানোর প্রক্রিয়া অর্থাৎ গুপ্তহত্যার সঙ্গে আজকের সরকার বিরোধী গোষ্ঠীর মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। আজকাল হামেশাই দেখতে পাবেন, গত সপ্তাহে পাড়ার অমুক ব্যক্তি পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে চাল চুরির অভিযোগ এনেছিল, কাল থেকে সেই অমুক ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তান বা স্বয়ং সেই ব্যক্তিটিই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন! দু'দিন পর কোনো নদী থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার হলো।
তেমনি মহাভারতে‌ও পরবর্তী সিংহাসনের দাবিদার, কিম্বা প্রধান বিরোধী দলের সদস্যদের সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া রীতিমতো পরিকল্পনা করে সম্পন্ন হতে দেখা যায়।
আদিপর্বে ভীমকে বিষ খাইয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন দুর্যোধন। তারপর 'লাশ' গুম করতে নদীতে ফেলেও দেন তাঁকে। এছাড়াও জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল।
কাল থেকে যে ব্যক্তিটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাঁর আত্মীয় পরিজন যা কিন্তু চুপ থাকেন। কারণ মুখ খুললে আরও কয়েকজনের নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। মহাভারতও কিন্তু এর ব্যতিক্রম না। ভীমকে খুঁজে পাওয়ার পর ভীম যখন উত্তেজিত হয়ে প্রতি আক্রমণের কথা বলেন, যুধিষ্ঠির তাঁকে শান্ত করেন। এখানে যুধিষ্ঠির কিন্তু নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই ভাইকে শান্ত করেন। বিদুর কুন্তীকে বলেন, যা হ‌ওয়ার হয়েছে, আপাতত ছেলেদের বাঁচাও..এ খবর প্রচার হয়ে গেলে গুপ্ত আক্রমণের বদলে প্রকাশ্য আক্রমণ আসতে পারে- “প্রত্যাদিষ্টো হি দুষ্টাথা শেষে পি প্রহরেত্তর।”
এবার প্রজাতন্ত্রের কথা বলা যাক। মহাভারতে বর্ণিত রাজ্যগুলির মধ্যে দ্বারকা, মথুরা, উত্তর কুরু, উত্তর মদ্র, বৃজি প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে 'প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা ছিল। জাতক অনুসারে বৈশালীতেও প্রজাতন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়, তবে বৈশালী নিজেই কোশল রাজ্যের অধিনস্ত হ‌ওয়ায় পণ্ডিতরা একে প্রজাতন্ত্র বলতে অস্বীকার করেন। মহাভারত বিশ্লেষকরা বলেন, এই রাজ্যগুলিতে প্রজাতন্ত্র থাকলেও, শাসন কার্য পরিচালনা করতেন রাজ্যস্থিত গোষ্ঠীগুলির নির্বাচিত বিশিষ্ট নেতৃবর্গ। এঁরা প্রত্যেকেই রাজার উপাধি পেতেন। তবে রাজ্যের প্রধান হিসেবে এঁরা নিজেদের মধ্যে থেকেই বয়স্থ বা জ্ঞানী ও সম্মানীয় কাউকে নির্বাচন করতেন। এই রাজা বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ অথবা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন।
প্রাচীন টীকাকার ও গবেষক যা অবশ্য এই রাজ্যগুলিকে আদর্শ রাজ্য বলতে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এদের 'বৈরাজ্য' বলেছেন। Social ও Anti Social এর মাঝে যেমন Unsocial বিরাজ করে, নৈরাজ্যের আগে তেমনি বৈরাজ্য বর্তমান। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “বৈরাজ্যায় এব তে অভিষিচ্যান্তে”- একাধিক রাজা যুক্ত রাজ্যগুলি বৈরাজ্য।
তবে এর পরেও এই রাজ্যগুলিতে একতাই ছিল একান্ত কাম্য নীতি। বর্তমানে আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রিক দেশগুলির মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে, "এক রাষ্ট্র, এক পরিচিত।" আর আমরা ভারতীয়রা তো ছোটবেলাতেই গান্ধীজীকে 'জাতির জনক' বলার মাধ্যমে নিজেদের একটি জাতি- ভারতীয় বলে পরিচিত হতে শিখি। তেমনি কৃষ্ণের রাজ্য যাদব, ভোজ, বৃষ্ণি, অন্ধক, হৈহয়, চেদী, বিদর্ভ প্রভৃতি গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হলেও, প্রত্যেকে নিজেদের ভোজ বলেই পরিচয় দিতেন। তবে আগে বলা রাজতন্ত্রের মতোই এখানেও বিরোধী নেতারা শাসক জোটের মধ্যেই অবস্থান করতেন। আর রাজতন্ত্রের থেকে শিথিল শাসনব্যবস্থা হ‌ওয়ায় এই প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে অন্তর্ঘাত হতো ব্যাপক হারে।
উদাহরণে সমন্তক মণি নিয়ে ভোজ গোষ্ঠীগুলির বিবাদের কথা বলা যায়। এই বিবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কৃষ্ণ নারদকে বলেন, সমস্ত ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য সত্ত্বেও আমি আসলে আমার জ্ঞাতিদের দাসত্ব করে যাচ্ছি। - “দাস্যম ঐশ্বর্যবাদেন জ্ঞাতিনাং নঃ করোম্যহম্। নিত্যোত্থানেন সম্পন্না নারদান্ধকবৃষ্ণায়ঃ” - নারদ, সময়কাল যেভাবে এগোচ্ছে, অন্ধক বা বৃষ্ণিরা যেকোনো সময় অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। আবার কখনো সরাসরি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমার হয়েছে মহা বিপদ, একজনের খুশিতে সামিল হলে গোষ্ঠীর অপর সদস্যরা ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, হিংসা করছেন!- “একস্য জয়মাশংসে অপরস্য অপরাজয়ম।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই এক‌ইঝামেলায় কৃষ্ণ নিজের দাদা বলরামের বিশ্বাসও হারান।
আমরা যদি আরেকটু পিছনে যাই, এই ভোজ গোষ্ঠীতেই আরেকটি ভয়াবহ অন্তর্দ্বন্দ্বের নিদর্শন পাই।
তখন‌ও কৃষ্ণের জন্ম হয়নি, বিশিষ্ট গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে নাম নেওয়া হয় বাসুদেব, উগ্রসেন, অক্রুর প্রমুখের। ঠিক এই সময় সক্রিয় হয়ে ওঠেন উগ্রসেন পুত্র কংস। নিজেকে গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি প্রথমেই হাত মেলান মগধরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে। তাঁর দুই মেয়েকে বিবাহ করে, শ্বশুরের বলে বলীয়ান হয়ে কংস প্রথমেই নিজের বাবা উগ্রসেনকে বন্দী করেন। এরপর অন্যান্য সংঘ সদস্যদের একপ্রকার তোয়াক্কা না করেই মথুরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীতে কৃষ্ণ, অক্রুর প্রমুখের হস্তক্ষেপে এই চক্রান্ত ব্যর্থ হলেও এই ঘটনা যাদব-ভোজ-বৃষ্ণিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব সর্বসমক্ষে এনে দেয়। সঙ্গে এও দেখিয়ে দেয়, শিথিল প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও সংঘ সদস্যদের মতানৈক্য রাজ্যের জন্য‌ কত বড়ো বিপদ ডেকে আনতে পারে!
এবার আসা যাক শাসন বিভাগ সমূহের কথায়। আজকের দিনে শাসন বিভাগ বলতে রাষ্ট্রের প্রধান পরিচালক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত সকলকেই বোঝার। তাই আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সংজ্ঞার তুলনায় মহাভারতীয় শাসন ব্যবস্থার সংজ্ঞা বেশ সংকীর্ণ ছিল বলেই মনে হয়। এখানে কেবলমাত্র রাষ্ট্রের প্রধান শাসক ও প্রশাসনিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণকারী সচিবদের নিয়েই শাসন ব্যবস্থা গঠিত হতো। সরকারি কর্মচারীদের সেখানে কোনো স্থান ছিল না। তবে আজকের দিনের মতো শাসন বিভাগের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দুটি অংশ তখন‌ও বর্তমান ছিল।
রাজনৈতিক অংশে অবস্থান করতেন রাজা, মন্ত্রীগণ, সেনাপতি প্রমুখ। আর অরাজনৈতিক অংশে বিরাজ করতেন সচিব অর্থাৎ রাজ পুরোহিত, শিক্ষক বা রাজবংশের বৃদ্ধ, জ্ঞানী ব্যক্তিরা। এঁরা প্রধাণত পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতেন। যেকোনো রকম কঠিন পরিস্থিতিতে রাজা এঁদের কাছে উপযুক্ত পরামর্শ চাইতে পারতেন।
যাইহোক, এঁদের কথা পরে বলা যাবে, আপাতত শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ সম্পর্কে বলা যাক।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্তেস্কুর মতে, সরকারের বিভাগগুলি নিজ নিজ গণ্ডীর মধ্যে থেকে কাজ করলে নাগরিক স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে রক্ষিত হয়। আর সেই নীতিতে বিশ্বাসী হয়েই বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ নিজ সংবিধান অর্থাৎ নির্দিষ্ট নীতিগ্রন্থ বলবৎ করেছে। এই গ্রন্থে শাসক বিরোধী প্রতিটি গোষ্ঠীর কার্যপ্রণালী, সম্পর্ক, জনগণের সঙ্গে শাসকের সম্পর্ক, এমনকি শাসক, প্রজা সকলের অবশ্য করণীয় কার্যাবলী সম্পর্কেও বলা হয়।
মহাভারতের মতো প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত রাজ্যগুলিও কিন্তু এর ব্যতিক্রম ছিল না। ওই সমস্ত রাজ্য চলতো 'দণ্ডনীতি' মেনে। না, দণ্ড মানে এখানে শাসন নয়, রাজ্য চালনার বিধানকে বোঝানো হয়েছে। ভারতে ঠিকঠাকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই যেমন সংবিধান রচিত হয়েছিল, পুরাণেও বলা হয় মনু প্রথম রাজা নির্বাচিত হ‌ওয়ার আগেই ভগবান শিব দণ্ডনীতি প্রচলন করেন। তবে সংবিধানেও তো ভুল থাকেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তন হতে থাকে। তাই সংবিধানকে সময়োপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে মাঝে মধ্যেই অ্যামেন্ডমেন্ট অর্থাৎ 'সংবিধান সংশোধনী বিল' আনা হয়। 
এক‌ই ভাবে দণ্ডনীতির‌ও কিন্তু অ্যামেন্ডমেন্ট হতো। ভগবান শিবের তৈরি দণ্ডনীতি যথাক্রমে ইন্দ্র, বৃহস্পতি, শুক্রাচার্য্য প্রমুখ পরিবর্তন করেন। এর পরেও বেশ কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি এই কাজ করলেও সর্বশেষ পরিবর্তনের কাজটি করেন চাণক্য কৌটিল্য। তাঁর 'অর্থশাস্ত্র'ই এই প্রাচীন দণ্ডনীতির সংশোধিত রূপ। তিনি অবশ্য দণ্ডনীতিকে নীতিশাস্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। অধুনা শাসকরা যেমন সংবিধানের নামে শপথ করে শাসনকার্য শুরু করেন, পুরাকালেও তেমনি রাজারা অভিষেককালে এই নীতিশাস্ত্রের শপথ গ্রহণ করতেন।
বর্তমানে প্রতিটি শাসক, এমনকি বিরোধীরা কিন্তু সংবিধানকে‌ চূড়ান্ত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। শাসক যেমন সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের থেকে দেশপ্রেম ভিক্ষা করে, যা কালক্রমে শাসক প্রেমে রূপান্তরিত হয়। তেমনি বিরোধীরা সেই সংবিধানকেই ভিন্নভাবে ব্যবহার করে জনতাকে শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালন করতে পারেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কিন্তু সংবিধানকে নিজের স্বার্থে নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।
এক‌ই ভাবে মহাভারতেও বারবার দ
বর্তমানে প্রতিটি শাসক, এমনকি বিরোধীরা কিন্তু সংবিধানকে‌ চূড়ান্ত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। শাসক যেমন সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের থেকে দেশপ্রেম ভিক্ষা করে, যা কালক্রমে শাসক প্রেমে রূপান্তরিত হয়। তেমনি বিরোধীরা সেই সংবিধানকেই ভিন্নভাবে ব্যবহার করে জনতাকে শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালন করতে পারেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কিন্তু সংবিধানকে নিজের স্বার্থে নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।
এক‌ই ভাবে মহাভারতেও বারবার দণ্ডনীতিকে রাজা তাঁর জনগণকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করেছেন, আবার বিরোধীরা এক‌ই দণ্ডনীতির দোহাই দিয়ে শাসককে চাপে ফেলেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কুরুবৃদ্ধরা কিন্তু এই দণ্ডনীতির উল্লেখ করেই যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ করার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে চাপ দেন - স্থাপিতো ধৃতরাষ্ট্রেণ... যৌবরাজায় পার্থিব।
রাজা দ
রাজা দণ্ডনীতিকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করলেও আপেক্ষিকভাবে তাঁর আয়ত্বের বাইরে থাকতেন রাজ্যের অমাত্য ও পরামর্শদাতারা। বর্তমানে অরাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় অবস্থান করা রাষ্ট্রভৃত্তক বা Civil Servant রা যেমন সরাসরি সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, পুরাকালের ওই পরামর্শদাতা গোষ্ঠীও সরাসরি দণ্ডনীতির‌ প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন। কুরু রাজতন্ত্রে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, কৃষ্ণ প্রমুখ এই অরাজনৈতিক পরামর্শদাতার কাজ করেছেন।
লক্ষ্য করবেন, জনসমাজে এরূপ বড়ো কিছু ব্যক্তিত্ব আজ‌ও বর্তমান, যাঁরা 'আপাত অরাজনৈতিক' ভেক ধরে জনহিতকর কাজের দ্বারা একটি ব্যাপক সংখ্যক জনতাকে নিজের অনুগত রাখেন। আর শুধুমাত্র জনসমর্থন লাভের আশাতেই সরকার এঁদের হাতে রাখতে চায়।
আজকের দিনে যেমন দেখা যায়, অমুক কোম্পানির প্রধান শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। আবার পাঁচ বছর পর সরকার বদল‌ হলে সেই ব্যক্তি কেই নতুন শাসকের পাশে হাসিমুখে ঘুরতে দেখা! এতে জনগণ কিছুটা অবাক হলেও ওই অমুক কোম্পানিটির প্রতিপত্তি কিন্তু বাড়তেই থাকে।
পুরাকালের ওই পরামর্শদাতা গোষ্ঠীও ঠিক একই ভাবে কাজ করতো। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর এমনকি কৃষ্ণ‌ও কিন্তু নিরপেক্ষতার ভান করে রীতিমতো রাজ্যপাট পরিবর্তনে ভূমিকা নিয়েছিলেন! ভীষ্ম বা কৃষ্ণের ছিল বিশাল জনসমর্থন, সৈন্যবল ও সর্বোপরি অতুলনীয় রাজনৈতিক জ্ঞান। দ্রোণ ও কৃপের ছিল অস্ত্রবিদ্যা। স্বভাবতই এরূপ ব্যক্তিদের যেকোনো রাজা‌ স্বপক্ষে টানতে চাইবেন।
শুধুমাত্র কৃষ্ণকে হাতে রাখার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের সময় যুধিষ্ঠির আরো অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে ছেড়ে কৃষ্ণের পায়ে অর্ঘ্য দান করেন।
ধৃতরাষ্ট্র এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুগত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে দুর্যোধন বলেন, পিতামহ হিসেবে ভীষ্মের কাছে পা
লক্ষ্য করবেন, জনসমাজে এরূপ বড়ো কিছু ব্যক্তিত্ব আজ‌ও বর্তমান, যাঁরা 'আপাত অরাজনৈতিক' ভেক ধরে জনহিতকর কাজের দ্বারা একটি ব্যাপক সংখ্যক জনতাকে নিজের অনুগত রাখেন। আর শুধুমাত্র জনসমর্থন লাভের আশাতেই সরকার এঁদের হাতে রাখতে চায়।
আজকের দিনে যেমন দেখা যায়, অমুক কোম্পানির প্রধান শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। আবার পাঁচ বছর পর সরকার বদল‌ হলে সেই ব্যক্তি কেই নতুন শাসকের পাশে হাসিমুখে ঘুরতে দেখা! এতে জনগণ কিছুটা অবাক হলেও ওই অমুক কোম্পানিটির প্রতিপত্তি কিন্তু বাড়তেই থাকে।
পুরাকালের ওই পরামর্শদাতা গোষ্ঠীও ঠিক একই ভাবে কাজ করতো। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর এমনকি কৃষ্ণ‌ও কিন্তু নিরপেক্ষতার ভান করে রীতিমতো রাজ্যপাট পরিবর্তনে ভূমিকা নিয়েছিলেন! ভীষ্ম বা কৃষ্ণের ছিল বিশাল জনসমর্থন, সৈন্যবল ও সর্বোপরি অতুলনীয় রাজনৈতিক জ্ঞান। দ্রোণ ও কৃপের ছিল অস্ত্রবিদ্যা। স্বভাবতই এরূপ ব্যক্তিদের যেকোনো রাজা‌ স্বপক্ষে টানতে চাইবেন।
শুধুমাত্র কৃষ্ণকে হাতে রাখার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের সময় যুধিষ্ঠির আরো অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে ছেড়ে কৃষ্ণের পায়ে অর্ঘ্য দান করেন।
ধৃতরাষ্ট্র এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুগত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে দুর্যোধন বলেন, পিতামহ হিসেবে ভীষ্মের কাছে পাণ্ডব আর কৌরব, দু'পক্ষ‌ই সমান, তাই তাঁকে নিয়ে চিন্তা নেই। আর দ্রোণকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই, কারণ স্বয়ং তাঁর ছেলে অশ্বত্থামা আমাদের পক্ষে আছে- দ্রোণপুত্রো ময়ি স্থিতঃ। লক্ষ্য করুন, দুর্যোধন কিন্তু সরাসরি প্রভাবশালীদের হাত করার কথা বলছেন।
উদ্যোগ পর্বে কৃষ্ণ সন্ধির জন্য কুরু বাড়িতে গেলে ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন তাঁকে নানা উপঢৌকন ও খাদ্যাদি দিয়ে নিজেদের দলের টানার চেষ্টা করেন।
আজকাল যেমন নির্বিঘ্নে শাসনকার্য চালানোর জন্য পয়সার জোরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আমলাদের কিনে নেওয়া বা প্রভাবিত করার রীতি প্রচলিত আছে, যুধিষ্ঠির বা দুর্যোধন ও কিন্তু সেই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন, মন্ত্রী, অমাত্য দু'দিনে আমার হাতে চলে আসবে, কারণ রাজকোষ এখন আমার অধীন- “অর্থবর্গঃ সহামাত্যো মৎসংস্থো'দ্য ম‌ইপতে... ধ্রবম অস্মৎ সহায়ান্তে ভবিষ্যন্তি প্রধানতঃ”। এবার আসা যাক জনগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের কথায়। আজকাল ভোটের প্রচারে নেতাদের মুখে প্রতিশ্রুতি ছাড়া যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, সেটি হলো, আমি জনগণের চাকর, জনগণের সেবা করতে চাই। অর্থাৎ তিনি নিজেকে জনগণের প্রতি সঁপে দিচ্ছেন। অথচ ওই একই নেতা ভোটে জেতার পর, ঘটনা হয়ে যায় একেবারে উল্টো। বড়ো নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি পদাধিকারী হলে তো পরিস্থিতি আরও ঘোরালো‌ হয়ে ওঠে! পরিস্থিতির কল্যাণে তিনি নিজেকে ভগবান প্রমাণ করতে না পারলেও, ভগবানের ঠিক পরের স্থানেই নিজেকে বসিয়ে ফেলেন। জনগণের স্বাধীনতা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, চাহিদার থেকেও তাঁর নিজের বিলাসটাই বড়ো হয়ে ওঠে। যে জনতার ভোট আর ট্যাক্সের টাকায় তিনি আজ‌ ওই স্থানে পৌঁছেছেন, সেই জনগণকেই তিনি ভুলে যান।
মহাভারতের সমাজ কিন্তু এর থেকে বেশ আলাদা‌ ছিল। আলাদা ছিল বললাম করে আবার ভাববেন না, যে, রাজা জনগণের খুব খেয়াল রাখতেন। আসলে এ সময় প্রজাদের স্বল্প শিক্ষার‌ সুযোগ নিয়ে, প্রাচীন গ্রন্থাদির ভুল ব্যাখ্যা করে রাজা নিজের ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার রূপে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন।
আদি মানব মনু বলেছেন, “সুরেন্দ্রানাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ” - ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, যম প্রমুখ দেবতার শক্তি দিয়েই আদর্শ রাজা গঠিত। ভেবে দেখুন, মনু কিন্তু এখানে রাজাকে ঈশ্বর বললেন না। তিনি বললেন, ইন্দ্রের মতো আক্রমণাত্মক ও সহস্রাক্ষী অর্থাৎ রাজকার্যের সবদিকে সর্বদা নজরদারির ক্ষমতা, চন্দ্রের মতো চপল ও কোমল, বরুণের মতো দানি অর্থাৎ প্রজাবৎসল ও যমের মতো ধার্মিক ও প্রয়োজনে কঠিনতম দ
উদ্যোগ পর্বে কৃষ্ণ সন্ধির জন্য কুরু বাড়িতে গেলে ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন তাঁকে নানা উপঢৌকন ও খাদ্যাদি দিয়ে নিজেদের দলের টানার চেষ্টা করেন।
আজকাল যেমন নির্বিঘ্নে শাসনকার্য চালানোর জন্য পয়সার জোরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আমলাদের কিনে নেওয়া বা প্রভাবিত করার রীতি প্রচলিত আছে, যুধিষ্ঠির বা দুর্যোধন ও কিন্তু সেই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন, মন্ত্রী, অমাত্য দু'দিনে আমার হাতে চলে আসবে, কারণ রাজকোষ এখন আমার অধীন- “অর্থবর্গঃ সহামাত্যো মৎসংস্থো'দ্য ম‌ইপতে... ধ্রবম অস্মৎ সহায়ান্তে ভবিষ্যন্তি প্রধানতঃ”। এবার আসা যাক জনগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের কথায়। আজকাল ভোটের প্রচারে নেতাদের মুখে প্রতিশ্রুতি ছাড়া যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, সেটি হলো, আমি জনগণের চাকর, জনগণের সেবা করতে চাই। অর্থাৎ তিনি নিজেকে জনগণের প্রতি সঁপে দিচ্ছেন। অথচ ওই একই নেতা ভোটে জেতার পর, ঘটনা হয়ে যায় একেবারে উল্টো। বড়ো নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি পদাধিকারী হলে তো পরিস্থিতি আরও ঘোরালো‌ হয়ে ওঠে! পরিস্থিতির কল্যাণে তিনি নিজেকে ভগবান প্রমাণ করতে না পারলেও, ভগবানের ঠিক পরের স্থানেই নিজেকে বসিয়ে ফেলেন। জনগণের স্বাধীনতা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, চাহিদার থেকেও তাঁর নিজের বিলাসটাই বড়ো হয়ে ওঠে। যে জনতার ভোট আর ট্যাক্সের টাকায় তিনি আজ‌ ওই স্থানে পৌঁছেছেন, সেই জনগণকেই তিনি ভুলে যান।
মহাভারতের সমাজ কিন্তু এর থেকে বেশ আলাদা‌ ছিল। আলাদা ছিল বললাম করে আবার ভাববেন না, যে, রাজা জনগণের খুব খেয়াল রাখতেন। আসলে এ সময় প্রজাদের স্বল্প শিক্ষার‌ সুযোগ নিয়ে, প্রাচীন গ্রন্থাদির ভুল ব্যাখ্যা করে রাজা নিজের ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার রূপে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন।
আদি মানব মনু বলেছেন, “সুরেন্দ্রানাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ” - ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, যম প্রমুখ দেবতার শক্তি দিয়েই আদর্শ রাজা গঠিত। ভেবে দেখুন, মনু কিন্তু এখানে রাজাকে ঈশ্বর বললেন না। তিনি বললেন, ইন্দ্রের মতো আক্রমণাত্মক ও সহস্রাক্ষী অর্থাৎ রাজকার্যের সবদিকে সর্বদা নজরদারির ক্ষমতা, চন্দ্রের মতো চপল ও কোমল, বরুণের মতো দানি অর্থাৎ প্রজাবৎসল ও যমের মতো ধার্মিক ও প্রয়োজনে কঠিনতম দণ্ড নির্ধারণে সক্ষম, এইসব গুণ থাকলে তবেই রাজা আদর্শ রাজা রূপে গণিত হবেন। 
দন্ডনীতি সংশোধন করে শুক্রাচার্য্য বলেছিলেন, মালিক যেমন ভৃত্য কে বেতন দেয়, প্রজারাও তেমন রাজাকে প্রদান করেন। অর্থাৎ রাজা আসলে প্রজাদের ভৃত্য। তাই তাঁর উচিত প্রজাদের হিতের কথা সবসময় ভাবা। কিন্তু এখানেও রাজা কি করবেন তা আমরা সবাই জানি। অর্থাৎ এখানে রাজা‌ নিজের স্বার্থে স্বয়ং মনু ও শুক্রাচার্যকে মানছেন না।
আজ পর্যন্ত কিন্তু এক‌ই নিয়ম চলে আসছে। এক‌ই ভাবে শাসকরা প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। রাজনীতির কূটিল নিয়মে সাধারণ মানুষ চিরকাল‌ই বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। মহাভারতের মহাযুদ্ধ, যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে গোটা আর্যাবর্তের প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তিকেই দাঁড় পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, সেই যুদ্ধ‌ও কিন্তু রাজনীতির এই চিরাচরিত নিয়ম বদলাতে পারেনি। আর্যাবর্তের বুকে সেই সময় সৃষ্টি হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। আর তখন থেকেই শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সাম্যবাদের অসম লড়াই। সত্যি বলতে কোথায় এই লড়াইয়ের শুরু আর কোথায় শেষ, তা হয়তো আজ আমাদের পক্ষে আন্দাজ করাও অসম্ভব। তাই এইসব ঘটনা থেকে আমরা শুধুই জীবনে ঠিকভাবে চলার প্রেরণা লাভ করতে পারি। আর সম্মান জানাতে পারি সেইসব প্রাচীন শিক্ষকদের, যাঁরা কয়েক হাজার বছর আগে আমাদের দিয়ে গেছেন জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ উপদেশাবলী।





অথচ রাজারা কি করলেন? উপরোক্ত ব্যাখ্যাটি গোপন রেখে, শুধুমাত্র শ্লোকের আক্ষরিক অর্থটি জনগণের সামনে পেশ করে দেবতার স্থানে বসলেন।
2

প্রাচীন কথা - ঋত্বিক ঘটক আর সৌহার্দ‍্য সেন

Posted in


এক শূদ্রাণীর জারজ সন্তানের জ্ঞানের কাছে হেরে যাচ্ছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবতা স্বয়ং, মহাভারত রচনার এই গল্পটি কোনও অজ্ঞাত কবির সংযোজন হলেও এই রূপকটির গুরুত্ব মহাভারতের পাঠকদের জন‍্য অপরীসিম। মহাভারতের মধ‍্যে লুকিয়ে থাকা আট হাজার ব‍্যসকূটের কথা ছেড়ে দিলেও যা পরে থাকে তা পাঠককে বারংবার ভাবায়, প্রতিবার পড়ার সাথে সাথেই যেন বদলে যায় পঞ্চমবেদ। এর চরিত্রগুলিও ক্রমশ অলৌকি্কত্ব ছেড়ে মানবিক হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। হয়তো তাই মহাভারতের আদিকবি নিজেই বলে গিয়েছেন ‘ন‍্য মনুষাৎ শ্রেষ্টতর হি কিঞ্চৎ’ অর্থাৎ মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই নেই।

ভারতের যুগযুগ থেকে চলে আসা গল্প-উপকথাগুলির এক অনবদ‍্য সঙ্কলন এই মহাকাব‍্য, বিভিন্ন সময় মহাভারতের বিভিন্ন অজ্ঞাত কবি ব‍্যস নামের আড়ালে এই গ্রন্থটির শ্রীবৃদ্ধি করে গেছেন। শ্রদ্ধেয় লেখক রাজশেখর বসুর মতে মহাভারতেকে পঞ্চমবেদ বলা হলেও এটি আসলে সংহিতা। উনি মহাভারতকে তৎকালিন সমাজ, ধর্ম, অর্থ ও বিচারব‍্যবস্থার জীবন্ত ইতিহাস বর্ণনা করে প্রত্নবিদদের অধ‍্যয়নের বিষয় বলতেও দ্বিধা করেননি। মহাভারত সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবিগুরুও বলেছেন- ‘ইহা কোনো ব‍্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহ একটি জাতির স্বতস্ফূর্ত স্বাভাবিক ইতিহাস’। তাই এখানে আমরাও চেষ্টা করেছি মহাভারতকে অলৌকিকত্বের বাইরে গিয়ে যথাসম্ভব মানবিক দৃষ্টিতে দেখার। মহাভারতে লৌকিক ও অলৌকিক ঘটনাগুলি ও বিভিন্ন রূপক এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তার মধ‍্যে থেকে আসল ঘটনাগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টাটা বেশ কঠিন হওয়ায় সমসাময়িক আরও কিছু পুরাণ ও কাব‍্যের সহায়তা নিতে হয়েছে। রূপকের আড়ালের অর্থ বুঝে মূল রচনাটিকে বার্ডস আই ভিউ থেকে দেখার চেষ্টায় হয়তো কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি থেকে যেতে পারে যার জন‍্য অগ্রীম ক্ষমাপ্রার্থী আমরা।


সমাজপর্ব:

মহাভারতের সময়ের সমাজ পর্যালোচনা করার জন‍্য আমাদের শুধু মহাভারত না, তার সাথে সমকালীন অন‍্য গ্রন্থগুলি যেমন ভাগবত পুরাণ, বৈবস্বত পুরাণ ও মহাভারতের অংশ বলে স্বীকৃত হরিবংশ পুরাণ-সহ আরও কিছু গ্রন্থের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সে যুগে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত ছিলো, কিন্তু তখনকার ব্রাহ্মণ্যবাদ আর আমাদের এখনকার ব্রহ্মণ্যবাদের ধারণা আদৌ এক ছিলো কি? নাকি মহাভারতের সময়ের সমাজ আমাদের ধারণার চেয়ে অনেকবেশি উদার ও আধুনিক ছিলো? পাঠক হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু ঘটনা আমাদের ফিরে দেখা আবশ‍্যক।

শ্রুতি নামক ঘন্টটির মধ‍্যে থেকে যখন ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ মন্ত্রাংশগুলি নিয়ে ঋক, গেয় অংশগুলি নিয়ে সাম, যজ্ঞপদ্ধতি এবং আহূতির মন্ত্রগুলি নিয়ে যর্জু আর অবশিষ্ট মারণ, উচাটন, বিভিন্ন অভিচার, আচার এবং রাজধর্মের খুঁটিনাটিগুলি নিয়ে অথর্ববেদ ভাগ করলেন তখন তিনি চেয়েছিলেন বেদ সর্বসাধারণের জন‍্য হোক। মহাভারতের ভারত মনুমহারাজের কাম‍্য ভারতের চেয়ে ছিলো বেশ কিছুটা আলাদা। মনুমহারাজের আদেশানুসারে যে ব্রাহ্মণ শূদ্রের অধররস(বৃষলীফেন) পান করেছে বা তার গর্ভে সন্তান উৎপন্ন করেছে সহস্র প্রায়শ্চিত্তেও তার পাপমুক্তি নেই। শূদ্রাণীর গর্ভে নিজ জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করার সময়েই যেন মহাভারতের আদিকবি বুঝিয়ে দিয়েছেন তার এই গ্রন্থে তিনি অনেক অচলায়তন ভাঙ্গতে চলেছেন। পরবর্তিতে এমন আরও অনেক ঘটনা আমাদের সামনে আসবে যেখানে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ‍্য করে কবি বর্ণাশ্রমের এক সম্পূর্ণ নূতন সংজ্ঞা দিয়েছেন। আদিকবির মধ‍্যে ঋষি পরাশরের সাগ্নিক ঋষিসুলভ প্রাজ্ঞতার পাশাপাশি শূদ্রা জননীর সমাজভয়, বেদহীনতার আক্ষেপ মিশে গেছে বলেই হয়তো তিনি এত মানবিকভাবে লিখতে পেরেছেন তাঁর পঞ্চমবেদ। যে বেদে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার।

বেদকে বিভাজন করার পর যখন চার প্রিয় শিষ‍্যকে চর্তুবেদ দান করলেন ব‍্যস তখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি সরাসরি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করা কিন্তু তাঁর নিজস্ব পঞ্চমবেদের ক্ষেত্রে তিনি নিয়ম শিথিল করলেন। ব্রাহ্মণদের একে বারে অগ্রাহ‍্য করার সাহস না দেখিয়েও নারী ও শূদ্রদের দিলেন পাঠ ও শ্রবণের অধিকার। নিজের জন্মের মধ‍্যে কৌলিন‍্য না থাকায় ব‍্যস বারবার প্রশ্ন তুলেছেন প্রকৃত ব্রাহ্মন কে? আর তার উত্তর ও তিনি নিজেই বলে গেছেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চরিত্রের মধ‍্য দিয়ে। মহাভারতের কবি জানতেন ভবিষ‍্যৎ বারংবার প্রশ্ন তুলবে সমাজব‍্যবস্থার এই বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে তাই তিনি বারবার বিভিন্ন জায়গায় এর উত্তরে বলেছেন ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না, তার জন‍্য প্রয়োজন ব্রাহ্মণের গুণ- আত্মত‍্যাগ, দয়া, ধর্ম ও চরিত্র। লক্ষণীয় যে এইসব প্রশ্নগুলি এসেছে মহাভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাথে জড়িয়ে, যেখানে মিথ‍্যাচারের অবকাশ নেই। ধরা যাক, বকযক্ষরূপ ধর্মের সাথে যুধিষ্ঠিরের কথোপকথন। মৃত চারভাই এর জীবন বাঁচাতে তাঁকে যে প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হতে হয়েছিলো সেগুলি আসলে সেই সময়কার সমাজে বারবার ওঠা প্রশ্নগুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। তার সাথে এও লক্ষ‍ণীয় যে ধর্ম স্বয়ং শত্রুর ছদ্মবেশে নিজপুত্রের পরীক্ষা নিচ্ছেন, যে পুত্র আবার স্বয়ং ধর্মরাজ‍্য স্থাপন করবেন ভবিষ‍্যতে। এখানে যেন ভবিষ‍্যতের সম্রাট সমাজের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন এবং তার উত্তরের ওপর নির্ভর করছে তাঁর ভাইদের জীবন তথা ভবিষ‍্যৎ ধর্মরাজ‍্য স্থাপনের স্বপ্ন। মহাভারতের এই পর্বেই যক্ষ প্রশ্ন করছেন যে বংশ, চরিত্র, বেদপাঠ নাকি গুরুর থেকে পাওয়া বেদার্থবোধ কোনটি দিয়ে ব্রাহ্মণত্বের নির্ণয় হবে? যার উত্তরে ধর্মপুত্র বলেন বংশ নয়, কুল নয়, নিয়ত বেদ পাঠ বা বা সদগুরুর বেদার্থ ব‍্যখ‍্যা শুনেও প্রকৃত ব্রাহ্মণত্ব লাভ হয় না। ব্রাহ্মণত্ব তৈরি করে সদগুণ এবং চরিত্র। এখানেই মহাভারতের কবি যেন ঠিক করে দিলেন ভবিষ‍্যত ধর্মরাজ‍্যে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ ছড়িয়ে পরবে তার আধারগুলি কেমন হবে। যে ব্রাহ্মণ সবার অনুকরণীয় হবে তার সম্পর্কে যুধিষ্ঠিরের জবানীতেই বলেছেন-‘চর্তুবেদাপি দুর্বৃত্তঃ স শূদ্রাদ অতিরিয‍্যতে’, অর্থাৎ চর্তুবেদ পড়ার পরেও যে ব্রাহ্মন দুবৃত্ত,দুঃশ্চরিত্র সে শূদ্রেরও অধম। এই জটিল প্রশ্নের স্বীকৃত উত্তর দিয়েছেন মহাভারতের কবি আরও অনেক পরে, মহাযুদ্ধের শেষে। শান্তিপর্বের ভৃগু-ভরদ্বাজ সংবাদের মাধ‍্যমে ব‍্যাস ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছেন ব্রাহ্মণত্ব আর চর্তুবর্ণের। উল্লেখ‍্য ভার্গবরা চিরকাল প্রশ্ন করে এসেছেন বেদ ও তার চিরাচরিত মতগুলিকে। এখানে প্রশ্নকর্তার ভূমিকায় দুর্বিণিত ভৃগুকে বসিয়ে ব্রাহ্মণ ও ঋষিশ্রেষ্ঠ ভরদ্বাজের জবানীতে সমাজের প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছেন ব‍্যাস স্বয়ং। বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের উত্তরে ধর্ম সন্তুষ্ট হলেও ব‍্যস সন্তুষ্ট হননি তা পরিষ্কার হয়ে যায় মহর্ষি ভৃগুর প্রশ্নগুলিতেই।ভৃগু প্রথম প্রশ্নেই বলছেন, বর্ণের ভিত্তিতে যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়াদি বিভাগ তা অত‍্যন্ত বিপদজনক কারণ সংকর বিবাহ আকছার ঘটছে এবং একবর্ণ আরেক বর্ণের সাথে মিশে যাচ্ছে- ‘সর্বেষাং খলু বর্নানাং দৃশ‍্যতে বর্নশঙ্করঃ’, তাহলে এসব ক্ষেত্রে জাতি কিভাবে নির্ধারিত হবে। নিজ জন্মকথা মাথায় রেখে ব‍্যস যে এরকম প্রশ্ন তুলবেন তা অতি স্বাভাবিক, যাঁর উত্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদের সবচেয়ে বড় প্রচারক ঋষি ভরদ্বাজ অবধি স্বীকার করতে বাধ‍্য হন এভাবে বর্ণ নির্ধারণ করা অদপেই সম্ভব নয়, কাজকর্ম, সংস্কার, বৃত্তি, পাল্টে ব্রাম্ভন প্রয়োজনে ক্ষত্রিয়, বৈশ‍্য এমনকি শূদ্রও হয়ে যায়। তার্কিক ভৃগুর থেকে এরপরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এসেছে, ব‍্যসের হয়ে ভৃগু জানতে চেয়েছেন এত হলো ব্রাহ্মণের শূদ্রগতি বা জ্ঞাতি ব্রাহ্মনের শূদ্র সংজ্ঞা। একজন ব্রাহ্মণ যে বৃত্তিই গ্রহণ করুক সে নিজের পরিচয় দেবে ব্রাহ্মণ বলেই, এখন একজন শূদ্র কিভাবে ব্রাহ্মণ হবে? ব‍্যসকূটের আক্রমণে বিপর্যস্ত ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণত্বের আবশ‍্যক গুণগুলি বর্ণনা করে বলেন ত‍্যাগ, তিতিক্ষা, ক্ষমা, সত‍্য, দান, অদ্রোহ ও সমদৃষ্টি এই কটি সদগুণ যার মধ‍্যে থাকবে তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ। যদি মানুষটি জাতি জন্মে শূদ্র হন কিন্তু তার মধ‍্যে এই গুণগুলি থাকে এবং ব্রাহ্মণ সন্তানের মধ‍্যে এই গুণগুলি না থাকে তবে শূদ্রজও ব্রাহ্মণ এবং ব্রহ্মজও শূদ্র। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রধান হলেও বর্ণ নির্ধারণের মাপকাঠি ছিলো যোগ‍্যতা। উল্লেখ‍্য ব‍্যস ও বিদূর উভয়েই ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রাণীর গর্ভজাত হলেও একজন ব্রাহ্মণ, অপরজন শূদ্র। পরবর্তিতে ধর্ম ও শিক্ষা পর্বে এই বিষয়ে আরও আলোচনার অবকাশ থাকবে। পরিশেষে এই সকল ঘটনার আগে স্বয়ং মহাভারতের ভগবান বাসুদেব কৃষ্ণ এককথায় সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন- ‘চার্তুবর্ণ ময়া সৃষ্টং গুণ কর্ম বিভাগশ্চঃ’ অর্থাৎ আমি গুণ ও কর্মের বিচারে চর্তুবর্গ সৃষ্টি করেছি। স্বয়ং ভগবানের মুখে এহেন উক্তি প্রমাণ করে মহাভারত ব্রাহ্মণ্যবাদ নয় সমবাদের আদর্শের প্রচারক এবং তৎকালীন সমাজও ছিলো সমবাদের।

মহাভারতের সমাজে রাজার স্থান ছিলো বেদজ্ঞের পরেই। সমাজে ব্রাহ্মণের ক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠলেও রাজার ক্ষমতা ছিলো প্রশ্নাতীত। সর্বত্র রাজতন্ত্র না থাকলেও গোষ্ঠিপতিরাও রাজার তুল‍্য সম্মান পেতেন। মহাভারতের মূলকাহিনি সিংহাসন দখলের দ্বন্দ হওয়ায় সমাজে বিভিন্ন রাজার চরিত্রগুলি ও তার নিরিখে আদর্শ রাজা বা শাষকের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত তার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রাজা ও তার কর্তব‍্যের বিষয়ে আমরা প্রথম উল্লেখ পাই পাণ্ডবদের পণ্ডিত ধৌমের মুখে। এই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ জতুগৃহ দাহের পর থেকেই পাণ্ডবদের সঙ্গী এবং সুখ-দুঃখে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন তাদের।

ইন্দ্রপ্রস্থে অভিষেকের পরেই নারদাদী ঋষিরা যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞের পরামর্শ দিলে ধৌম‍্য যুধিষ্ঠিরকে মনে করিয়ে দেন রাজ‍্য সদ‍্য স্থাপিত তাই রাজার উচিত এখন প্রজাপালনে মন দেওয়া। যজ্ঞ ও দেবসেবা রাজধর্ম হলেও রাজার প্রাথমিক কর্তব‍্য প্রজাপালন। এরথেকে একটা বিষয় মহাভারতের কবি বোঝাতে চেয়েছেন রাজার কাছে প্রজাপালন সবচেয়ে বড় ধর্ম। পরবর্তীতে এই ধৌম্যয় বিরাট পর্বের প্রাক্কালে যধিষ্ঠিরকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তাকে এবার একজন রাজকর্মচারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে যা রাজার ভূমিকার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পর্বে ধৌম‍্য আদর্শ রাজকর্মচারীর চরিত্র ব‍্যখ‍্যা করতে গিয়ে বলেছেন- “ যখন তুমি রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবে তখন প্রথমে তার দ্বারপালের সাথে দেখা করবে, রাজার হাজার প্রিয়পাত্র হলেও কখনও রাজ সমীপে সরাসরি যাবে না। আমিই রাজার প্রিয়পাত্র ভেবে কখনও তাঁর হাতি, ঘোড়া, রথ বা অস্ত্রাদি ব‍্যবহার করবে না। যতক্ষণ না জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে নিজে থেকে কোনও উপদেশ দেবে না। রাজার অন্দরমহলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না এবং রাজার অপছন্দের ব‍্যক্তির থেক দুরে থাকবে। রাজাকে তার মর্যাদা উল্লঙ্ঘন করতে দেখলে নিজেকে জন্মন্ধ মনে করে রাজাকেই সমর্থন করবে। রাজসভায় নির্দিষ্ট আসন ছাড়া যত্রতত্র বসবে না”। এইসব উপদেশ দিয়ে ধৌম‍্য বলেছেন এগুলি যারা পালন করতৈ সক্ষম তারা অযোগ‍্য হলেও নির্বিঘ্নে রাজবাড়িতে বাস করতে সক্ষম।

তখনকার পুরোহিতদের কাজ যে কেবল পৌরহিত‍্য ছিলো না এবং মর্যাদাও পূজারী বামুনের চেয়ে অনেক ওপরে প্রায় মন্ত্রীতুল‍্য ছিল তা এর পরের ঘটনা থেকে আরও পরিষ্কার। তিনি এরপর বলেছেন- “কখনও রাজার সামনে অট্টহাস করবে না, অতিরিক্ত স্তাবকতা করবে না, রাজার কাছে অকারণে দণ্ড পেলেও প্রকাশ‍্যে তার নিন্দা করবে না, রাজাকে অনুশোচনার সুযোগ দেবে”।

এছাড়া তিনি আরও বলেছেন- “রাজার কোনও কাজের জন‍্য উৎকোচ আশা করবে না বা দরিদ্র প্রজার থেকে কখনও ঘুষ নেবে না”। ঘুষ আর কমিশনের মতো প্রথা যে সে যুগেও ছিলো তার প্রমাণ আমরা পরবর্তী পর্বে আবার পাবো।

সেযুগের রাজপ্রাসাদগুলির সৌন্দর্য ও বিশালতার বর্ণনা শুনে সেগুলিকে কেবল রাজার পারিবারিক বাসস্থান বা বিনোদন কেন্দ্র ভাবলে ভুল হবে। স্টাফ কোয়ার্টার, গেস্টহাউস, মাল্টিকিচেন, ক‍্যান্টিন সহ এই রাজপ্রাসাদগুলি আধুনিক মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানীর হেড অফিস বা রাজনৈতিক ভবনগুলির সাথে এর তুলনা করা যেতেই পারে।

লক্ষণীয় অজ্ঞাতবাসের আগে যুধিষ্ঠির ধৌমসহ সকল সাথী ব্রাহ্মনদের দ্রূপদ ও দ্বারকায় গিয়ে তার নাম করে ভরণপোষনের অর্থ ও আশ্রয় নিতে বলেছেন। রাজ‍্য থাক বা না থাক রাজার কর্তব‍্য কি এবং তাদের কর্তব‍্যবোধ কত প্রবল এই ঘটনা তার প্রমাণ। পরবর্তীতে শাসন পর্ব আলোচনার সময় এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ থাকবে ।


মহাভারতের অস্ত্র কথা

সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রত্যেকটি প্রাণী বেঁচে আছে লড়াই করে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই লড়াই আবশ্যক। কালের নিয়মে প্রায় প্রতিটি প্রাণীই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজেকে পরিবর্তণ করেছে, যারা পারেনি, তারাই বিলুপ্তির পথে যাত্রা করেছে।

প্রাণীদেহের পরিবর্তণের সাথে সাথেই, টিকে থাকার লড়াইয়ের‌ও পরিবর্তণ হয়েছে যথেষ্ট। প্রতিটি প্রাণীই নিজ দেহে লড়াই করার উপযুক্ত কিছু অস্ত্র নিয়ে জন্মায়, যেমন বাঘ সিংহ ইত্যাদি বড়ো প্রাণী প্রচুর দৈহিক শক্তি, ধারালো নখ-দাঁত আর প্রবল গতি ব্যবহার করে আত্মরক্ষার খাতিরে, বাজ, চিল, শকুন প্রভৃতি পাখি অসাধারণ দৃষ্টি, শক্ত নখ আর ঠোঁট ব্যবহার করে, তেমন‌ই সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি প্রত্যেকটি প্রাণী কখনও নিজের বিষ, কখনও বা ক্ষীপ্রতা ব্যবহার করে..

মানুষ নামক প্রাণীটি কিন্তু এগুলির প্রায় একটিও পায়নি, সে পেয়েছে ক্ষুরধার একটি মস্তিষ্ক। আর নিজ দেহের এই অংশটি ব্যবহার করেই সে হয়ে উঠেছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম প্রাণী। অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকতে সে প্রাকৃতিক সম্পদকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে শিখে নিয়েছে।

সে ধারালো নোখ বা দাঁত পায়নি, তাই ছোট পাথর ভেঙে বানিয়ে নিয়েছে ধারালো অস্ত্র, ক্ষিপ্রতার অভাব মিটিয়েছে চাকা, ও তারপর চাকা চালিত গাড়ি ব্যবহার করে, পাশবিক ক্ষমতা নেই তার, কিন্তু আছে মানবিক বুদ্ধিমত্তা, তাই মানুষ পাহাড়ের উপর থেকে বড়ো পাথর ঠেলে দিয়ে আঘাত করেছে শত্রুকে।

বোঝাই যাচ্ছে যে, লড়াই জিনিসটার শুরু কিন্তু আত্মরক্ষার খাতিরে, তা সে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা হোক বা পরবর্তীকালে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের গোষ্ঠীরক্ষার চেষ্টা।

প্রস্তর যুগের শুরু থেকেই গুহাবাসী মানুষ নিজের খাদ্য ও সুরক্ষার জন্যই অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। কিন্তু কালক্রমে গুহাবাসী মানুষ প্রথমে গোষ্ঠীবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হতে শিখেছে, তারা গোষ্ঠীর সুরক্ষায় মনযোগ দেওয়ার পাশাপাশি গোষ্ঠী-বিস্তার ও পরাক্রমশীলতাও রপ্ত করেছে। এক‌ই সঙ্গে বেড়েছে নিজের বা গোষ্ঠীর সম্পত্তি রক্ষার চেষ্টায় অপর গোষ্ঠীর উপর আক্রমণের প্রবণতা। এই পরাক্রমশীলতা আর খাদ্যের সন্ধানেই মানুষ জন্ম দিয়েছে পাথর বা গাছের ডাল ভেঙে তৈরি ছোট বড়ো ধারালো অস্ত্রের। মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকলে তার তৈরি হাতিয়ারের‌ও উন্নতি হতে লাগলো।

কালক্রমে মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে বিস্তর।‌ তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা হাতিয়ারের মতো প্রায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসেও নিজেদের বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং কলার পরিচয় রাখে। অস্ত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র বুদ্ধি, শিল্প বা ক্ষমতাই প্রকাশ পায় না, এগুলি নির্দিষ্ট সময়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার‌ও পরিচায়ক। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর তৈরি অস্ত্রশস্ত্র ওই জনগোষ্ঠীর বিজ্ঞান চর্চা, প্রযুক্তি, চারুবিদ্যা, এমনকি সামরিক ইতিহাসেরও পরিচয় বহন করে।

খুব সাধারণ নিয়মেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ তার বাসস্থানের আশপাশ থেকেই হাতিয়ার তৈরির‌ উপকরণ সংগ্রহ করে, তাই প্রতিটি অঞ্চলে তথা দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের অস্ত্র শস্ত্র তৈরি হয়েছে। এমনকি বড়ো দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ঘরানার হাতিয়ার পাওয়া যায়। এখানে আমরা আলোচনা করবো মহাভারতে উল্লিখিত অঞ্চলগুলিতে ওই সময় উপলব্ধ ও ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলি সম্বন্ধে।

বিশাল এই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচুর ছোট বড়ো আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস ছিল, এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় বেশ কিছু বৈদেশিক জনগোষ্ঠী এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। ফলে এই ভূখণ্ডের প্রায় সমস্ত অংশেই বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা কারণে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত এমনকি রাষ্ট্রগত দ্বন্দ্ব যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। ভারতীয়দের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র শুধুমাত্র যুদ্ধ বা আত্মরক্ষার ভূমিকাই নেয় না, এখানকার বহু আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার আচরণেও হাতিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করে। ভারতের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যেই হাতিয়ার পূজার প্রচলন আছে।

যেমন, শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃপাণ বহন ও পূজার প্রচলন সর্বজনবিদিত, ভীল জাতির মধ্যে প্রচলিত‌ বিভিন্ন উৎসবে তাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত অস্ত্র টাঙ্গি পুজো করা হয়, দশেরা উৎসবের প্রধান আকর্ষণ রাবণ দহনের আগে তীর ধনুক পূজার প্রচলন আছে, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের কিছু কিছু অঞ্চলে খড়্গ বন্দনা প্রসিদ্ধ। অথচ ভারতের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গবেষণার ক্ষেত্রে অস্ত্র বিষয়ক গবেষণা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় ব্রাত্য থেকে গেছে!

কয়েকটা মাত্র ব‌ইতে খ্রীষ্টের জন্মের আগের ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তাও নামমাত্র।

তাই পুরাতাত্ত্বিক ভারতের অস্ত্র নিয়ে জানতে গেলে প্রথমেই স্মরণাপন্ন হতে হয় বিভিন্ন পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি ব‌ইগুলির উপর। তথ্যসন্ধানে সমস্যা বেড়েছে এই ব‌ইগুলোর বেশিটাই কবিতাধর্মী হ‌ওয়ায়। কবিরা কাব্য করেন, আর আলোচক আলোচনা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আলোচকে কাব্য করলে যে কি ভয়াবহ জিনিস হয় তা আজকের দিনে সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে কারো অজানা নয়, কিন্তু আরো বড়ো সমস্যা তখনই হয়, যখন কবি চান কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে! তাঁদের সৃষ্টিশীল কলমের খোঁচায় অতি সাধারণ ঘটনাও হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় কোনও ঘটনা! ফলায় আগুন জ্বালানো সাধারণ তীর হয়ে ওঠে "অগ্নি বর্ষণকারী দৈব কালদণ্ড!" আসল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে বছরের পর বছর আমরা নিজেদের সুবিধা, পছন্দ বা স্বার্থ অনুযায়ী এই ব‌ইগুলির কাহিনী লিখে চলেছি, হ্যাঁ, যেমন এই ব‌ইটি লেখা হচ্ছে তেমন‌ই..

ফলে প্রতিটি ঘটনা, চরিত্র বা বস্তুর আসল বর্ণনা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। বদলে তার উপর জমেছে অতিরঞ্জনের ধুলো। বাঙালীরা কথায় কথায় বলেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল! অথচ এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা যে মহাভারতগুলো পড়তে পাই, সেগুলো এতটাই অশুদ্ধ, যে পুনর্বার অশুদ্ধির ক্ষমতা আমাদের নেই হয়তো! সেই অশুদ্ধির পাহাড় খুঁড়ে উদ্ধার করা তথ্যগুলি যতটুকু সম্ভব লৌকিক উপায়ে উপস্থাপন করাই আমাদের লক্ষ্য। তাই আমরা মহাভারতের অস্ত্রাদির কথা বলতে গিয়ে, দিব্যাস্ত্রের দিব্য বিবরণ এড়িয়ে গেছি, তাকে বাস্তবের মাটিতে ফেলে নতুনভাবে তাদের বর্ণনা করতে চেষ্টা করেছি।

পৌরাণিক মতামতকে সমর্থন করলে মহাভারত যে সময়ের ঘটনা বলে ধারণা করা হয়, বিজ্ঞান বলে সেই সময় লাঠি, জীবদের আর পাথর ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে মানুষের অস্ত্র তৈরি হ‌ওয়া প্রায় অসম্ভব! কিন্তু এই ধারণা মেনে নিলে মহাভারতের প্রায় প্রতিটি ছোট বড়ো যোদ্ধার হাতে লাঠিসোঁটা ধরাতে হয়, তাহলে আবার গোটা গল্পটাই পাল্টে যায়! তাই অতবড়ো ঝুঁকি না নিয়ে আমি ধরে নিলাম, লোহা আবিস্কারের পরপরই এই ঘটনা ঘটেছে। তখনও অবশ্য পাথর, গাছের ডাল বা জীবদেহকে অস্ত্র রূপে ব্যবহার করার প্রথা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। গাছের ডাল ভেঙে বা শক্ত, ছোট কোনও গাছ মূলশুদ্ধ উপড়ে নিয়ে কাছাকাছি অবস্থিত শত্রুকে প্রতিহত করা যেত। মহাভারতের আদিপর্বে এ ধরনের যুদ্ধকে "বৃক্ষ যুদ্ধ" বলা হয়েছে। মহাভারতে বারবার এই ধরনের যুদ্ধ পদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায়। তুলনামূলক বলশালী যোদ্ধারা এই যুদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। ভীম, বলরামের মতো যোদ্ধা এই ধরণের যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। হিড়িম্ব বধকালে বা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর থেকে ফেরার সময় ভীমকে এইভাবে গাছের ডাল বা গাছ উপড়ে নিয়ে যুদ্ধ করতে দেখা যায়।

কিন্তু এই গাছ বা ডাল তো ছুঁড়ে মেরে শত্রুকে ভালো মতো কাবু করা যায় না, তাই মানুষ ক্ষেপণযোগ্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো ছোট-বড়ো পাথর। অর্থাৎ মানুষের ব্যবহৃত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র এই পাথর।

মহাভারতে বহুবার পাথর ছুঁড়ে যুদ্ধের বর্ণনা আছে। আমরা মহাভারতে প্রস্তর, শিলা, উপল, লোষ্ট্র প্রভৃতি নামে পাথরের তৈরি নানা অস্ত্রের উল্লেখ পাই। দ্রোণপর্বে উল্লিখিত অশ্মগুড় নামক এক অস্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বলেন, এটি একটি গোলাকার পাথর, যা দিয়ে বিপক্ষের হাড়(অশ্ম) গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল।

খাণ্ডবদহন কালে কৃষ্ণার্জুন ও ইন্দ্রের যুদ্ধের সময় ইন্দ্র অর্জুনকে বিশালাকার পাথর ছুঁড়ে মারেন বলে কথিত আছে।

তবে শুধু হাত দিয়ে পাথর ছুঁড়েই যুদ্ধ হতো এমনটাও না। ওই সময়ের মানুষ পাথরকে ভেঙে বা ঘষে ছুঁচালো করে ছুরি বা ক্ষুর হিসেবেও ব্যবহার করতো। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ছোট ও ছুঁচালো পাথর কে তীর বা বল্লমের বলা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নল, কঞ্চি প্রভৃতি ঋজু, শক্ত অথচ হালকা ডালের মাথায় ছুঁচলো ও ছোট পাথরের তৈরি ফলক লাগিয়ে তীর ও তুলনামূলক মোটা বাঁশের মাথায় ছুঁচলো ও বড়ো পাথরের ফলা লাগিয়ে বানানো হতো বল্লম, বর্শা বা হার্পুণ জাতীয় অস্ত্র।

কচ-গ্রহ-বিক্ষেপ - কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রস্তুতির বর্ণনায় এই শস্ত্রটির কথা বলা হয়। বর্ণনা থেকে মনে হয় বাঁশ বা ধাতুর ছোট লাঠির মাথায় প্রাণীর স্নায়ু বা পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা মারাত্মক আঠার পিণ্ড। এটি শত্রুর চুলে আটকে টেনে দিলে মাথার চামড়া সহ উঠে আসতে পারে! সাধারণত ঘোড়সওয়ার, সারথী প্রমুখ এটি ব্যবহার করতেন।

প্রাস- এটিকে আধুনিক ল্যাসোর‌ই মহাভারতীয় প্রতিরূপ বলা যায়। প্রাস তৈরি হত, পাটের দড়ি বা প্রাণীর স্নায়ু দিয়ে। এটি ছুঁড়ে শত্রুকে সহজেই ধরাশায়ী করা যেত।

এছাড়াও, বালি, জল, ঝোলাগুড় এমনকি নষ্ট হয়ে যাওয়া অস্ত্রের ধাতু পর্যন্ত গলিয়ে ছোঁড়া হতো শত্রুর গায়ে! এসব গলিয়ে ছোঁড়ার জন্য কুরুক্ষেত্রের ময়দানে প্রচুর বড়ো বড়ো হাঁড়ি, কড়া, হাতা প্রভৃতি জড়ো করা হয়েছিল। এই সময় আধুনিক স্মোক বম্বের মতো ধুনো জ্বেলে শত্রুকে তাড়ানোর কাজের‌ও উল্লেখ পাওয়া যায়।

পাথর বা গাছের ডাল দিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তৈরির সময়‌ই মানুষ তার সৃষ্টির ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করে, আগুন।

তারা বুঝতে শেখে, অন্যান্য যে কোনও প্রাণী আগুনকে ভয় পায়। ফলে তারা আগুন ব্যবহার করে হিংস্র প্রাণীদের দূরে রাখা বা আক্রমণ করার কৌশল অবলম্বন করে। পরবর্তীতে শুধু বন্যপ্রাণী নয়, অপর মানব শত্রুকেও আক্রমণ করতে আগুনের‌ ব্যবহার শুরু হয়।

লাঠির মাথায় আগুন জ্বেলে বিপক্ষকে ভয় দেখানো বা আক্রমণ করা, দুটো কাজ‌ই করা যেত। ভীষ্ম পর্বে অগ্নিদণ্ড নামক একটি অস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও দ্রোণ ও‌ শল্যপর্বে অলাতচক্র নামক একটি অস্ত্রের উল্লেখ করা হয়। আদতে এটি দিয়ে বিপক্ষের তাড়নকার্য‌ই করা হতো। কারণ এর গঠন বর্ণনা দেখলে বোঝা যায়, আক্রমণ সহায়ক অস্ত্র হিসেবে এটি বেশ দুর্বল। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্রী বলেছেন, একটি লাঠির দুদিকে আগুন জ্বেলে ঘোরানো হতো, তাতে যে অগ্নিগোলক তৈরী হতো, সেটিই অলাতচক্র।

আজ‌ও বেশ কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অলাতচক্রের ব্যবহার দেখা যায়।

প্রাচীন কালে শুধু লাঠির মাথায় আগুন জ্বেলেই তা ব্যবহার হতো এমন কিন্তু না। বিভিন্ন দাহ্য পদার্থে আগুন জ্বালিয়ে, তা‌‌ শত্রুর দিকে ছুঁড়ে মারা হত মাঝেমধ্যে। গন্ধক, কাঠকয়লা, গালা, লাক্ষা, বিভিন্ন দাহ্য তেল ইত্যাদি এই কাজে ব্যবহার করা হতো। জতুগৃহে পাণ্ডব র পুড়িয়ে মারার জন্য ঘর তৈরির সময় লাক্ষা, গালা ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়েছিল।

এরপর বলতে হয় তীর জাতীয় অস্ত্রের কথা, যা আবিস্কারের পর আগুন জ্বেলে তা দূরে ছুঁড়ে দেওয়া বহুগুণে সহজ হয়েছিল। তীরের ফলায় শন, খড় ইত্যাদি, বা দাহ্য তেলে ভেজা ন্যাকড়া জড়িয়ে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে ছোঁড়া হতো দূরে। প্রধানত যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর তাঁবু জ্বালিয়ে দেওয়া বা শত্রু সৈন্যকে পর্যুদস্ত করতে এই পন্থা অবলম্বন করা হতো।

মহাভারতে ভার্গবাস্ত্র, ব্রহ্মশির, ব্রহ্মাস্ত্র, উল্কা ইত্যাদি অস্ত্রের সাধারণ বর্ণনা থেকে এদের আগুন যুক্ত তীর বলেই মনে হয়।

আগুনের পর মানুষের আরেকটি কৃতিত্ব ছিল খনিজ ধাতুর আবিষ্কার। সম্ভবত মাটি খুঁড়ে চাষাবাদ করতে গিয়েই প্রথম খনিজ ধাতুর সন্ধান পায় আদিম মানুষ।

তাদের প্রথম আবিষ্কৃত ধাতু ছিল তামা। তবে তামা জিনিসটা খুব একটা সহজলভ্য আর শক্ত আর না হ‌ওয়ায়, তামার অস্ত্রের প্রচলন বেশ কম ছিল। ছুরি, জাঁতি জাতীয় ছোট ছোট অস্ত্রে তামার ব্যবহার থাকলেও যুদ্ধাস্ত্রে এর ব্যবহার সেরকম ছিল না।

তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের যোদ্ধাদের তামার তৈরী বর্ম, মুকুট বা অলঙ্কার পরতে দেখা যেত, মহাভারতে তামার তৈরি বাসনের উল্লেখ ও পাওয়া যায়। 

বনপর্বে ধৌম্য দ্রৌপদীকে তামার হাঁড়ি উপহার দেন।

আমার অনুমান কর্ণের বর্ম এবং কুণ্ডল ও তামার তৈরি ছিল। এই তিনটি বস্তুকেই সূর্যদত্ত বলা হলেও তামার সপক্ষে কিছু যুক্তি দেওয়াই যায়। সম্ভবত প্রাচীন মানুষ তামার মতো দুষ্প্রাপ্য ধাতু সম্পর্কে বিশেষ অবগত ছিল না, আর এই হাঁড়ি, বর্ম ও‌ কুণ্ডল যেহেতু সূর্যের আলোয় চকমক করতো, সেইহেতু ওগুলি সূর্যের বরপ্রাপ্ত বলে মনে করা হতো।

তামা দিয়ে শক্ত অস্ত্র বানাতে বিফল মানুষ কিছুকালের মধ্যেই বুঝলো, ওই ধাতুর সঙ্গে টিন মেশালে কাঁসা তৈরি করা সম্ভব, যা তুলনামূলক শক্তিশালী। এই কাঁসা দিয়েও সম্ভ্রান্ত পরিবারের গয়না, বাসন ইত্যাদি তৈরি হতো। তবে খুব বেশি শক্তিশালী না হ‌ওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে কাঁসা খুব কম ব্যবহার করা হতো।

ঘটোৎকচের বর্ণনায় দেখা যায়, সে কাঁসার তৈরি বর্ম ব্যবহার করতো।

যেকোনও রকম অস্ত্রশস্ত্রের ইতিহাস আমূল বদলে দেয় লোহার আবিষ্কার। প্রথম দিকে শুধু লোহা দিয়েই অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতো, পরে লোহার সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে ইস্পাত তৈরি করা হয়।

লোহা বা ইস্পাতের তৈরি হাতিয়ার গুলি কে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়- (১) ভোঁতা শস্ত্র, (২) ধারালো শস্ত্র ,আর (৩) ধারালো অস্ত্র।

১) ভোঁতা শস্ত্র- এই শ্রেণীর শস্ত্র ব্যবহার করে বিপক্ষকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা যেত। শত্রুর হাড় ভেঙে দেওয়া বা গভীর শারীরিক ক্ষতিসাধনে এই ধরণের শস্ত্র বিশেষ কার্যকরী ছিল।

গদা- মহাভারতে তীর ধনুকের পর‌ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার বোধহয় এই গদা। সাধারণত গোল, চৌকো বা শাঙ্কবাকার মাথা ও সরু হাতল বিশিষ্ট শস্ত্রই গদা নামে পরিচিত ছিল। ধরার সুবিধার জন্য‌ এর হাতলে পাটের সুতো জড়ানো‌ হতো। এর দৈর্ঘ্য মোটামুটি দেড় থেকে দুই হাত হতো। প্রচণ্ড ভারী হ‌‌ওয়ায় শক্তিশালী যোদ্ধা ছাড়া কেউ গদার ব্যবহার করতেন না।

সাধারণত লোহা দিয়ে তৈরি এই শস্ত্রের মাথা ছিল বর্তুলাকার। এর মাথায় বেশ শক্ত ও ছুঁচলো কিছু ধাতব কাঁটা লাগানো‌ থাকতো।

উদ্যোগ পর্বে ভুশুণ্ডি নামক একপ্রকার অষ্টভূজাকার মাথা বিশিষ্ট গদার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও, দ্রোণপর্বে অস্থিসন্ধি নামক একপ্রকার গদা দেখা যায়। শত্রুর হাড় ভেঙে দেওয়ার কাজে এই গদা ব্যবহার করা হতো।

মহাভারত সহ, প্রায় সমস্ত সংষ্কৃত গ্রন্থেই মুষল নামক এক প্রকার গদার উল্লেখ পাওয়া যায়, হামান-দিস্তার দণ্ডের মতো দেখতে তুলনামূলক হালকা এই গদা যদু-বৃষ্ণীদের বেশী ব্যবহার করতে দেখা যায়।

যুদ্ধ প্রস্তুতি, ব্যায়াম ইত্যাদি কাজে মুদ্গর নামক একপ্রকার গদার ব্যবহার করা হত। নীম্নশ্রেণীর যোদ্ধারা এই গদা যুদ্ধক্ষেত্রেও ব্যবহার করতেন। সম্ভবত আজকের মুগুর এই মুদ্গরের‌ই রূপান্তর।

দ্রেণপর্ব ও কর্ণপর্বে পরিঘ নামের এক গদার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, ভারী ও মোটা এই গদার মাথা ছিল ছুঁচলো।

২) ধারালো শস্ত্র- এই তীক্ষ্ণধার হাতিয়ারগুলি সাধারণত হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত করে বা সজোরে খোঁচা দিয়ে আঘাত করে বিপক্ষের শরীরের কোনো‌ অংশ ছেদন করতে ব্যবহৃত হতো। দূর ও‌ নিকট দুই যুদ্ধেই এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হলেও, নিকট যুদ্ধে এগুলি ছিল অমোঘ। এই শ্রেণীর অস্ত্র ও শস্ত্র আলাদা করে বর্ণনা করা হলো-

তীক্ষ্ণ ধার শস্ত্রের কথা বললে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে তরোয়ালের কথা। কাঠ বা লোহার হাতলের মাথায় লাগানো লম্বা লোহা বা ইস্পাতের পাতকে তরোয়াল বলা হয়। অবশ্য বাঁকা, সরু, মোটা, ছুঁচলো, চ‌ওড়া ইত্যাদি নানা ধরণের তরোয়াল দেখা যায়। এই শস্ত্র দিয়ে বিপক্ষের অঙ্গ কেটে ফেলা, খুঁচে দেওয়া বা প্রয়োজনে অস্ত্রের মতো ছুঁড়ে মারাও যেত।

মহাভারতের সময় তরোয়ালের ব্যবহার কিন্তু বেশ কম ছিল। রাজা, সেনাপতি বা বড়ো যোদ্ধা ছাড়া ছোট সৈনিকরা তরোয়াল ব্যবহার করতেন না। মহাভারত প্রভৃতি সংষ্কৃত গ্রন্থগুলিতে তরোয়ালের বিভিন্ন নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন তরবারি, সায়ক, অসি, খড়্গ, কৃপান, নিস্ত্রিংশ, ঋষ্টি, ক্রকচ ইত্যাদি।

সংষ্কৃত গ্রন্থগুলিতে অসির বর্ণনা থেকে জানা‌ যায়, এটি ছিল সোজা, লম্বা, ছুঁচলো‌ ও একদিক ধার বিশিষ্ট ফলা যুক্ত তরোয়াল।

খুব চ‌ওড়া ফলক বিশিষ্ট তরোয়ালগুলি খড়্গ নামে পরিচিত। শান্তিপর্বের ১৬৬তম অধ্যায়ে খড়্গকে উৎপত্তিগত দিক থেকে পবিত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই এক‌ই অধ্যায়ে বিশসন, খড়্গ, বিজয়, ধর্মপাল, তীক্ষ্ণধার প্রভৃতি নামের খড়্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।শান্তিপর্বে নকুল বলেছেন, হাতে খড়্গ থাকলে সে যেকোনও পরাক্রমশালী শত্রুর মোকাবেলা করতে পারে! দ্রোণ পর্বেও খড়্গ ব্যবহারের একুশটি পদ্ধতি ব্যক্ত করা হয়েছে।

ভীষ্ম পর্বে কৃপাণ ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়।

বন, ও দ্রোণপর্বে নিস্ত্রিংশ নামের এক তরোয়াল এর উল্লেখ আছে। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, এই তরোয়ালগুলি লম্বা কুকরির মতো, ফলার ভিতরের অংশ ধারালো।

মহাভারতে ক্রকচ নামক আরেকটি তরোয়ালের উল্লেখ আছে। এই লম্বা ও ঋজু তরোয়াল এর ফলায় করাতের মতো খাঁজকাটা থাকতো।

রণকুঠার- ভারতীয় পুরাণে রণকুঠার বা Battle Axe একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্ত্র। গণেশ, পরশুরাম, কর্ণ প্রমুখ পৌরাণিক চরিত্রের প্রিয় শস্ত্রগুলির মধ্যে রণকুঠার অন্যতম। মহাভারতে রণকুঠারের নাম পাই পরশ্বধ বা পরশু হিসেবে। পরবর্তীতে রণকুঠার আর পরশু আলাদা হয়ে গেলেও, মহাভারতে পরশুর বর্ণনা থেকে তা রণকুঠার বলেই মনে হয়। এর ফলক হতো মোটা, উজ্জ্বল ধার‌ বিশিষ্ট ও অর্ধচন্দ্রাকৃতি। পরশুর ফলক ধাতব হলেও, হাতল কাঠ বা ধাতু যেকোনো উপাদানের‌ই হতে পারতো। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে বলেছেন এটি প্রায় চব্বিশ আঙ্গুল লম্বা লৌহময় ক্ষুরযন্ত্র (ধারালো) বিশেষ।

সম্ভ্রান্ত পরিবারের যোদ্ধারা পরশুর‌ ধাতব হাতল বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য ধাতু, মণিমুক্তা দিয়ে সজ্জিত করতেন। কর্ণ পর্বে কর্ণের ব্যবহৃত পরশুর হাতলে সোনার উপস্থিতি বর্ণনা করা হয়েছে।

শক্তি- মহাভারতীয় সমাজের একটি সহজলভ্য ও জনপ্রিয় শস্ত্র ছিল এই শক্তি। শক্তি কতকটা আধুনিক বল্লম বা বর্শা‌ জাতীয় শস্ত্র। তবে শক্তি শুধুমাত্র শস্ত্র না, অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। শক্তি ছিল লোহার বা কাঠের লম্বা হাতলের মাথায় লোহার ছুঁচলো ফলক লাগানো শস্ত্র। বাঁকা লাঠির জন্য অনেক সময় সাপের মতো বাঁকা শক্তিও দেখা যায়। শক্তি সাধারণত চার থেকে পাঁচ হাত লম্বা হতো। সময়ে সময়ে ধরার সুবিধার জন্য আলাদা করে হাতল‌ও লাগানো হতো। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়, করবীর পাতার ন্যায় ফলা যুক্ত শক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ।

গোরু বা মহিষের শিং-এর তৈরী ফলা লাগানো বর্শাগুলি গোশীর্ষ নামে পরিচিত ছিল।

এছাড়াও মহাভারতে কুপন নামে একপ্রকার ছোট, সম্পূর্ণ লোহার তৈরি বর্শার উল্লেখ আছে, যার দুদিকের মাথাতেই ত্রিকন্টকাকার ফলা‌ লাগানো থাকতো।

কুন্ত- মহাভারতে ছয়দিক বিশিষ্ট কাঁটাওয়ালা ফলক যুক্ত এক ধরনের বল্লমের উল্লেখ আছে, এটাই কুন্ত। সাধারণ শক্তি জাতীয় বল্লমের থেকে বড়ো ও ভারী এই বল্লম পুরোপুরি লোহার তৈরি হতো। পণ্ডিত রাধাগোবিন্দ বসাক বলেছেন, কুন্ত প্রায় ছয়-সাত হাত লম্বা হতো।

শূল- মহাভারতে বহুবার এই শস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। শূল সাধারণত এক, দুই ও তিনটি মুখযুক্ত হতো। এর মধ্যে এক ও তিনটি মুখ‌ওয়ালা শূল সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। শূলগুলি সাধারণত সম্পূর্ণ লোহার তৈরি হতো। কুরুক্ষেত্রে শূল নিয়ে যুদ্ধের বর্ণনা আছে, এ ছাড়াও শিবের হাতে ত্রিশূল দেখা যায়।

তোমর- তোমর নামক শস্ত্রটি সাধারণত ঘোড়সওয়ার, রথী প্রমুখ ব্যবহার করতেন। এই শস্ত্রে একটি ধাতব বা কাঠের দণ্ডের মাথায় ধাতব শিকল দিয়ে বাঁধা থাকতো এক বা একাধিক ধাতব বল। এই বলগুলি অধিকাংশ সময়েই কাঁটা যুক্ত হতো।

ঠিকঠাক পদ্ধতি মেনে ব্যবহার করলে তোমার দিয়ে শত্রুর দেহে ক্ষত ও হাড় ভেঙে দেওয়া, দুটো কাজ‌ই করা যেত।

ভল্ল- মহাভারতে উল্লিখিত ভল্ল নামক শস্ত্রটি নিয়ে বহু পণ্ডিতের মতভেদ রয়েছে, তবে সেগুলিকে একত্র করলে মনে হয়, ভল্ল ছিল ভারী ও চ‌ওড়া ফলক বিশিষ্ট ছোট বল্লম, যা প্রয়োজনে বড়ো ধনুকে লাগিয়ে তীরের মতোও ব্যবহার করা যেত।

ধাত্র- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ণনায় এই ধাত্র-র উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্ণনা থেকে মনে হয়, আধুনিক দা এর পূর্বসূরি ছিল এই ধাত্র। সাধারণত ছোট সৈনিক রা এই শস্ত্রের ব্যবহার করতেন।

৩) ধারালো অস্ত্র- ধারালো শস্ত্র অর্থাৎ ছুঁড়ে মারার উপযুক্ত ধারালো হাতিয়ার মহাভারতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাত্র দুটি ধারালো অস্ত্র একপ্রকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে- তীর ও‌ চক্র।

মহাভারতে তীরের ব্যবহার নিয়ে অনেক গবেষক‌ই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কথায় ওই সময় আর্য্যরা প্রধাণত লাঠি,পাথর ও গদাযুদ্ধ করতো। তীরের ব্যবহার ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে। প্রধানত হড় কিংবা সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে তীরের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।

মহাভারতে তীরের ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ করার প্রচুর কারণ‌ আছে-

ধাতুর তীর প্রায় তিন থেকে চারশো গজ দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। সেখানে প্রতিটি যুদ্ধের শুরুতে দুই তীরন্দাজ পরস্পরের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়ায়; ছুটে গিয়ে প্রণাম করে! আবার তীর লেগে কুরুক্ষেত্রে কারো চোখ নষ্ট হয়নি! যেখানে তীরের ভীড়ে আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে যায়, সেখানে একজন যোদ্ধারাও চোখে তীর গাঁথে না?!

কিন্তু মহাভারতের পরতে পরতে আছে তীরন্দাজির প্রমাণ। তাই আমরা ওই গবেষক দের ধারণার সঙ্গে মহাভারতের প্রচলিত ধারণা মিশিয়ে বলার চেষ্টা করছি।

সাঁওতাল জাতির আবাসস্থল প্রধাণত পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি অঞ্চলে। ড. অতুল সুর‌ পাঞ্চাল রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও সাঁওতাল পরগণার কাছাকাছি এর অবস্থান ছিল। আর এই পাঞ্চালেই জন্মান মহাভারতের সবচাইতে বিখ্যাত অস্ত্রগুরু দ্রোণ। তিনি সম্ভবত ওই আদিবাসীদের থেকেই তীরন্দাজি শিখেছিলেন। তারপর, হস্তিনাপুরে এসে তীরচালনা শেখান সারা ভারতের প্রচুর রাজপুত্রকে। মহাভারতের উল্লেখযোগ্য ছোট বড়ো প্রায় সমস্ত তীরন্দাজ‌ই দ্রোণের শিষ্য, নয়তো তাঁর শিষ্যদের শিষ্য।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ভীষ্ম, পান্ডু বা বিচিত্রবীর্য কিভাবে তীর চালনা শিখলেন?

এর উত্তরে বলা যায়, ভীষ্মের যৌবনকালে সম্ভবত আর্যদের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্পৃহা ততটাও দানা‌ বাঁধেনি, বড়োজোর ছোট ছোট যুদ্ধ করে বা বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা রাজ্য অধিগ্রহণ হয়েছে। ফলে ওই সময় প্রতিটি গোষ্ঠীপতি নিজেকে রাজা‌ বলতে পারতেন। শান্তনুর রাজত্বকালে তাই ইন্দ্র থেকে শুরু করে জেলে, কাঠুরিয়া, নিষাদ পর্যন্ত সব গোষ্ঠীর নেতারাই রাজার সম্মান পেতেন। এই সময় আর্য্যরা ততটা সম্মান ও‌ লাভ করেনি হয়তো। তাই জেলে সম্প্রদায়ের "রাজা‌"র সামনেও আর্য্য রাজ শান্তনু করজোড়ে দাঁড়ান। যাইহোক, খুব সম্ভবত এই সময়ে রাজপুত্ররা স্বচ্ছন্দে আদিবাসী বা অন্য যে কোনও সম্প্রদায়ের যে কোন ব্যক্তির কাছে শিক্ষা লাভ করতে পারতেন। এভাবেই হয়তো ভীষ্ম তীরন্দাজ হয়েছিলেন। আর জেঠুর থেকে অস্ত্র বিদ্যা লাভ করবে ভাইয়ের ছেলেরা.. এ ভাবেই হয়তো পান্ডু বা বিচিত্রবীর্য তীরন্দাজী শেখেন।

কৃষ্ণের কাছে শার্ঙ্গধনু থাকলেও গোটা মহাভারতে তা‌‌ ব্যবহার করতে দেখা যায় না। শার্ঙ্গধনু কয়েকবার ব্যবহার করা হলেও, তা করেছেন বিষ্ণু। আর বিষ্ণু সেই আদিবাসীদের নেতাই ছিলেন।

যাইহোক, এইবার মহাভারতে ব্যবহৃত তীর-ধনুকের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক..

তীর-ধনুক- মানুষের আবিষ্কার করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হাতিয়ার এই তীর। মহাভারতের সময় সবথেকে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হাতিয়ার ছিল এই তীর-ধনুক।

আর্যদের আগমনের আগে থেকেই অবশ্য ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে তীরের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। অন্য যেকোনও গোষ্ঠীর থেকে হড় কিম্বা সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে তীর ধনুকের প্রচলন বহু পুরনো।

প্রথম দিকে লম্বা বা বেঁটে ও সরু লাঠির মাথায় পাথরের ধারালো টুকরো লাগিয়ে তৈরি হতো তীর। পরবর্তীতে ধাতুর আবিষ্কার হলে, প্রধাণত লোহার ছুঁচলো ফলা যুক্ত সম্পূর্ণ লৌহময় তীর বানানো হতে থাকে। তীরের পিছনে পালক, পাতলা কাঠের শাঙ্কবাকার টুকরো বা পরের দিকে ধাতুর পাতলা পাত লাগিয়ে তীরটিকে বাতাসের মধ্যেও অনুভূমিক রাখার উপযুক্ত বানানো হতো। পুচ্ছ-বিহীন তীরগুলি বেশী দূর যেতে পারতো না, তাই এদের ‌নিম্নশ্রেণীর তীর বলা হয়েছে। এগুলি বিশিখ নামে পরিচিত।

মহাভারতে একটি তীর কে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়- ফলক, দণ্ড ও পুচ্ছ।

তীরের ফলক লোহা, হাড়, পাথর বা কাঠের ধারালো টুকরো দিয়ে তৈরি হতো। এই ফলক নানা আকৃতির হতে পারে। মহাভারতে উল্লিখিত তীরগুলি ফলকের আকার ও প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যেমন- 

ভল্ল- ভল্লের ফলকের মতো দেখতে লক লাগানো, অর্ধচন্দ্র- অর্ধেক চাঁদের আকৃতির ফলা, বৎসদন্ত- বাছুরের দাঁতের মতো খাঁজকাটা ফলক, সূচীমুখ- সূচের মতো সরু, ছুঁচলো ফলক, তোমর- ফলকের বদলে থাকতো তোমরের কন্টকাকার গোল অংশটি।

পাথরের ফলা বিশিষ্ট তীরগুলি শিলিমুখ নামে পরিচিত ছিল, আর যেসব তীরের ফলায় শন, শুকনো ঘাস বা তেলে ভেজানো কাপড়ের টুকরো জড়িয়ে আগুন লাগানো হতো, তাদের নাম ছিল অগ্নিমুখ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ফলায় উদ্ভিজ্জ বা প্রাণীজ বিষ মাখানো তীরগুলি‌।

তীরের দণ্ড বাঁশ, নল বা ওই জাতীয় গাছের সরু, হালকা অথচ শক্ত শলাকা দিয়ে বা ধাতু দিয়ে তৈরি হতে পারে। যেসব তীর সম্পূর্ণ লোহার তৈরি, তাদের নাম ছিল নারাচ।

যোদ্ধা রা অনেক তীর নিয়ে যুদ্ধে যেতে, ফলে আধারের প্রয়োজন ও‌ ছিল, এই আধারগুলি তূণ, তূণীর ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। তূণ তৈরী হতো চামড়া, বাঁশ, কাঠ, বা লোহা দিয়ে। অর্জুন, কর্ণ, ভীষ্ম প্রমুখ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির তূণ রত্নখচিত ছিল বলে জানা যায়। তীর ছোঁড়ার জন্য প্রধানতম মাধ্যম ছিল ধনুক। ধনুক তৈরীর বিভিন্ন উপকরণ অনুযায়ী একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়-

চাপ- বেণু জাতীয় নরম অথচ অভঙ্গুর বাঁশ ছুলে তৈরি হতো এই ধনুক।

দারুময়- কাঠের তৈরি ধনুকগুলি এই নামে পরিচিত। সাধারণত চন্দন, শাল প্রভৃতি কাঠে তৈরি হতো এই ধনুক।

শার্ঙ্গ- প্রাণীর শিং দিয়ে তৈরি ধনুক গুলি শার্ঙ্গধনু নামে পরিচিত। সাধারণত বড়ো মহিষ, শরভ, রুরু প্রভৃতি হরিণের শিং দিয়ে তৈরি হতো শার্ঙ্গধনু। এই ধনুক তুলনামূলক ছোট আকৃতির হতো। তীরের দূরত্ব ও অন্য ধনুকে ছোঁড়া তীরের থেকে কম হতো। মহাভারতে কৃষ্ণ, ভগদত্ত প্রমুখ এই ধনুক ব্যবহার করতেন।

এ ছাড়াও নানা প্রাণীর হাড় দিয়েও ধনুক তৈরি হতো। অর্জুন গন্ডারের পাঁজরের হাড় দিয়ে তৈরী ধনুক গাণ্ডীব ব্যবহার করতেন।

পরের দিকে ধাতুর তৈরি ধনুক‌ও ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত কর্ণের ব্যবহৃত বিজয় ধাতব ছিল।

ধনুকের গুণকে বলা হতো জ্যা। মহাভারতে প্রধানত দুই রকম জ্যা এর কথা জানা যায়- পট্টসূত্র ও স্নায়ু।

পট্টসূত্র- পাট, শন প্রভৃতি গাছের পাতলা ও শক্ত আঁশ দিয়ে তৈরি জ্যা পট্টসূত্র নামে পরিচিত।

স্নায়ু- হরিণ, মহিষ প্রভৃতি প্রাণীর স্নায়ু অর্থাৎ নালীকা দিয়ে এই জ্যা তৈরি হতো।

এছাড়াও, চামড়ার ফিঁতে দিয়ে জ্যা তৈরির কথাও জানা যায়।

চক্র- মহাভারতের মহাযুদ্ধ ঘটার যতগুলি প্রধান কারণ আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে চক্র। ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাস ঘাঁটলে চক্রের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু মহাভারতে শুধুমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া কাউকে চক্র ব্যবহার করতে দেখা যায় না। তার মানে কি কৃষ্ণ খুব আধুনিক এবং অসাধারণ কোনও অস্ত্র ব্যবহার করতেন? উত্তর হলো.. না। মহাভারতে কৃষ্ণ ছাড়াও অন্য কয়েকজনের হাতে চক্র দেখা যায়।

হস্তিনাপুরের পশ্চিমি রাজ্যগুলির মধ্যে চক্রের ব্যবহার বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রধানত শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে চক্রের ব্যবহার বিশেষ ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে। তাঁরা এটিকে চক্রম্ নামে অভিহিত করেন। শিখ যোদ্ধারা সাধারণত ছোট আকারের চক্রম্ কোমরে, ও বড়ো চক্রম্গুলি পাগড়ীতে বেঁধে রাখতেন। অভিজ্ঞ যোদ্ধারা বলেন, ঠিকভাবে ছুঁড়তে পারলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও এই অস্ত্র বুমেরাং এর মতো ব্যবহারকারীর কাছে ফিরে আসতে পারে।

এই চক্র বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে, যেমন নিরেট, মাঝখানে ফাঁকা অবলম্বন বিহীন ও মাঝখানে এক বা একাধিক হাতল যুক্ত চক্র।

হাতল যুক্ত চক্রগুলি সাধারণত হাতে ধরে শস্ত্রের মতো ব্যবহার করা হতো। তবে প্রয়োজনে ছুঁড়েও ব্যবহার করতে দেখা যায়।

নিরেট চক্রগুলির মাঝে একটি ফুটো থাকে, এখানে তর্জনী গলিয়ে ধরতে হয়।

তবে সবচাইতে ভয়ঙ্কর হলো মাঝখানে ফাঁকা ও অবলম্বন বিহীন চক্র। বর্তমানে প্রচলিত ছবি ও মূর্তিতে কৃষ্ণের হাতে এই ধরনের চক্র ও নিরেট চক্র, দুটোই দেখা গেলেও, মহাভারতে তাঁর চক্র ব্যবহারের বর্ণনা দেখলে এই হালকা ধাতব পাতের তৈরি অবলম্বন বিহীন চক্রের কথাই মাথায় আসে। এগুলি তর্জনী বা অন্য কোনো একটি আঙুলের চারদিকে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিতে হয়। এগুলি ঠিকভাবে ছুঁড়তে পারলে বিপক্ষের অঙ্গহানী অসম্ভব নয়। আর কাছ থেকে ছুঁড়ে অভিজ্ঞ যোদ্ধা বিপক্ষের গলা কাটতেই পারে, তবে এই অস্ত্র দিয়ে সম্ভবত মুণ্ডচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। এইভাবেই রাজসূয় যজ্ঞের সময় কৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেন।

উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায়, শুধুমাত্র যাদব বীররা বা তাঁদের কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া যোদ্ধারাই যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য চাকা জাতীয় দ্রব্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কৃষ্ণ নিজেও কিন্তু শুধু ধাতব চক্র নিয়েই যুদ্ধ করেননি। ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে কৃষ্ণ হাতে তুলে নেন রথের ভাঙা চাকা।

আসলে চক্র জিনিসটা ডুয়েল জাতীয় স্বল্পদূরত্বের যুদ্ধে কার্যকর হলেও, বড়ো ও বিধ্বংসী যুদ্ধে এ জিনিস একদমই ব্যবহার করা যায় না। তাই নিরস্ত্র শিশুপাল কে চক্র দিয়ে সামনে থেকে হত্যা করলেও, ভীষ্মের বিরুদ্ধে কৃষ্ণের হাতে উঠে আসে রথের চাকা।

শুধু কৃষ্ণ কেন, চক্রব্যুহের মধ্যে বিপদে পড়ে অভিমন্যুকেও ভাঙা রথের চাকা তুলে নিতে দেখা যায়। আর তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই অভিমন্যু কিন্তু পিতা মাতার অনুপস্থিতিতে কৃষ্ণের বাড়িতেই শিক্ষালাভ করেছিলেন।

চক্রব্যুহের কথাই যখন উঠলো, এর সঙ্গে চাকার মিলটা খেয়াল করুন। কুরু সৈন্যের বাইরে যাঁরা এই চক্রব্যুহের ভিতর ঢোকা-বেরোনোর কৌশল‌ জানতেন, তা‍দের অধিকাংশই কোনও না কোনও ভাবে যাদব বংশের সঙ্গে যুক্ত। মহাযোদ্ধা হিসেবে কৃষ্ণ বা তাঁর বন্ধু অর্জুন যে চক্রব্যুহের রহস্য জানবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তুলনামূলক ছোট যোদ্ধা সাত্যকি, শাম্ব এমনকি বালক শিক্ষানবিশ অভিমন্যুও জানতো চক্রব্যুহে প্রবেশের গোপন রহস্য। অর্থাৎ একথা বলাই যায় যে, চক্র জাতীয় অস্ত্র ও যুদ্ধরীতির কৌশল যদুবংশে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় লালিত হয়েছিল।

দিব্যাস্ত্র- মহাভারত তথা প্রায় সমস্ত পৌরাণিক গ্রন্থেই এমন কিছু হাতিয়ারের কথা পাওয়া যায়, যার তথাকথিত প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা বিবরণ কোনোটিই পাওয়া যায় না। সংষ্কৃত গ্রন্থগুলিতে এই অস্ত্রকে 'দিব্যাস্ত্র' বলা হয়েছে। এই হাতিয়ারের প্রয়োগে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটার উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি নিক্ষেপ করার পর নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা প্রতিপক্ষের একসঙ্গে বহু মানুষের শারীরিক ক্ষতিসাধনের বিবরণ দেয় এই গ্রন্থগুলি। মহাভারতের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই কোনও না কোনও দিব্যাস্ত্রের ছোট বড়ো ব্যবহার আছেই। তাই এর উল্লেখ ছাড়া মহাভারতে ব্যবহৃত অস্ত্রের বর্ণনা করা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে দিব্যাস্ত্রের কোনও যুক্তিসঙ্গত মিল পাওয়া যায়নি আজ‌ও। এ ছাড়াও মানুষের সৃষ্টির ইতিহাস ও বিবর্তনের সূত্র খেয়াল করে লৌহযুগে দাঁড়িয়ে মানুষের দিব্যাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে প্রচুর গবেষক সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, গতানুগতিক হাতিয়ারের মাঝে অদ্ভুত ও বিধ্বংসী কোনও অস্ত্র দেখে, তৎকালীন মানুষ সেগুলিকে নিজের মতো কল্পনা করে বর্ণনা করতো। কালক্রমে কবিদের হাতে ইতিহাস লেখার কাজ এলে কাব্য, কল্পনা আর ইতিহাস মিলে দিব্যাস্ত্রের মতো এক অদ্ভুত বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে।

আমরা সেরকমই কিছু দিব্যাস্ত্র ও তাদের বাস্তবায়নের সম্ভাবনার কথা বলবো-

বজ্র- বজ্র ইন্দ্রের অস্ত্র। মহাভারত ও অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থের প্রধানত ইন্দ্রকেই এটা ব্যবহার করতে দেখা গেলেও, ইন্দ্রাণী, চণ্ডী, ঘন্টাকর্ণ প্রমুখ দেবদেবীকে এই অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী বজ্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল, এবং সেই বিদ্যুৎ শত্রুর দিকে ছুঁড়েও দেওয়া যেত। নর্স পুরাণ বর্ণিত বজ্রের দেবতা থরের হাতুড়ির সঙ্গে এর বিশেষ মিল দেখা যায়।

পণ্ডিত হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ বলেন, মহাভারতের আদি, বন ও‌ দ্রোণপর্বে বর্ণিত 'অশনি' নামক অস্ত্রটিই আসলে বজ্রের নামান্তর। বনপর্বে অশনিকে বিদ্যুৎ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে "শতপথ ব্রাহ্মণ" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ইন্দ্র যে বজ্র দিয়ে বৃত্তাসুরকে হত্যা করেন, সেটিতে ১০০০টি কীলক ও ১০০টি কিনারা ছিল।

অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, এই বজ্র বহু ধার বিশিষ্ট বর্শা বা হার্পুণ জাতীয় কোনও প্রকার অস্ত্র ছিল। অধ্যাপক সর্বদমন সিং বলেছেন, বজ্র অস্ত্রটির দেহে অসংখ্য সন্ধি, কিনারা ও খাঁজ ছিল, যা থেকে বোঝা যায়, এই অস্ত্রতির ফলক তৈরি হতো মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণীর হাড় দিয়ে। অধ্যাপক পাটিলের মতে, প্রথম দিকে পাথর, ও পরে হাড় দিয়ে বজ্র নির্মিত হতো।

মহাভারতে ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা প্রমুখ যোদ্ধাকে ঐন্দ্রাস্ত্র নামের এক অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। এগুলির প্রয়োগ কৌশল থেকে এদের বজ্রের ন্যায় ফলক বিশিষ্ট কোনও বল্লম বা তীর বলে মনে হয়।

পণ্ডিতরা বলেন, বজ্রের আকৃতির সঙ্গে প্রাকৃতিক বজ্রপাতে দেখা যাওয়া আলোর অনেক মিল দেখেই পুরোনো মানুষ এই দুটিকে এক বলে ভাবতো।

আগ্নেয়াস্ত্র- নাম থেকেই বোঝা যায়, এই অস্ত্র ছিল অগ্নিদেবের। মহাভারতে দ্রোণ ও কর্ণপর্বে বলা হয়েছে, এই অস্ত্র নিক্ষেপ করলে আগুনের স্রোত এসে বিপক্ষ সৈন্যদলকে জ্বালিয়ে দিত।

অস্ত্রটির প্রয়োগ কৌশল দেখলে মনে হয় মাথায় আগুন জ্বালানো সাধারণ তীর এটি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহাভারতে বারবার তীর বৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই একজন মানুষ একা অত তাড়াতাড়ি আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলার মতো প্রচুর পরিমাণে তীর ছুঁড়তে পারে না। তাই আমাদের ধরে নিতে হবে, কর্ণ তীর বৃষ্টি করছেন মানে, কর্ণের বাহিনী একসঙ্গে একই নিশানায় তীর ছুঁড়ছে।

এক‌ই বর্ণনা মেনে বলা যায়, কোনও যোদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়ে হাজার হাজার সৈন্য কে দাবদাহের কবলে ফেলার অর্থ হচ্ছে, তাঁর বাহিনী একসঙ্গে অনেক অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করছে।

ব্রহ্মাস্ত্র- প্রায় সমস্ত ভারতীয় পৌরাণিক গ্রন্থের মতোই মহাভারতের দ্রোণ ও সৌপ্তিক পর্বেও এই শ্রেণীর অস্ত্রের বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও গোটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বারংবার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহৃত হতে দেখি। সমস্ত দৈবাস্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম বিধ্বংসী অস্ত্র দুটি এই শ্রেণীর মধ্যেই পড়ে- ব্রহ্মাস্ত্র ও ব্রহ্মশির। নাম থেকেই বোঝা যায়, ব্রহ্মার নিজস্ব অস্ত্র ছিল এগুলি।

মহাভারতে দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী বলা যায়, এগুলি নিক্ষেপ করা হলে, এর মধ্যে থেকে শয়ে শয়ে অগ্নিময় শলাকা বেরিয়ে আসে। আর তার প্রভাবে আগুন জ্বলে উঠে বহু সৈন্য একসঙ্গে মারা যায়।

মৎস্য পুরাণে উল্লিখিত সৌর অস্ত্রের সঙ্গেও এর বেশ মিল‌ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করলে এটি থেকে অসংখ্য ছোট ছোট উল্কা নির্গত হয়ে বাতাসের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বাড়িয়ে দেয় ও শত্রু সৈন্যকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

সুতরাং বর্ণনা থেকে ধরে নেওয়া যায়, ব্রহ্মাস্ত্র গোত্রের অস্ত্র হিসেবে অগ্নিময় ফলক যুক্ত নয়, বরং গোটা তীরেই পাটের দড়ি বা উদ্ভিজ্জ তেল দিয়ে আগুন জ্বেলে নিক্ষেপ করা হতো। এবং একসঙ্গে বহু ধনুক এরকম তীর থেকে নির্গত হয়ে উল্কার মতো শত্রুর শরীরে, তাঁবুতে ঝরে পড়ে তা জ্বালিয়ে দিত।

রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থে যুদ্ধের সময় অগ্নিময় তীর থেকে শত্রু শিবিরে আগুন লাগার কথা বলা হয়েছে।

মহাভারতে অবশ্য ব্রহ্মশিরকে বেশি বিধ্বংসী বলা হলেও, ব্রহ্মাস্ত্রের‌ সম্মান ও‌ ক্ষমতা তুলনামূলক কম ছিল। আর সেজন্যই ছোট বড়ো যোদ্ধারা যখন খুশি এটি ব্যবহার করেছে। এখানে অর্জুন কখনও‌ অশ্বত্থামা আবার কখনও সংশপ্তকদের বিরুদ্ধে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করেন।‌ আবার দ্রোণের বিরুদ্ধে যুধিষ্ঠির ও এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন।

নারায়ণাস্ত্র- মহাভারত, নীতিপ্রবেশিকা প্রভৃতি গ্রন্থে এই অস্ত্রের উল্লেখ আছে। ছলনার দ্বারা ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে দ্রোণের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্ষুব্ধ অশ্বত্থামা পাণ্ডব সৈন্যদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র প্রয়োগ করেন। বলা হয়েছে, এটি প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত ও ভূমিকম্প হয়েছিল। এর প্রভাবে চারিদিক অন্ধকার হয়ে সূর্য‌ও মলিন হয়ে গিয়েছিল। আর পরমুহূর্তেই এর ভিতর থেকে অসংখ্য অগ্নিমুখ তীর, উল্কা প্রভৃতি ছুটে এসে শত্রু সৈন্যকে আক্রমণ করেছিল।

অতয়েব বোঝাই যাচ্ছে, নারায়ণাস্ত্র কোনও ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক ছিল, যা থেকে প্রচুর শব্দ, ধোঁয়া ও আগুন বেরিয়ে আসতো!

ভার্গবাস্ত্র- ভৃগুমুনির অনুগামী রা ভার্গব নামে পরিচিত ছিলেন। প্রধানত ব্রাহ্মণ হলেও, এই ভার্গব গোষ্ঠীতে প্রচুর যোদ্ধাও জন্মেছিলেন। ভৃগু মুনি নিজেই একাধারে ব্রাহ্মণ, যোদ্ধা ও সূত ছিলেন। তবে তাঁর অনুগামীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা পরশুরাম। অবতারবাদের আগমনের পর যিনি বিষ্ণুর অবতার রূপে অবতীর্ণ হন। জমদগ্নী পুত্র রামের নাম পরশুরাম হ‌ওয়ার কারণ পরশু বা কুঠার চালানোয় তাঁর দক্ষতা। এই পরশুরাম ভার্গবদের মধ্যে প্রচলিত সমস্ত প্রাণঘাতী অস্ত্রের ক্ষমতা একত্রিত করে তৈরি করেন ভার্গবাস্ত্র। তবে তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল নিজের ছাত্র অর্থাৎ ভার্গব ব্রাহ্মণ ছাড়া এই অস্ত্রের ব্যবহার কাউকে শেখাবেন না।

পরবর্তীতে কর্ণ এই অস্ত্র চালনায় শিক্ষা লাভ করেন। কর্ণপর্বে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি‌ পাঞ্চাল ও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেন। মহাভারতে বলা হয়েছে, এটি প্রয়োগের ফলে শত শত উল্কা শত্রুর উপর ঝরে পড়ে তাদের ভষ্ম করে দেয়। এক‌ই সঙ্গে ভার্গবাস্ত্র শত্রুর দেহাংশ ছিন্ন করেও তাকে হত্যা করতে পারে।

বর্ণনা থেকে মনে হয়, ভার্গবাস্ত্র ছিল ভার্গব যোদ্ধাদের দ্বারা ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্রের মিলিত রূপ। এটি আদতে কোনও বিশেষ অস্ত্র নয়, একটি বিদ্যা। অস্ত্র চালনার বিদ্যা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে জামদগ্ন্য নামক একপ্রকার যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো তীর রেখে একবারে নিক্ষেপ করা যেত।

তাই ধরে নেওয়া যায়, পরশুরাম‌ই এই যন্ত্র বানিয়ে নিজের বাবার নামে এর নামকরণ করেন, আর যন্ত্রচালনার বিদ্যাটির নাম হয় ভার্গবাস্ত্র। সম্ভবত এটি থেকে তীর, বর্শা, বল্লম, পরশু প্রভৃতি নানা রকম ধারালো অস্ত্র একসঙ্গে ছোঁড়া যেত। তাই ভার্গব বংশের সমস্ত শক্তি একত্রিত করার কথা বলা হয়েছে।

পশুপাত অস্ত্র- এটি পশুপতি শিবের অস্ত্র। পৌরাণিক গ্রন্থগুলি তে এটিকে বিধ্বংসী গণসংহারক অস্ত্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পৌরাণিক অস্ত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হচ্ছে এই পশুপাত। এর বর্ণনার সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রের প্রচুর মিল পাওয়া যায়। ত্রিপুর দুর্গ ধ্বংসকালে মহাদেব এই অস্ত্রের প্রয়োগ করেন। এই অস্ত্র অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বেশ কড়াকড়ি সুরক্ষা ব্যবস্থায় রাখা হতো। এর ব্যবহার হতো বিস্ফোরক হিসেবে এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রধাণত অগ্নিময় বাণের ব্যবহার করা হতো। পশুপাতের বিস্ফোরণ হলে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় অগ্নিশিখা আকাশের দিকে উঠে যেত এবং এর বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের বেশ কিছুদূর পর্যন্ত অঞ্চল এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। বনপর্বে কিরাতবেশী মহাদেব অর্জুনকে এই অস্ত্র দান করেন। এই সময় তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়, পশুপতি অস্ত্রকে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে ব্যবহার করা যেত। অর্থাৎ পশুপাত পরমাণু অস্ত্র হলেও, এর ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

তবে এই ধরনের নরসংহারক মারণাস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল এই সময়। তাই চরমতম সংকট উপস্থিত হলেও কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অর্জুন কখনও এই অস্ত্র তুলে নেননি।

সুদর্শন- মহাভারতে ব্যবহৃত দৈব অস্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে অস্ত্রের কথা না বললে সম্পূর্ণ রচনাটিই ব্যর্থ হয়ে যায়, তাই হলো সুদর্শন।

পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী "সুদর্শন" একটি দৈব্য চক্রের নাম বলে মনে হলেও মহাভারত-সহ বহু আনুষাঙ্গিক পৌরাণিক গ্রন্থে এর বর্ণনা চক্রের যুক্তিকে কিছুটা টলিয়ে দেয়। সুদর্শনের অলৌকিক গুণাবলীর কথা মাথায় রেখে আমরাও তাই চক্রের বর্ণনা থেকে বেরিয়ে এসে সুদর্শনকে এক ব্যতিক্রমী শক্তি হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করছি।

খাণ্ডব দহন পর্বে অগ্নিদেবের থেকে এই ভয়ঙ্কর অস্ত্র লাভ করেন কৃষ্ণ। কিন্তু তার পরেই তিনি‌ এই চক্র ব্যবহার করে প্রথম যে কাজটি করেন, সেটি স্বাভাবিকভাবেই কোনও চক্রের কাজ নয়। খাণ্ডব বনের সমস্ত প্রাণীকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেন কৃষ্ণ!

আবার কুরুক্ষেত্রের ময়দানে এই শক্তি ব্যবহার করে কৃষ্ণকে কখনও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করতে আবার কখনও অকাল সন্ধ্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেখা যায়, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই এই অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যায়!

এ থেকে প্রাচীন শাক্ত ও‌ তন্ত্রসাধনায় প্রচলিত দেহতত্ত্বের মূল ষড়চক্রের কথা উল্লেখ করা যায়। মূলাধার, স্বাধীষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা মানব দেব ভাণ্ডের এই ষড়চক্র সুষুম্না কাণ্ডের দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, আর এদের যোগসূত্র রক্ষা করে মূলাধার থেকে আজ্ঞা পর্যন্ত বিস্তৃত কুণ্ডলীনি চক্র। কঠিন সাধনা, যোগ বা প্রাণায়ামের দ্বারা এই ছয়টি চক্রকে জয় করা সম্ভব। এদের প্রত্যেকটিকে জয় করতে পারলে  কুণ্ডলীনিকেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর সাধনালব্ধ এই বিদ্যার নাম‌ই সুদর্শন।

দেহতত্ত্ব সাধক যা বলেন, এই বিদ্যার দ্বারা মানুষ তার এবং অপরের মস্তিষ্কে অনবরত ঘটতে থাকা বিদ্যুৎ তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ সুদর্শনের অধিকারী অপর ব্যক্তির চিন্তাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

হয়তো এভাবেই কৃষ্ণ সুদর্শন ব্যবহার করে কখনও অকাল সন্ধ্যা আনতেন, আবার কখনও নিজের বিশ্বরূপ দেখাতেন। কৃষ্ণের মৃত্যুকালে সুদর্শনের মাটিতে লীন হয়ে যাওয়া দেখে এই যুক্তিকে পোক্ত করে।

আবার বেশ কিছু পৌরাণিক গ্রন্থ অনুযায়ী অগস্ত্যের শাপে দেবতারা লক্ষ্মী হারা হলে, দেবী লক্ষ্মী পাতালে আশ্রয় নেন। তখন তাঁর রক্ষার্থে বিষ্ণু সহস্র সুদর্শন পাঠান। এই বর্ণনা থেকে সুদর্শনকে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী বলেও মনে হয়। রামায়ণে সুদর্শন ও হনুমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব এই যুক্তিকেই সমর্থন করে।

রামায়ণে রামকে আবার বিদ্যুন্মালীর বিরুদ্ধে সুদর্শন নামের একটি বাণ ব্যবহার করতে দেখা যায়!

তবে সুদর্শন যাই হোক না কেন, একটি বিষয় পরিষ্কার করেই বলা যায়, এই সুদর্শন বিদ্যা রপ্ত করতে পারলেই বিষ্ণু হয়ে ওঠা যায়। আর তাই শিশুপাল, পৌণ্ড্র্যক বাসুদেব প্রমুখ নিজেদের আসল বৈষ্ণব অবতার ঘোষণা করলেও বিষ্ণু হয়ে উঠতে পারেননি। এবং পরবর্তী কল্কি অবতারকেও এই সুদর্শন বিদ্যা শিখেই প্রকাশ্যে আসতে হবে।

উপরোক্ত অস্ত্রাবলী ছাড়াও কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে আরও বহুবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ হয়েছে। বহু মৃত্যুর সাক্ষী সেইসব অস্ত্র আজ হারিয়ে গেছে বিস্মৃত ইতিহাসের পাতায়।

আসলে কোথায় এই ইতিহাসের শুরু আর কোথায় শেষ, তা আজ আমাদের অজানা। তাই শুধু কল্পনায় ভর করে সেই সব হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে আমরা সম্মান জানাতে পারি, যারা রপ্ত করেছিলেন প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক শক্তি কে নিয়ন্ত্রণ করার আশ্চর্য উপায়, অত্যাধুনিক বিজ্ঞানকে রপ্ত করেছিলেন কঠিনতম সাধনার দ্বারা এবং তৈরি করেছিলেন নানা মহাস্ত্র নির্মাণের গোপন কৌশল।