প্রাচীন কথা - সৌহার্দ্য সেন ও ঋত্বিক ঘটক
Posted in প্রাচীন কথামহাভারত কালের খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থান:
অনেক খুঁজে না পাওয়া তথ্য, মেলাতে না পারা অঙ্ক আর ভুলে যাওয়া সময়ের সাক্ষী একটি বই- মহাভারত। কবিগুরুর ভাষায়, "একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।" 'ইতিহাস', কারণ মহাভারত শুধুই যুদ্ধ, খুনোখুনি আর রাজনীতির কথা বলে না; বরং আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পুরোনো জনজাতির সংস্কৃতি, জীবনযাপন, আচার-ব্যবহার, ভৌগলিক তথ্য, বিজ্ঞান চর্চা সমস্ত কিছুর এক বিরল সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু মহাভারত তো শুধুই ইতিহাস লেখার জন্য লেখা কোনো টেক্সট বই নয়। এটি গল্পের ছলে বলা এক সময়ের ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত এনসাইক্লোপিডিয়া।
মহাভারতের কবি বলতে বেদব্যাসের নাম পরিচিত হলেও পণ্ডিতরা বলেন, বছরের পর বছর বহু কবির হাতে সামাজিক, রাজনৈতিক নানা কারণে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে মহাভারত। আর তাই মহাভারতের পাতায় একই সঙ্গে প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। এতবার এডিট হওয়া কাহিনীটি গল্প প্রিয় পাঠকের জন্য বেশ জটিল হলেও তথ্যপ্রেমী পাঠক বেশ মজাই পান এতে। মহাভারতে প্রতিটি চরিত্রের জীবনযাপন, আচার আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ লৌকিক বর্ণনা দেখা যায়। বর্তমানে বিদ্যুৎ আর ইন্টারনেট নামক দুটি নতুন জিনিসের আগমন ঘটলেও, তৎকালীন সময়ে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র আর বাসস্থানের বেশি আর কিছু প্রয়োজন ছিল না। আজ আমরা সেই খাদ্য বস্ত্র ও বাসস্থান নিয়েই গল্প করবো.. হ্যাঁ, কিছু বিশিষ্ট গবেষক মহাভারতে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের উপস্থিতির কথা বললেও, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে আমরা এই লেখা থেকে সেগুলো বাদ দিয়েছি।
গত কয়েক বছরে বাজারে আসা বেশ কিছু পৌরাণিক টিভি ধারাবাহিকে আপনারা হয়তো দেখে থাকবেন, চরিত্রগুলো বেশ বড়োসড়ো ডাইনিং টেবিলে রাজকীয় খাবার সাজিয়ে বসে আছে! তন্দুরি থেকে শুরু করে বিরিয়ানী-পোলাও কি নেই সেখানে.. এইসব দেখে আর পাঁচটা খাদ্যরসিকের মতোই আমরাও প্রতিটা পর্ব বেশ খুঁটিয়ে দেখলাম। তারপর চিলি চিকেন, মোমো কিম্বা চাউমিন খুঁজে পাওয়ার আশায় মহাভারত ও সমসাময়িক গ্রন্থগুলি ঘাঁটতে বসলাম। ..যে মহাভারতে চিনা লোকজনের এত আনাগোনা, সেখানে চিনা খাবার খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ও না..
যাইহোক, খুঁজতে গিয়ে বই খুলে তো চক্ষু চড়কগাছ! চাউমিন-মোমো তো নেই ই, বরং রান্না করা উপমহাদেশীয় খাবারই ভালো করে খুঁজে পাওয়া গেল না। চারিদিকে শুধুই ফলমূল, শাকসবজি আর পোড়া মাংসের উল্লেখ! রান্না করা খাবারের মধ্যেও মশলার ব্যবহার প্রায় বিরল; সময়কালের বিচারে যা স্বাভাবিক বলেই ধারণা করা যায়। প্রিয় পাঠক বন্ধু, আমাদের ধারণা, আর্যরা ভারতে আসুক বা আদি অধিবাসী হোক, মহাভারত যদি আজ থেকে কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগেও ঘটে থাকে, তাহলে ওই সমাজে রান্না করা মশলাদার খাবারের অস্তিত্ব কম থাকাটাই স্বাভাবিক। ওই সময় মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। রাজা প্রজা সবাই প্রয়োজনে নিজের খাবার সংগ্রহ করে খেত। অথবা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে সংগ্রহ করা খাবার একসঙ্গে ভাগ করে খেত। কালক্রমে সমাজে পুঁজির উদ্ভব হলে, খাদ্য উৎপাদক-সংগ্রাহক ও নেতাদের মধ্যে বিভেদ প্রকট হয়, কিন্তু এই সময়েও মাঝেমধ্যেই নেতাদের শিকার অথবা চাষের কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
মহাভারতের শুরুর দিকেই সত্যবতীর বর্ণনায় তাঁকে মৎসগন্ধী বলা হয়, তাঁদের সম্প্রদায়কে জেলে বলে উল্লেখ করেন কবি। ভেবে দেখুন, একজন জেলে অথবা জেলেনীর গায়ে মাছের গন্ধ পাওয়ার অর্থ কিন্তু ওই ব্যক্তি সবসময় মাছের আশেপাশেই থাকেন। অর্থাৎ ধারণা করা যায়, মাইমল সম্প্রদায়ের মধ্যে মাছ ধরা, স্টোর করা ও বিক্রি করার প্রচলন ও ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মাছ বাজারের অস্তিত্বও হয়তো অলীক কল্পনা নয়।
বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বৃহদশ্ব মুনির দেখা হলে, তিনি যুধিষ্ঠিরকে নিষাদ রাজ নল ও তাঁর স্ত্রী দময়ন্তীর গল্প বলেন। এখানে দেখা যায়, কলির প্ররোচনায় পুষ্কর নলকে রাজ্যছাড়া করলে, বনবাসী হয়ে তিনি খাদ্যের প্রয়োজনে পাখি শিকার করেন। ভাবুন, যিনি একবস্ত্রে রাজ্য ছাড়া হয়েছেন, তিনি নিশ্চই শিকার করা পাখি পুড়িয়েই খাবেন, রান্নার সামগ্রী পাবেন না। হ্যাঁ, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় সবাই মাংস খেতেন। অশ্বমেধ, গোমেধ প্রভৃতি যজ্ঞের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় ঘোড়া ও গোরুও খাদ্য হিসেবে গৃহীত হতো। কামধেনু জাতীয় গোরুর সুরক্ষা ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায়, দুগ্ধবতী গোরু খাদ্য হিসেবে বিবেচ্য না হলেও মহিষ, বলদ প্রভৃতি খাওয়া হতো। মহাভারতের প্রায় প্রতিটি চরিত্রই কিন্তু মাংসভোজী। রাজা রন্তীদেবের রান্নাঘরে প্রতিদিন নাকি প্রায় দু'হাজার গোরু কাটা হতো। তিনি সেই মাংস রাজ্যবাসীর মধ্যে বিতরণও করতেন।
উদ্যোগ পর্বে যখন কৃষ্ণ দূতিয়ালি করতে কুরু বাড়িতে গেলেন, কৌরব ভাইরা তাঁকে দারুণভাবে সম্বর্ধনা দিয়ে, আলোচনার পর রীতিমতো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও করেন। এখানে দেখা যায় তাঁরা কৃষ্ণকে গোমাংস, মধুপর্ক ও জল দান করছেন- "তস্মিন গাং মধুপর্কঞ্চাপ্যুদকঞ্চ জনার্দনে।" গো-নির্ভর সমাজ হওয়ায় দুধ, দই, ঘোল ইত্যাদির গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক ছিল এই সময়। পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতে 'মধুপর্ক' নামক একপ্রকার খাদ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও, এটি দুধ বা দই ও মধুর মিশ্রণ বলেই মনে হয়।
খাদ্যরসিক হিসেবে খাদ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে মদ্যরসিকদের কথা না বললে অবিচার করা হয়। ভাবছেন পৌরাণিক গল্পে মদ এলো কেন? বন্ধু, আজ মদ খেয়ে বিষ্ণু মন্দিরে ঢোকা না গেলেও স্বয়ং বিষ্ণুই কিন্তু বেশ মদ্যরসিক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রিয় মদ ছিল 'বারুণী'। এই বারুণীর প্রতি বিষ্ণুর টানের কথা বিষ্ণুপুরাণে বেশ ভালোভাবেই বলা হয়েছে- "তৃষ্ণা চৈনং বিবেশাশু বারুণী প্রভবা।" মহাভারতেই কখনো অর্জুনকে আবার কখনো দুর্যোধনকে আমরা মদমত্ত অবস্থায় থাকতে দেখেছি। কিন্তু পুরাণের সবচেয়ে বিখ্যাত সুরাপ্রেমী মধ্যে শিবের পরেই যাঁর উল্লেখ না করলেই নয়, তিনি বলরাম। আর তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেক পৌরাণিক মদের নাম, 'কাদম্বরী।' কদম গাছের বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হতো এই কাদম্বরী- "কদম্ব কোটরে জাতা নাম্মী কাদম্বরীতি সা।" এটি আবার বেশ উৎকৃষ্ট কিছু মদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কবি বলেছেন, একবার যে কাদম্বরী খেয়েছে, অন্য খাবারে তার রুচি থাকে না- "কাদম্বরী রসজ্ঞানাম্ আহারোহপিন রোচতে।"
মহাকবি কালিদাস তো 'শকুন্তলা'য় কাব্য রচনার আগে শুঁড়িখানায় গিয়ে কাদম্বরী ভজনার উপদেশ দিয়েছেন- "কাদম্বরী শব্দিকে কখু পঢমং আস্মাণাং শোহিদে ইসচীঅদি। তা শুন্ডিকাগালং যেব গশ্চস্ম।" লক্ষ্য করুন, এখানে কিন্তু 'শুঁড়িখানা'র উল্লেখ করা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে মদ তৈরী, বিক্রি ও খাওয়ার আলাদা আলাদা জায়গা থাকলেও, গ্রামের দিকে এখনো বহু জায়গায় একই সঙ্গে মদ তৈরী, বিক্রি ও খাওয়া হয়; এগুলিই শুঁড়িখানা। হরিবংশে বলরামের মদিরা প্রেমের বর্ণনাতেও শুঁড়িখানার আভাস পাওয়া যায়। কবি বলছেন, বলরাম বাতাসে মদের গন্ধ পেলেন- "মদ্যসংস্পর্শজো গন্ধঃ সংস্পৃশন্ ঘ্রাণমাগতঃ।" গ্রামাঞ্চলে আজও বেশ কিছু জায়গায় রীতিমতো কারখানা বানিয়ে চোলাই মদ তৈরী হয়। এই এলাকার আশপাশের বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত মদের গন্ধ পাওয়া যায়, এখানে বলরামও ঠিক তেমনি গন্ধ পেয়েছেন।
দেখুন তো.. কারণ সুধার চক্করে আসল জায়গা থেকে কতটা সরে গেছি! এ গল্প না হয় পরে বলা যাবে, আপাতত মহাভারত কালে প্রচলিত পোষাক আশাকের বিবরণে আসা যাক। এই সময় প্রধানত গাছের ছাল ও তন্তু এবং পশুর চামড়া বস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সম্ভ্রান্ত পরিবারে ও শহরাঞ্চলে সুতোর পোষাক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
আদিপর্বে জন্মেঞ্জয়কে কুরুবাড়ির ইতিহাস বলতে মহাভারতের কবি শান্তনু ও ভীষ্মের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করেন। এঁদের জন্মকাহিনী আমাদের প্রয়োজন নেই বটে, তবে এই আলোচনায় স্বর্গবাসী গঙ্গার পোষাকের বর্ণনাটি বেশ উল্লেখযোগ্য। এখানে কবি বলছেন, হঠাৎ বাতাস এসে গঙ্গার গোপনাঙ্গ থেকে তাঁর সূক্ষ্ম বস্ত্রটি সরিয়ে দিলো!-
"তস্যা গঙ্গায়াঃ, শশীপ্রভং চন্দ্রকিরণতুল্যং সূক্ষ্মম্, বাসো বস্ত্রম্,
মারুতেন বায়ুনা, সমুদ্ধূতং সঞ্চাল্য গুপ্তাঙ্গাদপসারিতম্ ।।"
লক্ষ্য করুন, এখানে গঙ্গার বস্ত্রটিকে সূক্ষ্ম বলা হয়েছে। রামায়ণের কিছু উপজাতীয় ভার্সনে সীতাকেও এরকম সূক্ষ্ম বস্ত্র পরতে দেখি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত শাড়ি 'মসলিন'ও কিন্তু সূক্ষ্ম বস্ত্র হিসেবেই বিখ্যাত। এটি কিন্তু মহাভারত কালেও সম্ভ্রান্ত রমণীদের পরিধানের উৎকৃষ্টতার পরিচায়ক।
হরিবংশে আবার সুতোর তৈরী রঙিন কাপড়ের উল্লেখ ও পাওয়া যায়। এখানে কবি বলছেন, কৃষ্ণ হলুদ আর বলরাম নীল ধুতি পরতেন। গোপীনিদের পরিধেয় নিয়ে বলতে গিয়ে আবার রসিক কবি বললেন, যুবতী গোপীরা যখন কোমরে কলসী ও মাথায় ঘট নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তখন তাদের নীল হলুদ ও লাল শাড়িগুলি স্তনের অগ্রভাগে উঁচু হয়ে আছে।- "নীল-পীতারুণৈস্তাসাং বস্ত্রৈর গ্রস্তনোচ্ছিতৈঃ।" এখানে কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার যে, মহিলা ও পুরুষ উভয়েই একখণ্ড বস্ত্রকেই শাড়ি অথবা ধুতি হিসেবে ব্যবহার করতেন।
তবে দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই বস্ত্র হিসেবে পশু ও গাছের ছালের প্রচলন ছিল। বনবাসী অর্জুনকে আমরা গাছের ছাল তুলে পোশাক বানাতে দেখি। হ্যাঁ, তর্কের খাতিরে বলাই যায়, পাণ্ডবরা তো জীবনের প্রথম ভাগটা বনেই কাটিয়েছে, তাই অর্জুন ওরকম পোশাক বানাতে জানতো। কিন্তু সমাজে এরকম পোশাকের প্রচলন থাকলে তবেই না একজন মানুষ গাছের ছাল তুলে পোশাক বানানোর কথা ভাববে..
আজ আমরা মহাভারতীয় সভ্যতাকে প্রাচীন বলতে শিখেছি, কিন্তু এই সমাজেরই বেশভূষা আধুনিক সমাজকেও হার মানায়। আমাদের বর্তমান সমাজে ছেলেরা কানে দুল বা হাতে বালা পরলে 'রকবাজ' বলে গণ্য হয় বটে, তবে আমরা যাঁদের ভগবান বলে পুজো করি, সেই ভগবানদের কিন্তু অঙ্গ সজ্জার প্রধান সাধন ছিল এই কানের দুল। প্রায় প্রত্যেক দেবতার কানে দুল দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এঁদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ছিলেন সংকর্ষণ বলরাম। ভদ্রলোক এক কানে কুণ্ডল পরতেন! মণিমুক্তো খচিত গয়নার উল্লেখও পাওয়া যায় এই সময়- "জাতরূপময়ং চৈকং কুন্ডলং বজ্রভূষিতম্।"- বলরাম বজ্রমণি অর্থাৎ হিরে বসানো সোনার কুণ্ডল পরতেন। গোমন্ত পর্বতে আয়োজিত নাচগানের আসরে যোগ দেওয়া বলরামের এক কানে দুল আর গলায় বৈজয়ন্তী ফুলের মালা দেখা যায়- "স্রগী-এককুন্ডলো মতো বৈজয়ন্তো চ মালয়া।"
তবে শুধুই ধাতব কুণ্ডল অলঙ্কার না, হরিবংশে গোপপল্লীর নারী পুরুষদের মাথায় গাছের পাতায় তৈরী মুকুট আর ময়ূরপুচ্ছের তৈরী অঙ্গসজ্জা ব্যবহার করতে দেখা যায়- "ময়ূরাঙ্গদকর্ণো তু পল্লবাপীড়ধারিণৌ।"
এই গোপ-গোপিনীদের বিচরণস্থল কিন্তু মোটেও শহুরে ছিল না। এখানকার পরিবেশ ছিল একান্ত গ্রাম্য। আর এই গ্রাম্য পরিবেশেই বড়ো হয়েছিলেন কৃষ্ণ, বলরাম প্রমুখ। গ্রামগুলো প্রধানত জঙ্গল কেটে বা পুড়িয়ে তৈরী হতো। বনাঞ্চলের মধ্যে সমতল ও মনোরম জায়গা দেখে বাড়িঘর বানানো হতো। হিংস্র জানোয়ার, শত্রু গোষ্ঠী প্রভৃতির আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে এখানকার লোকজন গ্রামের চারপাশে গাছের গুঁড়ি ফেলে বেড়া দিত - "পর্যন্তেষ্বাবৃতং বনৈর্বৃহদ্ভিঃ পাতিতৈদ্রুমৈঃ।" এভাবেই খাণ্ডবদহন কালে পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থের জঙ্গল পুড়িয়ে ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপন করেন। এই ধরণের গ্রামগুলোতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোনো স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় না। এগুলো ছিল বাঁশ, খড় ও চাঁচের তৈরী অস্থায়ী ঘর - "কটচ্ছন্ধকুটীমঠম্।"
আপনারা হয়তো ভাবছেন পাণ্ডবরা গেল আর বন জ্বালিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়ে ফেললো, কিম্বা ব্রজভূমির লোকজন ইচ্ছা হতেই একদিন আদি বাসস্থান ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে গেল। আমরা বলবো, না, আজকের মতো জমি অধিগ্রহণ আর সেই সংক্রান্ত ঝামেলা তখনো ছিল। আজকাল আকছার দেখতে পাবেন অমুক বস্তি অধিগ্রহণ করে শপিং মল কিম্বা আবাসন তৈরী করা হবে, আর সেই নিয়ে বস্তিবাসীদের সঙ্গে আবাসন কর্তৃপক্ষের ঝামেলা। প্রাথমিক আলোচনায় ঝামেলা মিটলে ভালো, নইলে কদিন পর খবর আসে, শট সার্কিট বা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বস্তিতে আগুন লেগেছে। তারও কিছুদিন পর ছাই সরিয়ে আবাসনের ভীত পুজো হয়.. খাণ্ডবপ্রস্থেও একইভাবে জঙ্গলে আগুন দিয়ে স্থানীয় নাগ জনজাতির লোকজনদের মেরে পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপন করেন।
আরেকবার বর্তমানে ফিরে আসা যাক। ধরে নিলাম ওই বস্তিটিতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগেই বাসিন্দারা আলোচনা করে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিল। কিন্তু এরপরেও কয়েকজন বিদ্রোহী লোক থাকেন, যাঁরা সরাসরি আক্রমণের পথ বেছে নেন ও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজের আদিভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করেন।
ঠিক একই রকম লোক দেখি বৃন্দাবনের আশপাশের এলাকায়। ব্রজবাসীরা যখন নিজেদের পুরোনো আশ্রয় ছেড়ে যমুনাতীরে বৃন্দাবনে বসতি স্থাপন করলেন, ধেনুকাসুর, প্রলম্বাসুর প্রমুখের থেকে তাঁরা বাধা পান। এঁদের ভয়ে তাঁরা বৃন্দাবনের বাইরের এলাকায় যেতে ভয় পেতেন। আর তাই, বলরামের হাতে ধেনুকাসুর নিহত হলে হরিবংশে বলা হচ্ছে, "বিপ্রমুক্তভয়ং শুভ্রং বিবিক্তাকারদর্শনম্ চরন্তি স্ম সুখং গাবং..।" অর্থাৎ, বলরাম ধেনুকাসুরকে মারার পর সেখানে লোক যাতায়াতের আর কোনো ভয় ও অসুবিধা থাকলো না।
কবি সব্যসাচী দেব তাঁর 'কৃষ্ণা' কবিতায় কৃষ্ণার মুখ দিয়ে অর্জুনকে বলিয়েছেন, "... তোমার পূর্বপুরুষেরা যেমন একদা এক তৃণপ্রান্তরকে নিঃশেষ করে চলে যেতেন বনান্তরে।" কথাটি দ্ব্যর্থক বটে.. এক অর্থে যেমন দ্রৌপদীর জীবনের করুণ পরিণতির পরিচায়ক, অর্থান্তরে তেমনি অর্জুনের পূর্বপুরুষের যাযাবর হওয়ার আভাস দেয়। হ্যাঁ, তৎকালীন সমাজে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যাযাবরই ছিলেন। তাঁরা খাদ্যের সন্ধানে হোক বা হিংস্র জন্তুর নিশানা হওয়া থেকে বাঁচতে মাঝেমধ্যেই নিজেদের বাসস্থান পরিবর্তন করতেন, আর এই ঘটনার বর্ণনা মহাভারতে বলাও হয়েছে দারুণভাবে।
ডঃ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি মহাশয় তাঁর 'মহাভারতের ছয় প্রবীণ' বইতে লিখেছেন, কুরু পিতামহ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বনবাস করার জন্য বেশ কিছু নিয়ম তৈরী করে দিয়েছিলেন। ব্যাস এখানে বনবাসী পাণ্ডবদের বনের এক জায়গায় বেশিদিন না থাকার উপদেশ দিচ্ছেন। তিনি গাছপালা, পশুপাখি, বনজ ঔষধ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে চিন্তিত। ব্যাস বলছেন, একই বনে চিরকাল থাকলে বৃক্ষ, ঔষধ, পশু সবেরই বিনাশ হয়, তাই তোমরা অন্য বনে যাওয়ার কথা ভাবো-
"একত্র চিরবাসো হি ন প্রীতি জনকো ভবেৎ..
মৃগাণামুপয়োগশ্চ বীরুধোষধিসংক্ষয়ঃ
বনাদস্মাচ্চ কৌন্তেয় বনমন্যদ বিচিন্ত্যতাম্।।"
গ্রামে তো নয়ই, গোটা মহাভারতের কোথাও স্থাপত্য শিল্পের কোনো পোক্ত নিদর্শন পাওয়া যায় না। শহরাঞ্চলের বাড়িগুলো পোড়ামাটির ইঁট, মাটি বা কাঠের তৈরী হতো। আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা? মহাভারতে তো রাজপ্রাসাদের কথা বলা হয়েছে..; আমরা বলবো, অবশ্যই রাজপ্রাসাদ ছিল, তবে সেটাও তৈরী হতো ইঁট, কাঠ ও মাটি দিয়ে। এখানে বিপক্ষ যুক্তি আসে, ইন্দ্রপ্রস্থে ময় দানব পাণ্ডবদের জন্য মণিমুক্ত খচিত ত্রিভূবনবন্দিত একটি মহল বানিয়ে দেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, এই মহল যদি এতই ঐশ্বর্য মণ্ডিত হতো, তাহলে পাণ্ডবদের রাজ্যছাড়া করে দুর্যোধন বা অন্য কোনো কৌরব ভাই এখানে থাকলেন না কেন? তাঁরা মহলটি দ্রোণাচার্যকে দিয়েছিলেন। আর শুধু কৌরবরাই কেন, স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই তো রাজা হওয়ার পর এই প্রাসাদে থাকেন নি..
বারণাবতে জতুগৃহ তৈরীর সময় ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী পুরোচনকে আদেশ দেন- যাও, পাণ্ডবদের জন্য একটি নয়নাভিরাম বাড়ি তৈরী করো। বাড়ির প্রতিটি স্তম্ভ হবে শাল জাতীয় বৃক্ষে নির্মিত। শন, ধুনো প্রভৃতি যা কিছু আগ্নেয় দ্রব্য জগতে আছে, সমস্তটাই বাড়ি তৈরীর উপাদানে মিশিয়ে দিও। তারপর আবার তেল, ঘি, চর্বি ও গালার মিশ্রণ মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ালে লেপন কোরো।–
"শনসর্জ্জরসাদীনি যানি দ্রব্যাণি কানিচিৎ।
আগ্নেয়ান্যুত সন্তীহ তানি তত্র প্রদাপয়।।
সর্পিস্তৈলবসাভিশ্চ লাক্ষায়া চাপ্যনল্পয়।
মৃত্তিকাং মিশ্রয়িত্বা ত্বং লেপং কুড্যেষু দাপয়।।
..শনং তৈলং ঘৃতষ্ণৈব জতু দারূণি চৈব হি।"
লক্ষ্য করুন, রাজা রাজপুত্রদের থাকার ঘর বানাতে বলছেন শাল, শন গাছ দিয়ে। ঘরটি তৈরী হবে রাজকোষের টাকায়; স্থাপত্য শিল্প অত উন্নত হলে ধৃতরাষ্ট্র ইঁটের বাড়ি তৈরীর কথা বলতেন না কি? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, ঘরটি যাঁদের জন্য তৈরী হয়েছিল, তাঁরা কিন্তু বিনা আপত্তিতে সেখানে থাকতে রাজি হন। অভ্যস্ত না হলে তো এমনটা করতেন না পাণ্ডবরা। এই ঘটনা কিন্তু ওই সমাজে বাঁশ-বেত-শনের তৈরী বাড়ির অস্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেয়।
মহাভারতে মানুষের গুহাতে বাস করার প্রমাণও পাওয়া যায়। বিদুর যখন জানতে পারলেন, ধার্তরাষ্ট্ররা পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য জতুগৃহ নির্মাণ করেছেন, তখন তিনি পাণ্ডবদের বাঁচাতে গুহাঘর বানানোয় এক্সপার্ট একটি মিস্ত্রী পাঠান। ইনি খুব তাড়াতাড়ি মাটি খুঁড়ে বসবাসযোগ্য ঘর বানানোয় পারদর্শী ছিলেন। ভাবুন, সমাজে প্রচলন না থাকলে এক্সপার্ট লোক এলো কি করে? এছাড়াও হরিবংশে বলা হয়েছে সমন্তক মণি উদ্ধার করতে কৃষ্ণ জাম্বুবানের গুহায় যান।
পাণ্ডবরা শুতেন কুশাসনে; অর্থাৎ কুশ ঘাস বিছানো শয্যা। মহাভারত বলছে, পাণ্ডবরা শুতেন পাশাপাশি, তাঁদের মাথা ও পায়ের দিকে যথাক্রমে কুন্তী ও দ্রৌপদী আড়াআড়িভাবে শুতেন। এরকম বিছানা কিন্তু মাটিতেই সম্ভব। এছাড়াও বনপর্বে কুন্তী বলেন, এখানে আমার ছেলেরা তো হরিণের চামড়ার কোমল শয্যায় শুতে পাবে না..- "রাঙ্কযাজিন শায়িনঃ বঙ্কু মৃগচর্ম্মশয়নশীলাঃ" অর্থাৎ ওই সময় পশুচর্মের উপর শোওয়ার প্রচলনও ছিল।
মহাভারতের গৌরবময় স্মৃতি আজ মুছে গেছে মানুষের মন থেকে। গোকূল-হস্তিনা-ইন্দ্রপ্রস্থের মানুষের পদচিহ্ন মুছে গেছে নবাগতের পদক্ষেপে। কয়েক হাজার বছর আগে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে যে সামাজিক নাটকের অভিনয় হয়েছিল, এবং যারা অভিনয় করেছিল, তারা সকলেই মিলিয়ে গেছে কুরুক্ষেত্রের মাঠে ওড়া শেষবেলার ধুলোয়। তার উপর জমেছে অন্ধভক্তির ধুলো। পরে সেই ধুলোপড়া পাণ্ডুলিপিতে চেপেছে অলৌকিকতার মলাট; তাই আসল ইতিহাসটা আর জানা হয়নি কারো। তবু কোনো কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে যদি কোনো বই খুলে দেখেন, লেখা আছে, "কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বিরচিত মহাভারত", মনে রাখবেন সেই বই গল্প শোনায় নিচু স্বরে। পাতায় পাতায় জীবন্ত স্মৃতিকথা, কত চরিত্র, তাদের জীবনযাত্রার না শোনা গল্প, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম, বিরহ, জন্ম মৃত্যুর রক্তাক্ত ইতিহাস.. তার বিন্দুমাত্রও ভুলে যায়নি "মহাভারত"।
মহাভারতের নারী:
মহাভারতের প্রতিটি ঘটনার সাথেই নারীর ভূমিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহাভারতের কবি নারীচরিত্রগুলিকে অতি যত্নে এঁকেছিলেন। তৎকালীন আর্যাবর্তের সমাজে নারীর স্থান ও ভূমিকা একটি একক আলোচনার বিষয় হওয়ার যোগ্য, এখানে স্থানাভাবে কয়েকটি ঘটনা, চরিত্র এবং সমাজের ওপর নারী ও নারীর ওপর সমাজের প্রভাবের সংক্ষিপ্ত আলোচনার চেষ্টা করবো।
প্রথমেই দেখবো যে মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিতে নারীর প্রভাব কতটা। মহাকাব্যের শুরুতেই যদি সুরেশ্বরী বালিকাবেশে মহারাজ প্রতীপের কোলে এসে না বসতেন তবে মহাভারত লেখাই হতো না হয়তো। মহারাজ প্রতীপের পুত্রবধু হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গঙ্গাদেবী মহাভারতের মহীরুহের বীজটি বপন করেন। পরে মহারাজ শান্তনুর সাথে বিবাহের পূর্বে নিজের স্বাধীনতার ব্যপারটিও শর্তের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করেন। সাত সন্তানের মৃত্যুশোক সহ্য করার পর শান্তনু যখন শেষ সন্তানটির প্রাণরক্ষার্থে গঙ্গা দেবীকে আটকালেন, তখন দেবী রাজাকে ত্যাগ করলেও সন্তানকে ত্যাগ করেননি, মাতৃস্নেহে নিজের সাথে নিয়ে যান এবং কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আর বেদজ্ঞ বানিয়ে রাজাকে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান ফিরিয়ে দেন। এই গঙ্গাপুত্র পরবর্তীতে কুরুবৃক্ষের মূল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষণীয়ভাবে স্বামীত্যাগী মাতার পরিচয় অত্যন্ত গর্বের সাথে বহন করেছেন দেবব্রত। শান্তনু পুত্র নয় গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম নামে আর্যাবর্ত কম্পিত হতো। এমনকি ভীষ্মের রথধ্বজাও ছিলো গঙ্গাবাহন মকর চিত্রিত। মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রটির ওপর তার মায়ের প্রভাব ছিলো অনেক।
মহারাজ শান্তনুর দ্বিতীয় পত্নী সত্যবতী ছিলেন মৎসজীবী সমাজের প্রধান দাসরাজের কন্যা। কন্যা হলেও পুত্রের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না তিনি। পিতার অনুপস্থিতিতে উত্তাল গঙ্গায় পারাপারের কাজ করতেন এবং প্রয়োজনে প্রশাসনিক কাজেও সাহায্য করতেন পিতাকে। জীবিকার তাগিদেই তাকে হতে হয়েছিলো বাকপটু। কামার্ত পরাশরকে পারাপার কালে যুক্তিজালে নিবৃত্ত করার চেষ্টা দেখে মনে হয়, তার হয়তো কিছু বৈদিক শিক্ষা থাকাও অসম্ভব নয়। যদিও পরাশর সত্যবতীর শর্তপূরণের পরিবর্তে তার গর্ভে এক মহাজ্ঞানী পুত্রলাভ করেন। সমাজের ভয়ে সত্যবতীর পক্ষে সম্ভব হয়নি কুমারী মাতা হয়ে পুত্রকে গ্রহণ করা, পুত্র দ্বৈপায়ন পিতা পরাশরের সাথে যাওয়ার আগে প্রয়োজন হলেই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয়।
এরপর সত্যবতীর জন্যই ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা করেন সিংহাসন ত্যাগের আর সত্যবতীকে মাতা ও কুরুবংশের মহারাণী রূপে বরণ করে হস্তিনার রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসেন।
শান্তনুর মৃত্যুর পর দুই নাবালকের মধ্যে প্রথমজন, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদকে রাজা করার পেছনেও ছিলো সত্যবতীর প্রচ্ছন্ন অঙ্গুলী হেলন। পরে চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হলে অসুস্থ বিচিত্রবীর্য রাজা হলে, সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন রাজমাতা সত্যবতী। ভীষ্মের সাহায্যে কুরুবংশের সীমা বাড়িয়ে দিতে থাকেন চারিদিকে। তার নির্দেশেই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ভীষ্মকে কাশীর তিনজন রাজকুমারীকে হরণ করে আনতে হয় বিচিত্রবীর্য্যের জন্য। আবার তার নির্দেশেই শাল্বরাজের অনুরক্তা অম্বাকে ফেরত পাঠানো হয় তাঁর কাছে।
অপুত্রক অবস্থায় বিচিত্রবীর্য্যের অকালমৃত্যু হলে, নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে ক্ষেত্রজ পুত্র গ্রহণের মতো অপ্রিয় অথচ প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও সর্বপ্রথম ভীষ্মকে বলেন সত্যবতীই। ভীষ্মকে অনুরোধ করেন বিধবা ভাতৃজায়াদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে অপারগ ভীষ্মকে এরপর নিজের প্রথম সন্তান দ্বৈপায়নের কথা বলেছেন সত্যবতী। ভীষ্ম রাজি হলে দ্বৈপায়নকে রাজবাড়িতে স্মরণ করেন সত্যবতী। সত্যবতীই বহু কষ্টে, বহু অনুরোধে এবং যুক্তিতে দ্বৈপায়নকে রাজি করান। লক্ষণীয় যে ভীষ্মকে বোঝানোর সময় পুত্র সন্তানের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা, সিংহাসনে রাজার আবশ্যকতা এই সব যুক্তি দিলেও, ধর্মজ্ঞানী ঋষি দ্বৈপায়নের কাছে দেওয়া তার যুক্তিগুলো ছিলো সম্পূর্ণ মানবিক। অল্পবয়ষ্কা বিধবাদের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ও কুরুবংশ রক্ষার্থে নিজপুত্রকে নিয়োগ প্রথার অনুরোধ করেছেন তিনি। এমনকি তাকে এও বলতে দেখা যায় যে, তার জন্যই ভীষ্ম অকৃতদার, তার সন্তানেরা মৃত, কুরুবংশলোপের জন্য লোকে তাকেই দায়ী করবে। তিনি জানতেন, ঋষির কাছে ধনরত্ন, সিংহাসন, রাজত্ব এসবের থেকেও মানবিকতার দাম অনেক বেশী, মাতৃঋণ শোধ তপস্যা অপেক্ষাও গুরুতর কর্তব্য। দ্বৈপায়ন রাজি হলেও একবছর প্রিপারেশনের শর্ত রাখলেন, না হলে তার তেজ সহ্য করা রাজবধূদের পক্ষে অসম্ভব। আসলে তিনি চেয়েছিলেন রাজবধূদের হঠাৎ নিয়োগের ধর্ষণতুল্য অবস্থার মধ্যে না ফেলতে। অন্তত মানসিক প্রস্তুতির জন্য তাদের কিছু সময় দিতে চেয়েছিলেন। এখানেও সত্যবতী পুত্রের অনুরোধ উপেক্ষা করেন, তিনি জানতেন ব্যস আর বৈরাগ্য সমার্থক। একবছর পরে দ্বৈপায়নের মত পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডুর জন্ম হলে একত্রে দুই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় সত্যবতীর। কুরুকুল রক্ষা পায় এবং তার জারজ প্রথম সন্তান দ্বৈপায়ন অপরিহার্য হয়ে ওঠে কুরুবংশের কাছে। লক্ষণীয় যে, সত্যবতীকে কখনোই তার প্রথম পুত্রের জন্য লজ্জিত মনে হয়নি, বরঞ্চ তিনি তার প্রথম সন্তানকে গর্বের সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর এখানেই সত্যবতী রাজমাতা হিসেবে কুন্তীর তুলনায় অনেক এগিয়ে।
গান্ধাররাজ সুবলের রাজ্যটি ছিলো পাহাড় ঘেরা। উৎকৃষ্ট পশম আর গন্ধকের রপ্তানীর ফলে গান্ধারের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়ে। গান্ধার রাজ সুবলের একশো পুত্র ও এক কন্যা। কন্যার নাম গান্ধারী, তবে সম্ভবত এটি আসল নাম নয়, গান্ধার রাজপুত্রী তাই গান্ধারী। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের উপযুক্ত কন্যা হিসেবে ভীষ্মের কাছে গান্ধারীর নাম প্রস্তাব করেন সত্যবতী। জামাই হিসেবে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সুবলের অপছন্দ হলেও হস্তিনাপুর আর ভীষ্মের মিত্রতার কথা চিন্তা করে তিনি বাধ্য হন গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্রের বধূ হিসাবে মেনে নিতে। সুবল ছাড়াও এই বিয়ে মানতে পারেননি সুবলের ছোট ছেলে শকুনিও। সত্যনিষ্ঠ গান্ধারী পতির কাছে কিছু গোপন করতে চাননি। তাই প্রথম দিনেই ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেন তাঁর পূর্বের ছাগ বিবাহের কথা। মাঙ্গলিক গান্ধারীর সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী ছিলো যে তার অকাল বৈধব্য অবসম্ভাবী। তাই সুবল গান্ধারীর সঙ্গে একটি ছাগের বিবাহ দেন ও পরে ছাগটিকে দেবীর কাছে বলি দেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ঘটনাটিকে নিজের সাথে প্রতারণা বলে মনে করেন এবং শত পুত্রসহ সুবলকে বন্দি করেন। সেখান থেকে শকুনি কিভাবে ছাড়া পেলেন সে সব অন্য গল্প কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে এরপরেও গান্ধারীর পতিপ্রেম ছিলো অক্ষুন্ন। গান্ধারী হস্তিনার মহারাণী। বিপুল তার প্রতিপত্তি, একশো মহাবল পুত্রের মাতা; অথচ তার জীবনের একমাত্র সম্বল ছিল সত্য আর ধর্ম। ধার্মিক পরিবৃত হয়ে ধর্মাচারণ করা হয়তো সহজ, কিন্তু অধার্মিকদের মধ্যে থেকে ধর্মাচারণ করতে প্রয়োজন প্রভূত মানসিক দৃঢ়তার, যা গান্ধারীর ছিলো। ধর্মের জন্য, সত্যের জন্য গান্ধারীকে আমরা মাঝেমধ্যেই পতি ও পুত্রের আচরণের প্রতিবাদ করতে দেখেছি। বাসুদেবের কাছে তাকে আক্ষেপ করতে দেখেছি বারবার। পতিব্রতা গান্ধারীর তপস্যা ছিলো তার সংযম ও ত্যাগ। তিনিই মনে হয় একমাত্র, যিনি সত্যিই চাননি যুদ্ধ হোক। যুদ্ধ শেষে তার শতপুত্র হারানোর শোক ছাপিয়ে উছলে পড়ে ক্রোধ। প্রথমবার আর শেষবারের মতো আমরা গান্ধারীকে দেখি সংযম হারাতে। বাসুদেবকে বংশনাশের শাপ দেওয়ার আগের তার প্রতিটি অভিযোগ ছিলো যুক্তিযুক্ত। বাসুদেবের পরিকল্পনা একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন গান্ধারীই। এরপর যুধিষ্ঠিরের নখ দগ্ধ করার পরে তার মধ্যে জেগে ওঠে অনুশোচনা। এতবড় শোক সহ্য করেও গান্ধারী নির্বিকার, যেমন তিনি নির্বিকার তিনি ছিলেন অধর্মের মাঝে ধর্মচারণে।
ধৃতরাষ্ট্রের ভাই এবং হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর জন্য শূরসেনের কন্যা পৃথাকে মনোনিত করেন সত্যবতী। পাণ্ডু জন্মগত হৃদরোগী হলেও, অত্যন্ত সুপুরুষ আর দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন, তাই হস্তিনার প্রতিপত্তির কথা মনে রেখে কুন্তীভোজ পৃথাকে পাণ্ডুর হাতে তুলে দেন। কুন্তীভোজের কাছে বড়ো হওয়ায় হস্তিনাপুর নববধূকে কুন্তী নামে সম্বোধিত করে। হস্তিনার সকল রাজবধূদের মতোই পৃথারও ছিলো এক গোপন অতীত।
শান্ত, ধৈর্য্যশীলা পৃথা সেবার মাধ্যমে মহর্ষি দুর্বাসাকে প্রসন্ন করে এক গুপ্তমন্ত্র লাভ করেন, যার পাঠ মাত্র মনোস্থিত দেবতা স্বয়ং সামনে উপস্থিত হয়ে পাঠককে সন্তান দান করবেন। কিশোরী পৃথা অবিশ্বাসবশত মন্ত্রপাঠ করে সূর্যদেবকে আবাহন করলে, সূর্যদেবের দয়ায় কুমারী পৃথা গর্ভবতী হন এবং এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। সত্যবতীর মতোই পৃথাও সমাজের ভয়ে প্রথমপুত্রকে গঙ্গাবক্ষে ত্যাগ করেন। এই ঘটনাটি মহাভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। পরবর্তীতেও পৃথা তার প্রথম সন্তানকে চিনতে পেরেও তার প্রকৃত পরিচয় গোপন করেন। কে বলতে পারে রঙ্গমঞ্চে যদি পৃথা কর্ণকে প্রথম সন্তান হিসেবে স্বীকার করতেন, তবে হয়তো মহাযুদ্ধের প্রয়োজন হতোই না। সে সব অনেক পরের কথা।
পাণ্ডু মৃগবেশে সঙ্গমরত কন্দম ঋষিকে হত্যা করলে সঙ্গম কালে তার মৃত্যু হবে শাপিত হন। অনুতপ্ত পাণ্ডু দুই পত্নী সহ বনগমন করেন। পৃথা রাজকন্যা, রাজবধূ হলেও অত্যন্ত আনন্দের সাথে আশ্রমিক জীবন অতিবাহিত করছিলেন। পাণ্ডুর পুত্রহীনতার কষ্ট দেখে তিনি পাণ্ডুর অনুমতিক্রমে তিনবছরে তিন দেবতাকে তুষ্ট করে তিন পুত্রলাভ করেন এবং পাণ্ডুর দ্বিতীয়া পত্নী মাদ্রীও তার কাছে পুত্র লাভের ইচ্ছা জানালে, পৃথা মাদ্রীকেও সেই মন্ত্রদান করেন। মাদ্রীর সাথে সঙ্গমকালে পাণ্ডুর মৃত্যু হলে কুন্তী সহমরণে যেতে চান, কিন্তু মাদ্রী নিজের সন্তানদের কুন্তীর কাছে রেখে সহমরণে যান। মৃত্যু কালে মাদ্রী বলেন কুন্তীর মতো সমানভাবে তিনি হয়তো সতীনপুত্রদের স্নেহ করতে পারতেন না, ...তার সেই উদারতা নেই তাই কুন্তীর জীবিত থাকা আবশ্যক।
নিজের পাঁচ সন্তানদের নিয়ে হস্তিনা ফেরার সময় থেকেই কুন্তী জানতেন যে, এবার তাকে আর তার পুত্রদের রাজবাড়ির রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হবে, অরণ্যের স্বাধীনতা এখানে নেই। তাই প্রথমেই কুন্তী যোগাযোগ করেন হস্তিনায় তার পরম বিশ্বস্ত এবং পাণ্ডুর অতিপ্রিয় ভাই বিদূরের সাথে। বিদূর আর কুন্তীর মধ্যে মহাভারতের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত মধুর। এই বিদূরের গৃহে কুন্তী একাধিকবার আশ্রয় নিয়েছেন। বিদূর স্বয়ং শাপভ্রষ্ট ধর্ম আর যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র এই প্রসঙ্গ টেনে অনেকেই যুধিষ্ঠিরকে বিদূরপুত্র অবধি বলেন।
দ্রোণের গুরুকুলে অস্ত্রশিক্ষার শেষদিন রঙ্গমঞ্চে অস্ত্রপ্রদর্শনের সময় অর্জুনকে কর্ণ যুদ্ধের আহ্বান জানালে, তার জন্মগত কবচ আর কুণ্ডল দেখে কুন্তী কর্ণকে চিনতে পারেন অথচ কর্ণের সুতপুত্র অপবাদ শুনেও এর প্রতিবাদ করেননি। একে অনেকেই কুন্তীর দোষ হিসাবে দেখেন, কিন্তু রাজবাড়িতে যখন তার নিজের ও তার স্বীকৃত পুত্রদের অধিকার সুরক্ষিত নয়, সেখানে নুতন করে আরো এক সমস্যা টেনে আনা হয়তো তার কাছে যুক্তিযুক্ত ছিলো না। কিন্তু এই যুক্তিও কুন্তীকে দোষমুক্ত করে না। কারণ কুন্তীর কাছে পরবর্তীতে অনেকবার সুযোগ ছিলো কর্ণের পরিচয় প্রকাশ্যে আনার, কিন্তু তিনি তা কর্ণের মৃত্যু অবধি প্রকাশ করেননি।
বিদূরের থেকে যুধিষ্ঠির জানতে পারেন জতুগৃহ নিয়ে দুর্যোধন আর শকুনির ঘৃন্য পরিকল্পনার কথা। জতুগৃহ দাহ হলে কুন্তী পাঁচপুত্র সহ দ্বিতীয়বার বনে আসেন, যেখানে তার সাথে দেখা করতে আসেন মহাভারতের কবি স্বয়ং। ব্যাস আর কুন্তীর কথোপকথনের অংশটুকু থেকে আমরা বুঝতে পারি কুন্তী কেবল স্নেহশীলা মাতা বা ধর্মপরায়ণা মহিলা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে প্রতিপালিত একজন রাজকন্যা, রাজবধূ ও ভবিষ্যতের রাজমাতা। কুন্তী ব্যাসকে বলেন তার এবং তার পুত্রদের এখন উভয়সঙ্কট, তারা হস্তিনায় গেলে আবার দুর্যোধনের কুটিলতার শিকার হবেন, আর বনে আছেন জানলে তাদের গুপ্তহত্যা করা হবে। তাদের প্রয়োজন কোনও বলবানের সহায়তা। গান্ধারীর মতো কুন্তী ধর্ম বা সত্যনিষ্ঠ হয়তো ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন দক্ষ কূটনিতীজ্ঞ। দ্রুপদ রাজার কন্যার সয়ম্বরের খবর পেয়ে পাণ্ডবরা দ্রুপদ রাজ্যে গেলে তাদের আশ্রয় দেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। সেখানে বক রাক্ষসের অত্যাচার থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য কুন্তীই ভীমকে বককে বধ করতে পাঠান। আবার হিড়িম্বা ভীমকে বিয়ে করতে চাইলে সবার আগে সম্মতি দেন কুন্তীই। সয়ম্বরে অর্জুন দ্রৌপদীকে লাভ করলে কুন্তীই ভুলবশত(?) তাকে পাঁচভাইকে বিয়ে করতে নির্দেশ দেন। এই সময় প্রথমবার বাসুদেবের আবির্ভাব হয় মহাভারতের মঞ্চে। বাসুদেবের পিসি ছিলেন কুন্তী। এরপর বাসুদেব জড়িয়ে পরেন পাণ্ডবদের সাথে। ইন্দ্রপ্রস্থের মতো রাজধানী, রাজমাতার সম্মান, পঞ্চপুত্রের সঙ্গ সব ছেড়েও যখন তাকে বিদূরের গৃহে আশ্রয় নিতে হয়, তখনো তিনি নির্বিকার থেকেছেন। যুধিষ্ঠিরের হঠকারিতাকে দোষারোপ করেননি। শুধু চেয়েছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র সহদেব তার কাছে থাকুক। সতীনপুত্রের প্রতি বিমাতার এই স্নেহ দুর্লভ। ভাবতে অবাক লাগে একই মহিলার মধ্যে এ কেমন পরস্পর বিরোধী চরিত্র। কর্ণ আর সহদেব দুজনের জন্য পৃথক আচরণ তার চরিত্রটিকে বড় অদ্ভুত বানিয়ে দেয়। আজ্ঞাতবাস শেষ হলে যখন দূত মুখে কুন্তী খবর পান তার পুত্ররা বিরাট রাজ্যে আছেন তখন তিনি দূতকে বলেন যুধিষ্ঠিরকে বলতে, তিনি সমর্থ পাঁচপুত্রের জননী হয়েও পরগলগ্রহ, পরান্নভোজী। যুধিষ্ঠিরের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজ্য উদ্ধার করে মাতৃঋণ শোধ করা।
যুধিষ্ঠির যুদ্ধ এড়াতে পাঁচটি মাত্র গ্রাম চাইলে কুন্তী তাঁকে নপুংশক স্বভাব ত্যাগ করে বল ও বীর্য প্রকাশ করে অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। দ্রৌপদীর মতো কুন্তীও বাসুদেবকে বারবার বলেছেন যেন যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের আগে কুন্তী কর্ণের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন... কর্ণ অবশ্য তার অনেক আগেই জানতেন নিজের আসল পরিচয়। কুন্তী তাঁকে পাণ্ডবপক্ষে আহ্বান করেন, জেষ্ঠপুত্র হিসেবে সিংহাসনের প্রলোভন দেন এবং অবশেষে অর্জুন ছাড়া বাকি চারপুত্রের জীবন সুরক্ষিত করে ফেরেন। সেদিন মাতা কুন্তী নয়, কূটনিতীবিদ কুন্তী গিয়েছিলেন শত্রুপক্ষের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে মানসিকভাবে দুর্বল করতে।
মহাযুদ্ধ চলাকালীন কুন্তী ছিলেন বিদূরের আশ্রয়ে। যুদ্ধের শেষে সকল কুরুনারীদের সাথে তিনিও এসেছিলেন রণভূমিতে। মৃত যোদ্ধাদের সৎকারের সময় তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেন কর্ণের পরিচয়। গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্র, বিদূরের সাথে কুন্তীও বানপ্রস্থে যান। রাজমাতার সুখভোগের থেকেও স্বীকৃতিলাভ তার কাছে মুখ্য ছিলো।
ক্রমশঃ