প্রাচীন কথা - ঋত্বিক ঘটক ও সৌহার্দ্য সেন
Posted in প্রাচীন কথাশিক্ষা পর্ব
মহাভারতের সমাজ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো শিক্ষা ব্যবস্থা। সমাজে গুরুকুলের একটি সম্মানজনক অবস্থান ছিলো। এই গুরুকুলগুলি মূলত একজন বিখ্যাত গুরুর নামে হলেও শিক্ষা একজন গুরু দিতেন না। বিভিন্ন গুরুকুলগুলি বিভিন্ন প্রকার বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো। কয়েকটির তো একান্ত নিজস্ব এবং গোপনীয় শিক্ষাও ছিলো। বিভিন্ন প্রদেশের শাসনব্যবস্থার ছাপ তাদের গুরুকুলগুলির ওপরেও পড়তো। পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও গুরুকুলগুলির ওপর রাজার অধিকার ছিলো না। বরঞ্চ রাজসভায় গুরুকুলগুলির প্রভাব যথেষ্ট ছিলো।
শিক্ষার ধরণ অনুসারে তৎকালীন গুরুকুলগুলিকে মূলত তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলি যথাক্রমে বৈদিক শিক্ষার গুরুকুল, অস্ত্র শিক্ষার গুরুকুল, ও উভয় শিক্ষার গুরুকুল একত্রে। এছাড়াও অপ্রচলিত গোপন শিক্ষার জন্যও কিছু কিছু সম্প্রদায়ের নিজস্ব গুরুকুল ছিলো।
বৈদিক শিক্ষার গুরুকুলগুলি সাধারণত নগর থেকে দূরে বনমধ্যে হতো। এই গুরুকুলগুলি প্রধানত ব্রাহ্মণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এখানে বেদের গভীরতর ও সূক্ষতম বিষয়গুলি ছাত্রদের অধ্যয়নের বিষয় ছিলো। মহাভারতের লেখক স্বয়ং এমনই এক গুরুকুলের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। এই গুরুকুলগুলিতে একাধিক ঋষি একত্রে ছাত্রদের বৈদিক জ্ঞান দান করতেন।
মনে রাখতে হবে যে, তখনও বেদ লিপিবদ্ধ হয়নি তাই এই সব ঋষিদের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে বেদ গুরু শিষ্য পরম্পরায় প্রবাহিত হতো। ব্যস স্বয়ং বেদ বিভাজনের পর তা নিজের চার শিষ্যর মধ্যে ভাগ করে দেন যার মধ্যে একজন আবার তার পুত্র স্বয়ং। অর্থাৎ গুরুর জ্ঞান কেবল তার উপযুক্ত শিষ্যদের মধ্যে দিয়েই যেন সমাজ জীবনে প্রয়োগ হয়, এ ব্যপারে গুরুরা যথেষ্ট সচেতন থাকতেন। শিষ্যদের তার জ্ঞান বহনের উপযুক্ত কিনা তার জন্য কঠোর পরীক্ষা নেওয়া হতো। এই পরীক্ষা এখনকার নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট বিষয়ের পরীক্ষা নয়। এই পরীক্ষা, শিষ্যের চরিত্রের পরীক্ষা, বিশ্বাস ও আনুগত্যের পরীক্ষা।
ঊদ্দালকের ঘটনা প্রমাণ করে যে, একজন উপযুক্ত শিষ্য কেমন হবেন। শুধু উদ্দালকই নয়, এরকম পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সকলকেই। তা সে দ্রোণের কাছে অর্জুনই হন বা সন্দীপনীর গুরুকুলে বাসুদেব, প্রত্যেককে শিক্ষার গূঢ়তম পর্বের জন্য নিজের বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হয়েছে।
বৈদিকগুরুকুলগুলি মূলত ব্রাহ্মণদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও এখানে উচ্চবর্ণের ক্ষত্রিয়রাও বেদ শিক্ষার জন্য আসতো। গুরু তার শিষ্যদের মধ্যে থেকেই বেছে নিতেন পরবর্তী গুরু কে হবেন। গুরুকুলগুলিতে শুধু বেদ শিক্ষাই দেওয়া হতো না, এর পাশাপাশি চলতো চরিত্রগঠনের কাজ। রাজপুত্রকেও দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানের সাথে কাঠ সংগ্রহ, গুরুর সম্পত্তি রক্ষা, গোচারণ, এমনকি প্রয়োজনে ভিক্ষাও করতে হতো। শিক্ষা সম্পন্ন হলে গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিষ্যরা নিজ নিজ কর্ম করতে পারতো। শিষ্যরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রদেশে নিজস্ব গুরুকুল শুরু করে বৈদিক শিক্ষা ও পূর্বতন গুরুর দর্শনের প্রসার করতো। এভাবেই অনেকগুলি গুরুকুল একত্রে অনেকটা এখনকার বৈঠকের কায়দায় বিভিন্ন বিতর্কিত ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারের সিদ্ধান্ত নিতো। আবার বিভিন্ন গুরুকুলের মধ্যে বর্তমান ছাত্র আদান প্রদানের মতো শিষ্য আদানপ্রদানেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক গুরুকুলগুলির মধ্যে পরস্পরিক প্রতিদ্বন্দিতাও চলতো। রাজারা বিশেষ বিশেষ পর্ব বা যজ্ঞ উপলক্ষে বিতর্ক সভা আয়োজন করতেন। এই বিতর্ক সভাগুলি যেমন বিজয়ীকে শ্রেষ্ঠ বৈদান্তিকের স্বীকৃতি দিতো, তেমনই উক্ত রাজার অনুষ্ঠানকেও অমর করে রাখতো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গুরুশিষ্য পরম্পরায়। মহাভারতের বিভিন্ন সময় আমরা বৈদিক পাঠশালাগুলির বারংবার উল্লেখ পাই।
অস্ত্রশিক্ষা তৎকালীন সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই অস্ত্র শিক্ষার জন্য আলাদা গুরুকুল ছিলো। এই গুরুকুলগুলি নগরের আশেপাশেই হতো সাধারণত। কারণ, পর্বতশিখরে বা অরণ্যমধ্যে অস্ত্রের যোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য ছিলো। এই গুরুকুলগুলিতে শিক্ষার প্রধান বিষয় হতো সাধারণত ধর্নুবেদ, অসিকলা, মল্লযুদ্ধের রীতিনীতি ও বিভিন্ন দৈবাস্ত্র।
মহর্ষি অগ্নিবেশ ছিলেন এই ধারার গুরুকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।মহাভারতের দুই স্থানে তাঁকে ধর্নুবেদের শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক এই উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য দুটি ঘটনার সাথেই জড়িয়ে আছেন মহর্ষি অগ্নিবেশের সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য ও পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের নাম। মহাভারতের আগে(?) রামায়ণেও আমরা এই ধরণের বিশেষ অস্ত্র শিক্ষার গুরুকুলের উল্লেখ পাই দুইবার। প্রথমবার শ্রীরাম ঋষি বিশ্বামিত্রর সাথে ওঁর আশ্রমে যাওয়ার প্রাক্কালে ঋষি বশিষ্ট দশরথকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে উপনীত হওয়া এই ঋষি একজন শ্রেষ্ঠ অস্ত্রবিদ ও অস্ত্রগুরু তাই দশরথ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। দ্বিতীয়বার এর উল্লেখ পাই চর্তুদশ বর্ষব্যপী বনবাস কালে। এখানে শ্রীরাম ঋষি অগস্তের আশ্রমে আশ্রয় নেন, যেটি আসলে ছিলো এক এরকমই অস্ত্র শিক্ষার কেন্দ্র। ঋষি অগস্তের আশ্রম শুধু অস্ত্র শিক্ষার কেন্দ্রই ছিলো না, সাথে অস্ত্র তৈরির কারখানাও ছিলো এবং সম্ভবত সেটাই স্বাভাবিক ছিলো; কারণ, গহীন বনের মধ্যে বাইরে থেকে অস্ত্র সংগ্রহ সম্ভব ছিলো না। এখান থেকেই শ্রীরাম তাঁর কোদণ্ড ধনুক সংগ্রহ করেছিলেন এবং ঋষি অগস্তের থেকে বল-অতিবল নামক এক বিদ্যা শিখেছিলেন যার প্রভাবে নিজের সমস্ত অস্ত্রজ্ঞান একটি মাত্র অস্ত্রে কেন্দ্রীভূত করা সম্ভব হতো। অগস্তের গুরুকুলের শিষ্যদের পরাক্রমের ফলে বনের সেই বিশেষ অংশে রাক্ষসদের অত্যাচার কম ছিলো। রামায়ণ ছেড়ে মহাভারতের ওপর নজর ঘোরালে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে গুরুকুলটি আমাদের নজরে আসে, তা হস্তিনাপুরে দ্রোণাচার্যের গুরুকুলটি। এটি প্রথমে কৃপাচার্যের গুরুকুল থাকলেও পরে তার ভগ্নীপতি এর প্রধান অধ্যাপক নিযুক্ত হন ভীষ্মের আদেশে। এখানে লক্ষণীয় গুরু দ্রোণ প্রধান গুরু হলেও কৃপাচার্যের ক্ষমতা হ্রাস হয়নি, তিনি পূর্ববৎ গুরুর সম্মান পেতেন শেষ দিন অবধি এবং পাণ্ডবদের বেদ শিক্ষা দিতেন। দ্রোণাচার্যের গুরুকুলের বিশেষত্ব ছিলো ধর্নুবেদ। তিনি নিজেও যত দক্ষ ধনুর্ধর ছিলেন, ওঁর শিষ্যরাও ছিলেন ততই পরাক্রমী।
বিভিন্ন অস্ত্রগুরুকুল প্রসিদ্ধ ছিলো বিভিন্ন বিশেষ গোপনীয় অস্ত্রবিদ্যার জন্য। হস্তিনাপুরের এই গুরুকুলটির স্পেশালাইজেশন ছিলো ব্রহ্মগ্রোত্রের অস্ত্র সমূহ এবং এই গোত্রের সর্বোচ্চ অস্ত্র ছিলো ব্রহ্মশির। গুরুকুলগুলির শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুলি সবার শেষে শ্রেষ্ঠ শিষ্যদের হাতে তুলে দেওয়া হতো। তার আগে নেওয়া হতো পরীক্ষা। দ্রোণের গুরুকুল থেকে নিজ যোগ্যতায় এই অস্ত্র লাভ করেন একমাত্র অর্জুন। দ্রোণ পুত্রস্নেহে অযোগ্য অশ্বত্থামাকে এই অস্ত্র দেওয়া পরে এত বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলো, যা যোগ্য শিষ্যের হাতেই শিক্ষা সম্প্রদানের যুক্তিকেই দৃঢ় করে। মহাভারতের ঘটনা পরম্পরায় আরো অনেক অস্ত্র শিক্ষার গুরুকুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন দ্বারকায় বলরামের নিজস্ব গুরুকুল ছিলো গদাযুদ্ধের কৌশল শেখানোর, মদ্র ও কাশীর অস্ত্র শিক্ষার কেন্দ্রগুলির স্পেশালাইজেশন ছিলো অসি যুদ্ধ, বিরাট রাজ্যের গুরুকুলগুলিতে ভল্ল ও মল্লযুদ্ধের কৌশল শেখানো হতো।
বৈদিক শিক্ষা এবং অস্ত্রশিক্ষা একসাথে শেখানোর মতো গুরুকুল সংখ্যায় কম হলেও বেশ কয়েকটি ছিলো। এই ধারার গুরুকুলগুলির মধ্যে প্রধান ছিলো ভগবান পরশুরামের ভার্গব গুরুকুল। এই জাতীয় গুরুকুলগুলিতে অস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি বৈদিক শিক্ষাতেও জোর দেওয়া হতো। নগর জনবসতি থেকে সাধারণত অনেক দূরে এই শ্রেণীর গুরুকুলগুলি স্থাপিত হতো। শ্রীকৃষ্ণের গুরু সন্দীপনী ঋষির আশ্রমটিও এরকমই মিশ্র শিক্ষার গুরুকুল ছিলো। ভগবান পরশুরাম তার গুরুকুলটি শুধু ব্রাহ্মণদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখলেও যোগ্যতা বিচারে কয়েকজন ক্ষত্রিয় তার শিষ্যত্ব পেয়েছিলেন। এই গুরুকুলগুলিতে বিভিন্ন দৈবাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হতো। গুরু দ্রোণ ঋষি অগ্নিবেশ এর কাছে ধর্নুবিদ্যা শিক্ষা করলেও দিব্যাস্ত্রগুলির শিক্ষা লাভ করেন ভগবান পরশুরামের কাছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে দ্রোণাচার্য তার পরশুরামের থেকে সব দিব্যাস্ত্র পেলেও ভার্গব গুরুকুলের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ভার্গবাস্ত্র পাননি। তিনি দক্ষ ধনুর্ধর এবং ব্রাহ্মণ হলেও যেহেতু তিনি এই গুরুকুলের ছাত্র ছিলেন না তাই তাঁর চরিত্র সম্পর্কে পরশুরাম নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। ঋষি সন্দীপনী ছিলেন দক্ষ বেদজ্ঞ। তার গুরুকুলে বেদ শিক্ষা দেওয়া হতো প্রাথমিকভাবে কিন্তু অব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শিষ্যদের তিনি ধর্নুবেদের পাঠ ও দিতেন। সন্দীপনীর গুরুকুল থেকে বাসুদেব, বলরাম ছাড়াও সাত্যকি, কৃতবর্মার মতো বীর যোদ্ধাও এসেছিলেন। যদিও সাত্যকি পরে অর্জুনের থেকে দিব্যাস্ত্র শিক্ষা সম্পন্ন করেন। সন্দীপনীর গুরুকুল ছাড়াও যাদবদের বেশ কিছু নিজস্ব গোপন গুরুকুল ছিলো।
উপরিউক্ত তিনপ্রকার প্রধান গুরুকুল ছাড়াও বেশ কিছু অপ্রচলিত শিক্ষার, গোপন শিক্ষার গুরুকুল ছিলো। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিষাদ ও রাক্ষসগনের নিজস্ব গুরুকুল। হতভাগ্য একলব্যকে দ্রোণাচার্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে দেখে আমাদের মনে হতেই পারে নিষাদরা অস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলো বা তাদের গুরুকুল ছিলো না; কিন্তু আদপেই তা নয়। নিষাদগণের কাছে ধর্নুবেদ না থাকলেও এরা ধর্নুবিদ্যায় বিশেষ দক্ষ ছিলো। এরা ধাতু নির্মিত বিশেষ নারাচ বাণের আবিস্কার করেছিলো। পরে এই নারাচ বাণ দিয়েই অর্জুন দ্রোণকে কুম্ভীর মুক্ত করে পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়েছিলেন। ধনুক অস্ত্রটির প্রয়োগ ও আর্যরা এই নিষাদগণের কাছেই শিখেছিলেন বলেও অনেকে মনে করেন। যাই হোক এই নিষাদ গুরুকুলগুলি প্রধানত মগধ রাজ্যের আশেপাশে ছিলো কারণ মগধরাজ জরাসন্ধ এই নিষাদকুলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই গুরুকুলগুলিতে সাধারণ ধর্নুবিদ্যার পাশাপাশি বিভিন্ন গোপন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো; যেমন, বিষবিদ্যা, আয়ুর্বেদ, অশ্বহৃদয় প্রভৃতি। এছাড়াও ছিলো রাক্ষসগণের নিজস্ব গুরুকুল এই গুরুকুল প্রচলিত অস্ত্র শিক্ষাতো দিতোই, তার সাথে গুপ্ত বিদ্যা হিসেবে দিতো সম্মোহন এবং মায়া রচনার জ্ঞান। এইগুরুকুল গুলি সাধারণভাবে বেদবিরোধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো। তবে ব্যতিক্রম ও লক্ষ্য করা যায়।
গুরুকুলগুলি বৈদিকশিক্ষার হোক বা অস্ত্রশিক্ষার আশ্রমের মধ্যে গুরুর ক্ষমতা ছিলো সর্বোচ্চ। গুরুকুলগুলি ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিলো। কোন শিষ্য কতদিনে শিক্ষা সম্পূর্ণ করবে অর্থাৎ গুরুর থেকে সম্পূর্ণ শিক্ষা লাভ করবে তা নির্ভর করতো সম্পুর্ণভাবে গুরুর ওপর । শিক্ষা দানের সময় ধনী- দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বিচার করতেন না গুরু। এছাড়াও গুরুর আশ্রম থেকেই নৈতিক চরিত্র গঠনের কাজ শুরু হতো। যে ব্যক্তি ভবিষ্যতে বিভিন্ন শক্তিশালী অস্ত্র ও প্রভাবশালী জ্ঞান বহন করবেন তার জন্য এই চরিত্র গঠন খুব প্রয়োজনিয় ছিলো। একজন রাজপুত্রও এই গুরুকুলে থাকার সময়েই শিখতো কিভাবে সাধারণ প্রজারা জীবন ধারণ করেন, কিভাবে খাবার ভাগ করে নেয় পরিবারের সাথে। এই শিক্ষাগুলিই পরবর্তীতে সিংহাসনে বসার পর তাকে দক্ষ রাজা বানাতো। এই শিক্ষাগুলি মনে রেখে কৃষ্ণ সুদামাকে চিনতে ভুল করেননি তাই শাসক হিসেবে কৃষ্ণ মহান, অথচ এই শিক্ষা ভুলে গিয়ে দ্রুপদ ডেকে আনেন রাজ্যের ওপর বিপদ।
গুরুকুলে শুধু গুরু না গুরুপত্নীও সমান ভাবে সম্মানীয় হতেন। তাঁরা মাতৃসম্বোধিত হতেন এবং শিষ্যদের পুত্রবৎ দেখতেন। গুরুর অবর্তমানে গুরুপত্নীই আশ্রমের সর্বেসর্বা ছিলেন। কখনো কখনো এই গুরুপত্নীদের ও শিক্ষয়ত্রীয় আসনে দেখা যেত, যেমন অরুন্ধতি।
গুরুকুলগুলিতে নিয়ম বানানো হতো গুরুর ইচ্ছানুসারে এখানে রাজার কোনো নিয়ম না খাটলেও একটা প্রভাব অবশ্যই পড়তো। গুরু দ্রোণ কেবল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং রাজসন্তানদের শিক্ষা দিতেন। পরশুরামের গুরুকুল ছিলো কঠোরভাবে ব্রাহ্মণদের জন্য। গঙ্গার অনুরোধে পরশুরাম ক্ষত্রিয় দেবব্রতকে অস্ত্র শিক্ষা দিলেও তার সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও ভার্গবাস্ত্র দেননি। কর্ণকেও ভগবান পরশুরামের শিষ্য হতে মিথ্যা পরিচয় দিতে হয়েছিলো। তাঁর নিষ্ঠা, দক্ষতা দেখে এবং প্রকৃত পরিচয় না জানার জন্য ব্রাহ্মণভ্রমে পরশুরাম তাকে ভার্গবাস্ত্রের জ্ঞান দান করেছিলেন। তবে মগধের ও কাশীর গুরুকুলগুলিতে সবার শিক্ষাগ্রহণের অধিকার ছিলো। মগধের গুরুকুলে নিষাদ, সুত ও শূদ্র শিষ্যের সংখ্যা লক্ষণীয় ছিলো। তবে এই সব গুরুকুলগুলিতে বৈদিক শিক্ষা দেওয়া হতো না। কাশী মর্ত্যের শিবলোক হওয়ায় এখানে কোনও জাতিভেদ ছিলো না, এখানেই একমাত্র অব্রাহ্মণদের বেদ শিক্ষার অধিকার ছিল। মহাভারতের কবি স্বয়ং এই বিষয়ে কাশীবাসিদের বিরোধিতা করেন এবং নিজেই নাকাল হন। কাশীর গুরুকুলে বেদ ছাড়াও বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যা, গুপ্ত উপাচারের শিক্ষা দেওয়া হতো। যাদবদের মধ্যে সন্দীপনীর গুরুকুল প্রসিদ্ধ হলেও এদের কিছু নিজস্ব ও রহস্যময় গুরুকুল ছিলো যেখানে নারায়ণী সেনাদের শিক্ষা দেওয়া হতো। ভয়ঙ্কর এই গোপযোদ্ধাদের শেখানো হতো চাকা জাতিয় অস্ত্র চালনার বিশেষ কৌশল, বিভিন্ন ব্যুহ রচনার কৌশল, রথচালনা, অশ্বহৃদয় প্রভৃতি। অপ্রচলিত অস্ত্রচালনার শেখানোর জন্য এবং গদাযুদ্ধের কৌশল শেখানোর জন্য বলরামের একটি আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিলো। ভীম, দুর্যোধন ছাড়াও শাম্বও বলরামের কাছে গদাযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধ শেখেন। তবে মল্লযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলো মগধ। ভীম কীচকের লড়াইয়ের সময় দুই পৃথক কৌশলের মল্লযোদ্ধার লড়াই দেখা যায়। মগধের কৌশল বিরাটের কৌশলের থেকে অনেকবেশি আক্রমণাত্মক হতো।
গুরুকুলগুলি যে গোত্রেরই হোক গুরু হতেন সাধারণত ব্রাহ্মণরাই। একমাত্র নিষাদ আর রাক্ষসদের গুরুকুলগুলিই এর ব্যতিক্রম ছিলো। গুরুকুলে নারীদের সাধারণত শিক্ষা নিতে দেখা যেত না, তবে এর অনেক ব্যতিক্রমও ছিলো। মণিপুর, প্রাগজ্যোতিষ, গান্ধার প্রভৃতি অঞ্চলের আশ্রমগুলিতে নারীরাও অস্ত্র, রাজনীতি ও সমাজনীতির পাঠ নিতো। তবে মহাভারতে নারীদের বেদপাঠের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
গুরুকুলের শিক্ষাসম্পন্ন হলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈদিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিতর্ক সভা ও অস্ত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে রঙ্গমঞ্চে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো যেখানে শিষ্যরা নিজেদের জ্ঞান ও বাহুবল প্রদর্শন করতো। এটি একাধারে গুরু শিষ্য উভয়ের প্রতিভার বিজ্ঞাপন ছিলো। গুরুকে গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিষ্যরা গুরুগৃহ ত্যাগ করতো। এই গুরুদক্ষিণা ব্যপারটি ছিলো বেশ গোলমেলে। গুরুদক্ষিণার বিনিময়ে গুরু যা কিছু চাইতে পারতো। লেজকালো শরীর সাদা একহাজার ঘোড়া থেকে শুরু করে শিষ্যের বৃদ্ধাঙ্গুলি পর্যন্ত এই তালিকায় আছে। তবে সাধারণত গুরু নিজে যে সব অর্জন করতে পারেননি সেগুলিই শিষ্যদের অর্জন করার আদেশ দিতেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এগুলি ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার ও প্রথা প্রচলিত ছিলো। গুরুদক্ষিণা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় সম্ভবত দ্রোণ ও একলব্যের ঘটনাটি। দ্রোণের কুরুকুলের কাছে চাওয়া গুরুদক্ষিণার ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য, এই ঘটনার মধ্যেই ভবিষ্যতের মহাযুদ্ধের বীজ লুকিয়েছিলো। দ্রোণশিষ্যদের কাছে পরাস্ত দ্রুপদ দ্রোণবধের জন্য পুত্রলাভ করেছেন জেনেও সেই পুত্রকেও অস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন দ্রোণ স্বয়ং। এই ঘটনা একজন গুরুর কর্তব্য পরায়ণতার পরিচয় বহন করে।
পরিশেষে বলা যেতে পারে শস্ত্র হোক বা শাস্ত্র গোপন ও শক্তিশালী শিক্ষাগুলি গুরুশিষ্য পরম্পরায় প্রবাহিত হওয়াই গুরুকুলগুলির ভূমিকা উপেক্ষা করে মহাভারত পর্ব লেখা একেবারেই সম্ভব নয়।
শাসন
এ এমন এক দেশের গল্প, যেখানে গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র সবাই থাকতো এক ছাতার তলায়। এমন এক সময়ের গল্প, যখন ঘরে ঘরে তৈরী হতো 'রাজা'। যখন সামান্য কাঠুরে থেকে শুরু করে জেলে গোষ্ঠীর প্রধান, এমনকি দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত সবাই রাজা। এদেশে অনার্য মাইমল রাজা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে নির্দ্বিধায় শর্ত দেন আর্য রাজা শান্তনুকে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখতে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র যুদ্ধের ফাইফরমাস খাটেন। এ গল্প মহাভারতের।
কবি বলেছেন, "মহাভারতের কথা অমৃত সমান, কাশীরাম দাশ কহে শোনে পূণ্যবান।" তবে আমি মনে করি, যেই বলুন না কেন, শুধুমাত্র পূণ্যবান না, 'অমৃত সমান' এই কথা শোনার জন্য ধৈর্য্যবান হওয়াও একান্ত আবশ্যক।
ক্লাস ইলেভেনে যখন প্রথমবার রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরবই হাতে নিই, আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, রামায়ণ-মহাভারতের মতো ধর্মগ্রন্থগুলো ধৈর্য্য ধরে পড়লে এইসব বিরক্তিকর পাঠ্যপুস্তক পড়ার কোনো প্রয়োজনই হয় না। সদ্য পাখনা গজানোর বয়সে সে কথায় কান না দিলেও উড়তে উড়তে যখন এক জায়গায় থিতু হলাম, বুঝলাম সেই মহাভারতের বিশাল বৃক্ষশাখাতেই আশ্রয় পেয়েছি। তাই আজ মহাভারতের রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসে পাকেচক্রে পড়ে গিয়ে সেই শিক্ষকের কথা মনে পড়লো।
যাইহোক, কাজের কথায় আসি।
মহাভারতের রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসে, ওই সময়ের সমাজ ও জীবনযাত্রা বিশ্লেষণ করে আমরা কিন্তু শুধুই রাজতন্ত্র পাই না। বরং ওই ঘরে ঘরে রাজা জন্মানোর যুগেও বেশ কিছু সমৃদ্ধশালী, বিখ্যাত ও সামরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উল্লেখ ও পাওয়া যায়। বিশিষ্ট পণ্ডিতরা অবশ্য এগুলির শাসনতন্ত্র বিচার করে, এদের 'গণতন্ত্র' না বলে 'প্রজাতন্ত্র' বা Republic বলার পক্ষপাতি। আমরাও তাই এখানে প্রজাতন্ত্রই বলছি। তবে রাজনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা রাজতন্ত্র থেকেই শুরু করবো।
বাবার মৃত্যুর পর ছেলে রাজা হয়। ছেলে না থাকলে রাজ্য পায় মেয়ে বা মেয়ের স্বামী। কোনো ব্যতিক্রমী রাজা অপুত্রক অবস্থায় বা ছেলের অযোগ্যতার কারণে ইচ্ছামতো পছন্দের পাত্রকে রাজ্যপাট সঁপেন। আর পুত্র যদি ব্যতিক্রমী হন, তাহলে বাবাকে হত্যা বা বন্দী করে রাজত্ব হাতে নেন। ক্ষমতা, বুদ্ধি আর লোকবল থাকলে রাজা আশপাশের রাজ্যকে দখল করে, সম্রাট হন।
রাজতন্ত্রের এই চিরকালীন ও সহজ নিয়মেই মহাভারত-পূর্ব সমাজ চলে আসছিল। সেযুগে হাজারে হাজারে রাজা ছিল। অনার্য মাইমল, কাঠুরে, কিরাত, নাগ, এমনকি আর্য্য কুরু, পাঞ্চাল সবাই রাজা। মানব উগ্রসেন, কংস, জরাসন্ধ যেমন রাজা, দেবতা ইন্দ্র, বরুণ, যমও তেমনি রাজা। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বুদ্ধের সময় শুধুমাত্র বৈশালীতেই সাড়ে সাত হাজারের বেশি রাজা ছিলেন! এ থেকে একটা কথাই ধারণা করা যায়, সেযুগে প্রতিটি ছোট ছোট গোষ্ঠীপতিকেই 'রাজা' নামে অভিহিত করা হয়।
মহাভারতে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সময় বলেন, এ ভারতের ঘরে ঘরে রাজা আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ রাজ্যের হিত সাধন করে থাকেন- “গৃহে গৃহে হি রাজানঃ স্বস্যস্বস্য প্রিয়ঙ্করাঃ।” এ কথা প্রমাণ করে, শুধু মহাভারত পূর্ব সমাজেই না, যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকালে ও ছোট ছোট গোষ্ঠীপতিরা রাজার সম্মানই পেতেন। আর তাই রাজারাও নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় একাই দেশভ্রমণে বেরোতে পারতেন।
যেমন শান্তনু বেরিয়েছিলেন। আর এই শান্তনুর হাত ধরেই কুরু বাড়িতে কূটিল রাজনীতির প্রবেশ হয়েছিল। দেশভ্রমণ করতে গিয়ে মাইমল সুন্দরী সত্যবতীর প্রেমে পড়েন শান্তনু, বিয়ের প্রস্তাবও দেন। আর এখানেই রাজনীতির কূটিল চালটি চালেন সত্যবতীর বাবা। যুবরাজ দেবব্রতকে দিয়ে সিংহাসন না চাওয়া ও বিবাহ না করার ভীষণ প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়ে মেয়ের ও ভবিষ্যৎ নাতি-পুতির জীবনের ভিত শক্ত করে দেন মাইমল রাজ। এখানে লক্ষণীয় যে, মাইমল রাজ বুঝেছিলেন, ক্ষমতাশালী কুরুরাজ শান্তনুকে না চটিয়ে একইঙ্গে নিজের মেয়ের ও সর্বোপরি গোটা মাইমল সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর আসবে না। তাই তিনি এই কঠিন শর্ত রাখেন। এখানে রক্তপাতহীন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের একটি ইঙ্গিত পাওয়াযায়।
যাইহোক, এ গল্পের পরবর্তী ঘটনা বলার জায়গা এটা নয়, তবে এখানে এই কাহিনী বলার কারণ হলো, লক্ষ্য করুন, বিখ্যাত আর্য রাজা শান্তনু বা তাঁর চেয়েও বিখ্যাত যুবরাজ দেবব্রত কিন্তু এক অখ্যাত মাইমল রাজার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়েছেন। এটি শুধুমাত্র মাইমল সম্প্রদায়কে হাতে রেখে রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছাই প্রকাশ করেনা, বরং সামনে আনে আরেকটি সত্য- প্রতিটি গোষ্ঠীপতিই রাজা হওয়ায় তাঁরা তখনো রাজকীয় সম্মান লাভ করেননি। আসলে সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের ধারণা তখনও প্রচলিত না হওয়ায়, রাষ্ট্র শাসকের ব্যাপক সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা জনমানসে স্থান পায়নি।
বেশ কিছু প্রাচীন গ্রন্থে রাষ্ট্রকে সমাজ বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক কালে কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস্ প্রমুখ এই মতকে সমর্থন করে বলেছেন, অনন্তকাল ধরে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিলনা। রাষ্ট্র ছাড়াই অনেক সমাজ চলতো। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তরে সামাজিক শ্রেণীবিভাগ তৈরী হলে, রাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিগঠিত হয়। মহাভারতে ক্ষুদ্রক মালব, উত্তর মদ্র প্রভৃতি স্থানে এরূপ রাজ্য দেখা যায়।
মহাভারতের শান্তি পর্বে, অর্থশাস্ত্রে বা বৌদ্ধ দর্শনে রাষ্ট্রকে সম্মিলিত চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট এক স্বেচ্ছামূলক সংগঠন হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ এই সময় সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট রাষ্ট্রে বহুরাজার অস্তিত্ব অস্বাভাবিক ছিল না। আধুনিক কালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন রল্সের মতো ব্যক্তিত্ব এই মতবাদকে সমর্থন করেছেন। তবে সমস্ত দেশের সর্বময় কর্তার ধারণা সর্বপ্রথম ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পায় ভীষ্মের সেনাপতিত্বের সময়।
এই সময়ের কৌরব সাম্রাজ্যকে আজকের ভারত বা ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এই দেশগুলিতে যেমন একজন রাষ্ট্রপতি বা রাজা-রাণী শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে আসীন থাকেন, কিন্তু রাজ্য আসলে চালান প্রধানমন্ত্রী। তেমনি বিচিত্রবীর্য্য বা পাণ্ডু, রাজা যেই হোন, রাজ্য চালাতেন সেই ভীষ্ম। ধৃতরাষ্ট্র রাজা হওয়ার পরও শুরুর কিছুদিন ভীষ্ম ও বাকি সময়টা দুর্যোধন এই পরোক্ষ রাজার ভূমিকা পালন করেন। এরকম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরস্থ করদ রাজ্যগুলির রাজারা সম্রাটকে নির্বাচন করতেন। সম্রাট নির্বাচনের অধিকার জনগণের ছিল না। যেমন আধুনিক ভারতে প্রধানমন্ত্রী জনতার দ্বারা নির্বাচিত না হয়ে, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের দ্বারা নির্বাচন লাভ করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কয়েক হাজার বছরের পুরনো কয়েকটি রাজতন্ত্রের সঙ্গে কয়েকটি অত্যাধুনিক গণতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের তুলনা কেন করছি? উত্তরে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা ধার করে বলা যেতেই পারে, গণতন্ত্রের মধ্যেও কিন্তু প্রভাবশালীর রাজতন্ত্র বর্তমান। আজকের বিশ্বে একটি সুস্থ গণতন্ত্র বা জনদরদী রাজতন্ত্রের সন্ধান করা আর সাম্যবাদী বিশ্বের স্বপ্ন দেখা প্রায় সমান।
তৎকালীন রাজতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে বর্তমান যুগের শাসনব্যবস্থাগুলির প্রধান তফাৎ হলো এগুলির অন্তর্গঠনে। আজকের শাসনব্যবস্থায় রাজা ও তাঁর সহকারী মন্ত্রীসভা যেমন শুধুই গণভোটে বিজয়ী দল থেকে নির্বাচিত হন, মহাভারতের সমাজে এর বিপরীত এক অবস্থা পরিলক্ষিত হয়, এখানে রাজার সহকারী মন্ত্রী সভার মধ্য তাঁর Supporter ও Opposition দুই দলই স্থান পেতেন। কখনো আবার ওই মন্ত্রীসভার মধ্যে থেকেই কেউ কেউ অন্তর্দ্বন্দ্বের দ্বারা রাজাকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করতেন।
তবে এই বিরোধীদের খোঁজ পেলে, তাদের সরানোর প্রক্রিয়া অর্থাৎ গুপ্তহত্যার সঙ্গে আজকের সরকার বিরোধী গোষ্ঠীর মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। আজকাল হামেশাই দেখতে পাবেন, গত সপ্তাহে পাড়ার অমুক ব্যক্তি পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে চাল চুরির অভিযোগ এনেছিল, কাল থেকে সেই অমুক ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তান বা স্বয়ং সেই ব্যক্তিটিই হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন! দু'দিন পর কোনো নদী থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার হলো।
তেমনি মহাভারতেও পরবর্তী সিংহাসনের দাবিদার, কিম্বা প্রধান বিরোধী দলের সদস্যদের সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া রীতিমতো পরিকল্পনা করে সম্পন্ন হতে দেখা যায়।
আদিপর্বে ভীমকে বিষ খাইয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন দুর্যোধন। তারপর 'লাশ' গুম করতে নদীতে ফেলেও দেন তাঁকে। এছাড়াও জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল।
কাল থেকে যে ব্যক্তিটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাঁর আত্মীয় পরিজন যা কিন্তু চুপ থাকেন। কারণ মুখ খুললে আরও কয়েকজনের নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। মহাভারতও কিন্তু এর ব্যতিক্রম না। ভীমকে খুঁজে পাওয়ার পর ভীম যখন উত্তেজিত হয়ে প্রতি আক্রমণের কথা বলেন, যুধিষ্ঠির তাঁকে শান্ত করেন। এখানে যুধিষ্ঠির কিন্তু নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই ভাইকে শান্ত করেন। বিদুর কুন্তীকে বলেন, যা হওয়ার হয়েছে, আপাতত ছেলেদের বাঁচাও..এ খবর প্রচার হয়ে গেলে গুপ্ত আক্রমণের বদলে প্রকাশ্য আক্রমণ আসতে পারে- “প্রত্যাদিষ্টো হি দুষ্টাথা শেষে পি প্রহরেত্তর।”
এবার প্রজাতন্ত্রের কথা বলা যাক। মহাভারতে বর্ণিত রাজ্যগুলির মধ্যে দ্বারকা, মথুরা, উত্তর কুরু, উত্তর মদ্র, বৃজি প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে 'প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা ছিল। জাতক অনুসারে বৈশালীতেও প্রজাতন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়, তবে বৈশালী নিজেই কোশল রাজ্যের অধিনস্ত হওয়ায় পণ্ডিতরা একে প্রজাতন্ত্র বলতে অস্বীকার করেন। মহাভারত বিশ্লেষকরা বলেন, এই রাজ্যগুলিতে প্রজাতন্ত্র থাকলেও, শাসন কার্য পরিচালনা করতেন রাজ্যস্থিত গোষ্ঠীগুলির নির্বাচিত বিশিষ্ট নেতৃবর্গ। এঁরা প্রত্যেকেই রাজার উপাধি পেতেন। তবে রাজ্যের প্রধান হিসেবে এঁরা নিজেদের মধ্যে থেকেই বয়স্থ বা জ্ঞানী ও সম্মানীয় কাউকে নির্বাচন করতেন। এই রাজা বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ অথবা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন।
প্রাচীন টীকাকার ও গবেষক যা অবশ্য এই রাজ্যগুলিকে আদর্শ রাজ্য বলতে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এদের 'বৈরাজ্য' বলেছেন। Social ও Anti Social এর মাঝে যেমন Unsocial বিরাজ করে, নৈরাজ্যের আগে তেমনি বৈরাজ্য বর্তমান। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “বৈরাজ্যায় এব তে অভিষিচ্যান্তে”- একাধিক রাজা যুক্ত রাজ্যগুলি বৈরাজ্য।
তবে এর পরেও এই রাজ্যগুলিতে একতাই ছিল একান্ত কাম্য নীতি। বর্তমানে আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রিক দেশগুলির মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে, "এক রাষ্ট্র, এক পরিচিত।" আর আমরা ভারতীয়রা তো ছোটবেলাতেই গান্ধীজীকে 'জাতির জনক' বলার মাধ্যমে নিজেদের একটি জাতি- ভারতীয় বলে পরিচিত হতে শিখি। তেমনি কৃষ্ণের রাজ্য যাদব, ভোজ, বৃষ্ণি, অন্ধক, হৈহয়, চেদী, বিদর্ভ প্রভৃতি গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হলেও, প্রত্যেকে নিজেদের ভোজ বলেই পরিচয় দিতেন। তবে আগে বলা রাজতন্ত্রের মতোই এখানেও বিরোধী নেতারা শাসক জোটের মধ্যেই অবস্থান করতেন। আর রাজতন্ত্রের থেকে শিথিল শাসনব্যবস্থা হওয়ায় এই প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে অন্তর্ঘাত হতো ব্যাপক হারে।
উদাহরণে সমন্তক মণি নিয়ে ভোজ গোষ্ঠীগুলির বিবাদের কথা বলা যায়। এই বিবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কৃষ্ণ নারদকে বলেন, সমস্ত ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য সত্ত্বেও আমি আসলে আমার জ্ঞাতিদের দাসত্ব করে যাচ্ছি। - “দাস্যম ঐশ্বর্যবাদেন জ্ঞাতিনাং নঃ করোম্যহম্। নিত্যোত্থানেন সম্পন্না নারদান্ধকবৃষ্ণায়ঃ” - নারদ, সময়কাল যেভাবে এগোচ্ছে, অন্ধক বা বৃষ্ণিরা যেকোনো সময় অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। আবার কখনো সরাসরি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমার হয়েছে মহা বিপদ, একজনের খুশিতে সামিল হলে গোষ্ঠীর অপর সদস্যরা ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, হিংসা করছেন!- “একস্য জয়মাশংসে অপরস্য অপরাজয়ম।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই একইঝামেলায় কৃষ্ণ নিজের দাদা বলরামের বিশ্বাসও হারান।
আমরা যদি আরেকটু পিছনে যাই, এই ভোজ গোষ্ঠীতেই আরেকটি ভয়াবহ অন্তর্দ্বন্দ্বের নিদর্শন পাই।
তখনও কৃষ্ণের জন্ম হয়নি, বিশিষ্ট গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে নাম নেওয়া হয় বাসুদেব, উগ্রসেন, অক্রুর প্রমুখের। ঠিক এই সময় সক্রিয় হয়ে ওঠেন উগ্রসেন পুত্র কংস। নিজেকে গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি প্রথমেই হাত মেলান মগধরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে। তাঁর দুই মেয়েকে বিবাহ করে, শ্বশুরের বলে বলীয়ান হয়ে কংস প্রথমেই নিজের বাবা উগ্রসেনকে বন্দী করেন। এরপর অন্যান্য সংঘ সদস্যদের একপ্রকার তোয়াক্কা না করেই মথুরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীতে কৃষ্ণ, অক্রুর প্রমুখের হস্তক্ষেপে এই চক্রান্ত ব্যর্থ হলেও এই ঘটনা যাদব-ভোজ-বৃষ্ণিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব সর্বসমক্ষে এনে দেয়। সঙ্গে এও দেখিয়ে দেয়, শিথিল প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও সংঘ সদস্যদের মতানৈক্য রাজ্যের জন্য কত বড়ো বিপদ ডেকে আনতে পারে!
এবার আসা যাক শাসন বিভাগ সমূহের কথায়। আজকের দিনে শাসন বিভাগ বলতে রাষ্ট্রের প্রধান পরিচালক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত সকলকেই বোঝার। তাই আধুনিক শাসন ব্যবস্থার সংজ্ঞার তুলনায় মহাভারতীয় শাসন ব্যবস্থার সংজ্ঞা বেশ সংকীর্ণ ছিল বলেই মনে হয়। এখানে কেবলমাত্র রাষ্ট্রের প্রধান শাসক ও প্রশাসনিক বিষয়ে নীতি নির্ধারণকারী সচিবদের নিয়েই শাসন ব্যবস্থা গঠিত হতো। সরকারি কর্মচারীদের সেখানে কোনো স্থান ছিল না। তবে আজকের দিনের মতো শাসন বিভাগের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দুটি অংশ তখনও বর্তমান ছিল।
রাজনৈতিক অংশে অবস্থান করতেন রাজা, মন্ত্রীগণ, সেনাপতি প্রমুখ। আর অরাজনৈতিক অংশে বিরাজ করতেন সচিব অর্থাৎ রাজ পুরোহিত, শিক্ষক বা রাজবংশের বৃদ্ধ, জ্ঞানী ব্যক্তিরা। এঁরা প্রধাণত পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতেন। যেকোনো রকম কঠিন পরিস্থিতিতে রাজা এঁদের কাছে উপযুক্ত পরামর্শ চাইতে পারতেন।
যাইহোক, এঁদের কথা পরে বলা যাবে, আপাতত শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ সম্পর্কে বলা যাক।
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্তেস্কুর মতে, সরকারের বিভাগগুলি নিজ নিজ গণ্ডীর মধ্যে থেকে কাজ করলে নাগরিক স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে রক্ষিত হয়। আর সেই নীতিতে বিশ্বাসী হয়েই বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ নিজ সংবিধান অর্থাৎ নির্দিষ্ট নীতিগ্রন্থ বলবৎ করেছে। এই গ্রন্থে শাসক বিরোধী প্রতিটি গোষ্ঠীর কার্যপ্রণালী, সম্পর্ক, জনগণের সঙ্গে শাসকের সম্পর্ক, এমনকি শাসক, প্রজা সকলের অবশ্য করণীয় কার্যাবলী সম্পর্কেও বলা হয়।
মহাভারতের মতো প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত রাজ্যগুলিও কিন্তু এর ব্যতিক্রম ছিল না। ওই সমস্ত রাজ্য চলতো 'দণ্ডনীতি' মেনে। না, দণ্ড মানে এখানে শাসন নয়, রাজ্য চালনার বিধানকে বোঝানো হয়েছে। ভারতে ঠিকঠাকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই যেমন সংবিধান রচিত হয়েছিল, পুরাণেও বলা হয় মনু প্রথম রাজা নির্বাচিত হওয়ার আগেই ভগবান শিব দণ্ডনীতি প্রচলন করেন। তবে সংবিধানেও তো ভুল থাকেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার গ্রহণ করার দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবর্তন হতে থাকে। তাই সংবিধানকে সময়োপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে মাঝে মধ্যেই অ্যামেন্ডমেন্ট অর্থাৎ 'সংবিধান সংশোধনী বিল' আনা হয়।
একই ভাবে দণ্ডনীতিরও কিন্তু অ্যামেন্ডমেন্ট হতো। ভগবান শিবের তৈরি দণ্ডনীতি যথাক্রমে ইন্দ্র, বৃহস্পতি, শুক্রাচার্য্য প্রমুখ পরিবর্তন করেন। এর পরেও বেশ কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি এই কাজ করলেও সর্বশেষ পরিবর্তনের কাজটি করেন চাণক্য কৌটিল্য। তাঁর 'অর্থশাস্ত্র'ই এই প্রাচীন দণ্ডনীতির সংশোধিত রূপ। তিনি অবশ্য দণ্ডনীতিকে নীতিশাস্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। অধুনা শাসকরা যেমন সংবিধানের নামে শপথ করে শাসনকার্য শুরু করেন, পুরাকালেও তেমনি রাজারা অভিষেককালে এই নীতিশাস্ত্রের শপথ গ্রহণ করতেন।
বর্তমানে প্রতিটি শাসক, এমনকি বিরোধীরা কিন্তু সংবিধানকে চূড়ান্ত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। শাসক যেমন সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের থেকে দেশপ্রেম ভিক্ষা করে, যা কালক্রমে শাসক প্রেমে রূপান্তরিত হয়। তেমনি বিরোধীরা সেই সংবিধানকেই ভিন্নভাবে ব্যবহার করে জনতাকে শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালন করতে পারেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কিন্তু সংবিধানকে নিজের স্বার্থে নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।
একই ভাবে মহাভারতেও বারবার দ
বর্তমানে প্রতিটি শাসক, এমনকি বিরোধীরা কিন্তু সংবিধানকে চূড়ান্ত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। শাসক যেমন সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের থেকে দেশপ্রেম ভিক্ষা করে, যা কালক্রমে শাসক প্রেমে রূপান্তরিত হয়। তেমনি বিরোধীরা সেই সংবিধানকেই ভিন্নভাবে ব্যবহার করে জনতাকে শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালন করতে পারেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই কিন্তু সংবিধানকে নিজের স্বার্থে নিজের মতো করে ব্যবহার করেন।
একই ভাবে মহাভারতেও বারবার দণ্ডনীতিকে রাজা তাঁর জনগণকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করেছেন, আবার বিরোধীরা একই দণ্ডনীতির দোহাই দিয়ে শাসককে চাপে ফেলেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কুরুবৃদ্ধরা কিন্তু এই দণ্ডনীতির উল্লেখ করেই যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ করার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে চাপ দেন - স্থাপিতো ধৃতরাষ্ট্রেণ... যৌবরাজায় পার্থিব।
রাজা দ
রাজা দণ্ডনীতিকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করলেও আপেক্ষিকভাবে তাঁর আয়ত্বের বাইরে থাকতেন রাজ্যের অমাত্য ও পরামর্শদাতারা। বর্তমানে অরাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় অবস্থান করা রাষ্ট্রভৃত্তক বা Civil Servant রা যেমন সরাসরি সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, পুরাকালের ওই পরামর্শদাতা গোষ্ঠীও সরাসরি দণ্ডনীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেন। কুরু রাজতন্ত্রে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, কৃষ্ণ প্রমুখ এই অরাজনৈতিক পরামর্শদাতার কাজ করেছেন।
লক্ষ্য করবেন, জনসমাজে এরূপ বড়ো কিছু ব্যক্তিত্ব আজও বর্তমান, যাঁরা 'আপাত অরাজনৈতিক' ভেক ধরে জনহিতকর কাজের দ্বারা একটি ব্যাপক সংখ্যক জনতাকে নিজের অনুগত রাখেন। আর শুধুমাত্র জনসমর্থন লাভের আশাতেই সরকার এঁদের হাতে রাখতে চায়।
আজকের দিনে যেমন দেখা যায়, অমুক কোম্পানির প্রধান শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। আবার পাঁচ বছর পর সরকার বদল হলে সেই ব্যক্তি কেই নতুন শাসকের পাশে হাসিমুখে ঘুরতে দেখা! এতে জনগণ কিছুটা অবাক হলেও ওই অমুক কোম্পানিটির প্রতিপত্তি কিন্তু বাড়তেই থাকে।
পুরাকালের ওই পরামর্শদাতা গোষ্ঠীও ঠিক একই ভাবে কাজ করতো। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর এমনকি কৃষ্ণও কিন্তু নিরপেক্ষতার ভান করে রীতিমতো রাজ্যপাট পরিবর্তনে ভূমিকা নিয়েছিলেন! ভীষ্ম বা কৃষ্ণের ছিল বিশাল জনসমর্থন, সৈন্যবল ও সর্বোপরি অতুলনীয় রাজনৈতিক জ্ঞান। দ্রোণ ও কৃপের ছিল অস্ত্রবিদ্যা। স্বভাবতই এরূপ ব্যক্তিদের যেকোনো রাজা স্বপক্ষে টানতে চাইবেন।
শুধুমাত্র কৃষ্ণকে হাতে রাখার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের সময় যুধিষ্ঠির আরো অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে ছেড়ে কৃষ্ণের পায়ে অর্ঘ্য দান করেন।
ধৃতরাষ্ট্র এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুগত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে দুর্যোধন বলেন, পিতামহ হিসেবে ভীষ্মের কাছে পা
লক্ষ্য করবেন, জনসমাজে এরূপ বড়ো কিছু ব্যক্তিত্ব আজও বর্তমান, যাঁরা 'আপাত অরাজনৈতিক' ভেক ধরে জনহিতকর কাজের দ্বারা একটি ব্যাপক সংখ্যক জনতাকে নিজের অনুগত রাখেন। আর শুধুমাত্র জনসমর্থন লাভের আশাতেই সরকার এঁদের হাতে রাখতে চায়।
আজকের দিনে যেমন দেখা যায়, অমুক কোম্পানির প্রধান শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। আবার পাঁচ বছর পর সরকার বদল হলে সেই ব্যক্তি কেই নতুন শাসকের পাশে হাসিমুখে ঘুরতে দেখা! এতে জনগণ কিছুটা অবাক হলেও ওই অমুক কোম্পানিটির প্রতিপত্তি কিন্তু বাড়তেই থাকে।
পুরাকালের ওই পরামর্শদাতা গোষ্ঠীও ঠিক একই ভাবে কাজ করতো। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর এমনকি কৃষ্ণও কিন্তু নিরপেক্ষতার ভান করে রীতিমতো রাজ্যপাট পরিবর্তনে ভূমিকা নিয়েছিলেন! ভীষ্ম বা কৃষ্ণের ছিল বিশাল জনসমর্থন, সৈন্যবল ও সর্বোপরি অতুলনীয় রাজনৈতিক জ্ঞান। দ্রোণ ও কৃপের ছিল অস্ত্রবিদ্যা। স্বভাবতই এরূপ ব্যক্তিদের যেকোনো রাজা স্বপক্ষে টানতে চাইবেন।
শুধুমাত্র কৃষ্ণকে হাতে রাখার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের সময় যুধিষ্ঠির আরো অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে ছেড়ে কৃষ্ণের পায়ে অর্ঘ্য দান করেন।
ধৃতরাষ্ট্র এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুগত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে দুর্যোধন বলেন, পিতামহ হিসেবে ভীষ্মের কাছে পাণ্ডব আর কৌরব, দু'পক্ষই সমান, তাই তাঁকে নিয়ে চিন্তা নেই। আর দ্রোণকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই, কারণ স্বয়ং তাঁর ছেলে অশ্বত্থামা আমাদের পক্ষে আছে- দ্রোণপুত্রো ময়ি স্থিতঃ। লক্ষ্য করুন, দুর্যোধন কিন্তু সরাসরি প্রভাবশালীদের হাত করার কথা বলছেন।
উদ্যোগ পর্বে কৃষ্ণ সন্ধির জন্য কুরু বাড়িতে গেলে ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন তাঁকে নানা উপঢৌকন ও খাদ্যাদি দিয়ে নিজেদের দলের টানার চেষ্টা করেন।
আজকাল যেমন নির্বিঘ্নে শাসনকার্য চালানোর জন্য পয়সার জোরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আমলাদের কিনে নেওয়া বা প্রভাবিত করার রীতি প্রচলিত আছে, যুধিষ্ঠির বা দুর্যোধন ও কিন্তু সেই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন, মন্ত্রী, অমাত্য দু'দিনে আমার হাতে চলে আসবে, কারণ রাজকোষ এখন আমার অধীন- “অর্থবর্গঃ সহামাত্যো মৎসংস্থো'দ্য মইপতে... ধ্রবম অস্মৎ সহায়ান্তে ভবিষ্যন্তি প্রধানতঃ”। এবার আসা যাক জনগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের কথায়। আজকাল ভোটের প্রচারে নেতাদের মুখে প্রতিশ্রুতি ছাড়া যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, সেটি হলো, আমি জনগণের চাকর, জনগণের সেবা করতে চাই। অর্থাৎ তিনি নিজেকে জনগণের প্রতি সঁপে দিচ্ছেন। অথচ ওই একই নেতা ভোটে জেতার পর, ঘটনা হয়ে যায় একেবারে উল্টো। বড়ো নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি পদাধিকারী হলে তো পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে! পরিস্থিতির কল্যাণে তিনি নিজেকে ভগবান প্রমাণ করতে না পারলেও, ভগবানের ঠিক পরের স্থানেই নিজেকে বসিয়ে ফেলেন। জনগণের স্বাধীনতা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, চাহিদার থেকেও তাঁর নিজের বিলাসটাই বড়ো হয়ে ওঠে। যে জনতার ভোট আর ট্যাক্সের টাকায় তিনি আজ ওই স্থানে পৌঁছেছেন, সেই জনগণকেই তিনি ভুলে যান।
মহাভারতের সমাজ কিন্তু এর থেকে বেশ আলাদা ছিল। আলাদা ছিল বললাম করে আবার ভাববেন না, যে, রাজা জনগণের খুব খেয়াল রাখতেন। আসলে এ সময় প্রজাদের স্বল্প শিক্ষার সুযোগ নিয়ে, প্রাচীন গ্রন্থাদির ভুল ব্যাখ্যা করে রাজা নিজের ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার রূপে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন।
আদি মানব মনু বলেছেন, “সুরেন্দ্রানাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ” - ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, যম প্রমুখ দেবতার শক্তি দিয়েই আদর্শ রাজা গঠিত। ভেবে দেখুন, মনু কিন্তু এখানে রাজাকে ঈশ্বর বললেন না। তিনি বললেন, ইন্দ্রের মতো আক্রমণাত্মক ও সহস্রাক্ষী অর্থাৎ রাজকার্যের সবদিকে সর্বদা নজরদারির ক্ষমতা, চন্দ্রের মতো চপল ও কোমল, বরুণের মতো দানি অর্থাৎ প্রজাবৎসল ও যমের মতো ধার্মিক ও প্রয়োজনে কঠিনতম দ
উদ্যোগ পর্বে কৃষ্ণ সন্ধির জন্য কুরু বাড়িতে গেলে ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন তাঁকে নানা উপঢৌকন ও খাদ্যাদি দিয়ে নিজেদের দলের টানার চেষ্টা করেন।
আজকাল যেমন নির্বিঘ্নে শাসনকার্য চালানোর জন্য পয়সার জোরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আমলাদের কিনে নেওয়া বা প্রভাবিত করার রীতি প্রচলিত আছে, যুধিষ্ঠির বা দুর্যোধন ও কিন্তু সেই পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন, মন্ত্রী, অমাত্য দু'দিনে আমার হাতে চলে আসবে, কারণ রাজকোষ এখন আমার অধীন- “অর্থবর্গঃ সহামাত্যো মৎসংস্থো'দ্য মইপতে... ধ্রবম অস্মৎ সহায়ান্তে ভবিষ্যন্তি প্রধানতঃ”। এবার আসা যাক জনগণের প্রতি রাজার ব্যবহারের কথায়। আজকাল ভোটের প্রচারে নেতাদের মুখে প্রতিশ্রুতি ছাড়া যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, সেটি হলো, আমি জনগণের চাকর, জনগণের সেবা করতে চাই। অর্থাৎ তিনি নিজেকে জনগণের প্রতি সঁপে দিচ্ছেন। অথচ ওই একই নেতা ভোটে জেতার পর, ঘটনা হয়ে যায় একেবারে উল্টো। বড়ো নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি পদাধিকারী হলে তো পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে! পরিস্থিতির কল্যাণে তিনি নিজেকে ভগবান প্রমাণ করতে না পারলেও, ভগবানের ঠিক পরের স্থানেই নিজেকে বসিয়ে ফেলেন। জনগণের স্বাধীনতা, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, চাহিদার থেকেও তাঁর নিজের বিলাসটাই বড়ো হয়ে ওঠে। যে জনতার ভোট আর ট্যাক্সের টাকায় তিনি আজ ওই স্থানে পৌঁছেছেন, সেই জনগণকেই তিনি ভুলে যান।
মহাভারতের সমাজ কিন্তু এর থেকে বেশ আলাদা ছিল। আলাদা ছিল বললাম করে আবার ভাববেন না, যে, রাজা জনগণের খুব খেয়াল রাখতেন। আসলে এ সময় প্রজাদের স্বল্প শিক্ষার সুযোগ নিয়ে, প্রাচীন গ্রন্থাদির ভুল ব্যাখ্যা করে রাজা নিজের ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার রূপে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন।
আদি মানব মনু বলেছেন, “সুরেন্দ্রানাং মাত্রাভ্যো নির্মিতো নৃপঃ” - ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, যম প্রমুখ দেবতার শক্তি দিয়েই আদর্শ রাজা গঠিত। ভেবে দেখুন, মনু কিন্তু এখানে রাজাকে ঈশ্বর বললেন না। তিনি বললেন, ইন্দ্রের মতো আক্রমণাত্মক ও সহস্রাক্ষী অর্থাৎ রাজকার্যের সবদিকে সর্বদা নজরদারির ক্ষমতা, চন্দ্রের মতো চপল ও কোমল, বরুণের মতো দানি অর্থাৎ প্রজাবৎসল ও যমের মতো ধার্মিক ও প্রয়োজনে কঠিনতম দণ্ড নির্ধারণে সক্ষম, এইসব গুণ থাকলে তবেই রাজা আদর্শ রাজা রূপে গণিত হবেন।
দন্ডনীতি সংশোধন করে শুক্রাচার্য্য বলেছিলেন, মালিক যেমন ভৃত্য কে বেতন দেয়, প্রজারাও তেমন রাজাকে প্রদান করেন। অর্থাৎ রাজা আসলে প্রজাদের ভৃত্য। তাই তাঁর উচিত প্রজাদের হিতের কথা সবসময় ভাবা। কিন্তু এখানেও রাজা কি করবেন তা আমরা সবাই জানি। অর্থাৎ এখানে রাজা নিজের স্বার্থে স্বয়ং মনু ও শুক্রাচার্যকে মানছেন না।
আজ পর্যন্ত কিন্তু একই নিয়ম চলে আসছে। একই ভাবে শাসকরা প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। রাজনীতির কূটিল নিয়মে সাধারণ মানুষ চিরকালই বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। মহাভারতের মহাযুদ্ধ, যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে গোটা আর্যাবর্তের প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তিকেই দাঁড় পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, সেই যুদ্ধও কিন্তু রাজনীতির এই চিরাচরিত নিয়ম বদলাতে পারেনি। আর্যাবর্তের বুকে সেই সময় সৃষ্টি হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। আর তখন থেকেই শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সাম্যবাদের অসম লড়াই। সত্যি বলতে কোথায় এই লড়াইয়ের শুরু আর কোথায় শেষ, তা হয়তো আজ আমাদের পক্ষে আন্দাজ করাও অসম্ভব। তাই এইসব ঘটনা থেকে আমরা শুধুই জীবনে ঠিকভাবে চলার প্রেরণা লাভ করতে পারি। আর সম্মান জানাতে পারি সেইসব প্রাচীন শিক্ষকদের, যাঁরা কয়েক হাজার বছর আগে আমাদের দিয়ে গেছেন জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ উপদেশাবলী।
অথচ রাজারা কি করলেন? উপরোক্ত ব্যাখ্যাটি গোপন রেখে, শুধুমাত্র শ্লোকের আক্ষরিক অর্থটি জনগণের সামনে পেশ করে দেবতার স্থানে বসলেন।
0 comments: