অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য
Posted in অন্তরমহলআমার আমি
'আমি' শব্দটা ভারি ভাবায় আমায়। ঠিক কবে থেকে অন্তরমহলের সর্বেসর্বা হয়ে উঠলো সে তাও মনে করতে পারি না। অথচ এই 'আমি'-কে কেন্দ্র করেই তো আমাদের সমস্ত জগত অস্তিত্ব অনস্তিত্বের দোলায় দুলছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'আমি' কবিতায় বলেছেন, "আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে ,জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’ ,
সুন্দর হল সে ।”
এই আমি আসলে সমগ্র চেতন মনের সিংহদুয়ার যেন। যার ভিতর মহলের জগত আর বার মহলের জগতে আছে বাস্তব অবাস্তব পরাবাস্তবের আড়াআড়ি দ্বন্দ। আমিত্ব সেই দ্বন্দ যুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে রফা করে চলেছে। আমি আছি তাই জগতের অস্তিত্ব আমার কাছে সত্য। চুনি লাল, পান্না সবুজ, গোলাপ সুন্দর। এও যেমন সত্য আবার এই আমিত্বের বোধ থেকেই বুঝি বা জগতের উৎস মুখ। অন্তরমহলের আরও সব সদস্য যেমন অবচেতন, অর্ধ চেতন, বিবেক, বোধ বুদ্ধি সব কিছুর মধ্যে জেগে আছে একটা আমি যে কিনা জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করছে। ভেতরের গুঁতো সামলে বাইরের রক্তচক্ষু সমাজের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে "আমি" র জুড়ি মেলা ভার। অন্তরমহলে নিরন্তর উঠছে কত যে চাহিদার ঝড়। সে সব চাহিদা সমাজ সংসার বোঝে না, ন্যায় নীতির ধার ধারে না। তারা শুধু পূর্তি পূরণের উচ্ছাসে গা ভাসিয়ে দিতে চায়। এই সব চাহিদা আর ইচ্ছারা যদি বেগবান আর সফল হয় তবে সমাজে গেল গেল রব উঠবে। এমনকি অস্তিত্ব সংকট ঘটাও বিচিত্র নয়। কে তবে আমাদের রক্ষা করে চলেছে নিরন্তর? "আমি" সেই "আমি"। একদিকে বিবেকের দংশন অন্যদিকে সমাজের রক্তচক্ষু আর এদিকে অন্তরমহলে ইচ্ছাপূর্তির গুঁতো সামলে "আমি" আমাকে আপনাকে এমন কঠিন যুদ্ধের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে। অস্ত্র কি রে ভাই ঢাল তলোয়ার, নান চাক্কু? না না নিধিরাম সর্দার 'আমি'
সে সব নিয়ে লড়ে না। তার লড়াই অন্য জাতের। ইগো ডিফেন্স ব্যবহার করে সব কিছুতে সমতা বজায় রেখে চলে সে। হরেক রকম ইগো ডিফেন্স আছে।
এই ইগো ডিফেন্স সব যে মনের জন্য খুব স্বাস্থ্যকর এমনটাও নয়। বিপদ ঘনায় তখন যখন তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর ডিফেন্স বেশি ব্যবহার করা হয়ে যায়। সে যা হোক এখন এক নজরে কয়েকটা বহু ব্যবহৃত ডিফেন্স:
রিপ্রেশন বাঙলায় যা অবদমন। ব্যাপারটা কি? অনেক চাহিদা 'আমি' কে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে। কামনা বাসনায় লালায়িত সে চাহিদাদের ঠেলে অবচেতনের গভীর খাদে ঠেলে ফেলে 'আমি'। চেতন স্তরে ওঠার সব পথ বন্ধ। চিরতরে হারিয়ে গেল ভেবে নিশ্চিন্তে থাকে সে। কিন্তু অবচেতনের গর্ত থেকে প্রায়ই ছদ্মবেশে বেরিয়ে আসে সেই সব অবদমিত ইচ্ছারা। অজান্তেই আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে সেই সব অবদমিত কামনা বাসনা।
বাস্তব সত্য যদি মনোমত না হয় তবে তাকে অস্বীকার করলে বেড়ে হয়। বাঙলা সাহিত্যের দেবদাস তো এ ব্যাপারে আইকন বলা চলে। প্রেমে ঝাড় আর মদে ডুবে যাও। এ আসলে ডিনায়ালের চূড়ান্ত।
নিজের অবাঞ্ছিত চাহিদা বা আবেগ অনেক সময় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে 'আমি'। অফিসের সহকর্মী মেয়েটির প্রেমে পাগল বিবাহিত পুরুষটি অন্যদের বোঝাতে থাকে মেয়েটি আসলে তার প্রতি দূর্বল। প্রোজেকশন।
মনে এক, মুখে আর এক। কোনো মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে, মনে মনে নিজেকে দুর্বল ভাবছে অথচ বাইরে প্রচন্ড তর্জন গর্জন করছে। রিয়াকসন ফরমেসন।
আবার অবাঞ্ছিত আবেগ বা চাহিদাগুলো বিপথে চালিত করার বদলে তাকে সৃষ্টিশীল দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া এক ধরণের ডিফেন্স বটে।
এমন সব অস্ত্র নিয়ে লড়তে লড়তে আমি এগিয়ে চলে মহাকালের পথ ধরে। আলো অন্ধকার পর্যায়ক্রমে আসে, দিন বদল হয়, যুগ যুগ পার হয়ে যায়। বিবর্তিত আমি এগিয়ে চলে অস্ত্বিত্ব রক্ষায়।
0 comments: