গল্প - সমীক্ষণ সেনগুপ্ত
Posted in গল্পসন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফিরছিলাম।
সারা দিনের অফিসের হাড় ভাঙ্গা খাটুনি, দৌড়া-দৌড়ির পর এই সময়টা আমার বেশ ভালো লাগে। এমনিতে আমার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটার কম হয় না।
কিন্তু আজকে বিকেলের শেষে ফিরতে পেরে দেখছিলাম, আকাশটা একটা অদ্ভুত নীল মায়াবী আলোয় ভরে গেছে...দুরে পাখিগুলো ঘরে ফিরে আসছে কিচির-মিচির করে, সুবল কাকার চায়ের দোকানে অল্প অল্প করে ভিড় জমা হতে শুরু করেছে, সামনের চপের দোকানের নরেন বেসন গুলে গামলায় হাতটা কাঁচিয়ে নিলো, সামনের বড় কড়াইটায় তেল গরম হচ্ছে, ফালি ফালি করে কাটা বেগুন-গুলো শুধু ছাড়ার অপেক্ষা...
আজকে মালিককে বলে কয়ে আগে বেরিয়েছি কেজরিওয়াল বাবু আসবেন বলে। সত্যপ্রকাশ কেজরিওয়াল, এই এলাকার বড় প্রমোটার।
আমাদের বনেদি বাড়ি, ঠাকুরদার বাবা ওকালতি না মোক্তারি, কি একটা করে বিস্তর পয়সা কামিয়েছিলেন। তাই দিয়ে কুড়ি কাঠা জমির উপর বাগান সমেত তিনতলার বড় বাড়িটি বানান। শুনেছি, ব্রিটিশ আমলে অনেক মান্যি-গন্যিদের পায়ের ধুলো পড়ত এখানে। কিন্তু সেদিন এখন গেছে।
সাধারণ সেলসের কাজ করে আমার হাতে যা আসে, তাতে আমার আর মায়ের কোনক্রমে চলে যায়, কিন্তু ওই টুকুই। বাবা মারা গেছেন বছর পাঁচেক হোল, পয়সা-কড়ি না পান, ফাটবাজিটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন বিলক্ষণ। কাজেই, এই বড় ঝুরঝুরে বাড়ি আর এই বাগান ছাড়া আমাদের আর বিশেষ কিছুই নেই।
সত্যপ্রকাশ বাবুর সঙ্গে বাড়ি-বিক্রির ব্যাপারেই কথা ছিল আজ।
বাইরের ভাঙ্গা গেটটা দিয়ে ঢুকতে চোখ পড়লো ডান পাশের স্তম্ভের আধ- ভাঙ্গা সিংহটার দিকে, বাঁ পাশের স্তম্ভটা পুরোটাই ভেঙ্গে গেছে, বাবা যে বছর মারা গেলেন, তার পরের বছর। তারপর থেকেই বোধয় "সিংহ-দুয়ারের" গেট আটকানোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
গেটের ভেতরটায় বাগান ছিল এক কালে, এখন আগাছায় ভরে গেছে। কাঁটাঝোপ আর লতার মধ্যে দিয়ে দেখাই যায় না প্রায়, দাদুর লাগানো রডোডেনড্রন গাছ ছিল, বাগানের ওই বাঁ দিকের কোণটায়। এছাড়া বাইশ ধরনের গোলাপ ছিল, রজনীগন্ধা, জুঁই, চন্দ্রমল্লিকা, আরও কতো কি...সবটা মনেও পড়ে না, আসলে ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিলাম তো।
আর কি, সবই তো শেষ হয়ে যাবে এবার, শুধু পড়ে থাকবে কংক্রিটের কয়েকটা আখাম্বা টাওয়ার, আর তার মধ্যে পায়রার খোপের ভেতর মানুষ।
সামনে ভুতের মতো দাঁড়ানো বাড়ির দিকে নজর গেলো। আমাদের দুজন মানুষের লাগে সাকুল্যে দুই থেকে আড়াই খানা ঘর। একটায় মা টিভি দেখে, আর একটায় আমরা শুই। বাকিগুলো বন্ধই পড়ে থাকে। হ্যাঁ, এখনও আমি ব্যাচেলর, সামনের মার্চে পঁয়ত্রিশ হবে। মা-মাসিরা বিয়ের কথা তোলেন না, তা নয়। কিন্তু সেটা নিছকই আলোচনা।
সত্যপ্রকাশ বাবু এসেছেন কি? ঘরে তো আলো জ্বলছে না, তাহলে বোধয় এখনও এসে পৌঁছন নি। বাইরের অন্ধকার ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছে, মা বোধয় জানেনও না আমি কতক্ষণ বাড়ির ভিতরটায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার বয়স্ক মা, এক সময়ে ফরসা ছিলেন, সুন্দরীও। তারপর সংসারের চাপ সামলাতে সামলাতে...একটা সময়ে তো বাড়ির সব কাজ করতে হত নিজেকেই, বাবার কাজের লোক রাখার সামর্থ্য থাকলেও ইচ্ছা ছিল না। এখন সাধনাদির উপর ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বসে টিভি দেখে। মাঝে মাঝে ভাবি কাদের অবস্থা বেশি শোচনীয় - এই টিভি সিরিয়ালগুলো নাকি সেগুলো যারা দেখেন তাঁরা...
বাড়ির দিকে এগোতে গিয়ে কানে এলো খুব স্পষ্ট অথচ ক্ষীণ গলায় কে যেন বলল, "কে? রাজাবাবু নাকি?"
রাজা আমার ডাক নাম, কিন্তু খুব কম লোকই জানে এই নাম। জীবিতদের মধ্যে এক মাত্র মা ছাড়া আর কেউ আমাকে এই নামে ডাকে না। তাহলে?
কান খাড়া করে শুনলাম আওয়াজটা আসছে বাগানের ইশান কোণ থেকে। বাড়ির থেকে দূরে এই দিকটা আগাছায় ভর্তি, অনেক দিন যাওয়া হয়নি ওদিকটায়, যাওয়ার কোন কারণ হয়নি আসলে। কিন্তু আজকে ডাকটা শুনে কেমন না গিয়ে থাকতে পারলাম না। মনে হোল খুব পরিচিত কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে।
আধো-অন্ধকারের মধ্যে অফিসের শার্ট-প্যান্ট পরে কাঁটা-ঝোপ পেরিয়ে বেশ বেগ পেতে হোল, ডান হাতের কব্জির কাছটা কেটে গেলো, পায়ে মনে হল বিছুটি পাতা লেগেছে। মনে মনে ভাবলাম আজকে বাড়ি ঢুকলে মা মুখ করবে। কিন্তু কেমন যেন ছেলেমানুষির আকর্ষণে এগিয়ে গেলাম আমি...
কাঁটা-ঝোপ পেরিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ ! সামনে দেখি একটা বিশাল বট গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে !!
কি আশ্চর্য ! এই গাছটা আগে কোনোদিন দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। কোথা থেকে এলো এই বট গাছটা??
এমনিতে পুরনো-প্রাচীন গাছের প্রতি আমার একটা টান আছে। মনে হয়, এঁরা কতো বছর ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে - একশো বছর, দুশো বছর, এমনকি পাঁচশো বছরের পুরনো গাছও তো আছে। শুনেছি কাশ্মীরে সব চেয়ে পুরনো যে চিনার গাছটা রয়েছে, সেটার বয়স সাতশো বছর !!! এক সুফি সাধক সেটি রোপণ করেছিলেন।
ভাবা যায়??
তার মানে ভারতে মোগল যুগের আগে থেকে গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। চিরাগ দিল্লির দরগার মধ্যে যে খিরনি গাছটি রয়েছে, সেটি নাকি দরগা তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেখানে ছিল। দরগা তৈরি হয় ১৩২৭ সালে, তাহলে গাছটি কি প্রায় ৮০০-৯০০ বছরের পুরনো??
ভাবতে অবাক লাগে...
অতদুর যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের কাছের জোড়াসথতলায় যে হাট বসে, সেখানে সবার প্রায় অলক্ষ্যে থাকা জোড়া অশ্বত্থ গাছ গুলির বয়স কে বলতে পারে?? আমরা কলকাতার পত্তন, ইংরেজ আমল, মোগল আমলের প্রাচীনত্ব নিয়ে আকাশ থেকে পড়ি, কিন্তু স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে যে দেখে চলছে চলমান ইতিহাস, পালটে যাওয়া সমাজ-পরিবেশ-পরিস্থিতি, সেই প্রাচীন ঋষি-সুলভ গাছগুলির কথা আমরা ভুলে যাই কিভাবে??
আমার তো বেশ মনে হয়, আমরা যদি গাছদের ভাষায় কথা বলতে জানতাম, তাহলে তো এতো ইতিহাস বই লেখার দরকারই পড়ত না। আমরা গোল হয়ে বসতাম কোন প্রাচীন গাছ-দাদুকে ঘিরে আর তিনি শুরু করতেন, "আজ থেকে অনেক কাল আগে, উজ্জৈনী নগরীতে বিক্রমাদিত্য নামে এক রাজা ছিলেন..."
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম, হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো, "কি ভাবছ, রাজাবাবু?"
আমি এদিক ওদিক তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। চোখ পড়লো সামনের বট গাছটার দিকে, আবার শুনতে পেলাম,"হ্যাঁ, আমিই বলছি..."
আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বট গাছটা যেন হেসে উঠে বলল "আরে, অবাক হওয়ার কি আছে? গাছ বলে কি কথা বলতে পারি না নাকি?"
আমি অবাক হয়ে বটের গুঁড়িটার কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, অনেকগুলো ঝুরি নামিয়ে প্রকাণ্ড বট গাছটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, কতো বছরের পুরনো কে জানে। কাছে গিয়ে দেখলাম - আরে !অবিকল মানুষের মতোই যেন চোখ-মুখ আছে গাছটার। চোখগুলো গোল গোল, হাসিতে ভরা, মুখে ফোকলা দাঁতের হাসি। যেন বুড়ো "বটদাদু" আমার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে।
বেশ লাগলো, আমতা আমতা করে বললাম, "না মানে, সচরাচর তো এরকম দেখা যায় না..."
- "দেখা যায় না, কারণ তোমরা মানুষেরা দেখতে-শুনতে পারো না বলে। বলি, ওই যে লালু কুকুরটাকে যে রোজ রাতে তুমি ভাত দাও, ও কি বলছে তুমি বুঝতে পারো? রুটি চাইছে না চিকেনের লেগপিস? নাকি নিধু গয়লার কালো গরুটা, যে রোজ দু সের করে ঘন দুধ দেয়, সে যখন তার ছোট্ট বাছুর-ছানাটাকে ডাকে, তখন সে ডাক তুমি কি চিনতে পারো?"
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, ভাবছিলাম কি বলবো, এমন সময়ে বটদাদু আবার বলে উঠলো, "মানুষ সব কথা বুঝতে পারে না গো, আদ্ধেক কথা শুনতেই পায় না তো বুঝবে কি, যেমন বাদুড়ের ডাক, মাছেদের গল্পগাছা, এই আমাদের কথাবার্তা - এগুলো শোনার ক্ষমতা মানুষের কানের নেই..." বলে এক গাল হাসল।
মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলাম বটে - এক বিলিতি বিজ্ঞানী বিশেষ যন্ত্র দিয়ে "গাছের কথা" শুনতে পেয়েছেন, আর তাছাড়া আমাদের আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস তো রয়েছেনই, আর আছেন আমাদের সেই কবি যিনি ফুল ফোটার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, নামটা মনে নেই।
বটদাদু বলে চললেন, "আর আমার চারপাশে যে অন্য গাছদের দেখতে পাচ্ছ, এরা সব হচ্ছে আমার পাড়া-প্রতিবেশী। ওই যে দূরে ছাড়া ছাড়া তিনটে আম, অবস্থা খুব খারাপ গো ওদের, মেঝেটা দেখো জঞ্জালে ভরে গেছে, ওই পাঁচিলের ধারে বুড়ো ঘোড়া-নিম, তারপর আমার বন্ধু অশ্বত্থ, তেতুল, তারপর ওই যে বাগানের কোণায় ওই সেদিনের ছোঁড়া নারকেল দুলছে আর হাসছে...আর ওই বিলিতি বাবু তো আছেনই - ওই তোমরা কি বলো ইউক্যালিপটাস না কি..."
আমি সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম - "বিলিতি হতে যাবে কেন?"
- "আরে বিলিতি নয় তো কি, এদেশে তো নিয়ে এসেছিল ওই মহীশুরের টিপু সাহেব, হায়দারের ছেলে...ওই নেপোদের দেশ থেকে হুহ ।", দাদু বললে।
- "টিপু সুলতান?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
- "হু, ওই হোল।" তারপর একটু থেমে বলল, "কাজের ছেলে তো, আরও অনেক কিছু এনেছিল এদেশে - ওই চিংকোনা না কি বলে, আজকাল বয়স হয়েছে তো, মনেও রাখতে পারি না, যা দিয়ে তোমাদের ওই জ্বরের ওষুধ হয়..."
- "ম্যালেরিয়া??"
- "হ্যাঁ ঠিক ঠিক, ভালো ধরেছ তো...নীলগিরির বুকে তো প্রচুর জায়গা না, তা সেখানে এসব চাষ-বাস করতো আর কি। এক সাহেব নিয়ে পালিয়ে এসেছিল - অনেক দূর দেশ থেকে, পাতাল থেকে, ওই তোমরা যাকে পেরু বলো..."
- "পেরু মানে পাতাল?" আমি অবাক হয়ে যাই।
- "হ্যাঁ গো দাদা, জানো না?" বলে বটদাদু হাসল।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে দাদু হেসে উঠে বলল -
-"আরে, শোন তবে বলি, আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু বাইরে থেকে এসেছে। যেমন ওই যে তেঁতুল ভায়া। ওর দেশ তো এখানে নয়ই। ও এসেছে সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে, যেখান থেকে আসলে তোমরাও এসেছ।"
-"তেঁতুল এখানকার নয়?"
-" না গো। আরব দেশের লোকেরা যখন প্রথম তেঁতুল দেখল, তখন ভাবল বুঝি এ হচ্ছে হিন্দুস্তানের খেজুর। তাই নাম দিল "তামার-ই-হিন্দ", আর সেই থেকে হয়ে গেলো ভুল। এক লালমুখো সাহেব ভেবে বসলো এ নিশ্চয়ই ভারতের ফল, ব্যস আর কি...কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা দেখছেন মোটেও তা নয়, তেঁতুল এসেছিল বটে ভারতে তিন হাজার বছর আগেই, কিন্তু তার জন্ম আফ্রিকায়। কিন্তু আমাদের রাজা-রাজড়া থেকে সাধারণ মানুষ এতো বেশি তেঁতুল ব্যবহার করেছি, যে ও একদম ঘরের ছেলে হয়ে গেছে...হে হে..."
বলে দাদু একটু থামল।
আমার ততক্ষণে ধাঁধা লেগে গেছে। দাদু বলে কি? কোথায় পেরু, কোথায় আফ্রিকা, কোথা কোথা থেকে সব গাছেরা এসেছে আমাদের দেশে, কতো বছর ধরে আমাদের সেবা করে যাচ্ছে এরা, খাদ্য, আশ্রয়, শীতল বাতাস - কত কি দিয়ে চলেছে...আর আমরা গাছের বেদিতে সিঁদুর লেপে চলেছি আর এগিয়ে চলেছি কংক্রিটের জঙ্গলের দিকে...
বাইরে ততক্ষণে পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, ঝিঝি পোকা ডাকতে শুরু করেছে, গেটের বাইরে অফিস-ফেরতা বাবুরা সাইকেলে ক্রিং ক্রিং শব্দ করতে করতে চলে গেল, দূরে হালদারদের তিনতলা বাড়ির ওপরের ঘরে আলো জ্বালিয়ে ছেলেটা বোধয় পড়তে বসলো। সত্যপ্রকাশ বাবু এসে গেছেন কিনা কে জানে...তবুও আমার একদম উঠতে ইছা করলো না, বটদাদুর সামনে চুপটি করে বসে থাকলাম।
একটু পরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আর আপনি? আপনি কোথা থেকে এসেছেন?"
বটদাদু আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, তারপর হো হো করে হেসে উঠলো, বলল,
- "আমি?? আমরা কি আর আজকের লোক গো..." বলে দাদু শুরু করলেন।
"সিকন্দরকে চেনো তো? যবন দেশের একটা ছোট্ট দ্বীপের রাজকুমার সিকন্দর?
ছোট দ্বীপের রাজা হলে কি হবে, সিকন্দর সারা পৃথিবী জয় করেছিল ! গলদেশ, সাগরপারের লালমুখো সাহেবদের দেশ, আরবদেশ - কি ছিল না তার সাম্রাজ্যে...
তো আজ থেকে অনেক বছর আুগে যখন সেই সিকন্দর পারস্যদেশ জয় করে আমাদের ভারতবর্ষের দিকে পা বাড়িয়েছিল, তখন আরও অনেক নতুন জিনিসের পাশাপাশি একটি বিরাট বড় গাছ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সেই গাছের ডালপালার এতো বিস্তার ছিল, যে সিকন্দরের দশ হাজার সেনা ঘোড়া-সমেত তার তলায় আশ্রয় নিতে পেরেছিল বলে শোনা যায়।
সিকন্দরের দলে ছিল থিওফ্রাসটাস নামক এক দার্শনিক, যাকে এখন তোমরা উদ্ভিদ-বিদ্যার জনক বলো। যাইহোক, সেই থিওফ্রাসটাস বাড়ি ফিরে এই গাছটির গল্প তাঁর গুরুর কাছে ফলাও করে বলে। সেই গুরু, রাজকুমার সিকন্দরেরও গুরু ছিলেন, তাঁর নাম অ্যারিসটটল। আর সেই গাছটা কে জানো?
"মহাবট" - আমাদের সকলের পূর্বপুরুষ। এভাবে আমাদের কথা সারা পৃথিবী জানতে পারলো।"
বলে একটু থেমে দাদু আবার বললেন-
"কিন্তু আমাদের "মহাবট" জন্মেছিলেন কোত্থেকে?সে আরেক কাহানী, শুনে তোমরা হাসবে, বলবে যতো আজগুবি গল্প।" বলে দাদু হাসলেন।
আমি বললাম, "না না, বলুন না, জগতটাই তো কাহানী দিয়ে তৈরি..."
- "হা হা, তা বলেছ বেশ...তা মহাবটের গল্পে আছেন কবির দাস, মহাসাধক কবির। নর্মদা নদীর ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট পলিমাটির দ্বীপে যখন তিনি বাস করছিলেন, তখন তাঁর ফেলে দেওয়া দাঁতন থেকেই নাকি জন্মায় আমাদের পূর্বপুরুষ মহাবট। এর সত্যি-মিথ্যা তুমি বিচার করবে বাপু, আমি জানি না।
তবে সেই মহাবটের ছেলে-পুলে নাতি-পুতিরা সারা দেশময় ছড়িয়ে আছে। তোমাদের শিবপুরের যে পাঁচশো বছরের পুরনো মস্ত বটগাছটি রয়েছে,যার আসল গুঁড়িটা চিনতে পারা যায় না, তারপর অন্ধ্র দেশের ছশো বছরের পুরনো গাছটি, যা ছায়ায় এখনও বিরাট যাত্রাপালা বসে, এমনকি এই দুশো -আড়াইশো বছরের পুরনো আমি - সবাই ওই মহাবটেরই উত্তরপুরুষ।"
বলে দাদু শেষ করে হাঁফ নিল।
আমি শুনতে শুনতে কোথায় হারিয়ে গেছিলাম জানি না। শেষ কথাটায় সম্বিৎ ফিরল।
"আপনার বয়স আড়াইশো বছর?" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
দাদু স্নিগ্ধ হাসলেন, "আড়াইশো বছর বটগাছের হিসাবে কোন বয়স হোল নাকি রে দাদা..."
- "হ্যাঁ, তা ঠিক..." আমি ভাবলাম, " কিন্তু তার মানে, তার মানে আপনি এই বাড়িটা তৈরি হওয়ার আগে থেকে আছেন এখানে?"
- "হা হা হা...ঠিক ঠিক। আমার চোখের সামনেই তো বাড়িটা ধীরে ধীরে তৈরি হল গো..."
- "বলেন কি? তার মানে আপনি আমার নিজের দাদুকে চিনতেন?"
-"নিশ্চয়ই , সদাশিব তো প্রায়ই আমার কাছে এসে বসতো। তখন এখানটায় একটা ছোট বেদি মতো ছিল। অল্প বয়সে সদাশিব তো খুবই আসত, মাঝে বোধয় সময় পেত না, আবার আস্তে শুরু করেছিল শেষ বয়সে...অনেক কথা হত, সুখ- দুঃখের কথা, জীবনের কথা, যাপনের কথা..." দাদু আস্তে আস্তে বললেন।
আমি চুপ করে বসে ছিলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, "আমার কথা কিছু বলেনি?"
-"হা হা, বলেনি আবার? তুমি হওয়ার পর থেকে তো শুধুই তোমার কথা বলতো...তোমাকে খুব ভালবাসত তোমার দাদু..."
আমার চোখ জ্বালা করতে থাকল, গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে উঠছে মনে হল। হয়তো এটাকেই বলে দুঃখ, এটাকেই বলে সত্যিকারের কান্না, চোখ দিয়ে যেটা ঝরে পড়ে, সেটা তো ফলশ্রুতি মাত্র...
দাদু বলে চলল, "সদাশিব বলত, ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলাম না, কিন্তু আমার নাতিটা দেখবে আমার মান রাখবে। ছেলেটা বড় ভালো। সাধে কি আর নাম রেখেছি, রাজা।"
আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে গরম জল পড়তে থাকল, সামলাতে পারলাম না, বললাম "কিন্তু...কিন্তু...আমি তো পারিনি..."
দাদু খুব মোলায়েম স্বরে আমার কানের কাছে এসে বলল, "কে বলেছে তুমি পারনি...অঙ্কে একশ আর বড় চাকরিটাই কি একমাত্র পারা?"...মনে হল কেউ যেন বড় আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
বাঁধ ভেঙ্গে গেলো, কুড়ি বছরের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা- পড়াশোনায় হেরে যাওয়া, বাবার নিত্যদিনের গালাগাল,নেশার ঘোরে পড়ার বই-খাতা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া, সাদা মুখে মায়ের সিটিয়ে বসে থাকা, মাস্টার-মশাইদের তাচ্ছিল্য-ভরা চাহনি, আত্মিয়দের খোঁটা...সব হর হর করে চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
আচ্ছা, বড় হলে কি মানুষ কাঁদতে ভুলে যায়? তাই এতো কষ্ট জমে পাথর হয় বুকে?
-"শোন, শোন, শান্ত হও...কাঁদা তোমার দরকার ছিল...মানুষের মনে অনেক দুঃখ জমে গেলে তার কাঁদার দরকার পড়ে..." তারপর একটু থেমে বলল,
"সদাশিব আমাকে আরেকটা কথা বলে গেছিল...শোন, মন দিয়ে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে ঠিক বাইশ পা হাঁটলে তোমাদের বাড়ির পেছন দিকটায় পৌঁছবে। ওখানে তোমার ঠাকুরদাদার একটা গুদামঘর ছিল, জানো কি?"
আমি ততক্ষণে অবাক হয়ে শুনছি দাদুর কথা, জবাব দিলাম, "না...এরকম কথা তো শুনিনি..."
- "হুম, তোমার ঠাকুরদাদা আরও অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে মরিচের ব্যবসা করতেন। সেকালে মরিচের ব্যবসার বিশাল রমরমা ছিল, লোকে বলত "কালো সোনা"। যাইহোক, তা সেই মরিচের একটা গুদাম ছিল এখানে। ঘরটি বড়, কিন্তু বিশেষ ভাবে বানানো, বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়া যায় না। দুটো বাঁকা নারকোল গাছ আছে, সে দুটোর মাঝখান দিয়ে ঘরটিতে পৌঁছানোর রাস্তা। আজকে রাতে ছেড়ে দাও, কাল সকালে খুঁজে খুঁজে যেও সেখানে। একটা শাবল নিয়ে যেতে ভুলো না, দরজাটা অনেকদিন বন্ধ আছে তো, খুলতে কাজে লাগবে..."
-"কেন? কি আছে ওই ঘরে?" আমি প্রশ্ন করলাম।
দাদু হাল্কা হাসলেন, বললেন, "সদাশিবের বাবা সোমেশ্বরকে ব্যবসার দরকারে মালাবার-দেশে যেতে হয়েছিল। সেখানকার ত্রিবাঙ্কুর রাজ তিরুনালের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন তিনি। তো সেই মহারাজ ওনাকে কিছু উপহার দেন - হাতির দাঁতের উপর সোনার কাজ করা গহনা, তিনটি বড় বড় ঝুড়ি ভর্তি করে রাখা আছে, সব মিলিয়ে কতো ভরি আমি জানি না।"
আমার মনে হল আমি পড়ে যাবো। আরেকটু হলেই তো সব শেষ হয়ে যেত - এই বাগান, এই বাড়ি, এই লুকনো সম্পদ, এই বট-দাদু - সবই তো চলে যেত সত্যপ্রকাশ কেজরিওয়ালের হাতে...
দাদু বলে চলল, "সদাশিব বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করে রেখেছে গহনাগুলোকে, তোমার জন্য। তোমার বাবাকে কোনদিনই জানানো হয়নি, নাহলে সেগুলি থাকতো না। সদাশিব আমাকে বলে গেছিল, জানতো তুমি একদিন ঠিক আসবে আমার কাছে, তোমায় চিনত যে..."
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই শাবল-কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অভিযানে।
আগেরদিন সত্যপ্রকাশ বাবু আসেন নি, মল্লিকবাজারের কোন জলসায় "আটকে" গেছিলেন। ছাপোষা চাকুরের কষ্টার্জিত সময় আর নামকরা প্রমোটারের বিলাস-বহুলে খরচা করার সময়ের দামের বোধয় এটাই পার্থক্য।
যাইহোক, কালকের ঘটনা মাকে কিছু বলিও নি আমি, মা বিশ্বাস করতো না।
বট-দাদুর বলে দেওয়া জায়গা থেকেই উদ্ধার হল তিন ঘড়া ভর্তি গয়না। আলোয় আনতে চোখ ধাধিয়ে গেল আমার। এ জিনিসের মুল্য এখন অপরিসীম, বিশেষ করে এই ধরনের কাজ এখনকার কারিগররা পারবে না।
আমি ঠিক করে নিয়েছি আমি কি করবো। মায়ের জন্য বাছা বাছা কয়েকটি গয়না রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিয়ে সেই মুলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করবো আমি। আপাতত ছোট-খাট কিছু একটা দিয়ে শুরু করি, তারপর ধীরে ধীরে অগ্রসর হব। পারবো না কেন? হাজার হোক, সোমেশ্বর দত্তের বংশধর আমি !
দশ বছর পর
---------------
ফুড বিজনেসে অভূতপূর্ব সাফল্যের পর রিয়েল এস্টেটের দিকে এগোব ভাবছি। ইতিমধ্যে বিবাহ করেছি, একটি পুত্র সন্তানের বাবা আমি, বউ গৃহবধূ - চার জনের সুন্দর সংসার আমাদের।
কিন্তু, একটা জিনিস আমি কিছুতেই মেলাতে পারিনি।
দশ বছর আগে যে রাতে বট-দাদুর সাথে যে আমার এতো কথা হয়েছিল, তারপর দিন থেকে হাজার খুঁজেও বট গাছটিকে আমি খুঁজে পাইনি। আমাদের বাগানের প্রতিটা কোণা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি আমি - আম গাছ আছে, তেঁতুল গাছ আছে, নারকোল গাছ তো আছেই...কিন্তু বটদাদু যে কোথায় গেলো কে জানে?
0 comments: