0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in











  

  অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ১০


সুধী পাঠকদের কাছে আমি নতশিরে আর করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী, এই কিস্তির প্রেমের কবিতাগুলি খানিক এলোমেলো হয়ে পড়ার জন্যে, তার কারণ অবশ্য আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি নয়, কারণ আজ তিন মাস করোনার প্রকোপে সমস্ত লাইব্রেরিগুলি বন্ধ হয়ে রয়েছে। প্রয়োজনীয় বইপত্রের ভীষণ অভাব। কিছু নিজের ব্যাঙের আধুলি সঞ্চয় থেকে খুঁজে পেতে, চেয়ে চিন্তে আর কিছু আন্তর্জাল থেকে সংগ্রহ করে আজকের পরিবেশন।

উমবের্তো আকাবাল এর লেখা আমি প্রথম পড়ি ১৯৯০ এর দশকে -- “পাহাড়চূড়া থেকে নেমে আসা কবিতা” নামে একটি ইংরেজি অনুবাদ সংকলনে তাঁর কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তাঁর মাতৃভাষা “মায়া কিচে “, কিন্তু সেই ভাষা শেখার কোনো সুযোগ ছিল না তাঁর শৈশবে। তাই গুয়াতেমালার অন্য শিশুদের মতন তিনিও শেখেন এসপানিওল ভাষা এবং সেই ভাষাতেই তাঁর সাহিত্যচর্চার সূচনা। পরবর্তী জীবনে মাতৃভাষা শিখে নিয়ে তিনি সেই ভাষাতে কবিতা লিখতেন, কিন্তু তারপর এসপানিওল ভাষায় অনুবাদ করে নিতেন প্রকাশের জন্যে। চিলের ঐতিহাসিক মিগেল রোহাস মিস লিখেছিলেন, “Akʼabal sings like the birds, speaks Kʼicheʼ Maya and thinks like weʼd wish most men thinked.” তাঁর কবিতা হারিয়ে যাওয়া জগতের জন্যে হতাশার, বেদনার আর আক্ষেপের, কিন্তু সেগুলিই আবার প্রেমের কবিতার উপাদান। এর আগেও তাঁর কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছি কয়েকবার -- এখানে তাঁর কবিতাটি সংহত আর সংযত অনুভূতির। কবির শারীরিক মৃত্যু হয়েছে ২০১৯ সালে, কিন্তু তিনি এখনো তাঁর কবিতা দিয়ে গান গেয়ে চলেছেন পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষদের হয়ে।

চীন দেশে ১৯৭০ এর দশকে “ধূসর কবিগোষ্ঠী” (“মেংলং শিরেন”, “মিস্টি পোয়েট্স”) নামে একটি কবিতা আন্দোলন গড়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে শিল্পসৃষ্টির ওপরে ছিল কড়া সরকারী নিষেধাজ্ঞা, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে এই কবিরা লিখতে শুরু করেন কলাকৈবল্যবাদী কবিতা। চেয়ারম্যান মাও এর চিন্তাভাবনায় কবি ও শিল্পীরা মিলে গঠন করবেন এক “সাংস্কৃতিক সেনাবাহিনী”, যাঁদের একমাত্র কাজ হবে বিপ্লবকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রকৃত কবিরা এসব নিয়ম মেনে চলার মানুষ নয়, তাঁরা লিখলেন আপন মনে, প্রকাশ করলেন নিজেদের প্রাণের কবিতা পত্রিকা “জিনটিয়ান” (“আজকের দিন”)। পার্টির আর সরকারের প্রতিক্রিয়া নেমে এলো কঠিন ও কঠোর ভাবে; কবি ভাবুক আর বুদ্ধিজীবীদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো প্রত্যন্ত গ্রামে, প্রবল শারীরিক পরিশ্রমের কাজে। কিন্তু কবিতা লেখা থামলো না -- গড়ে উঠলো আন্ডারগ্রাউন্ড কবিতা আন্দোলন। সারাদিন শূকর পালনের শেষে, শূকরদের পাশে বসেই কবিতা লিখলেন একজন। অন্য একজন সেচের জন্যে খাল কাটার কাজ সেরে কাগজ কলম আর সিগারেট নিয়ে বসলেন। সেই সব কবিদের এখন বেশির ভাগ কারাগারে, অকালমৃত অথবা বিদেশে নির্বাসিত। এই আন্দোলন হাতেখড়ি নেওয়া দুই কবি এখানে সংকলিত।

কবি লিউ জিয়াওবো নেতৃত্ব দেন চীনের মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতার আন্দোলনে। ফলে তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় কাটে জেলখানায়। ২০১০ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান কিন্তু চীন সরকার তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেয় নি, স্টকহোমে গিয়ে পুরষ্কার নেবার জন্যে। কালান্তক কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়েও তিনি মুক্তি পান নি, তাঁর মৃত্যু ঘটে জেলখানাতেই। তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ করে রচিত করুণ প্রেমের কবিতাগুলি কারাগারেই রচিত।

হা জিন ভালো ইংরেজি জানতেন। সেই যুগে চীন সরকার চাইছে বিদেশে বাণিজ্য বিস্তারে, তাই ইংরেজি জানা চিনে নানুষের খুব-ই কদর। তাঁকে সরকারের হাতে বিশেষ কোনো দুর্বিপাকে পড়তে হয় নি। তিনি উচ্চশিক্ষার জন্যে আমেরিকায় আসেন কিন্তু ফিরে যান নি। গল্প বলার ছলে লেখা তাঁর কবিতাটিতে নারীপুরুষের বিষাদ-মধুর সম্পর্ক আর অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাগের কাহিনী।

এ ছাড়াও আছেন চারজন প্রসিদ্ধ মার্কিন কবি আর একজন আরবি ভাষায় দক্ষ ব্রিটিশ কবি -- তাঁদের প্রেমের কবিতা নিয়ে সরগরম এবারের নিবেদন। আসুন এবার কবিতা গুলি পড়ি:
রবার্ট রিগলি, (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫১- )

সতর্কতা

পরনে চাঁদের আলো আর
গায়ে নিবু-নিবু আগুনের ধোঁয়ার চাদর,
মেয়েটি হাতড়ে হাতড়ে বেরিয়ে এলো তাঁবু থেকে রাত দুটোয়,
এবং উবু হয়ে পেচ্ছাপে বসলো,

এক স্বর্গীয় আলোয় সব পরিষ্কার দেখলাম:
রূপোলি পাহাড়ের শীতল পাথুরে লকলকে জিভ 

আর সদা চলমান পপলারের ঝরা পাতারা,
চুকচুক চেটে নিচ্ছে তার পিঠ, তার নিতম্ব,

তার ঊরু, এবং আরও পরিষ্কার, সেই ঘন 

সবুজ চোখের অজ্ঞাত প্রাণীটি জঙ্গলের 

আড়াল থেকে লক্ষ করছিল তাকে নিমেষহীন --
মনে হয়েছিল একটি হরিণ, এখনও মনে হয়,

যদিও বলতে হবে সে রাতে আমি উঠি নি 

নিশ্চিত জানার জন্যে, আলো জ্বালি নি, টুঁ শব্দটিও করি নি 

অপেক্ষা করেছি তার ফিরে আসার,
আমার মাথা ক্রমশঃ ঢলে পড়েছে 

আমারই জামাকাপড় দিয়ে বানানো বালিশে 

আর জড়িয়ে নিয়েছি তার থরো থরো 

তাঁবুতে ফিরে আসা শরীরকে, যেখানে 

আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কোনোদিন উঁকি দেব না।

[রবার্ট রিগলি কবি, প্রাবন্ধিক এবং আইডাহো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কবিতাটি ২০০৩ সালে প্রকাশিত “প্রাণীর জীবন” (“Lives of Animals”) কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে।]

উমবের্তো আকাবাল: (গুয়াতেমালা, ১৯৫২-২০১৯)

ভোর

রাতের শেষ প্রহরে নক্ষত্রেরা
জামাকাপড় ছেড়ে
নদীর জলে নাইতে নামে

আকুল হয় প্যাঁচারা 

কামনায় তাদের ঘাড়ের পালক 

খাড়া হয়ে দাঁড়ায়

[গুয়াতেমালার ভূমিজ কবি, মায়া-কিচে ভাষায় কবিতা লিখে নিজে এস্পানিওল ভাষায় অনুবাদ করেন। কৈশোরে মেষপালক ও তাঁতির কাজ করেছেন। ঠাকুরদা বলেছিলেন, বই পড়া খুব খারাপ জিনিশ, কিন্তু তিনি তাঁর কথা শোনেন নি। মাতৃভাষায় নিজের কবিতা প্রকাশের সুযোগ পান নি অনেক দিন। কবিতা ও গানের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন লাতিন আমেরিকার বিবেক। কবিতাটির এসপানিওল ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডেনিস টেডলক।]


রিতা ডাভ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫২- )

প্রণয়রঙ্গ


প্রথমেই মুখ ফুটে
বলার কিছু নেই

মনে হয়। কেবল কমলালেবুটা
ছাড়িয়ে চার টুকরো 

টিউলিপের মতন মেলে রাখো 

মহার্ঘ বোন-চায়নার প্লেটে,

অভাবনীয় কিছু
ঘটলেও ঘটতে পারে।

বাইরে সূর্যদেব তাঁর মাদুর গুটিয়ে 

গৃহের পথে রওনা দিয়েছেন,

আর নিশীথ এসে মুঠো মুঠো লবণ 

ছড়িয়েছে আকাশের গায়ে।

আমার হৃদয়ে যে সব সুর বেজে চলেছে,
অনেক যুগ শোনা হয়নি তাদের।

প্রশান্তির এই নরম মাংস --
এসো প্রাণ দিয়ে শুঁকি তাদের, আর

পেট ভরে খাই। নানাভাবে
বাঁধিয়ে রাখা সম্ভব এই মুহূর্তকে -- 

বাগানের ঝোপঝাড় কেটে 

হাতিঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে রাখি,

যাতে তাদের মধ্যে দিয়ে আনন্দে হাঁটতে পারি
এই মুহূর্তটিকে স্মরণে রেখে। 

[মার্কিন কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। ১৯৮৭ সালে কবিতায় পুলিৎসার পুরষ্কার পেয়েছেন। দশটি কাব্যগ্রন্থ, একটি উপন্যাস আর একটি নাটক। আমেরিকার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস এর সভাকবির পদ অলংকৃত করেছিলেন ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫। কবিতাটি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত “মিউজিয়াম” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]


কিম অ্যাডোনিজিও: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫৪- )

তোমার জন্যে প্রথম কবিতা


গভীর, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে তোমার বুকের উল্কিগুলো 

ছুঁয়েছেনে দেখতে ভালোবাসি, চোখে তাদের দেখতে না পেলেও।
আমি জানি তাদের উপস্থিতি, তাদের স্থানাঙ্ক আমার মুখস্থ: তোমার
স্তনবৃন্তের ওপরে বিদ্যুৎচমকের নিখুঁত লাইনগুলো টানা, হৃদস্পন্দনের
মতন প্রাণচঞ্চল। অনায়াসে খুঁজে নিতে পারি তোমার কাঁধে সমুদ্রের নীল
জলের ঢেউ, যেখানে বিষাক্ত সাপ এঁকেবেঁকে ছোবল দিতে যায় অগ্নিবর্ষী
এক ড্রাগনকে। যখন তোমায় হিড়হিড় করে টেনে আনি

আমার স্তনের নরম উষ্ণতায়, ভরে নিই তোমায় নিজের গহনে,
তারপর দুজনেই নি:শেষিত এবং নীরব শয্যায় চাদরে: তোমার
ত্বকের ওপরে আঁকা ছবিতে চুমু খেতে ভালোবাসি। কামনায় তোমাকে 

পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া পর্যন্ত আমার চুমু খাওয়া চলবে। যা কিছু রয়ে যায়
অবশিষ্ট, কিংবা বয়ে আনে যন্ত্রনা তোমার-আমার মধ্যে,তারা সেখানে
থাকবে চিরকাল; ভয় পাই সেই সব স্থায়িত্বকে। তাই অন্ধকারে স্পর্শ
তাদের; আর চেষ্টা চালিয়ে যাই এইভাবে।


মেয়েরা কী চায়?


আমি একটা টকটকে লাল ড্রেস চাই। 

ফিনফিনে পাতলা, কমদামি,
ভীষণ আঁটোসাঁটো টানটান, পরে থাকতে চাই 

যতক্ষণ না কেউ টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলে।
হাত থাকবে না, পিঠটাও উদোম,
এমনই পোশাক, কাউকে কল্পনা করতে হবে না 

চোলিকে পিছে কি রয়েছে। আমি রাস্তা দিয়ে 

হেঁটে যাবো মনোহারি আর লোহালক্কড়ের 

দোকানগুলোর ধার ঘেঁষে, জানলায় চকচকে চাবির গোছা,
ওয়াং দম্পতিই ক্যাফেতে বিক্রি হয় বাসি ডোনাট,
গুয়েরা ভাইয়েরা ধরে ধরে ট্রাক থেকে নামাচ্ছে 

ছালছাড়ানো শুয়োর, কাঁধে করে এবং 

মসৃণ চোয়াল ধরে একে একে তুলছে হাতঠেলায়।

আমার হাঁটার দেমাকে বোঝা যাবে আমিই 

পৃথিবীর একমাত্র নারী, যা ইচ্ছে করতে পারি।

লাল ড্রেসটা আমি ভীষণ ভাবে চাই।
বাজারে ফিসফাস যা শুনেছো 

ড্রেসটা দেখলে মনে হবে সব সত্যি,
আমি কিছু কেয়ার করি না, আমি করবো 

আমার যা চাই।

ড্রেসটা খুঁজে পেলে তাকে টেনে নেবো 

হ্যাঙ্গার থেকে, নিজের নতুন শরীরের মতন 

সন্তর্পণে, উঠে আসবো নতুন পৃথিবীতে 

জন্ম নেবার কান্না ও রাগমোচনের কান্নার 

ফাঁকে ফাঁকে, আমি তাকে পরবো যেন 

আমার অস্থি, আমার ত্বক, তোমরা 

এই অভিশপ্ত ড্রেসটা পরিয়েই 

শ্মশানে পাঠিও আমায়।



[মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক। ছ’টি কবিতার বই, দুটি উপন্যাস, দুটি ছোটোগল্পের সংকলন, দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রথম কবিতাটি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত “দার্শনিকদের ক্লাব” কাব্যগ্রন্থ থেকে। দ্বিতীয় কবিতাটি ২০০০ সালে প্রকাশিত “আমাকে বলো” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]


কিমিকো হান, (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫৫- )

আলো 


তুমি যখন আপিস ছেড়ে যাও
আমি মাথার ওপরের আলো নিভিয়ে দিই যাতে 

সেক্রেটারি ভাববে আমিও চলে গেছি।
আমার বিবর্ণ ডেস্কে শাদা কাগজটির দিকে চেয়ে থেকে 

কৈশোরের কথা মনে পড়ে 

সেই একই আলোর নিচে: মিশতে না পারা 

বাকি জগতের সঙ্গে 

যারা চায় তাদের মতন করে 

তোমাকে সব কিছু করতে হবে।
সাঁতারের ব্যাকস্ট্রোক।
মৃদু টাইপিং।
প্যাটার্ন দেখে ড্রেস মেপে কাটা।
দামি খাপি সূতির কাপড়
গোলাপি রং, ঘাস ফুলের প্রিন্ট
সমান করে টেবিলের ওপরে পাতা,
পিনগুলো ধরে রেখেছি ঠোঁটে।
তারপর ঘরে বসে হেম শেলাই। তখন
স্কুলে ড্রেস পরে যাওয়া নিয়ম।
তখন থেকেই জানি একদিন আমার বিয়ে হবে 

কিন্তু তার আগে হবে নিজের আপিস।
এই আপিসে আলো থাকলেও, আসলে অন্ধকার 

যেমন ছিল আমার নিজের ঘর, আমি
আঁধার ঘরের কন্যা, কোনোদিন
আলোজ্বলা ঘরের কন্যা হতে চাই নি।
খুব ইচ্ছে করে, তুমি ঘুরিয়ে নেবে গাড়ি
তোমার স্ত্রী ও সন্তানের থেকে দূরে
আর ফিরে আসবে এই
আলো আঁধারের চৌকোয়
যা এতো চেনা, আমি সবসময় বলি,
কখনো কেঁপে ওঠে না দু:খে।


[মার্কিন কবি এবং নিউ ইয়র্কের কুইনস কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। “শিল্পীর কন্যা” এবং “মশা ও পিঁপড়ে” তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবিতাটি “দি নিউ ইয়র্কার” সাময়িকপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।]


লিউ জিয়াওবো: (চিন, ১৯৫৫-২০১৭)

পালাতে চাই
আমার স্ত্রীর জন্যে

ত্যাগ করো কল্পিত শহীদদের স্মৃতি 

তোমার পায়ের কাছে শুতে চাই আমি 

মৃত্যুর সঙ্গে নিবিড় বন্ধন থাকা সত্ত্বেও 

এটা আমার কর্তব্য --
মনের মুকুর যদি পরিচ্ছন্ন থাকে, তাতে 

অন্তহীন সুখ।

তোমার পায়ের আঙ্গুল আঘাত পাবে না 

তবে কাছে ঘেঁষবে তোমার মেনিবিড়াল 

আমি তাকে তাড়িয়ে দিলে সে 

দূর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে আমায়
উদ্যত থাবায় তাকাবে 

তার নীল চোখের গভীরে 

আমি খুঁজে পাবো আমার জেলখানাকে।
যদি আমি সঙ্গে সঙ্গে বিনা দ্বিধায় 

পালিয়ে না যাই 

তার চোখে প্রিয় খাদ্য 

মাছ হয়ে দাঁড়াব আমি। 


১২ আগস্ট ১৯৯৯।


একটি চিঠিই যথেষ্ট 

জিয়া-র জন্যে 


একটি চিঠিই যথেষ্ট 

আমার উত্তরণের এবং 

তোমার সামনে হাজির হয়ে 

কথা বলার জন্যে 


বাতাস যখন বয় 

রাতকে পেরিয়ে 

আর নিজের রক্ত দিয়ে 

গোপন কবিতা লিখে 

মনে করিয়ে দেয় আমাকে
প্রতিটি কথাই হতে পারে শেষ কথা 


তোমার শরীরের সব বরফ 

গলে যায় ঘাতকের চোখের 

কল্পকথার আগুনে 

ক্রোধ পরিণত হয় পাথরে 


দু সারি লোহার রেলিং 

অপ্রত্যাশিত -- একত্রে আসে 

পতঙ্গেরা ধায় আলোর দিকে --
সে আলোর অনির্বাণ দিকনির্দেশ 

তোমার ছায়ার অনুসরণে 


৮ জানুয়ারি ২০০০।

[চীনের নির্যাতিত কবি। ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তবে তখন তিনি জেলখানায়। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ২০১৭ সালে। জেলখানায় বসে লেখা এই সব কবিতা। কবিতাগুলির চিনে ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জেফ্রি ইয়াং।]

হা জিন, (চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৫৬- )

কীভাবে আমি আদর্শ স্ত্রী হলাম 


রাস্তার ধারে কালো ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো 

লোকটা আর তাকিয়ে দেখলো আমাকে ক্ষেতে
গুটিপোকার জন্যে মালবেরির পাতা ছিঁড়তে।

প্রথম থেকেই খেয়াল করেছি 

চিতাবাঘের মতন লেলিহান তার দৃষ্টি,
কিন্তু দেখেও দেখার ভান করি।

“কী গো? কেমন আছো?” এগিয়ে এলো মানুষটা
ঘুরে দাঁড়ালাম আমি
হাতুড়ি পিটছে আমার বুকের ভেতর।

জাঁদরেল আর রাজকীয়, এমন মানুষটাকে
নির্জলা অমান্য করি কী করে, হয়তো সে
ছদ্মবেশে কোনো সরকারি আমলা?

(আমার স্বামী আমাকে সাঙ্গা করে
তিন দিন পরেই কেটে পড়েছে
হান রাজ্যে বড়ো চাকরির নাম করে।

সাত বছর ধরে তার টিকির দেখা নেই 

বা কোনো চিঠিপত্তর, স্বামী থেকেও 

বিধবার জীবন আমার।)

মানুষটি কাছে এলো, আলতো করে 

কাঁধে হাত রাখলো আমার,
তার পর তার হাত নেমে এলো সিল্কের অন্তর্বাসে।

“ছেড়ে দাও, তোমার পায়ে পড়ি,” কেঁদে উঠি 

আমি ভয়ে, তার হাত তখন কোমরে 

ঘাঘরার দড়ির কাছাকাছি।

“কী করে ছাড়ি তোমায়,” হাসলো মানুষটা।
পাহাড়ের মাথা থেকে তোমায় দেখেছি
রাজহাঁসের মতন পাখা মেলতে। 

গাছের ডালে ঝুলছে আমার সাজি
তৃপ্ত মানুষটি পকেট থেকে খানকতক
রূপোর মুদ্রা বের করে ফেললো তাতে।

“কাল বিকেলে আসবো আবার,”
মুখ খুললো মানুষটি
“এইখানে অপেক্ষা করবে আমার জন্যে।”

সে ঘোড়ার পিঠে চাপলো আর ছুটলো টগবগিয়ে।
চেনা চেনা লাগলো খুব 

কিন্তু মনে পড়লো না মুখটা।

চটপট জিনিষপত্তর গুছিয়ে 

গ্রামের দিকে রওনা দিলাম 

কাল সারাদিন ঘরের থেকে বেরুবো না।

কিন্তু বাড়ির সদর দরজার বাইরে 

আমার স্বামীর পোঁতা উইলো গাছে বাঁধা 

সেই একই কালো ঘোড়া।

প্রায় মূর্ছা যাই আর কী, আমার মানুষটাই শেষে 

ভোগ করলো আমায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে আর লাভ কী?
যখন তুমি আর নেই সে তুমি?

সাজিটা নামিয়ে রেখে 

হাতের বালাদুটো ফেললাম তার ভেতর, আর 

দৌড় দিলাম জঙ্গল পেরিয়ে জলের পানে।

[চিনে-মার্কিন কবি। জন্ম কমিউনিস্ট চীন দেশে। এংলো-মার্কিন সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে আমেরিকার ব্র্যান্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করতে আসেন। তিয়েন-আন-মেন্ চত্বরের গণহত্যার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, ১) এর পর আমেরিকাতেই থেকে যাবেন; আর ২) কেবলমাত্র ইংরেজিতে লিখবেন। কবিতা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু করলেও এখন তিনি মূলতঃ কথাসাহিত্যিক। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন।]


সেরা ম্যাগুয়ার: (ইংল্যান্ড, ১৯৫৭-২০১৭)

ঠিক সময়মতো 


যে রাতে তোমার প্রেমে পড়লাম, আমার ঘড়ি হারালো:
খুলে রেখেছি সমুদ্রের প্রান্তে, গড়িয়ে গেল অন্ধকারে 

আমি তখন তারাদের অন্ধকারে, সাঁতরে জলে নামি,
আলো জ্বলা এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় জেলেদের চিৎকার 

তাদের মাছের কথা, বন্দরের, আর ভোরবেলা বাড়ি ফেরার।
কল্পনা করো, শীতল বালির মধ্যে ডুবে গিয়ে, লুকিয়ে 

অনেক বছর ধরে, একের পর এক বালুকণার 

টিক টিক শুনতে শুনতে -- যখন তোমার হাত 

বাঁধা পড়ে আমার হাতে, জমে নাড়ির টান।

[ব্রিটিশ কবি, অনুবাদক ও টেলিভিশনের প্রতিবেদক। সাহিত্যচর্চা শুরু করার আগে উদ্যানশিল্পের দক্ষ কর্মী ছিলেন। আরবি ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করে তাঁর খ্যাতি, বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দরবেশ (১৯৪১-২০০৮) এর কবিতা। যতদূর জানা যায় ইংরেজি ভাষার তিনিই একমাত্র কবি, যাঁর আরবি ভাষায় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত “নষ্ট দুধ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

জুন ২০২০ [ক্রমশ:]

0 comments: