গল্প - রাখী দাস
Posted in গল্পগগন বাউলকে কর্ড লাইনের প্রায় সবাই চেনে। আসল নাম গগন ভট্টাচার্য। পলাশবাড়ী গাঁয়ের পুরুত তারক ভট্টাচার্যের ছেলে গগন। সেই কোন ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে যজমানি করতে বেরিয়েছিল। বাবা চলে যাওয়ার পরে সেই বাঁধা বাড়ি ক'টায় যজমানি করে ভালই চলে যাচ্ছিল একটা পেট। কিন্তু কথায় আছে না, কাল; সেই কালে কালে গ্রামের চেহারা বদলালো। অবস্থাপন্নরা ধীরে ধীরে গাঁ ছেড়ে শহরে, শহর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিতে লাগলো। যারা পরে রইল তাদের মাসে মাসে পয়সা দিয়ে বামুন রাখার ক্ষমতা নেই। অগত্যা স্টেশনের কাছে চায়ের দোকান দিল গগন। মা লক্ষী উজাড় করে না দিলেও মোটা ভাত কাপড় জুটে যাচ্ছিল। তাছাড়া গাঁয়ের পুজো, ব্রতর উদযাপন এসবে তো ডাক পড়তই। যদিও গগনের বরাবরের শখ ছিল বাউল হবার। গাঁয়ের শেষে নদীর ধারে একটা বড়সড় আখড়া ছিলো বাউলদের। মাঝে সাজে সেখানে যেত গগন। শুনে শুনে কয়েকটা গানও তুলে নিয়েছিল। কিন্তু বরাবরের মত ঘরছাড়া হতে পারেনি। আখড়ায় সবাই যাকে গুরু মানত, সেই জগাই বাউল গাঁজায় দম দিতে দিতে বলেছিল, “বাউলানি অত সহজে হয় না রে গগন। অনেক কিছু ছাড়তে হয়। তোর ষোলো আনার চোদ্দ আনাই এখানে ওখানে বাঁধা পরে আছে। দু' আনির বাউল হয়ে কি হবে বল? যদি কখনো ষোলো আনা এক করতে পারিস তাহলে শুক্লপক্ষের চাঁদ পুরো হবার আগে আসিস। তখন দেখা যাবে”। সেই শেষ; আখড়ার দিকে আর পা বাড়ায়নি গগন। তবে সেই জগাই বাউল, লোকে যাকে ভালো বেসে পাগলা জগাই বলত, বেশ নামডাক ছিল তার। তাঁর খোঁজে অনেক বাউল, আধাবাউল, না-বাউল, খবরের কাগজের লোকজন আসত। স্টেশনের কাছেই গগনের দোকান হওয়াতে তারা একটু জিরিয়ে নিয়ে চা খেয়ে পথের কষ্ট কাটিয়ে আখড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিত। তাই বেশ ভালই চলত গগন বাউলের চায়ের দোকান। জংশন এর পাঁচটা স্টেশন আগে মল্লারপুরে সোম বুধ আর শুক্রবারে বড় হাট বসত। গগন ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ত হাটের দিন। সেখান থেকেই কিনে আনত দোকানের সরঞ্জাম, রকমারি বিস্কুট। ফেরার ট্রেনে দেখা হত ডেলি প্যাসেঞ্জার দের সাথে। জংশন এর ব্যাঙ্ক ডাকঘর ইস্কুলে চাকরি করতে আসত সবাই। গগনকে হপ্তায় তিনদিন দেখাটা সবার চোখের অভ্যেস হয়ে গেছিল। প্রথম প্রথম ট্রেনের দরজার কাছে বসে বসে আখড়ায় শেখা গানগুল গুনগুন করত গগন। গলাখানা বড় মিঠে ছিল তার। আস্তে আস্তে সবাই ওর গানের ভক্ত হয়ে গেল। অনেকেই পয়সা দিতে চাইত। কিন্তু গগন জিভ টিভ কেটে বলত, “আমি অভাবের বাউল নই গো, স্বভাবের বাউল। টাকা দিয়ে কি করব?” উপায়ন্তর না দেখে বাবুরা আস্তে আস্তে ওর কাছ থেকে বিস্কুট কেনা শুরু করল। এই বিস্কুট কলকাতায় মেলেনা। মফস্বলের ছোট বেকারির বিস্কুটের স্বাদই আলাদা। অবিশ্যি গগন বিস্কুট বেচতে আপত্তি করত না। একবার গাঁয়ের হরিহর কাকার সাথে ট্রেনে দেখা। গাঁয়ের সবাই গগনকে গগন বাউন বলেই ডাকত। হরিহর কাকার মুখে গগন বাউন শুনে ট্রেনের বাবুরাও তাকে ওই নামেই ডাকতে শুরু করল। সেই গগন বাউন মুখে মুখে কবে গগন বাউল হয়ে গেছে সে কথা গগনেরও মনে পড়েনা। আর মনে পড়বেই বা কিকরে? সারাদিনে কি কিছু কম কাজ থাকে গগনের? সেই কাক ভোরে উঠে কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করা। তারপর ঘরের কুলুঙ্গির দেবতাদের ঘুম ভাঙান, তাদের সজ্জা করা, ফুল তুলে পুজো করা। এসব সেরে রাতের রাখা একটু পান্তা খেয়ে দোকান খুলতে যায় গগন। সেখানে ততক্ষণে হারু গোয়ালা পৌঁছে গেছে; মাজা ডেকচিগুলতে দুধটা নিয়ে উনুন ধরায় সে। আর একটু পরেই লাইনম্যান রাখহরি আসবে মাস্টারবাবুর জন্য চা নিতে। আগে ভাগে সেইটুকু করে নিয়ে দোকান সাজিয়ে বসে গগন। ফুটন্ত চায়ের চড়াই উৎরাই দেখতে দেখতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুপুরবেলা রান্নার ঝামেলা নেই, হারুর কাছে মাসিক বন্দবস্ত করা আছে। ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁলেই হারুর মেজ মেয়ে আসে থালা সাজিয়ে। আয়োজন সামান্যই থাকে তবে গগনের চলে যায়। সুয্যি পশ্চিমে হেললে গগন দোকানে সন্ধ্যে দেয়। এই সময় আরও একপ্রস্থ চা যায় মাস্টার বাবুর জন্য স্টেশনে। সাড়ে সাতটার লোকালটা চলে গেলে স্টেশনটা কেমন যেন ঝিমিয়ে যায়। গগনও আস্তে আস্তে ঝাঁপ ফেলার জোগাড় করে। উনুন নিবিয়ে বাসন কোসন মেজে গগন যখন ঝাঁপ ফেলে দেয় তখন ঠিক ঘড়িতে আটটা। বাড়ি ফিরে কুয়োপাড়ে স্নান সেরে সন্ধ্যে দেয় গগন। তারপর একটু ভাতে ভাত বসিয়ে রেডিওটা চালিয়ে টুকটাক কাজ সারতে সারতেই রাত গভীর হয়। নৈঃশব্দের বুক চিরে দূর থেকে ভেসে আসে আখড়ার বাউলদের গানের সুর। সেই ঘুমপাড়ানি সুরে ভেসে ভেসে গগন ভাবে এজন্মে কি আর ষোলো আনা এক করা যাবে? জগাই বাউল কি তাকে কাছে টেনে নেবে। অবশ্য চিন্তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হওয়ার আগেই দুচোখে ঘুম নেমে আসে। এই মোটামুটি গগনের নিত্যদিনের কাজ। অবশ্য মল্লারপুরে হাটের দিন থাকলে আলাদা। সেদিন দোকান খুলতে দেরী হয়। বাবুদের ফরমায়েশি বিস্কুট কিনতে হয় হাট থেকে। তাছাড়া দোকানের জিনিস, সংসারের টুকিটাকি জিনিস কিনে নটা পাঁচের ডাউন ট্রেনে ওঠে গগন। সেখানে বিক্রি-বাট্টা দু এক কলি গান চলতে চলতে জংশন এসে পড়ে।
ট্রেনে চা বিক্রি করার কথাটা গগনের মাথাতে আসেনি। সেবার দাসবাবুর বদলী হয়ে গেল অন্য জায়গায়। শেষ দিনে ছলছল চোখে দাসবাবু গগনকে ডেকে বললেন, “গগন, এই নে এটা রাখ, তোর জন্য এনেছি।“ দাসবাবুর হাতের লম্বাটে বোতলের মত একটা কি যেন!
“এটা কি গো বাবু?”
“এটা? এটাকে ফ্লাস্ক বলে। এতে গরম জিনিস গরম আর ঠান্ডা জিনিস অনেকক্ষণ ঠান্ডা থাকে। “অ ফেলাক্স?” সলজ্জ হাসি হেসে গহন উত্তর দেয়, “ফেলাক্স তো আমি চিনি। দোকানে যখন খবরে কাগজের বাবুরা আসে তখন নিয়ে আসে দেখেছি। চা ভরে নিয়ে যায়। সেগুলো অবিশ্যি ছোট। এ তো বেশ বড়সড়। কিন্তু আমি এটা নিয়ে কি করব গো বাবু?”
“কেন, চা রাখবি? ট্রেনে সবাই তোর বিস্কুট খেতে পছন্দ করে। এবার থেকে যেদিন হাটে আসবি তখন এতে করে চা নিয়ে আসবি। দেখবি, ভাল বিক্রি হবে। আমরা অনেকেই খুব ভোরে বেরই। একটু চা পেলে বেশ হয়।“ শেষের দিকে বাবুর গলাখানা কেমন ধরে আসছিল। আহারে, এতদিনের দেখাসাক্ষাৎ। নাহয় কিছুক্ষণের জন্যই হল, তাও পথের সম্পর্ক বলেও তো একটা কথা হয়। দাসবাবুর কথা ফেলতে পারল না গগন। তাছাড়া কামরার অন্যরাও বলল চা পেলে তাদেরও ভাল হয়। সেই থেকে হাটের তিনদিন রাত থাকতেই ঊঠে পড়ত গগন। তড়িঘড়ি বাড়ির উনুনে আঁচ উঠিয়ে চা করে ফেলাক্সে ঢেলে রাখত সে। সকালে গগনের হাতের গরম গরম চা আর বেকারির বিস্কুট যেন একভাঁড় অমৃত। মল্লারপুরের আগের স্টেশনেই চা আর গান পাগল বাবুরা সবাই নিজের কামরা ছেড়ে গগনের কামরায় এসে উঠত। জংশন আসার আগেই গগনের ফেলাক্স খালি আর মণ্ডল বেকারীর বিস্কুট এর অর্ধেক প্যাকেট শেষ। বাকিটা দুদিনের জন্য যথেষ্ট। এইভাবেই এক চিলতে চায়ের দোকান আর ট্রেনের বাবুদের চা বিস্কুট খাইয়ে চলে যাচ্ছিল গগন বাউলের দিনগুলো। ডেলি প্যাসেঞ্জার দের অনেকেই বদলি হয়ে চলে যেত; তাদের জায়গায় নতুন লোকেরা আসত। নতুন নতুন মুখগুলো গগনের হাতের চা খেয়ে আর গলার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যেত। তবে গানের জন্য পয়সা দিতে চাইলেই গগনের এক বাঁধা বুলি, “আমি অভাবের বাউল নই গো, স্বভাবের বাউল।“
কার্তিকের শুরু হয়েছে দিন দুই হবে। বাতাসে হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ আর হেলে পড়া সুর্যের আলো জানান দিচ্ছে ঋতু বদলের। এই সময়ে গগনের চায়ের ব্যবসা ভালই চলে, বিশেষ করে ট্রেনের বাবুরা কেউ কেউ এক ভাঁড় বেশী চা খান। আবার যারা শুধু বিস্কুটের খদ্দের তারাও সকালের মিঠে রোদের ওম মেখে চায়ের ভাঁড় এ চুমুক দেন। ট্রেনে সেদিন ভালই ভিড় ছিল। অনেক বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপুলেরা যেন দল বেঁধে কোথায় চলেছে। ডাকঘরের সরকারদা বললেন আজ নাকি জংশনে কিসের একটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা ; তাই সব চলেছে সেখানে। গগনেরও বিক্রি-বাট্টা ভালই হল। জংশনে কামরা খালি হলে রোদ্দুরের দিকে সিটটাতে বসল গগন। আখড়ায় শেখা একটা প্রিয় গানের দু' কলি গেয়েছে কি গায়নি হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন সুরেলা একটা আওয়াজ ভেসে এল। শব্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে বুঝল ঠিক তার সিটের নীচ থেকেই আওয়াজটা আসছে। ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে চৌকোমতন যন্তরটা বার করে আনল গগন। এই তো, এইটার থেকেই আওয়াজ আসছে, কিন্তু একি? এটা এত কাঁপছে কেন? কাঁপুনির চোটে আর একটু হলেই হাত ফস্কে পড়ে যেত জিনিস্টা। যাহ, আর তো বাজছে না। সামনের কাঁচটা আবার কালো হয়ে গেল। কিন্তু দু এক মিনিট পরে আবার সেই কাঁপুনিময় বাজনা। কাঁচটায় অনেকগুলো ইংরেজি নম্বর ফুটে উঠেছে আর তার নীচে একটা সবুজ গোল আর একটা লাল গোল। তাহলে এটা কি মোবাইল? “না না, তা কিকরে হবে?” ভাবল গগন, “মোবাইল টেলিফোন তো স্টেশন মাস্টার বাবুরও আছে।“ একবার দেখেছিল সেই যন্তরটা গগন। বড় টেলিফোনের মত তারটার নেই। কিন্তু সেটাতে তো ছোট্ট একটা কাঁচে নম্বর ফুটে ওঠে। কাঁচের নীচে রবারের কাগজে এক দুই তিন এসব লেখা থাকে আর সেটা তো এই একমুঠ একটা জিনিস। এটা তো বেশ বড়সড়, গগনের হাতে এঁটে উঠছে না। এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল। এর মধ্যে দু তিনবার আরও বাজল যন্ত্রটা। কি করবে কি না করবে ভাবতে ভাবতেই পলাশবাড়ী এসে গেল। কোনোক্রমে জিনিসটা ঝোলায় পুরে মালপত্র নিয়ে নেমে গেল গগন। ডাউনের লাইনে নামলে আর ব্রিজ পেরোতে হয় না। স্টেশনের শেষ মাথায় মাস্টারবাবুর ঘর। দরজায় গিয়ে দাঁড়াল গগন। 'কিরে কিছু বলবি?' হাতের টেলিফোন রিসিভারটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন স্টেশন মাস্টার। “হ্যাঁ, মানে,” ঝোলা থেকে যন্ত্রটা বের করে টেবিলে রেখে গগন বলল, “এই,.....এইখান ট্রেন থেকে পেলাম, আপনি যদি একটু দেখেন।“ টেবিল থেকে জিনিসটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন মাস্টার বাবু।৷ “এ তো টাচফোন রে, খুব দামী জিনিস”। “কি ফোন?” দামী জিনিস কথাটায় আতংকিত হয়ে গগন অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করল! “টাচফোন। মোবাইল বলতে পারিস, এই আমার কাছে যেরকম আছে। তবে এ জিনিস অনেক ভালো। তা হ্যাঁ রে, তুই এটা কুড়িয়ে পাওয়ার পরে বেজেছিল?” ঘাড় নেড়ে গগন জানাল হ্যাঁ বেজেছিল আর খুব কাঁপছিলও। তবে মাস্টারবাবুর ফোনে যেমন গান বাজে এইটার গানটা তেমন নয়। “এটা তো চালু হচ্ছে না রে; তোর হাত থেকে পড়ে টরে যায়নি তো?” “না না মাস্টারবাবু,” বেশ জোর গলায় গগন জানাল যে তার হাত থেকে জিনিসটা পড়েনি। “তাহলে বোধহয় চার্জ শেষ হয়ে গেছে, তাই বন্ধ হয়য়ে গেছে। এ তো বেশ ঝামেলার ব্যাপার হল রে গগন। আমার কাছে তো এর চার্জার নেই”। “কি হবে তাহলে মাস্টার বাবু?” “তাইতো ভাবছি রে,” চিন্তিত গলায় বললেন স্টেশন মাস্টার। “ আচ্ছা, যেই সিটের তলায় তুই এটা পেল সেখানে কারা বসেছিল খেয়াল করেছিলি? তুই তো ডেলি প্যাসেঞ্জার দের চিনিস, ওদের কারো নয়ত।?” 'না গো, আজ অনেক নতুন ছেলেরা উঠেছিল ট্রেনে, ডাকবাবু বললেন কিসের নাকি পরীক্ষা আছে। জানালার সিটে দুটো অল্পবয়সী ছেলে বসেছিল। হয়ত ওদেরই হবে।' গগনের কথা শুনে চিন্তায় পড়লেন মাস্টারবাবু। দামী জিনিস। যার হারিয়েছে সে হয়ত মাথা কুটে মরছে এখন। অবিশ্যি এত দামি জিনিস নিয়ে ঘোরারই বা কি আছে কে জানে? “যাক গে; কি আর করা যাবে? শোন এক কাজ কর, এটা তুই আমার কাছেই রেখে যা। শুনেছি এসব জিনিস হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়ার নাকি কিসব ব্যবস্থা আছে। কেউ যদি এর মধ্যে খোঁজ করে তাহলে আমি দেখব নাহয়। তুই এখন যা, আর চিন্তা করিস না।“ গগনকে আশ্বস্ত করলেন মাস্টার বাবু। কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে বাড়ির পথ ধরল গগন। মনে যদিও চিন্তাটা কাঁটার মত খোঁচাচ্ছে। এত দামী জিনিস, যার গেল তার গেল। আগামী পরশু আবার হাট বন্ধ থাকবে। তার মানে ট্রেনে চাপতে চাপতে সেই সোমবার। নাকি কাল একবার যাবে গগন ট্রেনে? যদি সেই ছেলেদুটি ট্রেনে ওঠে? বা বাবুরাও তো ওদের কাউকে চিনতে পারে। দেখা যাক। এব্যাপারে আর ভাবার সময় নেই। দোকান খুলতে হবে। তাড়াতাড়ি পা চালাল গগন।
সেদিন চায়ের দোকানে আড্ডাটা ভালই জমে উঠেছিল। সকালে খবরের কাগজের লোকেরা এসেছিল আখড়ার সন্ধানে। তাদের চা খাইয়ে ভালই রোজগার হল গগনের। বিকেলের দিকে এল দোকানের রোজের খদ্দেররা। তাদেরই একজন নিতাই কাকা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে গগন; তোর বয়স কত হলরে?” “বয়েস?” একটু ভেবে গগন উত্তর দেয় তা কাকা এই কাত্তিকে দুই কুড়ি পুরবে। কেন গো?” ভাঁড়ের চায়ে বাদাম দেওয়া বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে নিতাই কাকা বললেন, “কেন আবার কি? এতখানি বয়স হল বিয়ে টিয়ে করবি না? বলি চুল পাকলে দেখবে কে?” স্মিত হেসে গগন জবাব দিল, “কে আর দেখবে? ঐ যিনি সবাইকে দেখেটেখে রেখেছেন উনিই দেখবেন!” ধমকের সুরে নিতাই কাকা বললেন, “ওসব জ্ঞানের কথা। তা আমরা হলাম গিয়ে গৃহী মানুষ। বয়েসের ধম্ম বলেও তো একটা কথা আছে নাকি? এইবেলা......” নিতাই কাকার কথা শেষ হতে না হতেই হারু থামিয়ে দিল। আরে গগন দার কথা বাদ দাও কাকা। এদিকের খবর কিছু রাখ না নাকি?” “কেন রে কি হয়েছে? ভাঁড়তা পিচবোর্ডের জঞ্জাল বাক্সে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন নিতাই কাকা। “ওমা তাও জানো না? বামুন পাড়ায় মুখুজ্জেদের মেয়েটা তো শাঁখা সিঁদুর খুইয়ে আবার বাড়িতে এসে জুটেছে......।“ নিতাই কাকা বা হারু, কারোরই কথা ঠিকঠাক কানে ঢুকছিল না গগনের। মাথায় চিন্তাটা ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। আর বেশী করে বাজছে মাস্টার বাবুর কথাটা, 'দামী জিনিস'। আহারে, ছেলেদুটো নিশ্চয়ই খুব ভাবছে, কিম্বা হয়ত বাড়ীতে দেদার বকাবকি খাচ্ছে। না না, নিজের মনেই ঠিক করল গগন, কালই ট্রেনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে ওদের কথা। সেরকম দরকার হলে জংশনের মাস্টারবাবুর কাছে গিয়ে কথা বলবে গগন।
রাতের খাবারের জন্য দুমুঠো চাল ডাল আর আলু কুমড়ো ধুয়ে কেটে বসিয়ে দিল গগন। ভাত নামতে নামতেই কালকে কি কি করবে ভাবে হয়ে গেছে তার। গরম ভাতে আলু কুমড়ো টা ফুইয়ে ফুইয়ে মেখে নিতেই বাইরে গুরগুর করে মেঘ ডেকে উঠল। রান্নাঘরের জানালাটা দিয়ে উঁকি মারতেই গগনের চোখে পড়ল লাল হয়ে যাওয়া আকাশ আর তার বুক চিরে মাঝে মাঝেই আলোর ঝল্কানি। “এই রে”, নিজের মনেই বলে উঠল সে, “ঝড় বৃষ্টি হলে তো কেলেংকারী হয়ে যাবে। যদি ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়? না ঠাকুর, দয়া কর, কাল যেন ছেলেদুটোর খোঁজ করতে যেতে পারি। দায়িত্ব বলেও তো একটা কথা আছে। আর জিনিসটা তো আমিই পেয়েছিলাম।“ বাসন কোসন মেজে গগন যখন শোবার জোগাড় করছে বাইরে তখন হাল্কা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। গগন আবার টুক করে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা সেরে নিল।
পরদিন সকালে কাত্তিকের অকাল বর্ষণ এ কাদাভরা মেঠোপথ ঠেলেন স্টেশনে পৌঁছতেই দুঃসংবাদটা পেল গগন। কালকের ঝোড়ো হাওয়ায় গাছটাছ পরে ট্রেন বন্ধ। খানিকটা হতাশ হয়েই প্ল্যাটফর্মের ভেজা বেঞ্চটায় বসে পড়ল সে। আকাশে জলভরা মেঘের পর্দা সরিয়ে সূর্য মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে আবার গায়েব হয়ে যাচ্ছে। বেশ শীত শীত করছে। “নাহ, আজ আর যাওয়া হবে না। তাছাড়া বাবুরাও কি কাজে যেতে পেরেছে এই দুর্যোগে?” “আরে? গগন না? আজ স্টেশনে কি করতে?” মাস্টারবাবুর গলা শুনে পিছনে তাকাল গগন। “কিরে আজ তো তোর হাটে যাওয়া নেই; তবে স্টেশনে কি করছিস?” “না, মানে, ভাবছিলাম, ইয়ে.....” কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা সে। যদি বলে ঐ যন্ত্রটার ব্যাপারে খোঁজ করতে যাচ্ছিল তাহলে মাস্টারবাবু খারাপ মনে করতে পারেন। কিন্তু তারও যে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ঐ দামী জিনিসটা সেটাই বা কাকে বুঝিয়ে বলবে। অবশ্য উত্তর পাওয়ার আগেই প্রশ্নকর্তা নিজের ঘরে চলে গেছেন। যাক এযাত্রা রক্ষে হল। ছাতাখানা খুলে গগন দোকানের পথে রওনা হল।
“কি গো, কোথায় ছিলে? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য। স্টেশনের দিকে গেসলে কেন?” বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে চলে হারু। গগনের কানে সেগুলো যে যাচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু উত্তরগুলো ঠিক কিভাবে সাজাবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দোকান খুলে ফেলল গগন। ডেকচিগুল হারুর কাছে দিয়ে ভিজে ছাতাটা টাঙিয়ে দিল সে। মাথার মধ্যে থেকে কিছুতেই চিন্তাটা যাচ্ছে না। “তোমার কি হয়েছে বলতো গগনদা?” হারুর কথা চমকে উঠে হাত ফস্কে পড়া কাঁচের বয়ামটা কোনোক্রমে সামাল দিয়ে গগন বলল “ককই কিছু না তো?” “কিছু না বললেই হবে? সেই কাল থেকে দেখছি তোমার মনটা যেন কেমন আনমনা। ঠিকঠাক করে কথার উত্তর দিচ্ছ না, কি যেন ভাবছ সব্বক্ষন! আজ আবার এই জলকাদা ঠেলে স্টেশনে গেছিলে? তুমি তো হাটবার ছারা ঐ দিক মাড়াওনা? কি হল গো তোমার? শরীর টরির খারাপ? বল তো, ওপারার বক্সী ডাক্তার কে খবর দিই....?” “এই শোন,” হারুকে মাঝপথে থামিয়ে গগন বলল, “তোর আজ দুপুরে কি কাজ আছে রে?” “আমার? আমার আবার দুপুরে কি কাজ? নেয়ে উঠে দুটো ভাত খেয়ে একটু রামায়ণ নিয়ে বসে ঢুলব। কেন গো?” “শোন, আজ দুপুরে একটু এখানে আসতে পারবি? তোকে না একটা কথা বলার ছিল; মানে একটা ব্যাপারে একটু সাহায্য.....” গগনকে ইতস্তত করতে দেখে অবাক হল হারু। এত বছর ধরে লোকটাকে দেখছে, আজ সত্যিই খুব অচেনা লাগছে। কিছু একটা নিয়ে যে চিন্তায় পরেছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। “এককাজ করি তাইলে গগনদা, আজ তোমার দুপুরের খাবারটা আমিই নিয়ে আসি। দুজনে নাহয় একসাথে খেতে খেতে কথা বলা যাবে? কি বল?” হারুর কথা শুনে গগনের বুকের বোঝা অর্ধেক হয়ে গেল। কারোকে কথাটা না বললেও শান্তি নেই, আবার যাকে তাকে বলে ঝামেলা বাড়ালেও মুশকিল। হারু অনেকদিনের চেনা লোক। বয়েসে গগনের থেকে বছর সাতেকের ছোট হলেও বুদ্ধিসুদ্ধি খুব পাকা আর মাথাখানা খুব ঠাণ্ডা। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা উপায় বার করতে পারবে। না পারলেও অন্তত ওকে বলে কিছুটা হাল্কা হওয়া যাবে। “ও গগনদা; আবার কি ভাবতে বসলে? এ তো আচ্ছা মুশকিল হল! আরে বললাম তো আজ আসছি দুপুরের দিকে!” স্বস্তির হাসি হেসে গগন বলল “আচ্ছা।“
দুপুরের দিকে এমনিতেই লোকজন কম থাকে দোকানে, তার উপরে আবার আজ দুর্যোগের বেলা। ট্রেন পরের দিকে চালু হয়েছিল বটে, তবে সেরকম প্যাসেঞ্জার ছিল না। অন্যদিন হলে গগনের একটু খুঁতখুঁতোনি হত, কিন্তু আজকের ব্যাপার আলাদা। শলা করার জন্য একটু গোপনীয়তার বড়ই দরকার। হারুর বাগানের সীম দিয়ে নতুন আলুর তরকারি আর ডাল দিয়ে ভাতটুকু খেতে খেতে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল গগন। হারুও চুপচাপ শুনল সব। তারপর আঁচিয়ে উঠে একটা বিড়ি ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “সবই তো বুঝলাম গগনদা। এ সত্যিই বেশ জটিল ব্যাপার। কিন্তু তুমি যে আজ হুট বলতে স্টেশনে দৌড়চ্ছিলে, কিভাবে খোঁজ করতে শুনি ওদের?” “না আসলে”, হাতের পোড়া বিড়ির টুকরো টা সামনের জমা জলের গর্তে ফেলে গগন বলল, “আমি ভাবছিলাম বাবুরা যদি ওদের কাউকে চেনে বা ওরা যদি খোঁজ টোজ করে তাহলে ব্যাপারটার একটা হিল্লে হবে। নইলে অত দামি জিনিস....” “শোনো গগনদা; জিনিস দামি হোক চাই না হোক। তোমার তো আর দায়িত্ব নয়। তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ, আর সেটা মাস্টার বাবুকে দিয়েছ। ব্যস কাজ শেষ। এবার যাদের জিনিস তাদের গরজ। তোমার অত উজিয়ে গিয়ে লোকের উপকার করার দরকার নেই। সেরকম হলে তুমি সোমবার তো হাতে যাচ্ছই। তখনই নাহয় জিজ্ঞেস করে নিও। তাছাড়া মাস্টারবাবু জ্ঞানী গুনি মানুষ। উনি ঠিকই এর কোনো উপায় বার করবেন। তুমি আর এই নিয়ে ভেব না।“ “হ্যাঁরে হারু”, সাবধানী গলায় প্রশ্ন করে গগন, “চুরির দায়ে পড়ব না তো রে?” “আরে না না। তুমি কেন চুরির দায়ে পড়বে? তোমাকে রেলের বাবুরা এত দিন ধরে দেখছে। মানুষ চেনার ক্ষমতা তাদের নেই নাকি? এত ভেবনা। আর তুমি হলে গিয়ে স্বভাবের বাউল, অভাবের নয়। কেউ তোমায় চুরির বদনাম দেবে না, মিলিয়ে নিও আমার কথা। যাই এখন উঠি গিয়ে। বিকেলে আবার বটতলার চৌধুরীদের দুধ দিতে হবে, কিসের যেন ব্রত আছে। আসি গো গগনদা।“ আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া হারুর সাইকেলের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল গগন। জিনিসটা নিয়ে যতটা না চিন্তা তার থেকে বেশী চাগাড় দিচ্ছিল অন্য একটা কথা। রেলের বাবুরা নাহয় তাকে চেনেন, কিন্তু যাদের জিনিস তারা যদি চুরির বদনাম দেয়? তাহলে অবিশ্যি বাবুরা রুখে দাঁড়াবেন। এতদিন ধরে দেখছেন তারা তাকে। নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিল সে। এতদিন ধরে কাটাকুটি চিন্তারা মাথায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এবার খুব হাল্কা লাগছে। হারুকে কথাগুলো বলার দরকার ছিল। গুনগুন করে গান ভাঁজতে ভাঁজতে নিভে আসা উনুনের আঁচ বাড়িয়ে দেয় গগন।
“কিরে গগন, বলি বাদাম বিস্কুট কবে আনবি রে? এ সব বিস্কুট দিয়ে চা খেয়ে সুখ নেই।“ বিস্বাদ মুখে চায়ের ভাঁড়ে একটা নোনতা বিস্কুট ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করলেন নিতাই কাকা। “আর এই তো আজকের দিন কাকা”, কাঁচের গেলাসগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে গগন উত্তর দিল, “শুক্কুরবারে হাট বসেনি। কাল গিয়ে আনব এখন তোমার বাদাম বিস্কুট। আজকের দিনটা একটু কষ্ট করে চালিয়ে নাও কাকা।“ “হুম, যাগগে, এবারে ঠান্ডাটা মনে হয় আগেই পড়বে, কি বলিস?” “তা আর বলতে কাকা?” সায় দিল গগন। বিষ্যুদবারের ঝড় বৃষ্টির পর থেকে বেশ ভালই ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। রাতের দিকে শুধু কাঁথাটায় আর শীত মানে না। এবারে তোরঙ্গ থেকে পশমের কম্বলটা না নামালেই নয়। ইসস, আজকে ভাল রোদ উঠেছিল, আসার আগে উঠোনে দিয়ে এলেই হত। নাহ, ওবেলা ফিরেই আগে কম্বলটা বার করতে হবে। তোলা উনুনের আঁচটা নামিয়ে দিয়ে রোদে এসে বসল গগন। নিতাই কাকার চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। এবার ট্যাঁক থেকে একটা বিড়ি বেরবে, গগনও একটা পাবে। হলও তাই। জ্বলন্ত বিড়িতে একটা সুখটান দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল গগন। শীতের শুরুর এই সময়টা গগনের বড় ভাল লাগে। মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসে দূরের গাছের পাতা ঝড়া দেখার মজাই আলাদা। আর এই সময়ে আখড়ায় কত বাউল ফকির আসে। অনেকেই অচেনা, আবার কেউ কেউ চেনাও বেরিয়ে যায়। গগনের দোকানে চা খেয়ে তারা যায় পাগলা জগাই এর খোঁজে। একটু জোরাজুরি করলে তারা দু' এক কলি গানও ধরে। শুনে শুনে শিখে নেয় গগন। তাছাড়া খবরের কাগজের লোকেরাও আসে মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে। তাই তো দুরে কুণ্ডলি পাকান ধুলীর মধ্যে সাদা গাড়িটাকে খুব একটা পাত্তা দিলনা গগন। নিয়মমাফিক গাড়িটা যখন বিকট শব্দে ব্রেক কষে দোকানের সামনে দাঁড়াল, গগন অভ্যাস বশেই উঠে গেল উনুনের আঁচ তুলতে। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে এক ভদ্রলোক নেমে এলেন। ভারী বুটের শব্দ, গায়ে ধোপদুরস্ত পোশাকআশাক, গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে গগন বাউলের বাড়িটা কোথায়?” অত ভারি গলায় নিজের নাম শুনে বুকটা একটু ছ্যাঁৎ করে উঠল গগনের। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সে অল্পস্বরে বলল, “আজ্ঞে আমার নাম গগন। এইটে আমারই দোকান। কেন বাবু?” “কেন? দেখাচ্ছি কেন?” গগনের প্রশ্নের উত্তরে লোকটার উদ্ধত হাত নেমে এল গগনের গালে। ছিটকে পড়ল গগন নিতাই কাকার গায়ে। ভাগ্যিস, নইলে আর একটু হলেই বেঞ্চে লেগে মাথাখানা চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল গগন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ফতুয়ার গলা চেপে টেনে ধরলেন বাবু। আরেকটা চড়। “বল, শিগগিরই বল কোথায় বেচেছিস এদের ফোন। ততক্ষণে গাড়ি থেকে আরও যারা নেমে এল তাদের মধ্যে সেদিনের সেই ছেলেদুটোও ছিল। আরে? এরাই তো সেদিন ট্রেনের জানালার ধারের সিটে বসে ছিল। তাহলে যন্তরটা কি এদের? সেটা তো মাস্টার বাবুর কাছে জমা আছে। হঠাৎ একটা চেনা গলার আওয়াজ কানে গেল গগনের। এ যে বিশ্বাসবাবু। জংশনের ইস্কুলের মাস্টার। কিন্তু উনি এখানে কেন? বিশ্বাস বাবুর কথায় সম্বিৎ ফিরল গগনের। বক্রোক্তিটা কানের থেকেও বুকে বেশি বাজল। “সে জিনিস কি আর পাবেন অফিসার? হাজার হোক চুরির মাল তো। কে আর ঘরে রাখবে? দেখুন এরই মধ্যে বেচেবুচে বসে আছে। না হলে শুক্কুরবার ওকে ট্রেনে দেখা গেল না কেন? ভালোই কামিয়েছে মনে হয়।“ অফিসার বলে যাকে সম্বোধন করা হল, সেই ভারি বুটের লোকটার হাত ছাড়িয়ে গগন ততক্ষনে বিশ্বাস বাবুর পায়ে গিয়ে পড়েছে। “একি বলছেন বাবু? আমি কি চুরি করেছি? সে জিনিস তো.....”। কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিশ্বাসবাবু, “থাক। আর ন্যাকা সাজিস না। তোদের মত দু পয়সার বাউলকে আমার খুব চেনা আছে। শিগগিরই বল এদের ফোনটা কোথায় রেখেছিস?” গলার কাছের কষ্টটা এবার চোখ বেয়ে নেমে এল গগনের। “এমনি এমনি বলবে না এ”, এতক্ষণ চুপ করে থাকা ছেলেদুটির একজন এবার মুখ খুলল, “যত্তসব চোর জোচ্চোর এর আখড়া হয় এই লোকাল ট্রেনগুলো। থ্যাংক গড, ফলওয়ালা ছেলেটা বলল তোকে নাকি আমার ফোনটা ঝোলায় পুরতে দেখেছে। নইলে তো গেছিল আর কি। ভালোয় ভালোয় বল আমার ফোন কোথায় বেচেছিস, নইলে আজই তোর শেষ দিন। প্রায় হাঁটুর বয়েসী ছেলের মুখে তুই তোকারি শুনে হতভম্ব হয়ে গেল গগন। বিশ্বাস বাবুর গলা আবার কানে এল, “এসবে হবে না অফিসার। থানায় নিয়ে আড়ং ধোলাই করলে তবেই ব্যাটার মুখ ফুটবে।“ “না না। এখানেই ফয়সালা হবে,” অফিসার নামের ব্যক্তিটির মুখে একটা বিশ্রী অমানবিক হাসি খেলে গেল। ততক্ষণে তিনি গগনের গালে আরও দু চার ঘা বসিয়ে দিয়েছেন। ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা গগনের ফতুয়ায় টপটপ করে পরছে। চড়ের ধাক্কায় কাঠের বেঞ্চে যখন গগনের কপালটা গিয়ে পরল তখন নিতাই কাকা সেখানে আর নেই। আশেপাশে বেশ ভিড় জমে গেছে। এ দৃশ্য গাঁয়ে নতুন। বিশেষত গগন বাউল, যে জানতে একটা পিঁপড়েও মারেনি তাকে এরকম পরে পরে মার খেতে দেখে সকলে অবাকই হল। কিন্তু এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করল না কেউ। কারণ অফিসার একা নয়, গাড়ি করে আসা চার জনের সবাই হাত লাগিয়েছে চোরের পেট থেকে কথা বার করতে। টুকরো টুকরো কথাগুলো যেন গরম লোহার শিকের মত ছ্যাঁকা দিয়ে যাচ্ছিল। “বাউল? বাউল না ছাই? সব চোরের দল। যেই দেখেছে অত দামি জিনিস সেই আর নোলা সামলাতে পারেনি। এসব বাউল টাউল ভেক এদের। এতদিন ধরে চিনতেই পারিনি। চায়ের সাথে সাথে শালা চুরির ব্যবসাও ফেঁদে বসে আছে।“ দু কুড়ি ছোঁয়া শরীরে নেমে আসা কোন হাত কোন পা যে কার সেটা আর ঠাহর হচ্ছিল না গগনের। বিধ্বস্ত বোধশক্তি ঠোঁটদুটো যেন চেপে ধরেছিল। শত চেষ্টা করেও সে বলতে পারল না সে চোর নয়। বাবুদের দামী জিনিস সে বেচেনি। ছত্রভঙ্গ চায়ের সরঞ্জাম, গুঁড়িয়ে যাওয়া বিস্কুট, সামনের কাঁঠালিচাঁপার গাছটা সব কিছু যখন মেঠো পথের ধুলো মেখে গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে দূরের আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছিল তখন গগনের চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সবকিছু লুপ্ত হওয়ার আগে সে দেখল ভিড়ের মধ্যে থেকে হারু ছিটকে স্টেশনের দিকে দৌড়ে গেল।
এরপরে ঠিক কি হয়েছিল গগন বাউলের তা জানা নেই।৷ কিভাবে হারু স্টেশন মাস্টার বাবুকে নিয়ে এসেছিল, কিভাবে তিনি দামী জিনিসটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি শেষ করেছিলেন , কখন সাদা গাড়িটা কার্তিকের পড়ন্ত বিকেলে শহরে ফিরে গেছিল তাও গগনের অজানা। জ্ঞান ফিরল নিজের বাড়ির উঠোনে। চোখ খুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বগুলোর মধ্যে চেনা গেল হারু নিতাই খুড়ো মাস্টার বাবুর আর বক্সী ডাক্তার কে। চাপা গুঞ্জন শোনা গেল, জ্ঞান ফিরেছে জ্ঞান ফিরেছে। নিতাই কাকার গলাটা যেন দূর থেকে ভেসে এল, “কিরে গগন, কেমন বোধ করছিস বাবা এখন?” উত্তর করল না গগন বাউল। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া নিস্তেজ শরীরের স্বরযন্ত্র থেকে ঠেলে একটাই আওয়াজ বেরোতে চাইল, 'আমি অভাবের বাউল নই গো, স্বভাবের বাউল'।
অসাধারণ। গরীবদের মরন সবসময়।
ReplyDelete