1

গল্প - পৃথা কুণ্ডু




জনসমুদ্রের এক প্রান্তে উদ্ভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিল স্বপ্নিল। এত চেনা চেনা লাগছে কেন?
ভাল করে দেখার পর খেয়াল হল, আরে – এঁকে তো সে দেখেছিল বছর কয়েক আগে, বাঁকুড়ার দিকে কোন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। গান শুনতে শুনতে গায়কের দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই চোখে আঁচল চেপে ধরে কান্না সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। অথচ যে গানগুলো চলছিল তখন - খুব জনপ্রিয় হলেও কান্নাকাটির মত কিছু ছিল না তাতে। স্বপ্নিলের মনে হয়েছিল, বেশ ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট তো। এই অনুষ্ঠানের রিভিউ করার কথা ছিল তার। ভদ্রমহিলার আবেগকে পুঁজি করে বেশ কয়েকটা মনছোঁয়া শব্দ লেখা যেত। একটু কথা বলবে ভেবেছিল, কিন্তু পরে আর তাঁকে খুঁজে পায়নি।
ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হয় এখন ষাটের কাছাকাছি বয়স। আজকের শোকমিছিলে রোদ, গরম, শারীরিক অস্বস্তি, শ্রান্তি সব কিছুকে হার মানিয়ে নানা বয়সের, নানা স্তরের বহু মানুষ ছুটে এসেছেন - প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তার মধ্যে এই মহিলাকে আলাদা করে চোখে পড়ার কথা ছিল না। তবু স্বপ্নিলের চোখে পড়ল। আগে দেখেছিল বলেই হয়তো।

শ্মশানে সব কাজ মিটতে মিটতে বিকেল গড়িয়ে গোধূলি। শহরে অবশ্য গোধূলি বোঝা যায় না তেমন। ফেরার পথে ভিড়টা অনেক আলগা - যে যার বাড়ির পথে। ভদ্রমহিলাকে আবার দেখল স্বপ্নিল। ক্লান্তিতে যেন ভেঙে পড়ছেন, আর পা চলছে না। মাঝে মাঝেই আঁচলের খুঁটে বাঁধা কিছু একটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরছেন। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।

স্বপ্নিল সাংবাদিক। বাস্তবের আড়াল থেকে 'স্টোরি' খুঁজে বের করাই তার কাজ।

আজ আবার ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে মনে হচ্ছে তার, একটা ভাল স্টোরি লেখার সুবর্ণ সুযোগ আবার তার হাতের সামনে। তাঁর সেদিনের সেই কান্না, আর আজকের এই আঁচলের আড়ালে ঢেকে রাখা রহস্যের মাঝে কোন যোগসূত্র আছে কি? কোন গোপন সম্পর্কের ইঙ্গিত? এঁকে তো নজরছাড়া করা যাবে না।

স্বপ্নিল এগিয়ে আসে, ‘মাসিমা, আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? জল খাবেন?’

ভদ্রমহিলা ক্লান্ত চোখে তাকান তার দিকে। ‘জল?... কোথায় পাব… হ্যাঁ গলাটা কেমন শুকনো লাগছে…’ যেন মনে না করিয়ে দিলে তেষ্টার অনুভূতিটাও ভুলে গিয়েছিলেন তিনি।

‘আমার কাছে আছে, আপনি খেতে পারেন।’
একটু যেন ধাতস্থ হয়ে মাথা নাড়েন ভদ্রমহিলা, স্বপ্নিলের কাছ থেকে জল নিয়ে গলা ভেজান।

‘অনেক ধন্যবাদ বাবা…’

‘না না এটুকু তো মানুষকে করতেই হয়’, মিষ্টি করে হাসে স্বপ্নিল, ‘আপনার সঙ্গে কেউ নেই? মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে এসেছেন...বাড়ি ফিরবেন কী করে?’

‘ঠিক ধরেছ, আমি কলকাতার লোক নই...ফিরতে তো হবেই। আচ্ছা, তোমাকেই জিগ্যেস করছি, গঙ্গার একটা নিরিবিলি ঘাট পাব কোনদিকে? তারপর সেখান থেকে হাওড়া স্টেশন যাব কীভাবে?’

‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে ঘাট দেখিয়ে দিচ্ছি, বাসের নম্বরও বলে দেব। কিন্তু তার আগে আপনি একটু কোথাও বসে বিশ্রাম করে নিন। আসুন আমার সাথে।’

‘না বাবা, তার দরকার নেই ... তুমি আমায় পথটা দেখিয়ে দাও তাহলেই হবে।’
এত সহজে ছাড়া যায় নাকি? স্বপ্নিল কাজের স্বার্থে অভিনয় করতে পারে একটু আধটু। গলায় খানিক আবেগ এনে বলে, ‘দেখুন আপনি আমার মায়ের বয়সী। আপনার শরীরের কথা ভেবেই বলছি মাসিমা, একটু বসে যান। আমার হাতে জল খেলেন, বাবা বলে ডাকলেন - দরকার হলে আমি স্টেশনে গিয়েই আপনাকে ...

‘কি... বললে তুমি? বাবা বলে ডাকলাম তাই – না না, সবাই যদি এরকম বলে – এ হয় না, হয় না ...’ ভদ্রমহিলার চোখ দিয়ে জল গড়ায় যেন বাঁধ ভেঙে।
স্বপ্নিল কোনভাবে ওঁকে শান্ত করে একটা ফাঁকা জায়গায় এনে বসায়। ঘাটের কাছেই। কেন ঘাট খুঁজছেন - আত্মহত্যা-টত্যা করার তালে আছেন নাকি? না, কাছে বসতে হবে তাকেও।

ভদ্রমহিলা বসে আছেন তো আছেনই। স্বপ্নিল খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিজেই কথা শুরু করে, আজ যে ঘটনা নিয়ে সবাই কথা বলছে – সেই বিষয়েই। ‘আজ আমারও আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। সকালে খবরটা পেয়েই মনখারাপ। এ তো একটা মানুষের চলে যাওয়া নয়, একটা যুগের অবসান...’

‘হ্যাঁ, ... তা তো বটেই। তুমিও যখন এভাবে বলছ,... একালের ছেলে!’
উৎসাহ পেয়ে স্বপ্নিল বলতে থাকে, ‘ওঁর ভক্তদের মধ্যে তো আর বয়সের বাছবিচার নেই। এই দেখুন আপনি বাইরে থেকে ছুটে এসেছেন, আমিও আজ অফিস না গিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। ছোট থেকে দেখেছি, আমার ঠাকুমা সন্ধ্যেবেলায় ওঁর গাওয়া ভজন, কীর্তনাঙ্গের গান, স্তোত্র বাজিয়ে শুনতেন।’
কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যি সে আজ অফিসের কাজেই রাস্তায় ঘুরেছে, শোকযাত্রা ‘কভার’ করার জন্যই। আর দেবায়ন বসুর গান এমনিতে ভালই লাগে। বাড়াবাড়ি রকমের আবেগ কিছু নেই অবশ্য তার। তবে খবরটা শুনে একটু দুঃখ হয়েছিল সে কথাও অস্বীকার করার নয়। ঠাকুমার ব্যাপারটাও সত্যি।

ভদ্রমহিলা আবার চোখের জল মোছেন। স্বপ্নিল বলতে থাকে, ‘অনেকেই বলেন, ওঁর গাওয়া এক একটা গান কেমন করে যেন তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যেমন আমার ঠাকুমা চলে যাবার কদিন আগে ‘আমি অকৃতী অধম’ শুনতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা কিন্তু এমনিতে গানটান তেমন শোনেন না, কিন্তু এখনও কোথাও এটা বাজতে শুনলেই ইমোশনাল হয়ে যান, আসলে ওই স্মৃতিটা মনে পড়ে।’ একটু উদাসী ছোঁয়া লাগে তার গলায়।

‘ঠিকই বলেছ।’

‘মাসিমা, একটা কথা বলব? যদি কিছু মনে না করেন।’ একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে স্বপ্নিল, ‘আপনার জীবনে এমন কোন স্মৃতি আছে নাকি? আজকের দিনে এভাবে আলাপ হল যখন, জানতে খুব...’

ভদ্রমহিলা একটা অদ্ভুত হাসি দেন তার দিকে তাকিয়ে। ‘তুমি হয়তো বুঝবে...’

আলোটা জ্বেলে লীনা বলেন, ‘ঘরটা মনে পড়ছে?’
দরজাটা খাটো। মাথা নিচু করে ঢুকে মানুষটি বললেন, ‘হ্যাঁ... সেবার এখানেই তো শুয়েছিলাম।’

‘শুতে আর হল কোথায়!’ লীনা বড় করে শ্বাস ফেলেন।

সতেরো বছর আগে – এই দিনটাতেই রাত একটা নাগাদ - জলসার শেষে এই মানুষটিকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর স্বামী প্রবাল। এত রাতে কারও বাড়িতে এ্রসে ‘বিব্রত করা’র ব্যাপারে যথেষ্ট আপত্তি করেছিলেন তিনি। প্রবালকে শেষে বলতে হয়েছিল, ‘আপনাকে না নিয়ে গেলে আমার বউ আমায় আজ বাড়ি ঢুকতে দেবে না, দয়া করে চলুন!’ প্রবালদের সাংস্কৃতিক চক্র থেকেই গত কয়েক বছর ধরে একটা বড় বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, বাইরে থেকে শিল্পীরা আসেন। সেবার অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল জলসা শেষ হতে, তাই যাঁদের অনুষ্ঠান একেবারে শেষের দিকে ছিল, উদ্যোক্তাদের কারও কারও বাড়িতেই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।

বাচ্চাদুটো আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতিথির শোবার ব্যবস্থা করে নিজেদের ঘরে এসে প্রবাল জানতে চেয়েছিলেন, ‘বলতে পারলে না?’

-‘এখন... ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, হাতমুখ ধোবার জলটল দিতে দিতে আর কতটুকুই কথা বলা যায়!’
- ‘জানতাম, পারবে না। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। কাল ভোরেই কিন্তু চলে যাবেন, তখন হাত কামড়িও না... নাও সরো, আমারও অনেক খাটনি গেছে আজ, একটু শান্তিতে ঘুমোই’ - বলে একপাশে শুয়ে পড়েছিলেন প্রবাল।
সেই শুয়ে পড়াটা যে এমন শান্তির হবে, কে জানত!
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল প্রবালের; বাথরুমে যেতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। লীনার চিৎকারে উঠে পড়েছিল বাচ্চাদুটো; পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন অতিথিও। লোকজন, ডাক্তার ডাকতে ডাকতেই সব শেষ।
এই বিপর্যয় দেখে পরদিন ভোরে ফিরে যাওয়া বাতিল করেছিলেন অতিথি। পাশে ছিলেন অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন – যে কোন সংবেদনশীল মানুষ যা করে থাকে এ অবস্থায়। কিন্তু তারপর...
কাঁদতে কাঁদতে লীনা বলে ফেলেছিলেন, ‘আমার যে সব শেষ হয়ে গেল, দাদা!’
সেই প্রথম সরাসরি সম্বোধন। আগের রাতে দুচারটে কথা – বিহ্বলতার মধ্যে কেবল ‘আপনি আজ্ঞে’ করেই সারা হয়েছিল।
মানুষটি এক মুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন সদ্য স্বামীহারা যুবতীর মুখের দিকে। তারপর বলেছিলেন, ‘দাদা বলে ডাকলে যখন, দাদার কর্তব্য করতে দিয়ো।’

আজও সেই বাড়িতে সেই অতিথি, সেই গৃহিণী - শুধু গৃহকর্তা নেই। লীনা নিজেকে সামলে নিয়ে, বিছানাটা ঠিকঠাক করে সরে দাঁড়ান সসম্ভ্রমে, ‘আসুন, হয়ে গেছে।’
বিছানায় এসে বসেন মানুষটি। বলেন, ‘এত পরিপাটি সব, একা হাতে...’

‘আমার সাহায্য করার লোক আছে। এত বছর পরে এলেন, এটুকু করব না?... ভেবেছিলাম এবছরও না করে দেবেন কি না!’

প্রবাল চলে যাওয়ার পর থেকে দেবায়ন আর আসতেন না এখানকার অনুষ্ঠানে। বলতেন – ‘সেবার অমন একটা ঘটনা ঘটে গেল... আর তাছাড়া আপনারা প্রতিবার একই আর্টিস্টকে ডাকবেন কেন? লোকে ভাববে, আর কাউকে পান না বোধহয়। আমি বলে দিচ্ছি অমুককে – খুব ভাল গাইছে, নিয়ে যান।’ দু-এক বছর এরকম হবার পর উদ্যোক্তারাও আর বলতেন না তাঁকে।

লীনার সঙ্গে কিন্তু যোগাযোগটা ছিলই। প্রত্যেক মাসে একটা খাম চলে আসত। বোনের প্রতি দাদার কর্তব্য। লীনা কয়েকবার চিঠিতে অনুরোধ করেছেন, এরকম না করতে। তিনি তো স্বামীর অফিসে একটা ছোট চাকরি পেয়েছেন। উত্তর এসেছে, ‘ছেলেমেয়েরা বড় হোক, তারপর দেখা যাবে।’ বাইরের কেউই জানত না বিষয়টা। লীনাও ঘন ঘন চিঠি দিতেন না, ওই বিজয়া-নববর্ষে যেটুকু। এখানকার অনুষ্ঠানে এলে, লীনার বাড়িতে থাকা ভাল দেখায় না। আবার না থাকলেও তাঁকে কষ্ট দেওয়া হবে। তাই বোধহয় না আসার সিদ্ধান্ত। লীনা নিজের মত করে এরকম একটা ব্যাখা ভেবে নিয়েছিলেন মানুষটির সামগ্রিক আচরণের।

‘এবার কেন এলাম, জানো?’

‘আমার চিঠি ...পেয়েছিলেন?’ উত্তরের বদলে প্রশ্নই করেন লীনা।

এবারে প্রবালদের সাংস্কৃতিক চক্রের রজতজয়ন্তী। পাড়ায় অনেকেই ভালবাসত প্রবালকে, লীনাকেও তারা সহানুভূতির চোখে দেখে। এখন নতুন অনেক সদস্য এসেছে, তবু এবারের মিটিং-এ ঠিক হয়েছিল – যারা প্রথম থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হবে। প্রবালের অবর্তমানে লীনাকেই বলতে এসেছিল ক্লাবের ছেলেরা। তখনই তিনি কথাটা পাড়েন, দেবায়ন বসুকে আনা যায় না?

‘উনি কি আসবেন বৌদি? তাছাড়া এখন বয়সও হয়েছে ওনার, অ্যাদ্দূরে কি আর... ’

‘দেখ না, যদি আসেন। এবার তো রজতজয়ন্তী। বড় কেউ না এলে হয়?’

ছেলেগুলোকে পাঠিয়েছিলেন লীনাই। সেই সঙ্গে আলাদা করে একটা চিঠি। আশ্চর্যের ব্যাপার, এবার আর আপত্তি করেন নি দেবায়ন।
লীনারও সংকোচ ছিল না। ছেলেমেয়েরা এখন বাইরে। বয়স হচ্ছে, তাই নিজের কাছে ইদানীং রেখেছেন একজন মহিলাকে। সে ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়ির একটা ঘরে থাকে। এ অবস্থায় অতিথি এলে কার কী বলার আছে?

দেবায়ন একটু থেমে গম্ভীর মুখে বলেন, ‘চিঠিটা না দিলেও আসতাম। তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে।’

‘সে কি!’ অবাক হন লীনা।

‘কাছে এসো।’
লীনা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসেন। দেবায়ন একটা কাগজে মোড়া বাণ্ডিল বুকপকেট থেকে বের করেন, ‘এবারের অনুষ্ঠানের ওয়ান থার্ড খরচ নাকি তুমি দিয়েছ?’

‘...আপনাকে... মানে, কে বলল?’

‘হ্যাঁ কি না বল।’

‘হ্যাঁ, উনি যেদিন চলে গেছিলেন,... এবারও সেই তারিখে অনুষ্ঠান – ওনার স্মৃতিতে...’

‘জানি। ছেলেগুলো কথায় কথায় বলছিল। সে যাই হোক, আমি এটা নিতে পারি না। রাখো।’

‘না না দাদা, এটা তো ...’
লীনার হাতে একরকম জোর করেই গুঁজে দেন তিনি বাণ্ডিলটা। ‘একটাও কথা না। আর দাদা বলে ডাকবেও না। এইজন্য ডেকেছিলে আমায়!’

‘আমাকে ভুল বুঝবেন না দাদা, আমি... আচ্ছা ক্ষমা চাইছি, এভাবে রাগ করে থাকবেন? আজকের দিনটা...’

‘ঠিক আছে, যাও ওটা সাবধানে তুলে রাখো। শুয়ে পড়।’
জল খেয়ে আলো নেভাতে যাচ্ছিলেন দেবায়ন, আবার দরজার কাছে ফিরে আসেন লীনা। ‘দাদা, এতে তো বেশি আছে।’

‘ঠিকই আছে।’

‘না, এই তো...’

‘দরজায় না, ভেতরে এস’, ডাকেন দেবায়ন। ‘...আমার ভগ্নীপতির স্মৃতিতে অনুষ্ঠানের খরচ দিয়েছ তুমি। সেখানে আমার কিছু কন্ট্রিবিউশন থাকতে পারে না?... চিঠিতে এত কথা লিখলে, ছেলের চাকরি হয়েছে, মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে হস্টেল পেয়েছে...আর এটা তো লিখলে না যে এবারে তুমি এত আয়োজন করছ?’

লীনা আর কিছু বলতে পারেন না। চোখে জল।

‘কেঁদো না লীনা। জানি আজ তোমার মন এমনিতেই খারাপ। দেখলাম, তখনও তুমি অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই উঠে চলে গেলে...’

‘আমি আর পারছিলাম না দাদা। সব আছে, শুধু সেই মানুষটা নেই – আর আপনি ওনার প্রিয় গানগুলোই গাইছিলেন। আমার খালি মনে হচ্ছিল, এত লোকের মধ্যেও আমি বড় একা ...’

‘এভাবে বোল না। তুমি তো ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছ। তখন কতটুকু বয়স ছিল তোমার? সেখান থেকে আজ - তুমি হেরে যাওনি, এটাই বড় কথা।’

‘জানেন, উনি সবসময় বলতেন, তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। কিছুই পার না...’

‘পেরেছ তো।’

‘সে আপনি ছিলেন বলে। আমায় হেরে যেতে দেননি।... আর একটা ব্যাপারে আমায় জিতিয়ে দেবেন, দাদা?’

‘কি ব্যাপার?’
লীনার গলায় যেন কিশোরীবেলার আবেশ, ‘আপনাকে নিয়ে... পাগলামি করতাম রীতিমত। আমার সঙ্গে অনেকটাই বয়সের তফাৎ ছিল ওনার... উনি শুনে ছেলেমানুষি বলে খ্যাপাতেন। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, আপনাকে রাখি পরাব, আপনি আমায় – ‘তুই’ বলে ডাকবেন। উনি বলতেন, সামনে পেলে বলতে পারবে এসব? না হাঁ হয়ে থাকবে? বলেছিলাম... নিয়ে এসো দেখি তোমাদের ফাংশনে, কেন বলতে পারব না! এই নিয়ে বাজি হয়েছিল আমাদের মধ্যে। সেই আপনি এলেন, অথচ সেদিনই...’ গলা কাঁপতে থাকে তাঁর, ‘আর বলা হয়ে উঠল না। আজ অ্যাদ্দিন পরে বলছি,... ডাকবেন আমায় তুই বলে? একবার!

‘কই, দেখি।’

‘কী?’ একটু থমকে যান লীনা।

‘রাখি। এনেছিস?’ খুব শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বলে, নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেন তিনি।

লীনা প্রায় ছুটে এসে সে হাতটা আঁকড়ে ধরেন নিজের দুহাত দিয়ে। ‘দাদা...!’
সে রাতে আরও অনেকক্ষণ জেগে ছিলেন দুজনে। বোনকে একান্তে একটা গান শুনিয়েছিলেন দাদা। খুব গভীর আর নিচু গলায়, যেন স্পর্শ করছেন অনাহত নাদকে –

‘চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া
শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া...’
টেবিলে রাখা প্রবালের ছবিটা হাসছিল। বাজি হেরে যাবার আনন্দে।

‘পরদিন সকাল সকাল চান করে, তাঁকে রাখিটা পরিয়েছিলাম। সতেরো বছর ধরে তুলে রাখা। যাবার আগে আবার খুলেও দিয়েছিলেন... আমারই আবদারে। বলেছিলাম, আপনি তো ফিরে গিয়ে খুলে রাখবেনই, কোথায় পড়ে থাকবে - তার চেয়ে আমার কাছেই থাক।... কিন্তু উনি তো শেষ কথাটা রাখলেন না। বলেছিলেন, সবসময় আমার পাশে থাকবেন।... তাই ভেবেছিলাম, এটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে যাব।’ আঁচলের খুঁটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকেন ভদ্রমহিলা।
চুপ করে শুনছিল স্বপ্নিল। এতক্ষণে কথা বলল, ‘রাখিটা... আপনি ফেলবেন না মাসিমা। আজ হয়তো আবেগের বশে আপনার এরকম মনে হচ্ছে। পরে খারাপ লাগবে।...চলুন, আপনাকে বাসে তুলে দিই।’

বাড়ি ফেরার পথে স্বপ্নিল ভাবছিল, সাধারণ একটা প্রতিবেদনই লিখবে সে। এই ‘স্টোরি’টা লেখার ক্ষমতা নেই তার। পারবে না।

1 comment: