0

সম্পাদকীয়

Posted in

























ফেব্রুয়ারি মাস বাংলাভাষীদের কাছে বিশেষ অর্থবহ। ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানে অকালে ঝরে যায় কয়েকটি তাজা প্রাণ। সেই দিনটি ছিল ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি। তারপর থেকে ঐদিনটি ভাষা দিবস হিসাবে উদযাপিত। পরে রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে স্বীকৃতি দেয়। এই উপলক্ষে এবারের সংখ্যায় থাকছে দুটি বিশেষ নিবন্ধ। একটি বাংলায়, অন্যটি ইংরেজিতে।  

এই একই মাসের ৫ তারিখ জন্ম বাংলা সাহিত্যের একজন অনন্যসাধারণ কাব্য প্রতিভার। আমাদের জাগ্রত বিবেক। শঙ্খ ঘোষ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য আমাদের এবারের ক্রোড়পত্রে। 

গত এক বছরে মহামারীর বিষদাঁত আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। তার মধ্যে একটি সম্ভবত আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ। মুখোশের আড়ালে থাকাই এখন 'নতুন স্বাভাবিকতা'। এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না।

ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর!

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - মালিনী মুখার্জি ও সুদেষ্ণা দত্ত

Posted in


ভাষা আন্দোলন – কালকের ও আজকের

মালিনী মুখার্জি


ভাষা আন্দোলন কার?

সে অনেক আগের কথা। আমি তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। আমার রুম মেট বা কক্ষসাথী হল চট্টগ্রামের মেয়ে সুদীপাদি। তা ছাড়াও আরো অনেক বন্ধু আমার বাংলাদেশের। তখন অত ভাষা দিবস টিবস বুঝি না। কিন্তু জানুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশি বন্ধুদের গানের মহড়ায় কিভাবে যেন জুটে যাই। শিখে ফেলি একুশের সেই বিখ্যাত গান– আমার ভাইএর রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি (আহা কী দরদ দিয়ে গাইত তনুশ্রী) আর বাংলা আমার দেশ / মাটি আমার মা/ শহিদের দান /ভুলতে পারবো না। তারপর একুশে সকালে রাস্তায় আলপনা আঁকা। বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী বাদে খুব বেশি লোক জমা হত এমন নয়। আঁকতে আঁকতে গাইতে গাইতে জানতে পারি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা। কিছু অর্বাচীন বন্ধু তখনও ছিল (এখনও আছে)। আমায় জিজ্ঞেস করত – বাংলাদেশের আন্দোলন, তোর তাতে কী? বাংলা ভাষার জন্য এত লোক প্রাণ দিল, আমার তাতে কী??

ভাষা আমাদের জড়িয়ে থাকে

সেই সব ঘটনার পর আরো পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে। এই কিছুক্ষন আগে মাস্কট থেকে সেই বাংলাদেশের তনুশ্রী আমায় আমন্ত্রন জানিয়েছে তার সংগঠনের একুশের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে – এখন তো সব অনলাইন। দেশ বিদেশের খুদে খুদে বাচ্চারা নানারকম বাংলা উচ্চারণে বাংলা গান গাইছে, কবিতা বলছে, নিজেদের লেখা পড়ছে। তাদের বাবা-মা রা উৎকীর্ণ হয়ে লক্ষ্য রাখছে, উচ্চারনে ত্রুটি হলে ধরিয়ে দিচ্ছে, বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে আছে, নিজের মাতৃভাষাকে আঁকড়ে আছে মাস্কাট, টেক্সাস আরো নানা জায়গায় বসে।(এক বিদেশবাসী বন্ধু একবার বলেছিল, সবই ভালো, শুধু নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে, আর ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি’ শুনলে কান্না পায়।)ভাষা বেঁধে রেখেছে আমাদের একসাথে।

যে যার ভাষা

মাসাইমারার এক স্কুলে গেছি আড্ডা দিতে। গানের কথা যখন উঠল, আমি তাড়াতাড়ি বেছে নিই – মোরা সাদাসিধা মাটির মানুষ দেশে দেশে যাই/মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন আর ভাষা জানা নাই। তাই শুনে ছাত্রীরা মুগ্ধ!! আমিও গেয়ে আহ্লাদিত। আমি যখন তাদের বলি ‘এবার তোমরা গাও’, তারা এক লাফে উঠে নিজেদের ভাষায় নেচে নেচে গায়। তারা খুব ভালো ইংরেজি জানে। আমিও জানি। কিন্তু যখন আমাদের গান গাইতে বলা হয়, আমরা মাতৃভাষাই বেছে নিই। তারমানে যার যার মাতৃভাষা তার তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করার, জাহির করার সবথেকে প্রিয় মাধ্যম।

কিন্তু প্রায়ই দেখি নিজের ভাষার প্রতি সংবেদনশীল হলেও অন্যের মাতৃভাষাকে অপমান করতে আমরা দ্বিধা করি না।

ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক

কলেজ জীবনের শেষে একদিন হুট করে গিয়ে হাজির সুদীপাদির ঢাকার বাড়িতে। তার সাথে, অন্য বন্ধুদের সাথে, আবার কখনো একাই ঘুরে ঘুরে দেখি ভাষা আন্দোলনের স্মারক, মিউজিয়াম। ভাবি, কতটা বুকের পাটা থাকলে এরকম অত্যাচারের মুখে তুড়ি মেরে লড়াই করেছিল আমার বয়সি ছাত্রছাত্রীরা। শুধু ভাষার জন্য এরকম করা যায়? তারপর বহুবার বাংলাদেশ গেছি। বন্ধুদের মধ্যে দেখেছি একুশে নিয়ে তাদের আবেগ, ভালবাসা।

আর জেনেছি তার রাজনৈতিক ইতিহাস। শুধু সাংস্কৃতিক আন্দোলন বললে পূর্ণ সম্মান দেওয়া হয় না এই ভাষা আন্দোলনকে। জানতে পারি এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার মানুষ। নিজের অধিকারের দাবীতে শুরু হয় এই আন্দোলন। উর্দুকে সরকারি ভাষা করে সরকারি চাকরি, ব্যবসা, এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করার যে ষড়যন্ত্র এঁটেছিল তখনকার সরকার, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব বাংলার মানুষ।

দুটো জিনিষ মনে হয় এই আন্দোলনের নিজস্ব বিশ্লেষণ করে। এক- অন্যর সংস্কৃতিকে সম্মান না করে, পেটে পা দিয়ে নিজের সংস্কৃতিকে গিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা একধরনের ফ্যাসিবাদ। ইতিহাস দেখাচ্ছে যে সাধারণ মানুষ সেই চক্রান্ত মেনে নেয় না। দুই- যেটা আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কেবল মাত্র উর্দুকে সরকারি ভাষা করার প্রচেষ্টা, সেটার পেছনে রয়েছে একটা জাতিকে অর্থনৈতিক আর সামাজিক ভাবে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র।

এই ধরনের ষড়যন্ত্র নানা জায়গায় নানা ভাবে করেছে যারা ক্ষমতায় আছে তারা। একটু নিজের ঘরের দিকে মুখ করে তাকালে দেখতে পাব এই সময়ে সেই কালো মেঘের ছায়া। সেই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের জোর করে নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করার অছিলায় অন্যকে পায়ে পিষে ফেলার চেষ্টা। আর ধর্মের অছিলায় একটা গোটা সমাজের অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া ভেঙ্গে ফেলা। বাংলাদেশেও কিছু মানুষ ছিল যারা এই সাম্প্রদায়িকতাকে নিজেদের স্বার্থে সমর্থন যুগিয়েছিল। এখানেও সেরকম লোকের অভাব নেই। কিন্তু ওই যে বললাম, সাধারন মানুষ ঘুরে দাড়াবেই।

তাই ভাষা আন্দোলন আজও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু সেই কলেজের অর্বাচীন বন্ধু কোথায় কে জানে—নাহলে তাকে বুঝিয়ে বলতাম।

*******************************************************************************






Language, local ecology, and Sovereignty: Why we must pledge to safeguard biodiversity on International Mother Language Day?

Sudeshna Dutta

My mother-in-law taught me how to differentiate methi from piring shaak, hingche from brahmi. She also taught me to recognise and cook chakunde and kalkasunde – two vegetable varieties still available in the rural part of the Budgebudge- Mahestala area. Due to her family’s humble economic background, she had to learn about the vegetables that were accessible outside the market. The free food helped the family of eight to stay afloat in their most challenging time.

Nandi Kachhap, an adivasi woman activist from Jharkhand, while giving me a tour of her village in 2017, showed me the exact plant and referred to it as chakor shaag. I got to know how the villagers of Nagri utilise chakor as a source of nutrition.

In 2019 after enrolling in the Agroecology course, I learned about the value of free food in protecting the food and nutritional security of economically marginal people. The importance of chakunde and kalkasunde, Hingche and piring lie in the traditional local knowledge that our elders have preserved through the language. As the rampant and careless urbanisation hence concretisation, have almost wiped out these local biodiversities from the everyday experiences of the ordinary people, the local knowledge preserved in the local language is withering away from the collective memory. Once dispossessed from the local biodiversity, knowledge, and language, the poor get any fair chance to disentangle themselves from the web of food insecurity.

The sense of autonomy depends on the way an individual perceives her freedom in making choices. The awareness regarding once competence arises from the understanding of self-sufficiency. Therefore, knowledge of self in a way brings out the agency role of the knower. An individual’s sense of autonomy and competence are related to the extent she understands herself as “the dynamic promoters of social transformations.” (Sen 2000, 189)

Sen has argued that an active agent possesses the capability to interpret her wellbeing. Her empowerment lies within her freedom in making decisions of choosing to be a participant or non-participant in an act and “taking responsibilities of that decision” (ibid). An individual’s agency lies within her decision-making process. It again depends on her ability to reinterpret the meaning of “wellbeing”. The method of making meanings in the mother language structures the autonomy of the self. Interpretations or ‘making meanings’ is the hidden bridge connecting ‘knowledge of self’ to the ‘agency factor’.

From the perspective of ecofeminism, through the creation of new meanings, the community members exhibit their nature of relationships with the surroundings. The value system that evolves from each member’s physical, psychological, emotional, and social relationships with the local biodiversity structures the collective sense of freedom.

The meaning of a particular object expands with time as new experiences make their way into the life of the individual situated within a specific social and cultural location and having a distinct view of the world. Susan Griffin points out that acknowledging the process of making meanings is crucial as it challenges the hegemony of a fixed meaning/interpretation and, thus, a particular knowledge system. According to her,

meaning, like life, is interdependent. Similar to the process by which an ecosystem sustains itself, meaning arises from meeting and connection, from overlapping boundaries, shifting identities. No single perspective can reveal the truth of the whole. The truth exists in no particular site. No particular site can even be said to exist separately, or permanently. And perhaps no written or spoken meaning can ever subsume or confine the experience of meaning (or hope, or love) (Griffin 2014 Indian Reprint, 226).


For an individual who shares close relationships with the local biodiversities as part of her everyday living, the local ecosystem’s sustainability ensures the survival of language and the sustenance of her authority over interpretations.

Place plays a crucial role in structuring the knowledge as it is where we accumulate experiences, understand ourselves through the changes that happen around us, reflect on those experiences and articulate our understandings through multiple codes of communication. The place becomes far more critical for those who depend on the various elements of the local ecology for self-sustenance.

The connection between the knower and the land demands constant interactions. The cultural and ethical values that thrive within the adivasi culture depend on the process and the objects of cognition. Human beings as an agent of knowledge, learn about the ‘world’ outside her through productive relationships. A knowledge system that cognises community members’ direct and multiple connections with the various elements of the surroundings as the basis of autonomy and power is open to accept the changes and can use creative imagination to manipulate the changes in favour of the community’s sustenance and sustainability. The multidimensionality and the dynamic aspects present in such production of knowledge makes the system open-ended.

The knowledge systems that exist within the ecocentric communities is related to the knowledge of life support. Unlike the knowledge system promoted by the corporate-controlled agri-business industry, these’ knowledge systems are diverse as each of these communities has developed their knowledge systems through various interactions with the local ecology.

According to Dayamani Barla, the renowned adivasi activist of Jharkhand, the adivasis have structured their culture of preserving the forest because their knowledge system finds unnecessary accumulation of the forest products would cause an imbalance within the local ecology. The peace and solidarity existing within the community would be in peril. That is the reason, says Barla, adivasi villagers of Jharkhand choose to preserve the jal-jangal-jameen over the economic development projects.

A village girl, Barla claims, knows the names of more than a hundred plants and their diverse uses. This Munda girl can expand the horizon of her possessed knowledge if she can continue maintaining her close connections with the local biodiversities, village society and Mundari language– her mother tongue. The physical, psychological, historical, social, and ecological relations existing beneath the adivasi interpretations of the jal-jangal-jameen make the landscape environmental heritage of the adivasi societies. Without the legacy, the adivasi languages would cease to evolve as they would lose their ability to create meanings from their epistemic standpoints. They will lose their freedom to envisage and choose the course of the future. The actual colonisation of indigenous and other ecosystem people begins when they hardly have any choice left but to accept the interpretation and value system of the dominant other.

Amartya Sen, in his book Development and Freedom, has argued that the true freedom of an individual exists in her capability to accept or refuse the interpretations of wellbeing and development. In his words:

To see individuals as entities that experience and have wellbeing is an important recognition, but to stop there would amount to a very restricted view of the personhood of women. Understanding the agency role is thus central to recognising people as responsible persons: not only we well or ill, but we also act or refuse to act and can choose to work one way rather than another. And thus we -women and men- must take responsibility for doing things or not doing them. (Sen 1999, 190)


The idea of food sovereignty argues that small-scale farmers and food producers, specifically those who are related to sustenance based food production, must have the rights to choose what to produce and how to yield without jeopardising the autonomy over sustainability. Preservation of the local ecology plays a crucial role in maintaining the sovereign status of the ecologically rich people because they have preserved the knowledge of sustaining diverse relationships with the local ecology in their local languages. Their ability to stand against any imposed monolithic unilinear meaning rests on their competence in creating definitions from their epistemic standpoints. For the ecosystem people, it is imperative to preserve the local biodiversities to maintain autonomy over knowledge and interpretation.

I have started this writing with a memory of my mother-in-law. I now conclude this writing with another anecdote. During the pandemic-induced lockdown phase, a woman from a nearby slum area came to my house with the hope of getting some monetary help. I initiated a conversation with the old lady and tried to understand how far the local biodiversities had helped her to avoid the family’s dependency on the market. I got to know from her the natural sources of the free food are on the brink of disappearance. The absence of knowledge regarding natural, free food resources in the community memory has discouraged the members from preserving natural resources. The absolute impoverishment of these people, I realised, was that they could not imagine themselves as capable of sustaining themselves in that trying time. The lady could neither collect free food from her surrounding, nor she could teach her granddaughter the utilisation of those plants.

Now one day before the international Mother language day, while vigorously typing to finish this short article of mine, I am thinking how many of us would pledge to preserve kulekhara and sajne to resist the control of corporate over public immunity and local nutrition.

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অঞ্চিতা ঘটক

Posted in




















২০২০ সালে কোভিড অতিমারির প্রকোপে আমাদের সকলের জীবনই আচমকা বদলে গেল। আমাদের দেশে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ‘লকডাউন’ জারি হল। শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই লকডাউন হল। পৃথিবীটা যেন থমকে গেল।

এই সময় ভারতের বহু সম্পন্ন ও গরীব পরিবারে সংকট দেখা দিল। কী হল? লকডাউনের কারণে গৃহপরিচারিকারা কাজে যেতে পারছিলেন না। নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে আরম্ভ করে অতীব ধনী পরিবারগুলি সকলেই কমবেশি গৃহশ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল । তাই লকডাউনের সময়ে বাড়ির দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষেই কষ্টকর হয়ে উঠল । আর গৃহশ্রমিকরা তো তাঁদের জীবিকা ও জীবন নিয়ে মহা সংকটে পড়লেন। তাঁরা ভাবতে লাগেন এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে আর কাজ না করলে খাবেন কী । তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না যে তাঁদের কাজগুলি আদৌ থাকবে কি না।

এছাড়া আর সকলের মত কোভিড ১৯ নিয়েও আর সকলের মত গৃহশ্রমিকদেরও অনেক প্রশ্ন আর ভয়ভীতি ছিল। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে ভারতে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের পক্ষেই প্রতি ঘন্টায় হাত ধোয়া এবং পাড়া প্রতিবেশীর থেকে দু মিটার (ছ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখা দুষ্কর। শহরাঞ্চলে তাঁরা খুবই সঙ্কীর্ণ জায়গায় বহু লোক মিলে থাকেন এবং খুব হিসাব করে জল ব্যবহার করতে হয়। অনেক গ্রামে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য জল আনতে নারীদের বহু দূর যেতে হয়। আমরা জানি যে বহু সাংসারিক কাজের মত জল আনার কাজ মেয়েরাই করে থাকেন।

আমি আর আমার সহকর্মীরা কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে সাংগঠনিক কাজ করি যাতে তাঁরা তাঁদের অধিকারের লড়াইটা বলিষ্ঠ করতে পারেন। এঁরা সকলেই কলকাতায় কাজ করেন। এই অতিমারির সময় বিস্তারিতভাবে গৃহশ্রমিকদের অভিজ্ঞতা জানার জন্য আমরা ২০২০ তে জুন থেকে অগাস্ট মাসের মধ্যে ১৪ জন গৃহশ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। এই সাক্ষাৎকারগুলি এবং আমার কাজের ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার ভিতিত্তে এই প্রবন্ধটিতে আমি গৃহশ্রমিকদের অবস্থা এবং তাঁদের উপর কোভিড অতিমারির প্রকোপ সম্বন্ধে আলোচনা করব ।

আমাদের দেশে গৃহশ্রমিক

আই এল ওর কথানুসারে ভারতের উপার্জনকারী মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ৮০% মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। তাঁরা কর্মী হিসাবে প্রায় কোনও সুরক্ষা অথবা সুযোগ সুবিধা পান না । গৃহশ্রমিকদের কাজও এই অসংগঠিত ক্ষেত্রে। গৃহশ্রমিকদের প্রচলিতভাবে ‘কাজের লোক’ অথবা ‘কাজের মেয়ে’ বলা হয়। তাঁরা অধিকাংশই গরীব, নিরক্ষর অথবা স্বল্প সাক্ষর, দলিত বা আদিবাসি সম্প্রদায়ের এবং অপুষ্টি ও অন্যান্য বঞ্চনার ফলে বহু স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত । কাজের জায়গায় এবং নিজেদের বাড়িতে এঁদের কঠিন পরিশ্রম করতে হয়।

ভারতে কতজন মানুষ গৃহশ্রমিক হিসাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন সে সম্বন্ধে সঠিক কোনও তথ্য নেই। এন এস এস ২০০৫ এ বলা হয়েছিল ৪.৭৫ মিলিয়ন মানুষ। আবার কিছু কিছু সমীক্ষায় বলা হয়েছে ৯০ মিলিয়ন মানুষ কিংবা তারও বেশি। খুব বেশি তর্কের মধ্যে না গিয়েও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ভারতে ৫০ মিলিয়ন গৃহশ্রমিক আছে এবং অধিকাংশই নারী অথবা মেয়ে ।

আমাদের দেশে গৃহশ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও আইন নেই। কয়েকটি আইনে, যেমন অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আইন (২০০৮) এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ আইন (২০১৩), গৃহশ্রমিকদের কিছু কিছু আইনী অধিকার দেওয়া হয়েছে । তবে এই আইনগুলি গৃহশ্রমিকরা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছেন তাই নিয়ে সমীক্ষা প্রয়োজন। নীতি ও আইনের ক্ষেত্রে গৃহশ্রমিকদের প্রায় অনুপস্থিতি প্রমাণ করছে যে সরকার এই বিশাল সংখ্যক নারী শ্রমিকদের উন্নতি ও কল্যাণ নিয়ে বিশেষ বিচলিত নয় ।

আইন ও নিয়ম নীতি না থাকার জন্য গৃহশ্রমিকরা নিয়োগকারীর সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করে কাজে যোগ দেন । কলকাতায় এবং পশ্চিমবঙ্গ গৃহশ্রমিকরা সপ্তাহে একদিন করে ছুটিও পান না। এখনও বহু পরিবারে গৃহশ্রমিকদের খাওয়ার বাসনপত্র আলাদা থাকে এবং তাঁদের নিয়োগকারীদের শৌচালয় ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। তাঁদের মজুরিও খুবই সামান্য । কলকাতায় দেখা যায় যে পাঁচ – ছ’টা বাড়িতে কাজ করেও একজন গৃহশ্রমিকের মাসিক আয় ১০,০০০ টাকার কম। ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যেই গৃহশ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরির নিয়মের আওতায় পড়েন না ।

লকডাউন এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরত যাওয়া

ভারতের লকডাউন খুবই কঠোর ছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণার পর বাড়ির বাইরে বেরোনো খুবই মুস্কিল ছিল। নিতান্ত দরকার ছাড়া কেউই বেরচ্ছিল না। পুলিশও তৎপর ছিল। কখনও বুঝিয়ে, অনেক সময়েই ভয় দেখিয়ে এবং মারধোর করে মানুষকে বাড়িতে ঢুকিয়ে রাখছিল। মে মাসের মাঝামাঝি অবধি এইরকম অবস্থাই ছিল। জনস্বাস্থ্যের জন্য এই লকডাউনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে তারপর পুলিশের ভয় দেখিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো কি সমীচীন? সাবধানতার বার্তা প্রচার করে আর সমাজকল্যাণ এবং জনসংযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের কর্মীদের দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে এই কাজটা করানো যেত না কী?

এপ্রিল মাসের শুরুতে জানা গেল যে অধিকাংশ গৃহশ্রমিকরা তাঁদের মার্চ মাসের বেতন পেয়েছেন। কিন্তু মে মাসে একদম আলাদা চিত্র দেখলাম। কিছু শ্রমিকরা জানালেন যে তাঁদের কাজ চলে গেছে আর অনেকেই বললেন যে তাঁরা এপ্রিল মাসের বেতন পান নি এবং পাবেন কি না বুঝতে পারছেন না। কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা বেতন চাইতেও ইতস্ততঃ করছেন।

তবে মে মাসের মাঝামাঝি যখন ‘আনলক’ শুরু হল – অফিস খুলতে লাগল, যানবাহন চলাচল আরম্ভ হল – তখন কিছু নিয়োগকারীরা গৃহশ্রমিকদের কাজে ফিরে আসতে বললেন। অনেক শ্রমিকরা তখন নিয়োগকারীদের বললেন যে তাঁরা কাজে ফিরতে রাজি আছেন কিন্তু কাজে যোগ দেবার আগে তাঁদের বাকি বেতন চুকিয়ে দিতে হবে। এর ফলে অনেকেই বাকি বেতন পেলেন – কেউ পুরোটা কেউ খানিকটা । তবে অনেকের বেশ কাটখড় পোড়াতে হয়েছিল এই দাবী আদায় করতে । কিছু নিয়োগকারী তো অকপটে বলেছেন যে যেহেতু লকডাউনে গৃহশ্রমিকরা কাজ করেন নি তাই তাঁরা মজুরি দেবেন না।

অতিমারির কারণে দেখা গেল যে অনেক নিয়োগকারীরাই চাইছেন যে শুধু একজন গৃহশ্রমিকই তাঁদের বাড়িতে কাজ করুন এবং শুধুমাত্র তাঁদের বাড়িতেই কাজ করুন। বয়স্ক অথবা অসুস্থ ব্যক্তিরা কাউকেই নিজেদের বাড়িতে ঢুকতে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না। কিছু বাড়িতে বিশেষতঃ যেখানে ছোট বাচ্চা অথবা বয়স্ক ব্যক্তি আছেন নিয়োগকারীরা চাইছিলেন যে গৃহশ্রমিকরা দৈনন্দিন যাতায়াত না করে কাজের বাড়িতেই থেকে কাজ করুন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিয়োগকারীরাও কাজ হারিয়েছিলেন বা ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বলে গৃহশ্রমিকদের কাজে বহাল করতে পারেন নি। অতএব দেখা গেল যে লকডাউনের পরে যদিও গৃহশ্রমিকরা কাজে ফেরত যেতে আরম্ভ করলেন তাঁরা কিন্তু তাঁদের সব কাজগুলি ফেরত পান নি। যেমন রানী মন্ডল লকডাউনের আগে ৬ টি বাড়িতে কাজ করতেন এবং তিনি ৩টি বাড়ির কাজ ফেরত পান। রুমা মাইতি ২টি কাজের ১টি ফেরত পান।

অতিমারি, লকডাউন ইত্যাদির অনিশ্চয়তার পর মে মাস থেকে যখন কিছু যানবাহন চলতে আরম্ভ করল আর সকলে কাজের জায়গায় ফেরার তোড়জোড় করতে লাগলেন তখনই এসে পড়ল সাইক্লোন আম্ফান। এর ফলে কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার মানুষ আরও একটা দুর্যোগের সামনে পড়লেন এবং অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। রানী মন্ডলের বাড়ির ছাদ উড়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ পূর্ব কলকাতায় ওঁদের পাড়ায় ৩০০ টি বাড়ির খুবই ক্ষতি হয়। ওঁর কাজের বাড়ি থেকে ওঁরা বলেছিলেন যে পার্টি অফিসের থেকে ওঁরা তেরপল পাঠিয়ে দেবেন কিন্তু তা হয় নি। পরে রানীদের পাড়া থেকে দশ বারোজন মহিলারা মিলে সাইক্লোনের ক্ষয় – ক্ষতি নিয়ে পার্টি অফিসে আলোচনা করতে যান। পার্টি অফিস থেকে তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন যে ওঁরা গিয়ে দেখে আসবেন এবং তারপরে ঠিক করবেন যে কি করা যাবে । তবে ওঁরা আসেন নি।

কাজের জায়গায় নতুন নিয়ম

নারী গৃহশ্রমিকরা সব সময়েই প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেন। তাই সুযোগ পেয়েই ওঁরা কাজে ফিরে গেলেন। এবারে অবশ্য কাজে গেলেন ব্যাগে স্যানিটাইজার নিয়ে আর মুখে মাস্ক পরে। কেউ আবার কাজের বাড়িতে গিয়ে বাইরের জামা কাপড় বদলে নেন। তাঁরা মনে করেন যে এই সাবধানতাগুলো নিজেদের ও নিজের পরিবারের এবং কাজের বাড়ির সকলের স্বাস্থ্যের জন্য দরকারি। প্রতিমা গায়েন ৪ টি বাড়িতে কাজ করেন। প্রত্যেকটি বাড়িতে ঢুকে উনি জামাকাপড় ছেড়ে নেন এবং সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেন। যেই জামাকাপড় পরে বাইরে থেকে আসেন সেইগুলি কাজের বাড়িতে কেচে শুকোতে দেন যাতে পরের দিন পরার জন্য কাচা কাপড় থাকে। সারাদিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে স্নান করে নেন। কাজ করার সময় মাস্ক পরে থাকেন। অবশ্য গরমের দিনে সন্ধ্যাবেলায় স্নান করা যতটা সহজ, খুব বৃষ্টির দিনে বা শীতের সময় তা নয়। অনেকেই বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নেন।

সব সময়েই নিয়োগকারীদের মধ্যে গৃহশ্রমিকদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একটা সংশয় থাকে। এবং পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে বেশ কিছু বর্ণ বিদ্বেষী প্রথা আমরা এখনও চালু রেখেছি। কয়েকটির কথা আমি এই লেখায় খানিক আগে উল্লেখ করেছি। পার্বতী মাঝি তিন বছর ধরে একটি বাড়িতে কাজ করতেন। লকডাউনের পরে যখন উনি কাজে ফেরত গেলেন তখন ওঁকে সেই বাড়ির ছোট বাচ্চাটিকে ছুঁতে মানা করে দেওয়া হল। এতে উনি খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। আরও খারাপ লেগেছিল যখন উনি দেখলেন যে কাজ করতে করতে যেই জায়গাগুলি উনি ছুঁয়েছেন ওঁর নিয়োগকারীরা আবার সেই জায়গাগুলি মুছে নিচ্ছেন। যদিও সকলেই বুঝেছেন যে এই অতিমারির সময় দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন কিন্তু গৃহশ্রমিকদের বিশেষ করে মনে হয়েছে যে এই অতিমারির ফলে আমাদের মত জাতি, ধর্ম ও শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষে মানুষে বিভেদ আর ‘সামাজিক দূরত্ব’ আরও বেড়ে যাবে কি না।

সরকার ও সমাজের দায়বদ্ধতা

অতিমারির সময়ে দেখা গেল যে গরিবদের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার কিছু প্রকল্প চালু করলেন। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি তো আছেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সকলে এই প্রকল্পগুলির সুবিধা পেলেন না। পাশাপাশি বহু ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবী দল, সামাজিক সংস্থা, রাজনৈতিক দল মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। বিরল হলেও কিছু গৃহশ্রমিকদের নিয়োগকারীরা তাঁদের টাকা ধার দিয়ে অথবা অর্থ বা জিনিস দিয়ে সাহায্য করেছেন।

ভারতে গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে অধিকার ও নিরাপত্তা অনিশ্চিত। কোভিড অতিমারির ফলে এই নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। খুবই তাড়াতাড়ি পশ্চিমবঙ্গে গৃহশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির নিয়মের আওতায় আনা প্রয়োজন। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ব্যবস্থা প্রয়োজন যাতে গৃহশ্রমিক ও তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

গৃহশ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা দূর করার জন্য নিয়োগকারীরা অবশ্যয়ই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন যেমন প্রতি ঘন্টা পিছু কমপক্ষে ৪৫ টাকা মজুরি ধার্য করা এবং প্রতি সপ্তাহে একদিন সবেতন ছুটি দেওয়া । গৃহশ্রমিকদের সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া। অসুখ করলে সবেতন ছুটি দেওয়া। তাঁদের স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পে নথিভুক্ত করা।

সাম্য ও অধিকার আদায় করা সহজ নয়। নারী গৃহশ্রমিকের নিয়োগকারীরা চাইলে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ খানিকটা সহজ করে দিতে পারেন।


অঞ্চিতা ঘটক – সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

India achieved freedom on the midnight of 14-15 August 1947. As Jawaharlal Nehru famously put it, when the world was asleep, India woke up to life and freedom. This meant the end of nearly two hundred years of British rule, for which the Indian National Congress and various other political groups have been fighting for about half a century. So naturally there was euphoria on the streets of capital New Delhi, as well as in the provinces. The celebrations started from 11 PM on 14 August when the Constituent Assembly met under the chairmanship of Rajendra Prasad, and Nehru delivered his emotionally charged ‘Tryst with Destiny’ speech. This was followed by the presentation of the emblems of the new nation – the flag and the anthem. The Constituent Assembly had accepted the new flag, which was the Congress flag since 1930, with a minor change – the charkha being replaced with chakra. The nation, as Nehru argued, could now stand under the same flag with which they had fought against foreign rule. As for the anthem, the Constituent Assembly preferred Rabindranath Tagore’s Jana-gana-mana over the familiar Bande mataram, which offended the Muslims. Thus, at the moment of arrival the founding fathers carefully chose the emblems of the new nation which they expected to be secular and democratic, as well as closely associated with the legacy of the Congress.

On the streets people were ecstatic that night and the following day. More than a million people came to watch the evening parade at Kings Way, where the national flag was hoisted and the government buildings were illuminated. A million people marched on the streets of Bombay that morning and some of them even took possession of the Secretariat Building. In Calcutta about 200,000 people broke the police cordon and rushed into the Governor House and later the Assembly House, in a bid to reclaim what was once the most sacred space of the Raj. There were numerous other functions all over the country, where national flag was unfurled, national anthem was sung and patriotic speeches were delivered.

But not everyone was in a mood to rejoice, as freedom also arrived with the pain of partition. Mahatma Gandhi, then in Calcutta trying to stop communal riots, spent the day in prayer as an act of penance. The Hindu Mahasabha did not participate in the celebrations as a protest against partition. The Muslim League decided to join, but the minority Muslims – like their Hindu counterparts in Pakistan - lived in a state of anxiety about an uncertain future.

Freedom at the moment of arrival thus evoked mixed emotions, and the partition was not the only cause of concern. The idea of freedom in India had developed as a result of a productive encounter with the colonial modernity, which transformed the older idea of mukti or an abstract spiritual notion of emancipation in the other world, into more worldly concerns for individual freedom of choice on the one hand and collective freedom on the other. However, as the freedom struggle progressed, the issue of individual freedom came to be subordinated by the concept of collective freedom; and of all collective identities, the nation took precedence over others, like class, caste or gender.

However, there was also tension in the ways national freedom was being conceptualised by myriad groups of people who constituted the grand nationalist coalition which wanted to see the end of British rule. While some saw in the attainment of political sovereignty for the nation-state the immediate fulfilment of the goal of the freedom struggle, others preferred to expand the meaning of freedom to incorporate also the notions of economic and social freedom for the people. As Nehru reminded his countrymen in his opening speech, in 1947 the immediate goal of political freedom had been achieved, but the greater challenge was to ensure for every citizen the freedom from poverty, ignorance, disease and inequality. And it was this challenge which caused anxiety, as there was no agreement yet on how to overcome it.

So freedom in 1947 did not mean a clinical break with the colonial past. In the initial years, continuities could be seen in the institutional structure, in the rituals and pageantry of the state, even in the modes of governance. Mahatma Gandhi had warned in Hind Swaraj (1909) that India might end up with English rule without the Englishmen. It is doubtful whether any complete reversal of the colonial past has ever occurred in any history of decolonisation. For India freedom was not certainly a moment of rupture, but symbolised a process of transference and adaptation – a process of hybridization through which the meanings of freedom would be expanded exponentially.

Sekhar Bandyopadhyay : Professor, Emeritus of History at Te Herenga Waka – Wellington University

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সুজান মুখার্জি

Posted in



‘ক্যাটাস্ট্রোফোজোইক’

‘ক্যাটাস্ট্রোফোজোইক’ শব্দটির সাথে আমার পরিচিয় হয় অমিতাভ ঘোষের দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট পড়ার সময়ে। ২০১৬-এ প্রকাশিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ কিভাবে আমাদের সভ্যতাকে নতুন এক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারই সাথে তিনি দাবী জানিয়েছেন যে এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাহিত্যিকদের কর্তব্য তাঁদের লেখায় জলবায়ু পরিবর্তনের সামাজিক প্রভাবকে তুলে ধরা।

তাঁর মতে কল্পবিজ্ঞান বা ক্লাইমেট ফিক্‌শনের (‘সাই-ফাই’-এর পর ‘ক্লাই-ফাই’) স্রষ্টারা যদি বা এই সমস্ত যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখেও থাকেন, সেই ভবিষ্যৎ বড়ই অপরিচিত এবং দূরের বলে মনে হয়। সেই পৃথিবী যে আমাদেরই পৃথিবী, সেই ভবিষ্যৎ যে আমাদেরই ভবিষ্যৎ, অনেক সময়ই তা খেয়াল থাকে না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে অবশ্য তাঁর সাথে একমত নই। মেনস্ট্রীম সাহিত্যে এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দুর্লভ হলেও, সাই-ফাই-এর জগতে নিজের বাস্তবকে খুঁজে নিতে যে বিশেষ কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয়, তা আমি মনে করি না। যে প্রজাতি যতিচিহ্ন সাজিয়ে নিজেদের আবেগ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে, তারা যে সর্বত্রই নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুজে পাবে, তা খুবই স্বাভাবিক। নার্সিসিস্ট নিশ্চয়ই আত্মসংরক্ষণের ব্যাপারে অন্ততঃ সচেতন?

সে যাই হোক। এই ‘ক্যাটাস্ট্রোফোযোইক’ (নতুন শব্দ শেখার পর ব্যবহার না করলে নাকি মনে থাকে না) যুগে দাঁড়িয়ে কলকাতা শহরের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গেলে দুশ্চিন্তা হওয়ারই কথা। বছর খানিক আগে নিউ জার্সির ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রাল’ নামের একটি সংস্থা তাদের গবেষণাপত্রে জানায় যে উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ২০৫০-এর মধ্যে কলকাতাসহ হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বার্ষিক বন্যার সম্ভবনা রয়েছে। তার ফলে আনুমানিক ৪.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হতে পারেন। অবশ্য তিন-তিনটে ক্যান্ডিডেট সামনে থাকতে বলা খুবই কঠিন অ্যাপোক্যালিপ্সের রূপ শেষমেশ কিরকম হবে – মহামারী ভাইরাস, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ, নাকি ফ্যাসিবাদের হিংসা।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা ইব্‌ন আল-নাফিসের রিসালাত ফাদিল ইব্‌ন নাতিক্‌ –এর মতন কিছু ছুটকো উদাহরণ বাদ দিলে, অ্যাপোক্যালিপ্স-কেন্দ্রিক সাহিত্যের উত্থান এবং ক্রমবিকাশ উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার থেকেই হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন আসন্ন অ্যাপোক্যালিপ্সের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা নিয়ে গল্প লেখা বা সিনেমা বানানো হয়েছে, তেমনই অনেক জায়গায় আমরা পাই উত্তর-অ্যাপোক্যালিপ্টিক একটি সময়ের চিত্র – অজানা, অচেনা পরিস্থিতির মুখে দু-চার জন উত্তরজীবির বেঁচে থাকার বা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার সংগ্রাম। মানব সভ্যতার ধ্বংস হওয়ার কথা কল্পনা করতে মানুষ কেন এতো ভালোবাসে তা বিশ্লেষণ করা যায় তবে আজ নাহয় তার মধ্যেই আর নাই গেলাম।

‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ‘ইম্পিরিয়াল ইন্ডিয়ান ওয়ার ফান্ড’-এর জন্য তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্ডিয়ান ইঙ্ক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাতে একদিকে যেমন চায়ের কাপে ভাসমান নৌ জাহাজ সমেত লিপ্টন চায়ের বিজ্ঞাপন, অন্য দিকে ছাপা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দ্য ট্রাম্পেট’ কবিতা এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি। তারই ফাঁকে গোঁজা একটি অদ্ভুত ছোট গল্প, ‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’ অর্থাৎ আজি হতে অর্ধশত বর্ষ পরের কলকাতা। গল্পের লেখকের এভেরার্ড ডিগবি, যিনি সেই সময়ে সাংবাদিক মহলে বেশ নাম করেছিলেন। সত্যি বলতে, লেখাটিকে গল্প বলা চলে কি না জানি না – ‘স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধ’ বলাই হয়তো ভালো। দেখে নেওয়া যাক লেখকের কল্পনায় কলকাতার ভবিষ্যৎ রূপ কি রকম।

এই ধরণের লেখায় একজন আগন্তুকের উপস্থিতি আবশ্যক। বড় মাপের সাহিত্যিকদের পক্ষেও বহিরাগত কারুর পৃথক দৃষ্টীভঙ্গি ছাড়া কল্পিত জগতের বৈশিষ্ট তুলে ধরা কঠিন। ডিগবির লেখায় সেই যাত্রী আসছেন ১৯৬৪ সালে, কলকাতা দর্শন করতে। সেই ৫০ বছরেই শহরে আক্ষরিক অর্থে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। দক্ষিণ দিক থেকে আসবার সময়ে সাগর দ্বীপ পেরোতে না পেরোতেই চোখে পড়ছে প্রকাণ্ড এক পাহাড়ের মত কি – সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। আরও একটু কাছে যেতে যাত্রী লক্ষ্য করছেন সেই পাহাড় আদপেই মাটি সংলগ্ন নয়। গোটা শহরটি যেন জলাভুমির কিছুটা উঁচুতে ভাসছে, এক গোছা মোটা মোটা অ্যালুমিনিয়াম ব্যান্ডের ওপর ভর দিয়ে। পড়বার সময়ে আমার চোখের সামনে ভাসছিল ক্রোমিয়ামে মোড়া একটা বিরাট পদ্বফুলের ছবি। কিন্তু এই অবস্থা কি করে হল তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯১৪-এ।

সেই সময়ে কলকাতা শহরে হাতে গোনা কিছু বাড়িতে লিফ্‌টের ব্যবস্থা ছিল। ওয়াল্টার গ্র্যানভিলের নির্মান করা কলকাতা হাই কোর্টের মাঝের অংশটা দেবে যাওয়ার কথা যাঁদের মনে ছিল, তাঁরা এও জানতেন যে গোটা শহরটাই আসলে কাদার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। লোকসংখ্যা যতই বেড়ে যাক, সেই ভিতে কার সাহস হবে ছ-তলার পর সাত-তলা বাড়ি নির্মান করার? চারিপাশে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে মনে হচ্ছিল না।

এমন সময়ে, কলকাতার ২০০ মাইল দূরে নতুন টাটা ষ্টীলের কারখানা স্থাপিত হল একটি লৌহ আকরিকের ঢিবীর ওপর। আধুনিক প্রযুক্তির ষ্টীলের কাঠামো তুলনায় অনেক হাল্কা আর তারই সাথে কারখানা চালু হবার পর ষ্টীলের দামও কমে যায়। দেখতে দেখতে ২৫ তলা, ২৬ তলা, শেষ পর্যন্ত ৪০ তলা বাড়িরও স্বপ্ন দেখতে লাগল কলকাতার মানুষ। বাঁশ ঝোপের মতন গজিয়ে উঠল শত শত স্কাইস্ক্রেপার। কলকাতার উচ্চমধ্যবিত্ত সংসারে প্রেমিক-প্রেমিকা চল্লিশ তলার উত্তরমুখী বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া খুঁজতে লাগলেন।

বাড়ির উচ্চতা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে, ইঞ্জিনিয়াররা সাবধান করে দিলেন যে গভীর ভিত না বানালে যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে। আশপাশের জমি থেকে কাদা তুলে আনার ব্যবস্থা হল। আইন জারি করা হল – শহরতলিততে কমসে কম দশ ফুট আর শহরকেন্দ্রে কুড়ি ফুট কাদা জমিয়ে তার ওপরেই মাল্টিস্টোরি নির্মান করা যাবে। এর ফলে যেখান থেকে কাদার কন্ট্র্যাক্টররা মাটি তুলে আনলেন, সেই সব জায়গায় বিরাট বিরাট নোনা জলের হ্রদ দেখা দিল। মশাদের হল ভারি মজা। কিন্তু এমনই একদিন, মেসার্স স্মিথ অ্যান্ড ওয়েস্টোভার কাদা কোম্পানির মালিকের মাথায় একটি নতুন আইডিয়া খেলে গেল। ডালহৌসি স্কোয়েরের অফিসের জানলার পাসে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছতে মুছতে দূরে একটি সাদা মেঘ দেখে তিনি ভাবলেন, গোটা শহরটাকেই মাটি থেকে তুলে নিলে কেমন হয়?

ব্রাইট আইডিয়া বাস্তবায়িত করতে গেলে কিছুটা ভাগ্যেরও দরকার হয়। ইতিমধ্যেই, দক্ষিণ ভারতের এক পাগলাটে ব্যবসায়ীর হাতে হাত মিলিয়ে এক পাগলাটে বৈজ্ঞানিক ম্যাঞ্চেস্টারের তুলোর মতন সূক্ষ্ম অ্যালুমিনিয়ামের তার বানাতে শুরু করে। সেই ম্যাজিক তারের দৌলতে পঙ্কজ নগরীর জায়গায়ে নিমেষের মধ্যেই গড়ে উঠল এক ঝলমলে দৈত্যাকার শহর, মাটির থেকে ১৫০০ ফুট উঁচুতে ভাসমান, উচ্চতায় ৮০০ ফুটেরও বেশি। সেখানে দার্জিলিং থেকে রোপওয়ে দিয়ে আসে কার্টন ভর্তি চা আসে, সিকিম থেকে আমদানি হয় তামা, আর তিব্বত থেকে আসে সোনা।

যে সময়ে ডিগবি এই স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধটি রচনা করেন, কলকাতার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশাসন খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। ১৯১২ সালে সি.আই.টি. সংগঠিত হলেও পুঁজির অভাবে এবং আরও অন্যান্য কারণে তাঁদের কাজ ধীরগতিতেই শুরু হয়। প্যারিসে ব্যারন হাউস্‌মান্‌ যেরম নির্মম ভাবে শহরের পুরনো রূপ এবং স্মৃতি ভেঙে চুরমার করেছিলেন, সি.আই.টি.-র কর্মকর্তারা ঠিক সেরকম না হলেও অনেক অঞ্চলে ‘ড্রাস্টিক সার্জারির’ পরিকল্পনা করেন। বলা বাহুল্য, তাঁদের নজর কেবলই শ্রমিক শ্রেণী-প্রধান এলাকাগুলির ওপর গিয়ে পড়ে। শহরকেন্দ্র অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠার ফলে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে এবং তাতে ব্যাবসা-বাণিজ্যের লোকসান হয়। অতএব তাঁরা প্রস্তাব দেন যে, যাঁরা এইসমস্ত এলাকার বাসিন্দা, তাদের ক্রমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক শহরতলিতে।

ভিন্নমত প্রকাশ করার মতন খুব বেশি মানুষ না থাকলেও, প্যাট্রিক গেডেস্‌ নামের একজন স্কটিশ জীববিজ্ঞানী সি.আই.টি.-র পরিকল্পনার সমালোচনা করেন। তিনি এও বলেন যে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের যেহেতু খাটুনী অনেক বেশি আর হাতে সময় অনেক কম, শহরকেন্দ্র তাঁদেরই বাসস্থান করে, অর্থবান মানুষদের শহরতলিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। পুঁজিভিত্তিক নগর পরিকল্পনায় এ যেন পাগলের প্রলাপ!

‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’-এ আমরা এই সমস্যা সমাধানের এক অভিনব (যদিও ব্যর্থ) প্রচেষ্টা দেখতে পাই। ডিগবির কল্পনায় বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থার নাগরিক, আলাদা আলাদা স্তরে বাড়ি করেন। শ্রমিক শ্রেণীর বসবাস সব থেকে নিচের স্তরে কিন্তু তা কোন অন্ধকারময় হতাশার জায়গা নয় – বরঞ্চ ছায়াময়, শান্ত, শীতল পরিবেশ। কতগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ডিগবি এড়িয়ে যান যেমন, এই যে বিভিন্ন স্তরের মানুষ, তাঁদের মধ্যে কি মেলামেশার সম্ভাবনা রয়েছে? যদি সকল শ্রেণীর মানুষ এক রাস্তা দিয়ে চলাফেরা নাই করতে পারেন, তাহলে কি শ্রেণী সংগ্রামের কোন জায়গা নেই? ‘ছোট গল্পের’ বদলে ‘স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধ’ বলে বর্ণণা করার কারণ পরিষ্কার হল আশা করি। গল্পের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে এই সমাজব্যাবস্থাকে প্রশ্ন করা যেত। ডিগবি তার প্রয়োজন মনে করেন নি।

‘২০০ বছর পরে ফ্যাতাড়ু’

১৯৬৪ থেকে আমরা চলে এসেছি একেবারে ২২১০ সালে। তিনজন ‘ফেমাস ফ্যাতাড়ু,’ মদন, ডি.এস. ও পুরন্দর ভাট ক্রায়ো-ঘুম থেকে উঠবে উঠবে করছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল যে ফ্যাতাড়ুরা সমান হলেও, মদন তাদের মধ্যে একটু বেশি করে সমান, অর্থাৎ সেই হচ্ছে ফ্যাতাড়ুদের লিডার। ক্রায়ো-ঘুম কি তা অবশ্য নবারুণ আমাদের গল্পের শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘৭৭.১৫ কেল্ভিন তাপমাত্রায়...জ্যান্ত বা হাফমরা মালদের দীর্ঘ সময়ের জন্য জমিয়ে রাখার একটা পদ্ধতি।’ মৃতুকে কমডিফাই করা এবং তার অন্যান্য দিক নিয়ে নবারুণ একাধিক জায়গায় লিখেছেন – কিন্তু সে কথা পরে হবে।

আর সব জ্ঞানী-গুনি লোক থাকতে এই তিন জন ফ্যাতাড়ুকে কেন এই মহান এক্সপেরিমেন্টের স্যাম্পেল হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল তা নবারুণও সঠিক বুঝতে পারেন নি। আমার ধারণা তারা যাতে এদিক ওদিক আর ঝামেলা বাঁধাতে না পারে, তাই এই সিদ্ধান্ত।

লিডার বলেই মদনের ঘুমের কোটা থেকে দু’দিন কেটে নেওয়া হয়েছিল। তার ওপর দায়িত্ব কিঞ্চিৎ বেশি। দু’শো বছর মাইনাস দু’দিনের গভীর ঘুমের পর বাকি দুই ফ্যাতাড়ুর ঘুম ভাঙার আগেই মদন নোয়ার সেই ঘুঘু পাখির মতন বাইরেটা সার্ভে করে আসে। ‘বারান্দায় তুমুল হাওয়া। যতদূর দেখা যায় জল আর ঢেউ। কয়েকটা বাড়ির ওপরটা দেখা যাচ্ছে, জলে থার্মোকল, পচা কাঠ, মরচে পড়া পেট্রলের ক্যান, নানা সাইজের জেরিক্যান, জাম্বো সাইজের পুতুল ভাসছে...জল কালচে এবং ঘোলাটে।’

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল জলের তলায় – বা হয়তো ভেসেই গেছে। মনুমেন্টের ডগাটা খালি দেখা যাচ্ছে – আর ভাটার সময়ে দ্বিতীয় হাওড়া ব্রিজ। মজার ব্যাপার, ‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’-এও ভিক্টোরিয়ার অসম্পন্ন অবস্থার একটি স্টিম্পাঙ্ক বর্ণনা আমরা পাই। যে সব আইকনিক মনুমেন্ট শহরের পরিচিতির সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশে যায় – যেমন কলকাতায় ভিক্টোরিয়া, নিউ ইয়র্কে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, বা লন্ডনের (কলকাতারও) বিগ বেন – সেগুলিকে ভগ্নদশায় দেখার মধ্যে কি যেন এক অস্বস্তিকর রোম্যান্টিসিজম লুকিয়ে থাকে। রোল্যাণ্ড এমেরিচের দ্য ডে আফটার টুমরো (২০০৪) ছবির পোস্টারেও আমরা তার উদাহরণ দেখতে পাই। তারই মধ্যে পুরন্দর দুটি কবিতাও রচনা করে ফেলে, যার প্রথমটি শুরু হচ্ছে –
‘কোথা সে সিনেমা হল
কোথা সে শপিং মল
চারিদিকে ঘোলা জল
করিতেছে খলবল’

দু’শো বছর বাদে ফ্যাতাড়ুদের জাগিয়ে তোলার প্রগ্রাম করার সময়ে বৈজ্ঞানিকরা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন যে ইতিমধ্যে কিছু অঘটন ঘোটতেই পারে। তাদের সাথে প্রচুর পরিমাণে বিড়ি, সিগারেট, বাংলা ও হুইস্কি, এমন কি গ্যাস মাস্ক, ডুবুরি সুট পর্যন্ত দিয়ে রেখেছিলেন। আণ্ডা ট্যাব্লেট দিয়ে ইয়া সাইযের মামলেট আর পাউরুটি ক্যাপ্সুলের পাউরিটি দিয়ে নাস্তা করে, ভাটায় জল নামার পর তিন জনে মিলে বেরিয়ে দেখল ‘অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাগুলোতে ডাঁই হয়ে থাকা খুলি ও হাড়গোড়, কাত হয়ে থাকা অসংখ্য গাড়ি...এ.টি.এম. মেশিন, কেৎরে পড়া মবাইল টাওয়ার।’

এই সব ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে দেখতে ফ্যাতাড়ুদের মনে হয়, সত্যিই কি উষ্ণায়ণের কারণে গোটা শহর জলের তলায় চলে গেল? যদি সমুদ্রের ঢেউ তাদের দিকে তেড়ে আসে, তাহলে কি কলকাতার মানুষ গ্যাঁট হয়ে নিজের জায়গাতেই বসে থাকবে না কি দেদার দৌড় মারবে? অর্থাৎ সমুদের জল এসে পৌঁছানো আগেই হয়তো কোন যুদ্ধে অ্যাটম বোমে পড়ে বা বিষাক্ত গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে সমস্ত মানুষ মারা গিয়েছিল। এইসব চিন্তা করতে করতে তারা হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি তাদের দিকে উড়ে আসছে ক্যাঁ ক্যাঁ করতে করতে। দ্বিগুন স্পিডে ফ্যাতাড়ুরা উড়ে পালায় আর সাউথ সিটির বত্রিশ তলার একটা খোলা বারান্দা দেখে ঢুকে পড়ে। তারপরের ঘটনায় নাহয় আজ আর নাই গেলাম।

ডিগবির লেখায় আমরা একধরণের আশাবাদী সরলতা বা নাইভেটে লক্ষ্য করি, আবার নবারুণের গল্পে প্রাকৃতিক অ্যাপোক্যালিপ্স আর অ্যাটমিক যুদ্ধ কোথায় যেন গুলিয়ে যায়। হয়তো সাধারণবুদ্ধির ফ্যাতাড়ুরাই ঠিক ধরেছিল। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন না হলে কলকাতা শহরে অদূর ভবিষ্যতে ঘোর প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসার আসঙ্কা রয়েছে। গতবছর উপমন্যু ভট্টাচার্য ও কল্প সংভিওয়েড বলে একটি চমৎকার অ্যানিমেটেড স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি করেছেন। নবারুণের দু’শো বছর পরের কলকাতার মতন এই গল্পেও শহর জলের তলায় চলে গেছে। তারই মধ্যে চলছে মানুষ এবং বাঘের – দুজনেই এক প্রকার জলবায়ু শরণার্থী – বেঁচে থাকার লড়াই। ছবিটি দেখার সুযোগ আমার এখনও হয় নি কিন্তু আশা করি বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

সুজান মুখার্জি : গবেষক ও লেখক

0 comments:

0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in



মরার কোকিল! মাঘ মাস শেষ না হতেই হৃদয়ের দরোজা খুলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।

প্রথম দিন ভেবেছিলাম, হয়ত কেউ গাড়িতে সখ করে কোকিলের তান লাগিয়েছে। করোনার কারণে ফাগুনের আগুনে এবারের ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করা যাবে না সেই দুঃখে। ঢাকার তরুণদের সখ বৈচিত্র্য যেমন বিচিত্র তেমন অভাবনীয় এবং উত্তুঙ্গগামী! গেল দুবছর পহেলা বৈশাখে এমন ভুভুজলা বাজাতে শুরু করেছিল কিছু ছেলেপেলে। কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল! মনে হয়েছিল ওদের হাত থেকে ভুভুজলাগুলো কেড়ে নিয়ে ওগুলো দিয়েই ওদের পেটাই।

মর জ্বালা! এ যে ভোরেও ডেকে উঠছে! গাড়িঘোড়ার কোনো বালাই নেই। শব্দহীন নিঝুম একলা ভোর। তবে ত কোকিল পাগলাই হবে! ভেতর বারান্দায় গিয়ে ভুচকুলি পাখির মত ভুচি মেরে দেখার চেষ্টা করি। বিশাল আমগাছ ঘুম চোখে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। কিন্তু কই সে ঘনকেষ্ট ব্লাক ডায়মন্ড! নেই ত নেইই।

দুদিন পর। চনমনে উষ্ণ দুপুর। আবার সেই ডাক, কুহু কুহু। কোকিল কি প্রেমের দেবী ভেনিসের দূত? আরাম করে পড়ছিলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে উপহার পাওয়া প্রিয় লেখক মাহমুদুল হকের রচনাবলী থেকে নিরাপদ তন্দ্রা গল্পটি। কুহু কুহু অভিরামে ভেসে গেল আমার অন্তরাত্মা। বাল্য বন্ধুকে ফোন করি, এই শোন তোদের ওদিকে কি কোকিল ডাকতে শুরু করেছে ?

না তো ! মাঘমাস তো এখনও শীতকালে ট্যাগে আছে। তুই কোকিল পাচ্ছিস কোত্থে !

আরে আমাদের এখানে তিন দিন ধরে ডেকে যাচ্ছে। শালার কোকিল খুঁজেই পাচ্ছি না –

না পাওয়াই ভাল। তোর ত আবার বর্ষাকালেও বসন্ত লাগে। কৃষ্ণরসে ভেসে যাস। মনে নাই সে কাহানি ? সাবধান কলাম !

তুই একটা শয়তান। যা ভাগ কুত্তা যেন কোহানকার---তুমুল হাসতে হাসতে আমরা ফোন কেটে দেই।

কেটে দিলে কি হবে ! দেখি আমার হাত বেয়ে নেমে এসেছে যমুনা। ঘর ভেসে যাচ্ছে থইথই যমুনার জলে। আমি যেখানেই পা রাখি ঝলকে ছলকে উঠছে নীল যমুনার জল। আর তখুনি, রাধা রাধা চোখে ভেসে আসে ঘোর ঘননীল এক বর্ষাদিন।

ছোট্ট শহরের অনামা এক লঞ্চঘাট। কাদামাটির বুকে নাক গেঁথে থেমে আছে একটি লঞ্চ। সারেং ঘরের উপরে ভিজে বাতাসে দুলে উঠছে লাল সবুজ পতাকা। ডেভিডরা চলে যাচ্ছে আমাদের শহর থেকে। ওর ড্যাডা ডাঃ ভ্যান ট্রান্সফার হয়ে গেছেন তার নিজের দেশ আয়ারল্যান্ডে। বৃষ্টি পিছল ডেকএ দাঁড়িয়ে তিনি হাত নাড়ছেন। ওঁর পাশে রেলিং ধরে হাসছে ডেভিড। তখনও আমরা ওদের দেওয়া বিদেশি ক্যান্ডি খাচ্ছি আর হাসাহাসি করছি। শেষবারের মত ভেঁপু বাজিয়ে নাক তুলে নিল লঞ্চটি। ঢেউ খেলে গেল নদীর জলে। তীর ছেড়ে মাঝনদীতে গিয়ে একটু থামলো। এরপর চলতে শুরু করল। প্রথমে ধীরে। তারপর বেগে। লঞ্চ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে সুদূর। অনন্ত আঁচল বিছিয়ে বয়ে যাচ্ছে বড় নদী। ঢেউ আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের গায়ে আর বড় বড় ঘূর্ণি স্রোত সারাক্ষণ ডেকে যাচ্ছে জলসিক্ত ঘর্ঘর গলায়। লঞ্চের গতি আরও দুরন্ত হলে বুঝতে পারলাম, ডেভিড চলে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, ও চলে গেলে আমি থাকব কি করে? কে থাকবে আমার সাথে? কে আমাকে কাঁধে করে শীত নদী পেরিয়ে নিয়ে যাবে শিমুলপলাশ বটপাকুড়ের অরণ্যে? ফিরে আয় ডেভিড -- লদী লাগোয়া রাস্তা ধরে সেই যে দৌঁড় দিয়েছিলাম, এক মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে উড়ে গিয়ে পড়েছিলাম কাশবনে। আমার প্রথম প্রেমে রক্তারক্তি ঘটলেও কাশফুলের মত ভেসে গেছিল সেই কৈশোরে! কিন্তু সে প্রেম গল্প হয়ে জেগে আছে আমাদের বন্ধু মহলে।

এখনও ডেভিডের লাল তিল ভরা কিশোর মুখ মনে পড়ে যায়। ওর গ্র্যান্ডমা চেয়েছিল, ডেভিড যাজক হোক। বংশ পরম্পরায় হেভেন লাভের সুযোগ করে দিক তার নাতি। জানিনা শেষপর্যন্ত কি হয়েছে ডেভিড। আজকাল যখন কেউ বলে তার ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে, তখনই বুকের ভেতর ডেভিড ভেসে আসে। ধর্মের কী আশ্চর্য যাদু কা ঝাপ্পি। কী অভাবনীয় অদ্ভুত মোহশক্তি। হিন্দু, মুসলিম, ক্রিশ্চান, ইহুদি সকলেই বেহেশতে যেতে চায়, অথচ কেউ চায় না, ছোট বড় স্বার্থগুলো ত্যাগ করে এ পৃথিবীটাকে বেহেশ্‌ত বানাতে!

পাশের দেশে ছেলের বয়েসি একজন লেখক থাকে। নিপুণ হাতে যেমন অক্ষর সাজায় তেমনি থরে থরে ফসল ফলায় সে। ওর সাথে যখন কথা বলি, শতধা হয়ে স্নেহ নেমে আসে। সে দেশের কৃষিভাইরা লড়ছে ।তাদের ফলানো অনেক জিনিস আমরা ব্যবহার করি। প্রতিদিন পত্রিকায় পড়ি, ছবি দেখি। কেমন আছে ওরা! কারও কারও মুখ দেখে মনে হয়, এইতো আমার তিন পুরুষ আগের অগ্রজের মুখ। ওই যে পেশির ভাঁজে আলো ফেলেছে ঈষের ফলার ধারালো প্রখরতা সে তো আমার অচেনা কিছু নয়। ওদের মুষ্টি উদ্যত হাতের তালুতে লেগে আছে গর্ভবতী বীজের সুগন্ধ। চোখের নিচে অজস্র আলপথ। অখন্ড ভারতের হারানো একাত্মতা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে মনের ভেতর। এর বেশি কিছু করা যে অশোভন!

আজকাল যখন তখন মাকে মনে পড়ে। বকুলফুলের মত রঙ আর এক রত্তি মেদহীন চিকন শরীরের মা বিছানায় গা এলিয়ে বসলেই বুঝতাম, এখন গল্পের বই পড়তে বসবে। মার সামনে ইশকুলের পড়া মুখস্থ করতে হত। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হত, মা কি সরস্বতী? বইটির প্রচ্ছদ দেখেই জানতাম কি আছে ভেতরে। কারণ নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আমিই বই এনে দিই। আনার আগে পড়ে ফেলি। না পড়তে পারলে বই নিয়ে খাটের নিচে চলে যাই। সেখানে আমার নিজস্ব জগত। পুতুলের ভরা সংসার। পড়তে পড়তে কতদিন ঘুমিয়ে গিয়েছি। মার খুব ইচ্ছে ছিল, পড়াশুনায় অনেক দূর যাব আমি। আমার স্বপ্নবাজ স্বল্প আয়ুর পিতামাতা নিকট ভবিষ্যতে তাদের মৃত্যুর অনাকাঙ্ক্ষিত ছায়াটি তখনও দেখতে পায়নি।

ছায়ায় সাথে মিশে থাকা মাকে বলি, তুমি খুশি মাগো? আমি একজন ছেলের মতই স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। দুহাত বাড়িয়ে রেখেছি মানুষের সাহায্যের জন্যে। ছেলে মরে গেছে, ছেলে নেই বলে দুঃখ নেই ত তোমার?

সেই মুখ টিপে হাসা। আমার প্রবল পুরুষ বাবার পাশে সর্বদা ছায়া হয়েই ছিল মা। আমপাতা ঝরঝর। মেয়ে তুই বই পড়। ঝরা কৃষ্ণচূড়া আলো করে রেখেছে উঠান। ফুল ঝরে পড়তেই টমি কুকুর ছুটে যাচ্ছে। নাচছে, গাইছে। এ বাসার অনেকেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প কবিতা লিখে, ছবি আঁকে। আমার ইচ্ছে করে না। তবু একবার ছড়া লিখেছিলাম। সাথে ছবিও ছিল, আমগাছে কাঁঠাল হয়, বুলবুলিতে ঠুকরে খায়। হয়নি মা ?

কড়া বিষম খেয়ে হাসতে হাসতে নেচে ওঠেছিল বাড়িটা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অপরিসীম দুঃখে কান্না পেয়ে গেছিল, আমি কি গোপালভাঁড়? আবার হাসি। এবার হাস্য মুখর বাড়িটার দরোজা খুলে যায়। বাপি আসে। আমার আঁকা আর লেখা পড়ে খুব খুশি হয়ে বকে দেয় সবাইকে। বুঝিয়ে দেয়, হাসজারু ছড়া হলেও ছন্দ ত মিলে গেছে। এতে হাসির কি হল ! উজিরে আলা আপনিও হেসেছেন। আপনার জন্যে শাস্তি বরাদ্দ হল। আজকের সন্ধ্যায় মহা নাস্তা বানানো হোক।

আমি মুড়মুড় করে লুচি ভাঙ্গি আর বায়ে দুলি, আমাগাছে কাঁঠাল হয়, এবার ডাইনে দুলি, বুলবুলিতে ঠুকরে খায়---হাহাহাহ আমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহি কবি নজরুল হয়ে যাচ্ছি তাই না বাপি !

অবশেষ মাঘ পেরুলো বাংলাদেশ। শাড়ি টাড়ি রেডি করে রেখেছিলাম। ইচ্ছে ছিল শাহবাগের ফুলের দোকানে গিয়ে অশোকফুলের মুকুট বানাব। না পেলে রক্তগাঁদা বেছে নেব। কিছুতেই ওই আজরা জাবরা বিদেশী ফুল পরব না। তারপর হলুদ রোদ্দুরে রিকশার হুড ফেলে চলে যাব পুরোন ঢাকার সদরঘাট। খুঁজে বের করব ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরী। যেখানে এতিম লাবণ্য গুপ্তের সাথে বিয়ে হয়েছিল, কেবল শুধুমাত্র কেবল কবি হওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মানো জীবনানন্দ দাশের।

জ্যাঠামশাইয়ের বাছাই করা পাত্রের সাথে দেখা করার দিন বৃষ্টি পেছল মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েছিলেন লাবণ্য। সেদিন ভাগ্য তাকে আছড়ে ফেলেছিল কুটিল পঙ্কে। তার স্বপ্ন, সাধ, স্বদেশ প্রেম সব লেপটে গেছিল কাদামাটির সাথে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি কাকের চঞ্চুর মত, শকুনির হৃদয়বাহী এক নারী। ভাত কাপড়ের নিরাপত্তাহীন সংসারে যে কেবল খুঁড়ে গেছে এক কবি হৃদয়। লাবণ্যের হৃদয় এবং শরীর? নারীর আবার এসব কি ফালতু বায়নাক্কা !

আপনজনদের কাছে এ জগতের সবচে বেশি ভারবাহী হচ্ছে এতিমের ভার। তাই ঝেড়ে ফেলাই দস্তুর। জ্যাঠামশাই যেভাবে ঝেড়ে ফেলেছিল। আমার চাচা কাকারাও সেভাবে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। আমি আলোকিত সময়ের সন্তান। পাশে ছিল আমার মা বোন। লাবন্য গুপ্ত কেবলই ধ্বসে গেছেন। একা। কেবলই ধূসর হয়েছেন। শুষে গেছিল জীবনের সব সাধ। দাহ্য হয়ে উঠেছিলেন। খর চৈত্রে বাংলার শুকনো ঘাসের মত, জলহীন চৌচির পুকুরের মত, হিজলের বনে খা খা রোদ্দুরের মত, অগাধ জ্যোৎস্নায় প্রেমহীন সঙ্গমের ঘৃণ্য শীৎকারের মত।

উত্তরবঙ্গ থেকে আসা সদ্য বিধবা এবং দুটি সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত মহিলাটিকে আমি কড়া গলায় বলি, সাহায্য করতে পারি। কিন্তু---

বলুন আপা। ছেলেমেয়েদের জন্যে আমি সব করব।

স্পষ্ট উচ্চারণ, জীবনের সাথে যুদ্ধে রত প্রত্যয় আর তেজি গলা। এখনও স্বচ্ছলতার জৌলুস লেগে আছে। আমি ওর অনার্স পড়ুয়া মেয়ের এ বছরের সমস্ত খরচ মিটিয়ে দিয়ে নিজে চলার মত একটি চাকরি যোগাড় করে দেব, কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দেওয়া চলবে না। অনেক বছরের ব্যাপার। পারবেন?

হয়ত পারবে। হয়ত পারবে না। সমাজ এবং পরিবারে জ্যাঠামশাই এবং চাচাকাকাদের ত অভাব নেই। তবু একটা স্বপ্ন বুনে দিলাম। সেই স্বপ্ন। আমার মাবাবা বলতেন, ভেঙে যাক। আবার দেখো। ভয় কি মেয়ে।

0 comments:

0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - শঙ্খ ঘোষ

Posted in






বেশ কয়েক মাস হল ঋতবাক তার ব্লগে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে – ক্রোড়পত্র। পাঠকমহলের উৎসাহে আমরা প্রতি মাসের ক্রোড়পত্রে একটি বিষয় বা একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করছি। ফেব্রুয়ারী মাসটা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই মাসের ২১ তারিখটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়, আর তাছাড়াও বাঙালিদের কাছে এইদিনটার একটা বিশেষ মূল্য আছে। আর এই মাসের ৫ তারিখে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলমকার, কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম। এই লেখকের কবিতা, কবিতার ভাষা, ছন্দ বা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ সমকালিন সময়েও আমাদের নাড়া দেয়, উদ্বুদ্ধ করে। এই কবির কবিতা নিয়ে পণ্ডিত মানুষেরা অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। সেইরকম কিছু লেখা, যার মধ্যে আমরা কবি ও মানুষ শঙ্খ ঘোষকে খুঁজে পাব, আমাদের এই প্রতিবেদনে স্থান নিয়েছে। লেখকেরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য। আশা করি এই প্রচেষ্টায় আমাদের পাঠক ঋদ্ধ হবেন। তাঁর কথায়

বাসের হাতল কেউ দ্রুত পায়ে ছুঁতে এলে আগে তাকে প্রশ্ন করো তুমি কোন্‌ দলে
ভুখা মুখে ভরা গ্রাস তুলে ধরবার আগে প্রশ্ন করো তুমি কোন্‌ দলে
পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয় তাকে টেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল




সূচীপত্র

১. মিথ্যা কথা : অনুবাদ বাপ্পা দত্ত
২. শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় : Sankha Ghosh’s Veranda
৩. শ্রাবন্তী ঘোষ : বাবার কথা আবার
৪. সুমিতা চক্রবর্তী : শঙ্খ ঘোষের কবিতা— আবহমান
৫. পল্লববরন পাল : প্রতিবাদী শঙ্খনাদ
৬. হিন্দোল ভট্টাচার্য : আত্মত্যাগের আত্মশক্তি
৭. ফারুক সুমন : শিল্পবোধ, শিল্পের শক্তি
৮. পাতাউর জামান : আমার শঙ্খ ঘোষ





মিথ্যা কথা
শঙ্খ ঘোষ

লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই
দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই।
ঘাটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন-ছুটছে যখন
মায়ের কাছে বাবার কাছে করছি বকম বকম।
হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে
এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে।
“ওমা , দেখো নৃত্যনাট্য” -যেই বলেছি আমি
মা বকে দেয় , “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।”
চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর
আদর করে দেখিয়ে দিলেন পশুরাজের কেশর।
ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী
ঠিক অবিকল সেইরকমই মূর্তি যেন দেখি ?
ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে
“জানিস ? আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে !”
শুনতে পেয়ে দিদিমণি অমনি বলেন “শোন ,
এসব কথা আবার যেন না শুনি কখনো।”
বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব
কিন্তু সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব-
আকাশপারে আবার ও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।


অনুবাদ বাপ্পা দত্ত
Lies

People say I'm quite okay,
in fact a decent child,
Except perhaps I lie at times,
that's all, to put it mild.
Once on a train to Ghatshila,
while chugging on in speed,
And talking with my Mom and Dad,
there's something that I did
See outside the window,
on a field where all the trees
Made choreographed expressions
and swayed with the breeze,
"Oh Ma, see a dance drama",
I murmured in a trance,
"Just stop such flippant comments!",
she scolded me at once.
You must have heard about the zoo, where an uncle showed me,
A grand majestic lion
with his mane flowing free, Within days, back at home on a plaster-peeled wall,
I really saw that same lion with flowing mane and all!
When I said this to Suranjana, a girl in my
class,
That "We have a lion tied up in our home with us",
Our teacher overheard and told me "Make sure,
That I don't get to hear from you such lies anymore!"
I refrain from talking much, this is the reason why,
But what to say, the other day, when I looked up at the sky,
I got overwhelmed, again, for everything it's worth,
I spotted in the autumn clouds –
Rabindranath!


লেখক পরিচিতি - অনুবাদক এবং সৃজনশীল লেখক।





Sankha Ghosh’s Veranda
Sibaji Bandyopadhyay

One of Sankha Ghosh’s major inputs to the study of nitty-gritties involved in the making of poems in Bangla is the introduction of the memorable metaphor, ‘veranda’. It immediately brings to mind a site often used by people to relax; a space relatively free of the stresses of the interior as well as of the anxiety bred by interactions with the risk-prone outside. Sankha Ghosh’s Chander Veranda (‘The Veranda of Metre’; first published: 1971; fifth edition: 1988) provides the fullest explication of the metaphor. In the Foreword, the author alerts the readers that the book is not exactly a treatise on the science of prosody; rather, it delves into the ways by which poets establish personal relationships with various types of metres. In short, the book is about the articulation of poetic sensibility via chanda and vice versa. The emphasis on intimacy both characterizes the metaphor and the poetic habit of the author. There is not a shadow of doubt that Sankha Ghosh is the most influential figure in the arena of contemporary Bangla poetry. Seen in this light, Chander Veranda may well be regarded as an account – albeit, shrouded – of his own poet-persona. But before we try to unpack the term in question, a few words on the fashioning of the grammar specific to modern Bangla poesy are called for.

#

Today’s educated class is constant in lamenting that Bangla does not possess the wherewithal necessary for processing large-scale intellectual improvisations on its own steam. The complaint is: even while Bengalis continue to produce impressive works of art, the most that they can do in the sphere of ‘theory’ is to circulate pale copies of speculations floated by western thinkers. To refute this supercilious dismissal – decidedly, the superciliousness is a mix of colonial inheritance and neo-colonial purchase – a look at the history of modern prosody would be sufficient. Anyone reflecting on the building blocks crucial to the crafting of a Bangla poem is bound to realize that no sense can be had by transcribing them in terms of the structural apparatus native to either Sanskrit or English. No! Nānyah panthā vidyate—there is no other way but to be self-reliant if the inquirer wishes to offer a verifiable hypothesis apropos metrical variations in Bangla in tandem with the language’s peculiarities of pronunciation, punctuation, accent, diction, etc. The longing to identify and tabulate the rules buried in the recurring patterns of Bangla poetry went on to intensify in the twentieth century. Probodhchandra Sen (1897-1986) was one of the preeminent pioneers of this perilous venture. It was as if, along with others, he was seized by a sense of urgency to set up an original prosody suited to the linguistic temperament of Bangla. And, the impetus for that urgency came from Rabindranath Tagore (1861-1941)—the poet who was ceaseless in devising teasing techniques to his dying day. To make the matter more exciting, Rabindranath also lent hand in resolving the puzzles posed by him. After a protracted tussle between various grammarians and a series of false starts, a consensus was reached. And, it revealed, contrary to the received wisdom, it was not embarrassment of poverty but that of riches which distinguished the metrical universe of Bangla. Poems designed in accordance with the principle of regular interval could be grouped within, not one, but three distinct paradigms. One of them was qualitative in nature, and the other two, quantitative. While the qualitative depended on stressed syllables, the quantitative did so on morae or syllable-weights. Going by rhythmic arrangement, the three paradigmatic constructs were: the ‘syllabic’ (qualitative), the ‘simple moric’ and the ‘mixed moric’ or ‘composite’ (quantitative).

#

Doubtless, the Composite is the junction at which the traffic is thickest. Given its capacity to hold light as well as heavy syllable-weights in the same foot, the ability to withhold the foot-wise internal breaks by varying means, modifying thus the measure of silence, the flexibility to be both distant from and proximate to everyday speech, the Composite had long established suzerainty in the sphere of verse-making. Just as in the pre-modern days it still enjoys enormous patronage. However, the practice of composing poems in mixed moric underwent a sea-change when Michael Madhusudan Dutt (1824-1873) put a stop to the monotony of end-stopping typical to the pre-modern Composite. The achievements of Michael’s blank verse were indeed spectacular: by initiating enjambment or incomplete syntax, it paved the way for the meaning to run over from one line to the next without terminal punctuation; by dealing a deathblow to the artificiality of having a full caesura at every line-break, it allowed for natural pauses to occur wherever one willed; while being mathematically exact in rhythmic scheme, it completely dispensed with the burden of rhymes, the correspondence of sound between words at the ends of lines. The revolution wrought by Michael was to have an immense impact on subsequent poets. In contrast to the ‘mixed moric’, the employment of the ‘syllabic’ was rather restricted during the pre-modern as well as early modern era. Although, stalwarts like Ramprasad Sen (? 1720-? 1781), Lalan Fakir (? 1774-? 1890) put it to use in their songs with great effect, the ‘syllabic’ was generally reserved for the sonic merriment of children or for caustic satirical purposes. And, except for stray instances, the ‘simple moric’ was conspicuous by absence then. Due to the efforts of a number of illustrious poets, the radical potentials implicit in Michael’s blank verse were increasingly concretized. But, we had to wait till the early twentieth century, to be precise 1914, before the trick of enjambment could be thoroughly internalized. Almost in conjunction with the attainment of expressive apex in the field of ‘mixed moric’ caesuras, the ‘syllabic’ became robust enough to encompass adult-like serious utterances. And, as though all of a sudden, the ‘simple moric’ was invented in late nineteenth century, its four sub-divisions meticulously defined and continually developed. It is extraordinary but nonetheless true that the credit for all these goes to one man, Rabindranath Tagore. Moreover, not content with working within the parameters of fixed metrics, Rabindranath gave a finished shape to yet another model during the third decade of twentieth century. Emboldened by the almost-instant international success of his English Gitanjali (1912), the collection of prose-poems fashioned by him, Rabindranath began experimenting with poetry set in prose in Bangla in the early twenties. Finally, managing to shake off all shackles of regularity, he, almost single-handedly, brought prose-poetry with all its refinements to the shores of Bengal. All the same, it is towards this same Titan that Sankha Ghosh raises a finger of accusation in Chander Veranda.

#

The performative function of ‘veranda’ is to configure a special kind of spatial ordering. It occupies some place in between the two other implied metaphors—the ghar or ‘home’ and the bahir or ‘(outside) world’. Located within the boundaries of the ‘home’ are those poems which abide by the dictates of metrical symmetry laid down by either the charter of the ‘syllabic’ or the ‘simple moric’ or the ‘mixed moric’. The ‘world’, on the other hand, promises liberty from moving along previously settled tracks—marks as it does unfettered prose-poetry, the ‘world’ sends out the call to renounce ‘home’ and take to the roads. In Chander Veranda, as is proper, Sankha Ghosh is profuse in his praise of Rabindranath—he cannot but marvel at the artistry and skill of the man who made the ghar habitable in every sense of the word and then took the risk of jumping on to the treacherous bahir. He has no trouble in admitting that it was the drive to tackle the ceaseless tension between rhythmic verse and ordinary locution which had impelled Rabindranath to opt for the bahir. Nevertheless, despite his admiration for Tagore’s astonishing daring, Sankha Ghosh finds Tagore’s ‘leap’ into the free-floating a bit problematic. Of course, as to be expected, Rabindranath did fabricate a great number of outstanding poems in the realm of prose-poetry. But, it is also indisputable that in his bid to break asunder limit-bound verse-schemes, Rabindranath often fell prey to slackness that led to no more than ponderous speechification. This fault – a fault signifying the failure to cover the distance between verse and prose in a meaningful manner – is the reason why while amateurs felt empowered to freewheel, many seasoned poets rejected prose-poetry in all shape and form. For Sankha Ghosh, the double-bill of abundance and withdrawal is, in truth, symptomatic of a lack—it points to the fact that in spite of rapidly garnering four fully-accomplished paradigms, save for occasional miscarriages, modern Bangla has missed upon conceiving a fifth possibility.

#

‘Veranda’ thus implies a phase that has been skipped, the unbuilt bridge which could have connected ghar with bahir as well as bahir with ghar. Refers as it does to ‘free verse’ or vers libre, the metaphor is indeed an apt and nifty one. Along with insisting that free verse constitutes a gaping gap in Bangla, Sankha Ghosh remarks that even in its highly systematised prosody the very concept of vers libre has remained hazy. In French the difference between vers libre and vers libéré, i.e., the kind of poetry which maintains rhyme but eschews classical rules apropos rhythm, is clear. Sankha Ghosh readily grants that like Bangla, English too has more or less failed to theoretically cognize upon the distinctive quality of vers libre—and, in both cases, this has resulted in discussions in which vers libre and vers libéré get confusingly intermingled. So, how does one visualize the ‘veranda’?

#

There is no denying that a degree of instability is intrinsic to ‘free verse’. And, adding to the difficulty of grasping its essence, that inbuilt instability is quite ineffable. For, those who deal in vers libre tend to cut into time a form which is unadorned by consistent metre, rhyme or other procedures of musical pattern and is yet so rhythmic as to stylistically imitate natural speech. Vers libre is neither ‘closed’ like poems in which every foot resonates with unvaryingly even beats nor is as blatantly ‘open’ as prose-poems. The ‘openness’ that ‘free verse’ strives to achieve is a product of delicate blend and balance of the two opposites. What concerns it most is cadence—addressing more to the ear than the eye, it aspires for cadence premised upon the rhythm of the speaking voice. Sankha Ghosh is firm in holding that mesmerized by Tagore, the modern practitioners have generally ignored vers libre—sure, there are some examples of the fifth paradigm but they are far too few. He opines, the problem becomes even graver if we take notice of a profound Tagore-essay written in 1934. Therein Rabindranath had categorically demonstrated that an in-between schema was latent in the language, waiting to be extracted by some bold adventurer. And then, wonder of wonders…

#

In one of the essays included in Chander Veranda – incidentally, it was written in 1961, the year of Tagore’s hundredth birth anniversary – Sankha Ghosh not only quotes verbatim a long passage from the 1934 Tagore-essay, he goes even further. He leaves behind Rabindranath’s poetry and turns to Rabindranath’s songs, Rabindrasangit. And that proves to be an awakening of sorts. Sankha Ghosh discovers that Shyama (1939), the last dance-drama, in fact, the last play composed by Tagore, contains far too many poems which are ‘loose’ in structure. The sheer number of such instances almost compels Sankha Ghosh to concede that they are far from being scattered examples of vers libre—instead, they stand witness to a conscious design; the very organizing principle of Shyama rests upon vers libre! Forced to partly qualify, literally repudiate his earlier grievance regarding Tagore’s inattention towards ‘free verse’, Sankha Ghosh concludes, what he could not flaunt in poetry, Rabindranath let it enter through the backdoor of music. Curiously, in case of Rabindranath, the full-fledged appearance of vers libre – a form catered to contrive rhythmic speech by explicitly avoiding musical patterns – was facilitated by melody!

#

So, who occupies the seat of fame in Sankha Ghosh’s veranda? Although, he takes on the tantalizing role of the King of Dark Chamber as far as vers libre is concerned, that person is Rabindranath, the Maestro of Metres. Sankha Ghosh closes his 1961 essay by pleading with modern poets in search of ‘natural speech’ to take cues from Rabindrasangit, in particular, Shyama. All said and done – besides inaugurating a scintillating discourse on vers libre – Chander Veranda gives us a glimpse of the hide-and-seek game Sankha Ghosh plays with Rabindranath. And, that intimate yet intense dramatic monologue, in turn, affords ample clues for the understanding of Sankha Ghosh’s personal poetic ventures…

Reprinted from:

Word & Truth: Reading Sankha Ghosh, Ed. Angshuman Kar, Bolpur: Birutjatio Sahitya Sammiloni, January 2020


লেখক পরিচিতি - শিবাজী বন্দোপাধ্যায় – অধ্যাপক এবং বহুমাত্রিক লেখক।




বাবার কথা আবার
শ্রাবন্তী ঘোষ

কিছুকাল আগেই বাবার কথা লিখেছিলাম বেশ কিছুটা, যেমন আমার মনে হয়। কথার তোড়ে এমন লিখেছিলাম সেখানে যে, আমার বাবার কবিতাকৃতি, গদ্যসৃজন, অধ্যাপনা—এই সবগুলিই তো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিশিষ্ট, কিন্তু আমার মনে যেন বাবার অধ্যাপক-সত্তাটিই উজ্জ্বলতম। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা বাবার ক্লাসে বসেছেন কোনো না কোনো সময়ে তেমনই একজন, আমার সমবয়সী বাবার ছাত্রী কয়েকদিন আগেই বলছিলেন: ‘‘তোমরা বাড়ির লোকেরা একটা বিষয় স্যারের কাছে পাওনি, সেটা হল ক্লাসের পড়া। আমরা এ-বিষয়ে খুবই ভাগ্যবান। যেভাবে ‘রক্তকরবী’-র পাঠ আমরা পেয়েছি, সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা আমাদের।’’ তখন আমার মনে হল, আমিও জানি। আমাকে বাবা যখন পড়িয়েছে ‘গান্ধারীর আবেদন’ কিংবা সাহিত্যের ইতিহাস কিংবা অলঙ্কার আর ব্যাকরণ, এমনকি কান্ট-এর দর্শন, তখন যে-কোনো ছাত্র-অধ্যাপক সম্পর্কই তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে। আমার ছাত্রজীবনে যেসব শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে আমি পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে কেউই যে আমার অতিপ্রিয় হয়ে ওঠেননি, আজ বুঝতে পারি, তার কারণ বাবাকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া। বাবার কাছে যা শিখেছি, আজও বোধহয় ঠিক ঠিক ছবি হয়ে জেগে আছে আমার মনে। কিন্তু তবু, বাবার অধ্যাপক সত্তাটিই ‘উজ্জ্বলতম’ আমার কাছে, সেরকম কি সত্যিই বলা যায়?

শিক্ষক-অধ্যাপক হিসেবে বাবার যে মোহ আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে, তারই পাশ দিয়ে সমান্তরাল পথেই বয়ে চলেছে বাবার ছড়ার ছন্দের কারুকার্য। সেগুলিই আমার মনে আলোড়ন তোলে খুব। আমি আবাল্য জানি, বাবা ছন্দশিল্পী, ছন্দেই বাবার হাঁটাচলা, ছন্দেই ওঠাবসা। যে-কোনো বাঙালির মতো আমরা, বাবার কাছাকাছি থাকা ছোটরা, মাঝে মাঝে খুব চেষ্টা করেছি ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখার। কিন্তু বাবা যদি দেখে ফেলে তবে সেসব ছড়ায় ঠিক আরো সৌন্দর্য জুড়ে যায়, সেটি হয়ে ওঠে বিশিষ্ট একটি ছড়া। আমার ছয়-সাত বছর বয়সে বন্ধু সবিতাকে নিয়ে একটা ছড়া লিখব ভাবছিলাম। লিখে রেখেছি, ‘শোনো ভাই সবিতা/লিখছি একটা কবিতা/কী যে লিখি পাই না ভেবে/তুমি মনে এনে দেবে?’ এই রকম বোকার মতো কয়েকটা লাইন লিখে রেখেছি খাতায়। পুরো হচ্ছে না কিছুতেই। হঠাৎ দেখি বাবা দেখতে পেয়ে খাতায় লিখে রেখেছে, ‘বলে আমি যা ভেবেছি/লিখে ফেললাম সবই তা’। ‘সবিতা’-র সঙ্গে বাবা মিলিয়ে দিল ‘সবই তা’! আমার লেখা বলে আর দাবি করিনি এই ছড়াটাকে এবং পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চমৎকৃত হয়ে এটা মনে রেখেছি শুধু। ‘জন্ডিসে’ শব্দের সঙ্গে বাবা মিলায় ‘বন্দী সে’, ‘মূর্ধন্য’-র ‘ধন্য’ অংশের সঙ্গে মেলে ‘কোন্‌ ন’।

জন্ডিসে
বন্দী সে
আর তার বাবা।

আমার পাঁচ বছর বয়সে “খুকুমণির ছড়া” উপহার দিয়ে তাতে এটা লিখে দিয়েছিল বাবা আর ‘দন্ত্য ন-মূর্ধন্য ণ’-এর গণ্ডগোল করি বলে আমাকে একটা চিঠিতে লিখেছিল,

ধন্য ধন্য হে মূর্ধন্য,
তোমাতে এখন বসাই কোন্‌ ন?
এত যে ঝামেলা কিসের জন্য!
ধন্য ধন্য হে মূর্ধন্য।

বিস্ময়স্পৃষ্ট হয়ে আর ছন্দোবন্ধনে বেড়ে উঠতে থাকি আমরা। গল্পে শুনি, দেবেশকাকুর (শ্রী দেবেশ রায়) সঙ্গে হঠাৎ বিয়ে হল কাকলিকাকিমার (শ্রীমতি কাকলি রায়)। একটা বই উপহার দিয়ে বাবা তাতে লিখে দেয়, “দেবেশ তো বেশ!” আমার শ্রুতি ঝন্‌ঝন্‌ করে, এই আবেশ নিয়েই চলাফেরা, বড়ো হওয়া।

বড়ো হতে হতে দেখি, সমকালীন খ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা বাবার এই ছন্দ-প্রজ্ঞায় বেশ আস্থাশীল। একবার নীরেনজ্যেঠু (শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) এসেছেন আমাদের বাড়ি। আমি তখন, বাবারই শিখিয়ে দেওয়া পথ চলে, খুবই আগ্রহী এক অটোগ্রাফ-শিকারী। নীরেনজ্যেঠুকেও জোরজার। আমার খাতায় লিখে দিলেন,

ব্যাঘ্র বলে, ‘হালুম’!
শ্রাবন্তী কয়, ‘আওয়াজ থেকেই মালুম
দন্ত নেই তোমার।
নাহলে এখন গলা ফাটিয়ে চেঁচাও কেন আর?
এখন তোমার গর্জনের
কিছুই তাৎপর্য নেই।’

শেষ লাইন দুটি লিখে আমার খাতা আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন: ‘বাবাকে দেখিও ছন্দ-মিল ঠিক হল কিনা! তোমার বাবার মতোই চেষ্টা করলাম!’ জানি, এ-তো তামাশাই। তিনিও মহা-সৃষ্টিকার, ছন্দের যাদু তাঁরও হাতে, কিন্তু ওই সময়ে (১৯৭২-৭৩ সাল হবে), ‘এখন তোমার গর্জনের/কোনোই তাৎপর্য নেই’ এই রকম অন্ত্যমিলের জন্য বাবার রেফারেন্স মনে করছেন তিনি, এইটা লক্ষ করেছিলাম আমি।

আমার যখন নয়-দশ বছর বয়স, সুচিত্রা মিত্রের রবিতীর্থ গানের স্কুলের নীচু ক্লাসে রবীন্দ্রসঙ্গীত থিয়োরি পরীক্ষায় একবার তাল-ফাঁক দিতে বলা হয়েছে “বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর” কবিতায়। অনেক সতীর্থ ঘাবড়িয়ে গিয়েছে, ভাবছে কবিতায় আবার তাল-ফাঁক কেন! আমার ঘাবড়ানোর কিছুই নেই, কারণ তার আগে বাবার কাছে বসে সম্‌-ফাঁক দিয়ে কত ছড়া-কবিতাই তো পড়েছি! “সহজ পাঠ”-এর সেই “কাল ছিল ডাল খালি” থেকে শুরু। চার/চার ছন্দ? নাকি তিন/তিন? (মানে কবিতায় যেটা ছয়মাত্রার ছন্দ, গানের তালে সম-ফাঁকে তিন/তিন।) দুইভাবেই পড়তে কী মজা! সই সংগ্রহের আর-একটা গল্প মনে পড়ে। অলোককাকুও (শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত) সুন্দর এক ছড়া লিখে দিয়েছিলেন আমার সই সংগ্রহের খাতায়।

......

হোস্‌ যেন তুই
কস্তুরি জুঁই,
সরল হিরণ
ভোরের কিরণ।
এই খোলা চিঠি
লিখে, লক্ষীটি,
লিখি একফাঁকে,
ভুলো না আমাকে।

কাগজে এই কবিতাটা কপি করে তালের যতিচিহ্ন বসিয়ে দৌড়ই বাবাকে দেখাতে, ঠিক হয়েছে কিনা।

ছোটদের আবিষ্ট করা লেখা তো বাবা অনেকদিন ধরেই লিখেছে। “আনন্দমেলা”-য় প্রকাশিত হতে থাকে সেগুলি ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে, আমার বোন যখন শিশু। আর এই সঙ্গেই শুরু হল বাংলা ছড়ায় অন্ত্যমিলের একটা নতুন খেলার ধারা। ‘মূর্ধন্য’ আর ‘কোন্‌ ন’, ‘জণ্ডিসে’ আর ‘বন্দী সে’—এই ভাঙা অন্ত্যমিলের খেলা তখন থেকে বাবার রচনায় জমজমাট! তৈরি হচ্ছে: ‘গন্ধমাদন পর্বতে/ফলত নাকি বরবটি?’ কিংবা ‘লঙ্কাতে কি হিঞ্চে নেই?/ওসব ওজর শুনছি নে।’ বা ‘রেকর্ড হল সোবার্সের,/একশো করল কাবার সে।’ এই ধরনের মুক্ত মিলের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বলে আমার মনে হয় ‘সূয্যি নাকি সত্যি নিজের ইচ্ছেয়/ডুব দিয়েছে সন্ধে হল দুচ্ছাই।’ এই ছড়াটি।

ছড়ার ছন্দের আবার একটা নতুন স্রোত এল ১৯৮৯-এর পর, আমার মেয়ে আমনের জন্মের পর। সকলেই জানেন, ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় ‘আমনধানের ছড়া’, ১৯৯৬ সালে ‘আমন যাবে লাট্টুপাহাড়’। আমার বোনের মেয়েরা শাম্পান-মন্মন জন্মানোর পর ২০০৩-এ ‘ওরে ও বায়নাবতী’, ২০০৭-এ ‘আমায় তুমি লক্ষ্মী বলো’। আমাদের বাড়ি তখন ছড়ায়-ছন্দে বিভোর হয়ে থাকে। বড়ো হতে হতে আমনও তখন দাদুতে মুগ্ধ, দাদুকে পরীক্ষা করে, দাদু কি রোজ-রোজ ছড়া লিখতে পারে? তার রোজ একটা করে ছড়া চাই। আমরাও স্তম্ভিত হয়ে দেখি, ভোরবেলা সে স্কুলে যাওয়ার আগে কমবয়সী গাড়িচালক আমনের বাপিকাকুর হাতে বাবা একটা করে ছড়া পাঠায়!

একখানা সাদা পাতা, নীল লেখা তাতে
রোজ যেন বাপিকাকু নিয়ে আসে হাতে।
কথা শুনে বসে পড়ি গালে হাত দিয়ে
রোজ রোজ ছড়া লেখা—সম্ভব কী এ?
সহজেই ভুলবে সে বান্দা না ও যে
পথেঘাটে ছুটি তাই ছন্দের খোঁজে।

জলপাইগুড়িতে আমার মামাবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে বাবা-মা। আমার মামার ছোট্ট নাতি বেবে চ্যালেঞ্জ করে বাবাকে, “এই যে একটা গোলাপ, এটাকে নিয়ে বলো তো একটা ছড়া!” ঘন্টাকয়েক। তারপরে তৈরি হয়,

তাই না শুনে সোনাদাদুর
বুক করে ধড়ফড়—
গোলাপ নিয়ে গল্পলেখা?
‘আচ্ছা, একটু পর।‘

......

গোলাপ বলে ‘এখনো কি
বুঝতে পারো নি তা?
আজ সকালে ঝরেই আমার
বদলে গেছে ভিটা।
সামনে তোমার চেয়ে দেখো
একটু দেখো ভেবে
গোলাপ হাতে গোলাপ হয়ে
উঠেছে আজ বেবে!’

আমন দেয় আরো কঠিন কঠিন চ্যালেঞ্জ। “ ‘এক যে ছিল রাজা/তার ছিল এক ছাগল’—মেলাও তো এর পর!” অমনি সম্পূর্ণ হয় ছড়া,

রাজার কি আর ছাগল থাকে?
আমন একটা পাগল।
চুপ করো তো—জানো না যা—
এই রাজা তো রাখাল রাজা
মাঠে মাঠেই ঘুরে বেড়ায়
কোত্থাও নেই আগল
একদিকে তার গরুবাছুর
আর-একদিকে ছাগল।

কিংবা, “ ‘এক যে ছিল রাজা/তার ছিল এক জুতো’—মেলাও মেলাও, ছন্দ মেলাও।” তৈরি হল,

একটা তো না, ভুল বলেছি
দু-পায়ে ছিল দুটো।

এরই মধ্যে কখনো-কখনো দেখি ছোট্ট শ্রীজাত, মন্দাক্রান্তা, সন্দীপন বাবার কাছে এসে শান্তভাবে পাঠ নিচ্ছে ছন্দের। ‘মন্দাক্রান্তা’ ছন্দ নিয়ে চলছে মজার খেলা। প্রত্যেককে নিজের মতো করে ‘মন্দাক্রান্তা’ ব্যবহার করে কবিতা লিখে আনতে বলেছে বাবা। ওরা লিখে আনলে শুধরে দিচ্ছে যত্ন করে।

কবিতার আবৃত্তিও বাবার কাছেই শিখতাম ছোটবেলায়। সহজভাবে, কথার অর্থ বুঝে, স্বচ্ছন্দে, ছন্দ-সহযোগে,নিজের মতো মন দিয়ে কবিতা পড়তে শিখি। কণ্ঠস্বরে যেন কোনো কৃত্রিমতা না থাকে, অকারণ উচ্চাবচতা যেন না থাকে, এসব শিখেছিলাম। একবার—তখন ক্লাস সেভেন আমার। কবির কন্যা, তাই নিশ্চয়ই আবৃত্তি করতে পারি ভেবে দিদিমণিরা বললেন, রবীন্দ্রনাথের ‘শঙ্খ’ কবিতাটি তৈরি করে আসতে হবে পরদিনই। একটা অনুষ্ঠানে বলতে হবে সেটা। চিরকালই আমার পারফর্ম্যান্স-ভীতি। আবৃত্তি তার আগে মোটেই তেমন করিনি কখনো। ভয়ে এমন বিবশ যে বাড়ি পৌঁছে ভুলেই গেলাম কী কবিতা শিখে আসতে হবে! বাবার কাছে বসে, রচনাবলী উল্টে-পাল্টেও মনে এল না কোন্‌ কবিতা শিখতে হবে! তখন তো টেলিফোনও থাকত না বেশির ভাগ গৃহস্থের। কী করব! কান্না থামিয়ে বাবার ঠিক অরে দেওয়া একটা কবিতা শিখলাম,

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া—
রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’।

মাইক হাতে পরদিন পারফর্ম্যান্স এবং দারুন নাকি বললাম! বাবার শিখিয়ে দেওয়া, ভালো তো হবেই! এখনকার খ্যাতনামা সমাজকর্মী আর কথাশিল্পী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় আমার সিনিয়ার দিদি, খুবই ভালোবেসে ফেলল আমায়। শুধু ইংরেজি পড়াতেন আমার এক প্রিয় দিদিমণি রাধাদি, জনান্তিকে বললেন, শ্রাবন্তী এত ভয় পেয়েছিল যে ভুলে গেছে ‘বাপের নাম’। কিন্তু এই গল্প বলার একটা অন্য উদ্দেশ্যও ছিল আমার—আবৃত্তি শেখার গল্প। উচ্চকিত কণ্ঠে নয়, নিজের আরোপিত কোনো নাটকীয়তা নয়, কবিতা পড়তে হয় সাবলীলভাবে। ঠিকমতো উচ্চারিত হলে কবিতা তার শব্দে-বাক্যে-অর্থে আপনিই পৌঁছে যায় শ্রোতার কাছে—এইটেই আমরা সবসময় শিখেছি বাবার কাছে। ছোটবেলায় কাজ দিত বাবা, ছুটির মাসে রোজ রচনাবলীর একটি কবিতা মুখস্থ করতে হবে। দেখতাম অর্থ বুঝে বা ছন্দ-মিল বুঝে পড়লে তা বেশ মনে থেকে যায়। আর আশ্চর্য যে, বাবার কাছে শেখা রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি বোধহয় আজও স্মৃতি থেকে বলতে পারি। প্রসঙ্গত, ‘তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে কেমন করে সইব’ (‘শঙ্খ’ কবিতা) এটিও আমাকে মুখস্থ করে পড়া দিতে হয়েছিল বাবার কাছে, ওই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই।

রবীন্দ্রনাথ কোন্‌ বাংলায় কবিতা লিখতেন? তদ্ভব-তৎসম শব্দই কি তাঁর বেশি ব্যবহার? তিনি কি সংস্কৃত-ঘেঁষা কবিতার ছন্দ পছন্দ করতেন? রবীন্দ্রনাথকে আমরা তেমন ভাবি না। আমরা জানি যে তাঁর হাতেই সূত্রপাত আজকের সাম্প্রতিকতম বাংলা ভাষার। কিন্তু তাঁর যেসব রচনা তদ্ভব-তৎসম শব্দপ্রধান, সেগুলিতে তিনি চেয়েছেন হ্রস্ব স্বর/দীর্ঘ স্বর-এর পার্থক্য রাখতে। অর্থাৎ ‘অহরহ’ যে মাত্রাবিভাগে উচ্চারিত হবে, ‘প্রচারিত’ সেই মাত্রাবিভাগে নয়। ‘অহরহ’-র চারটি মাত্রা, আর ‘চা-রিত’ চারটি মাত্রা, ‘প্র’ একটি আলাদা মাত্রা। কোন্‌ কবিতা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। বাবার কাছে ‘জনগণমন’ পূর্ণ কবিতাপাঠ-শিক্ষা আমার মনের মধ্যে একটা মূল্যবান সম্পদ হয়ে আছে।

ঘো-র তিমিরঘন নিবিড় নিশী-থে
পী-ড়িত মূ-র্ছিত দে-শে-
জা-গ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল
নত নয়নে- অনিমে-ষে-
দুঃস্বপ্নে- আ-তঙ্কে-
রক্ষা- করিলে- অঙ্কে-
স্নে-হময়ী- তুমি মা-তা-

অর্থাৎ, আ-কার, এ-কার, ঈ-কার থাকলে একটা মাত্রা বেশি সেখানে পড়তে হবে, দীর্ঘ স্বরের খেলা।

একটা দিগন্ত যেন খুলে যায় আমার বারো-তেরো বছর বয়সে।
ছন্দে-ছন্দে ব্যাকরণও মুখস্থ হয় কতো সহজে!
প্রপরা-পসমন্বব নির্‌দুরভি
ব্যাধি সূ-দতিনিপ্রতিপর্যপয়ঃ
উপআং ইতি বিংশতিরে-ষু সখে-
উপসর্গ বিধি ইতি কথিত কবিনা।

কুড়িটি উপসর্গ এই ছন্দোবন্ধনে ধরা থাকলে মনে রাখার কী কষ্ট! ছন্দ তো করেই দিয়েছেন বৈয়াকরণ। কিন্তু সকলে কি সে ছন্দে মন দেন? আমাদের মন না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। ‘প্রপরা’-র ‘রা’-এর পর এক মাত্রা না টানলে ‘সূদতি’-র ‘সূ’ দুই মাত্রায় না পড়লে কিম্বা ‘প্রপরা’-র ‘রা’-এর ওপর আর ‘সমন্বব’-র ‘ম’-এর ওপর তালের ঠেকা না পড়লে তো এর যথার্থ ছন্দ হবেই না! ফলে সেইভাবেই পড়তে হবে। এটা কি সকলে শেখেন? কারক-বিভক্তির পড়া তৈরির সময় ‘প্রত্যনুধিঙ্‌নিকষান্তরান্তরেণযাবদ্ভিঃ’ নিয়েও কত মজা! এটা কি ঢাক আর কাঁসরঘন্টা বাজার সুরে বলব? নাকি কাউকে যেন ধমক দিচ্ছি জোরে-জোরে এই সুরে বলব? মজায়-মজায় শক্ত কথাও মনে থেকে যায়।

যে-কোনো উপলক্ষ্যে নাতনিদের ছড়া-কবিতা উপহার দেওয়ার কাজ তো আছেই বাবার। এ-বছর অষ্টাদশী হল মেজোজন আর চতুর্দশী ছোটটি।

অষ্টাদশীর কবিতাটি এইরকম—

গ্যোয়েটে যা বলেছেন—রবীন্দ্রনাথেও যেটা আছে:

‘আমি একা আঠারো না, আজ যেন সবাই আঠারো।
নতুন জীবন যেন ভেসে আছে আকাশে বাতাসে’—
আমিও যদি তা বলি, আমাকে কি দোষ দিতে পারো?
আর আমি কিশোরী না, আজ আমি একান্ত নবীনা
প্রতিদিন প্রতিরাত্রি আমারই নিজস্ব অধিকার
নিজেরই মনের মতো এ-পৃথিবী ছুঁতে পারি কিনা
আজ সে পরীক্ষা হবে—সামনে নেই কোনোই প্রাকার

মা-কে শোনাবো বলে আমি জোরে পড়তে গিয়েছিলাম কবিতাগুলি। মন্মন-এর জন্য ছড়ার ছন্দে লেখা ছড়াটি তো বেশ পড়লাম। কিন্তু শাম্পান-এর মানে অষ্টাদশীর জন্য লেখাটা কীভাবে পড়ব? মনে মনে আউড়ালাম। একটুখানি সময় লাগল পয়ার ছন্দ বুঝতে! তারপর শোনালাম মা-কে। এই অসামান্য কবিতাটির ছন্দবিভাগ দেরি করে বুঝেছি যে, সেই গল্পটা আবার বলতে গেছি বাবার কাছে! বাবা শুনে গম্ভীর গলায় বলে: “শুধু ছড়ার ছন্দই পড়তে জানো! অন্য ছন্দ জানো না?” এইরকম ধমকেই তো বেড়ে ওঠা! ফলে অসুবিধা নেই। কিন্তু সত্যি কথা না বলি কী করে! সব কিছু ছাপিয়ে আমার কানে ঝমঝম করে বাবার রচনার ছড়ার ছন্দই। মনে পড়ে যায়, বাবা কেমন আঙুল বা হাত নাচিয়ে, কখনো বা পুরো শরীরেই ছন্দ এনে আমাদের সঙ্গে ছড়া-কবিতা বলত মনের আনন্দে। আঙুলের সেই তুড়ি দেখতে পাই ছড়া পড়তে গেলেই—

সূ্য্যি নাকি সত্যি নাকি নিজের ইচ্ছেয়
ডুব দিয়েছে? সন্ধে হল? দুচ্ছাই!
আকাশ জুড়ে এক্ষুণি এক ঈশ্বর
চমকে দেবেন লক্ষ রঙের দৃশ্যে
..............................

মা বলবে ঠ্যাং দুটো কি কুচ্ছিত
একগঙ্গা জল দিয়ে তাই ধুচ্ছি

অথবা

সকাল থেকে কপাল ঠুকে যতই করুক প্রার্থনা
যে-কাজটাকে ধরবে ভাবে কোনোটাই সে পারত না
না-পারা তো নিজেই পারি
প্রার্থনা আর কী-দরকারি!
এ-যুক্তিতে তারপরে আর করত না সে আর্তনাদ।

কিম্বা

বন বন বন বনান্ত
ঘোর ছমছম সন্ধ্যাবেলায়
এই পথে আর কে আনতো
........................

চম্‌ চম্‌ চম্‌ চমৎকার
এখন একটু খেলে কী হয়
এই ব্যাপারে কী মত কার?

উনিশশো বাহাত্তর-তিয়াত্তর সাল থেকে এই অর্ধমিল (ইংরেজিতে যাকে বলে half rhyme) নিয়ে লেখা বাবার ছড়াগুলির প্রকাশ শুরু হয়। বাবা বলে এর আগেও আরো লিখেছে এমন ছড়া, প্রকাশ করেনি কেউ, কোথায় হারিয়ে গেছে সে-সব! নীরেন জ্যেঠুর সম্পাদনায় ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায় যদি-না প্রকাশিত হত এইসব ছড়া, বাবা ভাবে তাহলে ছড়া লেখা হতই না আর! আমার মনে আছে, প্রতি সংখ্যার লেখার জন্য নীরেন জ্যেঠু তাগাদা দিতেন আর বাবা অবধারিতভাবে দেরি করত। বিরক্ত হয়ে একবার এক পত্রবাহকের হাতে চিরকুট পাঠালেন তিনি, “ ‘আনন্দমেলা’-র লেখাটা গতকাল চাই”। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্ধ-মিল শুধু ছড়াতেই ছিল না বাবার, ছিল পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কিংবা ষাটের দশকে প্রকাশিত ‘নিহিত পাতালছায়া’ বইয়ের কবিতাতেও।

প্রাণধারণের দিনযাপনের গ্লানি? নাকি তারা হর্ষ?
একটি ধানের শিষের উপর
গোটা জীবনের ভরসা
কবন্ধ মাঠ, ধান খেয়ে গেছে বুলবুলি আর বর্গি
অগত্যা তুমি শ্রীযুধিষ্ঠির—
মহাপ্রস্থান স্বর্গে (“পলাতকা”, ‘দিনগুলি রাতগুলি’)
......

আমায় বেছে-বেছে বরণ করেছিল
বিশ্ববিধাতার একটি দুরাশা।
এখন দেখছি তা কিছুই পূর্ণ না
বয়স যদ্যপি মাত্র বিরাশি।
সফল কীর্তি তো আঙুলে গোনা যায়:
বসতিনির্মাণ, বংশরক্ষা;
তাছাড়া ছিল বটে অন্ধকার ঘটে
সিঁদুরচিহ্নের মতম সখ্য। (“অন্তিম”, ‘নিহিত পাতালছায়া’)

‘ছন্দের শুকনো নিয়ম’ ভেঙে ফেলে ‘পদ্যছন্দের ঘর’ থেকে ‘গদ্যছন্দের পথে’ বার হওয়ার মাঝখানে যে ‘বারান্দা’-টুকুর কথা বাবা নিজেই বলেছিল, মনে হয় যেন অন্ত্যমিলের এই নতুন জাদুখেলায় বাঁধা ছড়াগুলিও আমাকে তেমনই এক বারান্দাতেই এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যখন ‘ইচ্ছেয়’-র সঙ্গে মিলে যায় ‘দুচ্ছাই’, ‘ঈশ্বর’-এর সঙ্গে ‘দৃশ্যে’, ‘চমৎকার’-এর সঙ্গে মেলে ‘কী মত কার’।

জানুয়ারি,২০২০

লেখক পরিচিতি - শ্রাবন্তী ঘোষ :অধ্যাপক 




শঙ্খ ঘোষের কবিতা— আবহমান
সুমিতা চক্রবর্তী

শঙ্খ ঘোষ একই সঙ্গে স্বাধীনতার উত্তরকালের এক প্রতিনিধি-কবি এবং স্বতন্ত্র কবি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলা কবিতার ধারায় পরিবর্তন এসেছিল। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-অন্তে স্বাধীনতার স্বাদ যখন ছড়িয়ে গেছে সমাজজীবনে এবং মনের ভিতরের স্তরগুলিতেও তখন সাহিত্যে তার স্বাক্ষর উৎকীর্ণ হবে বর্ণমালায়— এ-ঘটনা নিতান্তই স্বাভাবিক।

বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে ছিল এক অতিরিক্ত দহন, অতর্কিত এক অস্তিত্ব-সংকট। স্বাধীনতার শর্তরূপে ভারত যখন ভাগ হল তখন দেশের দুই প্রান্তে যে দুটি রাজ্যের উপর দিয়ে বিভেদের রক্তরেখা টানা হয়েছিল সে দুটি রাজ্য হল পাঞ্জাব এবং বাংলা। পূর্ববাংলার হিন্দু অধিবাসীরা দীর্ঘকালের ভিটে-মাটি ছেড়ে বাস্তুহারা হয়ে চলে আসতে বাধ্য হলেন পশ্চিমবঙ্গে। নতুন করে শুরু হল তাঁদের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম। সামাজিক পরিবর্তন যেখানে এত গভীর ও ব্যাপক সেখানে জীবনযাপনে, চিন্তায়-চেতনায় এবং যাঁরা সাহিত্যিক তাঁদের সৃষ্টিকর্মে দেখা দেবে ভিন্ন ধারা— স্বাভাবিকভাবেই। এজন্যই ১৯৩৭-৩৮ থেকে ১৯৪৭-৪৮ পর্যন্ত বাংলা কবিতার প্রধান স্রোতে প্রাক্‌-স্বাধীনতা পর্বের যে সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়নের আবর্তন এবং উত্তেজনামুখর স্বরগ্রাম ছিল তা আর আগের মতো রইল না।

কিন্তু পরিবর্তন হল কিছুটা বিস্ময়করভাবে। জীবনে যখন আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা; যখন পূর্ববাংলার মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পশ্চিমবাংলায় পা রাখার জায়গা খুঁজতে মরিয়া; যখন পশ্চিমবাংলার মানুষ পূর্ববাংলা থেকে আগত এই জনস্রোতকে অনেক সময়ই মনে করেছেন বাড়তি বোঝা—তখন কবিতায় অস্থিরতা, ক্ষোভ, ক্রোধ, অভিমান, হতাশা এবং সংগ্রামী চেতনা স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি পাবে—এমনই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু তেমন ঠিক হল না। যে তরুণেরা স্বাধীনতার উত্তরকালে শুরু করলেন কবিতা-চর্চা তাঁদের লেখায় ঠিক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের সুর বাজল না। তাঁরা কবিতায় ব্যক্ত করলেন মনের ভিতরের অনুভূতিমালাকে। তাঁরা প্রেমের কবিতা লিখলেন; একাকিত্বের কবিতা লিখলেন; চিত্তের গহনতলকে উন্মোচিত করে দিলেন একান্ত ব্যক্তিগত স্বগতোক্তিতে। প্রকাশিত হল অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি কবিতা-পত্রিকা— ‘শতভিষা’ (১৯৫১) এবং ‘কৃত্তিবাস’ (১৯৫৩)। এই দুটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত কবিরা অর্ধশতক অতিক্রম করেও প্রবাদপ্রতিম। কিন্তু স্বাধীনতার অন্যতম শর্ত যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নিজের মতো করে সমগ্র পারিপার্শ্বিককে অনুভব করবার চেতনা এবং প্রকাশ করবার পরিসর— তা এই পঞ্চাশের কবিরা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের সেই আত্মচেতনার হৃদকেন্দ্রে সমাজ, রাজনীতি, সর্বমানবের সুখ-দুঃখ—সবকিছুরই স্থান ছিল কিন্তু সে-সবই জারিত হয়ে গিয়েছিল কবির আত্মিক চৈতন্যে এবং হৃদয়প্লাবী ব্যক্তিক উপলব্ধির প্রগাঢ় তরঙ্গে। সেই কবিদেরই একজন শঙ্খ ঘোষ(জ- ১৯৩২)। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম কবিতা ‘দিনগুলি রাতগুলি’ এমন একজন কবিকেই আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিল।–“হে আমার সুনিবিড় তমস্বিনী ঘনভার রাত্রি, আমাকে হানো”। আবার সেখানেই রাত্রির কঠিন বেদনা উত্তীর্ণ হয়ে প্রেম-স্পর্শে যখন প্রভাত আসে তখন—“রাত্রির কলস ভেঙে প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে”।

কিন্তু শঙ্খ ঘোষের কবি-মানস সম্পর্কে এই কথাটুকু বলা যথেষ্ট নয়, এবং নির্ভুলও নয়। বস্তুত, পঞ্চাশের কবিদের অনেকের সম্পর্কেই প্রশ্নটি জাগে এবং উত্তরও সম্ভবত আজ পাওয়া কঠিন নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং ঔপনিবেশিক রাজনীতির কুটিল জটিলতার কারণেই তাঁরা হারিয়েছিলেন তাঁদের আশ্রয়; বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর চাপে পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা অনুভব করেছিলেন সেই বিপন্নতা; তবুও কেন তাঁদের লেখায় প্রকাশিত হল না আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাদ্বন্দ্ব সম্পর্কিত কোনও নিরাশ্রয়তাবোধ অথবা ক্ষোভ। তাঁরা লিখলেন প্রধানতই আত্মমগ্ন রোম্যান্টিক লিরিক।

তাহলে কি সমাজ সম্পর্কে, সমকালের জীবনযাপনের বিভিন্ন সংকট সম্পর্কে তাঁরা সচেতন ছিলেন না ? তেমন হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। তরুণ কবিদের আত্মলীন কবিতা-সম্ভারকে হয়তো বলা যায় কিছুটা প্রতিক্রিয়া। তখন দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-অন্তে স্বাধীন হয়েছে দেশ। যত সংকট ও বেদনাই থাকুক এই তরুণেরা অনুভব করলেন যে তাঁরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনতার আলো-বাতাসে, স্বাধীন দেশের মৃত্তিকায় বিকশিত হতে চলেছে তাঁদের জীবন। নিজেদের ব্যক্তিত্ব তাঁদের কাছে হয়ে উঠল গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। সামাজিক সংকটময় পরিমণ্ডলকে মেনে নিয়েও তার উপরে প্রতিষ্ঠিত হবে তরুণ প্রাণের আনন্দিত জয়যাত্রা— এমন একটি মনস্তত্ত্ব থাকা অস্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয়ত, এমনও হওয়া সম্ভব যে, কবি-প্রাণের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা যে বৈচিত্র্যর সন্ধান তারই অনুপ্রেরণায় এই কবিদের এই ভিন্ন পথ-যাত্রা। পঞ্চাশের অব্যবহিত পূর্ববর্তী কালপর্ব ছিল ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮-৪৯ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ের কবিতায় সমাজ ও রাজনীতি-সচেতনতাই প্রায় সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছিল বাংলায়। ব্যক্তিগত কবিকণ্ঠ যে স্বল্প সংখ্যক কবির রচনায় শ্রুত হয়েছিল, তা খানিকটা চাপাই পড়ে গিয়েছিল কবিতার সামাজিক ভাষ্যে ও রাজনৈতিক ঘোষণায়। পঞ্চাশের তরুণ কবিরা স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে চাইছিলেন।

যদি আমরা এমন সিদ্ধান্ত করি যে, তরুণ কবিদের এই আত্মমগ্নতা কিছুটা প্রতিক্রিয়া তাহলে কিন্তু একথাও বলতে হবে যে, সামাজিক সংকটের বাস্তব সত্যটি তাঁরা কোনোভাবেই ভুলে থাকতে পারেননি। তাঁরা কেবল তাঁদের তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে, যৌবনের উজ্জ্বল চোখের আলোয় এবং ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় সেই সময়টিতে নিজেদের অন্তরের অনুভবকে প্রবলতরভাবে মূল্যবান বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই ধারণাটি আরও প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই, যখন আমরা লক্ষ করি পঞ্চাশের অধিকাংশ কবিই পরবর্তী বারো থেকে পনেরো বছরের মধ্যেই নিজেদের কবিতায় সমাজ-সংকটের চলমান চিত্রকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তুলে আনছেন, এবং সামাজিক বিপন্নতাবোধকে গ্রহণ করছেন নিজেদের উপলব্ধির বিভিন্ন স্তরে। তাঁদের কবিতার ভাষার বিন্যাসে মাঝে মাঝেই শ্রুত হচ্ছে সামাজিক প্রতিবাদের স্বরগ্রাম। কাজেই, এই পঞ্চাশের কবিদের বলা যায় না কেবলই আত্মমগ্নতার কবি। রোম্যান্টিক আত্মমগ্নতার একান্ততার পর্যায়টি, বস্তুত যথেষ্ট দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। আধুনিকতার একটি শর্ত হল অনেকান্তিকতা। একজন কবি, যে-কোনও মানুষের মতোই তাঁর যাপিত মনোজীবনের ভিন্ন ভিন্ন মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির দ্বারা গ্রস্ত হতে পারেন। ভালোবাসার মগ্নতা এবং সুগভীর ঔদাসীন্য বিরাজ করতে পারে পাশাপাশি। কাজেই একজন কবি কোনও সময়ে ব্যক্তিগত উপলব্ধির নিবিড়তায় নিমজ্জিত হবেন এবং অন্য কোনও সময়ে সামাজিক বৈষম্যের তীব্র সংঘাতে যন্ত্রণাবিদ্ধ হবেন—এর মধ্যে কোনও স্ববিরোধ নেই। পঞ্চাশের কবি এবং একই সঙ্গে একুশ শতকের কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কবিতায় কবিমানসের এই সত্যটি ফুটে উঠেছে অবিসংবাদিতভাবে।

শঙ্খ ঘোষের কবিতায় প্রথমাবধি এই সংশ্লেষ লক্ষণীয়। প্রথম কবিতা-সংকলন ‘দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬) থেকেই এই লক্ষণ পরিস্ফুট। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ নামের কবিতাটিতে ‘প্রেমের বিকীর্ণ শাখা ফুলে-ফলে জলে’—এই অনুভবের সঙ্গেই স্থান পেয়েছে ‘যমুনাবতী’ নামের অন্য কবিতা। যেখানে খাদ্যের দাবিতে মিছিলে পা মেলানো কিশোরীর পুলিশের গুলিতে নিহত হবার ঘটনা ছিল কবিতার উৎস। দিনে দিনে তাঁর কবিতায় সমাজ-চৈতন্য হয়ে উঠেছে তীক্ষ্ণতর। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ (১৯৮৪) সংকলনের ‘লজ্জা’ কবিতাটি ভোলা যায় না। এক সর্বহারা মেয়ের ভাষা এই কবিতায়—

“খুঁটে খাই যখন যা পাই
সুবোদের পায়ের তলায়।
খেতে তো হবেই বাবা
না খেয়ে মরব নাকি!”

রিক্ত মানুষের চিরন্তন প্রশ্ন এবং চিরকালের সংগ্রাম এই কবিতায়। সবশেষে আছে এক তীব্র বিদ্রুপাত্মক উক্তি—‘বাবুদের লজ্জা হল’।

‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’ (১৯৮৭) সংকলনের ‘খবর সাতাশে জুলাই’ কবিতায় একটি দিনের কাগজ থেকে সংবাদ হয়ে ওঠে অবলম্বন। নিগৃহীত পরিচারিকা, আফ্রিকায় খরা-কবলিত শিশুদের জন্য সুপারস্টারদের নিয়ে ধুম জলসা, পারমাণবিক সাহায্য নিয়ে রাষ্ট্রনীতির চিঠি-চালাচালি, দুটি ক্ষুধার্ত বালিকা রুটি চেয়েছিল বলে মার খেয়ে হাসপাতালে। এই নিয়েই তাঁর কবিতাটি। ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ (১৯৯৩)-নামটি কাব্যময় নয় কিন্তু সত্যভাষী। প্রশাসকের স্বেচ্ছাচার ও ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে উচ্চারিত তাঁর স-ব্যঙ্গ প্রতিবাদ—

মেজাজ দেখাও যদি, কথার উপরে বলো কথা—
তাহলে মুশকিল বড়ো। মারতে তো চাই না সহজে
—কিন্তু এরকম হলে নিতান্তই নিরুপায় হয়ে
খুলে নিতে হবে চামড়া তোমারই ভালোর জন্য বাপু। (বঁড়শি)

সেই সঙ্গেই আমরা ভুলতেই পারি না, ‘বাবরের প্রার্থনা’ (১৯৭৬) সংকলনের নাম-কবিতাটিতে আহত ও বিপন্ন সন্তান-প্রতিম তরুণ প্রজন্মের প্রতি কবির ব্যাকুল সহমর্মিতা—“ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”

কবি শঙ্খ ঘোষকে আবহমানের কবি বলে উল্লেখ করেছি শিরোনামে। একদিকে মানুষের জন্য সংবেদনশীলতা, অন্যদিকে প্রশাসকের দলীয় রাষ্ট্রনীতির আধিপত্যবাদী নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানুষের পৃথিবীতে একই রকম আছে। সম্ভবত থাকবে চিরকাল। এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক অতিক্রান্ত হবার পরেও, বেশ কিছুকাল আগে লেখা একটি কবিতার চির-প্রাসঙ্গিক দুটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে শেষ করছি আমার কথা।

“আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন দল
রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন দল। তুমি কোন দল।” (তুমি কোন দলে)



লেখক পরিচিতি - সুমিতা চক্রবর্তী অধ্যাপিকা এবং লেখিকা।




প্রতিবাদী শঙ্খনাদ
পল্লববরন পাল

এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত-
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

উল্টোডাঙার বাড়ি। বইয়ের দেয়াল ঘেরা বসার ঘর। এক তক্তপোশ বই। কাঠের টেবিলে বই। বইয়ের মেঝেও। এই বইসমুদ্রের মাঝে আচমকা দ্বীপের মতো খান-চারেক বেতের চেয়ার। আর সময় নেই অসময় নেই – অজস্র মানুষ – নানান বয়স, নানান পেশা – কবি পাঠক অধ্যাপক কেরাণি ছাত্র সমাজকর্মী – নানান জিজ্ঞাসা, নানান কৌতূহল – কেউ কেউ শুধু মুগ্ধবিস্ময়ে নীরবদর্শন বা আড্ডার আকর্ষণের ভীড়।

রোববার রোববার এই ঘরই উপচে ওঠে কথায় – সাহিত্য শিল্প সমাজ রাজনীতি বা মানুষ। তক্তপোশের পাশের নির্দিষ্ট চেয়ারে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি - গৃহকর্তা শোনেন, মাথা নাড়েন, ভুরু কুঁচকান, হাসেন, কখনো কদাচিৎ সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন – কথা নিয়ন্ত্রণ করেন না – নানা কথা, নানা রুচি, নানা শব্দ, নানা উচ্চারণের নানা শব্দের মধ্যবর্তী নীরব নোম্যান্‌সল্যান্ড হয়ে – যে শূন্যতায় শব্দেরা অসংখ্য শব্দোত্তর প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে – শব্দের সেই ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে কুরুক্ষেত্র তক সোচ্চার চর্চাভূমিতে যেন থেকেও নেই, আবার না থেকেও হিমালয় ধ্যানমগ্নতায় বসে থাকেন এই সময়ের সম্ভ্রান্ত বিবেক কবি শঙ্খ ঘোষ।

ভালো নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ বর্তমান বাঙলাদেশের চাঁদপুরে। বাবা মণীন্দ্রকুমার, মা অমলা। পৈত্রিক বাড়ি বাঙলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। পাবনা থেকে ম্যাট্রিক, তারপর কলকাতায় প্রেসিডেন্সি থেকে বাঙলায় স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।

‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে
নোটন নোটন পায়রাগুলি খাঁচাতে বন্দী
দু-এক মুঠো ভাত পেলে তা ওড়াতে মন দিই...’

১৯৫১ সাল। সকালের খবরকাগজে শিরোনাম – কুচবিহারে পুলিশের গুলিতে ষোড়শী কিশোরীর মৃত্যু। চার বছর তখন স্বাধীনতার বয়স। খাদ্যের দাবিতে অনাহারী মানুষের মিছিলের সামনে থেকে কিশোরীকে টেনে কর্ডনের ওপারে নিয়ে গিয়ে স্বাধীন দেশের পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। হতভাগী মায়ের আর্ত জবানি পরদিন জানালো – মেয়েটির বিয়ের সব ব্যবস্থা সারা, কিন্তু কোনো নিষেধ না শুনে সর্বনেশে মিছিলে টেনে নিয়ে গেলো তাকে। দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড়, বিধানসভায় তুমুল হৈচৈ, তদন্তকমিশন – সময়ের নিয়মে সব ধামাচাপা পড়ে যায়। এরপর একদিন কলেজস্ট্রিট বাজারের পিছনে রেলকোয়ার্টারের তিনতলায় জানলার ধারে বসে নিচের গলিতে চোখ পড়লে চমকে ওঠেন – রুটিসেঁকার আয়োজনে আঁচ উঠেছে উনুনে, ময়লাছেঁড়া পোশাকে ক’টা ছেলেমেয়ে উনুনের পাশে দুলে দুলে মাদ্রাসার পাঠ নিচ্ছে - বি.এ. পরীক্ষা শেষের আলস্য ঝেড়ে জানলা থেকে উঠে ঘরে আসতে আসতে তরুণ কবির মানসপটে ভেসে উঠলো নাম-না-জানা সেই মেয়েটি ও তার মায়ের মুখচ্ছবি – এবং ঐ ধোঁয়াআগুন-উনুনের মধ্যেই অকস্মাৎ শব্দবারুদের বিস্ফোরণ হলো –

‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে’ –

তাদের দু’জনের সংলাপ, তাদের ক্ষুধা যাপন, সেই মিছিল, গুলির শব্দ - ১৯৫২ সালে বাঙলা কবিতা পেলো এক নতুন প্রতিবাদের ভাষা – সমর সেন, দীনেশ দাশ, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দের উত্তরসূরী হিসেবে সাড়া ফেলে দিলেন সদ্যযুবক শঙ্খ ঘোষ।

‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে।
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে!’

সেই থেকে শুরু। সেই থেকে বাঙলা কবিতায় অবিসংবাদী প্রতিবাদের নাম শঙ্খ ঘোষ। মানুষের বিপন্নতায়, সময়ের অস্থিরতায়, সমাজের সংকটে পরশুরামের কুঠার হয়ে নেমে আসে তাঁর কবিতার লাইন। তাঁর কবিতার সবচেয়ে নিকট ও আন্তরিক বিষয় সময়। তাঁর কবিতা আমাদের চারপাশের নিরন্তর মূল্যায়নের সঠিক নিরপেক্ষ দিনলিপি। আমাদের দৈনিক যাপনের যাবতীয় প্রকাশ্য উৎসব, এই মহাপৃথিবীর নিরঙ্কুশ অংশ হিসেবে চিহ্নিত আমাদের অতিক্ষুদ্র বিপর্যয় থেকে উদ্বাহু উদ্বোধনের সমারোহ অবধি সাড়ম্বর অতিবাহন অনায়াস বৌদ্ধিক সাবলীলতায় শঙ্খ ঘোষের কবিতার শব্দে শব্দে গভীর মননভঙ্গিতে উপজীব্য।

“মৃত্যুর খবর ছাড়া কোনো খবর শোনা যায় না কোথাও। কখনোকখনো চোখের সামনে দেখতে হয় সংঘর্ষের ছবি, যে-সংঘর্ষের দুদিকেই চেনামুখের ভিড়। ... সবাই সবাইকে সন্দেহ করে, খুঁজে দেখে কে কার গুপ্তচর। সেই সন্দেহে, দেখেছি পাঁচিলের সঙ্গে রণজয়কে কীভাবে পিষে ধরেছিল ছেলের দল আমাদের সকলেরই চোখের সামনে; দেখেছি শিপ্রাকে কীভাবে কবজি ধরে ঝোপের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল এ-প্রতিষ্ঠানেরই বলশালী এক সহকর্মী;... কোথায় নিয়ে চলেছে এই ঘৃণা? সেকথা ভাববার কোনো সময় সময় নেই মনে হয়। ... বাস থেকে যে-মুখটিকে ওই নামিয়ে নিল এইমাত্র, আর হিংস্র আক্রোশে ঘিরে ধরল ওই যারা, লাঠি দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল আমাদের – তারা সকলেই তো আমাদের চেনা, আমাদেরই কারো-না কারো ছাত্র।”

এরাই শঙ্খ ঘোষের কবিতা লেখার খাতা-কলম-কালি। এমনি এক ছাত্র, নাম তিমিরবরণ সিংহ, স্নাতক পরীক্ষার পরে কিছু বইয়ের খোঁজে এলো তার প্রিয় স্যারের কাছে, যে বইগুলো ফেরতের গ্যারান্টি নেই, কারণ সে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা ছেড়ে গ্রামে গিয়ে বিপ্লবের জরুরি কাজে যোগদানকেই সময়োচিত মনে করেছিলো। চলে গেল। এবং কিছুদিন পরে রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে ষোলোজন সহবন্দীর সাথে পিটুনি খেয়ে আরো দূরে চলে গেলো। তিমির বন্দী হলো তার স্যারের লেখা ‘তিমির বিষয়ে দু-টুকরো’ কবিতায় –

‘আন্দোলন
ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।

নিহত ছেলের মা
আকাশ ভরে যায় ভস্মে
দেবতাদের অভিমান এইরকম
আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান
এ ছাড়া
আর কোনো শান্তি নেই কোনো অশান্তিও না।’

অফিসফেরত দোতলা বাসের মধ্যে উলিডুলি ছেঁড়া পোষাকের ভিখিরিছেলের মাটির হাঁড়ি বাজিয়ে গান, সহযাত্রীদের বাহবা, গান শেষে ছেলেটি হাত পাততেই নিমেষে সেই সোচ্চার তারিফ মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরের অপূর্ব তিলোত্তমা কলকাতার নাগরিক সৌন্দর্যে নীরব অভিভূত হয়ে গেলো, এবং বাসের ভিতরে তির্যক গালাগালির আবহসংগীত – সামনের দিকে জানলার ধারে বসে এই ‘ভিখিরি ছেলের অভিমান’ প্রতিবাদ সহ গাঁথা হলো কবিতায় –

আগে বলবেন, গা রে খোকা
পরে বলবেন, মাপ করো –
সামনে থেকে যা সরে যা
চলার পথটা সাফ করো

গাব না তাই গান

আগে বলবেন, গতর খাটো
পরে মারবেন লাথি
আগে কথার ধুল্‌ ওড়াবেন
পরে দাঁতকপাটি

গাব না আর গান ...

কী অনায়াস বিনয়ী এই প্রতিবাদী কণ্ঠ – ঠাণ্ডা ও বলিষ্ঠ। একদম মানুষ শঙ্খ ঘোষের মতোন। কী নম্র ও নিষ্ঠুর, কী শান্ত ও শাণিত, বিনয়ী ও বারুদ – প্রতিনিয়ত আমাদের ঘাড় ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় মুহূর্তের মুখোমুখি। এমনই সাম্প্রতিক ও শাশ্বত তাঁর কবিতা। সমসময়কে তাঁর নিজেরই ভাষায় “শিকড় দিয়ে আঁকড়ে’ থাকেন কবি শঙ্খ ঘোষ। ১৯৫৬ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেই থেকে সময় তাঁর হাতের কলম। বিগত ছয় দশক মূর্ত হয়ে আছে তাঁর বিস্তীর্ণ শব্দব্যাপ্ত কুসুমকানন।

‘... এ-সংকটটা কেবল আমাদের দেশেরই নয়, এটা আমাদের সময়েরই এক সংকট। যে কোনো সত্য উচ্চারণকে মিথ্যা আড়ম্বরের দিকে টেনে নিতে এখন আর সময় লাগে না বেশি, যে-কোনো বোধ বা উপলব্ধি মুহূর্ত মধ্যে হয়ে উঠতে পারে নিছক পণ্য মাত্র। শব্দ বা ভাষার ব্যবহার তাই আমাদের কাছে ভয় নিয়ে আসে অনেক সময়ে, লেখকেরা নিজেরাও অনেক সময়ে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন তাঁদের ভাষা ব্যবহারের সম্ভাবনা বিষয়ে। লেখা থামিয়ে দেবার কথাও হয়তো তখন ভাবেন কেউ কেউ। যিনি থামিয়ে দেন, তাঁর আর কোনো সমস্যা নেই অবশ্য। কিন্তু প্রতিরোধের এই জটিলতা আছে বলে সকলে যে থামিয়েই দেবেন তাঁদের সৃষ্টি, এমন কোনো কথা নেই। বরং তখন সচেতন শিল্পীর সামনে এসে পৌঁছয় নতুন ধরনের একটা লড়াই, ভাষাকে ভেঙে দিয়ে ভাষার সত্যে পৌঁছবার কোনো লড়াই। এরই একটা ছবি ধরতে পাই যখন Nova Express-এর মধ্যে বারোজ দেখিয়েছিলেন যে নীরবতাই হলো আমাদের সবচেয়ে কাঙ্খণীয় অবস্থা। কিন্তু শব্দেরই কোনো বিশেষ প্রয়োগরীতির মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছতে পারি সেই নীরবতায়।’

রবীন্দ্রনাথের একশো পঁচিশ বছর উদযাপনের প্রস্তুতির মধ্যে রে রে ছুটে এলো খবর – ন-কাঠা জমির সমস্যা নিয়ে তেইশজন মানুষকে গুলি করে মেরেছে বিহারে আরওয়ালের পুলিশ – তিনদিক ঘিরে এক গান্ধীমাঠে – উনিশে এপ্রিল – প্রতিবাদে সেমিনারে উদযাপনের মধ্যে মাথায় ওলটপালট খেতে খেতে আগস্ট মাসে গীতার শ্লোকের নতুন অনুবাদে ফুটে উঠলো ধর্মক্ষেত্রের সে রণকাহিনী ‘অন্ধবিলাপ’ কবিতায় –
...

অন্ধ আমি, দেখতে পাই না, আমিই তবু রাজ্যশিরে
এবং লোকে বলে এ দেশ যে তিমিরে সেই তিমিরে

কারা এ সব রটিয়ে বেড়ায় বলো আমায় হে সঞ্জয়
অন্ধ আমি, কিন্তু তবু এ সব আমায় জানতে হবে

তেমন তেমন তম্বি করলে বাঁচবে না একজনার পিঠও
জানিয়ে দিয়ো খুবই শক্ত বল্গাতে এই রাষ্ট্র ধৃত ...

তিনদিকে তিন দেয়াল ঘেরা সাতান্ন রাউণ্ড গান্ধীমাঠে
ভিজল মাটি ভিজল মাটি ভিজুক মাটি রক্তপাতে

অধর্ম? কে ধর্ম মানে? আমার ধর্ম শত্রুনাশন
নিরস্ত্রকে মারব না তা সবসময় কি মানতে পারি?...

বাজশকুনে হাড়গিলেতে ভরবে উঁচু গাছের চুড়ো
তাকিয়ে থাকবে লোহার ঠোঁটে খুবলে খাবে মাংস কখন

মেঘ ঝরাবে ধুলো, মেঘেই মাংসকণা ছড়িয়ে যাবে
হাতির পিঠে লাফিয়ে যাবে বেলেহাঁস আর হাজার ফড়িং

কাজেই বলো, হে সঞ্জয়, কোন্‌ দিকে কার পাল্লা ভারি?
জিতব? না কি নিদেনকালের জাঁতায় পিষে মরব এবার?

সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধেক কি ছাড়তে হবে?
টুকরো টুকরো করব কি দেশ পিছিয়ে গিয়ে সগৌরবে? ...

পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা – অথচ শঙ্খ ঘোষের কলমের মুনশিয়ানা এটাই যে, পড়তে পড়তে যে কোনো সময়ের পাঠক তার সমকালকে দেখতে পাবে – আজকের নতুন পাঠকেরা যেমন আজকের দিল্লির কৃষকবিদ্রোহের সঙ্গে আরওয়াল গণহত্যার যোগসূত্রটি উপলব্ধি করবেন। ফ্যাসিস্ট শাসকের হিংস্র নখের উন্মাদ উল্লাসকে চিহ্নিত করবেন। পড়া শেষ করে চোখ তুলে দেখবেন – উল্টোডাঙার সেই বইপ্লাবিত ঘরে তক্তপোশের পাশের চেয়ারে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি - নানা কথা, নানা রুচি, নানা শব্দ, নানা উচ্চারণের নানা শব্দের মধ্যবর্তী নীরব নোম্যান্‌সল্যান্ড হয়ে – যে শূন্যতায় শব্দেরা অসংখ্য শব্দোত্তর প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে – শব্দের সেই ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে কুরুক্ষেত্র তক সোচ্চার চর্চাভূমিতে যেন থেকেও নেই, আবার না থেকেও হিমালয় ধ্যানমগ্নতায় বসে আছেন গভীর অন্তর্ভাষী কবি শঙ্খ ঘোষ।
...

আর তাছাড়া ভাই
আর তাছাড়া ভাই আমরা সবাই জেনেছিলাম হবে
নতুন সমাজ, চোখের সামনে বিপ্লবে বিপ্লবে
যাবে খোল-নলিচা
যাবে খোল-নলিচা পালটে, বিচার করবে নিচু জনে’
কিন্তু সেদিন খুব কাছে নয় জানেন সেটা মনে
মিত্র বাবুমশাই ...

হে শঙ্খ বাবুমশাই, আরো অনেকদিন আপনাকে এই সময়ের সম্ভ্রান্ত বিবেক হয়ে আমাদের অভিভাবকের মতো সভ্যতাকে আগলে রাখতেই হবে, এ আমাদের আকুল আর্তনাদ –

সামনে সমূহ বিপদ।


লেখক পরিচিতি - পল্লববরন পাল : কবি সাহিত্যিক




আত্মত্যাগের আত্মশক্তি
হিন্দোল ভট্টাচার্য

ব্যক্তিগত ভাবে আমি টি এস এলিয়টের ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত প্রতিভায় যে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ভাবনার কথা বলা আছে, তা অনুসরণ করতে পছন্দ করি। মনে হয় সমস্ত সার্থক শিল্প ও শিল্পীর মধ্যেই এই সমন্বয় ঘটেছে। তিনি যেমন ঐতিহ্য, ইতিহাসচেতনা এবং আবহমানকে ধারণ করে আছেন, তেমনভাবেই তিনি আগামীর দিকেও তাকিয়ে আছেন। তার তীক্ষ্ণ পাখির মতো দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে যেমন আগামী খুঁটিনাটি, তেমন ভাবেই তাঁর অনুভূতিমালায় পাক খাচ্ছে ঐতিহ্যের শিকড়। এই শিকড়কে যেমন তিনি শেষ কথা বলে ভাবছেন না, তেমন এই শিকড়কে কেটে ফেলেও দিচ্ছেন না, তাকে সম্মান করে, গভীর ভাবে তার প্রতিটি আণুবীক্ষণিক পাঠ করছেন। আবার অজানা নতুন, সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতা, ধ্বংসস্তূপের হাহাকার তাঁর কলমের মধ্যে দিয়ে কথা বলে উঠেছে। তিনি যেন এক মাঝপথে পড়ে যাওয়া লোক। তিনি গাইতে চান সুন্দরের গান, কিন্তু আর্তনাদগুলো লিখে রাখেন সহিষ্ণু ও সংযত ভঙ্গিতে। সমস্ত ঘটনার গভীরে যে তাঁকে অবগাহন করতে হবে। জানতে হবে দেওয়ালে লেগে থাকা হাতের ছাপের কারণ। জানতে হবে ও কার পায়ের ছাপ মাটিতে? এই পথে কারা হেঁটে গিয়েছিল?

কবি শঙ্খ ঘোষের বাবরের প্রার্থনা নিয়ে আলোচনা করার কথা আমার। কিন্তু আমার মনে হয়, প্রতিটি কবির প্রত্যেক কবিতা বই আসলে একটি হলোগ্রামের মতো। তাঁর প্রতিটি কবিতাগ্রন্থেই রয়েছে সেই বীজ, যা তাঁকে শণাক্ত করবে, তাঁর লেখনীর বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করবে এবং একইসঙ্গে, সামগ্রিক ভাবে কীভাবে এই গ্রন্থের মধ্যে ফুটে উঠেছে তাঁর ব্যক্তিগত সত্ত্বা, তা যেমন চিহ্নিত করবে, তেমন-ই চিহ্নিত করবে কীভাবে এই গ্রন্থের রয়েছে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। ঠিক যেমন আমরা। আমরা প্রত্যেকে ধারণ করে আছি আবহমানকালের অখণ্ড চেতনাকে। কিন্তু আবার আমরাই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে প্রতিনিধিত্ব করছি এবং সেই অখণ্ড চেতনাকেও সমৃদ্ধ করছি বিশেষ ব্যক্তিত্বের অবদানে। হাতের ছাপ রেখে যাচ্ছি দেওয়ালে।

বাবরের প্রার্থনা এমন একটি কাব্যগ্রন্থ, যেখানে কবি শঙ্খ ঘোষ একইসঙ্গে অন্তর এবং বাহিরের সঙ্গে গ্রীক নাটকের কোরাসের মতো কথা বলছেন। আবার শেক্সপীয়রের নাটকের সলিলকির মতো কখনও তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে গভীর গভীরতম উচ্চারণ। কোরাস এবং সলিলকির যুগপৎ সঙ্গত তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে, তা স্পর্শ করাই কঠিন। পাশাপাশি আমি বলতে চাই সমকালীনতার কথা। এই বইয়ের কবিতাগুলি মনে হয় এই দুহাজার উনিশের ভারতবর্ষে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। যে অসহিষ্ণুতা, যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হিংসা, যে অস্থিরতার বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে মানবিকতার, ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে, সেখানে আমরা সত্যই চোখে অন্ধকার দেখছি। সেই অন্ধকারে মন্ত্রের মতো প্রতিধ্বনিত হয় শঙ্খ ঘোষের এই কাব্যগ্রন্থের এক একটি কবিতা। মনে হয়, আমিও তো বলতে চাই এই কথাগুলিই। কিন্তু এই কথাগুলি কি উচ্চকিত ভাবে বলা? এই কথাগুলি কি স্লোগান? না। এই কথাগুলিতে কি শঙ্খ ঘোষের কাব্যব্যক্তিত্ব নেই? তাঁর যে আবহমান সত্ত্বা ঐতিহ্যের শিকড়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সমকালীনতার দিকে তাকান, তা নেই? না, তাও নয়। সবকিছুই আছে। এক নীরব ভাষা রয়েছে। যে ভাষায় রয়েছে দৃঢ়তা। যেমন-

আমি বলতে চাই, নিপাত যাও
এখনই
বলতে চাই, চুপ

তবু
বলতে পারি না। আর তাই
নিজেকে ছিঁড়ে ফেলি দিনের পর দিন।...
( ধ্বংস করো ধ্বজা)

এই কবিতাটি দিয়ে শুরু হয় বাবরের প্রার্থনা নামক কাব্যগ্রন্থটি। নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন আসে, তবে কি আমি সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার জায়গা থেকেই তাঁর এই বইটিকে আলোচনা করব, না কি আবহমানকালের কাব্যিক প্রবহমানতার এক অংশ হিসেবে। আসলে এই দুটি কাজ একসঙ্গে যে গ্রন্থে লেখাই আছে, তাকে তো সেই গ্রন্থের মতো করেই পড়ে যেতে হবে। আর আলোচনা তো পড়ার এক প্রতিফলন ছাড়া আর বিশেষ কিছুই না। আমি আর কীই বা করতে পারি, যেভাবে পড়ছি, তার অপ্রত্যাশিত দিকগুলিকে তুলে ধরা ছাড়া। এই যেমন এই কবিতাটিতে, পুরনো গাছের গুঁড়ি শীর্ষক কবিতাটিতে তিনি লিখলেন- “ দুধারে ছড়ানো এই প্রণতি ও উত্থান, মনে হয়েছিল/ তুমি আছো, আছো তুমি। তবু// চোখ যদি ফিরে আসে মূলে/ খুলে যায় রজনীর নীল-/ নিচু হয়ে বলি ঃ / পুরনো গাছের গুঁড়ি, বাকলে ধরেছে কত ঘুণ?” বাবরের প্রার্থনা সমগ্র কাব্যগ্রন্থটিই এভাবে কখনও আবহমানতাকে থেকে তুলে আনে ঐশ্বর্যের খনি, তো কখনও সাম্প্রতিকতার মধ্যে থেকে তুলে আনে সেই আবহমানতার প্রতীক। সে যেন ইতিহাসযানের ভূমিকা পালন করার জন্যই এসেছে এখানে। এই ভূমিকা কিন্তু কবি তাঁর জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ দিনগুলি রাতগুলি থেকেই করে আসছেন। এটি রীতিমতো ভাবার বিষয় যে কবির বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ১৯৭৬ এর অগস্টে। অর্থাৎ ধরে নিতেই পারি, জরুরি অবস্থার যে স্বৈরতান্ত্রিক ভারতবর্ষে বসে তিনি এই কবিতাগুলি লিখেছিলেন এবং তার আগে যে ব্যাপ্ত সময় জুড়ে শাসকের হাতে খুন হয়ে গিয়েছিল মানুষের কণ্ঠ, যে টালমাটাল সত্তর দশকের প্রেক্ষাপটেই তিনি লিখেছিলেন এই সমস্ত কবিতা, তাতে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এই রক্তক্ষরণ শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ততটা উচ্চকিত নয়, বরং নীরব। আর এই নীরবতার, এই শূন্যতার, এই স্থানাঙ্কহীনতার মধ্যেই কবি খুঁজে চলেছিলেন সমস্ত মানুষের শ্বাস নেওয়ার বসবাসযোগ্য জায়গা। এই শূন্যতাকে, বাধ্যতামূলক নীরবতাকে তিনি লিখেছিলেন নানা ভাবে। যেমন- ফিরে আসার সময়ে কেবল শোনা যায় পায়ের শব্দ- / কোনও একজন নেই/ সে কথা কারো-বা মনে পড়ে অল্প-স্বল্প।“ ( ডানা এখন চুপ)

কিন্তু একজন প্রকৃত কবির কাছে কবিতা হল দিগন্তের মতো। দিগন্তের মধ্যে সমস্ত রঙ, সমস্ত উচ্চতা, দৃশ্যগুলি কেমন একরকমের হয়ে যায়। যেন সবাই মিলেমিশে বলতে থাকে একটিই কোনও কথা। ঠিক সেভাবেই সমস্ত যন্ত্রণা কখনও কখনও মিশে যায় যন্ত্রণাবোধের ভিতর। সমস্ত পৃথক পৃথক ক্ষুদ্র সত্য তখন মিলেমিশে রচনা করে এক বৃহত্তর সত্যের। দুঃখ তখন দুঃখবোধের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। ছোট দুঃখের থেকে শিল্পী বা কবি বা ভাবুক তখন রওনা দেয় বড় দুঃখের দিকে। এই যে নীরবতার কথা কবি বললেন, সেই নীরবতার নানা দৃশ্যকে, নানা স্তব্ধতাকে তিনি আবিষ্কার করতে থাকেন। একজন কবি যখন এই বড় দুঃখের কাছে পৌঁছে যান, তখন তাঁর মধ্যে জন্ম নেয় এক নির্বিকল্প বোধি।

... দিনের বেলা যাকে দেখেছিলে চণ্ডাল
আর রাত্রিবেলা এই আমাদের মাঝি
কোনও ভেদ নেই এদের চোখের তারায়

জলের ওপর উড়ে পড়ছে স্ফূলিঙ্গ
বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে ভস্ম
পাঁজরের মধ্যে ডুব দিচ্ছে শুশুক

এবার আমরা ঘুরিয়ে নেব নৌকো
দক্ষিণে ঐ হরিশ্চন্দের ঘাট
দুদিকেই দেখা যায় কালু ডোমের ঘর

চতুর্দশীর অন্ধকারে বয়ে যায় গঙ্গা
এক শ্মশান থেকে আরেক শ্মশানের মাঝখানে
আমরা কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না।
( মণিকর্ণিকা)

এই মাঝি, এই পারাপার কি আবহমানের পারাপার নয়? যে বলে ‘ অনুমোদনের জন্য হৃদয়ে অপেক্ষা নেই আর’। যে ভীষণ একাকী হয়ে যায় এই ভারতবর্ষেই। একাকী হয়ে যায় জীবনের সমস্ত অনুসন্ধানের কাছে গিয়ে। আমাদের জীবনপ্রণালী প্রকৃতই একটি শ্মশান থেকে আরও একটি শ্মশানের মাঝখানে কারো মুখের দিকে না তাকানোর মতো শূন্যতা। কিন্তু কবি তো শুধু এই শূন্যতার কথা বলতে চান না। এখানেই তো কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে তথাকথিত অস্তিত্ববাদী আধুনিকতার বিরোধ। যে অস্তিত্ববাদী আধুনিকতা মানুষকে শুধুমাত্রই শূন্যতার মধ্যে নিজেকে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বরূপে ভাবতে শেখায়, জানায়, কবি অনেকটাই তার বিপরীতে। তিনি জানেন যে খণ্ড অস্তিত্ব একপ্রকার মায়া মাত্র। আবার অখণ্ড অস্তিত্ব একপ্রকার ধারণা মাত্র। কিন্তু তিনি খণ্ড অস্তিত্বের ক্ষণস্থায়ী শূন্যতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন না। বরং তিনি আরও বড় কোনও শূন্যতার কথা বলেন। যা শূন্য হলেও শূন্য নয়।

“ তোমার কোনও বন্ধু নেই তোমার কোনও বৃত্তি নেই
কেবল বন্ধন
তোমার কোনও ভিত্তি নেই তোমার কোনও শীর্ষ নেই
কেবল তক্ষক
তোমার কোনও নৌকো নেই তোমার কোনও বৈঠা নেই
কেবল ব্যাপ্তি
তোমার কোনও উৎস নেই তোমার কোনও ক্ষান্তি নেই
কেবল ছন্দ”
(তক্ষক)

এই যে মন্ত্রের মতো একটি কবিতায় কবি বলছেন আসলে আমাদের কিছু নেই। এই না-থাকাটা যে এক বিরাট বড় থাকা। এই শূন্যতা যে এক বিরাট বড় পূর্ণতা, তা তো আমরা এই বইয়ের পরের একটি কবিতায় পেয়ে যাব। যেখানে তিনি বলছেন-

“কেননা উড়ন্ত ফুল, চিতার রূপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়

সেকথা বলিনি? তবে কীভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?

শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সে কথা জানো না?”
( শূন্যের ভিতরে ঢেউ)

একদিকে যেমন শূন্যতা রয়েছে, তেমন আরেকদিকে শূন্যের ভিতরে রয়েছে ঢেউ। এই দুটিকেই তো জানতে বা অনুভব করতে হবে আমাদের। মাঝেমাঝে মনে হয় বাবরের প্রার্থনার কবিতাগুলি বেলা অবেলা কালবেলার ঠিক পরের ভাবনাস্রোত। যেমন ভাবে এই কবিতাগুলিকে আমরা ওয়েস্টল্যান্ডের পরের ভাবনাস্রোত হিসেবেও ভাবতে পারি। এমনকী যেখানে হলো মেন শেষ হয়ে গিয়ে বলছে – দিস ইজ দ্য ওয়ে দ্য ওয়ার্ল্ড এন্ডস/ নট উইথ এ ব্যাং/ বাট এ হুইম্পার, ঠিক তার পরে শুরু হচ্ছে এই কবিতাগুলির ভাবনাস্রোত।

ঠিক এইখানে এসে আমার আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, কবিতার নিজস্ব এক সত্ত্বা আছে। এই প্রকৃতি কথা বলছেন, কথা বলাচ্ছেন। কারো কারো কাছে এই প্রকৃতির জায়গায় ঈশ্বর হতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে তিনি এই মহাপ্রকৃতি, বিশ্বসংসার। তিনি সমস্ত কথা প্রকাশ করার জন্য বলে গেছেন। সেই কথাগুলি উপযুক্ত আধার খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে এই আধার হয়ে উঠছে, সে কথাগুলিকে প্রকাশ করছে। তাই মনে হয় জীবনানন্দ যে কথাগুলিকে বলেছিলেন তাঁর বেলা অবেলা কালবেলা কাব্যগ্রন্থে, বাবরের প্রার্থনার কবিতাগুলি ঠিক তার পরে বলে ওঠা। আর অন্যদিকে হলো মেনে যে সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এলিয়ট, তার পরের-ই এই উচ্চারণ- শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে সে কথা জানো না? কিন্তু আমরা কি আদৌ পড়ি এ ভাবে? ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ সোল যেমন হয়, তেমন কি হয় না ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ থট? আত্মার কি আদৌ পুনর্জন্ম হয় না কি হয় সেই সব ভাবনার, যেগুলি হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতর মতো জ্বলে ওঠে। কারণ এই প্রকৃতি তো সেই সব কথার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।

তো, কবি শঙ্খ ঘোষ ঠিক এভাবেই অস্তিত্ববাদী আধুনিকতার থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। সেখানে নীরবে যেমন উপস্থিত থাকলেন রবীন্দ্রনাথ, তেমন-ই নিয়তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন জীবনানন্দ। কিন্তু কবি নিজেই তো এই কাব্যগ্রন্থে বলে গেছেন- ‘ কেউ কারো মতো নয়, সমস্ত নিঃশব্দ নিজে আলো’। ফলে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, যাবতীয় নেতিগুলিকে নিয়েই তিনি এক অস্তির দিকে এগিয়ে যান সবসময়। আজ থেকে দশ বছর আগে যখন এই কাব্যগ্রন্থ পড়েছিলাম, তখন সত্যি বলছি, মনে হয়েছিল, এই যে এত আলো আসছে এত অন্ধকারের মধ্যে, তা কবির কোথাও এক গাঢ় ঔচিত্যবোধকেই সূচিত করছে। কিন্তু পরে যখন আমার নিজের বয়স বাড়ল, যখন অন্ধকার আর আলোর মধ্যে ততটা পার্থক্য করে উঠতে পারলাম না, যখন বুঝলাম, অন্ধকারও কখনও কখনও আলো, তখন, এই কবিতাগুলি আমার কাছে নিজে নিজেই খুলে গেল। সত্যিই তো তিনি যে ধ্বংসস্তূপের কথা বলছেন, সেখানে তো রয়েছে গভীর গভীরতম অন্ধকার। কিন্তু তিনি তো লিখছেন তো সেই ইতিহাসের কথা, যেখানে বাবর নিজের সন্তান্তের সুস্থ ভবিষ্যৎ চেয়ে বলছেন তাঁকে ধ্বংস করে দেওয়ার কথা। এই যে স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগের দর্শনের মাধ্যমে প্রতিরোধ হিংস্র অন্ধকারের বিরুদ্ধে, এটাই তো আলো। এই রিনান্সিয়েশনের দর্শনের হাত ধরেই তো গান্ধীজি একটা সময় তাঁর ব্যক্তিগত সাম্যবাদী ভাবনা এনেছিলেন ভারতবর্ষে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে হয়ত অনেক দূরের প্রসঙ্গের অবতারণা। বস্তুত, বাবরের প্রার্থনা কবিতাটিতে ছত্রে ছত্রে আত্মনিবেদন এবং ত্যাগের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সুস্থ দেশ গড়ে তোলার ভাবনা।

... জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান;
পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

... না কি এ প্রাসাদের আলোর ঝলসানি
পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড়
এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে
লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের?

আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

এই যে কবিতাগুলি সম্পর্কে আলোচনা করলাম, সেগুলি সবকটাই বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থের প্রথম অংশ মণিকর্ণীকার কবিতা। এর পরের অংশ হল খড়। সেখানে যেমন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হল শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে / সে কথা জানো না?, ঠিক তেমন মোরগঝুঁটি, খড় – এই কবিতাগুলি যেন এক ভিন্ন ভাষ্যে রচনা করল আস্তিকতার এক পরাবাস্তব। তরাই থেকে উঠে আসে রাত্রি/ শিখর থেকে গড়িয়ে আসে নিশ্বাস/ মস্ত এক চাকার নীল ঘূর্ণি”। প্রেম ও আস্তিক্যবোধের উচ্চারণ কত যে নীরব এবং নিখিল ও আকাশের মতো সহজ , মহৎ ও উদার হতে পারে, এই কবিতাগুলি তার উদাহরণ। আমরা যদি ধারাবাহিক ভাবে ‘খড়’ অংশের কবিতাগুলির দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাব এক শান্ত প্রতীকী কবির অন্তর্গত সংলাপ। হয়ত অঙ্গার কবিতাটির মধ্যে তার অন্তর্নিহিত ইঙ্গিত আছে।

আসলে শান্ত খুব, চুপ
গৃহী বলে মেনে নিই মনে;
হঠাৎ খুলেছে সব জামা
বুকে সূর্যাস্তের হামা
দাউ দাউ জ্বলে ওঠে নীল;

তারপর নীরব নিখিল
পড়ে থাকে ক্ষীণ অঙ্গার।
( দু-একটী ছবি/ অঙ্গার)

কী অনবদ্য সব হীরকখণ্ডের মতো কবিতা রয়েছে এই অংশে। কখনও মনে পড়ে যায় রুমির কথা আবার কখনও বা মনে পড়ে যায় গ্বালিবের কথাও। অনবদ্য প্রেমের কবিতাগুলির প্রেক্ষাপটে কিন্তু তখন ধোঁয়া উঠছে দূরে কোথাও। এক অন্তর্লীন বিষাদ এবং সংকটের হাওয়া ঘুরছে। কিন্তু তা কখনওই প্রেমকে অতিক্রম করে উঠতে পারেনি। কারণ প্রেম এখানে সেই অখণ্ড পূর্ণতা, যা কবিতাগুলিকে অন্ধকারের বিপ্রতীপে এক ভিন্ন আলো করে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে শুধু এই কাব্যগ্রন্থ নয়, বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা প্রেমের একটি কবিতা এখানে তুলে ধরা যায়-

এখন তুমি ভালো, কেননা এখন কোনো কথা বলোনি।

যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালে, শরীরে লাগল ঢেউ -

এই শুধু, আর কোনো কথা নেই
চোখের শুশ্রুষা হলো, এই শুধু।
( শুশ্রুষা)

এর পর আবার আমরা ধাক্কা খাই কবির সমকালীনতায়। ফিরে আসি যারা বাবরের প্রার্থনার মতোই আরেকধরনের ত্যাগের মাধ্যমে সমাজটাকে বদল করতে চেয়েছিলেন। যেমন ‘ কিছু না থেকে কিছু ছেলে’ নামক কবিতায় তিনি বলছেন- ‘ তবু তো দেখো আজও ঝরি/ কিছু-না থেকে কিছু ছেলে// তোমারই সেন্ট্রাল জেলে,/ তোমারই কার্জন পার্কে!” আব্বার তিনি লিখছেন হাসপাতালে বলির বাজনা নামক একটি রক্তপাত।


... ঠোঁটের ভিতর ফেনিল ঢেউ - এল, ঐ এল ওদের নিশান,
আমায় ছাড়! তুবড়ি ওঠে জ্ব’লে।
আমরা সবাই বলেছিলাম - শেষ সময়ের প্রলাপ।
হাসপাতালে বলির বাজনা - ভাই ছিল ফেরার।

যদি জরুরি অবস্থা এবং নকশাল আন্দোলনের কথা ভাবা যায়, তাহলে, এই কবিতাগুলি হল রক্তপাত, প্রতিবাদ এবং নীরব অনুচ্চকিত প্রতিরোধের এক প্রমাণ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এই কবিতাগুলির অনেকগুলিই নিকানোর পাররার-এর কবিতার অন্তর্গত প্রতিরোধ এবং শূন্যতার কবিতাগুলির সঙ্গে সমতূল্য। আমার কাছে অন্তত শাস্তি, কালযমুনা, পাখি বিষয়ে দুটি, মার্চিং সং, বিকল্প – এই কবিতাগুলি চরমতম রাজনৈতিক। রাজনৈতিক এই কবিতাগুলিতে স্পষ্টত ফুটে উঠেছে সেই সময়ের এক একটা ভাঙা চিত্র। রাজনীতিও যে কত সূক্ষ্মভাবে সামান্য স্পর্শের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়, তা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাগুলিতেও স্পষ্ট।

১) নিচু গলায় কথা বলার অপরাধে তার
যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড হলো।

হামলে পড়ল তার ওপর তিনটে ভালুক
ঠিক ভালুক নয়, প্রহরী
ঠিক প্রহরীও নয়, সত্যি বলতে, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

মেরুদণ্ড থেকে শাঁস তুলে নিতে নিতে
বলল তারা, খবরদার
এদিক-ওদিক তাকাবে না, কেবল গলা খুলে চেঁচাও।
(শাস্তি)

২) বন থেকে বেরুলেন টিয়ে
ইতিউতি তাকালেন
তারপর উঠলেন গিয়ে
বাবুদের মোটরে
এবার শিল্প হোক, এবার শিল্প হোক
বাবুরা মাতেন বনে
কোটরে।
( উপঘরণী)

৩) পেটের কাছে উঁচিয়ে আছ ছুরি
কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি
এখন সবই শান্ত, সবই ভালো।
তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
যে-কথাটাই বলাতে চাও বলি
সত্য এবার হয়েছে জমকালো।
(আপাতত শান্তিকল্যাণ)

৪) শব্দ কোর না
হেসো না বাচ্চা
চুপ
হাত-পা ছুঁড়ো না
দাঁত খুলে রাখো-
বাঃ
এবার শান্তি
স্বস্তি এবার
ওঁ!
(শৃঙ্খলা)

৫) সবাই যদি বলেও আমায়
মিথ্যে এবং মেকি
নিজের কথার জ্বালায় যদি
জ্বলে নিজের ডেরা
পুড়তে পুড়তে তখনও তার
জানলা দিয়ে দেখি
জীবনযাপন করছে যত
চাকরবাকরেরা।
(বাবু বলেন)

৬) ... এবার নিভৃত এই অপমানে শোকে
যে-কটি অন্তিম জবা উঠেছিল জ্বলে
আগুনে ঝরিয়ে দিতে হবে। আর তোকে
যমের দক্ষিণ হাতে দিতে হবে আজ
চায় তোকে দৃষ্টিহীন বধির সমাজ!
(নচিকেতা)

যতবার বাবরের প্রার্থনা – এই বইটির কাছে পৌঁছই, তত মনে হয় এই বইটি আজকেই লেখা হল। বইটির মধ্যে প্রথমেই যে ইতিহাসযানের কথা আলোচনায় এনেছিলেন, তার সঙ্গে আমি যুক্ত করতে চাই সময়যানের কথাও। তবে, তা কেবলমাত্রই এ কারণে নয়, যে , যে অস্থিরতা সে সময়ে এই বইয়ের অনেক কবিতার অন্তর্নিহিত জগতের রান্নাঘর, সেই অস্থিরতার চেয়েও আরও বড় কোনও অস্থিরতা আমাদের এই সময়েও চেপে ধরেছে। ১৯৭৬ কিংবা তার আগের যে স্বৈরতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে এই কবিতাগুলি রচিত, এখন তার চেয়েও ভয়ংকর এক ফ্যাসিবাদী ভারতবর্ষে আমাদের বসবাস। প্রতি মুহূর্তে আমাদের দিকে চোখ পাকাচ্ছে সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি। আজকেও যখন কবিতাগুলি পড়ছি, নিজেকে ও নিজের সময়কে যেন দেখতে পাচ্ছি কবিতাগুলির মধ্যে। পাঠক হিসেবে মনে হচ্ছে, না- হলেই বরং ভালো হত। যদি, এই কবিতাগুলি পড়ে বলা যেত ১৯৭৬ এর সমসাময়িক এই ঐতিহাসিক দলিল হয়ে বাবরের প্রার্থনা সময়ের কাছে সাক্ষ্য রেখে গেছে এবং যাচ্ছে, তাহলে হয়ত শান্তিতে থাকতাম। কিন্তু এখন শাসক, রাষ্ট্র এবং মৌলবাদীদের ভ্রুকুটির সামনে বসে এই কবিতাগুলি ছাড়া আমাদের আর অন্য কোনও অবলম্বন নেই। বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক কবিতার ইতিহাস যদি লেখা হয়, তাহলেও রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই কবিতাগুলিকেও আমাদের আগামীকালের দিকে এগিয়ে দিতে হবে। তার সঙ্গে মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি তিনি এক অস্তির দর্শনের কথাও বলেছেন এই কাব্যগ্রন্থে, বলেছেন ট্রান্সমাইগ্রেশন অফ সেলফ-এর কথাও। নীরবতা এবং স্বরের মধ্যে যে হাইফেন, তা অতিক্রম করেছেন কবি। জীবনজিজ্ঞাসার গভীরতম প্রশ্নগুলিকেও তুলে ধরেছেন। ফলে এই বাবরের প্রার্থনা নামক কাব্যগ্রন্থটিকে কিন্তু কোনও ছাঁচে ফেলতে পারবেন না কেউই। কবিতাও যে একধরনের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ যে কেবল সামনের কোনও শত্রু নয়, কখনও কখনও সেই শত্রু নিজের ভিতরেই লুকিয়ে আছে, টেনে বের করতে হয় তাকে। এই সামগ্রিকতার যুদ্ধকেই তিনি লিখে রেখেছেন এই কাব্যগ্রন্থে। খেয়াল রাখতে হবে, এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির নাম-ই ধ্বংস করো ধ্বজা। কিন্তু এই ধ্বজা আসলে কোথায়? যেমন তা বাইরে আছে, তেমন তা তো ভিতরেও আছে। আর তাকে ধ্বংস করা যায় আমার আত্মশক্তি দ্বারাই। এই কাব্যগ্রন্থ আত্মশক্তির মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই। সভ্যতার এই চরম সংকটে হয়ত এই কাব্যগ্রন্থটি আমাদের মতো প্রতিটি মানুষের গোপন রেডবুক অথবা নিত্য ম্যানিফেস্টো হয়ে উঠতে পারে।

আর কিছু না বদলাতে পারি, অন্তত নিজেকে তো বদলাই। শূন্যের ভিতরে যে অনেক ঢেউ। আত্মশক্তির এই কাব্যগ্রন্থটিকে আমরা বাংলার এক চিরকালীন সময়চেতনার কাব্যগ্রন্থ বলতেই পারি। আগামীকাল এই কাব্যগ্রন্থটিকে আবার নতুন করে পড়ুক, এই আশা রাখি সময়ের কাছে।

বাবরের প্রার্থনা। শঙ্খ ঘোষ। দেজ ।
প্রচ্ছদ করেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী।


লেখক পরিচিতি - হিন্দোল ভট্টাচার্য - কবি সাহিত্যিক




শিল্পবোধ, শিল্পের শক্তি
ফারুক সুমন

অন্ধের শক্তি যেমন হাতের যষ্টি। একজন শিল্পীর শক্তি তেমন তাঁর সৃষ্ট শিল্প। সভা-সেমিনার, অফিস-হাঁটবাজার ইত্যাকার কাজ সেরে দিনশেষে একজন শিল্পী একলা পথের সারণিক। নিঃসঙ্গতার অন্তর্গত অনুভব ধারণ করে অলক্ষ্যে চলে তার মানসভ্রমণ। মাঠের পর মাঠ হেঁটে চলেন শিল্পের খোঁজে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতি তাঁকে ব্যথিত করে। কত দুঃখকাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয় তাঁর অন্তর্লোক। তবুও অসীম কল্পাকাশে বিচরণ শেষে তিনি আনমনে লিখে ফেলেন-'আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।' (জীবনানন্দ দাশ) কিংবা এঁকে ফেলেন 'দ্য ক্রিয়েশন অব আদম' (মাইকেল এঞ্জেলো)।

শিল্পবোধ এবং শিল্পসৌন্দর্য সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। দেশকালসমাজ ও সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় শিল্পের ধরনও পাল্টে যায়। তবে শিল্পমাত্রই আনন্দিত অনুভবের সন্ধান দেয়। মনে অনাস্বাদিত স্বাদ তৈরি করে। শিল্পের গন্তব্য নিয়েও দর্শনগত বিভেদ রয়েছে। কারো কাছে শিল্প কেবল জীবনের ভিন্ন অনুরণন। জীবনকে অস্বীকার করে শিল্প হতে পারে না। কেউ আবার শিল্পকে একান্ত মনোজগতের সম্পদ মনে করেন।

শিল্পের রয়েছে নানা মাধ্যম। সেই বিবেচনায় যিনি লিখে শিল্প সৃষ্টির পথে হাঁটেন তিনি লেখক। যিনি রংতুলি হাতে নিয়ে চিত্রে মূর্ত করে তোলেন অন্তর্গত বোধের বিন্যাস, তিনি চিত্রকর। যিনি প্রস্তরখণ্ড কেটে-ছেনে মূর্ত করে তোলেন অনিন্দ্য সুন্দর ভাস্কর্য, তিনি ভাস্কর। এভাবে মানবমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্যাবৃত বোধের বিচিত্রপ্রকাশ ঘটে নানামত্রিক শিল্পাঙ্গিকে। শিল্পের ইতিহাসে শিল্পাঙ্গিকের এই শ্রেণিকরণ অসংখ্য মাত্রায় আভাসিত হতে দেখা যায়। যেমন লেখার ক্ষেত্রে কেউ কবি, কেউ গল্পকার কেউবা ঔপন্যাসিক। কেউ নাট্যকার, কেউ প্রাবন্ধিক, কেউ ছড়াকার। কেউ গীতিকার, কেউ সঙ্গীতশিল্পী, কেউবা আবার নৃত্যশিল্পী।

যে কেউ চাইলে লেখক হতে পারেন। তবে যে কেউ চাইলে সৃজনশীল লেখক হতে পারেন না। যিনি দলিল লেখেন তিনিও লেখক। আবার যিনি সংবাদ লেখেন তিনিও লেখক। লোকে স্বীকার করুক বা না করুক। সৃজনশীল লেখক হতে গেলে প্রকৃতিদত্ত কিছু গুণ থাকতে হয়। শূন্য থেকে অর্থপূর্ণ নতুন কোনো ব্যঞ্জনাবহ বার্তা কেবল সৃজনশীল শিল্পীই দিতে পারেন। মহৎশিল্পী কিংবা লেখক যা কিছু সৃষ্টি করেন, অন্যরা সেসবের পুনরাবৃত্তি করেন মাত্র। তবে সৃজনশীল শিল্পী চাইলে অসৃজনশীল লেখায় অবতীর্ণ হতে পারেন। তাঁর সেই সক্ষমতা আছে বৈকি। একর্থে অসৃজনশীল সৃষ্টি বলে কিছু নেই। তার বিপরীতে কিছু সৃষ্টি মৌলিক ও মহৎ ভাবনাকে উসকে দিয়ে ধ্রুপদীর মর্যাদা পায়। কালজয়ী হয়ে দীর্ঘকাল মানুষের সমাদরে আদৃত হয়। আবার কিছু সৃষ্টি সাময়িক। প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়ে আবার জলের বুদবুদের মতো দ্রুত মিলিয়ে যায়। তবে শিল্প কিংবা শিল্পী যেহেতু নতুনের আরাধনা করেন। সেহেতু অসৃজনশীল কোনো কিছু শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে না। এমনকি তার স্রষ্টাকেও শিল্পী বলে অভিহিত করা সমীচীন নয়।

দৃশ্যমান সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে শিল্পী যখন ভাবসরোবরে ডুব দেন। তখন অন্তর্গত স্বপ্ন, কল্পনা, অভিজ্ঞতা ও আবেগের রঙ দিয়ে সেই সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। তখনই শিল্প সৃষ্টি হয়ে পরস্পরের মাঝে সঞ্চারিত হয়। একজন শিল্পী শিল্পসৃজনমুহূর্তে নিজের মধ্যে মগ্ন থাকেন। সৃজনপ্রক্রিয়া সম্পাদন শেষে অন্যের নিকট প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এজন্যেই ধারণা করা হয়, যে সৃষ্টি অন্যের মনে সঞ্চারিত হয় না। কিংবা মনকে আন্দোলিত করে না। শিল্পের মানদণ্ডে সেই সৃষ্টি শিল্পের অভিধা পেতে পারে না। প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের 'আধুনিক সাহিত্য'-এ উদ্ধৃত শিল্প সম্পর্কিত মন্তব্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে:

'মানুষ বিশ্বসংসারে যাহা ভালোবাসে, আর্টের দ্বারা তাহার স্তব করে।...কেবলমাত্র বাছাই করিয়া জগতের যাহা-কিছু বিশেষভাবে সুন্দর, বিশেষভাবে মহৎ, তাহরই প্রতি আমাদের রুচিকে বারংবার প্রবর্তিত করিতে থাকিলে আমাদের একটা রসের বিলাসিতা জন্মায়।' মূলত শিল্পীর মনে জন্ম নেওয়া 'রসের বিলাসিতা'কে প্রকাশের বাসনা থেকেই সৃষ্টি হয় শিল্প।

সৃজনমুহূর্তে একজন শিল্পী যেন নিস্তব্ধ, নিশ্চল পাথরের নীরবতায় মগ্ন থাকেন। তাঁর পরিপার্শ্ব অচেনা, ধূসরতায় ম্লান হয়ে যায়। কেবল লেখকসত্তায় উদিত সূর্যের আলোয় চকচক করে চেতনার মণি। ঝলসে যাওয়া অনুভব নিয়ে শিল্পী আলোময় করে তোলেন আপন শিল্পভুবন। পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধুদের কোলাহলে থেকেও তিনি যেন নির্জন কোনো এক উপত্যকার বাসিন্দা। মরীচিকাময় কোনো বালুকাবেলায় তাঁর গমনাগমন। পাহাড় ডাকে আয়, শির উঁচু করে বাঁচি। নদী ডাকে আয়, ভেসে থাক জলের কল্লোলে। বৃক্ষ ডাকে আয়, বেঁচে থাক মৌনতার ভাষা আত্মস্থ করে। আকাশ ডাকে আয়, এখানে পাবে অবারিত উড়ান। এভাবে নিসর্গবিস্ময়ের ঘোর আর বাস্তবের আহরিত অভিজ্ঞতার মথিত নির্যাস শিল্পী'কে সৃজনোন্মুখ করে তোলে।

একজন মহৎশিল্পী নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে এগিয়ে যান আরাধ্য উপত্যকার দিকে। মহৎসৃষ্টির মহোৎসব কেবল তার অন্তঃপুরে। নিজের সৃষ্টিকে অতিক্রমণের দুর্নিবার আকর্ষণ মেনে নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, তবে পরিশেষে দেখা যাবে একই বৃত্তের ভেতর তার চিত্তের পরিভ্রমণ। চর্বিতচর্বণের ফলে সুমিষ্ট শিল্পসুধার বদলে পাঠক পাবে অম্লজলধারা। শিল্পীকে বিরামহীন আত্মপ্রস্তুতি ও আত্মনির্মাণের ভেতর দিয়ে আত্মঅতিক্রমণের পথে অগ্রসর হতে হয়। মৌলিক শিল্পী নিজেই নিজের সৃষ্টির কাছে বারবার নতজানু হয়ে থাকেন। বোধকরি একেই বলে শিল্পসমর্পণ।

শিল্পে অনুভবের চূড়ান্ত চাষাবাদ হয়। শিল্পানুভবের প্রকাশ ব্যক্তির আনন্দনিকেতনে কতটা প্রভাবসঞ্চার করেছে। তার নিরিখে শিল্পের শ্রেণিকরণ ও সফলতা নিরূপিত হয়। ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুভবের তারতম্য দেখা যায়। অনুভবের এই ভিন্নতা ও স্বাধীনতা শিল্পবোধের জন্য জরুরি। কারণ শিল্প সবসময় যুক্তি ও বাস্তবতার মুখাপেক্ষী নয়। যুক্তির বিবেচনায় শিল্প খুঁজতে গেলে শিল্পানন্দ ক্ষুণ্ণ হয়। হুমায়ূন আজাদ বলতেন, 'শিল্পকলা হচ্ছে নিরর্থক জীবনকে অর্থপূর্ণ করার ব্যর্থ প্রয়াস'।

শিল্প নিরেট সংবাদপত্র নয়। সংবাদপত্রের মতো শিল্প বুঝতে গেলেই বিপদ। শিল্পের গমনাগমন যুগপৎ অনুভব আর উপলব্ধির পথে। যেখানে আছে রসপূর্ণ নানামাত্রিক বৈভব। ফলে একজন শিল্পান্বেষীকে ক্ষণকালের জন্যে হলেও বৈষয়িক মোহ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। তবেই তার মনোজগতের বিশুষ্ক প্রান্তরে প্রবাহিত হবে শিল্পরসধারা। একজন শিল্পসমালোচক বড়জোর শিল্পের সম্ভাব্য অর্থবহতার ইঙ্গিত দিতে পারেন। তবে সর্বতোভাবে শিল্পপর্দা উন্মোচিত হয়ে গেলে সেখানে নিখাদ শিল্পের অনিবার্যতা থাকে না।

আলতামিরার গুহাচিত্রে হাজার বছর আগে কে বা কারা, কেন বাইসনের ছবি এঁকেছিলেন। সেই প্রশ্ন গৌণ হয়ে গেছে। কালক্রমে বড় হয়ে উঠেছে গুহাচিত্রের শিল্পসৌন্দর্য। আদিকাল থেকে যুগের আবহ এবং পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় শিল্পের আঙ্গিকগত টেকনিক বদলে যায়। যিনি যুগপৎ মহৎ ও মৌলিক শিল্পী, তিনি শিল্পের প্রকরণ নিয়ে নিরীক্ষা (Experiment) করেন। কারণ শিল্পের অভিনব প্রকাশ মৌলিক শিল্পীর চিরদিনের সাধনা। যিনি নিরীক্ষায় সফল হন তিনিই কেবল নব আঙ্গিকের শিল্পস্রষ্টা হিসেবে সর্বকালে সমাদৃত হন। শিল্পাঙ্গিকের এই নিবিড় নিরীক্ষা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ব্যতিক্রমী সৃষ্টির প্রয়াসে কখনোবা শিল্প অচেনা ও দুর্বোধ্যতার ঝুঁকিতে পড়ে। একজন মহৎশিল্পী এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি অতিক্রম করে তবেই সফল হন। স্নানের সময় ময়লাযুক্ত শরীর পরিষ্কার করার জন্য যেমন গাঘঁষা ভালো। তেমনই ঘঁষার মাত্রা বেশি হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। চামড়া ছিলে গিয়ে ক্ষত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বৈকি। শিল্পের ক্ষেত্রেও একথা খাটে। দশকে দশকে ব্যতিক্রম কিছু দেখাতে গিয়ে সাহিত্যান্দোলন কিংবা সাহিত্যতত্ত্বের প্রয়োগ দেখা যায়। উৎসুক ও অনুসন্ধিৎসু শিল্পীরা পৃথক সরণি আবিষ্কারের প্রয়াসে এধরনের নিরীক্ষা জারি রাখেন। আদতে দেখা গেছে, এইসব তত্ত্ব কিংবা শিল্পান্দোলন অভিনব শিল্পসৃজনে সবসময় প্রভাববিস্তারি হয়নি।

মহৎশিল্প ধরা-অধরা বোধের মাঝখানে পাঠককে দাঁড় করায়। বাস্তবের চেয়েও ভিন্ন এক বাস্তবতার চত্ত্বরে ফুল ফোটায়। যেখানে বাতাসের তালে ঢেউ খেলে চিরহরিৎ ধ্রুপদী সুন্দর। এমন নান্দনিকতাবোধ বিষয়বাহিত হয়ে উন্নীত হয় যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে। যেখানে বাস্তবের হুবহু সমাধান খোঁজা বৃথা। কেবল ভাবসরোবরে চলে অনন্ত সন্তরণ।

ধরা ও অধরার লীলারহস্য শিল্পকে অধিকমাত্রায় নন্দনের যোগান দেয়। মানুষ স্বভাবতই জ্ঞেয় এবং অজ্ঞেয়র মাঝামাঝি থেকে ছটফট করে। বোধকরি মহৎশিল্প মানবমনের এই অন্তরতম ছটফটানিকে উস্কে দেয়। বাস্তবতার ভেতরবাড়ি থেকেও উঁকি দিয়ে দেখতে ও দেখাতে চায় অদেখা আলো-অন্ধকার। সশব্দ চিৎকার ছেড়ে কখনোবা মৌন হাহাকারের ভেতর নিজেকে সঁপে দেয়। এই যে শিল্পবোধ, এটা প্রথমত সহজাত ব্যাপার। ক্রমশ এর সাথে যুক্ত হয় পঠনপাঠন ও অভিজ্ঞতার নির্যাস। শিল্পবোধ অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সবসময় জরুরি নয়। সৃষ্টি, প্রকৃতি এবং নিবিড় অনুভবের জগৎ মানুষের মনে শৈল্পিক রুচিবোধ তৈরি করে। অর্থাৎ দৃশ্য এবং অনুভব, এই দুইয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয় ব্যক্তির শিল্পমনের বিমূর্ত বীজতলা।

শিল্পীর শক্তি তাঁর সৃষ্ট শিল্পের প্রাতিস্বিকতার ভেতর আভাসিত হয়। নানামাধ্যমে কাজ করলেও একজন শিল্পী সব শাখায় সমানভাবে প্রশংসিত হন না। যদিওবা কদাচিৎ হয়। এঁদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। শিল্পবাতায়নে এটাও একধরনের সীমাবদ্ধতা। যিনি কবি হিসেবে সফল। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রশংসিত নাও হতে পারেন। যিনি চিত্রকর হিসেবে জগদ্বিখ্যাত। তিনি অন্য মাধ্যমে প্রাতিস্বিক পথ আবিষ্কারে ব্যর্থ হতে পারেন। সৃজনপ্রতিভার এই বৈচিত্র্য শিল্পের ব্যাপকতাকে ইঙ্গিত করে।

শিল্পের সাথে আনন্দযোগের ব্যাপারটি নতুন নয়। এই আনন্দযোগ তখনই সম্ভব, যখন শিল্পে থাকে সর্বাঙ্গসুন্দরের ইশারা। ফলে শিল্পে যিনি নিরেট আনন্দ অন্বেষী। তার কাছে শিল্পবোধ কিংবা শিল্পের শক্তি স্বতন্ত্র। পক্ষান্তরে, যিনি শিল্পে সমাজ ও বাস্তবতার প্রতিফলনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তার কাছে হয়তো আনন্দ মুখ্য নয়। তিনি শিল্পকে জীবনবাস্তবতা ও উপযোগিতার নিরিখে নিরূপিত করেন।

সর্বোপরি, শিল্প অন্তর্গত হার্দিক ব্যাপার। অনুভব কিংবা উপলব্ধির নিবিড়তম প্রদেশে শিল্পের বাস। শিল্পবোধ কিংবা শিল্পশক্তির পরিশেষ নিক্তি ও নিয়তি মানবমন। মানবমনের চিরকালীন রহস্যদ্বীপ শিল্পসমর্পণ, শিল্পভ্রমণ, শিল্পবোধ, শিল্পসৌন্দর্য কিংবা শিল্পচিত্তের উৎসদুয়ার উন্মোচন করে। বোধকরি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় একারণেই বলেছেন, 'নদীর বুকে যেমন ঢেউয়ের পর ঢেউ জাগে, মনের মধ্যেও তেমনি চিন্তার পর চিন্তা জাগে। ঢেউ জলের ভিতর হইতে উঠিয়া জলের ভিতরেই আবার মিলাইয়া যায়। চিন্তাও মনের অতল হইতে উঠিয়া আবার মনের অতলেই আত্মগোপন করে। নদীর বুকে ঢেউয়ের ওঠাপড়ার যেমন বিরাম নাই, মনের মধ্যেও চিন্তার তরঙ্গ তেমনি কেবলই উঠিতেছে, কেবলই পড়িতেছে।' [প্রবাসী, প্রথম খণ্ড, ১৩৪১ বাং, পৃ. ১২৪]


লেখক পরিচিতি - ফারুক সুমন : কবি ও প্রাবন্ধিক| বাংলাদেশ|




‘আমার’ শঙ্খ ঘোষ
পাতাউর জামান

কবির কী দায় থাকে – এ প্রশ্নের উত্তর ঠাউরে দেওয়া সহজ, কিন্তু উপলব্ধি করা কঠিন। খোদ কবিরাই এই দায়ের ব্যাখ্যা দিতে এত তৎপর যে কবিতা লিখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে বিস্তর ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে জিনিসটা বাজারে নিয়ে আসেন, তা হয় বাসি, না হয় কৃত্তিম সাজানো, না হলে একান্ত তার কিংবা ফেবুতে প্রচণ্ড বাহবা পাওয়ার জন্য কিছু একটা। এরপর থাকে ধরা-ধরি, একে ওকে তেল মারা এবং ব্যাগ বয়ে দিয়ে ঠিক জিনিসটা জুটিয়ে নেওয়া। কিন্তু কিছু কিছু কবির বেলায় এমন সব মন্তব্য বা বলা ভালো সরলীকরণের এমন সব সমীকরণ খাটে না। তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা এবং অল্প। এঁদের মধ্যে পড়েন শঙ্খ ঘোষ। সে কারণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শঙ্খ ঘোষের আকাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে সরকারি পুরস্কারের ব্যাপারটা নিয়ে এমন কুবিচার হয় যে ঐ ব্যাপারটা সম্পর্কেই আমাদের অনাগ্রহ জন্মে গেছে তবে শঙ্খ ঘোষের প্রতিভাবে স্বীকৃতি জানিয়ে এবার পুরস্কারদাতারাই পরিচ্ছন্ন হলেন।’

আমাদের বাংলার সাহিত্যের বাজারে শঙ্খ ঘোষের অনেক প্রকার ভেদ আছে। একজন শঙ্খ ঘোষ আছেন কবি, একজন আছেন প্রাবন্ধিক, একজন আছেন বড়োদের লেখক, একজন আছেন ছোটদের লেখক – এই রকম একই শঙ্খ ঘোষের নানান দিক আছে। কিন্তু আমার সঙ্গে শঙ্খ ঘোষের পরিচয় কলেজের সিলেবাসে। প্রথমে রবীন্দ্র নাটকের নোট নেবার সময় আমার বন্ধু রবীন্দ্রনাথের কাছে। গল্পটা আরেক বন্ধুকে বলতেই বলেছিল,

আরিব্বাস রবীন্দ্রনাথ আপনার বন্ধু?
ক্ষমা কর। ইনি সেই রবীন্দ্রনাথ নন্‌!
মানে?
মানে খুব সরল।
একটু ব্যাখ্যা করলে ভালো হত?

আসলে একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন, যিনি আমাদের সকলের। কিন্তু এখন আমরা নানান রবীন্দ্রনাথের সন্ধান দেখি। কখনো এদলের, কখনো ওদলের। কখনো ছোটোলোকের, কখনো বড়োলোকের।

কিন্তু এর মধ্যে কোন রবীন্দ্রনাথ আপনার বন্ধু!

কেউই না। রবীন্দ্রনাথ মন্ডল বলে আমার এক বন্ধু ছিল। খুব আজব ছেলে। কলেজ ছাড়ার পর ওর সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি। কলেজে ও ক্লাস করত না। সারাক্ষণ লাইব্রেরিতে থাকত। বই পড়ত। আমরা যখন সপ্তান্তে একবার লাইব্রেরিতে ক্লাসের সাজেশন বই তুলতে যেতাম, ওকেই ধরতাম। ওর কাছে সব বইয়ের হদিস থাকত। ও কখনো কলেজে ফার্স্ট হয়নি। ভালো নম্বর পায়নি। একদিন আমাকে রবীন্দ্র নাটকের উপর নোট লিখতে গিয়ে ও শঙ্খ ঘোষের একটা বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল, আরিব্বাস এ দেখি বাকি নোট লেখকদের আলাদা। কেমন একটা নতুন বিবরণ। নোট নেওয়া যায় না ভালো, কিন্তু পড়তে খুব ভালো লাগে। তখন খুব একটা পাত্তা দিইনি।

বেশ লাগছে শুনতে। তারপর?

কিন্তু থার্ড ইয়ারে গিয়ে আর একজন শঙ্খ ঘোষের পরিচয় পেয়েছিলাম সিলেবাসে। এই তো জানু পেতে...। প্রচণ্ড মায়ায়, প্রচণ্ড আবেগে একালের কবিতা সঞ্চয়ন থেকে জেরক্স করে সারা রাত চেয়ারের হাতল ধরে পড়ে গেছিলাম। আমার একটা মাছ ভাণ্ডার ছিল। ওখানে ক্রিকেট ব্যাট কেনার জন্য কয়েন জমাতাম। কিন্ত মাছ ভাণ্ডারকে আর অক্ষুন্ন রাখা যায়নি। পরের দিন ছাত্র বাসভাড়া দিয়ে কলেজ পাড়ায় নিজে গিয়ে বইটা সংগ্রহ করেছিলাম।

তারপর ছিল শঙ্খ ঘোষ নিয়ে কবিতার আমার একাকী যাত্রা। বিদ্যাধরী নদীর উপর দিয়ে তরঙ্গহীন গতির টানে যেভাবে কচুরিপানার উপর বক বসে ভেসে ভেসে যায়, অনেকটা সেরকম। কিন্তু এই যাত্রায় ছেদ পড়েছিল ২০০৭ সালে শিশিরমঞ্চে প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা শোনার পর। বক্তৃতার শিরোনাম ছিল – ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’। সেখানে আমি আমার আর এক শঙ্খ ঘোষকে পেয়েছিলাম। যিনি ‘আমি’র কথা বলেন না, বলেন ‘আমাদের’ কথা। যেখানে শুধু একক নয়, বহুত্বের কথা থাকে। এবং এই বহুত্বের মধ্যে একটা বহুত্ববাদী ভারতের ধারণা খুঁজে পেয়েছিলাম। এখনও যখন ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ বইটা পড়ি সেই বক্তৃতার স্মৃতি মনে পড়ে। আর যখন বহুত্ববাদের সংকট দেখি, এর থেকে বেরোনোর উপায় কী, সেটার জন্যও এ বইয়ের দারস্ত হই। কেন হই?

আমির মধ্যে যে এককের ধারণা আছে, সেই ‘ব্যক্তি আমি’ ‘আমাদের’ মধ্যে মিশে একটা বহুত্ববাদের জন্ম দেয়। সেখানে কেউ সংখ্যা লঘু বা সংখ্যা গুরু নয়। আমি আমি যোগ হয়ে আমাদের জন্ম হয়। যেখানে শুধু আমার সঙ্গে তার মিলন বা সমন্বয় হয় না, আমি এবং সে মিলে যে আমার জন্ম হয়, সেই প্রকল্প সাম্য, সমতা এবং সম্মানের ক্ষেত্র তৈরি করে। একটা সময় “অভীষ্ট ‘আমরা’ ” ছিল ‘শহুরে উচ্চশক্ষিতের গণ্ডি’। এখনও যে নেই, তা নয়। আছে এবং বেশ বহাল তবিয়তে আছে। সেই সময় সেই “অভীষ্ট ‘আমরা’ ”র বিপরীতে ছিল ‘তাঁহারা’। এখন এই ‘তাঁহারা’ হল ‘তারা’। যদিও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাহারায় চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে সম্মান করেছেন ‘তাঁহাদের’। কিন্তু এখন ‘আমরা’ আমি হয়ে ‘তাঁহাদের’কে তারা করে দিয়েছে। কিন্ত ‘আমি’ বা ‘আমার’ বা ‘তাঁহাদের’ প্রকল্পে দাঁড়িয়ে শঙ্খ ঘোষ সব সময় “ ‘আমি’কে ‘আমারা’য় পাল্টে নেবার কথা” লিখছেন।

এখন অধিকাংশ এই আমার আমির শোনার অভ্যাস নেই, আছে কেবল বলবার, দাবি শোনাবার, যুক্তি খাড়া কবার এবং এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে সে যেটা আশা করে, সেটা হল – জেতবার। কিন্তু সব সময় সে জিততে পারে না, আর পারে না বলেই বাঁধে দ্বন্দ্ব। কখনো নিজের সাথে, কখনো অপরের সঙ্গে। আপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলে তৈরি হয় ঘাত-প্রতিঘাত। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে সম্প্রতি মানুষের মধ্যে ঘাত প্রতিঘাত থাকলেও উভয় ভাবে উভয়ই জয়ী হয়েছে। শুধু কমেন্টের যুক্তি সাজিয়ে নিজের মধ্যে চেঁচায়, আত্মরতিতে ভোগে। এখানেই জন্ম হয় আমির মধ্যে একটা ফ্যাসিস্ট শক্তির। “ ব্যক্তিগত স্তর থেকে সামাজিক রাজনৈতিক স্তর পর্যন্ত এই ‘আমি’ তখন হয়ে ওঠে এক ঘোষণা-শব্দ, চিৎকার-শব্দ, যার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে অবারণ একটা জোর দিয়ে বলবার প্রতাপভঙ্গি। আর সেই চোরাপথে এগিয়ে আসে ফ্যাসিবাদ।” এই কারণে হয়তো বা আমরা উগ্রবাদের দারস্ত হচ্ছি বা স্বীকার হচ্ছি। ফলে সম্প্রতিকে বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে খুব একটা সমস্যা হয় না। যেমন এখন হচ্ছে না আমার দেশের উগ্রজাতীয়তাবাদ, উগ্রধর্মীয় মৌলবাদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উগ্র বিশৃঙ্খলা। এবং এমন একটা সময়ে অবস্থান করছি যেখানে শঙ্খ ঘোষ বুঝতে সাহায্য করেছেন, কেন আমাদের দেশ এখন ‘আমি’ আর ‘ওরা’তে ভাগ হচ্ছে? কেন ‘আমরা’ হতে পাচ্ছি না!

ঐ প্রথমে যে প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, কবির কী দায় থাকে? – আশা রাখছি এ প্রশ্নের উত্তরটা আমাদের জানা।

লেখক পরিচিতি - পাতাউর জামান : অধ্যাপক ও লেখক।

0 comments: