0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in


বইমেলার হেঁশেল

কলকাতা

বইমেলা না দইমেলা? সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় শাখার তদানিন্তন অধিকর্তা শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় আশির দশকে কোনও একসময় বইমেলায় গিয়ে এইরকম মন্তব্য করেছিলেন। তখন আসলে (সম্ভবত) মাদার ডেয়ারি প্লাস্টিকের কাপের আধারে বইমেলায় দই বিক্রি শুরু করেছিল। বিপননের নিরিখে সেইসময় যা ছিল অত্যন্ত অভিনব। দইও যে আইসক্রিমের সমকক্ষ হতে পারে সহনাগরিকদের এর আগে তেমন ধারণা ছিল না। আর ছিল বিজলি গ্রিল – যাদের ফিশ রোল বা ফিশ ফ্রাইএর সঙ্গে আমার আজীবন চলে আসা প্রেমকাহিনীর সবিস্তার বর্ণনা আমি আগেই করেছি। সত্যি বলতে কি আজ এই একবিংশ শতাব্দীর দু-দুটি দশক পার হয়ে আসার পর একথা কল্পনা করাও কঠিন যে গত শতকের সত্তর বা আশির দশকে বইমেলায় ঠিক কি ধরণের খাবার পাওয়া যেত। সেই খাদ্যসংস্কৃতি আজকের তুলনায় এতটাই আলাদা ছিল যে নব্বইএর দশক বা তার পরে যাদের জন্ম বহু চেষ্টা করেও মনে হয় না তারা সেদিনের ছবিটি আঁকতে পারবে।

বইমেলা তখন হত রবীন্দ্র সদনের উল্টোদিকের মাঠে, এখন যা মোহর কুঞ্জ বা তার সংলগ্ন এলাকা। সেখানে ওই ক’দিন অজস্র মানুষের পদচারণার ফলে ধুলো উড়ত। যাকে ধুলো না বলে ধুলোর ঝড় বললে অত্যুক্তি হবে না। আজকের মত ফুড কোর্ট তখন ছিল না। তাই খাদ্যবস্তু এবং দর্শক-ক্রেতাকে ধুলোর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে দেওয়া হত জল। আর তাতে তৈরি হত কাদা। সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা! তা এরই মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে গুটিকয়েক খাবারের স্টল ছিল, তার মধ্যে মাদার ডেয়ারি বা বিজলি গ্রিলের মত হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে ব্র্যান্ডের উপস্থিতি ছিল খুব সামান্য আর সীমিত। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে ওই সময়ের প্রেক্ষাপটটি একটু আলোচনার মধ্যে আনতে হবে।

সত্তরের মাঝামাঝি যখন কলকাতা বইমেলা শুর হয়, তখনও এই শহরের বাতাসে বারুদের গন্ধের রেশ রয়ে গেছে। সাতাত্তরে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট সরকার। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বর্জন করা হল কোকাকোলার মত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডও। তাই এই পরিবেশে দেশজ কিছু ব্র্যান্ড ছাড়া যে আর তেমন উল্লেখযোগ্য নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তাই সেইসময়ের বইমেলায় যে খাদ্যবস্তু বলতে রোল, চাওমিন, ফুচকা, ঝালমুড়ি, মোগলাই পরোটা, ফিশ ফ্রাই, ফিশ রোল কি বড়জোর বিরিয়ানি ছাড়া আর কিছু মেলা যে ভার ছিল, তাতে মনে হয়না অবাক হওয়ার উপাদান কিছু ছিল। পাস্তা বা পিৎজার অনুপ্রবেশ আমাদের হেঁশেলে তখনও সেভাবে ঘটেনি। তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই মাস্টার শেফ হয়ে উঠিনি আর সারা দুনিয়ার রান্নাঘরও আমাদের উঠোনে হুমড়ি খেয়ে পড়েনি। ভাগ্যিস!! তখন প্রতিটি পদের একটি নিজস্ব চরিত্র ছিল। তাদের একটিকে অন্যের থেকে আলাদা করা যেত। মনপসন্দ খাবারের তালিকাটা তখন ছোট হলেও তার মান অন্যরকম ছিল। আর তার সঙ্গে অবধারিতভাবে এসে পড়ত একটা আড্ডার সুবাস। যা বাড়িয়ে দিত কোনও এক অতি সাধারণ খাবারের স্বাদও। একে কি অণুঘটক বলবো? যত দিন গেছে, ভেবে দেখেছি খাবার যত সাধারণই হোক না কেন আড্ডার সঙ্গগুণে তা আমূল বদলে যেতে পারে। তখন সেই বস্তুটি সেই মুহূর্তে হয়ে ওঠে অনাস্বাদিতপূর্ব। কোনও এক স্টলে দিনভর কাটানোর পর সন্ধের মুখে যখন আমাদের হাতে পৌঁছত ঝালমুড়ির ঠোঙা আর চায়ের ভাঁড় ল্যাম্পপোস্টের নিচে জমে থাকা কুয়াশা আর ধুলোর স্তর ভেদ করে যেটুকু আলো গিয়ে পড়ত মানুষজনের মুখে, তাতেও স্পষ্ট চেনা যেত উজ্জ্বল মুখগুলি।

ফ্রাঙ্কফুর্ট

নব্বইএর দশকের মাঝামাঝি বাহরিন এর স্বল্প প্রবাস শেষ করে কলকাতায় ফিরে এসে যোগ দিলাম নবমুদ্রণ এ। পরবর্তী প্রায় চোদ্দ বছর যে সংস্থার সঙ্গে আমার সহাবস্থান চলবে। এই কর্মসূত্রেই পরিচয় হল বাদল বসুর সঙ্গে। বাদলদা! এই মানুষটির সঙ্গে দেখা না হলে মনুষ্য চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত। সে কথা অন্যত্র। আপাতত সময়টা পিছিয়ে নিয়ে যেতে হবে বছর কুড়ি। তখন আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি ইউরোপের প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে। বই ছাপার কাজ ওদেশ থেকে এখানে আনতে। একদিন যখন আমাদের আরিফ রোডের কার্যালয়ে এই আলোচনা চলছে, বাদলদা বললেন, ‘আমার সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্ট চল’। ব্যস, সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে বাদলদার সঙ্গে উঠে পড়া গেল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এর কলকাতা- লন্ডন উড়ানে। আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট যখন পৌঁছলাম, সন্ধে হয়েছে। বাদলদা রওনা হলেন ওঁর হোটেলের দিকে আর আমি ইয়ুথ হস্টেল অভিমুখে। স্বভাবতই প্রচণ্ড উত্তেজিত আমি কারণ পরদিনই আমারা যাব ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়। পৃথিবীর বৃহত্তম এই বইমেলাটি সম্পর্কে শুনেছি অনেক, বিশেষত অলোকদার (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত) কাছে। কিন্তু সে তো নেহাতই বই আর লেখক নির্ভর আলোচনা। কিন্তু কেমন হয় এই ধরণের একটি মেলার হেঁশেল সংস্কৃতি? সেটা বুঝতে লেগে গেল আরও কয়েকটি দিন। প্রথমত এই মেলার যে চরিত্র, তা কলকাতার তুলনায় একেবারে আলাদা। দেখলাম ওখানে বই কেনাবেচা হয়না। হয় সত্ত্ব কেনাবেচা। এরকম বিপুলায়তন এবং এত সুসংগঠিত কোনও মেলা ইতিপূর্বে দেখা হয়নি। দ্বিতীয়ত সেই প্রথম দেখলাম খাওয়ার জায়গাটি আলাদাভাবে চিহ্নিত। প্রাতরাশ বা মধ্যাহ্নভোজনের সময় সবাই সেই নির্দিষ্ট এলাকায় যাচ্ছেন সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তারপর একটি টেবিলে গিয়ে বসছেন। এই পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে মসৃণভাবে তেল দেওয়া একটি যন্ত্রের নিপুণতায়। একদিন দুপুরে এইসময় ঘটলো একটা মজার ব্যাপার। আনান্দ পাবলিশারর্স এর স্টলে সেদিন বাদলদার সঙ্গে আমি, সুবীরদা (সুবীর মিত্র) আর সুবীরদার স্ত্রী জয়তিদি। দুপুরে খাওয়ার সময় ঠিক হল আমারা চাইনিজ খাব। সেই মতলবে আমরা চারজন হাজির হলাম একটি চাইনিজ রেস্তরাঁর সামনে। ওমা এতো বিশাল লাইন! এখানে দাঁড়ালে তো অন্তত একঘণ্টার আগে খাবার পাওয়া যাবে না! বাদলদা তখন একটা অদ্ভূত ব্যাপার করলেন। সটান চলে গেলেন কাউন্টার এর কাছে আর সেখানে যে ভদ্রমহিলা ছিলেন, তাঁকে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘দিদিমনি আমাদের কিছু ব্যবস্থা করে দাও, ভীষণ খিদে পেয়েছে’। এতে দেখলাম ভাবলেশহীন সেই মুখেও একটা হাল্কা হাসি ফুটে উঠলো আর তৎক্ষণাৎ তিনি একটা টেবিলে আমাদের বসার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই ঘটনায় অপেক্ষমাণ সেই জনতার মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেলো কারণ এই ধরনের দাক্ষিণ্য ওদেশের সংস্কৃতিতে একেবারে বেমানান। খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি আরেকটি বিষয় পশ্চিমি সামাজিকতার সঙ্গে মিশে আছে। তা হল পান। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ওয়াইন পান। তাই লক্ষ্ করতাম বিকেল তিনটে-চারটের মধ্যে সবাই কাজ শেষ করে স্টলের মধ্যে একটা টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসেন। খোলা হয় ওয়াইন আর থাকে চিজ অথবা শুকনো ফল। আড্ডা জমে ওঠে কলকাতার মতই। মাঝে মাঝে শুধু শোনা যায় হাসির আওয়াজ। এরই মধ্যে দেখা হয়ে যায় পুরনো কোনও বন্ধুর সঙ্গে। তখন বন্ধুতা মিশে যায় খাওয়া-দাওয়ায় এবং তখনই হয় সেই ম্যাজিক। তখন কলকাতা মিশে যায় ফ্রাঙ্কফুর্টের সঙ্গে। তখন চিজ-ওয়াইন আর মোগলাই পরোটার মধ্যে যোগসূত্র হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব। এক বইমেলার খাদ্য-সংস্কৃতি অন্যটির থেকে সম্পূর্ণত আলাদা হওয়া সত্ত্বেও। তখন খাবারের স্বাদ ছাপিয়ে জেগে থাকে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, বন্ধুত্বের ইতিহাস।



0 comments: