4

গল্প - ঝান্‌কু সেনগুপ্ত

Posted in

- “হ্যালো-অভিমন্যুদা-”
- “আরে, মনন! কেমন আছিস? পাত্তা নেই কী ব্যাপার?”
- “আপনার সাথে জরুরী দরকার। দেখা করা যাবে?”
- “চলে আয়!”
- “কোথায়?”
- “তুই কোথায় আছিস?”
- “টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে।”
-“ঠিক আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে আমি আসছি, সাদার্ন এভিনিউ’য়ের মুখে-চা’এর দোকানটায়; আরে গতদিন যেখানে চা’ খেয়েছিলাম!”
- “হ্যাঁ, ঠিক আছে।”

ফোনটা রেখে মনন টালিগঞ্জ থেকে হাঁটতে শুরু করে। ইচ্ছে করেই! যেন মিছিলে হাঁটছে! কলেজ জীবনের কথা মনে হচ্ছিল! তখনও লড়াই ছিল! মিছিল ছিল! আন্দোলন ছিল!

সন্ধ্যে হল। ফুরফুরে হাওয়া বইছে! সাদার্ন আভিনিউ’য়ের এই ঠেকটা বেশ লাগে মননের! তার উপর, উপরি পাওনা অভিমুন্যদা!
- “এরা চা’টা কিন্তু বেশ করে!”-চা’ য়ে গলা ভিজিয়ে অভিমন্যু বলে!
- “অভিমন্যুদা-”
- “বল্‌ ভাই। দাঁড়া, তার আগে একটা বিড়ি ধরাই!”
- “সিগারেট খাবেন?”
- “কী সিগারেট?”
- “গোল্ড ফ্লেক, মিডিয়াম’ চলবে?”
- “ব্রান্ডেড, কী বল্‌?” হাসতে হাসতে সিগারেটটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে অভিমন্যু।
- “কী দেখছেন?”
- “দেখছি-এর ডিজাইন, গেট আপ, আর প্রেজেন্টেশন-”
- “বা-ব্বা! এসব তো ম্যানেজমেন্ট কোর্সে’ পড়ান হয়!”
- “হুম! সব নদী তো সেই সাগরেই!”
- “মানে?”
- “ছোটবেলায় পিঠে খেয়েছিস?”
- “হুম্‌! মা বানাত! পাটিসাপটা, পুলি পিঠে! তবে ঠাকুমার হাতে সেই চিতল পিঠে বা ভাপা পিঠে- আহা!
- “হুম্‌! এবার ধরা যাক- চিতল পিঠে! প্রথমে ডিজাইনিং! ওটা হল মাটির সরা! তারপর গেট আপ! ওটা হল অল্প আঁচে চালের গুঁড়ো কতটা ফুলে উঠল এবং সব শেষে প্রেসেন্টেশন! চিতল পিঠের সাথে ঝোলা গুড়! আহা- লা জবাব!
- সত্যিই অভিদা, অপূর্ব! ম্যানেজমেন্ট ক্লাসে এটা বোঝাতে হয়তো চারটে ক্লাস লেগে যেত, তবুও হয়তো অনেকের কাছেই ব্যাপারটা ধোঁয়াশাই থেকে যেত!
- “হুম্‌! চল্‌ হাঁটি।” হাঁটতে হাঁটতে অভিমুন্য সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দেয়!
-“ফ্লেভারটা বেশ! তবে যাই বলিস ভাই, বিড়িতে কিন্তু মাথাটা বেশ খোলে! এবার বল্‌, আমাকে হঠাৎ তলব করার হেতুটা কী?”
- “অভিদা, সম্পাদক মশাই ঐ অ্যাসাইনমেন্ট’টা আমাকেই দিয়েছেন!”
- “কোনটা? ওই তোর ‘-গনতান্ত্রিক বিপন্নতার মূল কারণ সামাজিক আন্দোলনহীনতা’?”
- “হ্যাঁ! ঠিক ধরেছেন!”
- “শুরু করেছিস?”
- “করেছি, কিন্তু গুলিয়ে যাচ্ছে!”
- “হুম্‌!”

ওরা হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রসরোবরে জলের কাছে ঘাসের উপর বসে পড়ে! বসন্তের হাওয়া বইছে! একফালি চাঁদের প্রতিবিম্ব সরোবরের জলের উপর দুলছে! অভিমন্যু বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে! তারপর আপনমনে বলে চলে- “ওই যে জলের উপর চাঁদের ছায়াটা দুলছে, গনতন্ত্র ব্যাপারটা অনেকটা ওই চাঁদের প্রতিবিম্বের মতন! দোদুল্যমান!”

সন্ধ্যে রাত্রির বসন্তে দু-চারটে মাছ মাঝে মাঝে ঘাই মারছে! নিজের ছন্দেই চাঁদের ছায়াটা দুলছে! গনতন্ত্রের সাথে চাঁদের দোলা, মনন এসব বুঝে ওঠার আগেই অভিমুন্য হঠাৎ করে একটা ঢিল ছোড়ে জলের উপর! ছায়াটা ভেঙ্গে যায়! অভিমন্যু বলে চলে- “যে কোনও অস্থিরতার সময় গণতন্ত্রটা’ও এভাবেই ভেঙ্গে যায়! তখন যে কোনও মুল্যে রাষ্ট্রের কাঠামোটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে এই শাসন ব্যবস্থা! চাঁদের ছায়াটা অপসৃয়মান! গনতন্ত্রটাও! আসলে গণতন্ত্রটা ওই চাঁদের মতন! একটা স্বপ্নের কনসেপ্ট! যাই হোক, তুই সামাজিক আন্দোলনহীনতা’ বিষয়টাকে ভাল ধরেছিস! এই আন্দোলনটা কিন্তু যে কোনও সিস্টেমেই জরুরী!”

- “কিন্তু অভিদা, লেখাটা ঠিক দাঁড়াচ্ছে না!”
- “দাঁড়াবে! তোর মতন করেই তুই লেখ! দেখবি কিছু একটা বেরিয়ে আসবে!”
- “আসলে আমার কি মনে হয় জান অভিদা, ৭০ দশকের পর সে ভাবে কোনও আন্দোলনই গড়ে ওঠেনি!”
- “হুম্‌! তোর মতে এর কারণটা ঠিক কী?”
- “কি জানি! আজকাল মানুষ কেমন স্বার্থপর হয়ে উঠেছে!”

অভিমন্যু একটা বিড়ি ধরায়! তারপর বলে- “হঠাৎ করেই তো মানুষ স্বার্থপর হয়ে ওঠেনি! এর পিছনে আসল কারণটা হল এলিয়েনেশন! বিচ্ছিন্নতা! ধর্‌, পঞ্চাশের দশকে আমাদের এখানে আন্দোলনের একটা প্রেক্ষিত ছিল! উদ্বাস্তু হয়ে প্রচুর মানুষ এ দেশে আসল! কলোনি গড়ে উঠল! ছোট ছোট দরমার বাড়ি! উপরে শতছিন্ন টিন! নোংরা নর্দমা! খাটা পায়খানা! রোজগার নেই! শিক্ষা নেই! খাবার নেই! তবু ওই জান্তব জীবনেও একটা ব্যাপার ছিল- আত্মসন্মান! আর এই সন্মানটুকু বাঁচাবার জন্য প্রয়োজন ছিল একত্রিত হওয়ার! লড়াই করে বেঁচে থাকার একটা অন্যরকম আনন্দ ছিল!” বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অভিমন্যু। চাঁদটা মাঝ আকাশের দিকে সরে এসেছে! সরোবরের জলে চাঁদের প্রতিবিম্বটা এখন আর পড়ছে না! একটা মাতাল হাওয়া বইছে! ওরা কেউ কোনও কথা বলছে না! রাত বাড়ছে।

অনেক রাত পর্যন্ত অভিমন্যুর ঘুম হয় না! চাঁদ! সেই ছোটবেলায় দেখা চাঁদ! বয়স হয় নি এখনও! একই রকম স্বপ্নময় বৈচিত্র্য! প্রথম চাঁদের আলোয় প্রেমিকার মুখ আর বেড়ার ফাঁকে ঝরে পড়া চাঁদের আলো, একইরকম রোমান্টিক!

‘চাঁদ ও গনতন্ত্র’, এরকম একটা লেখা হলে মন্দ হয় না! নিদেন পক্ষে একটা নাটক! আচ্ছা- এই চাঁদের আলো নিয়ে বানিজ্য করলে কেমন হয়! এখন তো সবটাই বাজারের কবলে! প্রকৃতির বিনোদনে চাঁদের মায়ামাখানো আলো মানুষ ভুলতে বসেছে! অথচ সেই ছোটবেলায় চাঁদের সাথে লুকোচুরি- ভাবতেও ভাল লাগে!


(২)

খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, তবু যেতে হল! মননের অনুরোধটা ফেলতে পারল না অভিমন্যু! আর ‘গনতান্ত্রিক মঞ্চের’ অনেককেই অভিমন্যু চিনত! দু-একজনকে তো সেই সত্তর দশক থেকেই! মননের গণতান্ত্রিক বিপন্নতা’ আর এই ‘গণতান্ত্রিক মঞ্চে’র উদ্যোগ, কোথাও যেন একটা মিল! বিচ্ছিন্ন হয়েও যে যার নিজের জায়গা থেকে অনেকেই কিছু ভাবছে! কিছু না হওয়ার থেকে তবু কিছু করার চেষ্টা!

নেতাজি নগরে একটা গলির মুখে মনন দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকে অভিমন্যুকে দেখে মনন এগিয়ে এল- “অভিদা, এদিকে।”
- “হ্যাঁ মনন, এসে গেছি! সময় ঠিক আছে তো?”
- “একদম ঠিক! হেঁটে এলে?”
- “না। পল্লীশ্রী’র মোড় পর্যন্ত বাসেই এসেছি।”
- “তারপর এতোটা পথ হেঁটে? অটো’তো ছিল!”
- “হ্যাঁ, ছিল। তবু একটু হাঁটলাম! অভ্যাসটা যদি ফিরে পাওয়া যায়!”

মনন চুপ করে রইল! মনে মনে ভাবল, হয়তো এ ভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হল না! অভিদার এখন কী ভাবে চলে কে জানে! একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে মনন বলল- “তোমার শরীর ঠিক আছে তো অভিদা?”
- “মন ঠিক থাকলেই শরীর ঠিক! তুই কেমন আছিস- বল্‌? তোর লেখাটা কতদুর? লেখাটা জমিয়ে লেখ। এই বিপন্ন সময়ে তোর ওই লেখাটা জরুরী!” কথাটা বলতে বলতে মননের পিঠে হাত রাখে অভিমন্যু!

মনন কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে! কতদিন পর কারও নিঃস্বার্থ হাতের ছোঁয়া! সমস্ত শরীরে একটা ভাল লাগার শিহরণ! মনন অবাক হয়ে বলে- “অভিদা, তুমি আমার লেখা নিয়ে এতোটা ভাবছ?”

- “আসলে মনন, সব মিলিয়ে অবস্থাটা ভাল নয়! আমরা ক্রমাগত মূল সমস্যা থেকে সরে আসছি! এই যে রাষ্ট্রের অতি ক্ষমতায়নে গনতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত্টুকুও না মানা, অর্থনীতির বেশীর ভাগটা যাদের দখলে তাদের স্বার্থে সমস্ত নিয়ম কানুনগুলো যেমন খুশি পাল্টে দেওয়া আর যুক্তিহীন ধর্মীয় উন্মাদনাকে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে শাসনের জাঁতাকলটাকে নিজেদের ইচ্ছেমত চালিয়ে যাওয়া- এসব মেনে নেওয়া যায় না! তবুও আমরা অনন্তকাল চুপ করে থাকি, প্রশ্ন করতেও ভুলে যাই অথবা ভুলে যেতে বাধ্য হই!” একটানা কথাগুলো বলে অভিমন্যু কিছুক্ষন চুপ করে থাকে! মনন কথা খুঁজতে থাকে! অভিমন্যু নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বলে-” তবুও এগোতে তো হবেই! এই ভাবনা নিয়েই তোকে লিখতে হবে- মনন! যাক সে সব। চল, কোন দিকে?”

- “ওই তো ডানদিকের শেষ বাড়িটার একতলায়।”
- “ও, তো কাছেই! এক বিড়ি পথ! ধরিয়ে নি - খাবি নাকি একটা? ব্রান্ডেড! পতাকা’ বিড়ি। মুর্শিদাবেদের আম্বানি!”
একটু হেসে মনন বলল- “সত্যি অভিদা, তুমি সেই আগের মতনই রয়ে গেলে!”
একটা ছোট্ব দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিমন্যু বলল- “আগের মতন?”

ডানদিকের শেষ বাড়িটার গেটের সামনে বড় একটা সাইনবোর্ড, তাতে লেখা ‘হুল্লালো -এখানে ওয়েস্টার্ন ডান্স শেখান হয়’! পাশে কয়েকজন যুবক যুবতী’র নাচের ভঙ্গিমা!
- “এই বাড়িটা?”-অভিমন্যু জিজ্ঞেস করে!
- “হ্যাঁ, এনট্রানসটা পাসের প্যাসেজে। ওদিকটায় গৌতমদার ছেলে শুভ্রনীলের নাচের স্কুল। গৌতমদার ঘরটা পিছন দিকে।”

সরু প্যাসেজ দিয়ে ঢোকার পরই সিঁড়ির নীচে অবিন্যস্ত কয়েক জোড়া চটি জুতো। সিঁড়ির পাশেই পিছনদিকে একটা লম্বাটে ঘর। একটা তক্তপোষ। পাঁচ ছটা প্লাস্টিকের চেয়ার। পাশের টেবিলে একটা বড় কাঁচের বোতলে জল আর কিছু বই-পত্তর। দুটো বই চোখে পড়ার মতনই যেন রেখে দেওয়া! একটা গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর অন্যটি স্টিফেন হকিং! অভিমন্যু আসার পরই উপস্থিত সবার চোখে মুখে একটা চাপা উচ্ছাস আর আলোড়ন!

- “আরে আসুন আসুন, অভিদা”! -গৌতম এগিয়ে এসে হাতটা ধরল।

দুটো হাতল দেওয়া একটা কাঠের চেয়ার ছেড়ে মধ্যবয়সী ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন!

- “আপনি এখানে বসুন, আমি তক্তপোষে বসছি!”
- “ধন্যবাদ! আমার পায়ে একটু অসুবিধে-” অভিমন্যুর কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়েই ভদ্রলোক বললেন- “আরে সেইজন্যই তো ওই চেয়ারটাতেই আপনি বসবেন।”

মুখটা তুলে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে অভিমন্যু বলল- “আরে শ্রীকান্ত! তুমি! কেমন আছ?”

- “ভাল, অভিমন্যুদা! ভাল!”
- “কতদিন পর!”
- “হ্যাঁ, প্রায় চল্লিশ বছর!”
- “তোমার সেই ব্যাথাটা? এখনও কি ওরকম কষ্ট হয়?”
- “আপনার মনে আছে?”
- “মনে তো অনেককিছুই আছে, শ্রীকান্ত! যাক সে সব কথা! তোমার সাথে পরে কথা বলব।”
- “হ্যাঁ, আমাদের আসল আলোচনাটা তাহলে শুরু করা যাক।” -বৃদ্ধ ভদ্রলোক চশমাটা ঠিক করতে করতে বললেন।
- “হ্যাঁ, দিলীপদা। শুরু করুন।” -গৌতম বলল।

দিলীপ বাবু এতক্ষন একটা খাতায় কিছু লিখছিলেন! লেখা থামিয়ে বলতে শুরু করলেন- “আসলে আমরা কিছু সমাজ সচেতন মানুষ সাম্প্রতিক এই দমবন্ধ পরিস্থিতিতে একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা ভাবছি-”

- “তার মানে? গণতান্ত্রিক আন্দোলন তো হচ্ছে!”- পাস থেকে মননের মন্তব্য!
- “আঃ, মনন! দিলীপদাকে শেষ করতে দে!” -গৌতম বলল।
- “কিন্তু গৌতমদা- শুরুতেই ধাক্কা খেলে গাড়ীটা তো চলতেই চাইবে না! গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ ব্যাপারটা অদ্ভুত একটা ধোঁয়াশা! সবাই তো গনতন্ত্র’ গনতন্ত্র’ বলে লাফাচ্ছে!”

শ্রীকান্ত একমনে এতক্ষণ টেবিলে রাখা একটা বই ওলটাচ্ছিল! বই থেকে মুখটা তুলে বলল- “কথাটা কিন্তু কিছু ভুল বলেনি মনন!”

মনন একটু যেন উত্তেজিত হয়েই বলে উঠল- “আর ফাঁকতালে গনতন্ত্রের নামে বেনামে কর্পোরেট শাসন চালু হয়ে গেল! ‘আমরা এখনও ‘কী করিতে হইবে’র আলোচনার টেবিলে!”

বৃদ্ধ ভদ্রলোক এতক্ষন মুচকি মুচকি হাসছিলেন! এবার বললেন- “আমি কিন্তু শেষ করিনি! আমাকে বলতে না দিলে-”

বাপ্পাদিত্য একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে লম্বা ঘরটার একদম পিছনে বসেছিল। বৃদ্ধের কথার মাঝখানে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল- “হঠাৎ করে কোনও কিছু শুরু করা যায় না! শুরু করার জন্যও একটা প্রস্তুতি লাগে। আজকের আলোচনাটা অনেকটাই প্রস্তুতিপর্ব! একটা অর্কেস্টাতে সুরগুলো না মিলিয়ে, স্কেলগুলো ঠিক না করে, লয়গুলো না বেঁধে, বাজনা শুরু করলে বেসুরো বাজবেই!”

- “এই যে শুনছ?”-উপর থেকে সুরেলা মিষ্টি গলা ভেসে এল! গৌতম উঠে এগিয়ে গেল। বাপ্পাদিত্য’ও গৌতমের পিছন পিছন যেতে যেতে ফুট কাটল- “প্রস্তুতিপর্বের প্রথম পাঠ এবার শুরু হবে!”

গৌতম একটা বড় ট্রে’তে ৮/১০ কাপ লাল চা নিয়ে টেবিলে রাখল। বাপ্পাদিত্য নিয়ে এল একটা সুন্দর প্লাস্টিকের কৌটো, তাতে ভর্তি ক্রিম কেকার’ বিস্কুট।

চা খেতে খেতে শ্রীকান্ত বলল- “আমাদের প্রস্তুতির প্রথম পাঠে, প্রথম উপপাদ্য- ‘পারস্পরিক পরিচয়’!
- “তারপর আলাপন!”-বাপ্পাদিত্য বলল।

বেশ কিছুক্ষণ চলল প্রথম পাঠ! এর মধ্যে দু-একজন উঠে পিছন দিকের দরজা খুলে ঘুরেও এলেন!

অভিমন্যুও উঠে বলল- “আমিও এক মিনিট আসছি।”

পিছনের সান-বাধানো উঠোনে এসে অভিমন্যু একটা লম্বা শ্বাস নিল! উঠোনের ডান দিকে একটা বাথরুম। উল্টোদিকে বাড়ির সীমানার দেওয়াল ঘেঁষে একটা বড় আমগাছ! গাছটার চারদিকটা উঁচু করে বাঁধানো! কী মনে করে উঠোনের আলোটা নিভিয়ে দিল অভিমন্যু! আমগাছটার বাঁধানো অংশে বসতে গিয়ে, আলো-আধাঁরির সংশয়ে বিবর্ন হয়ে যাওয়া গাছটিকে জিজ্ঞেস করল- “কেমন আছ?”

গাছটি কোনও কথা বলল না! টুপ টুপ করে দুটো শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ল অভিমন্যুর কোলে! একটা পাতার গায়ে লেখা- ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ আর একটিতে ‘গ্যালিলিও থেকে হকিং- সৃষ্টির আদি থেকে অন্তে’! বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল যেন! পরশু দিন সকালের কথা মনে হল!

সাইকেল করে বাজার থেকে ফেরার পথে সোনারগাঁয়ের ভিতরের রাস্তাটায় ঢুকে চমকে উঠল অভিমন্যু! পিচ বাঁধানো সুন্দর রাস্তার দু-পাশের ঘাসগুলোকে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে! সন্ধ্যের সময় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে!

অবিনাশবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলবেন- “হারামজাদা! তোদের গায়ে অ্যাসিড ছড়াইলে কেমন লাগবো? শুয়ার! অখন আবার আগুন ধরাস! ওই ধোঁয়ায় আমাগো মতন বুড়া মানুষের কষ্ট হয়, হেঁইটা বোঝোস না? না বুঝলে তোগো বাপরে গিয়া জিগা- শুয়ারের দল!”

জর্দা পান চিবোতে চিবোতে অজয় উত্তর দেবে- “এ দাদু, বাপ তুলো না বলছি! মিউনিসিপালিটি’র পারমিশন লিয়েই এসব হচ্ছে! সৌন্দর্যায়ন বুঝলে?”

বাবলু হে হে করে সায় দেবে- “শালা, বুড়ো হুব্বা! কোথা থেকে এসব মাল এসে জোটে কে জানে! দেসে্‌ কত উন্নয়ন হচ্ছে!”

চেঁচামেচি শুনে সাধনা এসে জানালা বন্ধ করে দেবে! অবিনাশকে জোর করে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বলবে- “তুমি অগো সাথে পারবা?”

- “তাই বইল্যা সবকিছুতেই চুপ কইরা থাকোন যায় না- বুঝলা? এই চুপ কইরা থাইকতে থাইকতে দ্যাশটার বারোটা বাজছে!” অবিনাশ নিজের মনে গজ্‌ গজ্ করতে থাকবে, করতেই থাকবে! ‌

- “অভিদা!” -বাপ্পাদিত্যের ডাকে ঘোর কাটে অভিমন্যুর!
- “হ্যাঁ, চল!”

আবার ঘরে এসে নির্দিস্ট চেয়ারে বসে অভিমন্যু! আলোচনা শুরু হয়!

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শোষণ! কর্পোরেট! জাত, পাত, ধর্ম! প্রস্তাব পাঠ! সংশোধনী! আশু কর্তব্য! আন্দোলনের রূপরেখা! গণতান্ত্রিক আন্দোলন! তর্ক-বিতর্ক!

অভিমন্যু অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে! অন্য এক অনুভূতি! মনের মধ্যে খোঁজ চলে অবিরাম! সত্তর দশক থেকে অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত! বৃত্তটাই শুধু বড় হতে থাকে!

বৃত্তের বাইরে কী ভাবে বের হবে অভিমন্যু!

4 comments:

  1. সময়টা ভালো ফুটে উঠেছে।

    ReplyDelete
  2. Excellent is the word ! Excellent presentation of the content.The present socio-political scenario of the country has come out beautifully in all its different shades .
    Congratulations to the author ! Waiting for more such sensitive piece which pricks our conscience.

    ReplyDelete