0

ধারাবাহিক - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





















The best way to keep a prisoner from escaping is to make sure he never knows he’s in prison

নতুন করে ঘোষণা করেছে সরকার। সব নিয়ম শিথিল এবার। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সব চলতে পারে। শপিং মল সিনেমা হল সব খুলবে। ডিসটেন্স বজায় রেখে। লোকাল ট্রেন একদম কড়া নিয়মে চলবে। কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী এলাওড হবেনা। দুর্গাপুজো চলে আসছে। বেশির ভাগ পুজোকমিটি এবার পুজোর রমরমা বন্ধ রেখেছে। দু একটি ছাড়া। শহরের নামজাদা নেতাদের পুজো বন্ধ হচ্ছেনা। দর্শনার্থীরা বিশেষ পাস সংগ্রহ করে আসতে পারবেন। বাকিরা টিভিতে দেখবেন।

কস্তুরীদের ‘এইদিন’ অনলাইন ক মাসে ভালো দাঁড়িয়ে গেছে। রণজয় বসু এর জন্য কস্তুরীকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।

মনীষাদের স্কুল অনলাইন চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই স্কুল খুলতে পারে বলে মনে হয়। এ নিয়ে সকলেই উদ্বিগ্ন। অভিভাবক থেকে শিক্ষক শিক্ষিকা সবাই। গ্রুপে অনেকেই মন্তব্য করছেন। বাচ্চাদের এভাবে অসুখের মুখে ঠেলে দেওয়া কি ঠিক হবে? অ্যাডমিনিস্ট্রেশান মিঠেকড়া মন্তব্য রাখছে।

সবচেয়ে সমস্যা যা, তা হল মানুষজন ব্যাপক হারে কাজ হারিয়েছেন। মনীষার সেই প্রতিবেশিনীকে আর ছাদে ওয়ার্ক আউট করতে দেখা যায়না। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে ওর বরের চাকরিটা নেই। কোম্পানি অনেক টপ টায়ার এক্সিকিউটিভকে খারিজ করেছে। এরকমভাবে অস্তিত্বের সংকট কখনও তৈরি হতে পারে মনীষা ভাবেনি।

এর মধ্যে সরকারী প্রতিনিধিরা সমানে বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। নিজের সুরক্ষা নিজের কাছে। কাজেই যান আর যাই করুন, নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন।

স্বামীনাথন এ নিয়ে বলছিলেন সেদিন। ওয়েল অর্ণব, ডু ইউ রিয়েলি থিংক পিপল ক্যান সারভাইভ আ সেকেন্ড অ্যাটাক? ভাইরাস উইল বি মোর পাওয়ারফুল ইউ নো? এখন এভাবে সব নিয়ম তুলে দিলে…। বহুদিন পর অর্ণব কথা বলছে। স্বামীনাথন চেয়ে আছেন ওর দিকে। অর্ণব দূরে তাকিয়ে ছিল -আমার মনে হয় মানুষ রোগে যেমন কষ্ট পেয়ে মরেছে কাজ হারিয়ে না খেতে পেয়েও কষ্টেই মরবে। নাও উই হ্যাভ টু ডিসাইড হুইচ ওয়ান উই প্রেফার। স্বামীনাথন ধাক্কা খেলেন -ইউ মিন আ চয়েস বিটুইন আ বুলেট এন্ড আ গ্যাস চেম্বার? অর্ণবের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ -আপনি সত্যিই অসাধারণ ডাক্তার। গ্যাস চেম্বার মনে হলো কেন? একিউট ব্রেদলেসনেস হয় বলে? স্বামীনাথন মাথা নাড়েন -নো। ইন কেস অফ গ্যাস চেম্বার ইউ নিড অ্যান অরগানাইজড প্রসেস দ্যাট ক্যান বি এরেঞ্জড ওনলি বাই…ইউ নো। থেমে গেলেন স্বামীনাথন। এত পজিটিভ লোক এরকম হয়ে যাচ্ছেন কেন? অর্ণব চেয়ে থাকে।

সেদিনও অতীন এসেছিল। তুতুনকে কাছের একটা অত্যন্ত মাঝারি স্কুলে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। অতীনের জন্যই হয়েছে। মনীষা যদিও তুতুনের সঙ্গে এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি।

অর্ণব কাগজ নিতে শুরু করেছে আবার। কতকাল ভয় পেয়ে এভাবে গুটিয়ে থাকব? কাগজ পড়ব না, খবর নেবো না। এভাবে বাঁচতে পারবনা। মাধু চেষ্টা করেছিল কাগজকে স্যানিটাইজ করতে। অর্ণব কড়া ধমক দিয়েছে। “একদম ওসব কোরো না মাধু। হসপিটাল ফরটি পারসেন্ট পে কাট করেছে। চালাতে হবে। বাড়ির লোন চলছে। কাগজটা ফেলে রেখে দাও। আমি দু ঘণ্টা পর হাতে নেবো”। মনীষার পুরনো দুধওলা এসেছে আবার। ওর ছেলে সোনার কাজ করত আমেদাবাদে। ফিরে এসেছে। বলছিল -মাজি, বহুত দুখ। টিরেনে পানি নাই, খাওয়া নাই, কুছ নাই। গাড়ি ভটক গেইল। সাত দিন পর এলো। বেটা বলছিল, বহুত লোগ গুজরে গেইল। জওয়ান বেটা দুবলা এইল। এমন দুঃখের সময় ওর থেকে দুধ নেওয়াই তো ভালো। অন্তত ওদের পেটের ভাতটুকু জুটবে। মাধু শুধু বলেছে -রামশরণ দুধ ভালো দিও। বুড়ো দুধওলা মাথা নেড়েছে -নাহি নাহি, ও বাত নাহি দিদি। ডগদরবাবু বহুত মরিজকে ভালো করিয়েছেন। পাপ লাগবে হামার।

অর্ণবকে অতীন বলেছে। ছেলের সঙ্গে সময় কাটা দাদা। ছেলেটা তোরই। দিনের শেষে ওর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি না। মনে রাখিস। অর্ণব মনে মনে হাসে। কত প্ল্যান! কত কিছু প্ল্যান! টাকা জমিয়ে রাখা! আর তো তিনটে বছর। তারপর ছেলে কী পড়বে কোথায় যাবে, টাকা রাখতে হবে না? স্টেটসে গেলে? ওরা স্কলারশিপ কমিয়ে দিয়েছে। ওদের সরকার এ ব্যাপারে একেবারে বেনিয়া। আর দেশের মধ্যেকার প্রিমিয়াম ইন্সটিটিউট গুলোও তো ভালোই খরচসাপেক্ষ। সব গুড়ে আপাতত বালি। মনীষা সম্ভবত স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেবে। অনলাইন ক্লাসে অনিয়মিত হচ্ছে কিছুদিন। শক্তি পাচ্ছেনা। স্কুলেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এরপর ঘরের বাইরে বেরনোর মতন মনের জোর আর পাবে বলে মনে হয়না। অর্ণব লক্ষ করেছে, মনীষা এখনও অস্বস্তি বোধ করে। ছেলেকে নিয়ে বড় লজ্জা। কাজেই অর্ণবকে বুঝে চলতে হবে।

সাহিল আর সরিতা এরই মধ্যে বিয়ে সেরে নিলো। শুধু বারো নম্বরের লোকেরাই ছিল। বাইরে থেকে কস্তুরী অতীন আর অর্ণব এসেছিল। অতীন সঙ্গে করে তুতুনকে এনেছিল। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে আনন্দ করেছে ওরা। যদিও বারো নম্বরে বেশির ভাগ মানুষেরই এখন আয় নেই। বেকার।

স্বামীনাথন শঙ্খ অর্ণব আবার আগের মতো রেগুলার পেসেন্ট দেখা শুরু করেছে। প্রেরণা আসছে আবার। স্বামীনাথন স্বভাব অনুযায়ী মজা করে চলেছেন -কি গো মেমসাহেব? আমরা তো ভাবলাম তুমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবার ডেলিভারি করাবে। প্রেরণা অন্য সময় হলে রেগে দুটো কথা বলত। কিন্তু আজ হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলল -মনিদা কতদিন তোমাদের দেখিনা। গলা শুনিনা। স্বামীনাথন চোখ বড় বড় করেন -সেকি? তাহলে অনলাইন মিটে ওগুলো কে আসত? তোমার ভুত? -না না মনিদা ঠাট্টা নয়। আই মিসড এভরিবডি। মাই সিনিয়রস মাই কলিগস মাই পেসেন্টস সব সব। স্বামীনাথন ওর হাত ছুঁয়ে স্নেহের স্বরেও মজা করেন -ওয়েল ওয়েল। কাল একটু ভালো করে শুক্তো করে এনো তো। নারকেল দেওয়া শুক্তো খেলেই আমার দেশের কথা মনে পড়ে। প্রেরণা চোখের জল মুছে হাসে -আনব। সিওর। শঙ্খ আর অর্ণব চোখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসে। স্বামীনাথন ছিলেন বলে যুদ্ধটা সোজা হয়েছে। যদিও ওরা জানে, এ হাসপাতালে দুজন ডাক্তার আর একজন নার্সের মৃত্যু হয়েছে এই অসুখে, জানে যে অসুখটা আজ নয় কাল ফিরতে পারে, তবু প্রাণ খুলে বেঁচে নেওয়া আর কি। শঙ্খ যেমন বলে -লিভ ফর দ্যা মোমেন্ট ব্রো!

সেদিন মনীষার মোবাইলে একটা অজানা নম্বর থেকে কল এলো -হ্যালো? কে বলছেন? ওদিক থেকে এক পুরুষের গলা শোনা গেল -মনীষা? আমি বাপনদা বলছি রে। তোরা ঠিক আছিস? মনীষা একটু চমকেছে। এতদিন পর কার থেকে নম্বর পেলো বাপনদা? বলল -ভালো আছি গো। তোমরা কেমন আছো? – চলছে রে। এখানে তো দারুন রিসেশান হিট করেছে। কী যে করব বুঝতে পারছি না। মনীষা একটা কাজ করে দিবি আমার? -কি? বলো? -আমি ও বাড়িটা বিক্রি করতে চাই। একটু ব্যবস্থা করে দিবি?

মনীষা ফোন রাখার পর অনেকক্ষণ বসে রইল। বাপনদার সঙ্গে কান্তিজ্যাঠা বা জেঠিমার শেষ দেখা হয়নি। ওরা যেন উবে গেছে। মনীষা অতীনের মুখে শুনেছে ও পাড়ায় একমাত্র হারুকাকা রয়ে গেছে। সব শেষ। বাবার জন্য ভাইয়ের জন্য মন কেমন করে ওঠে। কান্তিজ্যাঠাদের বাড়িটা কোয়ারানটাইন সেন্টার করা হয়েছিল। বস্তির এক গুচ্ছের লোক ওখানে ছিল। মনীষাদের বাড়িটা নাকি শর্ট সার্কিট হয়ে জ্বলে গেছিল। বাপনদা জানে?

সেদিন কস্তুরী বাড়িতে বসেই কাজ করছিল। সোশ্যাল মিডিয়াতে ওকে থাকতেই হয় কাজের খাতিরে। নিজেদের কাজের লিঙ্ক নিজেরাই শেয়ার করে। সোশ্যাল মিডিয়া এখন হেট স্পিচে ভর্তি। মেনলি তিনটে ইস্যু ট্রেন্ডিং। প্রথম, একটা হিন্দি সিনেমা রিলিজ করেছে যা নাকি কারও কারও অনুভুতিতে মারাত্মক আঘাত করেছে। দ্বিতীয়, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা শুরু। আর তৃতীয়, অমানবিক ছাঁটাই। আশ্চর্য! মানুষ কত তাড়াতাড়ি বিভীষিকা থেকে মুক্তি চায়!

ও উঠে গিয়ে সেই লাল খাতাটা নিয়ে আসে। উলটে পড়তে পড়তে আবার ফিরে যায় দিনগুলোতে। বন্দিত্বের দিনগুলো। এখনও কি বন্দী নয়? আর সব স্মৃতিই তো ফিরে দেখা উচিত। আর এ তো টাটকা স্মৃতি! সব স্মৃতির মধ্যেই তো কিছু পিছুটান থাকে। শুধু সেই গ্রুপ মেসেজের প্রিন্ট আউটগুলো ও গ্যাসের কাছে নিয়ে যায়। পুড়িয়ে দেয়। ও স্মৃতি নয়। দুঃস্বপ্ন। কেউ বিশ্বাস করে নিজের দুঃস্বপ্নের ভার ওকে দিয়েছিল। বিশ্বাস থাকুক। দুঃস্বপ্নের দলিল পুড়ে যাক।

গৌতম এখন লালু কালুকে খাইয়ে এসে শুয়েছে। লাল খাতাটা দেখে বলে ওঠে -মুখস্থ করে ফেলবে তো? কস্তুরী চোখ বড় বড় করে তাকায়। কৃত্রিম রাগ দেখতে গৌতমেরও ভালো লাগে। একটা সম্পর্কও তো স্বাভাবিক ছিলনা গত কয়েকমাস!


কৈফিয়ত

একটি বিখ্যাত ক্লাসিকের ইন্সপিরেশানে লিখতে বসেছিলাম। লেখার প্রয়োজনে কিছু বাক্যবন্ধ ব্যাবহার করেছি যার উৎস জানিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি।

1. The Plague by Albert Camus
প্রথম পর্বে এই উপন্যাসের কথা উদ্ধৃত করেছি।

2. The Dreamers by Karen Thomas
দ্বিতীয় পর্বে এই উপন্যাসের কথা।

3. Illness as Metaphor by Susan Sontag
তৃতীয় পর্বে ব্যবহার করেছি এই বইটির একটি উক্তি।
চতুর্থ পর্বে ড্যানিয়েল ডিফোর যে বিখ্যাত কথাটি কাম্যু ব্যবহার করেছেন সেটিই দিয়েছি।

4. The Years of Flood by Margaret Atwood
পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্বের শুরুতে এই বইয়ের কথা ব্যবহার করেছি। পঞ্চম পর্বে ‘প্লেগ’ থেকে উদ্ধৃতি আছে।

5. Fyodor Dostoyvosky
সপ্তম পর্বের উদ্ধৃতিটি বিখ্যাত। উপরোক্ত লেখকের কথা।

0 comments: