0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



আকাশে বাতাসে মাটিতে লেখা আছে... জল... ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, জল... জ-... ল!

নাহ, ওর হাতে আবার একটু জোর ফিরে আসছে... এবার ও পাত্রটা তুলে ধরতে পারছে। এবারে ও পাত্রটা মুখের কাছে নিয়ে জল পান করতে শুরু করলো।

কে যেন পেছন থেকে একটা ধাক্কা মারলো ওকে। এক ধাক্কায় দাঁড় করিয়ে দিলো। দেখতে পেলো সারিবদ্ধ সৈন্যদল প্রস্তুত হচ্ছে। প্রথম লেফটেন্যান্ট চিৎকার করে উঠলেন, ‘এগিয়ে চলো!’ ও কাঁধে রাইফেল তুলে নিয়ে যেখানে সার্জেন্ট হাত নেড়ে দেখিয়ে দিলেন সেইখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তারপরে ওরা কুচকাওয়াজ করে এগোতে শুরু করলো। অন্ধকারে চলবার ইচ্ছে একদম ছিল না তার। শরীর একেবারেই বইছে না। কিন্তু যেতেই হবে। ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হবে। চলতে হবে। নিজের ওজন যেন নিজের হাঁটু দুটো আর বইতে পারছে না। মনে হচ্ছে হাঁটুদুটো মাটির দিকে টানছে কেউ। মনে হচ্ছে যে এখনই বসে পড়বে সে। ফোস্কা পড়া পায়ের পাতাদুটো টেনে টেনে আর চলতে পারছেনা। ব্যথার চাঙড় হয়ে রয়েছে পা দুটো, যেটার ওজন বইতে পারছেনা পা। সে চলতে লাগলো। নিজের শরীরের ওজন, নিজের কাঁধ, নিজের হাত, পশ্চাদ্দেশ, সব কিছু টানতে টানতে ফোস্কা পড়া পা, কালশিটে পড়া হাঁটু নিয়ে সে চলতে লাগলো।

ঘণ্টা তিনেক পরে সে শুয়েছিল স্তেপভূমির ঘাসের উপরে। দেখতে পেলো ধূসর অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো। মূর্তিটা দুটো তেলতেলে কাগজে মুড়ে এনেছে একটুকরো রুটি, এক রোল লজেঞ্চুস আর ছটা সিগারেট। একটা হাল্কা কণ্ঠস্বর, একটা মেয়ের গলা বলে উঠলো...

‘তুমি সঙ্কেতের শব্দটা জানো তো?

-না!

-বিজয়! সঙ্কেত--- বিজয়।

ও নিজে নরম গলায় আউরে নিলো... বিজয়! বিজয়... শব্দটা ওর জিভে ঈষদুষ্ণ জলের মত স্বাদ এনে দিলো।

কাগজের থেকে লজেঞ্চুস ছাড়িয়ে নিয়ে ও জিভে রাখলো। একটা হাল্কা অম্লমধুর সিনথেটিক স্বাদে ভরে গেলো মুখ। লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসে মুখ ভরে গিয়ে মুখের শুকনো ভাবটা কেটে যেতে লাগলো। ঠিক তখনই একটা গ্রেনেডের আওয়াজ শোনা গেলো কাছেই। ওর সামনে অনেকটা দূরে যুদ্ধের ফ্রন্ট। সেখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরেই গোলাগুলি চলছিল। আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন একটা গ্রেনেড ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো ঝড়ের বেগে, চারদিক কেঁপে উঠলো, মনে হল যেন পেরেকভর্তি একটা বাক্স কেউ ঝাঁকিয়ে দিলো। গ্রেনেডটা ওদের অনেকটা পেছনে গিয়ে মাটিতে পড়লো এবং ফাটলো।

একটু পরেই আবার একটা ফাটলো। এটা সামনে। সামনে বাঁধের মত স্তুপ করে রাখা বস্তা ফেটে গিয়ে ব্যাঙের ছাতার মত বালির ফোয়ারা তৈরি হল পূর্বদিকে। ফাইনহাল্‌স্‌ লক্ষ্য করলো যে ওদের পেছনে এখন একদম অন্ধকার। বরঞ্চ সামনের দিকটা আলোকিত। তৃতীয়টার আওয়াজ ও শুনতে পায়নি। মনে হচ্ছিল ওদের সামনের প্লাইউডের দেওয়ালগুলো কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ছাতু করছে; বিপজ্জনক ভাবে আগুনের ফুলকি ঠিকরাতে লাগলো। ধুলো আর বারুদের গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। ও গড়িয়ে গেলো মাটিতে। বুকে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলো ও সামনের ট্রেঞ্চের মুখের কাছে। ফিসফিস করে নির্দেশ এলো, ‘প্রস্তুত হও! লাফ দিতে হবে!’ ডান দিক থেকে নির্দেশটা এলো, ফিউজের তার পুড়ে যাওয়ার মত হাল্কা শব্দে ফিসফিস করে নির্দেশটা বাম দিকে চলে যেতে লাগলো। ও যখন নিজের শরীরের নিচে ঢুকে যাওয়া ব্যাগটা সোজা করবার চেষ্টা করলো, তখন ঠিক ওর পাশেই একটা বিস্ফোরণ হল। মনে হল কে যেন ওর হাত ধরে টানতে শুরু করেছে; বুঝতে পারলো যে বাম হাত ভেসে যাচ্ছে উষ্ণ তরলে। ধুলো থেকে মুখ উঠিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে, ‘আমি আহত, আমার লেগেছে!’ কিন্তু সে নিজেই শুনতে পেলো না নিজের কণ্ঠস্বর, শুধু শুনতে পেলো কে যেন নরম স্বরে বলে উঠল ‘ঘোড়ার নাদি!’

দূরে, অনেকটা দূরে, যেন একটা কাচের দেওয়াল আছে মাঝখানে, কাছে অথচ দূরে, একটা কণ্ঠ বলে উঠলো ‘ঘোড়ার নাদি !’ পরিষ্কার আভিজাত্যপূর্ণ, চাপা অথচ বিভ্রান্ত একটা কণ্ঠ বলে উঠলো, ‘ঘোড়ার নাদি, ক্যাপ্টেন বাউয়ার, হ্যাঁ, একদম!’ তারপরে সব চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে কণ্ঠটা আবার বলে উঠলো, ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল—শোনা যাচ্ছে!’ একটা বিরতি। সব চুপচাপ। শুধু মনে হচ্ছে দূরে যেন হিসহিস কীসের আওয়াজ। কী যেন ফুটছে! চোখদুটো একটু বন্ধ করে রেখে আবার খুললো সে। হ্যাঁ, সে এখন ক্যাপ্টেনের মুখ দেখতে পাচ্ছে আর আওয়াজটা আরও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। একটা অন্ধকার, নোংরা জানালার ফ্রেমের মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেনের মুখটা দেখা যাচ্ছে। ক্যাপ্টেনের দাড়ি-না-কামানো অপরিচ্ছন্ন মুখে রাজ্যের কান্তি আর বিরক্তি। চোখ বুজে টানা তিনবার ছোট ছোট বিরতি দিয়ে বলে গেলেন তিনি..... ‘হ্যাঁ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল!... হ্যাঁ স্যর লেফটেন্যান্ট কর্নেল!... হ্যাঁ লেফটেন্যান্ট কর্নেল!’

ক্যাপ্টেন তার স্টিল হেলমেট মাথায় পরে নিলেন। এখন তার চওড়া, কালো চুলওয়ালা মাথা, ভালোমানুষের মত মুখ – সব কেমন অদ্ভুত হাস্যকর দেখাচ্ছে। পাশে কাকে যেন বলছেন… ‘ছ্যাঃ! ঘোড়ার নাদি! হ্যাঁ, ভেদ করো... ঘোড়ার নাদি তিন, ফ্রি-শুটার চার, আমাকে এগোতে হবে!’... আরেকটা কণ্ঠ শোনা গেলো... ‘ক্যাপ্টেনের জন্য ভটভটি!’ আওয়াজটা প্রতিধ্বনির মত ছড়িয়ে পড়লো... তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ ফাইনহাল্‌স্‌ মোটরসাইকেলের শব্দ শুনতে পেলো। ইঞ্জিনটার গরগর আওয়াজ ক্রমশ কাছে আসছে। হ্যাঁ, ধীরগতিতে একদম তার সামনে এসে দাঁড়ালো একটা মোটরসাইকেল; গর্জন করছে ধুলোয় ঢাকা দ্বিচক্রযান। হেলমেটের ফাঁক দিকে মোটরসাইকেল চালকের ক্লান্ত, নির্বিকার মুখটা দেখা যাচ্ছে। বলে উঠলো সে, ‘ক্যাপ্টেনের জন্য মোটরসাইকেল!’ সারা গায়ে ধুলোমাখা ক্যাপ্টেন লাফ দিয়ে মোটর সাইকেলের সাইডকারে উঠে বসলেন এবং বললেন ‘চলো!’ দ্বিচক্রযান প্রবল গতিতে অন্ধকার চিরে এগিয়ে গেলো।

ফাইনহাল্‌স্‌ শেষ কবে এত খুশি হয়েছিল সে জানেনা। ব্যথাটা সেরকম অনুভবে আসছে না এখন। বাম হাতটা প্লাস্টার করে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। একটা হাল্কা অস্বস্তি আছে, বেশি কিছু নয়। এছাড়া সবকিছুই ঠিকঠাক। ও নিজের বুটপড়া পা দুটো একটা একটা করে উঁচু করে তুলে ঘুরিয়ে দেখলো। নাহ্‌, ঠিক আছে। মাথাটা উঠিয়ে একটু এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। এখন ও সূর্যালোকিত আকাশের নিচে শুয়ে দিব্যি সিগারেট খেতে পারে। পূর্বদিকের আকাশে ধূসর ধুলোর মেঘ। কিন্তু ও কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওর মাথাটা তুলোর প্যাড দিয়ে মুড়ে দিয়েছে কেউ এবং গত চব্বিশ ঘণ্টায় সিনথেটিক অম্ল স্বাদের একটা লজেঞ্চুস আর অল্প কিছুটা বালিমেশানো, লোহার মরচের গন্ধওয়ালা ঈষদুষ্ণ জল ছাড়া সে কিচ্ছুটি খায়নি।

তার মনে পড়লো যে তাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল। ও চোখটা বন্ধ করে যা যা ঘটেছিল, সেটা গুছিয়ে নিয়ে মনে করবার চেষ্টা করছিল। তার মনে পড়ল যে গ্যাসোলিনের গন্ধে ভরা একটা গাড়ির মধ্যে তাকে তোলা হয়েছিল। স্ট্রেচারের সঙ্গে গাড়ির রেলের ঘষা লেগে বিশ্রী আওয়াজ হয়েছিল। গাড়ির ইঞ্জিনটা প্রচণ্ড শব্দ করছিল। কিন্তু গাড়িটা এগিয়ে চলবার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বাইরে গোলাগুলির আওয়াজটা ক্রমশ কমে আসছিল। সন্ধের অন্ধকার তার অনেক আগেই নেমে এসেছিল অনিচ্ছাকৃতভাবে। তার মনে হচ্ছিল যে একটু ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভালো হয়। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছিল, খুবই দ্রুত। তেষ্টা পাচ্ছিল, খুবই তেষ্টা পাচ্ছিল। আবার একটু ভয়ও করছিল।

গাড়িটা হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গিয়েছিল। তন্দ্রাটা ছুটে গিয়েছিল। দরজাটা খুলে গিয়েছিল। আবার স্ট্রেচারের সঙ্গে রেলের ঘষায় বিশ্রী আওয়াজটা হচ্ছিল। ঠাণ্ডা সাদা করিডোরের মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। জায়গাটা অস্বাভাবিক চুপচাপ। অনেকগুলো স্ট্রেচার একটা আরেকটার পেছনে রাখা আছে, যেভাবে একটা ডেকের মধ্যে পরপর ডেকচেয়ার রাখা থাকে। ও দেখতে পেলো ওর সামনে একটা ঘন কালো কেশে ঢাকা মাথা। তার আগের স্ট্রেচারে একটা টাক মাথা যে প্রচণ্ড বেগে অস্থিরভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার আগের অর্থাৎ একদম সামনের স্ট্রেচারে একটা সরু মাথা, ব্যান্ডেজে মোড়া। ব্যান্ডেজের সাদা গজের মধ্য থেকে একটা ভীষণ তীক্ষ্ণ, পরিষ্কার, ধারালো একটা কণ্ঠস্বর উঠে আসছে মাঝে মাঝে। সেটা কর্নেলের কণ্ঠ। মনে হচ্ছে শব্দগুলো একদম সিলিংয়ে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। কণ্ঠটা অসহায় এবং একইসঙ্গে কিছুটা নির্লজ্জভাবে চিৎকার করে বলে উঠলো, -‘শ্যাম্পেন!’

-‘পেচ্ছাপ!’ টাকমাথা লোকটা শান্তস্বরে বলে উঠলো, ‘নিজের পেচ্ছাপ খাও!’ সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে হাল্কা হাসির শব্দ শোনা গেলো।

-‘শ্যাম্পেন!’- প্রচণ্ড রাগত কণ্ঠস্বরটা চিৎকার করে উঠলো... ‘ঠাণ্ডা শ্যাম্পেন!’

-‘চুপ’ – শান্তভাবে বলে উঠলো টাকমাথা লোকটা- ‘একদম চুপ!’

-‘স্পার্কলিং ওয়াইন’... মনে হচ্ছিল কণ্ঠটা চারপাশের জায়গাটা একদম ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চায় - ‘আমি শ্যাম্পেন চাই!’ বলে সাদা ব্যান্ডেজবাঁধা মাথাটা শুয়ে পড়ল। একদম চিত এখন। বাঁধা গজের পুরু স্তরের মধ্য দিয়ে নাকের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ জেগে আছে। এরপর কণ্ঠটা আরও তীব্রভাবে চিক্কুর দিয়ে বলে উঠল- ‘মেয়েমানুষ- একটা অল্পবয়সী মেয়েমানুষ!’

-‘নিজের সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকো!’ আবার উত্তর দিলো টাকমাথা লোকটা।

অবশেষে সাদা মাথাকে দরজার দিকে নিয়ে যাওয়া হল এবং চারদিক চুপচাপ হয়ে গেলো।

নৈঃশব্দের মধ্যে ওরা ইতস্তত গ্রেনেড পড়বার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো; শহরের থেকে দূরে যুদ্ধের ফ্রন্টে লড়াই জারি আছে। যখন কর্নেলের সাদা মাথা দরজার বাইরে বেরিয়ে গেলো এবং টাকমাথা লোকটার স্ট্রেচার একধাপ এগিয়ে গেলো, ঠিক তখনই বাইরে থেকে একটা গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ শোনা গেলো। এঞ্জিনের গরগর শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে বলে মনে হল। প্রচণ্ড বেগে এগিয়ে আসতে আসতে যেন এই ঠাণ্ডা সাদা বাড়িটার গায়ে একটা ধাক্কা মারবে, এতটাই কাছে এসে গেছে গাড়িটা। তারপরে হঠাৎ আওয়াজটা থেমে গেলো, সব চুপচাপ। একটু পরে শোনা গেলো যে বাইরে একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে কী যেন বলছে। ওদের শান্তিপূর্ণ নিস্তব্ধতায়, আধোঘুমের ক্লান্তির মাঝে চমকে তাকিয়ে ওরা দেখলো যে জেনারাল ধীরে ধীরে স্ট্রেচারগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং সবার কোলের কাছে সিগারেটের প্যাকেট রেখে দিয়ে যাচ্ছেন নিঃশব্দে। তার নৈঃশব্দটা ভীষণ দমচাপা ধরনের মনে হচ্ছিল, যখন পেছন থেকে মানুষটি হেঁটে আসছিলেন। ফাইনহালস্‌ খুব কাছ থেকে জেনারেলের মুখটা দেখতে পেলো। হলদেটে, বিশাল, বিষণ্ণ মুখে বরফের মত সাদা ভ্রু-যুগল এবং ঠোঁটের উপরে ধূলিধূসর রেখার মত গোঁফ। তার মুখে লেখা আছে যে এই যুদ্ধটাও তিনি হেরে গিয়েছেন।

(চলবে)

0 comments: