ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৪)
' ভোই মঞ্চাম্মা..মঞ্চাম্মা...ভোই মঞ্চাম্মা...!'
এই ডাকটা যেন অনেক দূর থেকে এবারে কানে আসছে। তার সঙ্গে কেউ যেন ওর শরীরটা ধরে ঝাঁকাচ্ছে। অতিকষ্টে চোখ খুলে দেখল একজন স্থূলাঙ্গী মহিলা নাকে ইয়াব্বড় একটা চাকতির মত নথ না নাকচাবি কি একটা পড়ে আছে একটা ভাঁড়ে করে গরম দুধ এনে ওকে খেতে ইশারা করছে। ও দেখল এখন হাত পায়ের বাঁধন খোলা। তবুও যেন পালাবার একটুও শক্তি নেই। গোড়ালির কাছটায় অসহ্য ব্যথা। বোধহয় উঠে দাঁড়াতেই পারবেনা। ওখানকার হাড়টা হয় ভেঙেছে নয় মচকেছে।
খিদের বোধটাও এতক্ষণে চাগাড় দিচ্ছে। কথা না বাড়িয়ে ও ভাঁড়টায় চুমুক দিতে লাগল।
একটু পরে দুজন লোক এসে ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে একটা অন্য একটা বড় ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা দেখলেই বোঝা যায় যে সেটা একটা মন্দিরের ভিতরের অংশ। দেওয়ালে অনেক দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে। ঘরটাতে ওর মত আরও কয়েকটা অল্পবয়সী মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। সবার কথ্য ভাষা এক না হলেও চোখদুটোয় একপ্রকার হরিণের ভীতি আচ্ছন্ন হয়ে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
তিনজন দশাসই চেহারার মহিলা এসে সবাই কে একটা করে কাপড় ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকল। মহিলাগুলোকে দেখলে রামায়ণে বর্ণিত রাবণের চেরী বলে ভুল হতে পারে। ওদের গলায় মোটা মোটা রূপোর ভারী হাঁসূলী আর পায়ে মল। আর তখনকার ওই দুধ দিতে আসা মহিলাটির মত নাকে একটা করে পেল্লায় নথ। এদের পরণের শাড়িটি দক্ষিণদেশীয়দের মত কাছা দিয়ে পড়া আর জুঁইফুলের মালা দিয়ে মাথার লম্বা বেণীটি সজ্জিত। ওরা একটা পুকুরের মত বড় চৌবাচ্চার সামনে ওদের ডেকে এনে ইশারায় গায়ের পুরনো কাপড় খুলে দিয়ে জলে নেমে স্নান করতে বলল। এরকম অপরিচিতের মাঝে ও নগ্ন হওয়ার কথা ভাবতেই পারেনা। এককোণে জড়োসড়ো হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই আর একজন মহিলা এসে জোর করে একটানে কাপড় খুলে দিয়ে ওকেও বেআব্রু করে দিল। ততক্ষণে বাকি মেয়েগুলোকে চৌবাচ্চাটায় নামিয়ে স্নান করানো শুরু হয়ে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার চৌবাচ্চার জলটা ঈষৎউষ্ণ বলে স্নান করতে মন্দ লাগছে না।
*****
মা এর সাথে এবার অনেকদিন পর সাগরিকা রম্ভায় এল। চিল্কার এদিকটায় বেশ ভীড় হচ্ছে আজকাল। এখান থেকে তপ্তপানিও বেশী দূর নয়। আজকাল মোটরবোটে করে কালিজাই দ্বীপের কাছে যেখানটায় মোহনার মত ওখানে ডলফিন দেখাতে নিয়ে যায়। ওরা ঠিক করল এইবার কিছুক্ষণ বোট ভাড়া করে ডলফিন পয়েন্টটা দেখে আসবে। শ্রীরাধা সেনের স্বাস্থ্যটা দোহারা গড়নের। চট করে দেখলে ওদের মা -মেয়ে বলে বোঝা যায়না বরং দুই বোন বলে মনে হয়। দুজনেই ম্যাচিং করে কটকী প্রিন্টের শাড়ি পড়েছে। বাবা চলে যাওয়ার পর সাগরিকা মা'কে এক নিরাভরণ দেখতে পছন্দ করেনা। যতসব ডোকরা বা হালফ্যাশানের টুকিটাকি সাজগোজের জিনিস কিনে এনে মা কে পড়ায়। শ্রীরাধা গোড়ায় আপত্তি করলেও এখন মেনে নিয়েছেন।
সেদিন সন্ধেবেলা বালিযাত্রা দেখতে গিয়ে সাগরিকা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। ওই মন্দিরের শঙ্খ ঘন্টার শব্দের সাথে সাথে ওর চারপাশটা কেমন আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল। ও যেন আর এই দুনিয়ায় ছিলনা। সাগরিকার সামনে সিনেমার মত কিছু দৃশ্যপট এসে বারবার বদলে যাচ্ছিল। সাগরিকা তখন একটা বিশাল চৌবাচ্চা দেখতে পাচ্ছিল আর সেখানে কয়েকজন ওরই বয়সী মেয়েকে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করছিল। অবাক কান্ড, সেই মেয়ে গুলোর সঙ্গে আর একটি মেয়েও ছিল, তাকে ঠিক ওর মতই দেখতে। যেন ওর যমজ বোন!
তারপর যে ঠিক কি হল আর মনে নেই। মাথাটা ঘুরে সাগরিকা বসে বালির উপড় বসে পড়েছিল। মা তখন ওকে ওইভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে
'রিমি! রিমি! এ্যাই.. কি হয়েছে তোর ? তুই ঠিক আছিস তো?' বলছিল মনে আছে।
মা সামনে আসতে আসতে কিন্তু ওই সিনেমার মত দৃশ্যগুলো ততক্ষণে হারিয়ে গিয়েছে চোখের সামনে থেকে।
*****
পঞ্চায়েত প্রধান সমুদ্র আর তার সেবাকেন্দ্রের লোকজনদের ডেকেছিল। এই সব দক্ষিণপন্থী অসাধু রাজনীতির সংস্রব যদিও ওর পছন্দ নয়। কিন্তু এখন একটু একটু করে মেনে নিতে শিখেছে ও। জেলের বাইরে আসার পর নিজের পঙ্গু শরীরটাকে নিয়ে ভারী চিন্তিত ছিল। পুরনো কমরেডদের অনেকেই মারা গেছে নয়তো রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছে ততদিনে। কেন্দ্রে নেহরু কন্যার জনপ্রিয়তায় সারা দেশ আহ্লাদে গদগদ। যেদিন সমুদ্ররা ধরা পড়ে বেলেঘাটায়, পুলিশের গুলিতে সেই অ্যাকশনের রাত্রেই সনৎদা মারা যায়। আর ওরা চারজন এ্যারেস্ট হয়ে প্রথমে হিজলী জেল তারপর বহরমপুরে চালান হয়ে যায়। কলকাতায় আলিপুর বা প্রেসিডেন্সী জেলে তখন ওদের রাখাটা সমীচীন মনে করেনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ব্যারিস্টার নাতিটি।
*****
প্রকাশ পাখিরা এখানকার প্রধান। সমুদ্রকে বেশ খাতির করেই বসালো। একথা সেকথার পর তার মতলবটা খুলে বলে। ওর ইচ্ছা সামনের পঞ্চায়েৎ ভোটে সুখমণিকে প্রার্থী করে আদিবাসী শবরদের ভোটটাকে টানা। অবশ্য তার বিনিময়ে ইস্কুলঘরটাকে পাকা করে দেবার টোপও আছে। এখানকার টাঁড় ভূমিতে জলের খুব কষ্ট। সমুদ্ররা একটা মাস্টারপ্ল্যান করে এম পি অমিয় সামন্তকে মাস দুয়েক আগে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে। পঞ্চায়েৎএর সমর্থন পেলে ওটা নিজের তাগিদেই হয়ে যাবে।
ভাবলেশহীন গলায় চা আর নোনতা বিস্কুট শেষ করে সমুদ্র বলে?
'সুখমণির সাথে আগে কথা বলে দেখি। ওর মতটাও তো জানা দরকার!'
সেবায়তনের বাইরে আসলে সমুদ্র ক্রাচ ব্যবহার করে। প্রকাশ পাখিরা যদিও মোটর সাইকেলে করে সেবায়তন অবধি ছেড়ে দিতে চাইলেও সমুদ্র এইটুকু পথ হেঁটেই যেতে স্থির করল।
আজকাল আর সেভাবে বেড়াতে আসা হয়না। কালো কালো পাথুরে রিলিফের ফাঁকে আগুনের মত পলাশফুল গুলো জ্বলছে। কে বলে 'বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ'এর দিন একেবারে শেষ হয়ে গেছে?
0 comments: