0

প্রবন্ধ - সুজান মুখার্জি

Posted in



‘ক্যাটাস্ট্রোফোজোইক’

‘ক্যাটাস্ট্রোফোজোইক’ শব্দটির সাথে আমার পরিচিয় হয় অমিতাভ ঘোষের দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট পড়ার সময়ে। ২০১৬-এ প্রকাশিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ কিভাবে আমাদের সভ্যতাকে নতুন এক সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারই সাথে তিনি দাবী জানিয়েছেন যে এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাহিত্যিকদের কর্তব্য তাঁদের লেখায় জলবায়ু পরিবর্তনের সামাজিক প্রভাবকে তুলে ধরা।

তাঁর মতে কল্পবিজ্ঞান বা ক্লাইমেট ফিক্‌শনের (‘সাই-ফাই’-এর পর ‘ক্লাই-ফাই’) স্রষ্টারা যদি বা এই সমস্ত যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে লিখেও থাকেন, সেই ভবিষ্যৎ বড়ই অপরিচিত এবং দূরের বলে মনে হয়। সেই পৃথিবী যে আমাদেরই পৃথিবী, সেই ভবিষ্যৎ যে আমাদেরই ভবিষ্যৎ, অনেক সময়ই তা খেয়াল থাকে না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে অবশ্য তাঁর সাথে একমত নই। মেনস্ট্রীম সাহিত্যে এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দুর্লভ হলেও, সাই-ফাই-এর জগতে নিজের বাস্তবকে খুঁজে নিতে যে বিশেষ কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয়, তা আমি মনে করি না। যে প্রজাতি যতিচিহ্ন সাজিয়ে নিজেদের আবেগ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে, তারা যে সর্বত্রই নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুজে পাবে, তা খুবই স্বাভাবিক। নার্সিসিস্ট নিশ্চয়ই আত্মসংরক্ষণের ব্যাপারে অন্ততঃ সচেতন?

সে যাই হোক। এই ‘ক্যাটাস্ট্রোফোযোইক’ (নতুন শব্দ শেখার পর ব্যবহার না করলে নাকি মনে থাকে না) যুগে দাঁড়িয়ে কলকাতা শহরের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গেলে দুশ্চিন্তা হওয়ারই কথা। বছর খানিক আগে নিউ জার্সির ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রাল’ নামের একটি সংস্থা তাদের গবেষণাপত্রে জানায় যে উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ২০৫০-এর মধ্যে কলকাতাসহ হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বার্ষিক বন্যার সম্ভবনা রয়েছে। তার ফলে আনুমানিক ৪.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হতে পারেন। অবশ্য তিন-তিনটে ক্যান্ডিডেট সামনে থাকতে বলা খুবই কঠিন অ্যাপোক্যালিপ্সের রূপ শেষমেশ কিরকম হবে – মহামারী ভাইরাস, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ, নাকি ফ্যাসিবাদের হিংসা।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা ইব্‌ন আল-নাফিসের রিসালাত ফাদিল ইব্‌ন নাতিক্‌ –এর মতন কিছু ছুটকো উদাহরণ বাদ দিলে, অ্যাপোক্যালিপ্স-কেন্দ্রিক সাহিত্যের উত্থান এবং ক্রমবিকাশ উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার থেকেই হয়েছে বলে ধরা যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন আসন্ন অ্যাপোক্যালিপ্সের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা নিয়ে গল্প লেখা বা সিনেমা বানানো হয়েছে, তেমনই অনেক জায়গায় আমরা পাই উত্তর-অ্যাপোক্যালিপ্টিক একটি সময়ের চিত্র – অজানা, অচেনা পরিস্থিতির মুখে দু-চার জন উত্তরজীবির বেঁচে থাকার বা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার সংগ্রাম। মানব সভ্যতার ধ্বংস হওয়ার কথা কল্পনা করতে মানুষ কেন এতো ভালোবাসে তা বিশ্লেষণ করা যায় তবে আজ নাহয় তার মধ্যেই আর নাই গেলাম।

‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে ‘ইম্পিরিয়াল ইন্ডিয়ান ওয়ার ফান্ড’-এর জন্য তহবিল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্ডিয়ান ইঙ্ক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাতে একদিকে যেমন চায়ের কাপে ভাসমান নৌ জাহাজ সমেত লিপ্টন চায়ের বিজ্ঞাপন, অন্য দিকে ছাপা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দ্য ট্রাম্পেট’ কবিতা এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি। তারই ফাঁকে গোঁজা একটি অদ্ভুত ছোট গল্প, ‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’ অর্থাৎ আজি হতে অর্ধশত বর্ষ পরের কলকাতা। গল্পের লেখকের এভেরার্ড ডিগবি, যিনি সেই সময়ে সাংবাদিক মহলে বেশ নাম করেছিলেন। সত্যি বলতে, লেখাটিকে গল্প বলা চলে কি না জানি না – ‘স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধ’ বলাই হয়তো ভালো। দেখে নেওয়া যাক লেখকের কল্পনায় কলকাতার ভবিষ্যৎ রূপ কি রকম।

এই ধরণের লেখায় একজন আগন্তুকের উপস্থিতি আবশ্যক। বড় মাপের সাহিত্যিকদের পক্ষেও বহিরাগত কারুর পৃথক দৃষ্টীভঙ্গি ছাড়া কল্পিত জগতের বৈশিষ্ট তুলে ধরা কঠিন। ডিগবির লেখায় সেই যাত্রী আসছেন ১৯৬৪ সালে, কলকাতা দর্শন করতে। সেই ৫০ বছরেই শহরে আক্ষরিক অর্থে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। দক্ষিণ দিক থেকে আসবার সময়ে সাগর দ্বীপ পেরোতে না পেরোতেই চোখে পড়ছে প্রকাণ্ড এক পাহাড়ের মত কি – সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। আরও একটু কাছে যেতে যাত্রী লক্ষ্য করছেন সেই পাহাড় আদপেই মাটি সংলগ্ন নয়। গোটা শহরটি যেন জলাভুমির কিছুটা উঁচুতে ভাসছে, এক গোছা মোটা মোটা অ্যালুমিনিয়াম ব্যান্ডের ওপর ভর দিয়ে। পড়বার সময়ে আমার চোখের সামনে ভাসছিল ক্রোমিয়ামে মোড়া একটা বিরাট পদ্বফুলের ছবি। কিন্তু এই অবস্থা কি করে হল তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯১৪-এ।

সেই সময়ে কলকাতা শহরে হাতে গোনা কিছু বাড়িতে লিফ্‌টের ব্যবস্থা ছিল। ওয়াল্টার গ্র্যানভিলের নির্মান করা কলকাতা হাই কোর্টের মাঝের অংশটা দেবে যাওয়ার কথা যাঁদের মনে ছিল, তাঁরা এও জানতেন যে গোটা শহরটাই আসলে কাদার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। লোকসংখ্যা যতই বেড়ে যাক, সেই ভিতে কার সাহস হবে ছ-তলার পর সাত-তলা বাড়ি নির্মান করার? চারিপাশে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় আছে বলে মনে হচ্ছিল না।

এমন সময়ে, কলকাতার ২০০ মাইল দূরে নতুন টাটা ষ্টীলের কারখানা স্থাপিত হল একটি লৌহ আকরিকের ঢিবীর ওপর। আধুনিক প্রযুক্তির ষ্টীলের কাঠামো তুলনায় অনেক হাল্কা আর তারই সাথে কারখানা চালু হবার পর ষ্টীলের দামও কমে যায়। দেখতে দেখতে ২৫ তলা, ২৬ তলা, শেষ পর্যন্ত ৪০ তলা বাড়িরও স্বপ্ন দেখতে লাগল কলকাতার মানুষ। বাঁশ ঝোপের মতন গজিয়ে উঠল শত শত স্কাইস্ক্রেপার। কলকাতার উচ্চমধ্যবিত্ত সংসারে প্রেমিক-প্রেমিকা চল্লিশ তলার উত্তরমুখী বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া খুঁজতে লাগলেন।

বাড়ির উচ্চতা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে, ইঞ্জিনিয়াররা সাবধান করে দিলেন যে গভীর ভিত না বানালে যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে। আশপাশের জমি থেকে কাদা তুলে আনার ব্যবস্থা হল। আইন জারি করা হল – শহরতলিততে কমসে কম দশ ফুট আর শহরকেন্দ্রে কুড়ি ফুট কাদা জমিয়ে তার ওপরেই মাল্টিস্টোরি নির্মান করা যাবে। এর ফলে যেখান থেকে কাদার কন্ট্র্যাক্টররা মাটি তুলে আনলেন, সেই সব জায়গায় বিরাট বিরাট নোনা জলের হ্রদ দেখা দিল। মশাদের হল ভারি মজা। কিন্তু এমনই একদিন, মেসার্স স্মিথ অ্যান্ড ওয়েস্টোভার কাদা কোম্পানির মালিকের মাথায় একটি নতুন আইডিয়া খেলে গেল। ডালহৌসি স্কোয়েরের অফিসের জানলার পাসে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছতে মুছতে দূরে একটি সাদা মেঘ দেখে তিনি ভাবলেন, গোটা শহরটাকেই মাটি থেকে তুলে নিলে কেমন হয়?

ব্রাইট আইডিয়া বাস্তবায়িত করতে গেলে কিছুটা ভাগ্যেরও দরকার হয়। ইতিমধ্যেই, দক্ষিণ ভারতের এক পাগলাটে ব্যবসায়ীর হাতে হাত মিলিয়ে এক পাগলাটে বৈজ্ঞানিক ম্যাঞ্চেস্টারের তুলোর মতন সূক্ষ্ম অ্যালুমিনিয়ামের তার বানাতে শুরু করে। সেই ম্যাজিক তারের দৌলতে পঙ্কজ নগরীর জায়গায়ে নিমেষের মধ্যেই গড়ে উঠল এক ঝলমলে দৈত্যাকার শহর, মাটির থেকে ১৫০০ ফুট উঁচুতে ভাসমান, উচ্চতায় ৮০০ ফুটেরও বেশি। সেখানে দার্জিলিং থেকে রোপওয়ে দিয়ে আসে কার্টন ভর্তি চা আসে, সিকিম থেকে আমদানি হয় তামা, আর তিব্বত থেকে আসে সোনা।

যে সময়ে ডিগবি এই স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধটি রচনা করেন, কলকাতার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশাসন খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। ১৯১২ সালে সি.আই.টি. সংগঠিত হলেও পুঁজির অভাবে এবং আরও অন্যান্য কারণে তাঁদের কাজ ধীরগতিতেই শুরু হয়। প্যারিসে ব্যারন হাউস্‌মান্‌ যেরম নির্মম ভাবে শহরের পুরনো রূপ এবং স্মৃতি ভেঙে চুরমার করেছিলেন, সি.আই.টি.-র কর্মকর্তারা ঠিক সেরকম না হলেও অনেক অঞ্চলে ‘ড্রাস্টিক সার্জারির’ পরিকল্পনা করেন। বলা বাহুল্য, তাঁদের নজর কেবলই শ্রমিক শ্রেণী-প্রধান এলাকাগুলির ওপর গিয়ে পড়ে। শহরকেন্দ্র অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠার ফলে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে এবং তাতে ব্যাবসা-বাণিজ্যের লোকসান হয়। অতএব তাঁরা প্রস্তাব দেন যে, যাঁরা এইসমস্ত এলাকার বাসিন্দা, তাদের ক্রমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক শহরতলিতে।

ভিন্নমত প্রকাশ করার মতন খুব বেশি মানুষ না থাকলেও, প্যাট্রিক গেডেস্‌ নামের একজন স্কটিশ জীববিজ্ঞানী সি.আই.টি.-র পরিকল্পনার সমালোচনা করেন। তিনি এও বলেন যে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের যেহেতু খাটুনী অনেক বেশি আর হাতে সময় অনেক কম, শহরকেন্দ্র তাঁদেরই বাসস্থান করে, অর্থবান মানুষদের শহরতলিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। পুঁজিভিত্তিক নগর পরিকল্পনায় এ যেন পাগলের প্রলাপ!

‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’-এ আমরা এই সমস্যা সমাধানের এক অভিনব (যদিও ব্যর্থ) প্রচেষ্টা দেখতে পাই। ডিগবির কল্পনায় বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থার নাগরিক, আলাদা আলাদা স্তরে বাড়ি করেন। শ্রমিক শ্রেণীর বসবাস সব থেকে নিচের স্তরে কিন্তু তা কোন অন্ধকারময় হতাশার জায়গা নয় – বরঞ্চ ছায়াময়, শান্ত, শীতল পরিবেশ। কতগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ডিগবি এড়িয়ে যান যেমন, এই যে বিভিন্ন স্তরের মানুষ, তাঁদের মধ্যে কি মেলামেশার সম্ভাবনা রয়েছে? যদি সকল শ্রেণীর মানুষ এক রাস্তা দিয়ে চলাফেরা নাই করতে পারেন, তাহলে কি শ্রেণী সংগ্রামের কোন জায়গা নেই? ‘ছোট গল্পের’ বদলে ‘স্পেকুলেটিভ প্রবন্ধ’ বলে বর্ণণা করার কারণ পরিষ্কার হল আশা করি। গল্পের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে এই সমাজব্যাবস্থাকে প্রশ্ন করা যেত। ডিগবি তার প্রয়োজন মনে করেন নি।

‘২০০ বছর পরে ফ্যাতাড়ু’

১৯৬৪ থেকে আমরা চলে এসেছি একেবারে ২২১০ সালে। তিনজন ‘ফেমাস ফ্যাতাড়ু,’ মদন, ডি.এস. ও পুরন্দর ভাট ক্রায়ো-ঘুম থেকে উঠবে উঠবে করছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল যে ফ্যাতাড়ুরা সমান হলেও, মদন তাদের মধ্যে একটু বেশি করে সমান, অর্থাৎ সেই হচ্ছে ফ্যাতাড়ুদের লিডার। ক্রায়ো-ঘুম কি তা অবশ্য নবারুণ আমাদের গল্পের শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। ‘৭৭.১৫ কেল্ভিন তাপমাত্রায়...জ্যান্ত বা হাফমরা মালদের দীর্ঘ সময়ের জন্য জমিয়ে রাখার একটা পদ্ধতি।’ মৃতুকে কমডিফাই করা এবং তার অন্যান্য দিক নিয়ে নবারুণ একাধিক জায়গায় লিখেছেন – কিন্তু সে কথা পরে হবে।

আর সব জ্ঞানী-গুনি লোক থাকতে এই তিন জন ফ্যাতাড়ুকে কেন এই মহান এক্সপেরিমেন্টের স্যাম্পেল হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল তা নবারুণও সঠিক বুঝতে পারেন নি। আমার ধারণা তারা যাতে এদিক ওদিক আর ঝামেলা বাঁধাতে না পারে, তাই এই সিদ্ধান্ত।

লিডার বলেই মদনের ঘুমের কোটা থেকে দু’দিন কেটে নেওয়া হয়েছিল। তার ওপর দায়িত্ব কিঞ্চিৎ বেশি। দু’শো বছর মাইনাস দু’দিনের গভীর ঘুমের পর বাকি দুই ফ্যাতাড়ুর ঘুম ভাঙার আগেই মদন নোয়ার সেই ঘুঘু পাখির মতন বাইরেটা সার্ভে করে আসে। ‘বারান্দায় তুমুল হাওয়া। যতদূর দেখা যায় জল আর ঢেউ। কয়েকটা বাড়ির ওপরটা দেখা যাচ্ছে, জলে থার্মোকল, পচা কাঠ, মরচে পড়া পেট্রলের ক্যান, নানা সাইজের জেরিক্যান, জাম্বো সাইজের পুতুল ভাসছে...জল কালচে এবং ঘোলাটে।’

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল জলের তলায় – বা হয়তো ভেসেই গেছে। মনুমেন্টের ডগাটা খালি দেখা যাচ্ছে – আর ভাটার সময়ে দ্বিতীয় হাওড়া ব্রিজ। মজার ব্যাপার, ‘ক্যালকাটা ফিফটি ইয়ার্স হেন্স’-এও ভিক্টোরিয়ার অসম্পন্ন অবস্থার একটি স্টিম্পাঙ্ক বর্ণনা আমরা পাই। যে সব আইকনিক মনুমেন্ট শহরের পরিচিতির সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে মিশে যায় – যেমন কলকাতায় ভিক্টোরিয়া, নিউ ইয়র্কে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, বা লন্ডনের (কলকাতারও) বিগ বেন – সেগুলিকে ভগ্নদশায় দেখার মধ্যে কি যেন এক অস্বস্তিকর রোম্যান্টিসিজম লুকিয়ে থাকে। রোল্যাণ্ড এমেরিচের দ্য ডে আফটার টুমরো (২০০৪) ছবির পোস্টারেও আমরা তার উদাহরণ দেখতে পাই। তারই মধ্যে পুরন্দর দুটি কবিতাও রচনা করে ফেলে, যার প্রথমটি শুরু হচ্ছে –
‘কোথা সে সিনেমা হল
কোথা সে শপিং মল
চারিদিকে ঘোলা জল
করিতেছে খলবল’

দু’শো বছর বাদে ফ্যাতাড়ুদের জাগিয়ে তোলার প্রগ্রাম করার সময়ে বৈজ্ঞানিকরা ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন যে ইতিমধ্যে কিছু অঘটন ঘোটতেই পারে। তাদের সাথে প্রচুর পরিমাণে বিড়ি, সিগারেট, বাংলা ও হুইস্কি, এমন কি গ্যাস মাস্ক, ডুবুরি সুট পর্যন্ত দিয়ে রেখেছিলেন। আণ্ডা ট্যাব্লেট দিয়ে ইয়া সাইযের মামলেট আর পাউরুটি ক্যাপ্সুলের পাউরিটি দিয়ে নাস্তা করে, ভাটায় জল নামার পর তিন জনে মিলে বেরিয়ে দেখল ‘অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাগুলোতে ডাঁই হয়ে থাকা খুলি ও হাড়গোড়, কাত হয়ে থাকা অসংখ্য গাড়ি...এ.টি.এম. মেশিন, কেৎরে পড়া মবাইল টাওয়ার।’

এই সব ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে দেখতে ফ্যাতাড়ুদের মনে হয়, সত্যিই কি উষ্ণায়ণের কারণে গোটা শহর জলের তলায় চলে গেল? যদি সমুদ্রের ঢেউ তাদের দিকে তেড়ে আসে, তাহলে কি কলকাতার মানুষ গ্যাঁট হয়ে নিজের জায়গাতেই বসে থাকবে না কি দেদার দৌড় মারবে? অর্থাৎ সমুদের জল এসে পৌঁছানো আগেই হয়তো কোন যুদ্ধে অ্যাটম বোমে পড়ে বা বিষাক্ত গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে সমস্ত মানুষ মারা গিয়েছিল। এইসব চিন্তা করতে করতে তারা হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি তাদের দিকে উড়ে আসছে ক্যাঁ ক্যাঁ করতে করতে। দ্বিগুন স্পিডে ফ্যাতাড়ুরা উড়ে পালায় আর সাউথ সিটির বত্রিশ তলার একটা খোলা বারান্দা দেখে ঢুকে পড়ে। তারপরের ঘটনায় নাহয় আজ আর নাই গেলাম।

ডিগবির লেখায় আমরা একধরণের আশাবাদী সরলতা বা নাইভেটে লক্ষ্য করি, আবার নবারুণের গল্পে প্রাকৃতিক অ্যাপোক্যালিপ্স আর অ্যাটমিক যুদ্ধ কোথায় যেন গুলিয়ে যায়। হয়তো সাধারণবুদ্ধির ফ্যাতাড়ুরাই ঠিক ধরেছিল। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন না হলে কলকাতা শহরে অদূর ভবিষ্যতে ঘোর প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসার আসঙ্কা রয়েছে। গতবছর উপমন্যু ভট্টাচার্য ও কল্প সংভিওয়েড বলে একটি চমৎকার অ্যানিমেটেড স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি করেছেন। নবারুণের দু’শো বছর পরের কলকাতার মতন এই গল্পেও শহর জলের তলায় চলে গেছে। তারই মধ্যে চলছে মানুষ এবং বাঘের – দুজনেই এক প্রকার জলবায়ু শরণার্থী – বেঁচে থাকার লড়াই। ছবিটি দেখার সুযোগ আমার এখনও হয় নি কিন্তু আশা করি বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।

সুজান মুখার্জি : গবেষক ও লেখক

0 comments: