1

গল্প - অচিন্ত্য দাস

Posted in



নটবর মানে নাটুদা আমাদের থেকে বছর তিনেকের বড় ছিল। ইস্কুলে থাকতে পাড়ায় আমরা ফুটবল ক্রিকেট খেলতাম খুব। তবে আমরা শুনতাম নাটুদার একটা অসুখ ছিল। নাটুদা নাকি রাত্তিরে কাউকে কিছু না বলে ছাদে চলে যায়। সেখানে অনেকক্ষণ চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে – কেউ গিয়ে ঝাঁকানি দিলে তবে নাকি হুঁশ আসে।

একবার ওরা ওঝা ডেকেছিলো। ওঝামশায় দেখেশুনে বলল – “পেরেত ভর করসে। নূতন একখান নারিকেল ঝাঁটা আনেন তো … পিটাইয়া তাড়াইতে হইব।”

নাটুদার জ্যাঠামশায় থাকতেন একই বাড়িতে। তিনি আবার কোন ইস্কুলে কেমিস্ট্রি পড়াতেন। বিজ্ঞানী মানুষ। শুনতে পেয়ে ওঝাকে বললেন –“হু, ঝাঁটা একখান চাই বটে, তোমারে তাড়াইবার লগে..”

ওঝা ভয় পেয়ে মিনমিনে গলায় বলল – “সে আপনারা বিশ্বেস না করেন, উপাচার করুম না। গাড়িভাড়াটা দিয়াদ্যান, আমি চলি…”

জ্যাঠামশায় পরের দিন নাটুদাকে নিয়ে মনের অসুখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলেন শুনেছিলাম তারপর আর কিছু জানি না। বোধহয় সেরে গিয়েছিলো। সে রোগ থাক-না-থাক, নাটুদা কিন্তু পড়াশুনোতে ভালো ছিলো – আমাদের পাড়া থেকে বোর্ডের পরীক্ষায় নাটুদাই প্রথম ফার্স্ট ডিভিশন পায়।

*****

সেসব আজ কতদিনকার কথা। আমি পঞ্চাশে পড়েছি, তার মানে নাটুদার তিপ্পান্ন মতো। সাধারণ সেলস ম্যান আমি, মাইনে কম অথচ খাটনি আর ঘোরাঘুরি খুব। আমাদের কোম্পানীতে যে গুজরাট-রাজস্থান অঞ্চলটা দেখে সে অসুস্থ তাই আমাকে তার কাজও করতে হচ্ছে। গুজারাটের কোণায় গান্ধীধাম বলে একটা ছোট শহর আছে, সেখানে এসেছি। নাটুদা এখানে আছে জানতাম। আজকাল ফোনে যোগাযোগ করা সহজ হয়ে গেছে, নাটুদাকে বলতেই বলল –“ আরে চলে আয়… শনিবারে কাজ হয়ে যাবে? রবিবার সকালে ফেরা? ঠিক আছে, শনিবার সন্ধেবেলা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে চলে আয়। ছোট বাড়ি, কিন্তু তোর জায়গা হয়ে যাবে।

******

যেতেই নাটুদা জড়িয়ে ধরল। -“তুই ম্যানেজার না কী যেন একটা হয়েছিস না…”

-“ না গো, গত সাত বছরে কোনো প্রমোশন হয়নি মাইনেও বাড়েনি, চাকরিটা বজায় আছে এই অনেক..”

-“ওঃ, আবার মিষ্টির বাক্স হাতে করে এনেছিস – বাঙ্গালির লৌকিকতা! এই, তুই চিংড়ি খাস তো, এখানে দারুন গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়। সুমতি আজ নিজে রেঁধেছে তুই আসবি বলে। জমে যাবে ..”


তা জমিয়ে খাওয়া হল। নাটুদার ছেলে আছে শুনেছিলাম, দেখছি না তো। নাটুদা বলল –“ আরে কী আর বলি তোকে, ছেলেটা এক নম্বরের লায়েক হয়েছে। দুবারেও বিএ পাশ করল না … এখন আমেদাবাদে কলেজে দিয়েছি… সেখানেও শুনছি কটা বদ ছেলের পাল্লায় পড়েছে…”

--” অত ভেবো না। ঘরে ঘরে এই দেখছি আজকাল, ও নিজের লাইন নিজেই খুঁজে নেবে। তা তোমরা তো ভালো আছ…”

-“ সুমতিকে তো দেখলি, ভুগে ভুগে কাঠি হয়ে গেছে। সারছে না। হোমিও করাচ্ছি”

চুপ করে গেলাম। তারপর বললাম –“তোমার কাজ কেমন চলছে, তুমি তো কী একটা বড় কারখানায় আছো…”

উত্তর না দিয়ে নাটুদা বলল – ”চল, ছাদে যাই। খাওয়ার পরে ঘন্টাখানেক আমার ছাদে বসার সময় ।”

গেলাম। দোতলার ওপরে ছাদ, খোলা জায়গা। আশেপাশের বাড়িগুলো ছোট আর সংখ্যায় কম। নাটুদা বলল – “দ্যাখ, কী সুন্দর আকাশ দেখা যায়। জায়গাটা শুকনো তো, আর শহরের ধোঁয়াটোয়া নেই, তাই কত তারা দেখা যাচ্ছে বল তো !”

বহুদিন আকাশে তাকিয়ে তারা দেখিনি। নাঃ, সত্যি। চৈত্রের মেঘহীন অন্ধকার আকাশে গিজগিজ করছে তারা । বললাম – “দারুণ”

- “শোন, আমার ছেলেবেলাকার কথা তো জানতিস তোরা। আমি ফাঁক পেলেই রাতের বেলা ছাদে কেন চলে যেতাম জানিস?”

- “ছাদে যেতে জানতাম কিন্তু কেন তা তো তুমি কখনো বলেনি।”

- “সবাই তখন বকাবকি করত, পাগল বলত তাই কাউকে বলতাম না। এখন বলি শোন। আমি না রাতের তারাভর্তি আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কীরকম যেন একটা সুর শুনতে পাই। মনে হয় হাজারটা তার লাগানো বিরাত এক তানপুরা – তা থেকে ষড়জ,গান্ধার,পঞ্চম, নিষাদ আরও কীসব আছে না, সব একসঙ্গে বেজে চলেছে। আরও বহু যন্ত্র বাজছে, অদ্ভুত আকাশ-জোড়া জলসা …”

এই রে! নাটুদার সেই পাগলামি এখনো আছে? কী হবে! ছেলে বখাটে, কোনো কাজের নয়। বৌ রুগ্ন। কে এখন ওসব ওঝা কিংবা মনের ডাক্তার-ফাক্তারের ব্যবস্থা করবে…

- “ওহ, তুই আমাকে পাগল ভাবছিস? না রে আমি ঠিক আছি”

কোন পাগল তার নিজের পাগলামি স্বীকার করে? চেয়ারটা একটু পিছিয়ে নিলাম … বলা তো যায় না। কথা ঘোরাবার জন্য বললাম –“ তা নাটুদা তোমার কাজকর্ম কেমন চলছে বললে না তো… এদিকে তো শুনেছি পয়সা-কড়ি ভালো দেয়…”

- “কোম্পানীতে অনেক টাকা তছরুপ হয়েছে, দোষ আমার ঘাড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। কোনো রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে চলছি। চাকরি নট হয়ে যেতে পারে যে কোনো দিন…”

শুনে চুপ করে গেলাম। নাটুদা আবার আকাশে উঠল। বলল –“ রাত্তিরের গান খুব কম লোক শুনতে পায় রে। কোটিতে গুটিক বা তারও কম ধরতে পারিস। ইংরেজিতে একটা কথা দেখেছিলাম – কসমিক সিম্ফনি – আচ্ছা ব্যাপারটা যদি না থাকবে তো কথাটা এলো কোথা থেকে?

“রোজ আমি রাত্তিরের গান শুনতে আসি। বিশ্বাস কর, কিছুক্ষণ শোনার পর আমার মনটা একদম শান্ত হয়ে যায়। না কোনো চিন্তা না কোনো ভয়। ভাগ্যিস আমার ছেলেবেলাকার অসুখটা এখনো সারেনি! তাই একরকম ভালো আছি। নয়তো চারিদিকে যা ঝামেলা আর অশান্তি পাকিয়ে উঠেছে তাতে এতদিন মরেই যেতাম রে”

*****

বিকেলবিকেল বাড়ি পৌঁছোবার কথা কিন্তু ট্রেন, ফ্লাইট সব লেট থাকায় নটা বেজে গেলো। স্যুটকেশটা রাখতে না রাখতেই বৌ একটার পর একটা ‘সুখবর’ দিতে শুরু করল। বাড়িওলা সামনের মাস থেকে ভাড়া বাড়াতে চাইছে, বসার ঘরের ফ্যান খারাপ হয়ে গেছে, বড় ননদের নাতির মুখেভাতে সোনার কিছু একটা দিতে হয় – কবে আমার জ্ঞান হবে । এই রকম উঁচু গলায় গোটা আটেক খবরের পর নিচু গলায় বলল –“ তোমার গুণধর মেয়েকে আবার সেই ছেলেটার সঙ্গে দেখা গেছে, মনুবৌদি বাড়ি এসে বলে গেল। বিয়ের খোঁজখবর করা তো তোমার কাজ নয়, আমাকেই সব করতে হবে…”

এক গেলাস জল খেয়ে জানালা দিয়ে ওপরের দিকে তাকালাম। পাশে এমন একখানা ছতলা বাড়ি উঠেছে যে আমাদের জানালা দিয়ে অসীম আকাশের দশ ফুট বাই দশ ফুটই দেখা যায়। তাও আবার ধূলো-ধোঁয়ায় ঘোলাটে। ভাবছিলাম এত সব সমস্যার সমাধান আমাকে দিয়ে হবে না। সেরকম টাকার জোর বা এলেম কোনোটাই আমার নেই। ছেলেবেলায় যদি নাটুদার মতো এই অসুখটা বাধিয়ে ফেলতাম, মানে আমিও যদি আকাশে তাকিয়ে রাত্তিরের গান শুনতে পেতাম তাহলে কিন্তু বেশ হতো…

1 comment:

  1. Sundor golpo Achintya. Amrao jodi cosmic symphony sonbar chests kortam😇😇

    ReplyDelete