0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


প্রকাশিত হলো ঋতবাক ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। এতদিন পরেও সম্পাদকীয় লিখতে বসে -যে-কথা বলিতে চাই, / বলা হয় নাই, / সে কেবল এই– / চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই / দেখিনু সহস্রবার / দুয়ারে আমার। / অপরিচিতের এই চির পরিচয় / এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয় / সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী / আমি নাহি জানি।

অকপট স্বীকারোক্তি। কিন্তু সব সময়, সব পরিস্থিতিতে দোষ-গুণ স্বীকার করে নেওয়া কি এতই সহজ! কিম্বা ধরুন, স্বীকার করে নেওয়াই গেল, দোষ আমার! কিন্তু আমার দোষের কারণে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়, যা অনেকের বিপর্যয়, এমনকি, প্রাণ নাশেরও কারণ হলো, তাকে তো আর বদলানো যাবে না কোনও ম্যাজিকেই! 

মাঝেরহাটের সেতু ভেঙ্গে পড়ে, বাগরি মার্কেটে প্রায় চার দিন ধরে জ্বলতে থাকে আগুন। আমরা ভুলে যাই কেরলের সেই বন্যা-তাড়িত মানুষগুলোর কথা। মনে পড়েনা ফুটপাথে ধর্ণায় বসা ছেলেদের শুকনো বিষণ্ণ মুখগুলো। সব ভুলে যাই। না, সব ভুলে থাকি। ফেসবুকবাজি শেষ হলে নিমগ্ন হই আত্মরতিসুখ আস্বাদনে। আসলে 'আত্ম' শব্দটি গৌরব হারিয়ে 'আমি'তে এসে ঠেকেছে, আর গতিক দেখে 'আত্মীয়' শব্দটি অবলুপ্তির রাস্তা ধরেছে।

তবুও কিছু অবশিষ্ট থেকেই যায়। পার হয়ে আসা বছরগুলো তারই সাক্ষ্য বয়ে চলে। তবুও আশ্বিন আসে। কাশ আর শিউলি, সাদা মেঘ আর ভোরের শিশির জানান দেয় আসছে উৎসবের দিন। আসন্ন উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠুন। তবুও কখনও কখনও 'আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে'ও দাঁড়ান। সচেতন হোন, সহমর্মিতা অনুভব করুন। 

সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন, সৃষ্টিতে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চন্দ্রভানু

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


সিনোসিলিকাফোবিয়া
চন্দ্রভানু



সম্পাদীকামহোদয়া যবে থেকে আমার মেসেঞ্জারে ক্রুজ মিসাইল হয়ে ঢুঁ মেরেছেন, সেদিন থেকে জাইথোলজি (zythology) নিয়ে খেলতে হচ্ছে। ছোটোবেলায় যেমন খলতে খেলতে জ্বরজারি বাঁধিয়ে বসতাম তেমনি জাইথোলজি নিয়ে খেলতে গিয়ে সিনোসিলিকাফোবিয়ায় (cenosillicaphobia) ভুগে ভুগে এক মহা জ্বালা উপস্থিত হয়েছে। মানে, এই ধরুন গেলাসে ঠাণ্ডা বিয়ার ঢেলেছি, কিন্তু পাছে গেলাস খালি হয়ে যায় সেই ভয়ে চুমুক দিতে ভয় পাচ্ছি। পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে তো? আমারও তাই মনে হচ্ছিল, পরে দিব‍্যজ্ঞানের গুঁতোয় জানা গেল গ্রিক শব্দ zythos হলো বিয়ার (আরও সঠিকভাবে বললে গেঁজানো) আর logos মানে যে জ্ঞান, সেই জ্ঞান তো সকলেরই আছে। অর্থাৎ কিনা বিয়ার সংক্রান্ত জ্ঞানই হলো জাইথোলজি, মতান্তরে গ‍্যাঁজানোর জ্ঞান, আর সিনোসিলিকাফোবিয়ার আক্ষরিক অর্থ শূন্য গেলাসজনিত ভয়। অগত্যা এই ভয় কাটাতে সিরিস এবং তাঁর জননী নিনকাসির শরণাপন্ন হই। সিরিসের সঙ্গে কিন্তু শিরীষকাগজের কোনও সম্পর্ক নেই এবং যদ্দুর জানি অন্যজন শিব্রামের কল্কেকাশির কোনও আত্মীয়া নন। বেশী পাঁয়তারা না করে খুলেই বলি তাহলে, সিরিস হলেন সুপ্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতায় বিয়ারের দেবী এবং তাঁর মাতৃদেবী নিনকাসি সুমেরিয় সভ্যতায় ঐ একই পদে পূজিতা হতেন। পৌরাণিক গল্পকথা ছেড়ে পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণে নজর দিলে দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবীর সব থেকে পুরোনো অ্যালকোহলিক পানীয় এই বিয়ারের প্রথম লিখিত ইতিহাস উদ্ধার হয় অধুনা ইরান থেকে, যা কিনা খ্রিস্টের জন্মের চার হাজার বছরেরও বেশী পুরোনো। অথচ বিবর্তনের অঙ্গুলি নির্দেশে সেই ইরানেই এখন অ্যালকোহলিক বিয়ারের কেনাবেচা আইনত নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ববিদ ম‍্যাকগোভার্নের (Patrick McGovern) গবেষণা অনুযায়ী প্রাচীন মিশরের গিজা শহরের বিখ‍্যাত পিরামিড তৈরীর সময় শ্রমিকদের প্রতিদিন মাথাপিছু নাকি চার লিটার করে বিয়ার বরাদ্দ ছিল। আবার ব‍্যাবিলনের সম্রাট হামুরাবির আমলে কিউনিফর্ম হরফে লেখা শিলালিপি থেকে জানা যাচ্ছে, বিয়ারে জল মেশালে উনি বিন্দাস কোতল করার ফরমান জারি করেছেন। 

শুধু ইতিহাস কেন, নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে রাস্তার ঝাড়ুদারদের দৈনিক ভাতায় এখনও পাঁচ ক‍্যান বিয়ার‌ বরাদ্দ, দেবী সিরিসের আশীর্বাদধন্য হতে গেলে এই পাঁচ ক‍্যানের কথাটা যথাসম্ভব পাঁচ কান করুন। ঝাড়ুদারদের কথা যখন এল, তখন পেশাগত সাম‍্য বজায় রাখতে বৈজ্ঞানিকের কথাও বলতে হয়। ১৯২২ খৃষ্টাব্দে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর (Niels Bohr) নোবেল পুরস্কার পান আর সেই সম্মানে গর্বিত হয়ে সে দেশের বিয়ার কোম্পানি কার্লসবার্গ তাঁকে একটি বাড়ি উপহার দিয়ে বসে। কার্লসবার্গ বিয়ার ফ‍্যাক্টরির পাশে অবস্থিত বাড়িটির বৈশিষ্ট্য ছিল রান্নাঘরের কলে, কল খুললেই বিয়ারের আনন্দধারা চব্বিশ ঘন্টা। 

খামির বা ঈস্ট (yeast) ব্যবহার করে বিভিন্ন খাদ্যশস্য অথবা ফলমূল গেঁজিয়ে (ferment) বা চোলাই করে তা থেকে তৈরী হয় ধরাধামের তামাম সুরাসার পানীয়। এ লেখা যেহেতু বিয়ার পান করে, থুড়ি, বিয়ার পান করা নিয়ে, তাই চট করে সংক্ষেপে জেনে নিই বিশ্ব-জনপ্রিয়তায় (জল এবং চায়ের পরে) তৃতীয় স্থানাধিকারী এই পানীয় তৈরীর ছলাকলা। বিয়ার তৈরীতে ব্যবহার হয় মূলতঃ যব বা বার্লি (barley), তবে যবের সঙ্গে কখনও সখনও ব্যবহার হয় চাল, গম, ভুট্টা মায় কাসাভা (cassava) অবধি। এখেনে ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি, এই কাসাভা (এক প্রজাতির মূল) থেকেই আবার তৈরী হয় আমাদের অতিপরিচিত সাবুদানা বা সাগুদানা (tapioca)। বিয়ার তৈরীর পদ্ধতির সবিস্তার বর্ণনা করে পাঠককূলের মস্তিষ্ক ঘেঁটে দেবার কোনও সুপ্ত বাসনা আমার মধ‍্যে নেই, তবে কিছুটা উল্লেখ না করলে আবার অসম্পূর্ণতার দায়ে পড়তে হয়। বিয়ার তৈরীর যাত্রা শুরু হয় অঙ্কুরিত যব থেকে, অঙ্কুরোদ্গমের ফলে শস্যদানার ভেতরে তৈরী হয় বিভিন্ন ধরণের উৎসেচক (enzyme) আর এই অঙ্কুরিত যবদানা গরম হাওয়ায় শুকিয়ে নিলে তাকে বলে মল্টেড বার্লি (malted barley)। অতীতে বার্লি মল্ট করার জন্য ব্যবহার হতো কাঠের আগুনের চুল্লি। কিন্তু চুল্লির ভেতর সর্বত্র তাপমাত্রা সমান রাখতে পারত না এই কাঠের আগুন, যার ফলে বার্লিদানার মল্টিংও হতো অসমানভাবে, আর এর প্রভাব পড়ত বিয়ারের স্বাদের তারতম্যে। ইংল্যান্ডে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাপ উৎপাদনের জন্য ব‍্যাপকহারে কয়লার ব্যবহার শুরু হয় এবং মল্টিং-এর জন্যও অবশেষে কাঠের আগুনের জায়গা নেয় কয়লার আগুন। কয়লার আগুনের ব্যবহার শুরু হতে মল্টিং প্রসেসও সম্পন্ন হতে থাকে সর্বত্র সমানহারে আর বিভিন্ন ব্যাচে তৈরী বিয়ারের স্বাদের মধ্যেও তারতম্য কমে যায়। সময়ের সঙ্গে বিয়ার তৈরীর প্রত‍্যেকটি ধাপের পরিবর্তনে লক্ষ্য করা যায় বিজ্ঞানের উন্নতির পদক্ষেপ। 

মল্টেড বার্লিকে গুঁড়ো করে নিয়ে গরম জলের সঙ্গে মণ্ড বানালে যবদানার মধ্যে থাকা শ্বেতসার (carbohydrate) উৎসেচকের প্রভাবে পরিণত হয় বিভিন্ন ধরনের শর্করায়। এই শর্করা কিন্তু আমাদের চিরপরিচিত চিনির থেকে রাসায়নিকভাবে আলাদা, যদিও স্বাদে চিনির মতোই মিষ্টি। শর্করার এই জলীয় দ্রবণে (wort) মেশানো হয় বিভিন্ন গাছের পাতা ও ফুল, শুধুমাত্র সংরক্ষক (preservative) হিসেবেই নয়, বিয়ারের তিতকুটে স্বাদ এবং তার চারিত্রিক সুবাস (flavour) আনার জন্যও বটে, এই পদ্ধতির বিলাতি নাম হপ (hop)। ঐ হপ মিশ্রিত শর্করা দ্রবণ ছেঁকে নিয়ে তাতে মেশানো হয় ঈস্ট, যা কিনা এককোষী ছত্রাক। এই ঈস্টের কাছেই থাকে বিয়ার তৈরীর আসল চাবিকাঠি। শর্করা দ্রবণে ঈস্ট মহানন্দে নিজের বংশবিস্তার করে এবং তার সঙ্গে তৈরী করে বিভিন্ন উৎসেচক, উৎসেচকের প্রভাবে বার্লির শর্করা গেঁজে উঠে তৈরী হয় অ্যালকোহল আর কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। বিয়ারের গেলাসে যে ফেনা দেখা যায় তা এই কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের বুদবুদমাত্র। প্রায় দেড় হাজারেরও বেশী প্রজাতির ঈস্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে অনেকগুলি আবার মনুষ্যসৃষ্ট, তবে সব রকমের ঈস্ট কিন্তু বিয়ার তৈরীতে কাজে লাগে না। হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার বিবর্তনের ছোঁয়া পড়েছে বিয়ার তৈরীর পদ্ধতিতে, তবে সম্ভবত সবথেকে বেশী প্রভাব পড়েছে এই ঈস্ট নির্বাচনে, তাই ঈস্টকে বিয়ার তৈরীর ইষ্টদেবতা বললেও অত্যুক্তি হয়না। যাঁরা বিয়ারের নাম শুনলে নাক সিঁটকে বলেন, স্কচ-হুইস্কির কাছে বিয়ার কিস্যু নয়, তাঁদেরকে বলি, বিয়ার হচ্ছে গিয়ে স্কচের জনক। আজ্ঞে হ্যাঁ, হপ করার পরিবর্তে বিয়ারকে যদি সোজা পাতন (distillation) করা হয়, সোজা বাংলায়, উনুনে বিয়ার ফুটিয়ে তার বাষ্প সংগ্রহ করলে সেই থেকে জন্ম নেয় অ্যালকোহলসমৃদ্ধ স্কচ-হুইস্কি। সাধে কি মহাজনেরা বলেছেন, beauty is in the eye of beer holder. এই দ্যাহো, হপ লিখে লিখে হাঁপিয়ে গেলাম, অথচ এটা বলতে ভুলে গেছি যে, হপ আদতে একটি গুল্মজাতীয় ফুলগাছের চলতি নাম, দাঁতভাঙা ল্যাটিনে একে ডাকা হয় হিউমুলাস লুপুলাস (Humulus lupulus) নামে। হপ নামটি যদিও বিলিতি এনার একটি সুন্দর পোষাকি বাংলা নাম আছে, আজিঘ। এখেনে এটা জানিয়ে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আজিঘ আবার উচ্চবংশীয় কুলীন শ্রীল শ্রীযুক্ত শ্রীমান গঞ্জিকা গাছের নিকটাত্মীয়! আজকাল অবিশ্যি বিয়ার তৈরীতে হপ ছাড়াও অন্যান্য গাছের‌ও ফুল পাতা ব্যবহার হয়ে থাকে, তবে প্রক্রিয়াটির নাম সেই হপই রয়ে গেছে। 

গেঁজানোর গাজন শুনে এখনও অবধি যাঁদের গলা শুকিয়ে যায়নি বা প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়নি, তাঁদের আরেকটু তথ্য দিলে ক্ষতিবৃদ্ধির বিশেষ সম্ভাবনা দেখছিনে। আপনি বিয়ার রসিক হোন বা না হোন বিয়ারের প্রকারভেদ জানাটা কিন্তু অত‍্যন্ত জরুরী, নিদেন বন্ধুদের জ্ঞানসুধাধারা বিতরণে কাজে লাগতে পারে। ফার্মেন্টেশনের সময় কিছু ঈস্ট শর্করা দ্রবণের উপরিভাগে ভেসে থেকে বংশবৃদ্ধি করে, কিছু ঈস্ট আবার ডুবে ডুবে জল খাওয়ার মতো দ্রবণের তলানিতে থেকে বংশবৃদ্ধি করতে পছন্দ করে (যদিও ফার্মেন্টেশনের শেষে সমস্ত ঈস্ট নীচেই থিতিয়ে পড়ে)। প্রথম প্রকারের ঈস্টসৃষ্ট বিয়ারকে বলে এল্‌ (ale) আর অন্যটির পরিচিতি ল্যাগার (lager) নামে, মোটামুটিভাবে সমগ্র বিয়ার প্রজাতিকে এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এই দুজাতের ঈষ্টের কাজের পরিবেশও আবার ভিন্ন; এল্‌ তৈরি করার ঈষ্ট, যার পোষাকি ল্যাটিন নাম Sacchromyces cervisiae, কাজ করে মোটামুটি ১৬ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে এবং প্রাথমিকভাবে ফার্মেন্ট করতে প্রায় দিন সাতেক সময় নেয়। Sacchromyces patorianus ল্যাগার তৈরীতে সময় নেয় প্রায় দেড় থেকে দুমাস এবং এর পছন্দের তাপমাত্রা দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার‌ও নীচে। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে এল্‌ তৈরীর ঈস্ট পেডিগ্রিওয়ালা বিশুদ্ধ প্রজাতির, কিন্তু ল্যাগারের ঈস্ট আদতে বর্ণসঙ্কর, তাই খৃস্টিয় পনেরোশ বছরের আগে ল্যাগার বিয়ারের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তবে কয়লার আগুনের ব‍্যবহারকে যদি বিয়ার তৈরীর একটা মাইলস্টোন ধরা যায়, তাহলে ল্যাগার বিয়ার তৈরীর ক্ষেত্রে রেফ্রিজারেশনের আবিষ্কার ছিল অন‍্যতম যুগান্তকারী পদক্ষেপ। 

বিয়ার রসিকেরা বিয়ারের স্বাদ এবং সে স্বাদের রেশ (after taste) এই দুইয়ের ওপর ভিত্তি করে এল্‌ আর ল্যাগারের পার্থক্য অনায়াসে বলে দিতে পারেন। প্রকৃতির খেয়ালে এল্‌ তৈরীর ঈস্ট অনেক বেশী অ্যালকোহল সহ্য করতে সক্ষম, তাই এল্‌-এ অ্যালকোহলের ভাগ অনেকক্ষেত্রেই ল্যাগারের থেকে বেশী হয়। হয়ত সেজন‍্য‌ই সেই কোনওকালে সেক্সপিয়র সাহেব বলে গেছেন "for a quart of ale is a dish for a king", দুপাত্তর এল্ আর রাজভোগে কোনও পার্থক্য নেই। রঙের বিচারে ল্যাগার সাধারণত হালকা সোনালী থেকে গাঢ় হলদেটে রঙের হয়, সেখানে এল্‌-এর রঙ আরও গাঢ় হয়ে কালচে লাল, যাকে বলে অ্যাম্বার এল্‌ (amber ale), এমনকি আরও কৃষ্ণবর্ণের হতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেশীরভাগ বিয়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা ল্যাগার বিয়ার তৈরী করে থাকে, বস্তুত সারা বিশ্বে ল্যাগারের চাহিদাই বেশী। তবে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার কারণে এবং কেরামতিতে আজকাল শুধুমাত্র রঙ বা অ্যালকোহলের পরিমাণ দেখে এল্‌ আর ল্যাগারের পার্থক্য করা ক্রমেই শক্ত হয়ে পড়ছে। 

অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ারের আগমন ঘটে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাত ধরে এবং আরও পাকাপাকিভাবে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়লাভের পরে। এই কালা নেটিভদের দ্যাশে সাহেবরা যখন গরমে হেঁদিয়ে যেতেন, তখন দু-এক গেলাস ঠাণ্ডা বিয়ার বোধকরি তেনাদের শরীরে নতুন জোশের জোয়ার নিয়ে আসত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই উপমহাদেশে বিয়ার ছিল দুর্মূল্য, কারণ ইংল্যান্ড থেকে প্রায় ছয়মাস যাবৎ জাহাজ যাত্রা শেষে যখন বিয়ার এসে পৌঁছতো ততদিনে বহু বিয়ারের পিপে জাহাজ যাত্রার ধকলে ঠোকাঠুকি লেগে ভেঙে নষ্ট হয়েছে; আবার, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে বিয়ার খারাপ হওয়ার ফলেও অনেক বিয়ার নষ্ট হতো। ফলতঃ বেঁচেকুচে থাকা বিয়ারের দাম অগ্নিমূল্যে না বেচলে পড়তায় পোষাত না। অবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎসাহে লন্ডনের জর্জ হজসন (George Hodgson) ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তৈরী করেন পেইল এল্‌ (Pale ale); যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ইন্ডিয়ান পেইল এল্‌ (Indian pale ale বা সংক্ষেপে IPA) নামে। জর্জ সাহেবের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল এমন এক বিয়ার বানানোর, যা ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসার ছয়মাস জাহাজ যাত্রার পরেও ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণে নষ্ট হবে না। জর্জসাহেব সেইসময়ে লন্ডনে প্রচলিত অক্টোবর এল্‌ (October ale) নামে একটি জনপ্রিয় এলের স্বাদে অনুপ্রেরিত হয়ে বেশী অ্যালকোহল এবং অতিরিক্ত হপ যুক্ত এই ইন্ডিয়ান পেইল এল্‌ তৈরী করেন, pale শব্দ যোগ করা হয় এই এল্‌-এর হালকা রঙের জন্য। জানা যায়, ভারতে বসবাসকারী ধনী ইংরেজদের কাছে এই এল্‌ ছিল যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে IPA তৈরী করার কয়েক বছরের মধ‍্যেই হজসনের দুই ছেলে বুড়ো বাপের থেকে ব‍্যবসা ছিনিয়ে নেয় এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে বিভিন্ন বৃটিশ উপনিবেশে হজসন বিয়ার শুরু করে একচেটিয়া ব‍্যবসা। সম্ভবতঃ বিশ্বের প্রথম গ্লোবাল বিয়ার ব্র‍্যান্ড এই হজসন, যাদের লোগো ছিল একটি লাল রঙের ত্রিভুজ। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হজসন কোম্পানি অবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তোয়াক্কা না করে নিজেই সরাসরি বিভিন্ন বৃটিশ উপনিবেশে ব‍্যবসা শুরু করে। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লভ‍্যাংশ কমতে থাকে এবং কোম্পানির কর্তারা বিকল্প অনুসন্ধানে মনোযোগী হন। ১৮২১ খৃস্টাব্দের শেষাশেষি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্তাব‍্যক্তি Campbell Marjoribanks ইংল্যান্ডের বার্টন-অন-ট্রেন্ট শহরের একটি বিয়ার কোম্পানির মালিক স‍্যামুয়েল অ্যালসপকে (Samuel Allsop) চ‍্যালেঞ্জ দেন হজসন বিয়ারের থেকেও ভালো স্বাদের বিয়ার বানানোর। কয়েকমাসের মধ‍্যেই অ্যালসপ তৈরি করেন আরও ভালো স্বাদের IPA, ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি তৎকালীন খবরের কাগজ ক্যালকাটা গেজেটেও এই IPAর গুণগান করে খবর ছাপা হয়। অনুমান করা যায়, স্বাদে হিট দামে ফিট এই IPA ওয়াজ সেলিং লাইক হট কচুরিস। অ্যালসপের প্রায় রাতারাতি বিখ‍্যাত হয়ে ওঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বার্টন শহরের আরও অনেক বিয়ার তৈরীর কোম্পানি এই অলিখিত প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় এবং এর ফলে অবশেষে হজসনের একচেটিয়া ব‍্যবসার অবসান হয়। 

ফুল্লরার বারোমাস‍্যা বলুন বা ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পাদ্রি সাহেব উইলিয়াম ওয়ার্ডের লেখা (A view of the history, literature and religion of the Hindoos) বলুন, তৎকালীন ছাপোষা বাঙালীদের খাদ্যাভাসে পানীয় বলতে কিন্তু জল, ডাবের জল, ঘোল বা দুধ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। অথচ বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাবু' বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নব বাবু বিলাস' পড়লে দেখা যায় যে, উচ্চবিত্ত বাঙালিবাবুরা সবিশেষ পানপটু ছিলেন। তবে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী রাজ্যের আদিবাসীদের মতো বাংলার আদিবাসী সমাজেও বোধকরি তালের রস এবং মহুয়া থেকে বানানো অ্যালকোহলিক পানীয় চালু ছিল। তার মানে বর্তমান সামাজিক অবস্থার মত‌োই তখনকার মধ‍্যবিত্ত বাঙালিও এ রসে বঞ্চিত ছিল। বাঙালির বিয়ার পানের সপক্ষে প্রথম লিখিত ঐতিহাসিক রেফারেন্স পাওয়া যায় ১৮৪৩ খৃস্টাব্দে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ওরিয়েন্টাল ম‍্যাগাজিনের পাতায়। ডিরোজিওর নেতৃত্বে ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্টের যে সূত্রপাত তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল "... (young Bengalis) cutting their way through ham and beef, and wading to liberalism through tumblers of beer". অর্থাৎ, পশ‍্য পশ‍্য, তরুণ বাঙালিরা নির্দ্বিধায় গরু-শুয়োর হজম করিয়া বিয়ারের গেলাস হস্তে উদারনৈতিক পথে অগ্রসর হ‌ইতেছে। অত‌এব, দেখা যাচ্ছে শাক্ত বাঙালি যতই পঞ্চ ম-কারে পটু হোক না কেন, বিয়ারের নোলাটি কিন্তু তাঁদের বৃটিশদের থেকেই পাওয়া। 

বিয়ারপ্রেমীদের কাছে দুঃখের কথা এই যে, ইংরেজদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও IPA বা ইন্ডিয়ান পেইল এলের বিলুপ্তি ঘটে, যদিও ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এখনও এর কদর বেড়েছে বই কমেনি। অথচ ওদিকে আবার সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক শহরের Sixpoint brewery নামে একটি সংস্থা Bengali নামে একটি IPA ব্র‍্যান্ড বাজারে ছেড়েছে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে ছোটো ছোটো কিছু ভারতীয় কোম্পানিও IPA বানানো শুরু করেছে, যদিও ভারতীয় উপমহাদেশের ল্যাগারখোর সমাজ একে মেনে নেবে কিনা জানা নেই। প্রায় স্বচ্ছ হালকা সোনালি বর্ণের এল্‌ যদি পেইল এল্‌ হয়, তবে তার অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটি স্টাউট (stout) নামে পরিচিত। কাঁচের গেলাসে স্টাউট ঢাললে দেখা যাবে তা প্রায় অস্বচ্ছ, ঘোর বাদামি থেকে প্রায় কৃষ্ণবর্ণের, অ্যালকোহলের পরিমাণও এতে কিঞ্চিৎ বেশী থাকে। সাধারণত আয়তন হিসেবে বিয়ারে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৯% এর নীচেই থাকে, তবে এ নিয়মের ব‍্যতিক্রমী এমন অনেক ইউরোপিয়ান বিয়ার আছে যাতে ১৩% অবধি অ্যালকোহল পাওয়া যায়। বিয়ারে অ্যালকোহলের পরিমাণ নিয়েই যদি কথা ওঠে, তবে সেখানে জ্বলজ্বল করছে আইরিশ কোম্পানি Brewmeister-এর তৈরী Snake venom বিয়ার, শুধু নামে নয় কার্যত‌ই এ যেন সর্পবিষ, এতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৬৭.৫%! যেখানে হুইস্কি, ভডকা জাতীয় কড়া পানীয়তে অ্যালকোহলের পরিমাণ থাকে ৪২.৫%। 

এল্ নিয়ে এত কিছু বলার পর ল্যাগার নিয়ে কিছু না বললে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতে হয়। ল্যাগার শব্দটি কিন্তু আদতে জার্মান শব্দ lagern থেকে এসেছে, যার অর্থ জমিয়ে রাখা (to store)। ভাঁটিতে ল্যাগার তৈরী হবার পর বেশ কয়েকমাস যাবৎ একে শীতঘুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ খুব কম তাপমাত্রায় একে স্টোর করে রাখা হয়। এভাবে কয়েক হপ্তা রাখার ফলে এতে অত‍্যন্ত ধীর গতিতে অতিরিক্ত ফার্মেন্টেশন (secondary fermentation) ঘটে। ল‍্যাগার স্টোর করতে যদি কাঠের পিপে ব‍্যবহৃত হয় তাহলে কাঠের ট‍্যানিন বা ভ‍্যালিনিনের সঙ্গে বিয়ারের জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিয়ারে বিভিন্ন নতুন ফ্লেভার তৈরী হয়, একে বলে এজিং (aging)। তাই ঐতিহ্যগতভাবে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাঠের পিপেতে এজিং করা বাঞ্ছনীয়। বহুজাতিক সংস্থাগুলি অবশ‍্য ল‍্যাগার তৈরীর ক্ষেত্রে কাচের বোতলেই বিনা এজিং-এ শুধুমাত্র সেকেন্ডারি ফার্মেন্টেশন করে সেই কাজ সারছে। এখানে একটা কাজের ইনফরমেশন দিয়ে রাখা ভালো, অনেক রেঁস্তোরা বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে "এখানে ড্রট (draught) বিয়ার পাওয়া যায়" এই বলে, কাচের বোতল বা অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ক‍্যানের বদলে কাঠের পিপে থেকে গেলাসে ঢেলে যে বিয়ার পরিবেশন করা হয় সেটাই ড্রট (ভিন্ন উচ্চারনে ড্রাফ্ট) বিয়ার। তবে এখন কাঠের পিপের বদলে স্টেইনলেস স্টিলের পিপে ব‍্যবহার হয়, যার মধ‍্যে বিয়ারের সঙ্গে থাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা নাইট্রোজেন গ‍্যাসের উচ্চচাপ। সাধারণত কোনও রেস্তোরাঁর আশেপাশে বিয়ার তৈরীর ভাঁটি থাকলে সেখানে সদ‍্যোজাত ড্রাফ্ট বিয়ার পাবার সম্ভাবনা বেশী। সুতরাং, হে সরলমতি পাঠকপাঠিকাগণ, কদাপি বিজ্ঞাপনের চটকে ঠকিবেন না, ড্রট বা ড্রাফ্ট কোনও বিশেষ প্রকারের বিয়ার নয় বরং পরিবেশনের প্রকারভেদে (সাধারণতঃ সদ‍্যোজাত) বিয়ারের নামান্তর মাত্র। বলা বাহুল‍্য যে, এই ড্রাফ্ট বিয়ার কিন্তু এল্ বা ল‍্যাগার দুটোই হতে পারে। 

এ জগতে বিয়ার পান করার লোকের যেমন অভাব নেই, তেমনি বিয়ার ত‍্যাগ করেছেন এমন লোকও বিরল নয়। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল, গপ্পোটা বলি শুনুন। বেলজিয়ামের কোন এক বিয়ার বারে এক ব‍্যক্তি গিয়ে তিন গেলাস বিয়ার চাইলেন, বিয়ার এল। উনি তরিবৎ করে প্রত‍্যেকটি গেলাস থেকে একচুমুক একচুমুক করে শেষে তিনটে গেলাস‌ই খালি করে ফেললেন। পরের দিন ঐ একই সময়ে একই ব‍্যক্তি অকুস্থলে হাজির, সেই তিন গেলাস বিয়ার, ম‍্যায়খানার নতুন সাকি এবার একটু অবাক। তৃতীয় দিন ঐ একই ঘটনা ঘটতে আমাদের নয়া বারটেন্ডার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে ফেলে, দাদা, বলছি কি আপনি একসঙ্গে তিন গেলাস বিয়ার না নিয়ে একটা শেষ হলে পর একটা নিন না, সবাই তো ঠাণ্ডা বিয়ার‌ই পছন্দ করেন। লোকটি তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে, জানো ভায়া, আমরা তিন ভাই। কিন্তু তিন ভাই তিনটে আলাদা দেশে থাকি, তাই আমরা ঠিক করেছিলাম আমরা আলাদা থাকলেও যখন‌ই আমাদের মধ‍্যে কোনও একজন বিয়ার পান করবে, তখন সে একইসঙ্গে অন্য দুই ভাইদের জন্যও স্বাস্থ্যপান করবে। এই তিনটে গেলাসের একটা আমার আর বাকি দুটো আমার দুভাইয়ের জন‍্য, তাই আমাকে একসঙ্গে তিনটে গেলাস নিতে হয়। এমন অসাধারণ ভাতৃপ্রীতি দেখে আমাদের সাকি ভায়া খুবই মুগ্ধ, যাকে বলে এক্কেরে অভিভূত। এরপর থেকে ঐ ভদ্রলোক এলেই খাতিরটা একটু বেশী হতে লাগল। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন ঐ ভদ্রলোক এসে ছলছল চক্ষে দু গ্লাস বিয়ারের অর্ডার দিলেন। আমাদের সাকি ভায়া দরদী মানুষ, ওনার গেলাসের বিয়ার শেষ হলে পর সহানুভূতি জানাতে কাছে গেলেন, দাদা আপনার দুঃখ আমি বুঝতে পারছি, কেউ তো আর চিরকাল থাকে না, জন্মিলে মরিতে হবে, বাসাংসি জীর্ণানি ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি, এবং অবশেষে জিজ্ঞেস করেই ফেল্লে, তা আপনার কোন ভাই মারা গেলেন? ভদ্রলোক একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন, না হে, ভাইয়েরা সবাই ঠিক‌ই আছে, আমিই বিয়ার ছেড়ে দিয়েছি। 

সেই বেলজিয়ামের কাহিনী যখন শুনলেন তখন এটাও শুনে রাখুন, ইউরোপ মহাদেশে বেলজিয়াম এমন একটি দেশ যেখানে প্রায় একহাজার ছ'শ বিভিন্ন জাতের বিয়ার পাওয়া যায়। হতে পারে বেলজিয়ামে বিশ্বের সর্বাধিক বিভিন্ন প্রকারের বিয়ার পাওয়া যায়, কিন্তু কখনও কখনও মায়ের কাছেও মাসির গল্প করতে হয়। কেন জানেন? কারণ, প্রতি বছর মাথা পিছু বিয়ার পানের কম্পিটিশনে বেলজিয়ামকে বাইশ নম্বরে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করে বসে আছে বেলজিয়ামের পড়শির পড়শি দেশ চেক রিপাবলিক (পূর্বতন চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ)। চেক করে দেখে নিতে পারেন চেক রিপাবলিকের একজন মানুষ বছরে গড়পড়তা প্রায় ১৪২ লিটার বিয়ার পান করে থাকেন। এহেন তথ্য বোধকরি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ছাপার যোগ্য। ও হ্যাঁ, গিনেস বলতে আবার মনে পড়ল, এ হলো বিখ‍্যাত আইরিশ কোম্পানি Guiness Brewery এবং এদের তৈরী স্টাউট বিয়ার বিশ্বপ্রসিদ্ধ। অথচ আশ্চর্যের ব‍্যাপার হলো এই কোম্পানির বিয়ার সর্বাধিক বিক্রি হয় নাইজেরিয়ায়, নিজের দেশ আয়ারল‍্যান্ডে নয়। সেইজন্য বোধহয় বাংলায় প্রবাদ আছে, কোথাকার বিয়ার, থুড়ি, জল কোথায় গড়ায়। 

এই গিনেস কোম্পানির বিয়ার এত‌ই খানদানি যে একে নিয়ে একটি মজার গল্প বাজারে চালু আছে। কোনও একসময় সমস্ত নামকরা বিয়ার কোম্পানির কর্ণধারেরা নাকি ব্যবসা সংক্রান্ত একটি আলোচনাসভায় মিলিত হন। মিটিংয়ের শেষে খানাপিনার সময় প্রত‍্যেকে বিয়ার অর্ডার দিলেন, স্বাভাবিকভাবেই সবাই নিজের নিজের কোম্পানির তৈরী বিয়ারের অর্ডার করলেন। যেমন বাড‌ওয়াইজারের বড়কর্তা বাড‌ওয়াইজার অর্ডার দিলেন, টুবর্গের ম‍্যানেজার টুবর্গ চাইলেন ইত‍্যাদি। কিন্তু গিনেসের মালিক চাইলেন কোকাকোলা, উপস্থিত সকলেই অবাক, ব‍্যাপারটা কি? সবাই চেপে ধরলেন ওনাকে, কি ব‍্যাপার মশাই? আপনি গিনেস নিলেন না যে বড়ো? যেন একপ্রকার অপ্রস্তুত হয়েই উনি উত্তর দিলেন, দেখলাম আপনারা কেউ বিয়ার নিচ্ছেন না, আমি আর কোন মুখে গিনেসের কথা বলি। 

তা গিনেসের বিয়ার না পেলেও ক্ষতি নেই, অন্য যেকোনও বিয়ারে গলা ভেজাতে পারেন। কারণ, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় জানা গিয়েছে বিয়ার আদতে স্বাস্থ‍্যকর পানীয়, ওয়াইনের চাইতেও বেশী প্রোটিন আর ভিটামিন বি এতে আছে। সাদা বা হলদে রঙের উদ্ভিজ্জ দ্রব‍্যে যে সকল রঞ্জকপদার্থ পাওয়া যায় তাদেরকে একত্রে বলে ফ্ল‍্যাভোনয়েড (flavonoid), আর বিয়ারে এই ফ্ল‍্যাভোনয়েড রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে যা আসে হপ থেকে। এসমস্ত ফ্ল‍্যাভোনয়েড মানুষের শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, ঠিক যেমন ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই করে থাকে। গবেষকরা বলছেন নিয়মিত স্বল্প পরিমাণে বিয়ার পান করলে প্রস্টেট ক‍্যানসার থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, রক্তাল্পতা, কিডনির পাথর মায় হার্ট অ্যাটাক অবধি বিবিধ রোগ হ‌ওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, উপরন্তু শরীরের হাড়গোড় হয় মজবুত। তবে কিনা শাস্ত্রে বলেছে সর্বমত‍্যন্ত গর্হিতম, অর্থাৎ কিনা কোনওকিছুর বাড়াবাড়ি ভালো নয়। তাই কবি (কোন কবি জিজ্ঞেস করে অধমকে লজ্জা দিবেন না) লিখেছেন - 

অত‌এব হে সুধীজন, 
আপ্তবাক‍্য রাখিয়া স্মরণে 
বিয়ার সেবন কর 
নিয়মিত স্বল্প পরিমাণে। 

তবে শুধু স্বাস্থ্য কেন, সৌন্দর্যায়নেও বিয়ারের উপস্থিতি সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মতো, অনেক বিউটি টিপস্-এ স্নানের সময় বিয়ার দিয়ে চুল ধোয়ার কথা বলা হয়, বিশেষতঃ যাঁদের চুলে জট পড়ার প্রবণতা বেশী রয়েছে। ফার্মেন্টেশনের পরেও বিয়ারের মধ‍্যে থেকে যায় স্বল্প পরিমাণে স্টার্চ বা শ্বেতসার বেঁচে থাকে এবং বিয়ার দিয়ে চুল ভিজিয়ে ধুয়ে নিলে প্রত‍্যেকটি চুলের ওপর এই স্টার্চের একটা সূক্ষ্ম আস্তরণ পড়ে যায়, যা চুলকে জটমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। বিয়ারের চুলচেরা বিচার ছেড়ে বরং বিয়ার উৎসবের দিকে নজর দেওয়া যাক। বিয়ার পান করা যে শুধুমাত্র নেশা করার জন্য নয় বরং তার থেকেও আরও বেশী আনন্দ উদ্রেককারী অনুভূতির জনক, বোধকরি সেইটে বোঝার জন্য সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিয়ার উৎসবের দিকে তাকানো উচিত। জার্মানি, ইংল্যান্ড-সহ বহু ইউরোপিয়ান দেশে, ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর বা কলম্বিয়াতে বছরেরবিভিন্ন সময় বিভিন্ন শহরে বিয়ার উৎসবে শয়ে শয়ে মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। আপনার কাছে যদি একসেকেন্ডে বিশ্বভ্রমণের কোনও উপায় থাকত, তাহলে দেখতে পেতেন যেকোনও মুহূর্তে প্রায় পাঁচ কোটি লোক এই আনন্দধারায় মেতেছে ভুবনে। আজ্ঞে হ‍্যাঁ, পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জানা গেছে প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি হাজার জনে সাতজন লোককে মাতাল অবস্থায় পাওয়া যায়। 

জানি জানি, আপনারা এই বিয়ারের গেঁজানো গজল্লা পড়ে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছেন। তবে কেটে পড়ার আগে, খাস কোলকাত্তাইয়া কাহানি না শুনলে এই বিয়ারের পাঁচালি পড়ার পুণ‍্যটাই নষ্ট। কোলকাতায় কালীপুজোর সময় নতুন নতুন কলেজে ঢোকা ছেলে-ছোকরারা বিয়ার সেবনের কলজে পায়। সেরকমই কোনও এক কালীপুজোর রাতে দুই কলেজ পড়ুয়া বন্ধু আকন্ঠ বিয়ার-বিহার সেরে রাস্তা দিয়ে টলতে টলতে যাচ্ছে। এমন সময় সামনে পড়েছে কালীপুজোর এক প‍্যান্ডেল, মণ্ডপে বিরাজমানা মাকালীর বিগ্রহ দেখে এক বন্ধুর হঠাৎ ভক্তিযোগ জেগে ওঠে, সে দাঁড়িয়ে পড়ে উদ্বাহু হয়ে করজোড়ে বলে, মা, মাগো, আমাদের একটু দেখো মা। অন‍্য বন্ধুটির কানে মা শব্দটি পৌঁছতে সেও তখন জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে, আমাকেও একটু দেখবেন কাকিমা। 


1. Ancient Wine: The Search for the Origins of Viniculture, Patrick McGovern,Princeton University Press, 2003 
2. https://www.factslides.com/s-Beer 
3. A view of the history, literature, and mythology of the Hindoo, William Ward, Serampore Mission Press, 1818 
5. Studies in Bengalee Literature I, S. Mukerjee, Hindustan Review, May 1907, p 480

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

Posted in


প্রবন্ধ


কমলাকান্ত উবাচ –মুক্তজীব 
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী 



কমলাকান্ত আমার জীবনে অমাবস্যায় চাঁদের উদয়ের মতো। 

তার সাথে আমার একান্ত গোপনীয় সখ্যতাটা আমাকে,সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ভীষণ ভাবে হ্নট করে। গৌড় বর্ণ, আত্মভোলা, অল্পে তুষ্ট, আফিমসেবী, ভোজনং-যত্রতত্র-শয়নং-হট্টমন্দির বিলাসী, কর্মবিমুখ এই সদালাপী ব্রাহ্মণ আমাকে কেমন যেন সন্মোহিত করে তুলেছে। 

প্রায় প্রতিদিনই আমি মধ্যরাতে তার প্রতীক্ষায় বসে থাকি। কিন্তু সে নিয়মিত দর্শণ দেয় না। উঞ্ছবৃত্তীজিবী এই ব্রাহ্মণ কখন কোথায় যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে তার সন্ধান পাওয়া এক কথায় অসম্ভব। তাই তিনি দেখা দিলেন তো দিলেন, না দিলেন তো না দিলেন ধরেই আমায় “ধন্য আশা কুহকিনী” রূপে চাতক পাখির ন্যায় বসে থাকতে হয়। আমার গৃহে কখন তার পদধূলি পড়বে এই ভেবে ভেবেই আমার কত যে রাত নিদ্রাহীন অবস্থায় কেটে যায় তার ইয়ত্তা নেই। 

সন্ধ্যের পর থেকেই মন উচাটন হতে থাকে কৃষ্ণ বিরহে রাধার মতো। ব্যাপারটা যে অর্ধাঙ্গিনীর নজর এড়িয়ে গেছেতা নয়, তবে শ্বশুরদুহিতা আমার যে সকল কর্মকাণ্ড ক্ষমা ঘেন্না করে মাফ করে দেন তার মধ্যে আমার এই কমলাকান্ত সিন্ড্রোমটি বিদ্যমান থাকায় আমি আপাতত তাঁর অঙ্কিত লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করিনি। তবে তাঁর শ্যেন দৃষ্টিকে আর কতদিন ডজ করে যেতে পারব সেটা বলা খুব মুশকিল। একবার সাহস করে তাঁর কাছে কমলাকান্তরকথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম যে আমার স্ত্রী’র মতে আমার জন্য অবিলম্বে একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের জরুরি প্রয়োজন। তারপর থেকে ওনার সামনে আমি অত্যন্ত বিরল গাম্ভীর্য নিয়ে চলা ফেরা করে থাকি কেননা আমার কর্মক্ষেত্রে আমার উপরওয়ালা একবার বলেছিলেন যে কোনও সময়ে কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখাবার প্রয়োজন হলে জনসমক্ষে চিন্তামগ্ন অবস্থায় দ্রুত চলা ফেরা করাটা অতীব জরুরি। এই টোটকাটা কাজে লাগিয়ে আমি আপাতত স্ত্রী’র কাছে বেশ নিরাপদ দুরত্বে সন্মানিত অবস্থাতেই আছি। 

কিন্তু কমলাকান্ত যেভাবে নিজেকে আমার কাছে অনিয়মিত করে তুলছে তাতে আমার সেই “রাধার কানু বিহনে হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ” ভাবটার মতো “হা কমলাকান্ত, হা কমলাকান্ত” অবস্থাটা খুব শীঘ্রই সকলের নজরে এসে পড়বে বলেই মনেহয়। আর তার ফলে যে আমাকে অতি সত্বর প্রখ্যাত সেই শৈল শহরটির বিখ্যাত সেই ফাটকের লৌহ শলাকার পিছনে যেস্থান নিতে হবে সে বিষয়ে আর আমার কোনও দ্বিমত নেই। 

যাইহোক সেই অবশ্যম্ভাবী মহাপ্রস্থানের আগে আমি একবার কমলাকান্তের সৃষ্টির সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত হয়ে নিতে চাই। কেননা আমার মনে হয় কমলাকান্তের পূনর্মূল্যায়ণ হওয়া খুব জরুরি। ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয় কমলাকান্তকে সঠিক ভাবে না বুঝতে পেরে বেশকিছু তরল মন্তব্য করে ফেলেছেন। 

নিরুদ্দেশ হবার প্রাক্কালে কমলাকান্ত যে দপ্তরটি ভীষ্মদেবকে দান করে গেছিল তার সঠিক রসাস্বাদন করবার ক্ষমতা ভীষ্মদেবের ছিল বলে আমার মনে হয়না। 


(২) 

কারণ সে ক্ষমতা যদি ভীষ্মদেবের থাকতো তবে তিনি কিছুতেই বলতে পারতেন না – 

“এ অমূল্য রত্ন লইইয়া আমি কি করিব? প্রথমে মনে করিলাম অগ্নিদেবকে উপহার দিই। পরে লোকহিতৈষিতা আমার আমার চিত্তে বড় প্রবল হইল। মনে করিলাম যে, যে লোকের উপকার না করে তাহার বৃথায় জন্ম। 

এই দপ্তরটিতে অনিদ্রার অত্যুৎকৃষ্ট ঔষধ আছে – যিনি পড়িবেন, তাঁহারই নিদ্রা আসিবে। যাঁহারা অনিদ্রারোগে পিড়ীত তাঁহাদিগের উপকারার্থে আমি কমলাকান্তের রচনাগুলি প্রচারে প্রবৃত্ত হইলাম।” 

কমলাকান্ত’র সৃষ্টি সম্পর্কে ভীষ্মদেব খোশনবীসের এই অত্যন্ত অম্লময় কটু মন্তব্য যে তাঁর অবিমৃষ্যকারিতাই পরিচয়, এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ হলে খোশনবীস মহাশয় এত সহজে পার পেয়ে যেতেন বলে আমার মনে হয়না। ভীষ্মদেব বাবু তাঁর নিজের শক্তিহীন দন্তকৌমুদীদ্বারা আখের রস আস্বাদনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে ইক্ষুদণ্ড যে বংশদণ্ডে পরিণত হয় না সেটা ভদ্রলোকের বোঝা উচিৎ ছিল। কাজেই আজকের দিনে ওনার ফেবুর দেয়াল যে কমলাকান্ত ভক্তদের অগিবাণে খাণ্ডব দহনে পরিণত হয়ে যেত সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 

যাইহোক, আমি খোশনবীস মহাশয়কে উপেক্ষা করে কমলাকান্ত’র দপ্তরটিকে নিয়ে রাতের আহারের পরে আমার লেখার টেবিলে এসে বসলাম। বলাবাহুল্য রাতের জোগাড়যন্ত্র সব পুর্ববৎ; যদি কমলাকান্ত’র দেখা মেলে এই আশায়। 

দপ্তরটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সন্দেহাতীত হলামযে দপ্তরটি একটি স্বর্ণখনি। বুঝতে পারলাম, দপ্তরটি খোসনবীস মহাশয়ের গলায় মুক্তোর মালার মতো শোভা পাচ্ছিল। 

দপ্তরটিতে বর্ণিত কমলাকান্ত’র রচনাগুলিকে মোটামুটি ভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় –মোট চতুর্দশ সংখ্যা সম্বলিত “কমলাকান্তের দপ্তর”, মোট পঞ্চম সংখ্যা সম্বলিত“কমলাকান্তের পত্র” এবং “কমলাকান্তের জোবানবন্দী” যেটা খোসনবীস জুনিয়র প্রণীত এবং তার সাথে একটি “পরিশিষ্ট” আছে যেটা “শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী প্রণীত”। 

দপ্তরের যতই গভীরে প্রবেশ করতে লাগলাম ততই যেন দার্শণিক কমলাকান্ত আমার সমস্ত সত্ত্বাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। অহো, বিষয়ের কি বর্ণময় বৈচিত্রতা আর তার কি অসাধারণ বিশ্লেষন যা কালের গণ্ডি অতিক্রম করে বর্তমান সময়েও ভীষণরকম ভাবে সত্য। তার পলিটিকস, পতঙ্গ, বসন্তের কোকিল, বাঙ্গালীর মনুষ্যত্ব ইত্যাদি রচনাগুলি এককথায় অনবদ্য। 

খোশনবীস মহাশয় কমলাকান্তকে যতই অর্দ্ধোন্মাদ নেশাখোর রূপে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করুন না কেন, কমলাকান্ত সোজাসুজি সজ্ঞানে যে সকল কথা কখনও শর্করাযুক্ত ব্যঙ্গের সাহায্যে আবার কখনও বা ভাষার মাধুর্যে সরস রসিকতার মাধ্যমে পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে যেভাবে সমাজের খামতিগুলো দেখিয়ে দিয়েছে তার তুলনা মেলা ভার। 

শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত মহাশয়ের মতে -“কমলাকান্ত একাধারে কবি, দার্শনিক, সমাজশিক্ষক, রাজনীতিজ্ঞ ও স্বদেশপ্রেমিক; অথচ কবির অভিমান, দার্শণিকের আড়ম্বর, সমাজশিক্ষকের অরসজ্ঞতা, রাজনৈতিকের কল্পনাহীনতা, স্বদেশপ্রেমিকের গোঁড়ামি নাই। হাসির সঙ্গে করুণের, অদ্ভুতের সঙ্গে সত্যের, তরলতার সহিত মর্মদাহিনী জ্বালার, নেশার সঙ্গে তত্ত্ববোধের, ভাবুকতার সহিত বস্তুতন্ত্রতার, শ্লেষের সহিত উদারতার এমন মনোমোহন সমন্বয় কে কবে দেখিয়াছে?” 


(৩) 

ভীষ্মদেববাবু, আপনি যাই লিখে থাকুন কেন, এটাই কিন্তু কমলাকান্তের সঠিক মূল্যায়ন। 

নেশাগ্রস্তের ন্যায় দপ্তরটি পড়ার ঝোঁকে সহসা তেষ্টা অনুভব করলাম। চোখ তুলে আমার পাণীয় পূর্ণ গেলাসের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখি কমলাকান্ত’র জন্য বরাদ্দ পুর্ণকুম্ভটি অর্ধকুম্ভরূপে বিরাজমান। কাঁসার ঘটিটির ঢাকাটি পাশে রাখা আছে।

অত্যন্ত অবাক হয়ে পাশে রাখা দাদামশায়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখি তার ওপর স্বয়ং কমলাকান্ত সুখাসনে বিরাজমান। মুখে তার সেই বিখ্যাত রহস্যময় হাসির রেখা যা দেখলে আমি নিশ্চিত যে স্বয়ং দ্য-ভিঞ্চি সাহেব একটি পুরুষ মোনালিসা সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হতেন। 

আর তাহলে আজ প্যারিস শহরের ল্যুভের যাদুঘরে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত সৃষ্টি মোনালিসা’র পাশে আমাদের কমলাকান্ত’র ছবিও ল্যুভের যাদুঘরের মর্যাদা আরও সহস্রগুণ বাড়িয়ে তুলতো। 

যাইহোক, কমলাকান্তকে দেখে আমি যারপরনাই আনন্দিত এবং উত্তেজিত হয়ে তাকে কিছু বলতে যাবার চেষ্টা করতে যেতেই সে অভয়মুদ্রার সাহায্যে আমাকে সেই কার্য থেকে বিরত করল। 

আমি ঢোঁক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে নিশ্চুপ থাকলাম। বলা যায়না, তার আদেশ অমান্য করলে যদি আবার হিতে বিপরীত হয়ে যায়! 

আমি মুখে কোনও কথা না বলে তার পরবর্তী কার্যক্রম দেখতে লাগলাম। একটি আফিমের গুলি সে তার রূপোর ডিবে থেকে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে নিয়ে, গুঁড়ো দুধের নীলবর্ণ প্যাকেটটা ফট করে তার হাঁ-করা মুখের ওপর ছিঁড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে অর্ধকুম্ভের জল তার প্রসারিত মুখে নিঃশেষিত করে পরম আয়েশে কুলকুচো করে গিলে ফেলে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সে ঝিম মেরে বসে থাকল। 

তারপর একসময় চোখ খুলে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকল। 

“লেখক, বহুদিন তোমার কোনওপ্রকার সংবাদ লইনাই। স্থির করিলাম আজি রাত্রিতে তোমার দর্শণ করিব। এইস্থলে আসিয়া দেখিলাম তুমি আমার দপ্তরটি খুলিয়া স্থির চিত্রের ন্যায় বসিয়া আছ। আমি এই কারণেই তোমার তপস্বী ভাবে বিধ্ন ঘটাই নাই।” কমলাকান্ত আমায় তার নিঃশব্দ উপস্থিতির কারণ জানায়। 

“তোমার দপ্তরটি পড়তে পড়তে একেবারে বুঁদ গেছিলাম। তা সেটা হঠাৎ করে বন্ধ করলে কেন?” আমি কমলাকান্ত’র কাছে জানতে আগ্রহী হই। 

আমার কথা শুনে কমলাকান্ত কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। আবার সেই অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ ঘর জুড়ে বিরাজ করে। টেবিল ল্যাম্পের নরম আলো তার চোখে সজল একটা ভাব এনেছে মনে হলো। মাঝরাতে আমার রাত জাগা চোখে ভুল দেখছি কিনা সেটা বুঝে উঠবার আগেই দেখলাম কমলাকান্ত ধুতির কোঁচা দিয়ে তার মুখমণ্ডলের পরিচর্যা করে নিল। 

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কমলাকান্ত বলে ওঠে,“একদা হঠাৎ-ই লিখিবার ইচ্ছা ত্যাগ করিয়াছিলাম। ‘কমলাকান্তের বিদায়’ ছিল ‘কমলাকান্তের পত্র’-এর সর্বশেষ পঞ্চমসংখ্যা। সম্পাদক মহাশয়কে বলিয়াছিলাম যে কমলাকান্তের আর সে রস নাই। বলিয়াছিলাম কমলাকান্ত অন্তরের অন্তরে সন্ন্যাসী – তাহার এত বন্ধন কেন?” 

“তাই বলে এরকম ভাবে লেখা বন্ধ করে দেওয়া যায় নাকি?” আমি জোর করে চেপে ধরি,“তোমার লেখার যাঁরা নিয়মিত পাঠক ছিলেন, যাঁদের কাছে তোমার লেখার একটা মর্যাদা ছিল, তাঁদের কাছে তো তোমার একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায় নাকি?”


(৪) 

নিমরাজি হয়েও কমলাকান্ত বলে, “আসলে আমি নিরুদ্দেশ যাত্রা সম্পূর্ণ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া যখন দেখিলাম খোশনবীস মহাশয় আমার দপ্তরটি বঙ্গদর্শণ সম্পাদক মহাশয়কে বিক্রয় করিয়া শুধু দু-পয়সা কামাইয়াই লন নাই তৎসহিত কিছু নামও কামাইয়াছেন আমার বদনাম করিয়া তখন আমি সপ্তম রিপু বিষাদ দ্বারা ভীষণ ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হই। এই অবস্থাটি আমায় বড়ই ব্যথাতুর করিয়া তোলে। বলিতে পার তখন আমার শ্রীমদভাগবদ গীতায় বর্ণিত “অর্জুন বিষাদযোগ” অবস্থা। কিন্তু আমার তো কোন শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন না তাই আমি নিজেই নিজেকে বিষাদের কৃষ্ণগহ্বর হইতে উদ্ধার করিতে সচেষ্ট হইলাম। পরে অবশ্য ভাবিয়া দেখিলাম ইহাই বেশ হইয়াছে। আমার তো এখন সেই নসীবাবু নাই – অহিফেনের অনাটন – সে প্রসন্ন কোথায় জানি না – তাহার মঙ্গলা কোথায় জানি না। সত্য বটে, আমি তখনও একা – এখনও একা – কিন্তু তখন আমি একায় এক সহস্র – এখন আমি একায় আধখানা। কিন্তু একার এত বন্ধন কেন? কাজেই দপ্তর লেখার কর্মকাণ্ড বিসর্জন দেওয়াই শ্রেয় বলিয়া বোধ হইল। তোমরা লেখকেরা যাহাকে রাইটার্স ব্লক বলিয়া থাক, আমি মানসিক দিক হইতে সেই বাধারই সম্মুখীন হইলাম বলিতে পার।” 

আমি থাকতে না পেরে বললাম, “তুমি দেখছি একেবারেই শিশুসুলভ মনোবৃত্তির অধিকারি। চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেতে শুরু করে দিলে?” 

“দেখ লেখক, আমি দার পরিগ্রহ করি নাই। সংসারে বাঁধা পড়িতে চাহি নাই। আমি আপনার মর্জি মতো জীবন ধারণ করিতে চাহিয়াছি, তবে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করি নাই। আমি আপন বুদ্ধি দ্বারা সমাজ, জীবন, প্রকৃতিকে যেরূপ প্রত্যক্ষ করিয়াছি এবং যাহা উপলবদ্ধি করিয়াছি তাহার দ্বারাই আমি আমার দপ্তর সৃষ্টি করিয়াছি। ইহাতে কোনওরূপ তঞ্চকতা নাই। আমি সম্পূর্ণ নিজজ্ঞানে জীবন হইতে যে রং-রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দের সন্ধান পাইয়াছি তাহার দ্বারাই আমি আমার লেখনীকে সচল রাখিয়াছি। অপরের জীবন অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করি নাই। বিদেশী ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয় যে ইহা একেবারেই আমার firsthand experience.” 

আমি কমলাকান্তকে বাধা দিলাম না। তার সঙ্গে আমার আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু যখন সে নিজে তখন তার মনের জানালা-দরজাগুলো খোলা থাকা খুবই জরুরি। অতএব আমাকে আজ তার কাছে এক ঐকান্তিক শ্রোতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারলেই আজ কমলাকান্তের হৃদয় স্পর্শ করা সম্ভব হবে। আমি সেই চেষ্টাতেই ব্রতী হলাম। 

আর তার ফলে কমলাকান্ত আমাকে তার একজন নিষ্ঠাবান শ্রোতা পেয়ে নিজের বক্তব্য জারি রাখে। 

“জীবনের চরৈবতিতে যখন কোনও প্রকার বন্ধনেই বাঁধা পড়ি নাই তখন এই ক্ষুদ্র দপ্তর লইয়া এত চিন্তিত হইব কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিতে গিয়া দেখিলাম আমি আমার অজান্তেই কখন যেন আমার দপ্তরের সহিত এক অদৃশ্য বন্ধনে নিজেকে জড়াইয়া ফেলিয়াছি। এবং এই বন্ধনই যেন আমায় অক্টোপাসের ন্যায় আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়াইয়া ধরিতে চলিতেছে। কিন্তু আমি তো চিরকাল জীবনের সর্বপ্রকার অষ্টপাস হইতেই মুক্ত হইতে চাহিয়াছি। তাহা হইলে আর এই ক্ষুদ্র দপ্তরের বন্ধনে ধরা পড়িব কেন? কেন খোশনবীস মহাশয়ের কথা ভাবিয়া আমার মন নিম্নগামী হইবে? এতদিনকার পরিশ্রম লব্ধ আমার সকল অনুশাসন কি আমার দপ্তরের পরিচিতি প্রাপ্তির আশায় বালির বাঁধের ন্যায় ধ্বসিয়া পড়িবে আর আমি তাহা অর্বাচীনের ন্যায় প্রত্যক্ষ করিতে থাকিব? না, ইহা কখনই ঘটিতে দেওয়া 


(৫) 

যাইতে পারে না। অতএব আমি দপ্তরটির উপর হইতে আমার সমস্ত স্বত্ত্বসকল তৎকাল ত্যাগ করিয়া 

দিলাম। অহো, কি প্রশান্তি যে পাইলাম, লেখক, তাহা আমি তোমাকে সঠিক বুঝাইয়া বলিতে পারিব না।” 

বহুক্ষণ হয়ে গেছে আমার মুখে কোন কথা নেই। তবে আমার মন বলছে কি অসাধারণ সমসাময়িক জ্ঞানের ভাণ্ডারি এই মুক্তজীবরুপী ব্রাহ্মণ! ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে চার প্রকার সংসারী জীবের কথা বলে গিয়েছেন সেই সুপ্ত, বদ্ধ, নিত্য এবং মুক্তজীবগনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব আজ আমি প্রত্যক্ষ করলাম। অসূয়ারহিত, পরশ্রীকাতরতাহীন এই সদালাপী নির্লোভ দার্শনিক ব্রাহ্মণ প্রকৃত অর্থেই মুক্তজীবই বটে। ভীষ্মদেব খোশনবীস মহাশয়ের ওপর নিজের মনের নিম্নগামী গতিরোধ করবার জন্য কমলাকান্ত সকলের চোখের আড়ালে যেন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল; প্রথমত তার দপ্তরের ওপর থেকে শুধুমাত্র সমস্ত স্বত্ত্ব ত্যাগ করেই বসে থাকে নি, সেইসঙ্গে নিজের সৃষ্টির সাথে যে বন্ধনে জড়িয়ে পড়ছিল তার মূলে কুঠারাঘাত করার জন্য নিজস্ব সৃষ্টির আনন্দ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল পুনর্বার আর লেখনী ধারন না করে। 

বাঃ, কমলাকান্ত বাঃ কি অসাধারণ মানসিক স্থিতি তোমার...সত্যি, you really deserve a standing ovation with thousand gun salutes!

0 comments:

1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রবন্ধ


ফকিরাণি কথা—৩
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


মানুষের কার কখন কি মনে হয়,কে জানে! যে মুসলিম বন্ধুটি (আমি বন্ধুই বলব, যদিও তখনও তাঁর সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না, তবু তিনিই আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিলেন এই জগত সম্বন্ধে জানার ব্যাপারে। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।) সেদিন আমার বাড়ি থেকে উঠে চলে গিয়েছিলেন পরে আবার কোনদিন আসবেন বলে, তিনি যে সত্যিই দুদিন পর আমার বাড়ি আসবেন, আমি ভাবিনি। যদিও তাঁর কিছু নিজের কাজ ছিল, তবু আমার কৌতূহল তো মিটেছিল। এ তো কম কথা নয়!

সেদিন আর ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করিনি তাঁর নাম আমি আমার লেখায় উল্লেখ করতে পারব কি না, কিন্তু কি আশ্চর্য্য, তিনি নিজেই বললেন কথায় কথায় -আপনি সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করছিলেন, মুসলমান মেয়েরা ফকিরি নিয়ে ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারে কিনা, তাই তো? ঘাড় নাড়লাম।

ভদ্রলোক একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তারপর বললেন—দেখুন, একটু খারাপ ভাষাতেই বলছি, কিছু মনে করবেন না...আপনি মহিলা তো, তাই আর কি! কিন্তু খুব রাগ হয়, জানেন...আচ্ছা বলুন তো... ঈশ্বর বলুন আর আল্লাহ্‌ই বলুন, তিনি কি কারো বাপের সম্পত্তি! তিনি কি কারো কাছে বাঁধা আছেন নাকি, যে বাঁধা লোকের কাছে ছাড়া আর কারো কাছে যাবেন না। তিনি কাকে কখন দয়া করবেন, কার ঊপর তাঁর দয়া হবে, একি কেউ বলতে পারে, আপনিই বলুন না, কেউ বলতে পারে? সে যদি কেউ বলতে না পারে,তাহলে কে তাকে পূজবে, কে তাকে ভজবে,এই নিয়ে কথা বলার কোন দরকার আছে? বলুন আপনি...আজ যদি আমার উপর তিনি দয়া করেন, আমি তাঁর কাছে যেতে চাইব না? তাঁর দয়া আমি নেব না? আপনাকে দয়া করলে আপনি তাঁর দয়া চাইবেন না...হয় নাকি এমন যে তিনি দয়া করেছেন, আর কেউ না বললে সে দয়া কেউ নেবে না? কি অন্যায় কথা বলুন তো!

একনাগাড়ে বেশ রাগ রাগ স্বরে কথাগুলো বলে থামলেন। বললাম—দাদা, চা খাবেন? -হাসলেন, হেসে মাথা নেড়ে আবার বললেন -সেদিন ঘরে গিয়ে খুব ভেবেছি, জানেন! তাই আজ চলে এলাম। কই,বলুন ...কি জানতে চান আপনি। আর হ্যাঁ, আমার নাম কবীর চৌধুরী। আপনি বলতে চাইলে বলবেন আমার নাম করে - ঈশ্বর যদি দয়া করেন, সব মানুষের তাঁর দয়া চাইবার অধিকার আছে, সক্কলের। আমি তাঁর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চা আনতে গেলাম।

চা খেতে খেতে আবার বললেন—একজন পুরুষের যদি মারফতি জীবন যাপন করবার অধিকার থাকে, একজন নারীর কেন থাকবে না বলুন তো? ঈশ্বরের দয়া কার উপর হবে কে জানে! তিনি নারী না পুরুষ, আমরা কি হাত গুণে বলতে পারি? আর মারফতি জীবন যিনি যাপন করছেন সেই নারীকে এবার আপনি ফকিরি নারী বলুন, পীর আম্মা বলুন আর ফকিরাণিই বলুন, মূলে তো এক...

এবার আর চট করে মুখের উপর বলে উঠতে পারলাম না, কিন্তু ইসলামে যে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই। যিনি এমন সহজ সরল ভাবে সকলের জন্য ঈশ্বরের কৃপার কথা বলেছেন, তাঁকে আর কিই বা বলা যায়!

একটু একথা-সে কথার পর আবার জিজ্ঞেস করলাম---কিন্তু দাদা, তবে যে বলে—ইসলামে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই। গৃহধর্ম পালন না করে কিছু হয় না। একথা সত্যি?

চা শেষ হলো। সঙ্গে সামান্যটা ছিল, তাও প্রায় শেষের মুখে। চামচ দিয়ে সেটুকু মুখের মধ্যে চালান করে বললেন---দেখুন, ইসলামের দুটো দিক আছে। একটা হলো তার বাহ্যিক আচার-আচরণের দিক,যাকে বলে জাহেরী। আর একটা দিক হল অন্তরের দিক, যাকে বলে বাতেনি। যারা খুব অন্তর্মুখী মানুষ,অনেকসময়ই বাইরের আচার–আচরণ মানেন না, পরোয়াও করেন না কে কি বলল। অনেকসময় তাঁর নিজের অন্তরের যে পরিবর্তন তাও কাউকে বুঝতে দিতে চান না। কিন্তু এই অন্তরের টান বা বোধ যখন খুব বেশী হয়, সংসার ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে চলে যান, একেবারে মারফতি জীবন যাপন করেন। এটাই হলো প্রকৃত মারফতি জীবন, যাকে বলছেন ফকিরি। এরাই আসল ফকিরি জীবন যাপন করেন। এদের মধ্যে কেউ যদি মুরশিদের দেখা পান, তাহলে একেবারে সাধনের রাস্তায় চলে যান।

আবার প্রশ্ন -কিন্তু সে তো ছেলেরা, মেয়েরাও? কিন্তু ইসলামে যে মুরশিদ স্বীকার করেন না। অনেকেই বলেছেন, দাদা...মুরশিদ বলে কিছু হয় না।

এবার রেগে গেলেন -কে বলেছে আপনাকে? মুরশিদ ছাড়া সাধন হয় নাকি? শুনুন, যা হয়...তাকে অন্যের কাছে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কি লাভ? যারা বলেন, তারা সত্যকে স্বীকার করেন না।

-তাহলে পুরুষদের মতো নারীরাও মুরশিদের কাছে শিক্ষা লাভ করতে পারেন?

-পারেন। এর আবার ছেলে মেয়ের কি আছে? আপনি রাবিয়ার নাম শুনেছেন? ঘাড় নাড়ি। এবার একটু জোরে।

-তবে তো জানেন।

-কিন্তু তিনি তো সুফী

-সুফী তো কি? তিনি কি ইসলাম ধর্মের নন? আচ্ছা, আপনি একজন ইসলামের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে আসুন তো, তিনি যদি ঈশ্বরের দয়া লাভ করেন, তিনি চাইবেন কিনা! কেন যে এসব মিথ্যা কথার বোঝা চাপানো হয়...! এইজন্যই এত ভুল, এত সংষ্কার...’ তিনি বিরক্ত হলেন। আমি কিন্তু বাঁচলাম। 

সেই কবে থেকে এই কথাটা শুনব বলেই তো এত ছোটাছুটি, এত পরিশ্রম...এত জনে জনে জিজ্ঞাসা,এত জনে জনের কাছে বিরক্তি আর উষ্মা সহ্য করা। হেসে বললাম -দাদা, মনটা শান্ত হলো। কতজনকে যে জিজ্ঞেস করেছি, এই কথাটি কেউ স্বীকার করছেন না...কিছুতেই তাঁদের বোঝাতে পারছিলাম না। কিন্তু দাদা, আমার যে আরো প্রশ্ন আছে! কথাটি বলতেই হাতঘড়ি দেখে উঠে পড়লেন -ওরে বাবা, আজ আর নয়। কই, প্রফেসর সাহেব গেলেন কোথায়? আমি তাঁর সঙ্গে একবার বেরোব।

সেদিন বাড়ির কর্তার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু পরে একদিন আবার তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেকথা আবার অন্যদিন।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - নিলয় কুমার সরকার

Posted in

প্রবন্ধ


মুসাহারদের জীবনকথা
নিলয় কুমার সরকার


বিহারের মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার সমভূমি! স্থান গাজী কারমেইনির নেচুয়া জালালপুর! প্রাক চৈত্রের বাতাস যেন এখনি পাথর গলায় তার তীব্র দাবদাহে! এই তীব্র দহনে তখনও কৃষি ক্ষেত জুড়ে কাজ করে চলেছে

একটা ভূমিদাস সম্প্রদায়! স্থানীয় জনজীবনে যাদের পরিচয় 'মুসাহার' কাজ করছে শুধু পুরুষ নয় গােটা কয়েকটা পরিবার! শুধু তাই নয় সঙ্গে রয়েছে নাবালক শিশুপুত্র, কন্যা পর্যন্ত! জমি, মাটি, কৃষি, সেচ, ফসল তােলা, শস্য বপন, সবই তাদের কান্না ঘাম রক্ত আর শ্রমের উপহার! সবই তাদের কিন্তু কিছুই তাদের নয়! ওরা

ভূমিহীন শ্রমজীবি ওরা 'মুসাহার'-যাদের স্থানীয় পরিচয় দলিত।

এই জনগােষ্ঠীর উৎস সন্ধানে অনুসন্ধিৎসু হয়ে দেখলাম প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ননী মাধব চৌধুরী তাঁর "ভারতবর্ষের অধিবাসীর পরিচয়"-গ্রন্থে লিখেছেন ঝারখণ্ড অঞ্চলের মুন্ডা-ওরাও ট্রাইব সম্প্রদায় কতকগুলি। উপগােষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে! এরাই স্থানভেদে কোথাও ধাঙ্গর কোথাও মুসাহার নামে পরিচিত! অনান্য সূত্রে জানলাম মুসাহাররা হিন্দু ধর্মাবলম্বী! এদের দেখা যায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, নেপাল, হিমালয়ের তড়াই, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানের কৃষি শ্রমিক হিসাবে! এরা আত্ম পরিচয়ে জানায়, তারাই আর্য, এবং তারাই ভারতের আদিম বনবাসী! বিহারে এদের পরিচয় রাজওয়াড় নামে, আবার মালভূমি অঞ্চলে এদের পরিচয়- 'মাঝি'! আদি সূত্রে এদের পেশা ইঁদুর ধরা! এদের বংশানুক্রমিক লােককাহিনী থেকে দেখি -"সৃষ্টির আদি দেবতা পরমেশ্বর মানুষ কে সৃষ্টি করলেন ও একটি ঘােড়া উপহার দিলেন, এই পৃথিবীটাকে ঘুরে ঘুরে নিজের মত করে প্রত্যক্ষ করার জন্য! কিন্তু আদিপিতা প্রথম মুসাহার ঘােড়ার পেটে একটা গর্ত করলেন, তার পিঠে ওঠার জন্য! আর এই কারণে দেবতা পরমেশ্বর রুষ্ট হলেন ও শাস্তি দিলেন ইঁদুর ধরার পেশাদার জাতি হিসেবে!

বর্তমানে এই শ্রমজীবী সম্প্রদায়কে দেখতে পাওয়া যায় পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উত্তর মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলে! বর্তমানে এরা প্রধানতঃ ভােজপুরী ভাষাতেই কথা বলে! ভােজপুরী ভাষায় 'মুষ' মানে ইঁদুর বস্তুতঃ যে শব্দটা এসেছে সংস্কৃত 'মুষিক শব্দ থেকে! আর মুসাহার মানে হলাে যারা আদিম প্রথায় ইদুর ধরে খায়। (মুষ+আহার)! এরা আদিতে ট্রাইব গােষ্ঠি ভুক্ত হলেও বিহারে এরা আত্মপরিচয়ে জানায় তারা রাজওয়া বা রাজবংশী হিসেবে! যার ইঙ্গিত হল তারাই আদি ক্ষত্রিয়! এই দাবি অবশ্য উচ্চবর্ণ হিন্দু ক্ষত্রিয় গােষ্ঠী স্বীকার করেন না! তারা বলেন ওরা অচ্ছুত ওরা দলিত! বর্তমানে মুসাহার জনগােষ্ঠি আরও তিনটি উপগােষ্ঠিতে বিভাজিত! বর্তমানে তাদের বলা হয় ভগৎ, সাকতিয়া, এবং তুর্কাহিয়া! বর্তমানে মুসাহাররা ইঁদুর ধরা ও খাওয়ার অনুষঙ্গে অভ্যস্ত নয়!

বর্তমানে এরা পেশায় ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক মাত্র, শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের ক্ষীণ জনগােষ্ঠীর একটি সীমারেখায় সীমিত! আত্মপরিচয়ে এরা যদিও হিন্দু তবুও এরা প্রায় সমস্থ উপজাতি কুলদেবতাকে মানে ও পুজো দেয়! বিহারের কোথাও কোথাও এদের গভীর খনিতে দুর্মূল্য পাথর সংগ্রহের কাজে লাগিয়েছে ভারত সরকার! যেমন গােমেদ ও এমিথিস পাথর সংগ্রহের কাজের এরা দক্ষ কারিগর! সরকারি বদান্যতায় কিছু জনের পারিশ্রমিক ও ভালাে! এই জনগােষ্ঠির শিক্ষার হার সাকুল্যে ৩% এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে যা আরও ১%কম! পরিবেশ গত কারণে এই জনগােষ্ঠির অপুষ্টি, কৈশাের মাতৃত্ব, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, প্রভৃতি সমস্যার হতভাগ্য শিকার হয়ে ক্ষয়িষ্ণু! প্রায় প্রতিবছরই এই জনগােষ্ঠীতে কিছু না কিছু ক্ষয়ক্ষতির ছাপ রেখে যায়! লােকায়ত প্রথায় হঁদুর খাওয়া ছাড়াও খুব উন্নত মানের দেশি মদ তৈরির কৌশল এরা জানে! শুধু তাই নয় এদের সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই পানাসক্ত!

দানাপুরের ৪৫-বছর বয়সী প্রতিভা দেবীর কথা ভাবা যাক, একটা ভাঙ্গা কুড়ের সামনে বসে আনমনে ধুমপান করছিলেন! তিনি যেন আজও উদাস হয়েই অপেক্ষা করছেন, একমুঠো সামাজিক ন্যায় বিচারের! তথা মানবিক অবমূল্যায়নের প্রকৃত প্রতিকারের! হঠাত্ কোথা থেকে বৃষ্টি এলাে, তার একমাত্র সম্বল রাতের। কম্বলখানা বাঁচাবার তাগিদে দৌড়লেন! এই হল মুসাহার সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার দৈনন্দিন চিত্র! এই হল। বিহারের' গরিবী রাজ'-এর প্রান্তিক প্রজাদের ইতিকথা! ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈষম্য, দৈন্যতা, সাম্য ন্যায়, সামাজিক ন্যায় বিচার যেখানে সুদূরের স্বপ্ন! যদিও এই সম্প্রদায়ের মানুষ বিহার ঝাড়খণ্ডের ক্ষণস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী ও হয়েছেন তবুও স্বাধীনতার পর এতগুলাে বছর পার করে আসার পর ও সমাজ ইতিহাসে যারা আজও অচ্ছুত বলেই চিহুিত! আজও তারা মানবিক অধিকারে বৈষম্যের বলি প্রদত্ত একটি সম্প্রদায়!

বিহারের বিভিন্ন স্থানে মুসাহার সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে পরিচয় বহন করে উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গা, এবং মধুবনি অঞ্চলে এদের বলাহয় 'সদা' বা সদয়! মধ্য বিহারে যেমন পাটনা, নালন্দা, ও রােহতাস অঞ্চলে এদের বলা হয় 'মুসাহার' 'মন্ডল' বা 'মাঝি'! গয়া, বুদ্ধগয়া ইত্যাদি দক্ষিণ বিহারে এদের পরিচয় 'ভূঁইয়া' অথবা 'ভােক্তাস'! সম্ভবত প্রাকস্বাধীনতা যুগে ঝাড়খণ্ডের 'গুমলা' অঞ্চল থেকে উত্তর রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দাস হিসেবে পাঠানাে হয়েছিল (report :-Ramaghundam 2001)! জনগণনায় ১৯৫১ সালের পর থেকে এখানে তাদের সিডিউল কাস্ট হিসেবে দেখানাে হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে যে এরা সারাদিন ১৮ ঘন্টা কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকার বিনিময়ে পায় ৩-৪ কেজি দানাশস্য পারিশ্রমিক হিসেবে! এটাই তাদের সম্প্রদায়ের দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অপুষ্টি, ও অনাহারের একমাত্র কারণ! সমীক্ষায় (২০০২ সালের) দেখা গেছে যে ২২ জন মুসাহার শুধু চম্পারণ জেলায় না খেতে পেয়ে মারা যায়! জেলা শাসক উচ্চবর্ণের হওয়ায় তাকে সরকারি ভাবে নথিভুক্তই করতে দেয়া হয়নি! ঐ সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দেশ বিদেশের নানান NGO গুলি সাহায্যের সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হলেও, সরকারী ভাবে কোনাে রিলিফ পাওয়ার সুযােগই ঘটেনি।

বিহার সময়ের দর্পণের একটা রাজ্য নীরব সাক্ষী হয়ে থাকলাে অনেক বঞ্চনা অনেক অপমানের! ১৯৯৩ ২০০৩/২০১৩-২০১৮ র নির্ধারিত সময়কালে এই দলিত সম্প্রদায় ৪২৪৩-টা ও ৫০১৬-টা অভিযােগ নথিভুক্ত করতে পেরেছেন! বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিবিধ থানায়! সমস্ত অভিযােগই গিয়ে দাঁড়ায় উচ্চবর্ণের সমাজপ্রভুদের অবিচার ও শােষণের বিরুদ্ধে! যে সময়কালে ৬৯৪ জন ও পরবর্তী পর্বে ৩৩৩ জন মুসাহার কে হত্যা করা হয়েছে! অন্যদিকে প্রথম পর্বে ২০৪৯ জন ও পরবর্তী পর্বে ৩৬৬৭ জন মুসাহার নারী ধর্ষিত হয়েছেন কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের লালসার শিকার হিসেবে! এছাড়াও প্রায় ২৭৮৯ জন নাবালক ও নাবালিকা নিয়ত যৌন-লাঞ্ছনার শিকার! নৈরাশ্য, ক্ষুধা, বস্ত্রহীন জীবন, যে অবিচারের দৃশ্য নিয়ত বর্ণনা করে! হয়ত স্মরণে থাকবে ২৩শে মার্চ ১৯৯৭ দেশের সমস্থ সংবাদ পত্রের শিরােনাম হয়ে ছিল :-"রণবীর সেনার হাতে নিহত ১০ মুসাহার"! এই রণবীর সেনা হলাে উচ্চবর্ণের ঘরােয়া সশস্ত্র সেনা বাহিনী! যারা নিয়মিত বেতন ভােগী! সূর্যমনি দেবী, রামুনা দেবী, বাচ্চিদেবী, মানাে দেবী, শান্তি দেবী-রা হলেন সেই সব হতভাগ্যদের বিধবা স্ত্রী! যাদের দুচোখের জল আজও খুঁজে বেড়ায় সরকারিভাবে একটা প্রত্যয়, একটা সুষ্ঠ বিচার!

কথা ছিল প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের একএক জন-কে কোথায় যেন একটা সরকারী চাকরি দেয়া হবে!!

কান্না হাহাকার হয়ে ফেরে, সময়ের হাওয়ায় হাওয়ায়! শূন্যতা মেটেনা!

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড-৫ 
শিবাংশু দে
 

বিংশ শতকের শুরুতে সম্ভ্রান্ত বাঙালির অন্দরমহলে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে একটা অন্য ধরনের সামাজিক মন্থনও শুরু হয়েছিলো। অমলা দাশ ছিলেন বিখ্যাত দুর্গামোহন দাশের ভাই ভুবনমোহন দাশের কন্যা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভগ্নী। এছাড়া তিনি ছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর ঘনিষ্ট সহেলি। অমলা ও মৃণালিনীর অন্তহীন মেয়েকথার ধারাস্রোত কবিকে প্রেরিত করেছিলো একটি গান রচনা করতে, ''ওলো সই, ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই''। ইতোপূর্বে ঠাকুরবাড়ির দুই মেয়ে প্রতিভা ও ইন্দিরা চৌধুরীবাড়ির বৌ হয়ে এসে 'সঙ্গীত সঙ্ঘ' নামে একটা গানের ইশকুল খুলেছিলেন। 'ভদ্র'ঘরের মেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিলো সেখানে। কিন্তু তখনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের প্রকাশ্যে গায়ন ছিলো অকল্পনীয় কৃত্য। সেই পরিবেশে অমলা প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাঁর সাঙ্গীতিক পারদর্শিতা ছিলো অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় কোন গান রচনা করলে সেটি তৎক্ষণাৎ অমলাকে শিখিয়ে দিতেন। বস্তুতঃ দিনু ঠাকুরের আগে অমলাই রবীন্দ্রনাথের গান লিখে রাখার কাজটি করতেন। তাঁর বোনঝি সাহানা দেবী এবং হেমেন্দ্রমোহন বসুর কন্যা মালতী বসুর (ঘোষাল) প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা অমলা'র কাছেই হয়েছিলো। 


এই তিন কন্যা ও অমিয়া রায় (ঠাকুর) এবং কনক দাশ (বিশ্বাস) ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের একটি নতুন মানচিত্র প্রস্তুত করে দেন। এঁদের গান নিয়ে এ পর্যন্ত বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সঙ্গীত পরিবেশনের কোন জাদু এতোদিন পরেও শ্রোতাদের মজিয়ে রাখে, সেই সূত্রটি খুঁজতে তাঁদের তৎকালীন রেকর্ডগুলি একটু অভিনিবেশ সহকারে শোনা প্রয়োজন. এঁদের পাঁচ জনের মধ্যে সাধারণ সূত্র যে'টি রয়েছে তা' হলো, এঁরা প্রত্যেকেই ব্রাহ্মসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং জীবনের কোন না কোন পর্বে কবির থেকে সরাসরি গান শুনেছেন ও শিক্ষা নিয়েছেন। 'শিক্ষা' বলতে আমি সুরটি তুলে নেওয়া বোঝাচ্ছি না। তাঁরা যে শিক্ষাটি পেয়েছেন তা হলো 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ঠিক কীভাবে গাওয়া উচিৎ। এঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সুকণ্ঠী, নিখুঁত সুরেলা এবং ওজনদার স্বর। সেই সময়ের তালিম অনুযায়ী তাঁদের ছিলো মীড়প্রধান গায়কি এবং নানা সূক্ষ্ম অলঙ্করণ অবলীলায় কণ্ঠে ধারণ করতে পারতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে অকারণ গলা ঘোরানোর মোহ থেকে মুক্ত ছিলেন। কণ্ঠের ওজস ছিলো মুক্ত ও সতেজ। অর্থাৎ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক এবং সব থেকে জরুরি যে শর্তটি রয়েছে, সংযম ও পরিমিতিবোধ, সেই শিক্ষাটি তাঁরা সযত্নে আত্তীকৃত করেছিলেন। সেকালের অদক্ষ রেকর্ডিং যন্ত্রের ত্রুটি ছাপিয়ে তাঁদের এই পরিবেশন ক্ষমতা এখনও বিস্ময়কর লাগে। যন্ত্রানুষঙ্গ হিসেবে স্রেফ হারমোনিয়াম বা অর্গ্যান, কনক দাশের সঙ্গে লয় ধরে রাখতে গিটারে অনুচ্চ স্ট্রোক ব্যবহৃত হয়েছে। কখনও সামান্য বাঁশির ছোঁয়া। কোনও তালবাদ্য ব্যবহার হয়নি। সাহানা দেবী একবার বলেছিলেন কবি নিজে কখনও তালবাদ্যের সঙ্গে গীত পরিবেশন করেননি, যদিও স্বরলিপির সঙ্গে তালের উল্লেখ সতত রয়েছে। শান্তিদেব সাহানা দেবীর এই মতটির বিরোধিতা করেছিলেন। সম্প্রতিকালে এক প্রিয় শিল্পী প্রয়াতা রমা মন্ডল কোন রকম যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যতিরেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সেটি শুনলে আবার প্রমাণ হয় কোন স্তরের আত্মবিশ্বাস থাকলে আশি-নব্বই বছর আগে পঞ্চকন্যা এই ধরনের ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন। কণ্ঠসম্পদ ব্যতীত তাঁদের সফলতার সম্বল ছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক নতুন শিল্পমাধ্যমটি থেকে আনন্দ সন্ধানের নিরন্তর প্রয়াস। আমার ধারণায় এই উপলব্ধিটিই পরবর্তীকালের সফল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের প্রধান অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। 


সেই ধ্বনিতে চিত্তবীণায়.. 

এই শিল্পীদের পরিবেশন পদ্ধতিটিকে আদত জোড়াসাঁকো শিক্ষণের রূপ হিসেবে ধরা যেতে পারে। অমলা দাশ বিংশ শতাব্দীর প্রথম-দ্বিতীয় দশকে যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং যে রেকর্ডগুলি করেছিলেন, তার থেকে এই শৈলীটি সম্বন্ধে একটি ধারণা তৈরি করা যায়। তাঁর গাওয়া, 'অয়ি ভুবনমনমোহিনী', ' কে বসিলে আজি' বা ' ঐ রে তরী দিলো খুলে' অথবা ' তোমার গোপন কথাটি' ইত্যাদি গানে ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীতের পথটি কী রকম হবে তার কিছু আভাস পাওয়া যায়। যদিও আজ শুনলে মনে হবে সামান্য তাড়ায় পড়ে গাইছেন। মাঝে মাঝে সুরচ্যুতও হয়ে যাচ্ছেন। সেটা কতোটা কণ্ঠের জন্য বা রেকর্ডিং যন্ত্রের জন্য তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। কিন্তু সেই গান'কে আজকের বিচারেও পরিপূর্ণ রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে চিনে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান নির্দিষ্টভাবে পরিবেশনের রূপরেখা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াস মনে হয় কাজে আসছিলো। কারণ ১৯২৫ সালে মিস নীহারবালার গাওয়া ' এবার উজাড় করে নাও হে আমার' তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে অনেক পরিণত ও স্বীকার্য বোধ হয়। 


অমলার কাছে যাঁরা সরাসরি গান শিখেছিলেন, তাঁর বোনঝি সাহানা দেবী এবং মালতী বসু, তাঁদের গায়কীতেও বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নপদ্ধতির বিবর্তনটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাহানা দেবীর গুণমুগ্ধ কবি স্বয়ং তাঁকে আহ্বান করে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যখন প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে রাতারাতি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে পন্ডিচেরি চলে যান দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে, কবি অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি যদি দেশের রাজা হতেন তবে সৈন্য পাঠিয়ে সাহানা'কে শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে আনতেন। ভাবা যায়, ১৯২৮ সালের রবীন্দ্রনাথ, যাঁর 'পদতলে' ততোদিনে প্রায় সমগ্র কীর্তির সাম্রাজ্য পড়ে আছে, তিনি সাহানা দেবীর কণ্ঠে নিজের গান শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এই ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় স্বয়ং কবির মনে তাঁর গানের কোন মডেলটি প্রকৃতপক্ষে ধরা ছিলো। সাহানা দেবীর গাওয়া যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি তাঁর নামের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেছে, যেমন 'খেলার সাথি', 'রূপে তোমায়', 'আহা তোমার সঙ্গে', 'নতুন করে পাবো', 'তিমিরদুয়ার খোলো' বা 'যদি প্রেম' ইত্যাদি তার সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হয়েছে। নতুন করে বিশেষ বলার নেই। কিন্তু কয়েকটি গান, যেমন 'আমার যাবার বেলায়', 'শুকনো পাতা কে ঝরায়', 'যদি তারে নাই চিনি গো' বা 'ওদের সাথে মেলাও' শুনে আমার প্রতীতি হয়েছে, যে কথাটা ইতোপূর্বে কবির নিজের ভাষায় ঊদ্ধৃত করেছি এবং অবিরাম শুনে আসছি ছোটোবেলা থেকে, যে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকৃতপক্ষে আগে কবিতা পরে গান, তার চেয়ে বড়ো সত্য কিছু নেই। সুরবিন্যাসটি আধারমাত্র, হিরণ্ময় পাত্রের মতো, তার কাজ কবিতার অমৃতটিকে ধরে রাখা শুধু। সুরের যাবতীয় চাকচিক্য, বহির্মুখী প্রিয়ত্ব, সবই অন্তঃস্থ কবিতাটিকে গরিমান্বিত করার আয়োজন মাত্র, সেই খানেই তার সার্থকতা। 



এই উপলব্ধিটি মালতী ঘোষালের গান শুনেও অনেকের মনে হয়েছিলো। তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা নগণ্য, কিন্তু যাঁরা তাঁর গান সাক্ষাতে শুনেছেন তাঁরাও এই রকম একটি ধারণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত 'ট্রেইন্ড' শিল্পী, সঙ্গীতের কৃৎকৌশল সম্পূর্ণ আয়ত্ব ছিলো তাঁর। তিনি আর কিছু গান যদি নাও করতেন, শুধু 'এ পরবাসে রবে কে'র রেকর্ডটির জন্য তাঁকে চিরকাল মনে রাখা যেতো। শোরী মিঁয়ার মূল পঞ্জাবি টপ্পাটিতে সুর খেলানোর যে মজা রয়েছে, তা'কে সংযত শিল্পবোধে পোষ মানিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সূক্ষ্ম অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম যে শিল্প কবি সম্ভবতঃ তাঁর সৃষ্টির থেকে প্রত্যাশা করতেন, মালতীর উপস্থাপনায় তার প্রকাশ ঘটেছিলো। অমিয়া ঠাকুরেরও রেকর্ড প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু তাঁর গায়নভঙ্গির নিজস্বতা কবিসহ সবাই স্বীকার করেছিলেন । একটা গল্প শুনেছি, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দ্রোণাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্বয়ং কবিকে বলেছিলেন 'মরি লো মরি' গানটি শিখতে তিনি কলকাতায় অমিয়াদির কাছে যেতে চা'ন। তাই শুনে কবি ছদ্ম খেদ প্রকট করেন এই বলে যে স্বয়ং রচয়িতা মজুত থাকতে অমিয়ার প্রতি এ রকম পক্ষপাতিত্ব তাঁকে ঈর্ষিত করে। 


তবে এঁদের সবার মধ্যে অধিক সময়কাল সৃষ্টিপর ও প্রভাবী ছিলেন কনক দাশ (বিশ্বাস)। তিনি তাঁর গানের সঙ্গত হিসেবে হারমোনিয়াম বা অর্গ্যানের সঙ্গে গিটার, বাঁশি ও তালবাদ্য ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবহারের সংযত মাত্রা গান ও গায়নের সঙ্গে অবলীলায় একীভূত হয়ে গিয়েছিলো। পূর্বোক্ত শিল্পীদের গানে যে দাপট ও মজিয়ে দেওয়া সুরেলা উপস্থাপনা আমরা পেয়েছি, কনক দাশের গানেও তা পূর্ণ মাত্রায় উপস্থিত ছিলো। শব্দের স্পষ্ট উচ্চারণ এবং তা'কে ধরে রাখা স্বরের স্থিতি সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর গাওয়া অনেক গানের মধ্য থেকে কয়েকটি গান, যেমন, 'আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা', 'দিনশেষের রাঙা মুকুল', 'কাছে যবে ছিলো', 'এখনও গেলোনা আঁধার' বা 'আসা যাওয়ার পথের ধারে', তো এখনও পুরোনো হলোনা। 



0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল

এবারের আলোচ্য বইটির কথা ঠিক কতজন পাঠক জানেন, আমার জানা নেই। আমি নিজে পড়ে চমকিত হয়েছি। এত ভালোবেসে কেউ নিজের জন্মভূমির কথা লেখে? বিশেষ, লেখক যখন সেই হতদরিদ্র গ্রাম্য পরিবেশ থেকে উঠে এসে কৃতী হয়েছেন। বিদ্বান হয়েছেন। 
একসময় ইছামতী নদী তার দিক পরিবর্তন করেছিল। তার ছেড়ে যাওয়া খাতটি একটি অশ্বখূরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি করে। দক্ষিণ বঙ্গের ও অঞ্চলের মানুষ তাকে বাঁওড় বলে ডাকে। এই দ্বীপভূমি চারিদিকে জল আর মধ্যিখানে স্থল নিয়ে যেন জগৎবিচ্ছিন্ন। সেই দুনিয়ার বার স্থানে কতগুলো গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এক অপূর্ব ছবি এঁকেছেন লেখক। সে ছবি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাওয়া যায় কাহারদের শুয়োরের পাল। রাতের বুক ঠেলে চলেছে। অন্ধকারে সম্পন্ন মুসলমান প্রতিবেশীর উঠোনে দরিদ্র হিন্দু পড়শি সকলের অলক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। কারোর মুখে কথা নেই। শুধু পদ্মপাতায় সেদিনের ভোজনে ব্রাত্য পড়শি খেতে বসেছে। বাঁওড়ের বুকে জেলেদের আনাগোনা। যমুনার হাটে গরুর গাড়ি রাখার বড় মাঠ। রসে ফেলা কড়কড়ে জিলিপি। 
এসব অনেককাল হলো। তবু, আমাদের স্মৃতিতে এ ইতিহাসের প্রয়োজন আছে। 
বাংলার মাঠঘাট ফুল ভালোবেসে। 
লেখক নাকি দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর লেখায় ফিরেছেন। কেন? এ যে ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করা!

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


৯ 

ঠীলের সবকিছুকে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। মনে হতে লাগলো এসব একরাত্তির আগে মিনাকে নিয়ে দেখা সেই দুঃস্বপ্নটার মতো। সে নিজেকে বুঝ দেবার চেষ্টা করতে লাগলো, মনে মনে বলতে লাগলো.. এসব মিথ্যা, ভুল, দুঃস্বপ্ন! কিন্তু হায়... 

সে দৌড়াতে শুরু করলো, সে পালাতে চায় সবকিছু থেকে... অসহ্য... 

সে দৌড়াতেও পারছেনা... টলতে টলতে হোঁচট খেতে খেতে সে কেবিনে পৌঁছালো। তার শরীরটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। মাথার টুপিটা যেন কোথায় গড়িয়ে গেলো। যত্নে রাখা পকেটঘড়িটা ছিটকে পড়ল মাটিতে, ভেঙ্গে গেলো তার ডালা, ফেটে গেলো কাচের ডায়াল। সে ভ্রুক্ষেপ করলনা। তার মনে হচ্ছিল যেন একটা বিশাল লোহার হাত মুঠো করে ধরে আছে তার গলা; সে ছাড়াতে পারছেনা—উফফ, কী কঠিন বজ্রমুষ্টি! সে ব্যথায় শুয়ে গোঙাতে লাগলো... এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাইল... নাহ... মুক্তি নেই। তার কপালটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, চোখদুটো শুকিয়ে গেছে, গলাটা জ্বলছে। 

সিগন্যালের ঘণ্টার শব্দ শুনে তার ঘোর কাটলো। পর পর তিনটে ঘণ্টার আওয়াজে সে জেগে উঠল -- নাহ, তাকে তার ডিউটি করতেই হবে। পাদুটো সিসের মতো ভারি মনে হচ্ছিল তার। নিজের ডিউটি যন্ত্রের মতো করতে লাগলো সে। মনে হচ্ছিল সে যেন এক বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, এবং নিজের মাথাটা কেন যেন সেই কক্ষপথের কেন্দ্রবিন্দু থেকে একচুল নড়াতে পারছেনা সে। অতিকষ্টে ডিউটি শেষ করল সে। 

ওই যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসছে। হ্যাঁ, টোবিয়াসকে এই ট্রেনেই নিয়ে যাবার কথা। যত সে ট্রেনের কাছে যেতে লাগলো, তত তার মনে হতে লাগলো যে তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত চলে যাওয়া ট্রেনের ভেতরে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। শেষ কামরায় তার মনে হল সে একঝলক দেখতে পেল আহত, রক্তাক্ত শিশুকে; তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। 

কিছুক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরলো। সে দেখতে পেল যে সে রেললাইনের ধারের বালির উঁচু পাড়ির উপরে শুয়ে আছে। সে উঠে দাঁড়ালো, নিজের নাকমুখ আর পোশাক থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো গরম বালির দানা। তার মাথা আগের থেকে হাল্কা লাগছে; সে একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববে এবার। 

কেবিনে ফিরে সে ঘড়িটা কুড়িয়ে নিলো মেঝে থেকে। আশ্চর্য, ঘড়িটার ডালা ভেঙ্গে গেছে, ফেটে গেছে কাচের ডায়াল, কিন্তু ঘড়িটা বন্ধ হয়নি। সময় দিচ্ছে টিকটিক করে। ঠীল হিসেব করবার চেষ্টা করলো, অ্যাকসিডেন্টের পরে কতটা সময় কেটেছে; কেমন হতে পারে টোবিয়াসের শারীরিক অবস্থা, সে ভাববার চেষ্টা করল। সে চোখ বুজে ভাবতে লাগলো ... এতক্ষণে ডাক্তারের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। হ্যাঁ, লেনা এসে দাঁড়িয়েছে, ওই তো, ডাক্তারবাবুও দাঁড়িয়ে আছেন লেনার পাশেই। উনি দেখছেন টোবিয়াসকে... মাথা নাড়ছেন। 

‘খুবই খারাপ, খুবই খারাপ অবস্থা...’ বলছেন ডাক্তারবাবু, ‘তবুও... শেষ চেষ্টা... কে বলতে পারে?’ আরও খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি। তারপর মাথা নাড়ছেন... ‘নাহ, শেষ... সব শেষ!’ 

‘শেষ! শেষ!’ একা একা নিজের মনে অস্ফুটে গোঙাতে লাগলো গার্ড ঠীল। পরমুহূর্তে ছিলেছেঁড়া ধনুকের মত লাফ দিয়ে উঠল সে। দুই হাত উর্ধে তুলে মুঠি পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলো কেবিনের ছাতের দিকে। বীভৎস আওয়াজে চিৎকার করে উঠল সে, তার গলার জোরে ওই ছোট কেবিনের কুটিরটা যেন ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে! 

‘হ্যাঁ, ওকে যেতে হবে... ওকে যেতে হবে। আমি জানতাম... আমি জানতাম’... চিৎকার করে উঠল ঠীল। সশব্দে খুলে দিল কেবিনের দরজা। সন্ধ্যা নেমে আসবার আগে আকাশের শেষ আলো একটুখানি ঢুকে এলো ঘরে। দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে ঠীল দৌড়াতে লাগলো রেলগেটের দিকে। সেখানে গিয়ে একমুহূর্ত থামলো; তারপর আবার দৌড়াতে লাগলো বালির পাড় ধরে। দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দৌড়াতে লাগলো সে। প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা যেদিকে চলে গেছে, সেইদিকে দৌড়াতে লাগলো সে। কি করতে চায় সে? কাকে থামাতে চায়? তার বিস্ফারিত দুই চোখ যেন কিচ্ছু দেখছে না। চোখ খুলে রেখেও সে অন্ধের মত দৌড়াতে লাগলো। 

দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলো, ‘ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও, ফিরিয়ে দিয়ে যাও, নিয়ে যেও না। শুনতে পাচ্ছ? ছেলেটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, একটা দলার মতো হয়ে গেছে ছেলেটা! হ্যাঁ, যে ওর এই হাল করেছে, আমি তাকে ছাড়বো না। কিন্তু শোনো, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও, শুনছো তুমি? দাঁড়াও, যেও না।’... মনে হচ্ছিল যেন কে চলে যাচ্ছে এবং ঠীল তাকে আটকাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে; সে অন্য দিকে চলে গেলো এবং ঠীলও যেন তার পিছু পিছু অন্য দিকে যেতে লাগলো। 

‘যেওনা মিনা, তুমি যেওনা!’ ঠীল শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।... ‘শুনছো, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও।‘ ঠীল শূন্যে হাতড়ে হাতড়ে যেন কাকে ধরবার চেষ্টা করে যাচ্ছে... ‘হ্যাঁ, ঐ মেয়েমানুষ, হ্যাঁ, ওকে আমি ছাড়বো না... কুঠারের এক ঘা দেবো, মরবে, ওইরকম হাল করে ছাড়বো আমি!’... 

‘হ্যাঁ, কুঠার দিয়ে ... রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে যাবে... ছাড়বো না আমি’... ফেনা উঠতে থাকে ঠীলের মুখ দিয়ে। চোখের মণি অদ্ভুতভাবে ঘুরতে থাকে... 

সন্ধেবেলার ঠাণ্ডা বাতাস এসে হাল্কা পরশে ছুঁয়ে যায় অরণ্যের গাছপালাগুলিকে। পশ্চিম আকাশে গোলাপি আভার কিছু মেঘ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। 

ঠীল অদৃশ্য কারো পিছন পিছন গিয়েছিল প্রায় একশো পা; এখন সে ফিরে আসতে থাকে। দুই চোখে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে দুহাত ছড়িয়ে সে ভিখারির মতো ছেলের প্রাণভিক্ষা করছিল এতক্ষণ। এখন সে ফিরে আসে, হতোদ্যম, ক্লান্ত চোখদুটো ঢেকে রাখে দুই হাতে। তার শরীর শিথিল হয়ে গেছে হতাশায়, মুখটা ফ্যাকাসে, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, এক অদ্ভুত খাঁ খাঁ শূন্যতা তার চোখেমুখে। অতিকষ্টে নিজের দেহ টানতে টানতে ফিরে আসতে থাকে সে। 

সূর্য তার শেষ রশ্মির পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল অরণ্যের গায়ে। পাইনবনের চেহারা কেমন অদ্ভুত অপ্রাকৃত মনে হচ্ছিল। সরু কাণ্ড আর ধূসর মুকুটের মতো শরীর নিয়ে গাছগুলি নিস্তব্ধ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে। একটা কাঠঠোকরার ঠোঁটের ঠকঠক আওয়াজ ভেঙ্গে দিচ্ছিল নৈঃশব্দ। শীতল ধূসর নীল আকাশের মধ্যে মাত্র একখানি গোলাপি আভার মেঘ তখনো জেগেছিল। বাতাস ক্রমশ আরও শীতল হয়ে আসছে; ঠীলের খুব শীত করছিল। সে কেঁপে উঠলো। সবকিছু তার কাছে অদ্ভুত, অচেনা ঠেকছে। এই জঙ্গল, রেললাইন, রেলগেট, বালির বাঁধ, গাছপালা, পাখির ডাক সবকিছু মনে হচ্ছে যেন অন্য কোনো এক গ্রহের। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না! এমনসময় সে দেখতে পেলো একটা কাঠবেড়ালি রেলের ট্র্যাকের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে জানেনা হঠাৎ কেন, তার ঈশ্বরের কথা মনে হল... ‘ঈশ্বর আসছেন এই পথে!’ সে বিড়বিড় করতে লাগলো... ‘ঈশ্বর আছেন! তিনি আসছেন এই পথে!’ পরমুহূর্তে তার মনে হল সে পাগলামি করছে। সে অনেককিছু ভেবে নিচ্ছে যার কোনো মানে হয়না। সে চেষ্টা করতে লাগলো তার সব ভাবনাগুলো গুছিয়ে নেবার, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিল না। নিজেকে ভীষণ অসহায় বলে মনে হচ্ছিল তার। 

এমন সময় হঠাৎ পাশের বার্চগাছের জঙ্গল থেকে খুব জোরে শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো। হ্যাঁ, ছোট দুধের বাচ্চাটা। মাকে ছাড়া এতক্ষণ রয়েছে সে! ঠীল অনিচ্ছাসত্ত্বেও দৌড়ে গেলো সেদিকে। বাচ্চাটা এখানে, এই জঙ্গলে কীভাবে এলো? বাচ্চাটা কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো খিদে পেয়েছে। গাড়ির মধ্যে সেরকম কোনো আরামদায়ক বিছানাও নেই যে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে থাকবে। ঠীল ভেবে পাচ্ছিল না কিভাবে বাচ্চাটাকে শান্ত করবে! নানারকম আবেগ, প্রশ্ন সবকিছুর মধ্যে সে যেন তলিয়ে যেতে লাগলো। 

‘ঈশ্বর আসছেন এই পথে!’ সে বুঝতে পারছিল সে কি বলছে, ‘টোবিয়াস... ঐ মেয়েমানুষটা ওকে খুন করেছে। ওকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সৎমা, কাক-মা, সে কীভাবে...’ চিৎকার করে উঠল ঠীল, ‘এখন ওর নিজের বাচ্চাটা, হ্যাঁ, এটা এখনও বেঁচে আছে।’ তার সমস্ত যুক্তি- বুদ্ধি যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো; সব অনুভূতি যেন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগলো। শিশুটির চোখদুটি তাকে যেন বিঁধছিল। সে নিজের আঙুলের ফাঁকে নরম একটা মাংসের দলা অনুভব করছিল। এমন সময় এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ আওয়াজ তার কানে আঘাত করল। 

আগের মুহূর্ত অবধি তার মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার ব্রহ্মতালুতে ফোঁটা ফোঁটা গরম মোম ঢেলে যাচ্ছে। তার মন, যুক্তি বুদ্ধি, ভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। এমন সময় সিগনালের ঘণ্টা তীব্র ধ্বনিতে বেজে উঠল, বাতাসে ছড়িয়ে যেতে লাগলো সেই আওয়াজ। সে ধীরে ধীরে নিজের সম্বিত ফিরে পাচ্ছিল সেই আওয়াজে। সেই আওয়াজে সে বুঝতে পারলো যে সে কি করতে যাচ্ছিলো! শিশুটির কণ্ঠনালী থেকে সরিয়ে নিল নিজের হাত। বাচ্চাটা ওর হাতের চাপে খাবি খাচ্ছিল। হাতের চাপ আলগা হতেই বাচ্চাটা কাশতে শুরু করল এবং প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। 

(চলবে) 
[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 





0 comments:

0

ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ

Posted in

ধারাবাহিক

বইপাড়ার তন্ত্রধারক ৪
ফাল্গুনি ঘোষ



কলেজজীবনের গোড়ার কথা। কলেজস্ট্রিটে গ্রন্থপ্রেমী ভিজিটরের পর্ব চুকিয়ে ঢুকে পড়েছি বইপাড়ার নিত্যকর্মের এক অংশে। কলেজের ভিতরে ক্যান্টিন, বাইরে কফিহাউস, ফেভারিটের সীমানা ছাড়িয়ে আড্ডা পৌঁছেছে হেয়ার স্কুল আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝের রাস্তায়। কখনো কলেজ থেকে বেরিয়ে ডানহাতি ফুট ধরে আর হিন্দু হোস্টেল থেকেও সোজা ডানহাতি হেঁটে কলেজস্ট্রিটে ধাক্কা খাওয়ার দুটি দোকান আগেই সারা দিনের যখনতখন, মানে সকাল নটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত, পৌঁছে যাওয়া যায়। চা বিস্কুট পাউরুটি ঘুগনির সঙ্গে নানা সময়ের বইপাড়ার স্বাদ একত্র করে নিতে ডাকেন যে মানুষটি, তাঁর নাম বুড়োদা। আমাদের নানান কাজের অগতির গতি। হৃদয়পুরের বাসিন্দা বুড়োদা রোজ সকালে ট্রেন ধরে চলে আসেন কলেজস্ট্রিট। বাড়ি থেকে আসেন অথবা বাড়িতেই আসেন। আজ দু-দশক পেরোনো আমাদের কলেজজীবনে হাতে পকেটমানির বিশেষ বালাই নেই। অথচ চারপাশে এত বই! তখন আবার প্রযুক্তির বাইরেও প্রচুর জ্ঞানপিলে চমকে দেওয়া বইয়ের দেখা মিলত এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। অতএব আমাদের ত্রাহিমাম দশা। বিপত্তারণ শ্রীমধুসূদন বুড়োদা। পরের দু’এক মাসে ধারাবাহিক সুদহীন শোধের কড়ারে ধার। একমাসে একাধিক বারেও আপত্তি নেই। দোকান গুমটির পাশে পাতা মুখোমুখি তক্তাপোশ বেঞ্চ ও সেই গাছটি, যা অচ্যুৎদার লাগানো আর নাম যার জীবনানন্দ। বেশ বোঝাই তো যাচ্ছে, সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক কূট থেকে কবিতা বিপ্লব স্মরণসভা; বিশ্রাম থেকে বিশ্রামের ক্লান্তিবিমোচন নিয়ে জমজমাট বুড়োদার চায়ের দোকান। একদিন হঠাৎ দেখি স্বভাবত কলেজস্ট্রিটের ইনফরমেশন সেন্টার বুড়োদার মুখ গম্ভীর। শোনা গেল একটু আগেই এই রাস্তা দিয়ে তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দাহ করতে। সবাই অবাক। কোথাও কোনো খবর নেই! তবে কি গোপনে ঘটে গেল চাঞ্চল্যকর কিছু! বইপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল গুঞ্জন। আর তা বিপদসীমা অতিক্রমের ঠিক আগে বুড়োদা জানালেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী ঠিকই, তবে কুশপুত্তলিকার আকারে।
বুড়োদা কয়েকবছর হল বাকি পৃথিবীসহ কলেজস্ট্রিট ত্যাগ করেছেন। আর তারও আগে পৌরসংস্থার উদ্যোগে ভাঙা পড়ে ছোটো হয়ে আড্ডার অবকাশ হারিয়ে হীনবল হয়েছে সে-দোকান। প্রশাসন দোকান ভেঙেছে। আর ভিতরপানে ভেঙে গেছে না-দেখা পুরোনোকে এক প্রৌঢ়ের এগিয়ে দেওয়া গ্লাস পাউরুটির টুকরো আর পেঁয়াজকুচির মধ্যে ছুঁয়ে নিয়ে নিজেদের সামনের দিকে ঠেলে দেওয়ার অবকাশ।
বুড়োদার দোকানের উল্টো দিকে কাগজের বাঘের বন্ধ গুমটির নীচের বাসিন্দা এক ভিখারিনীর মাতৃহারা ছেলেকে অনেক স্নেহে বড়ো করছিলেন এই চায়ের দোকানি। মৃত্যুর আগে ওই সংকুচিত দোকানটার অধিকার বুড়োদা দিয়ে যান ওই ছেলেটিকেই। এই শার্সি-লাগানো লড়াইয়ের কালে সে-দোকানও আজ নেই। ছেলেটি ভ্যান চালায়। প্রায়শই দেখি তাকে বইপাড়ার অলিতে গলিতে। আর দেখলেই জিজ্ঞাসা করতে যাই, 'বুড়োদার খবর কী রে ? দেখছি না অনেকদিন !' বস্তু আর বাস্তবের সিগন্যালে আটকে যাই। অথচ তোমার ছাকনির সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে কত অনায়াসেই পুরোনো সময়গুলো ঢুকে পড়ত আমাদের চায়ের গ্লাসে, বুড়োদা !

# প্রসঙ্গত, বুড়োদার ছবিটি বোধিসত্ত্ব করের সহায়তায় আয়নানগর.কম এর সূত্রে পাওয়া গেল।



0 comments: