0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in


ধারাবাহিক


পায়ের শব্দ
সোমঙ্কর লাহিড়ী 



৯ 
সারারাত অ্যান্ডি মাঝেমাঝেই ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠেছে। গলা শুকিয়ে গেছে। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থায় কখন যে তার ঘুমটা ফিরে এসেছে সেটা সে নিজেও জানে না। 

ফোনটা যখন আবার বেজে উঠল, তখন কটা বাজে সেটা অ্যান্ডির পক্ষে বোঝা সম্ভবপর নয়, কারণ গোটা ঘরটার সব জানলা দরজা বন্ধ। চমকে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখল লেখা কাঞ্চনদা কলিং। 

বল, কাঞ্চনদা। 

আমি কিরণ ঘোষদস্তিদার কথা বলছি। আমি কাঞ্চনের সাথে তোমার ফাইনান্সিয়াল সাইডটা নিয়ে কথা বলে নিয়েছি। সো ফার কন্ডিশান ইস নট দ্যাট ব্যাড, দ্যাট আই অ্যাপ্রিহেন্ডেড। উই ক্যান ম্যানেজ, এন্ড ইউ হ্যাভ টু গো টু দ্য রিহ্যাব। হ্যাং অন আয়্যাম কামিং উইদ ইন এ কাপল অফ মিনিট। ডোন্ট ট্রাই টু অ্যাক্ট স্মার্ট আপঅন হিয়ারিং অ্যাবাউট রিহ্যাব। ট্রাই মি। 

অ্যান্ডি ভেবে পেলো না রিহ্যাবের হাত থেকে বাঁচবে কি করে। সে এক বিদঘুটে কষ্টকর অভিজ্ঞতা। প্রথমদিন থেকে উইথড্রয়ালের ভোগান্তি। মেপে সামলে নেশা। ইঞ্জেকশান, ওষুধ। অখাদ্য সব খাবারদাবার। তার উপরে একদল শ্যুড্ডার জ্ঞান বিতরণ। বাড়াবাড়ি করলে অল্প বিস্তর মার, তার চেয়েও বেশী কিছু করলে ঘুমের ইঞ্জেকশান। উফ্‌ ভগবান!! এই কিরন বুড়ো তো জ্বালিয়ে খেলো!! 

ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করতেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। আবার অ্যান্ডি দেখল একটা আননোন নম্বর। ভয়টা ফিরে এলো আবার। 

ফোনটা বেজে যেতে লাগল, ওটাকে তোলার মতো সাহস অ্যান্ডি পাচ্ছিল না। অনেকবার বেজে বেজে সেটা থেমে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আবার বাজতে শুরু করল। এবারে আর থাকতে না পেরে অ্যান্ডি ফোনটা ধরল। অন্যদিকে মুকেশের গলা, 

ক্যয়া ইয়ার, ফোন কিঁউ নে উঠাতা তু? 

কাল রাত কো তুনে ফোন কিয়া থা? 

নেহী তো! 

ও আদমি ফির সে ফোন কিয়া থা, ইয়ার ক্যায়সে ছুটকারা পাউঁ উসসে। 

তু সাচ বোল রাহা হ্যায়? কোই সাচমে তেরে কো ফোন কিয়া কাল? 

তো ক্যা? ম্যায় বানাকর বোল রাহা হুঁ, তুঝে? 

রাগে বিরক্তিতে অ্যান্ডি ফোন রেখে দিল। 

কিরণ ঘোষদস্তিদার এসে ডোরবেল না বাজিয়ে কাঞ্চনের ফোন থেকে ফোন করলেন। তারপরে অ্যান্ডি দরজা খুলল। 

ওঁকে অনেক রকম ভাবে অ্যান্ডি বোঝাতে চেষ্টা করল যে, ও আর নেশা করবে না। ঠিকঠাক জীবন যাপন করবে, কিন্তু সবার সব কথা শুনতে হবে, এমন মাথার দিব্যি উনি কাউকে দেননি, তাই শেষে বললেন। 

সোজা কথায় যাবে? না অন্য ব্যবস্থা দেখব? 

অন্য ব্যবস্থা মানে অ্যাসাইলামের গাড়ি আসা, তারপরে চোর ছ্যাঁচোড়ের মতো হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়তে নিয়ে যাওয়া। আর যদি মিডিয়া হাজির থাকে, তো একেবারে সোনায় সোহাগা। 

অ্যান্ডি কথা না বাড়িয়ে বাপ আর ব্যাটার সাথে নীচে গিয়ে শান্তভাবে গাড়িতে গিয়ে বসল গাড়ি সোজা গিয়ে হাজির হলো ড্রাগ রিহ্যাবে। 

ড্রাগ রিহ্যাবে গাড়ি ঢুকল, নিজের মোবাইল যখন জমা করে দিতে হলো, তখন অ্যান্ডির মনে হলো, ওর যেন জেল হলো। তারপরে ডাক্তারবাবু এলেন চেক আপ শুরু করলেন। 


প্রায় আড়াই মাস বাদে অ্যান্ডি যখন রিহ্যাব থেকে কিরণ ঘোষের সাথে বেরল, তখন নিজেকে অনেক হালকা লাগছে, কোনও রকম মানসিক গ্লানি নেই। শরীরের সেই দড়ি পাকানো ভাবটা ছেড়ে গিয়ে বেশ স্বাস্থবান হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো যে পরিবর্তন ও নিজে টের পাচ্ছে সেটা হলো সেই ভয়টা কেটে গেছে। 

ফোনটা হাতে পেয়েই প্রথম অ্যান্ডি একটা সেলফি নিয়ে ট্যুইট করল, ব্যাক টু লাইফ। 

কিরণ ঘোষ একেবারে নো ননসেন্স মোডে গিয়ে বললেন, 

তোমার ঐ পেল্লায় ফ্ল্যাট সেল আউট করে দিতে হবে, তাতে যা টাকা পাবে সেই টাকায় একটা ছোটো ফ্ল্যাট নাও, কারণ ইউ হ্যাভ টু সারভাইব ফর সাম টাইম। আমার বাড়িতে তোমায় রাখতে পারতাম, কিন্তু আমি চাই না তুমি কারো কোনও ওবলিগেশানে থাকো। লীভ ইন ইয়োর ওন টার্ম। তোমাকে তোমার পুরানো বন্ধুদের সাথে আবার র‍্যাপো বিল্ড আপ করে নিতে হবে কুইক। যতক্ষণ না কোনও বড়ো ব্যানারে কোনও প্রোগ্রাম পাচ্ছো, ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে বিভিন্নভাবে প্রোগ্রাম জোগাড় করতে। বিকজ ইন দিস টু অ্যান্ড হাফ মান্থ ইউ হ্যাভ লস্ট মোস্ট অফ ইয়োর গ্রাউন্ড। গট ইট? 

নিজের পুরানো বড়ো ফ্ল্যাট ছেড়ে আসার সময় একটু যে মন খারাপ লাগছিল না, তা নয়। কিন্তু ঐ পিছনে তাড়া করা ভয়টা আর থাকবে না, সেটা মনে করতে একটা হালকাভাবও লাগছিল অ্যান্ডির মনে। 

আর্মাডিলোর পুরানো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে দলটাকে আবার ফর্মে আনার জন্য চেষ্টা শুরু করতে হবে, ভেবে নিল অ্যান্ডি। সেইমতো তাদের বাকি চারজন কে ডেকে নিল নিজের নতুন ফ্ল্যাটে। শুধু মুকেশকে আর ডাকল না। ও যে এখন রিহ্যাবেরে বাইরে সেই খবরটাও জানাল না। 

সাংবাদিক বন্ধু বীরুকে ফোনে ধরল অ্যান্ডি, 

বস্‌ এখন ক্লীন এন্ড ক্লীয়ার, কিছু হাত টাত বাড়াও। 

আরে প্রোগ্রাম করবে নাকি? 

হাতে আছে? 

ফিলানথ্রপিক অ্যাক্টিভিটি করতে হবে কিন্তু। 

আরে স্টেজ চাই, মাইক চাই, আর পাবলিক চাই দিতে পারলে দেখবে অ্যান্ডি এন্ড আর্মাডিলো ইস স্টিল দ্য বেস্ট। 

বীরু এক ফাদারকে ধরে করে তাদের চার্চের আর অরফ্যানেজের জন্য একটা ফান্ড রেইজিং এর প্রোগ্রাম ঠিক করল। 

অনেকদিন বাদে অ্যান্ডি স্টেজ পেল, সেই পুরানো উদ্দীপনা, সেই পুরানো উত্তেজনা, শুধু শুরু করার আগে অ্যান্ডি মাইক হাতে সর্বসমক্ষে তার নেশার জীবন আর নেশা ছাড়ার পরের জীবন নিয়ে একটা ছোট্ট কথা সবার সাথে শেয়ার করল, তারপরে সবার কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ জানাল নেশা বিহীন জীবন যাপনের জন্য। 

শুরু হলো, “সান সাইন অন মাই শোল্ডার্স মেক মি হ্যাপী” তারপরে একে একে প্রায় বারোটা গান গেয়ে একটু বিশ্রাম চাইল শ্রোতাদের কাছে। দর্শক স্রোতা চার্চ কতৃপক্ষ সবাই বুঝল, এ এক অন্য অ্যান্ডি আজ স্টেজে। 

সাময়িক বিরতি নিয়ে অ্যান্ডি গ্রীন রুমে এল, শরীরের ক্লান্তি অবশ্যই আছে কিন্তু তারচেয়েও বেশী রয়েছে উদ্দীপনা। সে পেরেছে। আবার দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সে মানুষের সামনে এসে তাদের মনজয় করতে পেরেছে। এটা কিমি. কীসের? 

গ্রীন রুমের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অ্যান্ডি গেল ওয়াসরুমে। যেহেতু এটা অডিটোরিয়ামের পিছন দিক, তাই এখানে শুধু আর্টিস্ট ইত্যাদিরাই ব্যবহার করে। অ্যান্ডি ওয়াসবেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে নীচু হয়ে মুখে জল দিতে শুরু করল। দেখতে পেল না পিছন থেকে একটা বেশ লম্বা লোক, পুরো ধোপ দুরস্ত পোষাক আসাক পরা, খুব দ্রুত আর নিশব্দে অ্যান্ডির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আন্ডীর মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। অ্যান্ডি চমকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পারল তার পায়ে আর কোনও জোর নেই। নাকে একটা ঝিম ঝিমে গন্ধ। তারপরে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল অ্যান্ডির। 

সেই দীর্ঘকায় লোকটা হাতে করে বেশ অনেকটা সাদা পাউডার অ্যান্ডির মুখে নাকে মাখিয়ে দিয়ে। ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে গেল। 

পনের মিনিটের বিরতির পরে আবার যখন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মুখে তখন ঘোষক কে জানাতে হলো যে বাথরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার জন্যে অ্যান্ডি আর আর্মাডিলো প্রোগ্রাম করতে পারবে না। অ্যান্ডিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। 

ফাদার এন্ড্রুজ বীরুকে বললেন, 

আমি তোমার কথার উপরে বেস করে ওকে নিয়েছিলাম, এখন তো দেখছি, এটা এক মস্ত ভুল করেছিলাম আমি। 

বীরু মাথা নীচু করে উত্তর দিল, 

ফাদার আই হ্যাভ ডাউট। লাস্ট পনের কুড়ি দিন আমি মাঝে মাঝেই ওদের রিহার্সালে গেছি। ওদের সাথে সময় কাটিয়েছি। অ্যান্ডিকে একটা সিগারেট অবধি টানতে দেখিনি, সে কিনা এখানে পারফর্ম করতে এসে মিড টাইমে এতটা কোকেন কনজিউম করে অজ্ঞান হয়ে ওয়াসরুমে পড়ে থাকবে? 

যাই হোক, বীরু আমাদের প্রোগ্রামটা নষ্ট হয়ে গেল। প্যাট্রন স্পন্সর্সরা আবার টাকা নিয়ে আসবে বলে তুমি মনে কর? 

ফাদার যদি এর পিছনের সত্যিটা সামনে আসে তবে? 

তবে আর কি, তোমার বন্ধুর মান সম্মানটা বেঁচে যাবে। কিন্তু আমাদের টাকাটা আবার ফিরে আসবে কি না, সেটা তো বলতে পারছি না। 

আপনি আস্বস্ত থাকুন ফাদার, যদি অ্যান্ডি দোষী হয় তবে ওকে আর ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা দেবে না মিডিয়া। আর না হলে এর শেষটা আমিও দেখতে চাই। কারণ আমি ক্লোজলি এন্ড পার্সোনালি ওকে দেখেছি লাস্ট কাপল অফ ডেস। হি হ্যাস চেঞ্জড হিমসেলফ। অ্যাট লিস্ট ট্রায়েড আই মাস্ট সে। 

হাসপাতালে ডঃ সব্যসাচী মুখার্জী বীরুকে আর কিরণ ঘোষ দস্তিদারকে নিজের ঘরে বসিয়ে জানালেন, 

অ্যান্ডিকে আগে ক্লোরোফর্ম দেওয়া হয়েছে তারপরে ওর নাকে মুখে কোকেনের গুঁড়ো দেওয়া হয়েছে। 

বীরু জিজ্ঞাসা করল, 

ডঃ মুখার্জী আপনি যদি একটু ইলাবরেট করেন আমাদের। 

ক্লোরোফর্মের গন্ধ যায়নি বাবা! ডঃ মুখার্জী অধৈর্য হয়ে জবাব দিলেন। সরকারি হাসপাতালে এমনিতেই ঝামেলা পোয়াতে পোয়াতে জেরবার, তায় এখন বীরু। নেহাত পরিচিত তাই বাকী অত্যাচারগুলো নিয়ে হাজির হয়নি। শুধু অ্যান্ডির বাড়ির না কোথাকার এক বুড়ো ভদ্রলোক সাথে। 

যদি সেন্সে থেকে কোকেন টানত তবে ব্লাডে পেতাম, জ্ঞান ছিল না, তাই ব্লাডে কোন ফাউল কেমিক্যালের প্রেজেন্স পাইনি। ঘণ্টা খানেক বাদে জ্ঞান ফিরে আসবে তখন ছেড়ে দেব নিয়ে বাড়ী চলে যেও। 

বাইরে তখন গন্ধেগন্ধে মিডিয়া এসে জড়ো হয়েছে। কিরণ ঘোষ চিন্তিত মুখে বীরুকে বললেন, ফ্ল্যাটেতে সিকিয়োরিটির জন্য সব ব্যবস্থা করেছি, সি সি ক্যামেরা, ভালো ডোর লক। সব কিছু। ঐ কমপ্লেক্সের সিকিয়োরিটির লোকেদের আমি নিজে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছি। তারাও যথেষ্ট অ্যালার্ট। কিন্তু বাইরে যদি এই রকমভাবে হঠাৎ করে ওর উপরে অ্যাটাক করে দেয়, তবে তো বাউন্সার ইত্যাদির ব্যবস্থাও করতে হবে। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম বুঝলে, ইয়াং ম্যান। ছেলেটা কিন্তু সত্যি নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করছিল, আজকে কেমন স্টেজ করছিল দেখলে! 

বীরু স্বীকার করল। 

আমার বুড়ো বয়েসে অনি একটা চ্যালেঞ্জ আমার কাছে। কিন্তু ওকে এই নেশার হাত থেকে বার করতে পেরেছি অনেক চেষ্টা চরিত্র করে। কিন্তু এইভাবে যদি ওকে শেষ করে দিতে চায়, তবে কি করে হবে? সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে মোটিভটা কি?

0 comments: