0

গল্প - তন্ময় বিশ্বাস

Posted in


গল্প


মশাল 
তন্ময় বিশ্বাস 


আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, যে ভিড় কতটা হুজুগে হতে পারে! হলোই বা নববর্ষ, না হয় বছরের প্রথম দুপুরের বইপড়া। তো? তাই বলে কি আর চৈত্র সেলটা আরেকদিন এক্সট্রা এক্সটেনশান পেয়েছে? নাকি কলেজস্ট্রিট বলে সূর্যটা ছেড়ে কথা কইছে? না তো! সেই তো পাঞ্জাবির হাতায় কপাল মুছে নেওয়া, পিঠে হাজার পিঁপড়ের সুড়সুড়ি, শান্তিনিকেতনী ব্যাগ থেকে মিনারেল জলের বোতলটা একটু উঁকি মেরেছে কি, পিছন থেকে 'দাদা জলটা এঁটো নাকি?....'। কিম্বা ধরুন প্যারামাউন্টের আধঘণ্টা লাইনের পর চামচ দিয়ে বরফ কাটিয়ে তুলে আনা নারকোল শাঁসের মালাই। তবু আসাটি চাই! 

যারা আজকাল বাঙালী বই পড়ে না, বই পড়ে না করে চিৎকার চেঁচামেচি করে, মাঝে মাঝে মনে হয়, তাদের এই প্যারামাউন্টের সিঁড়িতে এনে দাঁড় করাই। নেতাজি, মানিকের প্রিয় শরবতে স্ট্র ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করি, 'কি দাদা? কি বুঝছেন?' 

গাঁঠিয়া চুবিয়ে বাংলা খাওয়া পাবলিকের এত আঁতলামি আসে কোত্থেকে কে জানে! 

আচ্ছা, এবার বরং ওদিকে দেখুন। ওই যে মহাবোধি সোসাইটির সিঁড়ি থেকে এবার ভিড়ের মধ্যে যে মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক নেমে পড়লেন? উনি জয়ন্তবাবু। মানে জয়ন্ত চৌধুরী। আমাদের গল্পের নায়ক। নায়ক বলতে, উনি না তো রিস্ট ঝাঁকিয়ে জাল বুনতে পারেন, না তো চোখ পিটপিট করলে লেজার বেরোয়। এমন কি দাড়ি জটা পড়ে, পিস্তল হাতে নিয়ে, কাশীর হাওয়া খেতে খেতে, 'ঘুঘু ফাঁদ তো দেখোনি মার্কা ডায়লগও আওড়ান না। ওনার মোটা ফ্রেমের চশমা, তেলে চোবানো চুল, মৌলালির ফুটপাথ থেকে কেনা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ আর প্রায় তিনশো দিনই পরা একই ডিজাইনের হাফহাতা পাঞ্জাবী এ সবের সাথে যায়ও না তেমন। 

তবে উনি একটা জিনিস করেন বটে। যাতে কিনা এই টিপিক্যাল বাঙালী বাঙালী লুক নিয়েও দিব্যি স্পটলাইট পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কি এই কাজটার জন্য এই লুকটাই সবথেকে বেশি মানানসই! 

ইয়েস, সেটা হচ্ছে লেখালেখি। জয়ন্তবাবু ওই যাকে বলে কিশোর সাহিত্যিক! 

আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি পুরো কথাটা মিস করে যাচ্ছেন। বলছি, 'হওয়া যায়'। হননি। বাজারে ওনার নাম আছে বটে। কিন্তু ওঁর নামে বাজার কাটে না। সহলেখকদের যেমন একটা গল্প কি উপন্যাস বেরলেই হইহই পড়ে যায়। ফেসবুকে পোস্টের পর পোস্ট পড়ে। কমেন্ট লাইকে ভরে ওঠে নোটিফিকেশন বাক্স। তখন উনি সবুজ আলো জ্বেলে চুপচাপ বসে থাকেন, আর ভাবেন ওই ম্যাগাজিনে, ওই সংখ্যায় ওঁরও তো গল্প আছে। কই কেউ তো.... 

অবশ্য এই রিভিউয়ের ব্যাপারগুলো আবার বেশ গোলমেলে। সবসময় যে লেখার ওপর ডিপেন্ড করে তা কিন্তু নয়। এর ভেতর যে সূক্ষ্ম মেরুকরণ বা দলাদলি আছে, সেগুলো বাইরের কোনও পাঠক চট করে বুঝবেন না। তবে হ্যাঁ, এখন আপনি যদি ফেসবুকের কোনও না কোনও সাহিত্য গ্রুপের মেম্বার হন, তাহলে আর কিছু না হোক, বিভিন্ন লেখকের পিছনে কাজ করা দলগুলোর ব্যাপারে জানেনই। 

ও ভাল কথা, লেখক বলতে কিন্তু মোটামুটি লেজেন্ড পর্যায়দের কথা বলছি। যারা বিভিন্ন পত্রিকায় শারদীয়ায় উপন্যাস, গল্প লেখার জন্য রীতিমত আমন্ত্রণ পান বা ছোটো করে বললে যারা আমন্ত্রণ ছাড়া লেখা দেন না কোথাও। এটা বলে নিলাম, কারণ এখন আবার যা দাঁড়িয়েছে তাতে করে পাঠকের চেয়ে লেখকের সংখ্যায় বেশি! দুটোকে আলাদা করা বেজায় মুশকিল। 

এই যে ধরুন, আপনি প্যারামাউন্টের তিনটে সিঁড়ি উঠে গিয়ে সাঁই করে এই ভিড়ের মধ্যে ঢিল ছুঁড়লেন, তারপর সেই ঢিলটা যার মাথায় গিয়ে 'অ্যাঁক' করবে, এইটটি পার্সেন্ট চান্স সে একজন লেখক (স্বঘোষিত না অর্জিত সেটা পরের ব্যাপার) আর বাদবাকি নাইন্টিন পার্সেন্ট চান্স হলো, এই নববর্ষের বাজারে সে কোনও না কোনও লেখকের পিছন ধরেছে, ফ্রি কপি আদায়ের জন্য। আর বাদবাকি পড়ে পাওয়া এক পার্সেন্ট হলো গিয়ে.... 

আচ্ছা এসব থাক বরং। জয়ন্তবাবুর এমনিতেই এসবে বিশ্বাস নেই তেমন। তাঁর ধারণা, না, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে ভাঁড়ে মিষ্টি থাকলে তবেই গিয়ে পিঁপড়েটা ধরে। নইলে কই? তিনিও তো বেশ কিছু নামী পত্রিকায় মাঝে মধ্যেই লেখেন। চুপিচুপি নিজের কয়েকটা বই যে ডাকবাক্সে ফেলে আসেননি তাও নয়। তবে? কই তাঁর তো ধূমকেতুর লেজের মতো কোনও ফ্যানক্লাব নেই, কোনও সেলফি স্টিকই তো আকাশ ঢেকে দেয় না তাঁকে লক্ষ্য করে! 

তাই টকে যাওয়া 'আঙুর ফল'-এ তার বিশ্বাস নেই তেমন। বরং আঙুর পাড়ার মই, ইয়ে মানে লেখালেখির দিকেই তিনি আরও বেশি করে ডুবে যান। লেখেন, কাটেন, দিয়ে আবার লেখেন। দরকার মতো মোবাইলে গুগল করে নিতেও অনীহা দেখান না কখনও। ব্যাপারটা তো আর তেমন সোজা নয় বরং বেশ কঠিনই বলতে গেলে। 

শুনতে একটু খারাপ লাগলেও লেখালেখির সাথে সব থেকে ভালো তুলনাটা কিন্তু টানা যায় বড়োবাইরের! 

ধরুন কখনও কমোডে গিয়ে ঘন্টাখানেক বসে থেকেও বিফল মনোরথে ফিরে আসেন। তখনকার সেই 'কত কথা বলার ছিল, কত কিছু হওয়ার ছিল' মার্কা অস্বস্তি। কিম্বা ভেবে দেখুন, হঠাৎ 'দুর্লভ' কোনও স্থানে কি কখনও আপনার পেটে চাপ পড়েনি? যখন কিনা কপালের ঘামটুকু মোছার মতো অবস্থাও থাকে না, নড়লে চড়লেই যখন তখন পৃথিবী ব্যালেন্স হারাবে, যন্ত্রণাময় বসন্ত ফুল ছড়িয়ে যাবে চারদিকে। হ্যাঁ ঠিক তক্ষুনি যদি একবার বাথরুম হয়ে আসেন। তারপর 'আমার খোলা হাওয়া' টাইপ যে আরামটা পান, আমি সেটার কথায় বলছি। 

এই লেখালেখিও তাই। যতক্ষণ না নিব গলে খাতায় নামছে, ততক্ষণ শান্তি নেই। 

ইয়ে বলছি কি, জয়ন্তবাবু যতক্ষণ ভিড় ঠেলাঠেলি করছেন, ততক্ষণ আমরা বরং এই ঘামাঘামি, গুঁতোগুঁতি থেকে একটু খোলামেলাই গিয়ে দাঁড়াই। চিন্তা নেই যখন ফিরে আসার ঠিকই ফিরে আসব, ডিও ফিও মেরে এই ভিড়ের মধ্যেই আসব। নো চাপ। 

এখন এই 'খোলামেলা' জায়গা বলতে ছেলেবেলা ছাড়া কোথায় বা যাওয়া যায় আর? বলতে নেই, কিন্তু ওখানেই তো শান্তির যাকে বলে পাকাপোক্ত আস্তানা, শত কানমলা, হোমওয়ার্কের মধ্যেও! 

তবে জয়ন্ত বাবুর ছোটোবেলাটা কিন্তু ছিল বেশ হিংসা করার মতো। আরে শুধু জয়ন্তবাবু কেন? ওই সময়ে যারাই জন্মেছেন, তারায় দুটো এক্সট্রা কপাল নিয়ে জন্মেছেন। সময়টা বুঝতে পারছেন তো? তখনও কিন্তু মোবাইল নিয়ে কল্পবিজ্ঞান লেখা হয়। পাড়ায় পাড়ায় একটা-দুটো বাড়িতে বিঘ্নতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয় টেলিভিশনের সাদাকালো ছায়া। 

আর আমরা তো জানিই, সে সব সময় মা একটু আড়াল হলেই ভূগোল বইয়ের পাতার ফাঁকে ঢুকে পড়ত অন্যরকম একটা পৃথিবী। যেখানে সব না পাওয়াগুলো হেসে খেলে পাওয়া যায়, যেখানে ক্র্যাচ হাতের কোনও এক দুঃসাহসী পাহাড়ে চড়ে বা টাক মাথা কোনও এক বিজ্ঞানী আবিষ্কার করে ফেলে রূপকথার অমোঘ রাজ্য। 

এরপরও কি বলবেন, যারা ওই সময়টায় জন্মায়নি, যারা সেই সময়ের কলমের স্বাদ অনেক অনেক পরে পেয়েছে, তাদের হিংসেটা খুব বাড়াবাড়ি? 

তবে জয়ন্ত বাবুর সব থেকে বেশি টানটা ছিল একদম অন্য জায়গায়। মাংসের সেরা পিসটার মতো, সব কিছু গোগ্রাসে গিললেও সেটিকে কিন্তু উনি পাতের পাশে বাঁচিয়ে রাখতেন। 

সে এক অদ্ভুত কলম বুঝলেন কিনা! মাথার মধ্যেকার সমস্ত লজিক্যাল ঘ্যাম ছুড়ে ফেলে পড়তে বসতে হয়। যদি সেটা না পারলেন, ইউ লস। এই রাজ্যের এন্ট্রি টিকিট আপনার জন্য নয়। সেই রাজ্যে যেমন থাকে এলেবেলে কিছু লোক, বা ধরুন পাগল ভিনগ্রহী - যারা কিনা মানুষকে ভেড়া বানাতে চায় ধরে ধরে! আবার সে দেশের ভূতেরাও বেজায় ভালো। শুধু মানুষের ভালো করার মওকা খোঁজে, চান্স পেলেই কুঁড়ের হদ্দকে চাঁটি মেরে মেরে করে তোলে দৌড়বীর! সব মিলিয়ে সে কিম্ভূত কিমাকার এক ব্যাপার! 

পড়তে শুরু করলে দেখবেন, নতুন নতুন ক্যারেক্টার আসছে তো আসছেই। একটা চ্যাপ্টারের সাথে আরেকটার কোন মিল নেই। মনে হবে লেখক বুঝি আলাদা আলাদা গল্প মিশিয়ে দিয়েছেন উপন্যাসের নাম করে। তাই বলে ছেড়ে দিতে কিন্তু পারবেন না। আরে বাবা প্রশ্নের উত্তর তো খোঁজা চাই নাকি? গল্প বলতে বলতেই কোথাও টুক করে বসিয়ে দিচ্ছেন রহস্য, কিম্বা ছাড়ছেন দেদার হাসির ফোয়ারা, তখন একটু পড়া থামিয়ে, পেট চেপে দুম দাম হাত-পা ছোঁড়া ছাড়া উপায় থাকে না তেমন! যদি একটু দীক্ষিত টাইপ পাঠক হন, পড়তে পড়তেই বুঝবেন কথা বলাটাও ঠিক কতটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়! নাও যদি বোঝেন, শেষের দিকে এটা তো বুঝবেনই ছড়িয়ে থাকা পুঁতির মতো আলাদা আলাদা গল্পগুলো, চরিত্রগুলো কেমন সুন্দর গেঁথে যাচ্ছে লাল, নীল সুতোয়! সব শেষে সেই মালাটা কিন্তু লেখকের গলাতেই পড়ে। তখন পাঠকের একটা হতদম্য হাততালি ছাড়া আর কিই বা থাকে দেওয়ার মতো? 

দিব্যেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় সেই ম্যাজিশিয়ানের নাম। যাকে আদর করে সবাই বলি কথাশিল্পী। 

ভিড়ের মধ্যে জয়ন্তবাবুর ঘেমে ওঠা বুকপকেটের কাছে বাহারি কার্ডটায় সময় লেখা আছে চারটে তিরিশ। তার উপরের নীল কালি তে ছাপা গুণগানসমূহও একটু চেষ্টা করলেই বেশ বলে দেওয়া যায়। কালজয়ী কথা শিল্পী.....ছোটো-বড়ো-মেজো সমগ্র সাহিত্যে তার অশেষ, বিশেষ, নির্বিশেষ অবদানের জন্য..... নিজের সমগ্র জীবন নিইয়োজিত করার জন্য আমরা ধন্য, আমরা ধন্য নববর্ষের শুভ সন্ধ্যায় তার হাতে সমগ্র জীবনের..... " 

এনাফ! 

পাতি কথায় মশাই লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড! অত কি লেখা আছে জেনে হবেটা কি? আমি কি কার্ডখানা দেখতে গেছি নাকি! আন্দাজেই বললাম। বেশির ভাগ প্রশংসাপত্র বা শংসাপত্রেই মোটামুটি ঘুরেফিরে ওই এক ফর্মাটই থাকে। মাখন মাখন একটা ব্যাপার আর কি। প্রশংসাপত্রে কি আর কেউ সমালোচনা লেখে! ভুলেও 'একটু অন্য কিছু করে দেখি' মার্কা কথা ভাববেন না। দু ফুট এক্সট্রা লম্বা করে দিয়ে যাবে সব! 

যাকগে, যেটা বলছিলাম - আজ কিন্তু জয়ন্তবাবুকে বার বার আসতে বারণ করেছিলেন সুজাতা। মুখে বলতে না পারলেও সুজাতা জানেন, বোঝেন মানুষটা ভিতর ভিতর কতটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত। সম্পাদকের দোরে দোরে ঘুরে ঘুরে, যে কোনও অনুষ্ঠানে এককোণে অনাহুতর মতো বসে থেকে, আর কটা দিনই বা কলম ধরার মতো ইচ্ছে বাকি থেকে যায় একা মানুষের? 

এমনিতেই এখন বাংলাতে যাঁরা লেখালেখি করেন তাঁরা মেরি শেলির থেকেও অনেক অনেক কঠিন পরিস্থিতিতে লেখালেখি করেন..... 

আচ্ছা নিন, আগে হেসেই নিন তারপর বলছি। হয়েছে? 

বেশ শুনুন, মেরি শেলি একটা আপাত নিরীহ অজগরকে গলায় জড়িয়ে লিখতে বসেন। থুড়ি বসতেন। আর যে কোনও বাঙালি লেখক, অফিস, সংসার, ঘর-বাড়ি, ইলেকট্রিক বিল, ছেলের স্কুল, মেয়ের কলেজের সমস্যা ইত্যাদি হাজারটা জিনিস (পড়ুন কিং কোবরা) গলায় পেঁচিয়ে নিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে দুপাশে ঝুলিয়ে লেখার টেবিলে বসেন। 

একটা মাত্র সাপের মুড বদলে একটু গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফুসুর করল কি আমি উঠে গিয়ে সেখানাকে ঝুড়িতে শুইয়ে দিয়ে আমিও একঘুম মেরে দিলাম, এমনটা নয় কিন্তু। লিখতে লিখতে কেউই জানেন না কখন তাল কেটে গিয়ে হঠাৎ অফিসের ফোন আসবে। কিম্বা ছেলের ডাইপার বদলানোটা বেশি জরুরি হয়ে পড়বে 'ছাইপাশ' লেখার থেকে। 

অবশ্য এতে কারোরই কোনও অভিযোগ নেই। আপনি শত কাজ সামলেও যখন 'শখে' একটা কিছু করেন। যেটাতে শুধুই ইনপুট লাগে, আউটপুট ওই না বরাবর। তখন আপনার কিই বা বলার থাকে? কণ্টকশয্যার শহীদোচিত আরামটুকু মেনে নেওয়া ছাড়া? 

জয়ন্তবাবু কিন্তু তবু এসেছেন। ছোটোবেলার সেই ম্যাজিশিয়ানের সব থেকে সেরা দিনটাতে। নাই বা এলো স্পটলাইট, হলোই বা কোনার দিকে চাকলা ওঠা কোনও এক কমজোরি চেয়ার। তবু দেখা তো হবে! থাকা তো হবে ইতিহাসের সাথে সাথে। 

অথচ এইসব কিছুই হত না জানেন! এই নিভু নিভু করে টিকে থাকা, সূচিপত্রের ভাঁজ আটকে পড়ে থাকা! এসব হত না। যদি না ওনার ছোটোবেলাটা অমন পাঞ্জাবী ধাবার রুমালি রুটির মতো সোনা দিয়ে বাঁধানো হত। যদি না বাংলার সম্পাদকরা ধুলো ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারতেন! আর যদি না দশবছর আগের সেই 'অস্বস্তি'টুকুকে উনি এতটা পাত্তা দিতেন। বয়ে না বেড়াতেন এতটা রাস্তা। 

কিই বা হয়েছিল এমন? একটু তো জাস্ট আনইজি ফিলিং। খেতে, বসতে, শুতে, ক্লাস নিতে নিতে একটা আনমনা ভাব। উনি তো বোঝেনওনি প্রথমটা। ধরব ধরব করে ধরতেও তো পারছিলেন না ঠিকঠাক। কি হত যদি সেটা অধরাই থেকে যেত। যদি একদিন হঠাৎ করে জেলপেনদুটো বমি করে নাই বা ভরাত দিস্তে কাগজের রুলটানা পাতা! 

খুব ভাসা ভাসা একটা ধারণা হয় বুঝলেন। মনে হয়, সমস্ত সফল লেখারই ক্ষমতা থাকে আরেকটা সৃষ্টির জন্ম দেওয়ার। যেমন ভাবে চড়ুইয়ের অসাবধানতায় মাটি পেয়ে যায় বটের সদ্যোজাত চারা। ঠিক তেমনি সফল লেখক মাত্রেই নিজের অজান্তেই ছড়িয়ে দেন নতুন মশালের বীজমন্ত্র। 

কবে, কোথায়, কখন সেই বীজ মাথা তুলবে কেউ জানে না। পৃথিবী শুধু অপেক্ষা করে থাকে একটা বিস্ফোরণের জন্য। যে বিস্ফোরণে চারা গাছ হয়ে ওঠে মহীরুহ। মৃত গাছের জায়গা নেয় নতুন যুগ। 

ইয়েস আ ব্যাং। বিস্ফোরণ! 

প্রথম দানেই একটা আস্ত উপন্যাস নেমে গেলে, তাকে কিই বা বলা যায় 'বিস্ফোরণ' ছাড়া? সমাজ আমাদের একটা মাত্র উদাহরণই তো দিয়েছে তুলনা করার মতো। 

আসলে এই টানটান ওরকম। দিনের প্রথম জোয়ারের মতো সেই স্রোতে ভেসে যাওয়ায় একমাত্র উপায়। 

কথায় আছে একটা ভালো বই একটা মানুষকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে পারে। এ নিয়ে প্রচুর গল্প, সিনেমা, কার্টুন, মিমস তৈরি হয়েছে, অনেকেই অনেক আঁতলামি করেছেন। কিন্তু কখনও ভেবেছেন সেই বইটা লিখতে গিয়ে লেখক নিজে কতটা পালটে যান? তার চেনা জীবন, দর্শন, চিন্তা-ভাবনায় কতটা দোল লাগে? 

লিখতে লিখতে নিজেই বেশ অবাক হচ্ছিলেন জয়ন্তবাবু। কোনও প্রি-প্ল্যানড প্লট নেই, ফ্রেমিং নেই, কোনও ফুটনোট, ভাষার বুনোটটুকু আগে থেকে সাজিয়ে নেওয়া নেই। তবু কোথা থেকে যেন একটার পর একটা অনুচ্ছেদ লেখা হয়ে যাচ্ছে। পরপর চরিত্ররা এসে পড়লেও তাল কাটছে না একটুও! ঠিক ঠিক জায়গায়, ঠিক ঠিক কমা দাঁড়ির পর এসে পড়ছে হিউমারের মৃদু-মন্দ ছন্দ। শুধু যেটা থাকছে না সেটা হলো লজিক। দিব্যেন্দু ঘরানায় লজিস্টিক চর্চা মারাত্মক পাপের জিনিস। 

বুঝলেন? রেসিপিটা সেই ছোটোবেলার ডালমাখানির পরে খাব বলে তুলে রাখা রেশমি কাবাবের মতো হলেও, হুবহু এক নয় কিন্তু। এর ঝলসে নেওয়া রূপের ওপর যত্ন করে মিশিয়ে দেওয়া মোলায়েম ঝোল, ওপরে গাজর স্যালাডের টপিং সবটায় আলাদা। তবু কিন্তু দাঁতের ফাঁকে আটকে যাওয়া নেই। আর কে না জানে পর্দানশিন রেশমি কাবাবেরই মানায় রুমালি রুটির আড়াল নিয়ে জিভের সাথে মিশে গিয়ে ঝড় তোলার। মুখের মধ্যে গিয়ে যদি আঙুল চাটতে থুড়ি শেষ লাইনটা পড়তে বাধ্য নাই করল, তবে আর কাবাব রান্না কেন? দিব্যেন্দু ঘরানায় কলম ঠোকা কেন? 

লেখা হলো, পাঠানো হলো, আর কি আশ্চর্য, দু মাসের মাথায় সম্পাদক দফতরের ফোনও চলে এলো! লেখা মনোনীত। ধারাবাহিক ভাবে বেরোবে তারও দু মাস পর থেকে। আপনার জেনারেল নলেজের জন্য বলে রাখি, পাবলিশার্স হাউসে লেখা পাঠালে ছ-মাসের আগে কখনই পাত্তা মেলে না। সেখানে মাত্র দু মাস! তবে আসল চমক সেটা নয়। লেখাটা মনোনীত হলো কোথায়? না তো জমাটিমেলায়। যার শারদীয়ায় ৩০ বছর ধরে দিব্যেন্দু এখনো দেখিয়ে চলেছেন তার অদ্ভুতুড়ে ম্যাজিক। 

কিন্তু পি.সি সরকারের ইন্দ্রজাল সন্ধ্যাও দুবার দেখার পর আবার দেখতে গেলে কেমন একটা বিরক্ত লাগে, মনে হয় সেই তো পেট কাটবেন, হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে হুট করে টেনে নিয়ে ধুলো ঝাড়বেন চাদরের। আর শেষের পর টাটা টাটা করতে করতে পর্দা ফেলে দেওয়ার পরেই সেই একই ম্যাড়ম্যাড়ে ক্লাইম্যাক্সের মতো হুট করে আবার পর্দা তুলে গান ধরবেন! 

হ্যাঁ বাঙালী ধুলোর গন্ধ ভালোবাসে এটা ঠিক। কিন্তু এক ঘেয়েমিটুকু কাঁহাতক আর নস্টালজিয়া দিয়ে ঢাকা যায়। পনির পাসিন্দার স্বাদও পূরণ হয় একটা সময়ের পর। 

অতএব, শচীন রমেশ তেন্ডুলকরের আভিজাত্যময় শূন্য রানের পর, বিরাটের অমনোযোগী সেঞ্চুরি পেয়ে গেলে যা হয় আর কি! সারা পড়ে গেল মশাই! 

এমনিতে এটা যখনকার কথা তখন পাঠক লেখকের রেশিওটা এমন বিপদজনক পর্যায়ে ছিল না। লোকে আর যাই হোক পড়ত। রিভিউয়ার বিরিয়ানি না খাওয়ালেও রিভিউ লিখত বেশ। 

একজন তো সটান বলেই ফেললেন, 'এতদিনে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের যোগ্য উত্তরসূরী পাওয়া গেছে।' 

আচ্ছা কি মনে হয়? এই টাইপের সত্যি গল্পে কি হয়ে থাকে? হ্যাপি এন্ডিং? এরপর থেকে তিনি লেখার পর লেখা, লেখার পর লেখা লিখে চললেন আর বইপাড়া জুড়ে সুখে শান্তিতে ঘর করতে লাগলেন! 

হ্যাঁ গল্পটা নিজের হাতে থাকলে তাইই করতাম বটে। কিন্তু ফিকশন আর নন ফিকে কবেই বা মিলমিশ খেয়েছে? আমরা যা ভাবি, যা প্ল্যানিং করি তা যদি সব হয়েই যাবে, তাহলে তো মশাই নন-ফিকশনের ট্যান্ডেলিপনা কবেই চুকে যেত। 

যাকগে ফিলজফি থাক বরং। 

হ্যাঁ এর পর পরই উনি আরেক খানা উপন্যাস লিখে ফেললেন। সে খানাও যথারীতি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হলো এবং সারা পড়ল। আর এর পরই ঘটল যাকে বলে সেই ট্র্যাজেডি। 

হয়েছে কি, এমনিতে তো বাংলা সাহিত্য আর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের মধ্যে আশমান জমিনের ব্যাপার। এখানেও যদি ওখানকার মতো প্লেয়ার খেলতে পারছে না, বয়স হয়েছে, স্ট্রোক মিস করছে, ঠিকঠাক স্পিন দিতে পারছে না। ব্যাস সসম্মানে বসিয়ে দাও বা আগে ফিটনেস আনো তারপর আবার এসো না হয়, এরকমটা হত। তাহলে আজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসটা হয়তো..... না হয়তো কেন! ডেফিনেটলি অন্যভাবে লেখা হত। এখানে একটা ঘোড়া তার পিক পয়েন্টে রেসের পর রেস জিতে গেল মানেই তাকে শেষ অব্দি জিইয়ে রাখো। আফটার অল বুড়ো ঘোড়ার লাখ না হোক হাজার দশেক তো হবেই। তাই পা কেঁপে গেলেও, মুখে রক্ত উঠে এলেও পিঠে চেপে চুপটি করে বসে থাকো। তখন তরুণ তুর্কিদের সাধ্য কি সেই বুড়ো ঘোড়া এড়িয়ে ঘাস খাওয়ার? 

সেবার জমাটিমেলা শারদীয়ায় ডাক এলো লেখার জন্য। পরপর দুটো হিটের পর এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু, আমন্ত্রণ জিনিসটার মোহই আলাদা এই জগতে। মাথায় উঠল সংসার, স্কুল, খাতাদেখা। প্রথমবারের জন্য লিখতে বসলেন গলার সব পাইথনগুলো কে খুলে রেখে। আচ্ছা এটা কি আগে বলেছি, যে জয়ন্তবাবু মারাত্মক রকমের কালীভক্ত? নিজে গেরুয়া-রুদ্রাক্ষ চড়িয়ে পুজো অবদি করেন! তো সেই কালী নাম করেই রাতের পর রাত কাটল, ক্লাসের পর ক্লাস গেল ঘুমে ঢুলে ঢুলে। 

তারপর ওয়ান ফাইন মর্নিং। জয়ন্তবাবু দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। সুজাতার সামনে হাসি হাসি মুখটা একটু নিচু করে জিজ্ঞেস করলেন, 'কি খাবে শুধু বলো?' 

পাশের খোলা জানলা দিয়ে দিনের প্রথম রোদটুকু এসে পড়ছিল সেই হাসি হাসি চোয়ালে, জানলার পাশের কোকিলটা কেঁদে চলেছিল একটানা, আর সুজাতা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, মানুষটা তবে এত হাসতেও পারে! 

সম্পাদক মহাশয়ের চোখ তো কপালেই উঠে গেল প্রায়, 'করেছ কি জয়? এর মধ্যেই নামিয়ে ফেললে!' 

উত্তরে সেই একই হাসি দিয়েছিলেন জয়ন্তবাবু, এই উত্তর না চাওয়া প্রশ্নে আর কিই বা দেওয়ার থাকে! 

আর এর পরেরটুকু তো ইতিহাস........ হতে পারত। হয়নি। দু পোয়া ঘাস পেয়েছ বলে কি আর মুঠো মুঠো পাওয়া যায়? 

প্রফুল্ল স্ট্রিট থেকে কুরিয়ার এলো সাথে চিঠি, যাকে চিরকুট করলে দাঁড়ায়- শারদীয়ায় দিব্যেন্দু বাবুও অদ্ভুতুড়ে সিরিজে লিখছেন, একই থিমের, একই জোনের দুটো লেখা কি রাখা যায়? সমরেশ বাবুরও তো প্রথম উপন্যাস শারদীয়াতে বের হয়নি, শরৎচন্দ্রের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির জন্য। আপনারটাও না হয়........... 

"যখন মনের ভেতর সূর্যটা হঠাৎ ডুবে যায়, 

যখন আশা ভরসা সব রাস্তা হারায়...." 

পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে দিলেন জয়ন্তবাবু, 'হ্যাঁ হ্যালো। কে সুধাংশু? বল।' 

'........' 

'হ্যাঁ ওইদিকেই যাচ্ছি। তুই যাবি না?' 

'........' 

'ও আচ্ছা আচ্ছা। তোকে একবার দেখলাম বটে প্যারামাউন্টের কাছে। তারপর কোথায় গায়েব হয়ে গেলি!' 

'........’ 

'আমার পিছন পিছন! হা হা হা হা। তা ফলো করে কিছু পেলি নাকি? সিক্রেট-ফিক্রেট?' 

'........' 

'বেশ বেশ। সারপ্রাইজের জন্য তাহলে অপেক্ষায় না হয় করলুম।' 

'.........' 

'আচ্ছা রাখলাম রে। পারলে চলে আয়।' 

ফোনটা কেটে আবার পকেটে পুরে ফেললেন জয়ন্তবাবু। এই একটা ছেলে আছে! পাগল বললে খুব কম বলা হয়। এ হচ্ছে গিয়ে সাহিত্য উন্মাদ! 

প্রথম কোথায় দেখেছিলেন? বোধহয় অক্সফোর্ডের একটা অনুষ্ঠানে। উসকোখুসকো চুল, ঢিলে ঢালা জামা-প্যান্ট, ঠোঁটের ওপর নীলচে গোঁফ, পাওয়ারের চশমা আর চশমার পেছনে ইয়া বড়ো বড়ো দুটো চোখ। একটা কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। নিঃশব্দ বিপ্লবেরা বোধহয় চুপচাপই থাকে! তারা হঠাৎ এসে পিছনে দাঁড়ায়। আর প্রায় ফাটা বাঁশের মতো গলায় বলে, 'আচ্ছা আপনি বেকার বেকার রহস্য, সাইফাই এসব নিয়ে পড়ে আছেন কেন? আপনার জোন তো আলাদা। একেবারেই আলাদা!' 

শুরুতেই যে এরকম সুগার ফ্রি পাওয়ার কাট ছাড়ে। তার সাথে আলাপ না জমে উপায় কি? ব্যস হয়ে গেল। 

একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, অসমবয়সী বন্ধুত্বগুলোই কিন্তু বেশি গাঢ় হয়। ব্যাপারটার মধ্যে আসলে একটা চোরা কৌতূহল কাজ করে। দুটো মন, দুটো বয়স, দু রকম অভিজ্ঞতা। একটা নস্টালজিয়ার আরেকটা চিরদিনের বড়ো হতে চাওয়া ছোটো বয়সের। 

তো একদিন এই সুধাংশুকে বলেই ফেললেন সব। কেন উনি অদ্ভুতুড়ে লেখা ছেড়ে গোয়েন্দা, রহস্য, ভূতে চেষ্টা করে চলেছেন? সাফল্য না পাওয়া সত্ত্বেও। কেনই বা তার জন্য কোণার সিট! 

যখন দেখলেন ছেলেটা পুরোনো জমাটিমেলা ঘেঁটেঘুঁটে উপন্যাসদুটো পড়েছে, আর এসে প্রায় হাঁপানোর মতো করে জিজ্ঞেস করেছে, 'আর কি হলো জয়দা?' 

তখন কফির কাপে একটা শান্ত চুমুক দিয়ে সবকিছু বলে যাওয়া ছাড়া আর কিই বা করার থাকে এক অভিমানী লেখকের? আসলে এইসব বলে যাওয়া এক ধরনের কান্নাই। খুব ভালো করে যদি চেঁছে নেওয়া যায় ফাঁকে ফাঁকে লুকোনো দীর্ঘশ্বাসের দমক, কাপ চলকে পড়া কফিটুকু কিম্বা দাঁতে লেগে যাওয়া নখের ময়লাগুলো, যদি বেছে বেছে এই আপাত তুচ্ছগুলোই সাজানো যায়, একের পর এক, তবেই মেলে সেই নোনা জলের টলমলে ঢেউ। আর কে না জানে, এই সব ঢেউয়ের প্রোডাক্টিভিটি বলে কিছু নেই। কিছু হয় না। ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও সৃষ্টি তার আসে না। 

মোড়টা পেরোতে পেরোতে জয়ন্তবাবুর কেমন যেন একটা আফশোস হলো। সেদিন যদি এভাবেই দিব্যেন্দুবাবুকেও কথাগুলো বলতে পারতেন। হ্যাঁ সুযোগ তো এসেছিল। জীবন তো সুযোগ দিয়েই থাকে। সেটাও ছিল এরকমই এক সাহিত্য সন্ধ্যা। সম্ভবত কোনও শারদীয়া প্রকাশ বা ওরকমই কিছু। 

হঠাৎ দিব্যেন্দুবাবুর মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলেন জয়ন্তবাবু। সৌজন্য হাসি, নমস্কারের প্রত্যুত্তরে ভেসে উঠেছিল কোমল অথচ ঋজু এক কণ্ঠস্বর, 'তুমি জয়ন্ত না? জয়ন্ত চৌধুরী? ' 

বিস্ময়ের সাথেই ঘাড় হেলিয়ে ছিলেন জয়ন্ত বাবু। 

'সেদিন তোমার দুটো উপন্যাস পড়লাম। খাসা লিখেছ। আর লেখো না কেন বলো তো?' 

জীবনে এতটা অপ্রস্তুত, এতটা অসহায় কোনওদিনই হননি জয়ন্তবাবু। অবশ্য তক্ষুনি ক্যামেরা-মাইক্রোফোনের একটা দল ঢুকে পড়েছিল তাঁদের মাঝে। উনি আসতে আসতে সরে এসেছিলেন কোণার দিকে। আপাত অন্ধকারে। 

দেখা তারপরেও হয়েছে। অনেকবার। মাথা ঝুঁকিয়ে কুশল বিনিময় হয়েছে, ভালোমন্দের খোঁজ খবরও হয়েছে কিছু কিছু, কিন্তু ওই প্রসঙ্গ আর ওঠেনি। সুযোগ কবারই বা আসে জীবনে? খুব কম। একবার কি দুবার। 

অবশ্য কীই বা ছিল বলার মতো? কি বলতেন? বলতেন যে আপনি এখনও অদ্ভুতুড়ে সিরিজ লিখছেন বলেই আমার আর লেখা হবে না? সিনিয়র সিটিজেনের সিটের সামনে হাতল ধরে ঝুলে থাকায় এ শহরের রীতি! অলিখিত নিয়ম। বলা যায় এসব? হয়তো যায়। উনি পারবেন না। 

মহাজাতি সদনে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। দেওয়ালে দেওয়ালে সদ্য আঁকা গ্রাফিতি লোকজনের শব্দ পেয়ে জেগে ওঠা পায়রা আর শত পরিচ্ছন্নতার মধ্যে বেরিয়ে পড়া সোঁদা গন্ধটা বলে দেয়, এ বাড়ির গাছ-পাথর নেই। এর দেওয়াল, প্রত্যেকটা ইট, গাঁথনি যেন ইতিহাসের জন্যই তৈরি। এরা ইতিহাস তৈরি করে প্রতিমূহুর্তে। যেন কোনও সাধারণ ঘটনাকেও এপিক না করা অব্দি এ বাড়ি থামে না। এ বাড়ির পোষায় না। 

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। গোটা হলটাকে অন্ধকার করে দিয়ে আলো জ্বলে উঠেছে স্টেজ জুড়ে। আজ তো সেখানেই আলো থাকার কথা। মঞ্চই তো আলো পায়। বরাবরের মতো। 

জয়ন্তবাবু সিটের সারি পেরিয়ে, সামনের দিকে ব্যাগটাকে কোলে নিয়ে বসলেন। তার আশেপাশে অনেক অনেক চেনা মুখ। লেখাকে যদি সন্তান হিসেবে ধরা যায় তাহলে এঁরা সেই সব কৃতী সন্তানের বাবা-মা। আজ সবাই এসেছে। জোনাকির মতো জ্বলে উঠেছে সেইসব মুখের সারি। 

তবে তা নেহাতই জোনাকি। আসল চাঁদ ওই তো স্টেজের ওপর, পায়ের ওপর পা তুলে আছেন। মুখটা একটু ঝুঁকে পড়েছে বয়সের ভারে। অথচ তাও কি আভিজাত্যময় সঞ্চার! 

ওই তো কথক মাইক্রোফোনে 'দিব্যেন্দু' নামটা ঘোষণা করতেই সারা ঘর ভেঙে পড়ল হাততালিতে। দৃপ্ত অথচ মৃদু পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন কথাশিল্পী। করতালির ওমটুকু যেন পুইয়ে নিলেন খানিক। তারপর গোটা হল নীরব করে দিয়ে ছড়িয়ে দিলেন শব্দজাল, 

'অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আপনাদের সকলকে যারা এই সন্ধ্যায় এসেছেন বা আসতে পারেননি। সেই সকলকে যারা আমার কলমকে নিজগুণে করে তুলেছেন সার্থক এবং এত বছর ধরে আমার সাথেই ভাগ করে নিয়েছেন আমার মননের সমস্ত সুখ, সমস্ত দুঃখ, বিরহ, কি একটা আস্ত বৈঠকখানাই! লেখকের একমাত্র আশ্রয় তো পাঠক, পাঠকের মন। তাই না? পাঠক না থাকলে লেখকের কোথায় বা যাওয়ার থাকে, মহুয়াটোলা ছাড়া? 

একটা হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল হল জুড়ে। উনি নিজেও হেসে ফেললেন, হাসতে হাসতেই বললেন, 'অন্যদের কথা জানি না। কিন্তু আমি লেখক হয়েছি কারণ আমি অন্য কিছু আর পারতাম না। বলতে পারেন এটায় ছিল আমার শেষ আশ্রয়। ঘর-বাড়ি। 

'আর এই ঘরের আশ্রিত হিসেবে যে কারোর কাছেই আজকের মূল্য অনেক। ভাবা যায়! তুমি ৬০ বছর ধরে বাড়িতে উড়ে এসে জুড়ে বসে আছ বলে তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে!' 

স্বাভাবিক ভাবেই একটা হাসির রোল উঠল। 

'তা এই বাড়ির বাসিন্দা হিসেবে আমি গর্বিত। কত মানুষ! সুনীলদা, শক্তিদা, সমরেশ, বিমলদা আর কত বলব! এদের সান্নিধ্য, এও বা কম কি?' 

বলে একটু থামলেন দিব্যেন্দু। নিজের সাথেই যেন বোঝাপড়া করে নিলেন খানিক,'তারপর মাইক্রোফোনটা আরেকটু নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, 'তবে কি জানেন, মেয়াদ ফুরোয়। আর সবকিছুর মতো কলমও বৃদ্ধ হয়। কলমের পিছনের মুড়োটা বুড়িয়ে যায়। একটা সময় তো আসেই যখন নদীর আর সমুদ্রে মেশার তাড়া থাকে না, যখন দেওয়ালের রজনীগন্ধা ঝোলা ছবি হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।' 

হলের ভেতর এখন পিন পড়লেও কানে তালা লাগতে বাধ্য। 

'যদি ভেবে দেখেন, তাহলে সাহিত্যও তো পথ চলা বই আর কিছু না। কৃষ্ণকীর্তন থেকে ধরুন কি ব্যাসদেব! পথই তো একটা। আমরা তার পথিক মাত্র। চলতে চলতেই বৃদ্ধ হই। তখন নতুনদের হাতে মশাল তুলে দেওয়াই তো রীতি। তাই না? নইলে মশাল টিকবে কেন? পথ চলায় যে বন্ধ হয়ে যাবে।' 

পাশে রাখা গেলাস থেকে এক ঢোক জল খেয়ে ঠোঁটটুকু মুছে নিলেন। তারপর আবার খেই ধরলেন ছেড়ে রাখা কথার, সমগ্র হলের। 

'আচ্ছা একটু অহংকার নিয়েই জিজ্ঞেস করছি। আমার নাম বললে সবার আগে কি মনে পড়ে? বড়ো বড়ো তিনশো, ছশো পাতার গম্ভীর গম্ভীর বইগুলো? না তো! আপনার মনে পড়ে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের কথা, তার অদ্ভুত অদ্ভুত ইলাস্ট্রেশনগুলোর কথা। আমারও তাই। মনের আরাম, আত্মার শান্তি যাই বলেন না কেন! আমার সবই ওগুলোতেই। এগুলোর জন্যই গলা উঁচিয়ে বলতে পারি আমার লেখক জীবন সার্থক! 

'কিন্তু ওই যে বললাম সব কিছুতেই পাক ধরে। এতেও যে ধরেছে তা তো জানেনই। কেউ মুখের ওপর না বললেও নিজে বেশ বুঝছিলাম। তাই এবার উঠে পড়ে লাগতেই হলো। কোনওদিন যেটা হয় না, সেটাই করে ফেললাম এবার, মার্চেই পাঠিয়ে দিলাম শারদীয়ার লেখা! 

'আর তার পরদিনই কিনা সম্পাদক ছোকরা বাড়ি এসে হাজির। ব্যাটা এসে বেশ করে লুচি ছোলার ডাল সাঁটিয়ে বলে কিনা, "এবার তো ফাটিয়ে দিয়েছেন মশাই!" 

আমি বললুম, "মানে?" 

"মানে ওই, ইয়ে আর কি! ক বছর ধরে আপনার লেখাগুলো ঠিক জমছিল না। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই বলতেও পারছিলাম না কিছু। কিন্তু এবার! উফস! মশাই জমে ক্ষীরেরও পরের স্টেজে চলে গেছে!" 

উত্তরে শুকনো মুখ বানিয়ে বললুম, "কিন্তু লেখাটা তো আমার নয়। ও তো আমি চুরি করেছি। চুরি করা লেখা।" 

পুরো হল জুড়ে গুঞ্জন উঠল এবার। কথা শুনে তো সবাই হাঁ! সেদিকে তাকিয়ে যেন বেশ মজা পেয়েই আবার বললেন উনি, 'হ্যাঁ আপনাদের মতো, ও ব্যাটারও মুখ হাঁ হয়ে গেছিল। তাহলে এবার গল্পের পিছনের গল্পটা বলিই বরং। 

'সে মাস চার আগের কথা বুঝলেন। একদিন হঠাৎ বাড়ির কলিংবেল বাজিয়ে, চশমা পড়া একটি ছেলে এসে, বেশ শিরদাঁড়া-টিরদাঁড়া সোজা করে বলল, "এবার আপনি বরং নতুনদের জায়গা করে দিন স্যার। অনেক তো হলো, তাই না?' 

আমি সাধারণত অনাহুতদের সাথে দেখা করি না তেমন। কিন্তু এ হেন বাক্যবাণে কাত না হয়ে উপায় কি! ধরে বসানো গেল। চা খেতে খেতে শোনা গেল জিভ বৃত্তান্ত। 

'ছোটো করেই বলি। একজন তরুণ লেখক অদ্ভুতুড়ে সিরিজে লেখা শুরু করেন। আমাকে, আমার লেখাকে ভালোবেসে। তার লেখা প্রশংসাও পায় বিস্তর। কিন্তু, একটা সময়ের পর তাকে সরে আসতে হয়, শুধুমাত্র আমি এখনও ওই একই পত্রিকায় অদ্ভুতুড়ে সিরিজ লিখে চলেছি বলে। 

'সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম জানেন। পর্দার পেছনে এত কিছু হয়ে যায়, অথচ টেরটিও পাই না! ছেলেটি, যার কিনা নাম বলা বারণ, সেইই লেখকের দুটো লেখা পড়ার জন্য দিয়ে গেলে, আমি সেদিনি রাত জেগে পড়ে ফেলি।' 

উনি একটু থামলেন, তারপর হাতদুটো দু পাশে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, 'বিশ্বাস করুন আমি মুগ্ধ! আমার দেখানো পথে এমন অসাধারণ চলন, এমন গতি! আর তার কিনা লেখা হচ্ছে না, শুধু আমি লেখার মোহ, নামের মোহ ছাড়তে পারছি না বলে! তার সেরা পাণ্ডুলিপিটা নাকি পড়ে আছে এখনও! 

'পরদিনই আবার ছেলেটাকে ডেকে পাঠালাম। কাজটা সরাসরিই করা যেত। কিন্তু আমি আবার নাটকপ্রিয় মানুষ। নাটকীয়তা ছাড়া আমার আর কীই বা আসে? হ্যাঁ ছেলেটাকে দিয়ে ওই অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিখানা চুরি করিয়ে আনলাম। আর তারপরেরটুকু তো আগেই বলেছি। 

'আজ আমার জীবনের একটা সেরা সন্ধ্যা, সন্দেহ নেই এবং এটাও নিশ্চয় মানবেন মশাল বদলের এর চেয়ে শুভ দিন আর আসবে না। এই স্বল্পায়ুতে তার আর আশাও করি না। এবার তাহলে তাকে ডেকেই নেওয়া যাক, এর পরের শারদীয়া থেকে যার অদ্ভুতুড়ে সিরিজ আপনারা পড়তে চলেছেন।' 

তারপর থামলেন। এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে মশালের যতটুকু সময় লাগে, ঠিক ততটুকু। তারপর নিজের গলাকে শেষ সীমায় পাঠিয়ে করলেন সেই অমোঘ ঘোষণা, 'জয়ন্ত। জয়ন্ত চৌধুরী। ' 



কথায় বলে বিস্মইয়ের সীমা পেরিয়ে গেলে মানুষ নাকি অবাক হতে ভুলে যায়। তারও কি তবে তাই হলো! কই না তো! এই তো পাঞ্জাবির ভেতরেও লোমগুলো বেশ খাড়া হয়ে উঠছে। চশমাটা একটু একটু করে নেমে আসছে নাক বেয়ে। তারপর সেটা টুপ করে মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিলো কেউ একটা। তাঁকে ঠেলে দাঁড় করিয়ে দিলো আরও কেউ। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। মানে ইতিহাস যেভাবে এগোয় আর কি! 

স্টেজের উষ্ণতা বরণ করে নিলো নতুন মানুষ। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হলো মহাজাতি সদনের পৃথিবী। কোথাও দুটো পায়রা উড়ে গেল ডানা ঝাপটে। কালো মাথার সমুদ্রের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই উনি শুষে নিতে থাকেন হাততালির স্নিগ্ধ ওম! 

আর আমি! নিজেকে ওই বাদবাকি এক পার্সেন্ট পাঠক মনে করা সুধাংশু মিত্র। কি শর্টে শুদো। সকাল থেকে একটা গল্পকে ধাওয়া করে যে এখন একদম পিছনের সিটে বসে এসির হাওয়া খেতে খেতে, নেপথ্যের থেকে দেখছি স্পটলাইটের এগিয়ে যাওয়া। দেখছি, ক্লাইম্যাক্সের মতো স্পটলাইটও হাফ হাতা পাঞ্জাবী আর তেলকুচে চুলকেও কীভাবে করে তোলে নায়কের মতো নায়ক, মশালের মতো মশাল, কিম্বা গল্পের মতো গল্প!

0 comments: