ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিকধারাবাহিক
এক কিশোরীর রোজনামচা - ৩১
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 29
10 November, 1942, Tuesday
প্রিয় কিটী,
একটা ভাল খবর দিই। আমাদের সাথে থাকার জন্যে অষ্টমজন আমাদের গুপ্তগৃহে আসছেন। আমরা ত' সবসময় ভাবতাম, আমাদের স্টোরে যে পরিমাণ খাবার আছে, এবং প্রতি সপ্তাহে যে পরিমাণ জমা হচ্ছে, তাতে আরও একজন ভালমতোই খেতে পারবে। তা'ছাড়া আমাদের ঘরে যে জায়গা আছে, তাতে আরও একজন আমাদের মধ্যে এলেও আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। তবে একটা বিষয়ে আমাদের কিছুটা সংকোচ ছিল। আমাদের মধ্যে একজনকে সংখ্যায় বাড়ানোর অর্থ হল, মিঃ কোপহৌস আর মিঃ ক্রেলারের ওপর আরও একটু দায়িত্ব চাপানো। কিন্তু বাইরে ইহুদিদের সঙ্গে সরকারী পুলিশ যে ব্যবহার করছে, বা করে চলেছে, তা’ সত্যিই আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয়। ক্রমান্বয়ে এই আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। ইহুদিদের জীবন ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বাবা, মিঃ ড্যাসেলকে আনার ব্যাপারে প্রধানতঃ দু'জনের সাথে পরামর্শ করে ছিলেন। মিঃ কোপহৌস আর মিঃ ক্রেলার। দু'জনেই বাবার প্রস্তাবে এককথায় সহমত পোষণ করেছিলেন। তাঁদের মতে "সাতজনের পক্ষে গুপ্তগৃহে লুকিয়ে থাকা যতটা বিপদজনক, সংখ্যাটা আটজন হলে নতুন করে বিপদ বাড়বে না।" এদের মধ্যে যে'কোন একজনের জন্যেই চূড়ান্ত আঘাত নেমে আসতে পারে। বাবা ভ্যান ড্যানের পরিবারের কাউকে আর আনতে চাননি। ঠিক হয় আমরা দন্ত চিকিৎসক অ্যাল্বারট ড্যাসেলকে আমাদের সাথে সামিল করব। ড্যাসেলের স্ত্রীর কপাল্ভাল তিনি যুদ্ধ শুরুর আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেখাগেল তিনি আমাদের ও ভ্যান ড্যানের পরিবারের কাছে মোটামুটিভাবে পরিচিত। তাই আমাদের কারুরই ড্যাসেলের বিষয়ে কোন আপত্তি ছিল না। আমরা যারা গুপ্তগৃহে আছি তারা সবাই একমত, যে, ড্যাসেল আমাদের মধ্যে এলে, আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। মিয়েপ, ড্যাসেলকে খুব ভালভাবে চেনেন। তাই এ'ব্যাপারে ড্যাসেলের সঙ্গে কথা বলতে মিয়েপের কোন অসুবিধা হবে না। ড্যাসেলকে এই গুপ্তগৃহে নিয়ে আসতেও মিয়েপের কোন অসুবিধা হবে না। যদি তিনি আসেন, তবে তিনি আমার ঘরেই শোবেন। আর মারগট আমার ঘর থেকে পাশের ঘরে, মা বাবার কাছে শোবে। সেখানে সে ক্যাম্প খাটটাতে শোবে। এই ব্যবস্থাটাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো।
ইতি,
অ্যানি
Friz Preffer, also known as Albert Dussel.
ফ্রিতয ফ্রেফফার বা অ্যাল্বারট ডাসেল ১৯৪২ সালের শরত কালে ঠিক করেন যে তিনি গোপন কোন স্থানে আশ্রয় নেবেন। পেশায় তিনি ছিলেন দাঁতের ডাক্তার। শ্রীমতী মিয়েপ গিয়েসকে তিনি অনুরোধ করেন এ'রকম কোন জায়গা তাঁকে দেখে দিতে। মিয়েপ ওটো ফ্রাঙ্কে ও ভ্যান পেলসের সাথে আলোচনা করেন। এবং ড্যাসেলকে অ্যানেক্সের গুপ্তগৃহে নিয়ে আসেন। ওটো বিশেষ করে তাঁর ডাক্তারি ডিগ্রীর জন্যে তাঁকে বিবেচনা করেন। কারণ তাঁদের গুপ্তগৃহে কোন ডাক্তার ছিলেন না। ড্যাসেল আসার পর মারগটকে ওটো তাঁদের ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা করেন। এবং ড্যাসেলকে, অ্যানির ছোট ঘরে, তার সাথে, পাশের বিছানায় শোওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সত্যি কথা বলতে, এই ধরণের ব্যবস্থা, বিশেষ করে অ্যানি, খুশী হতে পারেনি। একটা মধ্য বয়সী লেকের সাথে সদ্য যুবতী অ্যানির পক্ষে একসাথে থাকা, অ্যানির চোখে বেশই সমস্যার। ড্যাসেল মনে করতেন অ্যানির সবসময় তার কথা শুনে চলা উচিৎ, কারণ তিনি বয়সে অনেকই বড়। বিশেষ করে ঘরে বসে অ্যানির ডাইরি লেখার অভ্যাস ড্যাসেল একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। বরঞ্চ তাঁর মনে হতো অ্যানির ডাইরি লেখা অপেক্ষা, তাঁর নিজের ডাক্তারি সংক্রান্ত পড়াশুনা অনেকবেশী জরুরী। এ'কথাটা তিনি অ্যানিকে বারবার বোঝাতেও চাইতেন। অ্যানির বিষয়ে তাঁর এই অভিবাবকগিরির চেষ্টা, অ্যানির বিশেষ বিরক্তির কারণ ছিল। ড্যাসেলের প্রতি অ্যানির এই বিরক্তি, তার ডাইরির বিভিন্ন অংশে পরিষ্কার।
১৯৪২ সালের ১৬ই নভেম্বর ড্যাসেল গুপ্তগৃহে আসেন। অ্যানি তার আসল নাম ফ্রিতয ফ্রেফফার কে পরিবর্তন করে তার ডাইরিতে তাঁর নাম দেয়, অ্যাল্বারট ড্যাসেল। জার্মানিতে ড্যাসেল কথাটির অর্থ হলো, "বোকা বা গর্দভ"। অ্যানির সম্পর্কে ফ্রেফফার ঠিক কি ভাবতেন তা আমরা জানি না। ফ্রেফফার সম্পর্কে অ্যানি ত্রই ডাইরির বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের মন্তব্য করেছে। যেমন এক জায়গায় সে লিখছে ঃ-
১) আমি জানতাম মিঃ ড্যাসেল বেশ ভালো লোক। তিনি আমার সঙ্গে এক ঘরে থাকতে কোনই আপত্তি করেননি। অবশ্য সত্যি কথা বললে আমি খুব একটা ভালভাবে বিষয়টা প্রথম থেকেই নিতে পারি নি। ঘরে একজন নতুন লোক থাকবে, যার জন্যে নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুকে আড়াল করে রাখতে হবে। বিশেষ করে লোকটা যখন অনাত্মীয়। প্রথম দিন ড্যাসেল এসেই আমায় বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করছিলেন, যেমন কখন অফিসের কাজ শুরু হয়; বাথরুম ব্যবহার কি নিয়মে করা হয়; কখন আমরা "পটিতে যেতে পারি –এরকম সব প্রশ্নও। আমি ঠাণ্ডা মাথায় তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। আমাদের এখানকার নিয়মকানুন সব বললাম। তবে একটা বিষয় দেখে আমি অবাক! ভদ্রলোক কিছুই ভাল করে মনে রাখতে পারেন না। আমায় বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন। এ'টুকু যদি সহ্য করা যায়, তবে ভদ্রলোকটি মোটামুটি ভালই।
২) ২২শে ডিসেম্বর ১৯৪২-এর ডাইরিতে অ্যানি লিখেছেঃ ভদ্রলোকের সবথেকে বড় দোষ, উনি চান ঘরে সবাই সবসময় চুপ করে থাকবে, কথা একমাত্র উনিই বলবেন। ওনার মতে আমি সব সময় ঘরে হৈ চৈ করি। তাই ওনাকে সবসময় আমায় চুপ করানোর জন্যে "শশ" শশ"করতে হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম ভদ্রলোকটি সহানুভূতিশীল। অন্ততঃ নিজের রুমমেটের সঙ্গে তিনি সহানুভূতি সম্পন্ন ব্যবহার করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা বিস্কুট পর্যন্ত হাতে করে দেননি। বিশেষকরে রবিবারে তার মেজাজ থাকে তুঙ্গে। ঐ দিন ভোর বেলায় ঘরে আলো জ্বেলে ব্যায়্যাম করতে শুরু করেন। তখন কেউ যদি বিরক্ত হয়, তবে আর রক্ষে নেই।
৩) তাঁর যেদিন জন্মদিন ছিল, সেদিন প্রথমে এমন ভাব দেখালেন, যেন জন্মদিন পালন করাটাই তিনি অপছন্দ করেন, তারপর যখন, মিয়েপ তার জন্যে একব্যাগ উপহার নিয়ে এলেন, তখন এমন আত্মহারা হয়ে পড়লেন যে, উপহারগুলো টেবিলে সাজিয়ে রেখে সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে লাগলেন।
এই তিনটি মন্তব্য পড়ে বেশ ভালই বোঝা যায়, অ্যানি ড্যাসেলকে কি চোখে দেখত!
0 comments: