0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


৯ 

ঠীলের সবকিছুকে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। মনে হতে লাগলো এসব একরাত্তির আগে মিনাকে নিয়ে দেখা সেই দুঃস্বপ্নটার মতো। সে নিজেকে বুঝ দেবার চেষ্টা করতে লাগলো, মনে মনে বলতে লাগলো.. এসব মিথ্যা, ভুল, দুঃস্বপ্ন! কিন্তু হায়... 

সে দৌড়াতে শুরু করলো, সে পালাতে চায় সবকিছু থেকে... অসহ্য... 

সে দৌড়াতেও পারছেনা... টলতে টলতে হোঁচট খেতে খেতে সে কেবিনে পৌঁছালো। তার শরীরটা আছড়ে পড়ল মাটিতে। মাথার টুপিটা যেন কোথায় গড়িয়ে গেলো। যত্নে রাখা পকেটঘড়িটা ছিটকে পড়ল মাটিতে, ভেঙ্গে গেলো তার ডালা, ফেটে গেলো কাচের ডায়াল। সে ভ্রুক্ষেপ করলনা। তার মনে হচ্ছিল যেন একটা বিশাল লোহার হাত মুঠো করে ধরে আছে তার গলা; সে ছাড়াতে পারছেনা—উফফ, কী কঠিন বজ্রমুষ্টি! সে ব্যথায় শুয়ে গোঙাতে লাগলো... এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাইল... নাহ... মুক্তি নেই। তার কপালটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, চোখদুটো শুকিয়ে গেছে, গলাটা জ্বলছে। 

সিগন্যালের ঘণ্টার শব্দ শুনে তার ঘোর কাটলো। পর পর তিনটে ঘণ্টার আওয়াজে সে জেগে উঠল -- নাহ, তাকে তার ডিউটি করতেই হবে। পাদুটো সিসের মতো ভারি মনে হচ্ছিল তার। নিজের ডিউটি যন্ত্রের মতো করতে লাগলো সে। মনে হচ্ছিল সে যেন এক বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, এবং নিজের মাথাটা কেন যেন সেই কক্ষপথের কেন্দ্রবিন্দু থেকে একচুল নড়াতে পারছেনা সে। অতিকষ্টে ডিউটি শেষ করল সে। 

ওই যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন আসছে। হ্যাঁ, টোবিয়াসকে এই ট্রেনেই নিয়ে যাবার কথা। যত সে ট্রেনের কাছে যেতে লাগলো, তত তার মনে হতে লাগলো যে তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত চলে যাওয়া ট্রেনের ভেতরে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। শেষ কামরায় তার মনে হল সে একঝলক দেখতে পেল আহত, রক্তাক্ত শিশুকে; তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। 

কিছুক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরলো। সে দেখতে পেল যে সে রেললাইনের ধারের বালির উঁচু পাড়ির উপরে শুয়ে আছে। সে উঠে দাঁড়ালো, নিজের নাকমুখ আর পোশাক থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো গরম বালির দানা। তার মাথা আগের থেকে হাল্কা লাগছে; সে একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববে এবার। 

কেবিনে ফিরে সে ঘড়িটা কুড়িয়ে নিলো মেঝে থেকে। আশ্চর্য, ঘড়িটার ডালা ভেঙ্গে গেছে, ফেটে গেছে কাচের ডায়াল, কিন্তু ঘড়িটা বন্ধ হয়নি। সময় দিচ্ছে টিকটিক করে। ঠীল হিসেব করবার চেষ্টা করলো, অ্যাকসিডেন্টের পরে কতটা সময় কেটেছে; কেমন হতে পারে টোবিয়াসের শারীরিক অবস্থা, সে ভাববার চেষ্টা করল। সে চোখ বুজে ভাবতে লাগলো ... এতক্ষণে ডাক্তারের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। হ্যাঁ, লেনা এসে দাঁড়িয়েছে, ওই তো, ডাক্তারবাবুও দাঁড়িয়ে আছেন লেনার পাশেই। উনি দেখছেন টোবিয়াসকে... মাথা নাড়ছেন। 

‘খুবই খারাপ, খুবই খারাপ অবস্থা...’ বলছেন ডাক্তারবাবু, ‘তবুও... শেষ চেষ্টা... কে বলতে পারে?’ আরও খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি। তারপর মাথা নাড়ছেন... ‘নাহ, শেষ... সব শেষ!’ 

‘শেষ! শেষ!’ একা একা নিজের মনে অস্ফুটে গোঙাতে লাগলো গার্ড ঠীল। পরমুহূর্তে ছিলেছেঁড়া ধনুকের মত লাফ দিয়ে উঠল সে। দুই হাত উর্ধে তুলে মুঠি পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলো কেবিনের ছাতের দিকে। বীভৎস আওয়াজে চিৎকার করে উঠল সে, তার গলার জোরে ওই ছোট কেবিনের কুটিরটা যেন ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে! 

‘হ্যাঁ, ওকে যেতে হবে... ওকে যেতে হবে। আমি জানতাম... আমি জানতাম’... চিৎকার করে উঠল ঠীল। সশব্দে খুলে দিল কেবিনের দরজা। সন্ধ্যা নেমে আসবার আগে আকাশের শেষ আলো একটুখানি ঢুকে এলো ঘরে। দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে ঠীল দৌড়াতে লাগলো রেলগেটের দিকে। সেখানে গিয়ে একমুহূর্ত থামলো; তারপর আবার দৌড়াতে লাগলো বালির পাড় ধরে। দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দৌড়াতে লাগলো সে। প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা যেদিকে চলে গেছে, সেইদিকে দৌড়াতে লাগলো সে। কি করতে চায় সে? কাকে থামাতে চায়? তার বিস্ফারিত দুই চোখ যেন কিচ্ছু দেখছে না। চোখ খুলে রেখেও সে অন্ধের মত দৌড়াতে লাগলো। 

দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলো, ‘ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও, ফিরিয়ে দিয়ে যাও, নিয়ে যেও না। শুনতে পাচ্ছ? ছেলেটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, একটা দলার মতো হয়ে গেছে ছেলেটা! হ্যাঁ, যে ওর এই হাল করেছে, আমি তাকে ছাড়বো না। কিন্তু শোনো, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও, শুনছো তুমি? দাঁড়াও, যেও না।’... মনে হচ্ছিল যেন কে চলে যাচ্ছে এবং ঠীল তাকে আটকাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে; সে অন্য দিকে চলে গেলো এবং ঠীলও যেন তার পিছু পিছু অন্য দিকে যেতে লাগলো। 

‘যেওনা মিনা, তুমি যেওনা!’ ঠীল শিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।... ‘শুনছো, ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাও।‘ ঠীল শূন্যে হাতড়ে হাতড়ে যেন কাকে ধরবার চেষ্টা করে যাচ্ছে... ‘হ্যাঁ, ঐ মেয়েমানুষ, হ্যাঁ, ওকে আমি ছাড়বো না... কুঠারের এক ঘা দেবো, মরবে, ওইরকম হাল করে ছাড়বো আমি!’... 

‘হ্যাঁ, কুঠার দিয়ে ... রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে যাবে... ছাড়বো না আমি’... ফেনা উঠতে থাকে ঠীলের মুখ দিয়ে। চোখের মণি অদ্ভুতভাবে ঘুরতে থাকে... 

সন্ধেবেলার ঠাণ্ডা বাতাস এসে হাল্কা পরশে ছুঁয়ে যায় অরণ্যের গাছপালাগুলিকে। পশ্চিম আকাশে গোলাপি আভার কিছু মেঘ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। 

ঠীল অদৃশ্য কারো পিছন পিছন গিয়েছিল প্রায় একশো পা; এখন সে ফিরে আসতে থাকে। দুই চোখে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে দুহাত ছড়িয়ে সে ভিখারির মতো ছেলের প্রাণভিক্ষা করছিল এতক্ষণ। এখন সে ফিরে আসে, হতোদ্যম, ক্লান্ত চোখদুটো ঢেকে রাখে দুই হাতে। তার শরীর শিথিল হয়ে গেছে হতাশায়, মুখটা ফ্যাকাসে, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, এক অদ্ভুত খাঁ খাঁ শূন্যতা তার চোখেমুখে। অতিকষ্টে নিজের দেহ টানতে টানতে ফিরে আসতে থাকে সে। 

সূর্য তার শেষ রশ্মির পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল অরণ্যের গায়ে। পাইনবনের চেহারা কেমন অদ্ভুত অপ্রাকৃত মনে হচ্ছিল। সরু কাণ্ড আর ধূসর মুকুটের মতো শরীর নিয়ে গাছগুলি নিস্তব্ধ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে। একটা কাঠঠোকরার ঠোঁটের ঠকঠক আওয়াজ ভেঙ্গে দিচ্ছিল নৈঃশব্দ। শীতল ধূসর নীল আকাশের মধ্যে মাত্র একখানি গোলাপি আভার মেঘ তখনো জেগেছিল। বাতাস ক্রমশ আরও শীতল হয়ে আসছে; ঠীলের খুব শীত করছিল। সে কেঁপে উঠলো। সবকিছু তার কাছে অদ্ভুত, অচেনা ঠেকছে। এই জঙ্গল, রেললাইন, রেলগেট, বালির বাঁধ, গাছপালা, পাখির ডাক সবকিছু মনে হচ্ছে যেন অন্য কোনো এক গ্রহের। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না! এমনসময় সে দেখতে পেলো একটা কাঠবেড়ালি রেলের ট্র্যাকের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে জানেনা হঠাৎ কেন, তার ঈশ্বরের কথা মনে হল... ‘ঈশ্বর আসছেন এই পথে!’ সে বিড়বিড় করতে লাগলো... ‘ঈশ্বর আছেন! তিনি আসছেন এই পথে!’ পরমুহূর্তে তার মনে হল সে পাগলামি করছে। সে অনেককিছু ভেবে নিচ্ছে যার কোনো মানে হয়না। সে চেষ্টা করতে লাগলো তার সব ভাবনাগুলো গুছিয়ে নেবার, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছিল না। নিজেকে ভীষণ অসহায় বলে মনে হচ্ছিল তার। 

এমন সময় হঠাৎ পাশের বার্চগাছের জঙ্গল থেকে খুব জোরে শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো। হ্যাঁ, ছোট দুধের বাচ্চাটা। মাকে ছাড়া এতক্ষণ রয়েছে সে! ঠীল অনিচ্ছাসত্ত্বেও দৌড়ে গেলো সেদিকে। বাচ্চাটা এখানে, এই জঙ্গলে কীভাবে এলো? বাচ্চাটা কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো খিদে পেয়েছে। গাড়ির মধ্যে সেরকম কোনো আরামদায়ক বিছানাও নেই যে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে থাকবে। ঠীল ভেবে পাচ্ছিল না কিভাবে বাচ্চাটাকে শান্ত করবে! নানারকম আবেগ, প্রশ্ন সবকিছুর মধ্যে সে যেন তলিয়ে যেতে লাগলো। 

‘ঈশ্বর আসছেন এই পথে!’ সে বুঝতে পারছিল সে কি বলছে, ‘টোবিয়াস... ঐ মেয়েমানুষটা ওকে খুন করেছে। ওকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সৎমা, কাক-মা, সে কীভাবে...’ চিৎকার করে উঠল ঠীল, ‘এখন ওর নিজের বাচ্চাটা, হ্যাঁ, এটা এখনও বেঁচে আছে।’ তার সমস্ত যুক্তি- বুদ্ধি যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো; সব অনুভূতি যেন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগলো। শিশুটির চোখদুটি তাকে যেন বিঁধছিল। সে নিজের আঙুলের ফাঁকে নরম একটা মাংসের দলা অনুভব করছিল। এমন সময় এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ আওয়াজ তার কানে আঘাত করল। 

আগের মুহূর্ত অবধি তার মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার ব্রহ্মতালুতে ফোঁটা ফোঁটা গরম মোম ঢেলে যাচ্ছে। তার মন, যুক্তি বুদ্ধি, ভাবনা সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। এমন সময় সিগনালের ঘণ্টা তীব্র ধ্বনিতে বেজে উঠল, বাতাসে ছড়িয়ে যেতে লাগলো সেই আওয়াজ। সে ধীরে ধীরে নিজের সম্বিত ফিরে পাচ্ছিল সেই আওয়াজে। সেই আওয়াজে সে বুঝতে পারলো যে সে কি করতে যাচ্ছিলো! শিশুটির কণ্ঠনালী থেকে সরিয়ে নিল নিজের হাত। বাচ্চাটা ওর হাতের চাপে খাবি খাচ্ছিল। হাতের চাপ আলগা হতেই বাচ্চাটা কাশতে শুরু করল এবং প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। 

(চলবে) 
[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 





0 comments: