0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in


ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত

॥২৫॥ 

দিগন্ত ক্যানভাসে কেউ একপোঁচ সবুজ মুক্তির রঙ দিয়েছিলো/মুক্তিকামী রঙের প্যালেট ব্রাশ এনে এঁকে ফেললো ঘরের আঙন 

পেরো 

এখানেও গুহামুখে বুনোফুলের ঘন লতাপাতা। গুহার ভিতরে জলাশয়ের পাড়ে জোহার সাথে গলা মিলিয়ে দেওয়াল লিখনের অলচিকি ভাষার কবিতা আবৃতি করতে করতে আবেশ এসেগেছিল পেরোর। অরণ্যের অধিকার তার রক্তে টগবগ করে ফুটছিল। মনে হচ্ছিল এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে যারা তাদের একেবারে নিঃশেষ করে দিতে পারে সে।গায়ে বুনো হাতির শক্তির অনুভব। ওই সরোবরের জলে নিশ্চয়ই কিছু রয়েছে যা পান করলে এমনটা অনুভব হচ্ছে, এই কথা ভাবতে ভাবতেই জোহা সেই কথাই বলে উঠল। পাথরের দেওয়ালে খোদাইকরা কবিতার শেষে একটা নকশা খোদিত রয়েছে। জোহা সেটার উপর হাত ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগলো। সঙ্গীসাথীরা সেই তালে তাল মিলিয়ে মাথা নাড়তে লাগলো। পেরো কিছুই বুঝতে পারলোনা। অবশ্য তখন শরীরে সঞ্চিত বলশক্তির প্রভাবে বুঁদ হয়ে হাতপা শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। একসময় সেই নক্সা স্পর্শ করেই দেওয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রায় ছুটে ছুটে এগিয়ে চললো। দেওয়াল ধরে ধরে পেরো ও অন্যেরা দৌড়ে এগিয়ে গেল। জলাশয় পার হয়ে দেওয়ালের পাথরের রঙ নীলাভ থেকে চুনির মতো প্রায় পারদর্শী লাল হতেই জোহা থামল। এখানের পাথর এত পিছল যে পা রাখা যায় না। আর দৌড় নয় এবারে সাবধানে পা ফেলে এগোতে লাগলো ওরা। পেরো দেখলো লাল দেওয়াল সঙ্কীর্ণ হয়ে একটা নীলচে সবুজ রঙের সরু সুড়ঙ্গ হয়ে নিচে নেমে গেছে আর জলাশয়ের জল ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে সবেগে নিচে বইছে। জোহা আগে আগে পিছল পাথরের গা বেয়ে উঠতে লাগলো পিছনে পিছনে পেরো।পেরোর তখন দুধঝর্ণার কথা মনে পড়ে গেল আর তখুনি তার পা পিছলে নিচে পড়তে পড়তে জোহা শক্ত হাতে ধরে ফেলল। পেরো তার শরীরের শক্তি দেখে অবাক হয়ে গেল। এইরকম কয়েকজন থাকলেই তার প্রতিবাদী দলকে কেউই হারাতে পারবেনা। এইভাবেই চলতে চলতে একসময় পাহাড়ের দেওয়ালে বুনো হলুদ ফুলের ঘন লতাগুচ্ছ পাওয়া গেল। এই লতাগুলো এত ঘন আর এত শক্তঝুরি যে সেগুলো ধরে ঝুলে যাওয়া যায়। ফুলগুলো এত উজ্জ্বল যে জায়গাটা আলোয় আলোময় হয়ে গেছে। সেই হলুদ আলোতে জোহাকে এত সুন্দর লাগলো যে পেরোর মনে হলো ওকে জড়িয়ে ধরে। জোহা এগিয়ে চললো। থামল না। ক্রমশ ফুলের দেওয়াল ধরে উপরে উঠতে লাগলো। একসময় কয়েকটা উজ্জ্বল গোলাপী রঙের ফুলের লতা পেতেই জোহা থামল। এখানে গোলাপী আলোয় জোহাকে কেমন যেন অচেনা সৈনিক গাইডের মতো মনে হলো পেরোর। জোহা ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখ শক্ত করে বলতে লাগলো, 

-আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। এইখানেই আছে একটা গোপন গুহাপথ।সেটা পাহাড়ের ওইপারে একটা গোপন পাথরের খাঁজে শেষ হয়েছে। আমার কাছে আছে এমন একটি ভেষজ শিকড় যেটা চিবিয়ে খেলে তার সাময়িক স্মৃতিভ্রংশ হয়। অবশ্য আমাদের এখান থেকে দু তিনজনকে আমরা ওইপারে পাঠিয়েছি। আমাদের সুরক্ষার জন্যে ওদের এমন একধরনের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে যারা এখানে থাকার কথা একেবারেই মনে করতে পারেনা। তাদের মধ্যে একজন অতি সজ্জন অরণ্যবাসী প্রেমী ও পণ্ডিত মানুষ। তাঁর নাম গোরাচাঁদ দাস। পেরো আমি তোমাকে এই শিকড় এইজন্যে খেতে দিচ্ছি যে আমাদের সাথে থাকার ও এখানে আসার কথা এমনকি তুমি কে তোমার কি পরিচয় তোমার স্মৃতি থেকে কিছুদিনের জন্যে লোপ পেয়ে যাবে। এটা চিবিয়ে খেয়ে তুমি ওইপারে যাও। তোমার গায়ের রঙ এখন ফর্সা হয়েছে। তোমাকে কেউ চিনতেও পারবেনা। যদি সব কিছু ঠিক থাকে, যদি ওদের পিছনে অন্য কোনো মানুষ না এসে থাকে তবে একসময় আমরা তোমাকে ও তোমার জনজাতি ভাইদের এই গুহাপথ দিয়ে নিয়ে আসব। তুমি কিছু চিন্তা করোনা। এটা আমরা তোমার সুরক্ষার কথা ভেবে করছি। 

পেরো তাই করলো। শিকড়টা চিবিয়ে খাওয়ার একটু পরেই কেমন ঘুম পেতে লাগলো। সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে একটু এগিয়ে একটা পাথরের গোল মসৃণ গর্ত পাওয়া গেল যেখান দিয়ে একজন মানুষই গলে যেতে পারে। পেরোর হাত ধরে সেই পাথরের গর্তের কাছে নিয়ে গেল। একবার তাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ থেকে জোহা তাকে পাথরের গর্ত দিয়ে গলে যেতে সাহায্য করল। পেরো পিছলে সেখান দিয়ে গলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঢালু পথে গড়িয়ে গড়িয়ে আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে লাগলো। তার কিছুই বোধ হচ্ছেনা সে কি করছে কোথায় যাচ্ছে। শুধু যাওয়া আর যাওয়া। 

0 comments: