গল্প - সৈকত ভট্টাচার্য
Posted in গল্প
গল্প
দূরে কোথায়
সৈকত ভট্টাচার্য
মরচে ধরা গেটটা ঠেলে ঢুকতে একটা ‘ক্যাঁচ’ করে শব্দ হলো। চারিদিকের একটা প্রশান্ত পরিবেশের মধ্যে শব্দটা শুনে নিজেই চমকে ওঠে মৌবনী। হ্যাঁ, এটাই তো সেই বাড়িটা। ঠিকই চিনতে পেরেছে সে। গেটের পাশের নাম-ফলকের অর্ধেকটা খসে পড়ে গেছে। বাকি অর্ধেকটা ধুলো-ময়লার তলায়। তার ফাঁক দিয়ে ‘অবকাশ’এর শুধু ‘কাশ’ টুকু পড়তে পেরেছিল মৌবনী। মৌবনীর মেমরি যে বেশ শক্ত পোক্ত সেটা বরাবর সকলেই বলে। মা-বাবা, স্কুল-কলেজের টীচাররা সবাই বলেছে। এমনকি এখন এই স্কুলের টীচার্সরুমে এটাই আলোচনা হয় যে, মৌবনী কী করে প্রতি ক্লাসের প্রতিটা ছেলেমেয়ের নাম রোলনাম্বার মনে রাখে এবং তা একবার শুনেই! এটা মৌবনী নিজেও ভেবে পায়নি কোনদিন। কিন্তু থেকে যায় মনে। বিনা চেষ্টাতেই। শুধু নাম নয় – ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নাম্বার, ক্রেডিট কার্ডের কার্ড নাম্বার – সব কিছু তার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে থাকে। বিশেষ করে এই সংখ্যাগুলো। এক রাশ সংখ্যা দেখলেই তাদের মধ্যে একটা সম্বন্ধ খুঁজে পেয়ে যায় মৌবনী। আর সেই সম্বন্ধ দিয়েই মনে থেকে যায় তারা।
গেটটার সামনে নুড়ি বিছানো রাস্তাটা থেকে নুড়ি সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘাস জঙ্গল হয়ে আছে চারিদিকে। তার মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলে চলে হয়ে যাওয়া দাগ ঘাসের বুক চিরে চলে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা ছোট আউট হাউজ চোখে পড়ল মৌবনীর। এই আউট-হাউজটার কথাও মনে পড়ল এবার। বোধহয় গেটের শব্দ পেয়ে একজন বয়স্ক কর্মচারী আউট হাউজের দোর ঠেলে বের হয়ে এসেছে। ঘোলাটে চশমার কাঁচের মধ্যে দিয়ে মৌবনীর দিকে তাকিয়ে আছে। মৌবনী একটু এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এক্সিউজ মি। ইয়ে ব্যানার্জী সাবকা কোঠি হ্যায় না?”
“থি। আভি তো কোই নেহি রাহেতে হ্যায়।“ লোকটা উত্তর করে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “আপ?”
“নেহি। অ্যায়সে হি। জারা অন্দর যাকে দেখ সাকতি হুঁ ক্যায়া?”
“যাইয়ে” মাথা নাড়ে লোকটা। চশমার নড়বড়ে ডান্ডিটা নেমে যায় একদিক থেকে। সেটা হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে আবার বলে, “পর দেখনে কা কুছ হ্যায় নেহি। কিতনে সাল হো গয়া। আনা যানা সব বন্ধ। মেইনটেনেন্স ভি বন্ধ...” মেইন্টেনেন্স শব্দটায় জোর দিয়ে লোকটা থামে।একটু দম নেয়। মৌবনী একটু এগিয়ে যায় বাড়িটার দিকে। সেই সদর দরজার সামনের চওড়া সিঁড়িটা। সিঁড়িটা উপর থেকে নীচ অবধি ইংরিজি ওয়াই অক্ষরের মতো ছড়িয়ে গিয়ে লনে মিশে গেছে। হ্যাঁ, লন। এখন এই ঝোপ হয়ে থাকা সাপ-খোপের আড্ডা দেখলে বোঝা যাবে না সেই কুড়ি বছর আগে যখন ও এসেছিল সুন্দর সবুজ গালচের মতো ঘাসে ঢাকা লন ছিল। সকালের ব্রেকফাস্ট অনেকসময় ওখানেই খাওয়া হতো। টেবিল পেতে।
লোকটা পিছন পিছন এগিয়ে এসেছে। “আপ ব্যানার্জী সাব কা কোই রিলেটিভ হ্যায় কেয়া?”
মৌবনী হেসে মাথা নাড়ায়, “নেহি। ইয়ে ঘর য়ো লোগ কিরায়া পে দেতা থা। তব একবার আয়ি থি।“
“হাঁ। পর য়ো ভি তো আজ দস সাল হো গায়া, কোই আতা নাহি হ্যায়।“
“কিঁউ?”
“পাতা নাহি ম্যাডাম। দো তিন মাহিনে মে একবার মেরে লিয়ে কুছ পাইসা ব্যানার্জী সাব কা বেটা ভেজতে হ্যায়। মেরা তো চল যাতা হ্যায়। পর ইয়ে ঘর সাফ সুতরা রাখনা মুশকিল হ্যায়। আপ সাব সে মিলেঙ্গে তো বাতানা।”
মৌবনী একটু হেসে মাথা হেলায়। যদিও ‘ব্যানার্জী সাব কা বেটা’র সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই। তবু ভদ্রলোকের মনের আশাটা ভাঙতে ইচ্ছে হলো না তার। সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠে সদর দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজায় একটা বহুদিনের জং ধরা তালা ঝুলছে। লোকটা পিছন থেকে সেটা লক্ষ্য করে বলল, ”আপ অন্দর যানা চাহতে হ্যায়?”
“চাবি হ্যায় আপকে পাস?” মৌবনী পাল্টা প্রশ্ন করে।
“হাঁ। হ্যায় না! এক মিনিট রুকিয়ে।” বলে হন্ত-দন্ত হয়ে আউট হাউজের দিকে চলে গেল। মৌবনী ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করে সিঁড়ির উপর সিমেন্টের বসার জায়গাটা পরিষ্কার করে সেখানে বসল। অযত্নে গাছ পালা গজিয়ে গেছে এখানে সেখানে। শ্যাওলাও ধরে গেছে। তক্ষকের ডাক শোনা যাচ্ছে ভিতরের কোথাও থেকে।
বছর কুড়ি আগে ও যখন মা-বাবার সঙ্গে মধুপুর এসেছিল ও তখন ক্লাস সিক্স। এই বাড়িটার মালিক ব্যানার্জীবাবু মৌবনীর বাবার বসের বন্ধু বা ঐ জাতীয় কিছু ছিলেন। তার সূত্রেই এই বাড়িটা ভাড়া পাওয়া গেছিল। একতলায় এই সদর দরজা দিয়ে ঢুকে লম্বা একটা হল আছে। তার দুপাশে দুটো দুটো চারটে ঘর। হলের শেষ মাথায় পাশাপাশি দুখানা টয়লেট। এখনও বেশ পরিষ্কার সব মনে পড়ল মৌবনীর। ঢুকে বাঁদিকের ঘরদুটো ওরা নিয়েছিল। আর ডান দিকের ঘরে অন্য একটি ফ্যামিলি ছিল। কী যেন নাম? ভাবার চেষ্টা করে মৌবনী। পদবী ছিল রায়। আর কিছু মনে পড়োছে না। ওদের সঙ্গে ওর বয়সীই একটি ছেলে ছিল। ওই একটা সপ্তাহে দুজনের বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। ছেলেটির নাম ছিল যদ্দুর মনে পড়ছে - বিল্টু। এই বাগানের কোণে একটা বড় রাধাচুড়াগাছে এক ঝাঁক টিয়া পাখির বাসা ছিল। ভোরবেলা হলেই উড়ে বের হয়ে পড়ত তারা। আবার সন্ধ্যে বেলায় কর্কশ আওয়াজ করতে করতে ফেরত আসত। শহরে থাকা মৌবনীর সেই প্রথম টিয়া পাখি দেখা। তাই বেশ স্পষ্ট মনে পড়ল ঘটনাটা।
লোকটা ফিরে এসেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে রাধাচূড়া গাছটা খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেল মৌবনী। হাতে এক গোছা চাবি। তার থেকে খুঁজে খুঁজে একটা চাবি দিয়ে জং ধরা তালাটা অনেক কসরৎ করে খুলে ফেলল।
দরজাটা খুলতেই যেন এক রাশ অপেক্ষায়মান স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ল মৌবনীর উপর। ওই সেই হল ঘর। মাঝে লম্বা ডাইনিং টেবিলটা। উপরে পুরনো কেতার একটা বড় আলো। হলের দুপাশে দুটো দুটো চারটে দরজা। বন্ধ সেগুলো। হলের শেষ মাথায় দুপাশে দুটো টয়লেটের দরজার মাঝ দিয়ে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি।
মৌবনীর এবার মধুপুর আসাটা একেবারেই অপরিকল্পিত। ওর স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে মধুপুরে একটা এক্সকারশন ট্রিপের পরিকল্পনা হয়েছিল। কিছু স্কুলকে এখানে একটা নেচার ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রকৃতি চেনার জন্য। আরো কয়েকটা স্কুল আসছে। দায়িত্ব ছিল বায়ো টিচার মিসেস সান্যালের উপর। কিন্তু মিসেস সান্যাল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দায়িত্ব এসে বর্তায় মৌবনীর কাঁধে। মৌবনী ফিজিক্সের। সঙ্গে মিসেস বসু অবশ্য আছেন। গত দুদিনে বাচ্চাদের নিয়ে নেচার ক্যাম্পেই বিভিন্ন রকম অ্যাক্টিভিটিজের মধ্যে দিয়ে ব্যস্ততায় কাটছিল।আজ রবিবার। ছুটি। দুপুরে গিরিডি যাওয়ার প্ল্যান আছে। উশ্রী নদীর ঝরণা দেখতে যাবে সবাই। দিনটা যদিও বিশ্রী নয়। বরং বেশ সুন্দর। ঝকঝকে রোদ, নীল আকাশ। নভেম্বর মাসে হাল্কা ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে দেয় এখানে। তাই জন্য আজ সকাল হতেই মিসেস বসুর জিম্মায় বাচ্চাদের রেখে ও একা একাই বের হয়ে পড়েছিল। বের হতেই দেখা হলো সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। অন্য একটা স্কুলের টীচার। বাচ্চাদের সঙ্গে এসেছেন। গত দুদিন ধরেই দেখেছে মৌবনী। মুখের আদলটা খুব চেনা লাগে। কিন্তু মৌবনীর কম্পিউটার ব্রেনও সেটা খুঁজে পায়না স্মৃতি ঘেঁটে। আজ ও রাস্তায় বের হতেই পাশ দিয়ে ভদ্রলোককে দেখল হন হন করে হেঁটে বাজারের দিকটায় যেতে। মৌবনীর উল্টো রাস্তা ধরে।
“আপ অন্দর নেহি যায়েঙ্গে?” লোকটা প্রশ্ন করে। কুড়ি বছর পিছন থেকে বর্তমানে এসে পড়ে মৌবনী। শহুরে মনে একটু সন্দেহ হলো। এরকম বিনা বাক্যব্যয়ে ঢুকতে দিল। দরজা খুলে দিল। ‘অন্দর’ যাবে কি না সেই নিয়ে এত পীড়াপীড়ি। কোনও বদ মতলব নেই তো? তারপরেই বয়স্ক মানুষটির ঘোলাটে চশমার কাঁচের মধ্যে দিয়ে একাকীত্বের বেদনা মাখা চোখগুলো দেখে সেই চিন্তাটা মন থেকে তাড়িয়ে দিল। মাথা নাড়িয়ে বলল, “জরুর যাউঙ্গি।“
মৌবনী ভিতরে ঢোকে। বাঁদিকের ঘর দুটো নিয়ে ওরা ছিল। পালঙ্কের মতো বড় খাট ছিল। দরজা ঠেলে দেখল মৌবনী। এখনো আছে। জরাজীর্ণ। ছোটবেলায় এই খাটগুলোকে বিশাল উঁচু মনে হতো। মনে হতো বেয়ে বেয়ে বুঝি উঠতে হবে। বিশাল মোটা মোটা থামের মতো এক এক খানা পায়া। বিল্টুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে কতবার এই খাটের তলায় লুকিয়েছে! সিমেন্টের লাল ঠাণ্ডা মেঝেতে সে যে কি আরাম ছিল সে বুঝি শুধু ওই জানে।
“ছাদ খুলা হ্যায়?” মৌবনী হলে ফেরত এসে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে। লোকটা সদর দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। মৌবনীর প্রশ্নে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে।
মৌবনী হলটা পার হয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
ছাদের এক কোণায় একটা আম গাছের ডাল নেমে এসেছিল। ওই ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় লাগত মৌবনীর। সেই ডালে দেখেছিল কীভাবে কাঠপিঁপড়ের দল সারি দিয়ে খাবার মুখে করে যাওয়া আসা করে। কাঠবেড়ালীগুলো ছাদের কার্নিশ বেয়ে দৌড়ে গিয়ে তুড়ুক করে লাফিয়ে ঐ ডালে উঠে পাতার আড়ালে ভ্যানিশ হয়ে যায়। বিকেল বেলায় ওর আর বিল্টুর খেলার জায়গা ছিল এই ছাদ। মা-কাকীমারাও গল্প করত এক দিকে মাদুর পেতে বসে। বিল্টুদের সঙ্গে তারপর আর কখনো দেখা হয়নি। তখন তো আর বাড়িতে ফোন ছিল না। যে নাম্বার নিয়ে রাখবে। ঠিকানা হয়ত ছিল মায়ের কাছে। ও জানেনা। জিজ্ঞেস করবে একবার মাকে? এখনই? ফোন করে?
ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল মৌবনী। টাওয়ার প্রায় নেই বললেই চলে। মায়ের নম্বরে পিক পিক করে লাইন লাগল না। এমন সময় একটা গলার আওয়াজে চমকে গিয়ে দরজার দিকে ফিরে তাকাল মৌবনী।
“কাউকে খুঁজছেন?” ওই সেই অন্য স্কুলের টীচার ভদ্রলোক। এখানে কী করে এল?
“না। আপনি?”
“আমার নাম নিশীথ রায়। আমি এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। এই বাড়ির কেয়ারটেকার বলল যে, আপনি নাকি এই পোড়ো বাড়ির ভিতরে ঢুকেছেন অনেকক্ষণ। বের হচ্ছেন না। তাই ভাবলাম দেখি একবার।“
‘পোড়ো’ শব্দটা শুনে মাথার মধ্যে একটা স্মৃতি খেলা করে গেল মৌবনীর। এই বাড়ির পিছনেই একটা পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল। ভগ্নপ্রায়। ওইটা দেখিয়ে বিল্টু বলেছিল ‘পোড়ো’ বাড়ি। ‘পোড়ো’ মানে মৌবনী ভেবেছিল যে, বাড়ি পুড়ে গেছে। বিল্টু বলেছিল, “ধুর বোকা। পোড়ো মানে হলো পরিত্যক্ত।“ ‘পরিত্যক্ত’র মতো গম্ভীর একটা শব্দ বলে দিগগজ মুখ করে তাকিয়েছিল। মৌবনী এখন ঘাড় উঁচু করে সেই বাড়িটা দেখতে পেল না। এদ্দিনে বোধহয় সেটা মাটিতে মিশেই গেছে।
“এখানে এই পোড়ো বাড়ির মধ্যে কী করছেন? একা একা?” ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করেন।
“না সেরকম কিছু না। আসলে এখানে অনেকদিন আগে একবার এসে ছিলাম বেশ কদিন। তাই আনাচে কানাচে কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেগুলোই একবার ফিরে দেখা আর কি!”
“বাহ। কথাগুলো বেশ লিরিক্যাল শোনাল তো! সাহিত্য টাহিত্য করেন নাকি?”
“এই রে! একদম না। তবে পড়ি। আপনি তো ওই সেন্ট উইলিয়াম স্কুলের সঙ্গে...”
“হ্যাঁ। আমি ওদের বায়ো টীচার। আপনি?“
“আমি কুমুদিনী গার্লসের ফিজিক্স টীচার। বায়ো টীচার আসতে পারলেন না। তাই আমায় আসতে হলো।“
“বাহ ভাল। ভাগ্যিস এলেন।“
“কেন বলুন তো?”
“তাই দেখা হয়ে গেল।“ একটু থেমে ভদ্রলোক বললেন, “আবার। এই বিশ বছর পরে।“
মৌবনী প্রায় এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “বিল্টু?”
“যাক, চিনতে পেরেছেন তবে? সেই আমগাছটার কথা খেয়াল আছে? আর নীচে লুকোচুরি খেলার কথা? আমিও অনেকদিন ধরে এই বাড়িটা খুঁজে চলি। আসলে আমরা প্রত্যেকেই তো কিছুর একটা খোঁজে বেঁচে থাকি। হারানো ছেলেবেলাই হোক বা কিছু ছবির মতো সযত্নে রাখা স্মৃতি। এই বাড়িটাতে কাটানো কয়েকটা দিনও আমার কাছে তেমনি ছিল। বাবার এল টি সির পয়সায় ঘুরতে আসা।”
এই এতক্ষণ মৌবনীর মনে খালি হচ্ছিল কেন সে বিল্টুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেনি, কেন তার ঠিকানা, ফোন নাম্বার নেই... এখন সে শুধু মুখ ফুটে বলল, “হ্যাঁ।“ তার মনে হলো, এই এতসব পার হয়ে দেখাটা না হওয়াটা খুব দরকার ছিল।
“ঠিক আছে। আপনি এখানে সময় কাটান। আমার আবার ছেলেদের নিয়ে গিরিডি যাওয়ার আছে। চলি। তবে সাপখোপ থাকতে পারে। সাবধানে।“ বলে ভদ্রলোক তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। মৌবনী কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে।
নীচে এসে দেখতে পেল কেয়ারটেকার লোকটি একইভাবে দাঁড়িয়ে সদর দরজার কাছে। ওকে দেখতে পেয়ে হাসল।
“হালত দেখা হ্যায় না? ছোটা সাব কো বাতানা। পাতা নাহি কব ইয়া সারে গির পড়েগা!”
মৌবনী বলল, “য়ো সাব কাঁহা গয়া?”
“কওন?”
“যো আভি আয়ে থে। আভি ত নিকালা।“
“কই নেহি আয়া! ম্যাঁয় তো ইহাঁ পে হি খাড়া হুঁ।“ লোকটার মুখে নিখাদ বিস্ময় খেলা করে যায়।
মৌবনী কিছু না বলে বেরিয়ে আসে। ঝোপ জঙ্গল ভেদ করে গেট খুলে বাইরে আসে। আবার একটা মৃদু ‘ক্যাঁচ’ করে শব্দ হয়। পিছন থেকে লোকটা আবার মনে করিয়ে দেয়, “ছোটা সাব কো বোলনা, ম্যাডাম। ভুলিয়ে মৎ...”
ওরা গিরিডি যখন পৌঁছাল তখন প্রায় একটা বাজে। মেয়েরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল হই হই করে। মিসেস বাসু আবার ঊল বোনেন। মৌবনী মজা করে বলল, “তোমায় কেমন নন্দিনী মালিয়ার মতো দেখাচ্ছে। ‘নিমন্ত্রণ’এর। একটা গান কর না, প্লিজ।“
মিসেস বসু গান গাওয়ার ব্যাপারে লজ্জা পাননা সেরকম। টীচার্স রুমেও মাঝে মধ্যেই তাঁর গলার গান শোনা যায়। একটা পাথরের উপর বসে তাই বিনা বাক্যব্যয়ে শুরু করলেন –
“দূরে কোথায় দূরে দূরে
আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে।
যে বাঁশিতে বাতাস কাঁদে সেই বাঁশিটির সুরে সুরে॥...”
সেন্ট উইলিয়ামের ছেলেরা ফিরছিল। সঙ্গে সেই ভদ্রলোক। মৌবনী দেখল। কিন্তু এখন আর সেরকম চেনা মনে হলো না। ভদ্রলোকও পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মিসেস বসুর গানের আওয়াজে একবার তাকালেন। মৌবনীর দিকে চোখ পড়লেও তাতে পরিচয়ের কোনও ছোঁয়া পাওয়া গেল না। সেন্ট উইলিয়ামসের বাসের দিকে এগিয়ে গেলেন তাড়াতাড়ি।
আকাশটা মেঘলা করে এসেছে। উশ্রী নদী দেখতে গেলে দিনটা কি বিশ্রী হতেই হয়? কে জানে! মিসেস বসুর গান তখন অন্তরা পার হয়ে সঞ্চারিতে পড়েছে,
“...যে পথ সকল দেশ পারায়ে
উদাস হয়ে যায় হারায়ে
সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে ॥”
0 comments: