2

গল্প - মৌলি ঘোষ

Posted in


গল্প


রঙ 
মৌলি ঘোষ 



“হাওড়া যাওয়ার ট্রেন এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। হাওড়া যাওয়ার ট্রেন এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে।” 

ঘুম জড়ানো অস্পষ্ট স্বর। শেষের দিকের শব্দগুলো ক্রমশ বাতাসে মিলিয়ে যায়। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শম্ভু উঠে বসে। ভোর থেকে এই নিয়ে তিনবার। তার মানে এখন ছ’টা বাজে। অন্যদিন এত সকালে সে ওঠে না। প্রথম ট্রেন চারটেয় যায়। ঘড়ঘড়ে মাইকের আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে। কিন্তু সে ওঠে না। বাতিল লুঙ্গিতে মোড়া জীর্ণ মশারির বিচিত্র শেপের পাশবালিশটার ওপর ঠ্যাং তুলে দৃশ্যহীন শব্দাবলী-টুকরো কথার ক্যালাইডোস্কোপ জাপটে পড়ে থাকে। তারপর সাতটার দিকে উঠে আটটার দিকে বেরোয়। 

আজকে কিছুতেই সেই আধো ঘুমের আমেজটা আসছে না। 

বিছানার তলা থেকে লম্বা সরু কঞ্চিটা বের করল। বিছানা বলতে মেঝেতে মাদুরের ওপর একটা কাঁথা আর একটা কম্বল। কম্বলটা কয়েক বছর আগে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে দিয়েছিল। কাঁথাটা গোলাপির নিজের হাতে করা, এটা ওপরে থাকে। কিছু সুতো গোলাপি নিজেই দোকান থেকে কিনে এনেছিল। আর কিছু ঝুপড়িতে এর-তার থেকে জোগাড় করেছিল। প্রায় মাস তিনেক ধরে একটু একটু করে বানিয়েছিল। শম্ভু রোজ জিজ্ঞেস করত “কতদূর হলো ক্যাঁতা ?” কাঁথাটায় গোলাপির গায়ের গন্ধ লেগে থাকত। 

কাঁথার ওপর অনেক পুরোনো একটা চাদর পাতা। দু-তিন জায়গায় একটু ফুটো হয়েছে, তবে চলে যাচ্ছে এখনো। রঙটা চটে গেলেও বেশ পরিষ্কার। শম্ভু এক সপ্তাহ বাদে বাদে কলতলায় বসে নিজেই রগড়ে রগড়ে ধোয়। চাদরটা নিজেই পছন্দ করে কিনেছিল চেনা ফেরিওয়ালার কাছ থেকে, তাতে একটু কমে পাওয়া গেছে। লোকটা বলেছিল “আর চারটেই পড়ে আছে। বড়ো বড়ো ফুলছাপ, একটাতে পুতুলের ছবি, একটাতে পাতা পাতা নক্সা দেওয়া, আরেকটা লোডশেডিং পিরিনটের।” শম্ভু মুচকি হেসে বলেছিল “ওই লোডশেডিং পিরিনটটা আমার কথা ভেবেই এনেচ নাকি মিয়া?” 

দেওয়াল ঘেঁষে পাতা বিছানাটার চার ফুট মতো ওপরে কাঠের জানলাটা। ছিটকিনি নেই, ঝড়-বাদলার দিনে একটা থান ইঁট দিয়ে এঁটে রাখা হয়। কঞ্চি দিয়ে পাল্লাটা ঠেলতেই তাজা হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল, সাথে বেল ফুলের মিষ্টি গন্ধটা। শম্ভু বুক ভরে গন্ধ নিয়ে চাদরের তলায় হাত ঢুকিয়ে কাঁথাটার গায়ে হাত বুলিয়ে গোলাপির স্পর্শ নিতে থাকল। 

চারটের ট্রেন ছাড়লে শম্ভুর ভোর হয়। তখন থেকে সকালের কোলাহল শুরুর আগে পর্যন্ত সময়টা তার খুব প্রিয়। ছোটোবেলায় এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে বইয়ের দোকানের যে জ্যাঠা, তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল “জ্যাঠা ভোরের রঙ কেমন গো?” জ্যাঠা বলেছিল “ধূ্র্ পাগলা। ভোরের আবার রঙ কি?” তারপর একটু ভেবে বলেছিল “সাদাই হবে।” জ্যাঠার উত্তরটা শম্ভুর পছন্দ হয়নি। জ্যাঠা যে বলে টিকিটঘরের বাইরে শিব মন্দিরের খেঁচো বামুনের সবকটা চুল পেকে সাদা। ‘তাইলে!’ খেঁচো বামুনকে শম্ভুর পছন্দ নয়। ওকে দেখলেই সে দুচ্ছাই করে বলত “অজাত-কুজাতের বাচ্চা এসে জোটে সব। ছুঁসনি যেন।” –বলে আওয়াজ করে দু-চারটে প্রসাদি ফল-বাতাসা, কখনো একটা লুচি ওর বাটিতে ফেলে দিত। 

ভোরের রঙ তবে সাদা নয়। 

- তুমি জানো না জ্যাঠা। 

- বটে? তবে কি রঙ শুনি? 

শম্ভু চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবেছিল। - ঘুম হালকা হালকা ভাঙতেই দূর থেকে ভেসে আসা রেডিওতে বন্দেমাতরম। দু-একটা পাখির ডাক। ওর পায়ের কাছে গুটিসুটি মারা কুকুরটার আদুরে কেঁউকেঁউ। রাস্তার ধারে খোলা কলটা থেকে জল পড়ার সোঁদা শব্দ। কেউ একজন সাইকেলে যাবার সময় অকারণেই ঘণ্টি বাজিয়ে গেল। চটি ফটফটিয়ে শম্ভুকে টপকে একজন ওভারব্রিজের দিকে চলে গেল। ওর পায়ের আওয়াজ শম্ভুর জানা। ওর গায়ে লেগে থাকা মাছের আঁশটে গন্ধটা সে চিনতে পারে। একেএকে প্ল্যাটফর্মের দোকানগুলোর জেগে ওঠার গন্ধ পায়। দোকান খুলে কেউ ধূপ দেয়। গন্ধটা হাওয়ায় ভেসে আসে। চায়ের দোকানদারের দুধে চা পাতা ভেজানোর গন্ধ ‘আহ্’। 

এই সময়ে প্রতিটা শব্দ-গন্ধ শম্ভু আলাদা আলাদা করে বুঝতে পারে, চিনতে পারে। শম্ভু বলেছিল “না জ্যাঠা, ভোরের বোধহয় আলাদা কোনও রঙ নেই। অনেক কিছু মিশে গিয়ে, অনেক রঙ মিলে গিয়েই বুঝি ভোরের রঙ। সুন্দর আর খুব নরম সেই রঙ।” 

পচা মাছের গন্ধে শম্ভুর গা’টা গুলিয়ে উঠল। কঞ্চিটা দিয়ে খুব সাবধানে জানলাটা ঠেকিয়ে দিল, আওয়াজ হলো না একটুও। অন্যদিন তো এসময়ে কেউ রান্না করে না। তবে ঝুপড়ির কেউ আজ সকাল সকাল কাজে বেরোবে হয়তো। 

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে বাঁকিয়ে-চুড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে গুনে গুনে ঠিক দশ পা। আগে গুনতো, এখন আর দরকার হয় না, ঠিক খাটিয়াটার সামনে দাঁড়াল। মুখোমুখি দেওয়াল দুটোর গা ঘেঁষে দুজনের বিছানা। প্রথম যেদিন খাটিয়া পাতা হলো, শম্ভু উল্টোদিক থেকে আসার সময় বুঝতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। কপালের কাছটা কেটে গেছিল সামান্য। 

মেঝেতে বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে বুঝল বালিশ থেকে ঘাড়টা নেমে কাত হয়ে আছে। আলতো করে মাথাটা তুলে বালিশে রেখে দিল। বেশ কয়েক মাস চুলটা কাটানো হয়নি। কপালের ওপর পড়ে থাকা ঝাঁকড়া চুলগুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল। চুলের মধ্যে আঙুলের নাড়াচাড়া। ঘুমন্ত ছেলেটার গায়ে যখনই হাত দেয়, আজও সেই প্রথম দিনের সন্তানকে স্পর্শ করার অনুভূতি। 



উদ্বিগ্ন শম্ভু জিজ্ঞেস করেছিল- 

- গোলাপি সব ঠিক আছে তো? 

- হ্যাঁ গো, চাঁদপানা। গোল গোল চোক করে তোমাকেই দেকচে। গায়ের রঙ ফসসা। বাপের দিকেই গেচে। 

তুলতুলে শরীরটায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বাপ তার ছেলেকে দেখেছিল। ওর গায়ের গন্ধ, শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ, ওর প্রতিটা কান্নার ধরন শম্ভু বুঝতে পারত। 

সব্বাই বলেছিল তার ছেলে নাকি সিনেমার হিরোদের মতো দেখতে। শম্ভুর ছেলের নাম তাই হয়ে গেল হিরো। হিরো যখন একটু বড়ো হলো, বুঝতে শিখল, তখন ঝুপড়ির কিছু ডানপিটে ছোকরা প্রায়ই তাকে “হেরো হেরো” বলে খ্যাপাতো। শম্ভু সামনে থাকলে ছেলেগুলোকে যে ভাষায় গাল দিত তাতে সভ্য সমাজ কানে আঙুল দিলেও ওদের সমাজে সেটাই স্বাভাবিক। বজ্জাতগুলো এতে আরো উচ্চস্বরে “হেরো হেরো” বলে হাসত। হিরো তাদের সাথে মারপিট করতে গিয়ে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরত। শম্ভু তাকে কাছে টেনে আদর করতে গেলে ছেলে বাপকে আঁচড়ে-কামড়ে অস্থির করে তুলতো, কান্না ভেজা গলায় খিস্তি করত। 



ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা লাল যত্ন করে মুছে দিল। হিরো নামটা দেওয়া তবে ঠিক হয়নি! শম্ভুর নাম রেখেছিল খেঁচো বামুন। জ্যাঠার পছন্দ হয়নি নামটা। 

- শম্ভু মানে কি জ্যাঠা? 

- শিব। শিব ঠাকুর। খেঁচো কম করে শ খানেক ছেলের নাম দিয়েছে শম্ভু আর শঙ্কর। আগেরটা নিশ্চয় শঙ্কর দিয়েছিল। তোর বেলা শম্ভুর পালা। 

- শিব ঠাকুর কেমন দেখতে? 

- বেশ সুন্দর দেখতে বুঝলি তো। আধবোজা চোখে মুচকি হেসে ক্যালেন্ডারের ভেতর থেকে আমাদেরই দেখছে। তেনার আবার তিনটে চোখ, কপালে একটা। গলায় সাপ জড়ানো। হাতে ত্রিশূল, সে কেমন জানিস? 

শম্ভুর হাতটাকে টেনে নিয়ে বুড়ো আর কড়ি আঙুল দুটো মুড়ে বলত “এইরকম। একটা লাঠির ওপর তিনটে কাঠি। - এঃ, তোর হাতগুলো বড্ড সরু। বাঁচবি কী করে ব্যাটা!” ওর মাথাটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলত “তোর নাম কিশোর হলে বেশ হতো। এত ভালো গলা তোর।” 

কোনো একটা কলি গুনগুন করতে গিয়ে শম্ভু থেমে যায়, ছেলেটার যদি ঘুম ভেঙে যায়। গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে হাঁটুর কাছে এসে থমকে যায়। 

- কী হবে ডাক্তারবাবু! ওই এক ছেলে বৈ জগতে আর কেউ নেই আমার। দয়া করে— 

- প্রাণে বেঁচে যাবে। সে নিয়ে কিছু ভেবো না। তবে পা দুটো বোধহয়- 

- কি? 

- বাদ দিতে হবে। রাখা যাবে না। উপায় নেই আর। 

বেচো ধরে না ফেললে শম্ভু পড়েই যেত। কানের মধ্যে অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকার গোঙানি। মাথার ভেতর কারা যেন দাপাদাপি করছে। মাথাটাকে ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। অসহায় ক্ষোভে চোখদুটো কচলাতে থাকে। নিজের ওপর তীব্র ঘেন্না হচ্ছিল শম্ভুর। চোখ থাকলে কিছুতেই ছেলেকে চোখের বাইরে হতে দিত না। 

জ্যাঠা ছুটে গিয়ে জল এনেছিল। একটু ঠাণ্ডা হবার পরে শম্ভুর হঠাৎ নিজেকে খুব নিশ্চিন্ত মনে হয়েছিল। এবং সাথে সাথেই নিজের সেই বোধ সম্পর্কে সচেতন হয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। 



খাটিয়ার নিচে রাখা ট্রাঙ্কের ঢাকনাটা খুলে মলম ওষুধটা বের করল। অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসটার বয়স প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ পেরিয়েছে। বেচো কোত্থেকে বন্ধুর জন্যে কম দামে কিনে এনেছিল। শম্ভু ওকে টাকা দিয়ে দিয়েছিল। যদিও তার ধারণা বেচো মালটা ঝেড়েছিল। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। বাজারের থেকে তো অনেক কমে হয়েছিল। 

মলমটা আঙুলে নিয়ে পায়ের ক্ষতে লাগায়। ঘা’টা আগের তুলনায় কমে এলেও পুরোপুরি শুকোয়নি এখনো। ডাক্তারবাবুও বলেছে সময় লাগবে। 

হিরো একটু নড়ে ওঠে। অল্প হেসে ওঠে। অস্পষ্ট কিছু বলে ওঠে। শম্ভুর মনে হয় তার কিশোর ছেলে দেয়ালা করে হয়তো। হিরো যখন ছোটোবেলায় দেয়ালা করত, গোলাপি খিলখিল করে হেসে উঠত। শম্ভু জিজ্ঞেস করত 

- কি হলো? হাসিস কেন? 

- তোমার ছেলে দ্যায়লা করচে গো। 

- সে আবার কি? 

- আ মরণ! তুমি দ্যায়লাও জানো না? কী লোকের সাথেই ঘর করচি! 

ঘর অবশ্য বেশিদিন করেনি গোলাপি। 



শম্ভু উঠে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথার কাছটায় একটা পুরোনো রেডিও, বিড়ি এক বাণ্ডিল, তাজমহল ছবি দেওয়া এক বাক্স দেশলাই, দুটো কালি ফুরোনো পেন আর একটা জলতরঙ্গ। আঙুল দিয়ে যন্ত্রটায় একটা টোকা মারল। ভোঁতা আওয়াজ হলো একটু। জিনিসটা কয়েক বছর আগে হিরো কোত্থেকে কুড়িয়ে ঘরে এনেছিল। জ্যাঠা বলেছিল “এতো জলতরঙ্গ রে। এটা দিয়ে সুর বেরোয়। বাজানোর জন্য দুটো বাতিল পেনও দিয়েছিল। ছেলে কদিন সেটা নিয়েই মেতে রইল। সারাক্ষণ ওটা নিয়েই ঘোরে। ঘুমোবার সময়েও কাছছাড়া করত না। কদিন পর একঘেয়ে হয়ে গেলে সেটাকে ঘরের কোনায় ফেলে রাখল। শম্ভু সেটা তুলে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। রোজই রাতের দিকে সে বাজায়। মিষ্টি আওয়াজটা শম্ভুর একচিলতে ঘরটুকুতে ঘুরপাক খেতে থাকে। কখনো কখনো পেনগুলো দিয়ে অসম্ভব দ্রুত যন্ত্রটায় পেটায়। আবার কখনো খুব ধীরে সময় নিয়ে একটা একটা পর্দা বাজায়। কান পেতে শোনে সুরের মিলিয়ে যাওয়া। ওর মনে হয় প্রতিটা পর্দার নিজস্ব একেকটা রঙ আছে। প্রতিটা পর্দা- প্রতিটা সুর কিছু বলতে চায়, হয়তো বিশেষ কোনও মনোভাব। শম্ভু সেটা বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারে না। 



শম্ভুর যখন কাজ থাকে না কোনও তখন সে অনেক কিছু ভাবে। একই কথা বারবার বারবার ভাবে। গোলাপির কথা ভাবে। তার কী একবারও শম্ভুর কথা মনে পড়ে না! পেটের ছেলেটাকেই বা কী করে ভুলে থাকে। গোলাপি ফিরে এলে শম্ভু এখনো তাকে ঘরে তুলবে। বৌকে সে এখনো ভালোবাসে। শম্ভু ঝুপড়ির কথা ভাবে, কখনো কখনো নিজের বাপ-মা’র কথাও ভাবে। তার মতো পরিবার পরিত্যক্ত জন্মান্ধ একজনকে এতগুলো অজানা-অচেনা মানুষ নিজেদের হাজারটা সমস্যা সত্ত্বেও কেন যে এত ভালোবেসে বাঁচিয়ে রাখল সেটা এক রহস্য। জ্যাঠাই তাকে প্রথম দেখেছিল। না, শুনেছিল, তার কান্না। খুঁজতে গিয়ে দেখেছিল তাকে, প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্তে বেঞ্চের নিচে তোয়ালে জড়ানো অবস্থায়। 

- বুঝলি ব্যাটা, গিয়ে দেখলুম সাদা তোয়ালে জড়ানো, বেশ দামিই মনে হলো, একটা ধবধবে পুতুল। কান্নার চোটে মুখটা নেপলার দোকানের চেরি ফলের মতো লাল। একটা হাত তোয়ালের বাইরে বের করে কি যেন ধরতে চায়ছিলি। 

- তারপর? তারপর কি হলো? 

শম্ভু যে কতবার এটা শুনেছে। প্রতিবার একইরকম কৌতূহল নিয়ে শোনে। 

খুব যখন ছোটো তখনো শম্ভুর খাওয়া পরার কোনো অভাব ঘটেনি। ঝুপড়ির কেউ না কেউ ঠিক খাইয়ে দিত। এ-ও জামাটা-কাপড়টা দিয়েছে। এমনকি খেঁচো বামুনও বাড়ির গাছের কলাটা-আমটা তাকে এনে দিয়েছে। সব থেকে বেশি করেছে জ্যাঠা। সেই বোধহয় এ দুনিয়ায় শম্ভুকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসে। শম্ভুও জ্যাঠা বলতে অজ্ঞান। যেটুকু যা শেখা-জানা, তা এই মানুষটার জন্যই। দিনের বেশিরভাগ সময়টা তার এই মানুষটার সাথেই কাটত। 

- ওইটা কি ডাকে? 

- কাক। পাখি একটা। 

- পাখি কি? 

- সে একটা জীব। তোর-আমার মতো নয়। চেহারায় অনেকটাই ছোটো। দুদিকে ডানা আছে। আকাশে উড়ে উড়ে যায়। 

- সে কি! ওদের পা নেই? 

- সেও আছে। তবে আমাদের মতো না। 

- ও জ্যাঠা ডানা কি গো? 

- উঃ। জ্বালালি মাইরি। কাজ তো নেই এই করি আর কী! 

খানিক গজগজ করে শম্ভুর হাতদুটো বুকের দুপাশে ছড়িয়ে হাওয়ায় দুলিয়ে দুলিয়ে ওড়ার ভঙ্গিমায় নাড়িয়ে বলত “এই হচ্ছে ডানা বুঝলি।” শম্ভু খিলখিলিয়ে হেসে উঠত। হিরোর যখন সাত-আট মতো বয়স, শম্ভু একদিন ছেলেকে বলেছিল “পাখি কেমন করে ওড়ে দেখবি?” হিরো বলেছিল “তুমি তো অন্ধ। কি করে জানলে কেমন করে ওড়ে ?” হিরোর বাবা চুপসে গেছিল। 



জ্যাঠাই একদিন আবিষ্কার করেছিল শম্ভুর গলায় বেশ সুর আছে। দোকানে বসে রেডিওতে শোনা গানটাই শম্ভু গুনগুন করছিল। জ্যাঠা শুনে বলেছিল “তুই তো ভালো গাস রে ছোঁড়া। ব্যাস চিন্তার শেষ। তোর আর ভাতের অভাব হবে না বুঝলি।” 

কয়েকদিনের মধ্যেই রেডিওতে শুনেশুনে দু-তিনটে গান কিছুটা তুলে নিল শম্ভু। জ্যাঠার নির্দেশ মতো কখনো গুনগুন করে কখনো গলা ছেড়ে গেয়ে রপ্ত করে নিল। দোকানের দিকে কাউকে আসতে দেখলেই জ্যাঠা শম্ভুকে খোঁচা মেরে দিত, সে গান ধরত। অনেকে কেনার পরে একটু দাঁড়িয়ে ওর গান শুনত। কেউ কেউ হয়তো আদর করে বিস্কুটটা-কেকটা দিত। একদিন একটা মাঝবয়সি দিদিমনি শম্ভুকে দশ টাকা দিল। সেই তার প্রথম রোজগার। 

এরপর একদিন সে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজের নিচে ডানদিক ঘেঁষে বস্তা পেতে বসতে শুরু করল। শম্ভু তখন তেরো। তার ছেলেটার বয়সও এখন তেরো। 



পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা সুন্দর চেহারার এক অন্ধ ছেলে প্ল্যাটফর্মে বসে গান গাইছে। ঠিক আর পাঁচজন ভিখারির মতো নয়। গলাটাও বেশ। কম-বেশি সকলেই আকৃষ্ট হতো। ট্রেন আসতে দেরি থাকলে কেউ কেউ আবার বিশেষ কোনও গান শুনতে চাইত। কেউ কেউ কিছুই দিত না, আবার অনেকেই খুশি হয়ে পকেট ভারী করা, ভিখারিদের জন্য বরাদ্দ বাড়তি খুচরোর থেকে কিছুটা বেশিই দিত ওকে। শম্ভু কখনো কোনোদিনও নিজে মুখ ফুটে একটা পয়সাও চায়নি কাউকে। 

শম্ভুর ছেলে চায়। বাপের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে না পেলে বাপের থেকেই চুরি করে। টের পেয়ে শম্ভু যখন সে উপায় বন্ধ করল, তখন বাপকে দেদার খিস্তি মেরে এর-ওর কাছে চাইতে লাগল। 

জ্যাঠাই এসে শম্ভুকে সব বলল। জ্যাঠার কাছেও হিরো টাকা চেয়েছে। কয়েকজন ইয়ার্ জুটেছে তার। তাদের সাথে নানারকম নেশাটেশা করে। গোলাপি থাকলে হয়তো এরকম হতো না। সে ছেলেটাকে চোখে চোখে রাখতে পারত। 

শম্ভু আবার বিছানা ছেড়ে ওঠে। তেষ্টা পেয়েছে খুব। জানলাটার একটু পাশেই মেঝেতে বোতলগুলো রাখা থাকে। কিনতে হয়নি। জল শেষ হয়ে গেলে প্লাস্টিকের বোতলগুলো অনেকেই ফেলে রেখে যায়, বেচো কয়েকটা এনে দিয়েছিল। এর জন্য অবশ্য পয়সা নেয়নি। এক বাণ্ডিল বিড়ি দিয়েছিল শম্ভু ওকে। জল খেয়ে আবার বিছানায় এসে বসে। 

শম্ভু ভাবে গোলাপি থাকলে হয়তো আজকের দিনটাই আসত না। সবকিছু সুন্দর গুছিয়ে রাখতে পারত। নিজের পরিবার-নিজের একটা সংসার শম্ভুকে উপহার দিয়েছিল গোলাপি। 

ছোটোবেলায় একবার জ্যাঠার সাথে মেলা ঘুরতে গিয়েছিল শম্ভু। কোথায় কি হচ্ছে সেটা বলে বলে দিচ্ছিল ওকে। অনেক কিছু খাইয়েছিল, আর একটা বেলুনও কিনে দিয়েছিল। 

- বেলুনটা কেমন অন্যরকম লাগে, মাঝের দিকটা একটু ভেতরে ঢোকানো। অমন কেন গো জ্যাঠা? 

- ওটা হার্টশেপ বেলুন। এই তোর-আমার-আমাদের ধুকধুক ধুকধুক করছে যে হৃৎপিণ্ডটা সেটার মতো দেখতে। 

- কি রঙের? 

- লাল। লাল হলো গিয়ে ভালোবাসার রঙ, বুঝলি ? 

শম্ভু মানতে পারেনি। লাল তার কাছে ভয়ের রঙ। আতঙ্কের রঙ। তার কয়েকটা দিন আগেই হাজারো দাবিদাওয়া নিয়ে বিরোধী পার্টি রেল অবরোধ করেছিল। পুলিশের সাথে ছেলেপুলেদের ঝামেলার মাঝে শম্ভু দিশেহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল। এক ছোকরার ছোঁড়া ঢিল মাথায় লেগে মাথা ফেটে যায়। যতোটা না আঘাত তার থেকে বেশি ভয়ে সে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। জ্যাঠা সেদিন সকালে দোকান খোলেনি। বিকেলে এসে খবর পেয়ে ঝুপড়িতে ছুটে গেছিল। 

- সবাই বলচে অনেকখানি রক্ত বেরিয়েচে। 

- ধুর ব্যাটা ভুল বলছে সব। এই দু-তিন ফোঁটার বেশি বৈ নয়। 

- রক্তের রঙ কি জ্যাঠা ? 

- লাল 

সেই থেকে শম্ভুর লালে ভয়। লাল নয়, ভালোবাসার রঙ শম্ভুর কাছে গোলাপি। 

শম্ভুর রোজগারপাতি অন্য ভিখিরিদের চেয়ে একটু বেশিই। উপরন্তু খরচাপাতি সামান্যই। বিড়ি বৈ অন্য নেশা নেই। জ্যাঠাই বলেকয়ে ঝুপড়িতে তার জন্য একটা আলাদা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। শম্ভুর যখন সুখের সময়, যখন সে যুবক তখন এসে জুটল গোলাপি। রাতবিরেতে কোত্থেকে এসে ধূম জ্বর নিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চের ওপর প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। দুদিন সেখানেই ছিল। কেউ জিজ্ঞেস করলে একটাই উত্তর দিয়েছে। তার কেউ নেই, কিছু নেই। টিকিট ঘরের গায়েই পূর্বদিকের চায়ের দোকানের যে বুড়ি মাসি সেই নিজের ঘরে গোলাপিকে থাকতে দিল। বুড়ো মারা যাবার পরে নিঃসন্তান বুড়ি হিমসিম খাচ্ছিল সব কাজ সামলাতে। সে দেখল এতে তার সুবিধাই হবে। শুধু ঘরে তোলার আগে গোলাপির গলায় কালো কারে বাঁধা রংচটা লকেটটা হাতে নিয়ে দেখে নিয়েছিল ছবিটা হনুমানজির। এগুলো শম্ভু জ্যাঠার কাছেই শুনেছে। 

মেয়েটা বেশ তৎপর। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গুছিয়ে নিল। দেখে বোঝা যেত না যে মাত্র ক-টাদিন আগেই এসেছে। কয়েকদিন পরেই শম্ভুকে এসে পাকড়াও করল “ও সাহেব ওই গানটা একবার শোনাও না গো। ওই যে গুলাবি আঁখে।” শম্ভু গানটা প্রায়ই গাইত। সেদিনও গেয়েছিল সকালের দিকে। সে বুঝল মেয়েটা তার গান শুনেছে। 

শম্ভু গেয়েছিল। অন্তরের সবটুকু সুর উজাড় করে গেয়েছিল। অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই গলা ছেড়ে গেয়েছিল। 

পরেরদিন গোলাপি বুড়ির হেঁশেল থেকে শম্ভুর জন্য বাটি করে পুঁইচচ্চড়ি এনেছিল। শম্ভুর মনে হয়েছিল এমন স্বাদ সে জন্মে খায়নি। 

- তোর নাম কি? 

- ধরে নাও গুলাবি। গোলাপিও বলতে পার। 

শম্ভু মনে মনে ভেবেছিল মেয়ে বেশ চৌখস। 

- বুড়ির থেকে নুকিয়ে আনচিস? 

- মাইরি, বুড়ির কাচে তোমার নাম করেই এনেচি গো। 

মিথ্যেটুকু ধরতে শম্ভুর অসুবিধা হয়নি। 

- কেমন হয়েচে? 

আঙুল চাটতে চাটতে প্রয়োজনের বেশি টাকনায় আওয়াজ তুলে শম্ভু বলেছিল ‘অমিত্যি’। 

মাস ফুরোতে না ফুরোতেই শম্ভু জ্যাঠাকে গিয়ে বলেছিল সে গোলাপির সাথে ঘর করতে চায়। 

- টের আমি পেয়েছি। বসেছিলাম কখন নবাবপুত্তুর এসে কথাটা পাড়বেন। তা বাবা এ যে বাঁদরির গলায় মুক্তোর মালা। তোর এমন চেহারা আর সে বেটির তো রূপের কোনো ছিরি নেই। গায়ের রঙ বুড়ি মাসির চায়ের কেটলির তলাটা থেকেও কালি। 

এ কথা শম্ভুর অজানা নয়। বেচোর কাছে সে আগেই শুনেছে। 

- উপরের রঙ দিয়ে কি হবে জ্যাঠা ? মানুষের ভেতরকার রঙটুকুই তো মনে রাখার। 

- সাব্বাশ। এসব শিখলি কোথ্থেকে বাপ? 

শম্ভু অল্প হাসে। 

- মন্দিরের সামনে যে সাধু বাবা মাঝে মাঝে এসে বসে, সেই বলে এসব আমায়। জানো কি বলে? বলে, প্রতিটা মানুষেরই রঙ থাকে। আলাদা-আলাদা। সে চামড়ার রঙ নয় গো, সে হলো ভেতরের মনটুকুর রঙ। সেটেই হলো গে আসল। আবার কোনো কোনো মানুষের নাকি অনেক রঙ। উপর থেকে বোঝা যায় না। গিরগিটের মতো অবস্থা বুঝে নাকি রঙ পাল্টায়। আবার কেউ নাকি নিজেই নিজের রঙটুকু সারাটা জীবন ধরেও চিনে উঠতে পারে না। 

- হুমম। ঠিকই বলে হয়তো। তাহলে তোর যা মনে হয় তাই কর। 

জ্যাঠা একটু চুপ করে থাকে। তারপর নিচুস্বরে বলে “নেহাত তোর জাত-ধর্ম কিছুই জানি না। নইলে তোকে আমার বেটির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নিজের ঘরেই তুলতাম। আমার ওই মা মরা একমাত্র সন্তান, আমার কাছেই থাকত। দোকান তো শখের। জমি-জিরেত যা আছে তোদের দিব্য চলে যেত। কিন্তু ওই একটাই যে---” 

প্ল্যাটফর্মের প্রান্তে ন্যাড়া বেঞ্চটায় বসেছিল দুজনে। ওদিকে আলোটা একটু কম। শম্ভু মুখটা নিচু করে বসেছিল। নইলে, জ্যাঠা তার ব্যাথায় নীলচে পড়ে যাওয়া মুখটা দেখতে পেত। খুব কষ্ট পেয়েছিল শম্ভু। মনে হয়েছিল খেঁচো বামুন আর জ্যাঠার রঙ বোধহয় একই। জ্যাঠার ভেতরে কোনও এক খেঁচো বামুন ঘাপটি মেরেছিল। শম্ভু টের পায়নি এতদিন। 

রাতে শুয়ে শুয়ে শম্ভু ভেবেছিল যাইহোক, জ্যাঠা ছিল তাই, নইলে শম্ভুর জীবনটা কবেই চোরাগলির বাঁকে বয়ে যেত। 



মন্দিরে সিঁদুর দিয়ে মালা গলিয়ে বিয়ে। চাঁদা তুলে সবাই সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু বাসনপত্র উপহার দিয়েছিল। জ্যাঠা হাজার টাকা আর একটা শাড়ি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিল। ভালোই চলছিল। গোলাপি শম্ভুকে বেশ যত্নআত্তিই করত। দেড় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে ছেলেও এল। ছেলে যখন বছর তিনেকের তখন থেকেই খুটুর খুটুর অশান্তি শুরু। শম্ভু ঝামেলার মানুষ নয়। গোলাপির মেজাজই সব সময় চড়ে থাকত। শম্ভু কাছে গেলেই কখনো শরীরের দোহাই দিয়ে কখনো ভালো লাগছে না বলে মুখ ঝামটা দিয়ে সরে যেত। শম্ভুর কোলে ছেলে ফেলে বেশিরভাগ সময় সে মাসির দোকানেই কাটাত। 

এরপর একদিন গোলাপি পালাল। সাথে বিহার থেকে আসা মাসির জোয়ান ভাইপোও। 

শম্ভু অবাক হয়নি। মনে হয় সে আগে থাকতেই আভাস পেয়েছিল, মেনেও নিয়েছিল। কাছের মানুষগুলো নিজেদের সুখ নির্মাণে তার মতো জগদ্দলকে প্রত্যাখ্যান করবে এটাতে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। সে ছেলে নিয়েই বেশ ছিল। ছোটো ছেলেটাকে সামলাতে তার সমস্যা হয়নি কোনো। জ্যাঠা আর ঝুপড়ির মেয়ে বৌরা খুব সাহায্য করেছে। 

ছেলেকে ঘিরেই তার ভেতরে সুখের গুঁড়োগুঁড়ো দানা জমাট বাঁধছিল। -একটা শান্তির ঘর, হিরোটা বড়ো হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তখন শম্ভু আর প্ল্যাটফর্মে বসবে না। সে ছেলেকে বলবে তাকে একটা জলতরঙ্গ কিনে দিতে। 

কিন্তু ছেলেটা বড়ো হতে থাকল যখন তখন শম্ভু বুঝতে পারছিল, ছেলের স্বপ্নে বোধহয় বাপের জন্য কোনো জায়গা নেই। অথচ নিজের শখ-নেশা মেটাতে সে বাপের কাছেই পয়সা নেয়। হিরো তার বাপকে নিয়ে বেশ বিরক্তই। একে ভিখিরি তার ওপর অন্ধ। ইয়ার দোস্তদের কাছে শম্ভুকে নিয়ে তার অস্বস্তির শেষ নেই। 

শম্ভু আকাশ পাতাল ভাবে। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। নিজের বাপ মা তাকে ত্যাগ করেছে বলে তার আজ পর্যন্ত কোনো আপশোস হয়নি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক সে ঝুপড়ির মানুষগুলোর সাথেই বড়ো হয়েছে। এদেরকেই নিজের আপন বলে ভেবেছে। এই ঝুপড়িতেই যেন তার জন্ম হয়েছে। এখানের মানুষগুলোই তাকে জীবন দিয়েছে। তার ছেলেও এখানে জন্মেছে। ছেলের ছেলেও এখানে জন্মাবে, বড়ো হবে। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু না, হিরো তা মানতে চায় না। এই ঝুপড়িটাকে সে প্রচণ্ড ঘেন্না করে, সাথে ঝুপড়ির মানুষগুলোকেও। সে এখান থেকে বেরোতে চায়। 

- তোমার মা-বাপের কোনও খবর তুমি জানো না? তোমাকে যখন ফেলে রেখে গেসলো সাথে কিছুটি দেয়নি? 

- না বলেচি তো হাজারোবার। বিশ্বেস না হয় তোর বই দাদুকে গিয়ে জিগেস কর। 

- তাদের আর দোষ কোথায়! এরম বোঝা ছেলে আর কোন বাপ-মা বইতে চায়। কদিন পরে আমার কাঁধে বোঝা হয়ে বসবে। 

গলায় একরাশ বিরক্তি। এ কথাগুলো অনেকবার তার বাপকে বলেছে হিরো। প্রতিবার গলায় ঝাঁজের মাত্রা আগের তুলনায় একটু একটু করে বাড়তে থাকে। কারা যেন তার মাথায় ঢুকিয়েছে তার মতো চাঁদপনা নাতি দেখলে দাদু-ঠাগমা আর ফেলতে পারবে না। আর যাই হোক তারা ঝুপড়িতে থাকে না নিশ্চয়। 



শম্ভুর জাবর কাটায় একটা ছোট্ট কমা পড়ে। হিরো ঘুমের ঘোরে কাকে যেন দুটো খিস্তি মেরে চুপ করে গেল। 

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোতে গিয়েও বেরোতে না পেরে আবার শম্ভুর শ্বাসনালীর ভেতরে সেঁধিয়ে গেল। কারণ ঠিক সেই সময়েই ঠ্যাং ভাঙা একটা আরশোলা শম্ভুর গোড়ালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শুঁড়ের নাড়াচাড়া আর রোঁয়াওয়ালা পাগুলো থেকেই সে বুঝেছিল এটা আরশোলা। শম্ভু শিকারির মতো ক্ষিপ্র গতিতে খপাৎ করে ধরেই হাতের তালুতে সেটাকে চটকে পায়ের দিকের দেওয়ালে ছুঁড়ে দিল। 



“আমার টাকা লাগবে। আমি আর এ ঝুপড়িতে থাকব না।” –মাস ছয়েক আগে হিরো যেদিন কথাটা বলেছিল শম্ভুর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। 

- থাকবি না! মানে? 

- বোম্বে যাব। 

- বোম্বে। কেন? 

- সিনমার হিরো হতে। ওকেনে আমার বাপ বসে আছে কিনা! ন্যাকামো যত্ত সব। কাজ করতে যাব। 

- কিসের কাজ? কে দেবে? 

- পলাশের মামা সেকেনে সোনার কাজ করে। পলাশকে নে যাচ্ছে। আমাকেও যেতে বলচে। 

কাঁপা হাতে ছেলের কাঁধ ছুয়ে ডুকরে উঠেছিল শম্ভু। 

- আমাকে ফেলে চলে যাবি বাবা? একেনেই না হয় একটা কিছু কাজের- 

- কি করব? তোমার মতো বাটি হাতে বসব? ভিখিরি শালা! 

শব্দ করে থুতু ফেলে হিরো উঠে চলে গেছিল। 



শম্ভু হিরোকে যেতে দেয়নি। হাত খরচা আরো একটু বাড়িয়ে দিয়েছিল। জ্যাঠাকে তো বটেই ঝুপড়ির সব্বাইকে ডেকে ডেকে বলেছিল তারা যেন হিরোকে বোঝায়, সে যেন না যায়। 

জনে জনে হিরোকে ডেকে বোঝাতে লাগল। এতে তার মেজাজ আরো বিগড়ে গেল। যে তাকে বোঝাতে আসে তাকেই সে গাল দেয়। প্রায় রাতেই ঘরে ফেরে না। হাত ফাঁকা হলে তবেই বাড়ি আসে। আগে তবু খোশ মেজাজে থাকলে বাপের সাথে একটু গল্পটল্প করত। এখন ‘টাকা লাগবে’ বাদে বাড়তি একটা শব্দও খরচা করে না। 

মাস তিনেক আগে সে একদিন মাঝরাত গড়িয়ে বাড়ি ফিরল। জড়ানো গলায় বাপকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ। বাপ-বেটায় বেশ কিছুক্ষণ বচসা চলার পর হিরো ধাক্কা মেরে শম্ভুকে ফেলে দিয়েছিল। চৌকাঠে মাথা ঠুকে ফুলে গেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঝুপড়িতে সে সময় যারা জেগেছিল, ছুটে এসেছিল। বেগতিক দেখে হিরো পালায়। 

দুদিন আর কোনো পাত্তা নেই। তিনদিনের দিন বেলার দিকে, শম্বু তখন কলতলায়, জ্যাঠা বেচো আরো কয়েকজন এসে হাজির। - হিরো আর তার এক শাগরেদ বাইকে যাবার সময় বেসামাল হয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে, হাসপাতালে ভর্তি। 

হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছনোর মাঝের রাস্তাটুকু শম্ভু নিজেকে কুটতে কুটতে গেছে। তার মনে হয় এর থেকে ছেলেটাকে যেতে দিলে হয়তো ভালোই হতো। সংসারের সব সম্পর্কগুলো তাকে ছেড়ে রেখে ফেলে রেখে চলে যায়, সেটা তার নিজেরই দোষে। তারই অক্ষমতা। 

হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তারবাবুর কাছে পা’টা বাদ যাবার কথা কথা শুনে আঘাত পেয়েছিল মারাত্মক। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে তার মনে হয়েছিল, যাই ঘটে যাক না কেন শেষ পর্যন্ত ছেলেটা তার কাছেই রয়ে গেল। এটা ভেবে সে শান্তি পেয়েছিল। পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনায় নিজেই সঙ্কুচিত হয়ে অনুতপ্ত উচ্চকিত বিড়বিড় করছিল “আমার জন্যেই এমনটা হলো। দায়ী, আমিই দায়ী।” বারবার একই কথা বলে একটু আগের ভাবনাটা শম্ভু নিজেই নিজের কাছে চাপা দিতে চাইছিল। 

বেচো বলেছিল “ঠাণ্ডা হ। তোর দোষ কি আছে এতে? ছেলের বেয়াদবির ফল এটা। তবে এতে বোধহয় ভালোই হলো জানিস। ছেলেটা তোর কাছেই রয়ে যাবে।” 

চমকে উঠেছিল শম্ভু। বেচো কী তবে কিছু টের পেল! 

হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবার সময় ডাক্তারবাবু কলকাতায় গিয়ে আরেকটু ভালো চিকিৎসা, যদি নকল পায়ের একটা ব্যাবস্থা করা যায়, সেরকম একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জ্যাঠা বলেছিল ধার করে-দেনা করে-একেতাকে ধরে টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে ঠিক। রাজি হয়নি। শম্ভুই রাজি হয়নি। সে বলেছিল “ছেলেটার মাথায় আর দেনার বোঝা চাপাতে চাই না।” 

দৃষ্টি থাকলে শম্ভু দেখতে পেত, জ্যাঠা থমকে গিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কি জানি কি ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিল। 



ঘরে ফেরার পর থেকেই ছেলেটা সারা সময় ব্যাজার হয়ে থাকে। বাপের ওপর চোটপাট করে না ঠিকই তবে বেশি কথাও বলে না। বেশির ভাগ সময়টাই শুয়ে শুয়ে রেডিও শোনে। শম্ভুর কাজ আর দায়িত্ব দুটোই বেড়েছে। নিজেকে বেশ প্রয়োজনীয় মনে হয় তার। নিজের সংসারে সে বেশ গুরুত্বপূর্ণ, এই উপলব্ধিটুকু খুব তৃপ্তির। সে হাসি মুখে সব কিছু সামলায়। 

শম্ভু হাসি মুখে সবটুকু সামলাতে পারে কারণ সে দেখতে পায় না, হিরো তার বাপের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে কি যেন বোঝার চেষ্টা করে। তার চেরা দৃষ্টি বাপের ভেতরটা ফালা ফালা করে কি যেন খোঁজে। 



আর শুয়ে থাকতে পারে না। শম্ভু উঠে কলতলায় গিয়ে স্নান করে আসে। ঘরে ঢুকে টের পায় হিরোও উঠে গেছে। ভিজে গামছাটা তাড়াতাড়ি ছেড়ে লুঙ্গিটা পড়ে মাসির দোকান থেকে দুটো চা আর পাউরুটি নিয়ে আসে। ছেলের হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে তার পাশে বসে পড়ে। ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে আদর দেয়। জ্যাঠার সাথে শম্ভু আলোচনা করে রেখেছে। হিরোকে ওভারব্রিজের ওপরে পশ্চিম দিকটায় বসাবে। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে ছেলেটার। দিনেদিনে অভ্যেস হয়ে যাবে ঠিক। ছেলেটা একটু সামলে উঠুক, স্বাভাবিক হোক, তারপর তাকে দু-একটা গান শিখিয়ে দেবে বলেও ঠিক করেছে। এতে হিরোর রোজগারে সুবিধেই হবে। আজ থেকে ছেলেটার রোজগার শুরু। বাপ-বেটায় ঠিক চলে যাবে। আর এতগুলো বছর ধরে অল্প অল্প করে শম্ভুও কিছু জমিয়ে রেখেছে। জ্যাঠা ছাড়া আর কেউ অবশ্য জানে না সে কথা। 

বাপ ছেলেকে তাড়া দেয় “তাড়াতাড়ি খেয়ে নে বাবা। বেরোতে হবে তো।” 

জামাটা গলাতে গলাতে শম্ভু গুনগুন করে “ম্যায়নে তেরে লিয়ে হি সাত রংগ্ কে সপ্নে চুনে...” 

হিরোর নখগুলো তখন কোলের ওপর রাখা বালিশের খোল ভেদ করে ন্যাতানো গুটলি পেকে যাওয়া তুলোর মণ্ডগুলোর ওপর গেঁথে যাচ্ছে। ছেলে বাপের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। ঘৃণা-বিদ্বেষ-তীব্র আক্রোশ মেশানো সেই চাহনির রঙ হিরোর বাপের অজানা। 

2 comments: