0

প্রবন্ধ - নিলয় কুমার সরকার

Posted in

প্রবন্ধ


মুসাহারদের জীবনকথা
নিলয় কুমার সরকার


বিহারের মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার সমভূমি! স্থান গাজী কারমেইনির নেচুয়া জালালপুর! প্রাক চৈত্রের বাতাস যেন এখনি পাথর গলায় তার তীব্র দাবদাহে! এই তীব্র দহনে তখনও কৃষি ক্ষেত জুড়ে কাজ করে চলেছে

একটা ভূমিদাস সম্প্রদায়! স্থানীয় জনজীবনে যাদের পরিচয় 'মুসাহার' কাজ করছে শুধু পুরুষ নয় গােটা কয়েকটা পরিবার! শুধু তাই নয় সঙ্গে রয়েছে নাবালক শিশুপুত্র, কন্যা পর্যন্ত! জমি, মাটি, কৃষি, সেচ, ফসল তােলা, শস্য বপন, সবই তাদের কান্না ঘাম রক্ত আর শ্রমের উপহার! সবই তাদের কিন্তু কিছুই তাদের নয়! ওরা

ভূমিহীন শ্রমজীবি ওরা 'মুসাহার'-যাদের স্থানীয় পরিচয় দলিত।

এই জনগােষ্ঠীর উৎস সন্ধানে অনুসন্ধিৎসু হয়ে দেখলাম প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ননী মাধব চৌধুরী তাঁর "ভারতবর্ষের অধিবাসীর পরিচয়"-গ্রন্থে লিখেছেন ঝারখণ্ড অঞ্চলের মুন্ডা-ওরাও ট্রাইব সম্প্রদায় কতকগুলি। উপগােষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে! এরাই স্থানভেদে কোথাও ধাঙ্গর কোথাও মুসাহার নামে পরিচিত! অনান্য সূত্রে জানলাম মুসাহাররা হিন্দু ধর্মাবলম্বী! এদের দেখা যায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, নেপাল, হিমালয়ের তড়াই, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানের কৃষি শ্রমিক হিসাবে! এরা আত্ম পরিচয়ে জানায়, তারাই আর্য, এবং তারাই ভারতের আদিম বনবাসী! বিহারে এদের পরিচয় রাজওয়াড় নামে, আবার মালভূমি অঞ্চলে এদের পরিচয়- 'মাঝি'! আদি সূত্রে এদের পেশা ইঁদুর ধরা! এদের বংশানুক্রমিক লােককাহিনী থেকে দেখি -"সৃষ্টির আদি দেবতা পরমেশ্বর মানুষ কে সৃষ্টি করলেন ও একটি ঘােড়া উপহার দিলেন, এই পৃথিবীটাকে ঘুরে ঘুরে নিজের মত করে প্রত্যক্ষ করার জন্য! কিন্তু আদিপিতা প্রথম মুসাহার ঘােড়ার পেটে একটা গর্ত করলেন, তার পিঠে ওঠার জন্য! আর এই কারণে দেবতা পরমেশ্বর রুষ্ট হলেন ও শাস্তি দিলেন ইঁদুর ধরার পেশাদার জাতি হিসেবে!

বর্তমানে এই শ্রমজীবী সম্প্রদায়কে দেখতে পাওয়া যায় পূর্ব উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উত্তর মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি অঞ্চলে! বর্তমানে এরা প্রধানতঃ ভােজপুরী ভাষাতেই কথা বলে! ভােজপুরী ভাষায় 'মুষ' মানে ইঁদুর বস্তুতঃ যে শব্দটা এসেছে সংস্কৃত 'মুষিক শব্দ থেকে! আর মুসাহার মানে হলাে যারা আদিম প্রথায় ইদুর ধরে খায়। (মুষ+আহার)! এরা আদিতে ট্রাইব গােষ্ঠি ভুক্ত হলেও বিহারে এরা আত্মপরিচয়ে জানায় তারা রাজওয়া বা রাজবংশী হিসেবে! যার ইঙ্গিত হল তারাই আদি ক্ষত্রিয়! এই দাবি অবশ্য উচ্চবর্ণ হিন্দু ক্ষত্রিয় গােষ্ঠী স্বীকার করেন না! তারা বলেন ওরা অচ্ছুত ওরা দলিত! বর্তমানে মুসাহার জনগােষ্ঠি আরও তিনটি উপগােষ্ঠিতে বিভাজিত! বর্তমানে তাদের বলা হয় ভগৎ, সাকতিয়া, এবং তুর্কাহিয়া! বর্তমানে মুসাহাররা ইঁদুর ধরা ও খাওয়ার অনুষঙ্গে অভ্যস্ত নয়!

বর্তমানে এরা পেশায় ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক মাত্র, শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের ক্ষীণ জনগােষ্ঠীর একটি সীমারেখায় সীমিত! আত্মপরিচয়ে এরা যদিও হিন্দু তবুও এরা প্রায় সমস্থ উপজাতি কুলদেবতাকে মানে ও পুজো দেয়! বিহারের কোথাও কোথাও এদের গভীর খনিতে দুর্মূল্য পাথর সংগ্রহের কাজে লাগিয়েছে ভারত সরকার! যেমন গােমেদ ও এমিথিস পাথর সংগ্রহের কাজের এরা দক্ষ কারিগর! সরকারি বদান্যতায় কিছু জনের পারিশ্রমিক ও ভালাে! এই জনগােষ্ঠির শিক্ষার হার সাকুল্যে ৩% এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে যা আরও ১%কম! পরিবেশ গত কারণে এই জনগােষ্ঠির অপুষ্টি, কৈশাের মাতৃত্ব, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, প্রভৃতি সমস্যার হতভাগ্য শিকার হয়ে ক্ষয়িষ্ণু! প্রায় প্রতিবছরই এই জনগােষ্ঠীতে কিছু না কিছু ক্ষয়ক্ষতির ছাপ রেখে যায়! লােকায়ত প্রথায় হঁদুর খাওয়া ছাড়াও খুব উন্নত মানের দেশি মদ তৈরির কৌশল এরা জানে! শুধু তাই নয় এদের সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই পানাসক্ত!

দানাপুরের ৪৫-বছর বয়সী প্রতিভা দেবীর কথা ভাবা যাক, একটা ভাঙ্গা কুড়ের সামনে বসে আনমনে ধুমপান করছিলেন! তিনি যেন আজও উদাস হয়েই অপেক্ষা করছেন, একমুঠো সামাজিক ন্যায় বিচারের! তথা মানবিক অবমূল্যায়নের প্রকৃত প্রতিকারের! হঠাত্ কোথা থেকে বৃষ্টি এলাে, তার একমাত্র সম্বল রাতের। কম্বলখানা বাঁচাবার তাগিদে দৌড়লেন! এই হল মুসাহার সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার দৈনন্দিন চিত্র! এই হল। বিহারের' গরিবী রাজ'-এর প্রান্তিক প্রজাদের ইতিকথা! ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈষম্য, দৈন্যতা, সাম্য ন্যায়, সামাজিক ন্যায় বিচার যেখানে সুদূরের স্বপ্ন! যদিও এই সম্প্রদায়ের মানুষ বিহার ঝাড়খণ্ডের ক্ষণস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী ও হয়েছেন তবুও স্বাধীনতার পর এতগুলাে বছর পার করে আসার পর ও সমাজ ইতিহাসে যারা আজও অচ্ছুত বলেই চিহুিত! আজও তারা মানবিক অধিকারে বৈষম্যের বলি প্রদত্ত একটি সম্প্রদায়!

বিহারের বিভিন্ন স্থানে মুসাহার সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে পরিচয় বহন করে উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গা, এবং মধুবনি অঞ্চলে এদের বলাহয় 'সদা' বা সদয়! মধ্য বিহারে যেমন পাটনা, নালন্দা, ও রােহতাস অঞ্চলে এদের বলা হয় 'মুসাহার' 'মন্ডল' বা 'মাঝি'! গয়া, বুদ্ধগয়া ইত্যাদি দক্ষিণ বিহারে এদের পরিচয় 'ভূঁইয়া' অথবা 'ভােক্তাস'! সম্ভবত প্রাকস্বাধীনতা যুগে ঝাড়খণ্ডের 'গুমলা' অঞ্চল থেকে উত্তর রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দাস হিসেবে পাঠানাে হয়েছিল (report :-Ramaghundam 2001)! জনগণনায় ১৯৫১ সালের পর থেকে এখানে তাদের সিডিউল কাস্ট হিসেবে দেখানাে হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে যে এরা সারাদিন ১৮ ঘন্টা কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকার বিনিময়ে পায় ৩-৪ কেজি দানাশস্য পারিশ্রমিক হিসেবে! এটাই তাদের সম্প্রদায়ের দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অপুষ্টি, ও অনাহারের একমাত্র কারণ! সমীক্ষায় (২০০২ সালের) দেখা গেছে যে ২২ জন মুসাহার শুধু চম্পারণ জেলায় না খেতে পেয়ে মারা যায়! জেলা শাসক উচ্চবর্ণের হওয়ায় তাকে সরকারি ভাবে নথিভুক্তই করতে দেয়া হয়নি! ঐ সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দেশ বিদেশের নানান NGO গুলি সাহায্যের সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হলেও, সরকারী ভাবে কোনাে রিলিফ পাওয়ার সুযােগই ঘটেনি।

বিহার সময়ের দর্পণের একটা রাজ্য নীরব সাক্ষী হয়ে থাকলাে অনেক বঞ্চনা অনেক অপমানের! ১৯৯৩ ২০০৩/২০১৩-২০১৮ র নির্ধারিত সময়কালে এই দলিত সম্প্রদায় ৪২৪৩-টা ও ৫০১৬-টা অভিযােগ নথিভুক্ত করতে পেরেছেন! বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিবিধ থানায়! সমস্ত অভিযােগই গিয়ে দাঁড়ায় উচ্চবর্ণের সমাজপ্রভুদের অবিচার ও শােষণের বিরুদ্ধে! যে সময়কালে ৬৯৪ জন ও পরবর্তী পর্বে ৩৩৩ জন মুসাহার কে হত্যা করা হয়েছে! অন্যদিকে প্রথম পর্বে ২০৪৯ জন ও পরবর্তী পর্বে ৩৬৬৭ জন মুসাহার নারী ধর্ষিত হয়েছেন কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের লালসার শিকার হিসেবে! এছাড়াও প্রায় ২৭৮৯ জন নাবালক ও নাবালিকা নিয়ত যৌন-লাঞ্ছনার শিকার! নৈরাশ্য, ক্ষুধা, বস্ত্রহীন জীবন, যে অবিচারের দৃশ্য নিয়ত বর্ণনা করে! হয়ত স্মরণে থাকবে ২৩শে মার্চ ১৯৯৭ দেশের সমস্থ সংবাদ পত্রের শিরােনাম হয়ে ছিল :-"রণবীর সেনার হাতে নিহত ১০ মুসাহার"! এই রণবীর সেনা হলাে উচ্চবর্ণের ঘরােয়া সশস্ত্র সেনা বাহিনী! যারা নিয়মিত বেতন ভােগী! সূর্যমনি দেবী, রামুনা দেবী, বাচ্চিদেবী, মানাে দেবী, শান্তি দেবী-রা হলেন সেই সব হতভাগ্যদের বিধবা স্ত্রী! যাদের দুচোখের জল আজও খুঁজে বেড়ায় সরকারিভাবে একটা প্রত্যয়, একটা সুষ্ঠ বিচার!

কথা ছিল প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের একএক জন-কে কোথায় যেন একটা সরকারী চাকরি দেয়া হবে!!

কান্না হাহাকার হয়ে ফেরে, সময়ের হাওয়ায় হাওয়ায়! শূন্যতা মেটেনা!

0 comments: