0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড-৫ 
শিবাংশু দে
 

বিংশ শতকের শুরুতে সম্ভ্রান্ত বাঙালির অন্দরমহলে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে একটা অন্য ধরনের সামাজিক মন্থনও শুরু হয়েছিলো। অমলা দাশ ছিলেন বিখ্যাত দুর্গামোহন দাশের ভাই ভুবনমোহন দাশের কন্যা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভগ্নী। এছাড়া তিনি ছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর ঘনিষ্ট সহেলি। অমলা ও মৃণালিনীর অন্তহীন মেয়েকথার ধারাস্রোত কবিকে প্রেরিত করেছিলো একটি গান রচনা করতে, ''ওলো সই, ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই''। ইতোপূর্বে ঠাকুরবাড়ির দুই মেয়ে প্রতিভা ও ইন্দিরা চৌধুরীবাড়ির বৌ হয়ে এসে 'সঙ্গীত সঙ্ঘ' নামে একটা গানের ইশকুল খুলেছিলেন। 'ভদ্র'ঘরের মেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিলো সেখানে। কিন্তু তখনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের প্রকাশ্যে গায়ন ছিলো অকল্পনীয় কৃত্য। সেই পরিবেশে অমলা প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাঁর সাঙ্গীতিক পারদর্শিতা ছিলো অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় কোন গান রচনা করলে সেটি তৎক্ষণাৎ অমলাকে শিখিয়ে দিতেন। বস্তুতঃ দিনু ঠাকুরের আগে অমলাই রবীন্দ্রনাথের গান লিখে রাখার কাজটি করতেন। তাঁর বোনঝি সাহানা দেবী এবং হেমেন্দ্রমোহন বসুর কন্যা মালতী বসুর (ঘোষাল) প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা অমলা'র কাছেই হয়েছিলো। 


এই তিন কন্যা ও অমিয়া রায় (ঠাকুর) এবং কনক দাশ (বিশ্বাস) ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের একটি নতুন মানচিত্র প্রস্তুত করে দেন। এঁদের গান নিয়ে এ পর্যন্ত বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সঙ্গীত পরিবেশনের কোন জাদু এতোদিন পরেও শ্রোতাদের মজিয়ে রাখে, সেই সূত্রটি খুঁজতে তাঁদের তৎকালীন রেকর্ডগুলি একটু অভিনিবেশ সহকারে শোনা প্রয়োজন. এঁদের পাঁচ জনের মধ্যে সাধারণ সূত্র যে'টি রয়েছে তা' হলো, এঁরা প্রত্যেকেই ব্রাহ্মসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং জীবনের কোন না কোন পর্বে কবির থেকে সরাসরি গান শুনেছেন ও শিক্ষা নিয়েছেন। 'শিক্ষা' বলতে আমি সুরটি তুলে নেওয়া বোঝাচ্ছি না। তাঁরা যে শিক্ষাটি পেয়েছেন তা হলো 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ঠিক কীভাবে গাওয়া উচিৎ। এঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সুকণ্ঠী, নিখুঁত সুরেলা এবং ওজনদার স্বর। সেই সময়ের তালিম অনুযায়ী তাঁদের ছিলো মীড়প্রধান গায়কি এবং নানা সূক্ষ্ম অলঙ্করণ অবলীলায় কণ্ঠে ধারণ করতে পারতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে অকারণ গলা ঘোরানোর মোহ থেকে মুক্ত ছিলেন। কণ্ঠের ওজস ছিলো মুক্ত ও সতেজ। অর্থাৎ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক এবং সব থেকে জরুরি যে শর্তটি রয়েছে, সংযম ও পরিমিতিবোধ, সেই শিক্ষাটি তাঁরা সযত্নে আত্তীকৃত করেছিলেন। সেকালের অদক্ষ রেকর্ডিং যন্ত্রের ত্রুটি ছাপিয়ে তাঁদের এই পরিবেশন ক্ষমতা এখনও বিস্ময়কর লাগে। যন্ত্রানুষঙ্গ হিসেবে স্রেফ হারমোনিয়াম বা অর্গ্যান, কনক দাশের সঙ্গে লয় ধরে রাখতে গিটারে অনুচ্চ স্ট্রোক ব্যবহৃত হয়েছে। কখনও সামান্য বাঁশির ছোঁয়া। কোনও তালবাদ্য ব্যবহার হয়নি। সাহানা দেবী একবার বলেছিলেন কবি নিজে কখনও তালবাদ্যের সঙ্গে গীত পরিবেশন করেননি, যদিও স্বরলিপির সঙ্গে তালের উল্লেখ সতত রয়েছে। শান্তিদেব সাহানা দেবীর এই মতটির বিরোধিতা করেছিলেন। সম্প্রতিকালে এক প্রিয় শিল্পী প্রয়াতা রমা মন্ডল কোন রকম যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যতিরেকে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সেটি শুনলে আবার প্রমাণ হয় কোন স্তরের আত্মবিশ্বাস থাকলে আশি-নব্বই বছর আগে পঞ্চকন্যা এই ধরনের ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন। কণ্ঠসম্পদ ব্যতীত তাঁদের সফলতার সম্বল ছিলো রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক নতুন শিল্পমাধ্যমটি থেকে আনন্দ সন্ধানের নিরন্তর প্রয়াস। আমার ধারণায় এই উপলব্ধিটিই পরবর্তীকালের সফল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের প্রধান অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। 


সেই ধ্বনিতে চিত্তবীণায়.. 

এই শিল্পীদের পরিবেশন পদ্ধতিটিকে আদত জোড়াসাঁকো শিক্ষণের রূপ হিসেবে ধরা যেতে পারে। অমলা দাশ বিংশ শতাব্দীর প্রথম-দ্বিতীয় দশকে যেভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং যে রেকর্ডগুলি করেছিলেন, তার থেকে এই শৈলীটি সম্বন্ধে একটি ধারণা তৈরি করা যায়। তাঁর গাওয়া, 'অয়ি ভুবনমনমোহিনী', ' কে বসিলে আজি' বা ' ঐ রে তরী দিলো খুলে' অথবা ' তোমার গোপন কথাটি' ইত্যাদি গানে ভবিষ্যতের রবীন্দ্রসঙ্গীতের পথটি কী রকম হবে তার কিছু আভাস পাওয়া যায়। যদিও আজ শুনলে মনে হবে সামান্য তাড়ায় পড়ে গাইছেন। মাঝে মাঝে সুরচ্যুতও হয়ে যাচ্ছেন। সেটা কতোটা কণ্ঠের জন্য বা রেকর্ডিং যন্ত্রের জন্য তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। কিন্তু সেই গান'কে আজকের বিচারেও পরিপূর্ণ রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসেবে চিনে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান নির্দিষ্টভাবে পরিবেশনের রূপরেখা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াস মনে হয় কাজে আসছিলো। কারণ ১৯২৫ সালে মিস নীহারবালার গাওয়া ' এবার উজাড় করে নাও হে আমার' তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে অনেক পরিণত ও স্বীকার্য বোধ হয়। 


অমলার কাছে যাঁরা সরাসরি গান শিখেছিলেন, তাঁর বোনঝি সাহানা দেবী এবং মালতী বসু, তাঁদের গায়কীতেও বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নপদ্ধতির বিবর্তনটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাহানা দেবীর গুণমুগ্ধ কবি স্বয়ং তাঁকে আহ্বান করে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যখন প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে রাতারাতি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে পন্ডিচেরি চলে যান দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে, কবি অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি যদি দেশের রাজা হতেন তবে সৈন্য পাঠিয়ে সাহানা'কে শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে আনতেন। ভাবা যায়, ১৯২৮ সালের রবীন্দ্রনাথ, যাঁর 'পদতলে' ততোদিনে প্রায় সমগ্র কীর্তির সাম্রাজ্য পড়ে আছে, তিনি সাহানা দেবীর কণ্ঠে নিজের গান শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এই ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় স্বয়ং কবির মনে তাঁর গানের কোন মডেলটি প্রকৃতপক্ষে ধরা ছিলো। সাহানা দেবীর গাওয়া যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি তাঁর নামের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেছে, যেমন 'খেলার সাথি', 'রূপে তোমায়', 'আহা তোমার সঙ্গে', 'নতুন করে পাবো', 'তিমিরদুয়ার খোলো' বা 'যদি প্রেম' ইত্যাদি তার সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হয়েছে। নতুন করে বিশেষ বলার নেই। কিন্তু কয়েকটি গান, যেমন 'আমার যাবার বেলায়', 'শুকনো পাতা কে ঝরায়', 'যদি তারে নাই চিনি গো' বা 'ওদের সাথে মেলাও' শুনে আমার প্রতীতি হয়েছে, যে কথাটা ইতোপূর্বে কবির নিজের ভাষায় ঊদ্ধৃত করেছি এবং অবিরাম শুনে আসছি ছোটোবেলা থেকে, যে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকৃতপক্ষে আগে কবিতা পরে গান, তার চেয়ে বড়ো সত্য কিছু নেই। সুরবিন্যাসটি আধারমাত্র, হিরণ্ময় পাত্রের মতো, তার কাজ কবিতার অমৃতটিকে ধরে রাখা শুধু। সুরের যাবতীয় চাকচিক্য, বহির্মুখী প্রিয়ত্ব, সবই অন্তঃস্থ কবিতাটিকে গরিমান্বিত করার আয়োজন মাত্র, সেই খানেই তার সার্থকতা। 



এই উপলব্ধিটি মালতী ঘোষালের গান শুনেও অনেকের মনে হয়েছিলো। তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা নগণ্য, কিন্তু যাঁরা তাঁর গান সাক্ষাতে শুনেছেন তাঁরাও এই রকম একটি ধারণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত 'ট্রেইন্ড' শিল্পী, সঙ্গীতের কৃৎকৌশল সম্পূর্ণ আয়ত্ব ছিলো তাঁর। তিনি আর কিছু গান যদি নাও করতেন, শুধু 'এ পরবাসে রবে কে'র রেকর্ডটির জন্য তাঁকে চিরকাল মনে রাখা যেতো। শোরী মিঁয়ার মূল পঞ্জাবি টপ্পাটিতে সুর খেলানোর যে মজা রয়েছে, তা'কে সংযত শিল্পবোধে পোষ মানিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সূক্ষ্ম অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম যে শিল্প কবি সম্ভবতঃ তাঁর সৃষ্টির থেকে প্রত্যাশা করতেন, মালতীর উপস্থাপনায় তার প্রকাশ ঘটেছিলো। অমিয়া ঠাকুরেরও রেকর্ড প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু তাঁর গায়নভঙ্গির নিজস্বতা কবিসহ সবাই স্বীকার করেছিলেন । একটা গল্প শুনেছি, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দ্রোণাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার স্বয়ং কবিকে বলেছিলেন 'মরি লো মরি' গানটি শিখতে তিনি কলকাতায় অমিয়াদির কাছে যেতে চা'ন। তাই শুনে কবি ছদ্ম খেদ প্রকট করেন এই বলে যে স্বয়ং রচয়িতা মজুত থাকতে অমিয়ার প্রতি এ রকম পক্ষপাতিত্ব তাঁকে ঈর্ষিত করে। 


তবে এঁদের সবার মধ্যে অধিক সময়কাল সৃষ্টিপর ও প্রভাবী ছিলেন কনক দাশ (বিশ্বাস)। তিনি তাঁর গানের সঙ্গত হিসেবে হারমোনিয়াম বা অর্গ্যানের সঙ্গে গিটার, বাঁশি ও তালবাদ্য ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবহারের সংযত মাত্রা গান ও গায়নের সঙ্গে অবলীলায় একীভূত হয়ে গিয়েছিলো। পূর্বোক্ত শিল্পীদের গানে যে দাপট ও মজিয়ে দেওয়া সুরেলা উপস্থাপনা আমরা পেয়েছি, কনক দাশের গানেও তা পূর্ণ মাত্রায় উপস্থিত ছিলো। শব্দের স্পষ্ট উচ্চারণ এবং তা'কে ধরে রাখা স্বরের স্থিতি সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর গাওয়া অনেক গানের মধ্য থেকে কয়েকটি গান, যেমন, 'আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা', 'দিনশেষের রাঙা মুকুল', 'কাছে যবে ছিলো', 'এখনও গেলোনা আঁধার' বা 'আসা যাওয়ার পথের ধারে', তো এখনও পুরোনো হলোনা। 



0 comments: