1

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রবন্ধ


ফকিরাণি কথা—৩
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


মানুষের কার কখন কি মনে হয়,কে জানে! যে মুসলিম বন্ধুটি (আমি বন্ধুই বলব, যদিও তখনও তাঁর সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না, তবু তিনিই আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিলেন এই জগত সম্বন্ধে জানার ব্যাপারে। আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।) সেদিন আমার বাড়ি থেকে উঠে চলে গিয়েছিলেন পরে আবার কোনদিন আসবেন বলে, তিনি যে সত্যিই দুদিন পর আমার বাড়ি আসবেন, আমি ভাবিনি। যদিও তাঁর কিছু নিজের কাজ ছিল, তবু আমার কৌতূহল তো মিটেছিল। এ তো কম কথা নয়!

সেদিন আর ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করিনি তাঁর নাম আমি আমার লেখায় উল্লেখ করতে পারব কি না, কিন্তু কি আশ্চর্য্য, তিনি নিজেই বললেন কথায় কথায় -আপনি সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করছিলেন, মুসলমান মেয়েরা ফকিরি নিয়ে ঈশ্বরের উপাসনা করতে পারে কিনা, তাই তো? ঘাড় নাড়লাম।

ভদ্রলোক একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তারপর বললেন—দেখুন, একটু খারাপ ভাষাতেই বলছি, কিছু মনে করবেন না...আপনি মহিলা তো, তাই আর কি! কিন্তু খুব রাগ হয়, জানেন...আচ্ছা বলুন তো... ঈশ্বর বলুন আর আল্লাহ্‌ই বলুন, তিনি কি কারো বাপের সম্পত্তি! তিনি কি কারো কাছে বাঁধা আছেন নাকি, যে বাঁধা লোকের কাছে ছাড়া আর কারো কাছে যাবেন না। তিনি কাকে কখন দয়া করবেন, কার ঊপর তাঁর দয়া হবে, একি কেউ বলতে পারে, আপনিই বলুন না, কেউ বলতে পারে? সে যদি কেউ বলতে না পারে,তাহলে কে তাকে পূজবে, কে তাকে ভজবে,এই নিয়ে কথা বলার কোন দরকার আছে? বলুন আপনি...আজ যদি আমার উপর তিনি দয়া করেন, আমি তাঁর কাছে যেতে চাইব না? তাঁর দয়া আমি নেব না? আপনাকে দয়া করলে আপনি তাঁর দয়া চাইবেন না...হয় নাকি এমন যে তিনি দয়া করেছেন, আর কেউ না বললে সে দয়া কেউ নেবে না? কি অন্যায় কথা বলুন তো!

একনাগাড়ে বেশ রাগ রাগ স্বরে কথাগুলো বলে থামলেন। বললাম—দাদা, চা খাবেন? -হাসলেন, হেসে মাথা নেড়ে আবার বললেন -সেদিন ঘরে গিয়ে খুব ভেবেছি, জানেন! তাই আজ চলে এলাম। কই,বলুন ...কি জানতে চান আপনি। আর হ্যাঁ, আমার নাম কবীর চৌধুরী। আপনি বলতে চাইলে বলবেন আমার নাম করে - ঈশ্বর যদি দয়া করেন, সব মানুষের তাঁর দয়া চাইবার অধিকার আছে, সক্কলের। আমি তাঁর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চা আনতে গেলাম।

চা খেতে খেতে আবার বললেন—একজন পুরুষের যদি মারফতি জীবন যাপন করবার অধিকার থাকে, একজন নারীর কেন থাকবে না বলুন তো? ঈশ্বরের দয়া কার উপর হবে কে জানে! তিনি নারী না পুরুষ, আমরা কি হাত গুণে বলতে পারি? আর মারফতি জীবন যিনি যাপন করছেন সেই নারীকে এবার আপনি ফকিরি নারী বলুন, পীর আম্মা বলুন আর ফকিরাণিই বলুন, মূলে তো এক...

এবার আর চট করে মুখের উপর বলে উঠতে পারলাম না, কিন্তু ইসলামে যে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই। যিনি এমন সহজ সরল ভাবে সকলের জন্য ঈশ্বরের কৃপার কথা বলেছেন, তাঁকে আর কিই বা বলা যায়!

একটু একথা-সে কথার পর আবার জিজ্ঞেস করলাম---কিন্তু দাদা, তবে যে বলে—ইসলামে বৈরাগ্যের কোন স্থান নেই। গৃহধর্ম পালন না করে কিছু হয় না। একথা সত্যি?

চা শেষ হলো। সঙ্গে সামান্যটা ছিল, তাও প্রায় শেষের মুখে। চামচ দিয়ে সেটুকু মুখের মধ্যে চালান করে বললেন---দেখুন, ইসলামের দুটো দিক আছে। একটা হলো তার বাহ্যিক আচার-আচরণের দিক,যাকে বলে জাহেরী। আর একটা দিক হল অন্তরের দিক, যাকে বলে বাতেনি। যারা খুব অন্তর্মুখী মানুষ,অনেকসময়ই বাইরের আচার–আচরণ মানেন না, পরোয়াও করেন না কে কি বলল। অনেকসময় তাঁর নিজের অন্তরের যে পরিবর্তন তাও কাউকে বুঝতে দিতে চান না। কিন্তু এই অন্তরের টান বা বোধ যখন খুব বেশী হয়, সংসার ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে চলে যান, একেবারে মারফতি জীবন যাপন করেন। এটাই হলো প্রকৃত মারফতি জীবন, যাকে বলছেন ফকিরি। এরাই আসল ফকিরি জীবন যাপন করেন। এদের মধ্যে কেউ যদি মুরশিদের দেখা পান, তাহলে একেবারে সাধনের রাস্তায় চলে যান।

আবার প্রশ্ন -কিন্তু সে তো ছেলেরা, মেয়েরাও? কিন্তু ইসলামে যে মুরশিদ স্বীকার করেন না। অনেকেই বলেছেন, দাদা...মুরশিদ বলে কিছু হয় না।

এবার রেগে গেলেন -কে বলেছে আপনাকে? মুরশিদ ছাড়া সাধন হয় নাকি? শুনুন, যা হয়...তাকে অন্যের কাছে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কি লাভ? যারা বলেন, তারা সত্যকে স্বীকার করেন না।

-তাহলে পুরুষদের মতো নারীরাও মুরশিদের কাছে শিক্ষা লাভ করতে পারেন?

-পারেন। এর আবার ছেলে মেয়ের কি আছে? আপনি রাবিয়ার নাম শুনেছেন? ঘাড় নাড়ি। এবার একটু জোরে।

-তবে তো জানেন।

-কিন্তু তিনি তো সুফী

-সুফী তো কি? তিনি কি ইসলাম ধর্মের নন? আচ্ছা, আপনি একজন ইসলামের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে আসুন তো, তিনি যদি ঈশ্বরের দয়া লাভ করেন, তিনি চাইবেন কিনা! কেন যে এসব মিথ্যা কথার বোঝা চাপানো হয়...! এইজন্যই এত ভুল, এত সংষ্কার...’ তিনি বিরক্ত হলেন। আমি কিন্তু বাঁচলাম। 

সেই কবে থেকে এই কথাটা শুনব বলেই তো এত ছোটাছুটি, এত পরিশ্রম...এত জনে জনে জিজ্ঞাসা,এত জনে জনের কাছে বিরক্তি আর উষ্মা সহ্য করা। হেসে বললাম -দাদা, মনটা শান্ত হলো। কতজনকে যে জিজ্ঞেস করেছি, এই কথাটি কেউ স্বীকার করছেন না...কিছুতেই তাঁদের বোঝাতে পারছিলাম না। কিন্তু দাদা, আমার যে আরো প্রশ্ন আছে! কথাটি বলতেই হাতঘড়ি দেখে উঠে পড়লেন -ওরে বাবা, আজ আর নয়। কই, প্রফেসর সাহেব গেলেন কোথায়? আমি তাঁর সঙ্গে একবার বেরোব।

সেদিন বাড়ির কর্তার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু পরে একদিন আবার তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেকথা আবার অন্যদিন।

1 comment: