0

গল্প - নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী

Posted in

গল্প


মইন মিঁয়ার ভীষণ বিপদ
নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী


বিপুল সবকিছু টিপটপভাবে করতে ভালোবাসে। সকালে উঠেই যেমন তার চাই করলা আর য়্যালোভেরার জুস। সেটা খেয়েই সে জিমে যায়। জিম থেকে ফিরেই তার হাতের কাছে চাই টাওয়েল। স্নান করে করে উঠেই চারটে ডিমের পোচ। সময় মতো হাতের কাছে কিছু না পেলেই তার দুশ্চিন্তা হয়। তার চিন্তাভাবনা খুব পরিস্কার। সে জানে তার মতো মানুষেরা আশেপাশের মানুষের থেকে একটু উঁচুস্তরের। একটু আলাদা। যখনই সে হাতের কাছে কিছু পায় না তখনই সে ভাবে - সব ঠিকঠাক হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? লোকজনে কী তাকে অবজ্ঞা করা শুরু করল। 

জীবনে সে সবকিছু সহ্য করতে পারে। অবজ্ঞা সহ্য করতে পারে না। 

তার ইচ্ছে হয় তার জীবনটা স্বপ্নের মতো হয়ে যাক। ধর, তার ওয়াইন খেতে ইচ্ছে হল, হাতের কাছে ক্যাভিয়ের চলে এল, যেদিন তার বেড়াতে যেতে ইচ্ছে হল, সেদিনই মহামায়ার স্টুডিও বন্ধ থাকল। সে আর মহামায়া চলে গেল সুইজারল্যান্ডে। সেখানে ঠাণ্ডার মধ্যে মায়ার সেই ওয়াইন খেয়ে তাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হলো। 
বিপুল জিমে বসে আছে। তার হাতে প্রোটিন শেকের গ্লাস। এসি চলছে। তবু তার গা থেকে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। মেহবুব বলল - দাদা আজকে কী ওজনটা কম করে দেব। তোমার তো তিনটে রিপিটেশন হয়ে গেল।

বিপুল বলল - চল্লিশ বাড়া।

মেহবুব বলল - চল্লিশ বাড়াব? একটু বেশি হয়ে যাবে না?

মেহবুব বিপুলের পার্সোনাল ট্রেনার। তাকে আজ বছর খানেক ধরে ট্রেনিং করাচ্ছে। বিপুল তার দিকে নিস্প্রাণ চোখে তাকাল। বিপিনের চোখের দিকে তাকিয়ে মেহবুবের পেটটা গুরগুর করে উঠল। কিছুদিন ট্রেনিং করানোর সূত্রে মেহবুব জানে এই লোকটা খুব রাগি। কথায় কথায় রেগে যায়। যত রেগে যায় লোকটার তাকানোটা তত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মেহবুব শুনেছে খুনিদের একরকম চোখ হয়। মেহবুব কোনওদিনে সজ্ঞানে খুনি দেখেনি। তার মনে হয় খুনিদের চোখ হয়তো এরকম হয়। 

সে কথা না বড়িয়ে বারবেলে ওজন লাগাতে চলে গেল। প্রোটিন শেকটা শেষ করে বিপুল বারবেলটা মাথার উপর তুলে ধরল। তার শরীরের পেশিগুলো ফুটে ফুটে উঠল। মেহবুব বিপুলের চেহারাটা দেখছিল। এই বয়সেও নিয়মিত ব্যায়াম করে করে চেহারাটা দারুণ ধরে রেখেছে। মেহবুবের মনে হলো - পেশিগুলো বলছে, কিছু একটা করতে দাও। কিছু একটা করতে দাও।


বিপুল জিম থেকে বেরিয়ে এল। বাড়ির কাছেই জিমটা। হাঁটতে হাঁটতেই চলে আসা যায়। ঠাণ্ডা বাতাস তার গায়ে এসে লাগল। সকালে আসার সময় বেশ গুমোট গরম থাকলেও এখন একটা হালকা ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। মহামায়া কাল সারারাত স্টুডিওতে কাজ করেছে. সকালে ফিরবে। তার চারটে ছবি এখন ফ্লোরে। সকাল কটায় তা সে জানে না। মোবাইলে জিজ্ঞেষ করে নিলেই হয়। তার ইচ্ছে করছে না। সে কমপ্লেক্সেরর গেটের কাছে সিকিউরিটি গার্ডটাকে জিজ্ঞেস করবে। গার্ডটা কেবিন থেকে ছুটে এসে ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে জানাবে। সে সিকিউরিটি গার্ডটিকে এইটুকু সময় নেওয়ার জন্যে একটা জঘন্য ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে দেখবে। সিকিউরিটি গার্ডটা কুঁকড়ে মুঁকড়ে একসা হয়ে যাবে। অনেক চেষ্টা করে সে এইরকম নজর দিয়ে তাকাতে শিখেছে। গার্ডটাকে যদি সে কুঁকড়ে দিতে পারে তবে সে সফল। না পারলে সে ব্যর্থ। 

মুশকিল হলো সে ব্যর্থটা সহ্য করতে পারে না। ব্যর্থ হলে সে ওপেন পার্কিংয়ে নিজের গাড়ির কাছে যাবে। একটা না একটা ছোট দাগ সে গাড়িতে বার করবেই। আর তারপরেই সে গার্ডটিকে ডেকে গালাগাল দেবে। এটাই সবল মানুষের লক্ষণ। সে দুর্বলকে সব সময় মাটিতে মিশিয়ে রাখবে। আর দুর্বল মানুষকে দুর্বল করে রাখার একমাত্র উপায় তাকে বুঝিয়ে দেওয়া - তুই দুর্বল। তুই নাকারা। ব্লাডি ইউজলেস।


গুডমর্ণিং, স্যার।

বিপুল চমকে তাকাল। এই লোকটার নাম মইন মিঁয়া। প্রায়ই সে দেখে। তার নিচের ফ্লোরে থাকে। একই কমপ্লেক্স। এখন সে বিপুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে বিপুল আসতে দেখেনি। সে গেটের কাছে গার্ডটাকে দেখতে ব্যস্ত ছিল। সে আগেও খেয়াল করেছে। লোকটা হঠাৎ হঠাৎ করে সামনে এসে যায়। যেন হাওয়ার ভিতর থেকে ভেসে এল। অথচ লোকটা হাওয়ার ভিতর থেকে আসার মতো না। বেশ দশাসই চেহারা। খুব সরল ধরনের হাসি। বেশ নির্বোধ দুটো চোখ। চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা। ভারি মিষ্টি করে কথা বলে।

আরে! মইনবাবু, কেমন আছেন?

সবই আপনার দোয়া স্যার। চলে যাচ্ছে। জিম থেকে ফিরলেন?

হুম।

মাশাল্লাহ। নিজের শরীরের দিকে আপনার নজর দেওয়া দেখে খুব ভালো লাগে। গার্ডটাকে খুঁজছেন, স্যার?

বিপুল একটু অবাক হলো। এর আগেও মইন মিঁয়া এ ধরনের সাধারণ দু একটা কথা বলেছে যা তার জানার কথা নয়। সে কিছু জিজ্ঞেষ করার আগেই মইন মিঁয়া বলল - চলি স্যার। আপনি জিম টিম করেন। গায়ে এত জোর। মাথাটা ঠাণ্ডা রাখাই কাছে অনেক বড়ো ব্যাপার। আজকে আবার লিফটটা খারাপ। আপনাকে সাততলা অবধি হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি চড়তে হবে। এই গরমে মানুষ মাথা ঠাণ্ডা রাখবে কী করে কে জানে? বৌদির নতুন ছবির গানগুলো টিভিতে দেখছিলাম। ভাবা যায় না। কী লাগছে!

বলেই মইন মিঁয়া চলে গেল। খুব দ্রুত আর চটপটে। অথচ লোকটা বেশ মোটাসোটা। এত চটপটে হয় কী ভাবে কে জানে?

বিপুল গেটে এসেই গার্ডটাকে দেখল। জিজ্ঞেষ করল - ম্যাডাম ফিরেছে? 

গার্ডটা ছুটতে ছুটতে সিকিউরিটি কেবিনের দিক থেকে তার দিকে আসার আগেই বিপুল পৌঁছে গেল নিজেদের ওপেন পার্কিংয়ের দিকটায়। তার গাড়িটা রাখা আছে। মহামায়া এখনও ফেরেনি। গাড়ির গায়ে আঙুল ঘষতেই সামান্য ময়লা উঠে এল।

বিপুল গার্ডটার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করল - আজ গাড়ি মোছার সময় খেয়াল রাখিসনি? এত ময়লা কেন?

গার্ডটা মিনমিন করে বলল - আমার গেটের ডিউটি ছিল, স্যার। খেয়াল রাখতে পারিনি। 

বিপুল ঠাস করে গার্ডটার গালে সপাটে একটা চড় কষাল। গার্ডটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে, সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছে না চড় খাবার মতো সে কী করল? 

চড়টা মেরে বিপুলের খুব ভালো লাগল। এরপর একটু ঝামেলা আছে। সোসাইটির সেক্রেটারি তাকে জিজ্ঞেষ এসে করবে, গার্ডকে কেন সে চড় মেরেছে? সে বলবে গার্ডটা তার সাথে অসভ্যতা করেছিল। বাজেভাবে কথা বলেছিল। বেশ প্রফুল্ল মনে বিপুল সিঁড়ির দিকে চলে এল, লিফট খারাপ হওয়ার ব্যাপারটা আর সেরকম তার গায়ে লাগল না।

একটু দূর থেকে গোটা ব্যাপারটা দেখে মুচকি হাসল মইন মিঁয়া। পুরো ব্যাপারটাই মানুষের মনে কিছু একটা ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ। মানুষের মনে কিছু একটা ঢুকিয়ে দিতে পারলেই তার কাজ সহজ হয়ে যায়। আর এধরনের কাজ সে সবসময় করতে পারে। এখন যেমন সে এই লোকটির মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে আজ রাগারাগি করার দিন, রাগ টাগ করা যেতেই পারে। আর রাগ করে ছুটকো ছাটকা ব্যাপারে হাত ফাত তোলাই যায়। 

লোকটাকে বিরক্ত হওয়ার তিনটে কারণ দিয়েছে সে। এক, আজ খুব গরম। দুই, লিফট খারাপ। তিন, একজন স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে সে তার স্ত্রীর ব্যাপারে কিছু কথা বলেছে। যে কথার মানে দাঁড়ায় আপনার স্ত্রী একটি মাল। একটি অতি দারুণ মাল। কথাটা সে বলেছে অন্যভাবে। তবে সে যা বলেছে তার মানে সেটাই দাঁড়ায়।

মানুষের সাব কনশাস অতি অসাধারণ ব্যাপার। একে যদি ঠিকঠাক ব্যবহার করা যায় তবে মানুষকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো যায়। এ ধরনের শক্তিমান মানুষদের সাধারণত আত্মবিশ্বাস বেশি থাকে। এদের সাব কনশাসে কিছু ঢুকিয়ে দিতে পারলে আর রক্ষা নেই। গত কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে সে বিপুলের সাথে এই কাজটা করছে। আজ তার ফল পেতে শুরু করল।

এই লোকটা তার নতুন প্রজেক্ট। এর স্ত্রী অসাধারণ রূপবতী। মহিলা একজন নায়িকা। খুব বেছেবেছে সিনেমা করে। প্রথম সারিতে না থাকলেও নিজের একটা আলাদা জায়গা বানিয়েছে। মহিলার সাথে লিফটে, লবিতে দেখা হলে মইন মিঁয়া মিষ্টি করে হাসে। মহিলার পর্দায় নাম মায়া । বরটা মহামায়া বলে ডাকে। মহিলার চোখদুটো ভারি অসাধারণ। অত্যন্ত উজ্জ্বল। সে মইন মিঁয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি তাকিয়ে হাসে। মইন মিঁয়া এখনও তার চোখের ভাষা পড়তে পারেনি। সে রাতে ঘুমের মধ্যে মহামায়ার চোখের স্বপ্ন দেখে। কোনও একদিন সে নিশ্চয়ই মহামায়ার চোখের ভাষা পড়তে পারবে।

হালকা শিস দিতে দিতে মইন মিঁয়া ফ্লাইওভার ব্রিজের দিকে দিকে এগোয়। ব্রিজের নিচে বর্তমানে চলছে তার দ্বিতীয় প্রজেক্ট।

মহামায়ার দরজার চাবিটা ঠিকমতো ঢুকছিল না। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে। ড্রাইভারটাও তাকে ড্রপ করে দিয়েই চলে গিয়েছে। সে বেচারাও কাল রাত থেকে তার সাথে ফ্লোরে পড়ে ছিল। মহামায়া আর আটকায়নি। প্যাসেজের বাল্বটা কেটে গিয়েছে। চাবির ফুটো দিয়ে চাবি ঢোকান যাচ্ছে না। 

- গাদাগুচ্ছের টাকা দিয়ে সোসাইটির এই সার্ভিস - গজগজ করতে করতে ভাবছিল পাশের ফ্ল্যাটের কাউকে ডাক দেবেন কিনা! কিন্তু সে গুড়ে বালি। ও দিকের ফ্ল্যাটে একটা ডিংক কাপল থাকে। তাদেরই মতো। ডি আই এন কে। ডাবল ইনকাম নো কিডস। তারাও বাড়ি নেই।

কেউ চটি খসখস করে উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। মহামায়া বলল - কে?

গুড ইভনিং ম্যাডাম, আমি মইন।

কী ব্যাপার?

আপনার জন্যে একটা টর্চ এনেছি ম্যাডাম।

মহামায়া একটু অবাক হলো। এই লোকটি তার নিচের ফ্লোরেই থাক। লোকটি কি তাকে লিফটে ওঠার সময় দেখেছে? হতে পারে। লোকটি কি এটাও জানে এই ফ্লোরের প্যাসেজের লাইটটা কাজ করছে না? 

মইন মিঁয়া শুধু টর্চই আনেনি, হাতে করে একটা বাল্বও এনেছে। ছোটো একটা টুলও এনেছে। চটপট সে টুলের উপর দাঁড়িয়ে বাল্ব লাগিয়ে ফেলল। টর্চটাকে জ্বালিয়ে মুখে করে ধরল। তারপর মহামায়ার হাত থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল - আসুন। 

যেন সে নিজের ঘরে মহামায়াকে ঢুকতে বলছে, এতটাই সাবলীল তার ব্যবহার। নিজেই সুইচ টিপে আলো জ্বালল। মহামায়া জিজ্ঞেস না করে পারল না - আপনি কী আমাকে উপরে উঠতে দেখেছেন? 

মইন মিঁয়া লজ্জিত গলায় বলল - আজ্ঞে না। দেখিনি। সকালে আপনার হাজব্যান্ডের সাথে দেখা হয়েছিল। উনি একবার বলেছিলেন আপনার ফিরতে রাত হবে। অনেকক্ষণ ধরে নিচের লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে আপনার খুটখাট শুনছিলাম। আন্দাজ, জাস্ট আন্দাজ। 

শুধু আন্দাজ? ইন্টারেস্টিং! আমার হাজব্যান্ডও একবার বলেছিলেন আপনি নাকি কিছু বলার আগেই সেসব কথা বলে দেন। আপনার কী পীর ফকির জাতীয় কোনও ক্ষমতা আছে? 

নাঃ আমার সেসব কোনও ক্ষমতা নেই। আসলে আমি অনেকসময় অনেক কথা বলি তা কিছু মানুষে বলে তারা নাকি আগে থেকেই ভাবছিল। ছোটবেলা থেকেই। গরীব না চিজের উপর আল্লার কুদরৎ বলতে পারেন।

হুম। বসুন চা বানাই, খান।

কিছু যদি মনে না করেন ম্যাডাম, আমি একটু আগেই চা বানিয়েছি। আপনি আর কষ্ট করে চা কেন বানাবেন? আমি দু মিনিটের মধ্যেই নিয়ে আসছি।

মহামায়ার না না বলা সত্ত্বেও মইন ঠিক দু মিনিটের মধ্যে ঘরে দিয়ে ফ্লাস্কে চা নিয়ে আসল। এবারেও মহামায়া অবাক হলো। যেন চা ফ্লাস্কে ঢালাই ছিল। সে আর কথা বাড়াল না। তার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগছে। তার ইচ্ছে করছে না আর কথা বাড়াতে। সে এখন একটা হট শাওয়ার নেবে। তারপর টানা একটা ঘুম লাগাবে। এ লোক উঠলে সে বাঁচে। বিপুল কোথায় কে জানে? ফোন, এস এম এস কিচ্ছু করেনি সকাল থেকে। সেও ব্যস্ত ছিল খোঁজ নেওয়ার সময় পায়নি।

এ লোকের ওঠবার কোনও লক্ষণ নেই। 


স্যার বেশ শরীরের যত্ন নেন। শরীর ছাড়া এ জীবনে কোনও কিছুই সারা জীবন আমাদের সাথে থাকবে না। আপনিও নিশ্চয়ই জিমে টিমে যান। খুবই ভাল। দীর্ঘদিন বাঁচতে হলে নিরোগ শরীর ও প্রফুল্ল মন খুবই প্রয়োজনীয় ব্যাপার। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি এত অপ্রয়োজনীয় কথা কেন বলছি?

মহামায়া মইন মিঁয়ার চা খেতে খেতে সত্যিই তাই ভাবছিল। 

আসলে ম্যাডাম আজ আমার মনটা বড়ো খুশি হয়ে আছে। খুশিতে বেশি কথা বলে ফেলছি।

আচ্ছা। কোনও বিশেষ কারণ? ব্যক্তিগত হলে বলার দরকার নেই। 

নাঃ নাঃ। আসলে অনেকদিন পর আমার নতুন একটি বিশেষ প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। 

কী ধরনের প্রজেক্ট? 

আমি আসলে শিশুদের নিয়ে কিছু কাজ করছি। বিশেষত মেয়েদের নিয়ে। বহুদিন ধরে ব্যক্তিগত র্স্তরে কাজ করছিলাম। একাই একাই। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আমার সাথে কাজ করতে চায় বলে জানিয়েছে। 

কী ধরনের কাজ?

ওই মেয়েদের স্বাবলম্বী করার কাজ। 

বাঃ এ তো দারুণ খবর। অনেক অভিনন্দন আপনাকে। 

আমার যদিও এসব সংস্থার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। তবু শিখে যাব। একজনকে এর মধ্যেই কাছে পেয়েছি। আরও দু একজনকে শিগগিরি পেতে চলেছি। খবরটা আপনাকেই প্রথম দিলাম। এই না চিজের জন্যে একটু মন থেকে দোয়া করবেন।

মইন মিঁয়ার চোখ ছলছলে হয়ে এসেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল - শুরু দিনগুলো ভারি কষ্টে কেটেছে জানেন তো। একলা চলো রে ধরনের। প্রথম দিকে একটা ওষুধের প্রজেক্টে কাজ করতাম। গরীবদের বিভিন্ন ওষুধ দেওয়া। মানুষজন ফ্রিতে ওষুধ দিলেও নিতে চাই তো না। আস্তে আস্তে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করলাম। একজন দুজন করে ওষুধ দিতাম। এখন তো অনেককেই..যাকগে সে কথা। কী আর বলব! অবশ্য অনেক বদগুণও আমার আছে। কোনও একটা ব্যাপারের প্রতি সমানে লেগে থাকতে পারি না। কখনও এটা করছি, কখনও সেটা করছি। একবার তো মানুষকে বিশ্বাস করাতে গিয়ে নিজের শরীরেই বেশ খানিকটা ওষুধ ইনজেক্ট করে বসলাম। প্রায় মরে যাই যাই অবস্থা।

নিজেই নিলেন? কেন?

কী বলব, ম্যাডাম। খুব কষ্টকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু কী করা যাবে। মানুষের বিশ্বাস বাড়াতে হবে তো। ম্যাডাম, আমার কথা শুনতে কী আপনার এখনও বিরক্তি লাগছে? 

মহামায়া কিছু বলল না। লোকটির কথা বলার বাহাদুরি আছে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে পজ দিচ্ছে। চা খাচ্ছে। মহামায়ার চোখের এক্সপ্রেশন দেখছে। তার প্রফেশনে স্ক্রিপরাইটাররা এভাবে গল্প বলেন। এভাবে কথা বললে শ্রোতার ইন্টারেস্ট বেড়ে যায়। 

ম্যাডাম, বোধহয় আমার কথা শুনে বোর হয়ে যাচ্ছেন। আসলে এসব কাজে কোনও হিরোইক ব্যাপার হয় না জানেন তো! খুব ঢিমেতালে কাজ হয়। তবে এর রেজাল্ট একদিন আসবেই তা আমার স্থির বিশ্বাস।

মইন মিঁয়া এবার উঠে দাঁড়াল। খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল - আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন, ম্যাডাম। সাধারণ মানুষ। যদি এই পৃথিবীতে একটা ছাপ রেখে যেতে পারি। আর একটা ছোটো অনুরোধ। রাগ না করলে বলি।

বলুন।

আমার এই প্রজেক্টগুলোর একটা নাম যদি দেন। বেশ সুন্দর কোনও নাম। আপনি ফিল্ম লাইনে আছেন। সিনেমার নাম টাম নিয়ে কাজ কারবার। এভাবে প্রজেক্ট ওয়ান, প্রজেক্ট টু এসব বলতে আর ভালো লাগে না।

আমার সিনেমার নাম টাম দেন রাইটাররা। ডায়রেক্টর, প্রডিউস্যাররা। আমার নাম টাম বিশেষ আসে না। 

আপনি যে নাম দেবেন সেটাই আমি রাখব। সে নাম যাই হোক না কেন। আপনি যদি নাম দেন ফালতু প্রজেক্ট, আল্লাহর কসম আমি সেই নামই দেব।

কেন?

এটা আমার একটা ইচ্ছে। মানুষের বিভিন্ন ইচ্ছে থাকে। আমার ইচ্ছে যে, এই প্রজেক্টটার আপনি একটা নাম দেন।

ঠিক আছে পরে ভেবে বলব।

না না, চিন্তাভাবনা করে দিলে তো হবে না। ধরুন আপনি আপনার কোনও কলিগকে জিজ্ঞেস করলেন। তখন সে একটা নাম সাজেস্ট করল। আপনি আমায় সেই নামটা বললেন। তখন তো ম্যাডাম সেটা আপনার দেওয়া নাম হল না। যে নামটা এখন মাথায় আসছে সেটাই বলে ফেলুন। বললাম না, আপনি যদি নাম দেন ফালতু প্রজেক্ট, তবে সেই নামটাই থাকবে। 

এখন মাথায় কিছু আসছে না। 

যা ইচ্ছে তাই বলুন।

ভালবাসা।

মাশাল্লাহ। প্রজেক্ট ভালবাসা। আমার প্রজেক্টের নাম আজ থেকে প্রজেক্ট ভালবাসা। উঠি ম্যাডাম।

বেশ।

মইন মিঁয়া খুব নরম গলায় বলল, ম্যাডাম, আর একটা ছোট্ট কথা। ওই যে বাল্বটা প্যাসেজে লাগিয়েছি, ওটার দাম পঁচিশ টাকা। টাকাটা আমায় দিয়ে দিন। 

মহামায়া হাঁ হয়ে গেল। এতক্ষণ কথাবার্তা বলার পর এইভাবে টাকা চাওয়ার কায়দায় সে অবাক। পার্স থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বার করে সে দিল। মইন মিঁয়া তাকে পঁচিশ টাকার ভাঙতি ফেরৎ দিল। এত সাবলীলভাবে না গুনে দিল যেন সে জানত এই টাকাটাই সে পাবে এবং বাকিটা ফেরৎ দেবে। 

মইন মিঁয়া চলে যাবার পর মহামায়া একবার বিপুলকে ফোন করল। ফোন বন্ধ। স্নান টান সেরে তার আর কিছু খেতে ইচ্ছে করল না। বিছানায় শোওয়া মাত্র গভীর ঘুমে সে তলিয়ে গেল।


কলিংবেলের শব্দ শুনে মহামায়া উঠে বসল। দরজা খুলে দেখল সামনে ঝর্ণা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বলল - দিদি আপ সো রহিথি? 

ঝর্ণার বয়েস বারো তেরো। এখনও কিশোরীর ছাপ তার শরীরে। বোকাসোকা চেহারা। মহামায়া জানে মেয়েটার যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। শুধু বুদ্ধির ছাপ তার চেহারায় আসেনি। বয়েসের সাথে তার দৃষ্টি গভীর হতে শুরু করেছে, হঠাৎ করে। কোমরের উপর আর নিচে ভারি হতে শুরু করেছে। এতে তাকে খুবই চালাক চতুর মনে হতে শুরু করেছে। কিন্তু মহামায়া জানে ঝর্ণা খুব চালাক চতুর না। 

মহামায়া অনেকবার তাকে বলেছে একবার কলিংবেল টিপলে সে যদি সাড়া না দেয় তবে ঝর্ণা যেন চলে যায়। উল্টে বেল বাজিয়ে তাকে তুলে এনে যেন না জিজ্ঞেস করে সে ঘুমোচ্ছিল বা ঘুমোচ্ছিল না। কাজের সময় বরং ঠিক উল্টোটা হয়। সে ঘুমোলেই ঝর্ণা যেন দায়িত্ব নিয়ে তাকে ডেকে তোলে। এজন্যে এখন তাকে খুব আনন্দিতও মনে হচ্ছে।

মহামায়া হাই তুলে শান্ত গলায় বলল - কটা বাজে বল তো!

ঝর্ণা খুব উৎসাহের সাথে ঘড়ি দেখল। কদিন আগে মহামায়া মেয়েটাকে নিজের একটা পুরনো ঘড়ি দিয়েছে। কীভাবে ঘড়ি দেখতে হয় তা শিখিয়েছে। সে চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ঘড়ি টড়ি দেখে মহামায়ার দিকে তাকাল। হাসি মুখে বলল - সমঝ মে নেহি আতা।

মহামায়া চাইলেই ঘরের দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখে নিতে পারে। তবু সে বলল - ছোট কাঁটাটা কটার ঘরে?

বারোটার ঘরে।

আর বড় কাঁটাটা?

ছয়ের ঘরে।


সাড়ে বারোটা! কাল রাত থেকে মহামায়া আজ দুপুর সাড়ে বারোটা অবধি ঘুমিয়েছে। সাঁ করে সে নিজের ঘরের ঘড়ির দিকে তাকাল। ঝর্ণার বাবা একজন ইস্ত্রিওয়ালা। সে জামাকাপড় ইস্ত্রি করে মেয়ের হাত দিয়ে পাঠায়। মহামায়া বহুবার লোকটাকে ফোন করে বারণ করেছে মেয়েকে পড়াশোনা করাতে। এসব কাজের জন্যে অন্য বড়ো লোক রাখতে। 

লোকটা তাকে ফোনে বলেছে - লোগ মেলে না ম্যাডাম? মিললেও থাগতে চায় না। 

মহামায়া বলেছে - তা হোক। তবু নিজে আসবে। মেয়েকে এভাবে পাঠাবে না। তোমার মেয়ে এখনও অনেক ছোটো। তাছাড়া ওর বুদ্ধিও বয়েস হিসাবে পাকেনি। 

লোকটা বলেছে - হামি মানা করি। ও সোনে না। আপনাকে দেকতে যায়। বলে আপনাকে দেখলে ওর দিন ভাল যায়। 

কাপড় জামাগুলো নিয়ে মেয়েটাকে গাল টিপে দিল। ঝর্ণা সরল হাসল। মহামায়া বলল - সাবধানে ফিরবি। রাস্তাঘাট দেখে পার হবি বুঝলি। 

ঝর্ণা একগাল হেসে লিফটে ঢুকে যায়। 

মহামায়া দরজা বন্ধ করে। কাজের দিদি বোধহয় একবার বেল বাজিয়ে চলে গিয়েছে। সে যদি বোঝে মহামায়া ঘুমোচ্ছে তবে আর বিরক্ত করে না। পরে এসে ঘর টর সাফ করে যায়। 

মহামায়া বিপুলের ফোনে চেষ্টা করল। এখনও ফোন অফ। বিপুল এই কাণ্ড আগেও করেছে। সে একজন রিসার্চ স্কলার। বিদেশে অনেকদিন কাজ করে এসে, এখন এ দেশে কয়েকটা কোম্পানিতে ফ্রি ল্যান্স কনসালটেন্সি করে। কাজ না থাকলে প্রায়ই এদিক সেদিন ঘুরতে চলে যায়। একবার চারদিন পরে ফোন করে জানিয়েছিল - হঠাৎ মন করল তাই জুলুক চলে এলাম। 

মহামায়ার মনে হয় বিপুল এই কাজটা ইচ্ছেকরে করে। যাতে মহামায়া অন্য বউদের মতো তার জন্যে চিন্তা করে। কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে দিয়ে ভাবে, কোথায় গেলে গো! 

মহামায়ারও ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে এমন করে। সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো এমন করে বাঁচে। মুশকিল হয় সে সময়ে তার পাঁচশোটা ফোন চলে আসে। কোনটা ডায়রেক্টরের, কোনটা প্রডিউসারের, ইউনিটের লোকজনের। আবার কখনও এমনি ফালতু ফোন, মিসড কল। বিরক্ত করার জন্যে।

মহামায়া আবার বিপুলের ফোনে চেষ্টা করল। সেই একই মহিলা কন্ঠের উত্তর - এই নম্বরটিতে আপাতত যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। দয়া করে কিছু পরে আবার চেষ্টা করুন।

মোবাইল ফোনের আওয়াজ পেয়ে মহামায়া মুখ ঘোরাল। সে যেদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিল তার উল্টো দিক থেকে শব্দটা আসছিল। সে শুয়ে আছে ডিভানে আধশোয়া হয়ে।

ফোন তুলে চোখ বুজেই জিজ্ঞেস করল - কে?

ওপাশ থেকে বলল – বৌদি আমি মেহবুব। আপনি কেমন আছেন এখন?

ভালো আছি মেহবুব। 

দাদার কোনও খোঁজ পেলেন?

পুলিশ এখনও খোঁজ চালাচ্ছে।

ঠিক আছে বৌদি। আমি রাখছি। আপনি একটু বিশ্রাম করুন। ভালো থাকবেন। রাখছি। কোনও দরকার পড়লে ফোন করবেন।

মায়া ফোন ডিভানে ছুঁড়ে দিয়ে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করল। মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে। চোখ কুঁচকে সে দেখার চেষ্টা করল। চোখের সামনের আলো খুব উজ্জ্বল। তারপর উঠে বসল। একটা সিগারেট ধরাল। মহামায়া সিগারেট টানতে টানতে ফিসফিস করে বলল - গাধা একটা।

নিজেই বুঝতে পারল না কাকে গাধা বলছে । বিপুলকে না মেহবুব নামের লোকটিকে। 

আবার একটা ফোন এল।

মিসেস মহামায়া।

ইয়েস।

নমস্কার, ম্যাডাম।

নমস্কার।

কেমন আছেন, ম্যাডাম।

ভালো। আপনি কে?

আমার নাম মোহন। ইন্সপেক্টর মোহন সর্দার। আমি আর বিপুলবাবু একসাথে জিম করতাম। ওনাকে ভালোমতো চিনতাম। রোজ কথা হতো।

আপনি ওনাকে চিনতেন খুব ভালো কথা। আমি এখন ফোন রাখছি। আমি এখন খুব ব্যস্ত।

প্লিজ, প্লিজ একমিনিট শুনুন। আমি ওনার কাছ থেকে লাখখানেক টাকা ধার করেছিলাম। টাকাটা ফেরৎ দিতে চাই। 

ফেরৎ দিতে হবে না। বাই।

একটু পরে আবার ফোন। সেই একই নম্বর থেকে।

ম্যাডাম, আমি মোহন ।

একটু আগে আপনাকে বললাম না আমি ব্যস্ত। আর ইউ নাটস?

রাগ করবেন না, ম্যাডাম। প্লিজ। আপনার সাথে একবার দেখা করতে চাই। 

কেন? দেখা করার কী হল?

বিপুলবাবুর অন্তর্ধানের ব্যাপারটা কেউ মিডিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন। বলা হচ্ছে ওনার জীবনহানিও হতে পারে।

কে করেছে এটা?

আমার জানা নেই। 

তাহলে আমাকে বিরক্ত করবেন না। 

ছিঃ ছিঃ আপনাকে এই অবস্থায় বিরক্ত করার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। 

ফোন কেটে গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন। একই নম্বর।

নমস্কার, ম্যাডাম। আমি মোহন।

আপনি একটু আগে বললেন বিরক্ত করবেন না। এখন আবার করছেন। 

একটা ছোট্ট প্রশ্ন ছিল, ম্যাডাম। এই প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে গেলে আর করব না।

কী প্রশ্ন?

আপনি সিগারেট খান?

এটা আপনার প্রশ্ন?

আজ্ঞে না, এটা আমার প্রশ্ন নয়। বিপুল বাবু অত্যন্ত হেলথফ্রিক মানুষ ছিলেন। ধূমপান করতেন না। অথচ আপনার বাড়ি থেকে যে ময়লা ফেলা হয় তাতে রোজ প্রচুর সিগারেটর বাড থাকে। গত কদিনের সিগারেটের শেষাংশ পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি তার মধ্যে চরস আছে। আপনার বাড়ির দুজন মানুষের মধ্যে যদি আপনি ধূমপান করেন, তবে আমার প্রশ্ন হলো, চরসের মতো একটি নিষিদ্ধ নেশার বস্তু আপনি কোত্থেকে সংগ্রহ করেন। 

আপনার চরস চাই? আপনার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারেন।

ম্যাডাম, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আপনার রসিকতায় হাসতে পারলাম না। আমি শুধু জানতে চাই চরস ছাড়া আর কোন কোন ড্রাগস আপনি নেন? মিয়াও মিয়াও, ব্রাউন সুগার, এল এস ডি ট্যাবলেটস। আমাদের সন্দেহ আপনার আর নেশার জগতের লোকজনের যোগসূত্রেই বিপুলবাবুকে অপহরণ এবং সম্ভবত হত্যা করা হয়েছে।

বুলশিট। একটা মানুষের আটদিন ধরে কোনও খবর নেই। তাকে না খুঁজে এইসব করছেন। আপনার সাথে আর একটা কথাও আমি বলব না।


মইন মিঁয়া এখন কালু পাঁড়ের ইস্ত্রির দোকানে। পান্ডে তাকে খুব মানে। একটা ফুল চা হাফ হাফ করে দুজনে খাচ্ছে। মাস কয়েক আগে পান্ডে তার ছোট মেয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে হা পিত্যেশ করে বসে ছিল। সদ্য দেশ থেকে কলকাতায় এসেছে। কোথায় যাবে তার ঠিক নেই। এই মানুষটা এগিয়ে এল - কেয়া, বিহার সে আয়া? ছাপরা জিলা?

না বাবুজি, আরা সে আয়া।

আচ্ছা। ইধার রহনে কা মকান উকান কুছ হ্যায়?

নেহি বাবুজি।

কামকাজ কুছ জানতা হ্যায়?

কিষাণ হুঁ বাবুজি।

আরে বাবা শহর মে কিষাণ কা কেয়া কাম। অর কুছ জানতা কাম জানতা হ্যায়।

নেহি বাবুজি।

এরপর এই মানুষটিই তাকে নিয়ে আসে এই ফ্লাইওভারের তলায়। একটা থামের নিচে সে আর তার মেয়ে একটা ছোটখাট সংসার বানিয়ে নিয়েছে। আশেপাশে তাদের মতো অনেকেই আছে। কালু পাঁড়ে মনে মনে খুব কৃতজ্ঞ দুজনের কাছে। এক, যে এই ফ্লাই ওভার বানিয়েছে। দুই এই মহান মানুষটি, মইন মিঁয়ার কাছে। 

অন্য বিহারীদের মতোই কাজকর্মের ব্যাপারে পাঁড়ের মাথা খুব সাফ। কয়েকদিনের মতোই যা জমা -পুঁজি ছিল তাই দিয়ে সে চটপট একটা ইস্ত্রির দোকান খুলে ফেলল। আবার এগিয়ে এল এই মহান মানুষটি। আশেপাশের বেশ কয়েকটি কমপ্লেক্সে কাজ পাইয়ে দিল। 

চা খেতে খেতে মইন মিঁয়া জিজ্ঞেষ করল - তারপর পাঁড়েজি। ওই নায়িকা ম্যাডামের বর ফিরল? 

পাঁড়ে দুঃখিত ভাবে বলল - নাঃ বাবু। এখনও ফেরেনি। আমার মেয়ে তো কয়েকদিন পর পর যায়। ম্যাডাম খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন।

হুম।

তা তোমার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছ। যে জায়গায় থাক যে কোন দিন তো মেয়ে হাপিস হয়ে যেতে পারে।

আরে বাবু, গাঁয়ে থাকলে তো মেয়ের শাদি ওয়াদি কবে দিয়ে দিতাম। এ শহরে এসেই ঝামেলা হয়ে গেল। ওই ম্যাডাম ভি ফোন করিয়েছিল। বলল মেয়েকে পড়াও। কী যে করি! এখন ভয় লাগে বিয়ে দিয়ে দিলে কেউ আবার পুলিশ উলিশে না দিয়ে দেয়।

ধুসস পাঁড়েজি। কোথায় আছ? এসব আইন কানুন সব হাইফাই লোকেদের জন্যে। তোমার আমার মতো মানুষের জন্যে নয়। আচ্ছা ছাড় এসব কথা। এই নাও সিগারেট খাও। 

পাঁড়ে মইন মিঁয়ার হাত থেকে সিগারেট ধরিয়ে ফুকফুক টানে। আজ বর্ষার দিন। ধান্দা এমনিই মন্দা। লোকের জামাকাপড় শুকোচ্ছে না। ইস্ত্রি করতে আর কে দেবে?

পাঁড়েজি সিগারেট খেতে খেতেই বলে - আছ্হা বাবু, আপনি কোথায় থাকেন?

মইন মিঁয়া সিগারেট খাওয়া থামিয়ে দেয়। বলে - আরে আমি পথেঘাটের মানুষ। আজ এখানে, কাল ওখানে। দেখলে না তোমাদের সাথে যেদিন দেখা হল সেদিন স্টেশনে বসেছিলাম। যাক গে, বাদ দাও। তোমার মেয়ে কোথায়। ঝর্ণাকে দেখছি না। 

আমিও তাই ভাবছি বাবু। দু ঘন্টা হয়ে গেল, মেয়েটা কাপড় আনতে গেছে। আপনি এখানে আসার আগে। এখনও এলো না। মেয়েটা একটু কম দিমাগের আছে তো। সবসময় ডর লাগে কুছু হয়ে না যায়।

ধুর ছাড় তো! আছে কাছাকাছি কোথাও। চল আমি তোমার টাইমপাসের ব্যবস্থা করি। এম এম এস দেখছ কখনও? চল দেখাই তোমায়।

পরবর্তী এক ঘন্টা কালু পাঁড়ের আর মেয়ের কথা খেয়াল রইল না। 

বিভোর হয়ে মইনমিঁয়ার মোবাইলে এম এম এস দেখতে দেখতে মিনিটে মিনিটে সে বলতে লাগল - হায় রাম! ই কেয়া! আই সাব্বাস! ঔর জোর সে! ই লেকড়িটার ফেস ক্লিয়ার দেখা যাচ্ছে না বাবু…

কলিংবেল বেজে উঠল। মহামায়া লাফিয়ে উঠল। কে আসবে এরকম একটা সময়ে? সিকিউরিটি কেবিনে বলা আছে কেউ আসলে আগে থেকে ফোন করে দেয়। মায়া দরজা খুলল। দরজা খুলেই সে একটা ধাক্কামতো খেল। পুলিশের ড্রেসে একজন দাঁড়িয়ে। হাসি হাসি মুখ। পুলিশটির পাশে দাঁড়িয়ে একজন সিকিউরিটি গার্ড আর মেহবুব দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশি রগড়ানির ছাপ তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট।

ম্যাডামের খবর কী? আমাকে দেখে চমকে গেলেন না কী? কাছাকাছিতেই একটা কেস ছিল। ভাবলাম দেখা করেই যাই। কেমন আছেন? - পুলিশটি হলেন ইন্সপেক্টর মোহন সর্দার। কয়েকদিন আগে ইনি মহামায়াকে থানায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

ভালো?

হঠাৎ করে সেদিন ফোন নামিয়ে রাখলেন।

ফোন আমি নামিয়ে রাখিনি। রেখেছিলেন আপনি। একজন গরীব সিকিউরিটি গার্ডকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো এই অজুহাতে তার বিপুলের সাথে তার কদিন আগেই ঝামেলা হয়েছিল, আর একজন জিম ইন্সট্রাক্টরকে থানার ডাকা হলো এজন্যে যে সে আমার স্বামীকে জাস্ট চিনত, এর মানেটা আমি বুঝতে পারিনি।

আর তাই আপনি আমার উপরওয়ালাকে ফোন করে বসলেন? ঠিক আছে যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। এই দেখুন আপনার গার্ডকে আর ইন্সট্রাক্টরকে সসন্মানে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। এবার খুশি তো? বিপুলবাবু তো এখনও ফিরলেন না। 

আজ্ঞে না। 

আপনি কী করছিলেন?

ব্যালকনিতে বসেছিলাম। 

ওদের দুজনকে চলে যেতে বলে পুলিশ অফিসার মোহন সর্দার ভিতরে ঢুকলেন। চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বললেন - বিপুলবাবু ফিরুন একদিন। তারপর এসে চা টা খাবখন।

বসুন, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।

না থাক. থাক। কষ্ট করতে হবে। এত মনখারাপের সময়ও দেখছি ঘরটর বেশ গুছিয়ে গাছিয়ে রেখেছেন। জুতো টুতো পড়ে ঢুকে পড়েছি ভেবেই খারাপ লাগছে।

আসলে আমরা দুজনেই গোছানো ঘর পছন্দ করি তো তাই। আমি এবং আমার স্বামী। এর মধ্যে মনখারাপ আর ভালোর তো কিছু নেই।

সে তো ভাল, খুবই ভাল - অমায়িক হাসলেন মোহন সর্দার - তা চা এক কাপ পেলে ভালোই হতো মিস মহামায়া। বানাবেন না কি?

পুলিশ অফিসার প্রথম দিন মিসেস বলছিলেন। আজ বললেন মিস।

চা এনে মহামায়া মোহন সর্দারের সামনে রাখল। মোবাইলে তিনি কারোর সাথে কথা বলছেন - বাচ্চাটার কোনও খবর পেলে?

চা খেয়ে একটা তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন - আহ, চা বেশ ভাল হয়েছে। মাঝে মাঝে এসে দেখছি আপনার হাতের চা খেয়ে যেতে হবে। 

মোহন সর্দার একটা সিগারেট ধরালেন। মনে হচ্ছে উনি আরও কিছু বলতে চান।

ম্যাডাম আপনাকে বলছিলাম না। অন্য একটা কেসের ব্যাপারে এখানে এসেছিলাম। কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং। একটু শুনবেন? বসুন না! 

একটু আগে পুলিশ অফিসার মিস বলে ডাকছিলেন। এখন আবার ম্যাডাম। মানে শক্ত কিছু বলবেন। মহামায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসল।

কেসটা অনেক পুরনো জানেন তো! একটি ছেলে তার গোটা পরিবারকে খুন করে সুপরিকল্পিতভাবে। আমরা পুলিশরা অনেক মেহনৎ করে কেসটা গুছোই। ছেলেটি কোর্টে খুব কম শাস্তিতে ছাড়া পেয়ে যায় শুধু তার বয়েস কম বলে। এখন সে ছাড়া পেয়েছে। ড্যাং ড্যাং করে এই অঞ্চলেই ঘুরছে। আমি তার প্রতিটা ব্যাপারে নজর রেখেছি। এবার একটা কেসে ধরতে পারলে এমন কেস সাজাব যে হয় গোটা জীবনের জন্যে জেলে ঢোকাব নয় ফাঁসিকাঠে ঝোলাব। আমার রেকর্ড আছে ম্যাডাম। আমি কোনও কেস হাতে নিলে কেসের সাথে সাথে আসামীর শেষ করে ছাড়ি। আরে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? আপনার স্বামী ঠিক ফিরে আসবেন। আমি জানি ম্যাডাম। আমরা একসাথে জিমে যেতাম তো! আপনি আবার আমার উপর ওয়ালাকে চেনেন।

শুনুন ইন্সপেক্টর। বার বার এই মিথ্যেটা বলার দরকার নেই যে আপনি আমার স্বামীকে চিনতেন। আপনি যেমন আমার খবর রাখছেন আমি ও আপনার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। জিমে যাওয়া তো দূরের কথা আপনি সকালে জগিংয়েও যান কিনা সন্দেহ। এমনকি থানায় একসপ্তাহের ফ্রি যোগা সেশন রাখলে আপনি তা তেও যান না। সারাদিন আপনি প্রচুর সিগারেট খান। বিরিয়ানি এবং মাটন রেজালা হলো আপনার প্রিয় খাদ্য। এরপর থেকে আমরা দুজনে একে অপরের কাছে একটু ট্রান্সপারেন্ট থাকলে বোধহয় দুজনেরই সুবিধা হবে।

ইন্সপেক্টর মোহন সর্দার একটু থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন - আজকে উঠি 

দরজার কাছে এসে বললেন - চলি ম্যাডাম

মহামায়া বলল - একটু অনুরোধ ছিল ইন্সপেক্টর। জানি আমার কেসটা অনেক হাই প্রোফাইল। মিডিয়ার নজর আছে। একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে আজ প্রায় চারদিন ধরে নিখোঁজ। বাচ্চাটির বাবা ফ্লাইওভারের নিচে ইস্ত্রির দোকান চালায়। খুব গরীব। পারলে একটু কেসটা দেখবেন। মেয়েটিকে আমি চিনতাম। আমার স্বামী সেটা খুব পছন্দ করতেন না। তবে আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম।

ইন্সপেক্টর সর্দার একটু বিস্মিত হয়ে মহামায়ার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন - কেসটা আমার নজরে আছে। একটু আগেই মোবাইলে খোঁজ নিচ্ছিলাম। কিছু পেলে আপনাকে জানাব।


পৃথিবীতে মানুষ শুধু চোখে দেখা আর কানে শোনায় ব্যস্ত। মইনমিঁয়া ভেবে পায় না এরা মন নামে বস্তুটাকে কখন ব্যবহার করে। কেউ ভাবেই না মন বলে একটা ব্যাপার আছে। আর সেই মন সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয় যখন কেউ ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমনো মানে সত্যি সত্যি ঘুমনো নয়। ওষুধ নিলে তার নিজের মন সবচেয়ে ভালো ঘুমোয়। জেগে ওঠে তার সাব কনশাস মাইন্ড। আর তখন সে সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারে অন্য মানুষকে।

যেমন এই বিপুল নামের লোকটা। লোকটার সাথে কদিন কথা বলেই মইন বুঝে গিয়েছিল এই লোকটা তার বউকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। নিজের আর বউয়ের বয়সের একটু পার্থক্য থাকায় সবসময় তার সামনে নিজেকে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। তাই লোকটাকে সবসময় সে একটু উত্যক্ত করার চেষ্টা করত। লিফটের সামনে পেরেক ফেলে দিত। প্যাসেজের লাইটটা খারাপ করে দিত। অথচ লোকটা তার টার্গেট ছিল না। 

যেমনি তার টার্গেট ছিল না একটা ছোটো মেয়ে। অথচ মেয়েটাকে তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবলে খারাপই লাগে তার। অথচ সে তো এমন ছিল না। তার কী দোষ ছিল! সে শুধু একটা সাদা কুকুরের গলাটা কেটে ফেলেছিল। কুকুরটারও দোষ ছিল না। নেড়ি কুকুরদের বংশে অমন ধবধবে রঙ নিয়ে জন্মেছিলি কেন হতভাগা? কেন এত সুন্দর হতে গেলি? আর মহামায়াও বা অত সুন্দর হতে গেল কেন? আর কুকুরটারও এমনই ভাগ্য মহামায়ার বাড়ির সামনে পয়দা হলি। 

মহামায়ার তখন বছর বারো তেরো বয়েস। মইন মিঁয়া তার বাড়ি থেকে একটু দুরেই এক বস্তিতে থাকে। মহামায়া ছোট একটা স্কার্ট পড়ে তাদের বস্তির সামনে দিয়ে সাইকেল করে স্কুলে যায়। বস্তির অনেক ছেলেই দেখত। কিন্তু মহামায়া শুধু মইনের। তাকে আর কারোর দেখার অধিকার নেই। 

মহামায়াকে অনুসরণ করে সে প্রায়ই তার বাড়ি অবধি যেত। বাড়িতে ঢোকার সময় মেয়েটা রোজ কুকুরের বাচ্চাটাকে বুকের কাছে নিয়ে হোগলা হোগলি আদর করত। মহামায়ার আদরের উপর শুধু মইনের অধিকার। 

সে এক শীতের সন্ধের মতো তাদের বাড়ির দরজার কাছে গেল। আ - তু -তু করে একটা বিস্কুট নিয়ে বাচ্চাটাকে ডাকল। বাচ্চাটা ল্যাজ নাড়াতে নাড়াতে এল। মইনমিঁয়া বাচ্চাটাকে আদর করে কোলে নিল। একটা বিস্কুট দিল। বাচ্চাটা হাঁ করল খেতে খেতে। মইন তার মুখে কাপড় গুঁজে ছুরিটা বার করে পোঁচ দিতে থাকল।

মহামায়া কখন গেটের কাছে এসেছিল মইন জানত না। সে কুত্তার বাচ্চাটাকে জবাই করতে ব্যস্ত ছিল। মহামায়া ঘটনাটা দেখে এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছিল। সে বোধহয় রাতের খাবার নিয়ে বাচ্চাটাকে খাওয়াতে এসেছিল। মইন মিঁয়া কুকুরের বাচ্চাটার নিথর দেহ ফেলে পালাচ্ছিল। ততক্ষণে সে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মুন্ডুটাকে ধড় থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তার খুব আনন্দ হচ্ছিল। পৃথিবীতে থেকে একটা পাপ কমল। 

সে ছুটে পালাচ্ছিল। তার মধ্যেই শুরু হলো মহামায়ার আর্তনাদ। লোকজন ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। পুলিশে দিল। জেল থেকে বেরিয়ে শুরু হলো তার নতুন জীবন। সে নেশার ওষুধের ব্যবসা ধরল। এল এস ডি, ব্রাউন সুগার, মিয়াও মিয়াও, আরও অনেক পার্টি ড্রাগস। শুধু মানুষকে ধরাও আর পকেট থেকে টাকা বার করে নাও। 

টাকা পয়সাটা বড় ব্যাপার নয়। টাকা পয়সা তো অনেকেই করে। আসল ব্যাপার হলো মন। নেশার ওষুধ খাওয়ার পর তার মন জেগে উঠতে লাগল। সে বুঝল এ জীবন মধুময়। মধুময় তার ভালোবাসা। হ্যাঁ ভালোবাসা। প্রজেক্ট ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসার নাম মহামায়া। সে মহামায়ার জীবনের সব ভালোবাসা সরিয়ে দেবে। প্রজেক্ট ভালোবাসায় থাকবে শুধু সে আর মহামায়া।


আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘরটার দরজা খুলল মইনমিঁয়া। লাইট জ্বালাল। রট আয়রণের খাটে মেয়েটার হাত পা বাঁধা আছে। বাচ্চা মেয়েটাকে রোজ একটা করে ইঞ্জেকশান দেয় সে। মেয়েটা সবসময় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে জানে কখনও রিস্ক নিতে নেই। সে কোন রিস্ক নেবে না। 

এরপর সে এই মেয়েটির জামাকাপড়ে খুলে ফেলবে। এর একটা এম এম এস বানাবে। তারপর সেটা ছড়িয়ে দেবে। মোবাইলে মোবাইলে ছড়াতে ছড়াতে সে একদিন এম এম এসটা পাঠিয়ে দেবে মহামায়ার কাছে। মহামায়াকে সারাজীবন সে একবার শাস্তি দেবে, একবার ভালোবাসবে, একবার শাস্তি দেবে, একবার ভালোবাসবে, একটু শাস্তি দেবে, একটু ভালোবাসবে...


মোহন সর্দার যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তার মেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তার স্ত্রী বোঝাচ্ছে - দেখ মা, তোমার বাবা পুলিশে চাকরি করেন। তার ডিউটির কোনও সময়ের ঠিক নেই।

তার নিজেরও মন খারাপ। 

ঠিক এরকম একটা সময়ে মোহন ঘরে ঢুকলেন। তার স্ত্রী বললেন - তুমি বসো, আমি খাবার গরম করে আসছি। 

মোহনের স্ত্রীর নাম লীলা। তার মেয়ের নাম নিশা। 

মোহন স্ত্রীর একটা হাত টেনে ধরলেন। লীলা যখন খুব অভিমান করে তখন সে খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে। যখন সে সাধারণ মুডে থাকে তখন মান অভিমান করে। এখন সে খুব অভিমান করে আছে। তাই সে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। আজ লীলার জন্মদিন ছিল। মোহন দেরি করেছেন। 

লীলা খুব স্বাভাবিকভাবে বলল - আমার হাতে লাগছে। ছাড় খাবার গরম করে আনি। তুমি হাতমুখ ধোও।

তাও মোহন লীলাকে ছাড়লেন না। সিনেমার নায়কদের মতো তাকে বুকের কাছে টেনে এনে বললেন - আমি অপরাধী। 

লীলা বললেন - বেশ। এবার আমায় ছাড়।

নিশা এর মধ্যে এসে গেল। নিশার কাজ হলো লীলা আর মোহনকে কাছাকাছি দেখলেই তাদের আলাদা করে দেওয়া। নিশার বয়েস বছর পাঁচেক। তাদের বাড়িতে যারই জন্মদিন হোক না কেন, নিশার জন্যে একটা আলাদা কেক আনতে হয়। মোহনের জন্মদিন হলে নিশার জন্মদিন, লীলার জন্মদিন পালন হলে নিশার জন্মদিন, আর তার নিজের জন্মদিন তো আছেই। 

মোহন লীলাকে জড়িয়ে ধরে বললেন - একটা খুব খারাপ কেসে কিছুতেই সলভ করতে পারছি না। 

নিশা তাদের দুজনের মাঝখানে ঢুকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দুজনকে আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। লীলা সরে গিয়ে মোহনের হাতে টাওয়েল ধরিয়ে দিল। বলল - তুমি প্লিজ স্নান করে এস। গা দিয়ে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে।


মোহন স্নান করে এসে খেতে বসলেন। লীলা বলল - একটা দিন কিন্তু তাড়াতাড়ি আসতেই পারতে।

অর্থাৎ লীলা এবার স্বাভাবিক মুডে ফিরে আসছে। মোহন বলল - আর বোলো না, কয়েকটা কেস নিয়ে এমন ফেসে আছি। 

লীলা কেক সাজিয়ে দিল। তারপর সেই কেক কাটা হলো। মোহন আর নিশা গলা মিলিয়ে হ্যাপি বার্থডে গাইলেন। মেয়ের নজর বাঁচিয়ে মোহন লীলার গালে হালকা ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলেন। লীলা লজ্জায় লাল হয়ে বলল - যাঃ।

মোহন হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন।

খেতে বসে লীলা বলল - কী কেস নিয়ে এত ব্যস্ত তুমি?

মোহন খেতে খেতে বললেন - দুটো কেস। একটা হলো ফিল্মস্টার মায়ার বর গায়েব। নিউজেও দেখে থাকবে। উপরমহল থেকে খুব চাপ আসছে। আমার মনে হয় মায়া নিজেই এটা ঘটিয়েছে। দ্বিতীয়টা খুব সাধারণ কেস। একটা ইস্ত্রিওয়ালার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। ফ্লাইওভারের নিচে বস্তিতে থাকত। 

নিশা মন দিয়ে বাবার কথা শুনছিল। সে বলল - বাবা আঙ্কেলটা খুব দুষ্টু।

মোহন খাওয়া থামিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেষ করলেন - কোন আঙ্কেলটা মা?

নিশা বলল - ওই যে চশমা পড়া আঙ্কেলটা। আন্টির নিচের ফ্ল্যাটে থাকে।

মোহন একটু চুপ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ছোটো থেকে তার মেয়ে খুব অদ্ভূত অদ্ভূত ছবি আঁকে। অনেক সময় সে সব ছবি দেখে মোহন চমকে উঠতেন। কোনওদিন হয়তো ঘরে তার ঠাকুর্দার কথা হলো, যে ঠাকুর্দাকে নিশা কোনওদিন চোখেই দেখেনি, কদিন পরে তার ছবি এঁকে এনে দেখাত - বাবা দেখ, এই দাদুটা আমায় অনেক হাসাচ্ছে।

এর আগেও তার একটা কেসে এমন করে একটা অপরাধী ধরা পড়েছে। একটা বাড়িতে একটা ছোটো মেয়ে মারা গিয়েছে। ছাদে তার ডেডবডি রাখা বস্তার মধ্যে। বাড়ির লোক জানাচ্ছে মেয়ে কদিন আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। কিডন্যাপারের ফোনও আসে। পুলিশ হয়রান হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার ডেডবডি ছাদে কী ভাবে এল!

হঠাৎ নিশা একরাতে ছুটতে ছুটতে এল। সে ভয়ে কাঁপছে। মোহন তাকে বুকের মাঝে নিয়ে বলল - কী হয়েছে মা! ভয় পেয়েছিস!

নিশা হাতের খাতার ছবি দেখাল। আঁকাবাঁকা ছবি। সে ছবি দেখে মনে হয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে। পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আর কত ভালো ছবি আঁকবে। নিশা কাঁপতে কাঁপতে বলল - বাবা এই মেয়েটা বলছে ওর ঠাকুমা নাকি ওর হাতের তিনটে আঙুল কেটে দিয়েছে। ও খুব কাঁদছে।

বাচ্চামেয়েটির ডেডবডিতেও আঙুল কাটা ছিল। আসল খুনি ধরা পড়ল। জানা গেল মেয়েটির ঠাকুমা, ছোট কাকা ও কাকিমা মিলে তন্ত্রমন্ত্র করতে গিয়ে কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। 


এখন মোহন নিশাকে কোলে নিয়ে বললেন - তোমায় কে বলল মা? 


নিশা ছুটে গিয়ে একটা ছবি নিয়ে এসে বলল - এই আঙ্কেলটা বলেছে।

মোহন দেখলেন তাতে বিপুলের একটা ছবি আঁকা। ত্যাড়াব্যাঁকা ছবি। তবে বোঝা যাচ্ছে ওটা বিপুলের ছবি। পাঁচ বছরের মেয়ের হাতে আঁকা। মোহন খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন ফোন হাতে নিতে।

ঝর্ণাকে হাসপাতাল থেকে আজ দুদিন হলো আনা হয়েছে। মেয়েটি এতো ট্র্মায় আছে যে সে মহামায়াকে আঁকড়ে রেখেছে। আর কারোর কাছে যাচ্ছে না। নিজের বাবার কাছেও না। মোহন গম্ভীর মুখে বসে আছেন মহামায়ার ড্রয়িংরুমে। তিনি বুঝতে পারছেন না কথাটা কী ভাবে শুরু করবেন।

একটু গলা ঝাড়লেন। মহামায়া তার সামনেই ডিভানে বসে আছেন ঝর্ণাকে জড়িয়ে। সে বলল - আপনি কী কিছু বলতে চান অফিসার?

মোহন খুব অপ্রতিভভাবে বললেন - একটা কথা অফ দি রেকর্ড বলতে চাই মিস মহামায়া। কিছু মনে করবেন না। আমার মেয়ে বছর পাঁচেকের। একটু অন্যরকম। সে মৃত মানুষদের সাথে ইনট্যারাক্ট করতে পারে। আই মিন, জানি খুব ফানি শোনাবে। বাট এটাই সত্যি। ঝর্ণাকে আমরা ওর দেওয়া তথ্যেই উদ্ধার করেছি।


মহামায়া মুখ শক্ত করে ফেলেছে। তার চোখে অবিশ্বাস নেই। আছে ভয়ঙ্কর কিছু একটা শোনার প্রস্তুতি। সে বলল - আপনি কী আরও কিছু বলবেন, মোহনবাবু।

নাঃ আর কিছু না। আমি চলি।

আর ইউ সিয়োর?

ইয়েস

দরজার কাছে গিয়ে মোহন সর্দার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন - আমরা মইন মিঁয়াকে এখনও ইন্টোরোগেট করছি। নেশার অভাবে লোকটা পাগলের মতো করছে। একদমই কো অপারেট করছে না। লোকটা সারাজীবনে এতগুলো খুন করেছে যে নিজেই একটার সাথে আরেকটা ওভারল্যাপ করছে। ভেরি স্যাড স্টেট অফ মাইন্ড। আর একটা কথা, আপনার স্বামী একটু বদমেজাজি আর পাগলাটে ছিলেন হয়তো। অনেকটা আমারই মতো। কিন্তু উনি আপনাকে আর এই মেয়েটিকে খুব ভালোবাসতেন। জানি আপনাদের কোনও সন্তান নেই। ওকে বিপুলবাবু নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন ম্যাডাম, যাদের হৃদয় ভরা ভালোবাসা। কিন্তু তারা সেই ভালোবাসাটা সবসময়ে বলে বোঝাতে পারে না। এই ব্যাপারটা আমি বুঝি। আশা করি আপনিও বুঝবেন।

মোহন বেরিয়ে আসলেন। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন তিনি। লীলা আর নিশা খুব খুশি হবে।

0 comments: