0

ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ

Posted in

ধারাবাহিক

বইপাড়ার তন্ত্রধারক ৪
ফাল্গুনি ঘোষ



কলেজজীবনের গোড়ার কথা। কলেজস্ট্রিটে গ্রন্থপ্রেমী ভিজিটরের পর্ব চুকিয়ে ঢুকে পড়েছি বইপাড়ার নিত্যকর্মের এক অংশে। কলেজের ভিতরে ক্যান্টিন, বাইরে কফিহাউস, ফেভারিটের সীমানা ছাড়িয়ে আড্ডা পৌঁছেছে হেয়ার স্কুল আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝের রাস্তায়। কখনো কলেজ থেকে বেরিয়ে ডানহাতি ফুট ধরে আর হিন্দু হোস্টেল থেকেও সোজা ডানহাতি হেঁটে কলেজস্ট্রিটে ধাক্কা খাওয়ার দুটি দোকান আগেই সারা দিনের যখনতখন, মানে সকাল নটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত, পৌঁছে যাওয়া যায়। চা বিস্কুট পাউরুটি ঘুগনির সঙ্গে নানা সময়ের বইপাড়ার স্বাদ একত্র করে নিতে ডাকেন যে মানুষটি, তাঁর নাম বুড়োদা। আমাদের নানান কাজের অগতির গতি। হৃদয়পুরের বাসিন্দা বুড়োদা রোজ সকালে ট্রেন ধরে চলে আসেন কলেজস্ট্রিট। বাড়ি থেকে আসেন অথবা বাড়িতেই আসেন। আজ দু-দশক পেরোনো আমাদের কলেজজীবনে হাতে পকেটমানির বিশেষ বালাই নেই। অথচ চারপাশে এত বই! তখন আবার প্রযুক্তির বাইরেও প্রচুর জ্ঞানপিলে চমকে দেওয়া বইয়ের দেখা মিলত এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। অতএব আমাদের ত্রাহিমাম দশা। বিপত্তারণ শ্রীমধুসূদন বুড়োদা। পরের দু’এক মাসে ধারাবাহিক সুদহীন শোধের কড়ারে ধার। একমাসে একাধিক বারেও আপত্তি নেই। দোকান গুমটির পাশে পাতা মুখোমুখি তক্তাপোশ বেঞ্চ ও সেই গাছটি, যা অচ্যুৎদার লাগানো আর নাম যার জীবনানন্দ। বেশ বোঝাই তো যাচ্ছে, সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক কূট থেকে কবিতা বিপ্লব স্মরণসভা; বিশ্রাম থেকে বিশ্রামের ক্লান্তিবিমোচন নিয়ে জমজমাট বুড়োদার চায়ের দোকান। একদিন হঠাৎ দেখি স্বভাবত কলেজস্ট্রিটের ইনফরমেশন সেন্টার বুড়োদার মুখ গম্ভীর। শোনা গেল একটু আগেই এই রাস্তা দিয়ে তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দাহ করতে। সবাই অবাক। কোথাও কোনো খবর নেই! তবে কি গোপনে ঘটে গেল চাঞ্চল্যকর কিছু! বইপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল গুঞ্জন। আর তা বিপদসীমা অতিক্রমের ঠিক আগে বুড়োদা জানালেন, সংস্কৃতিমন্ত্রী ঠিকই, তবে কুশপুত্তলিকার আকারে।
বুড়োদা কয়েকবছর হল বাকি পৃথিবীসহ কলেজস্ট্রিট ত্যাগ করেছেন। আর তারও আগে পৌরসংস্থার উদ্যোগে ভাঙা পড়ে ছোটো হয়ে আড্ডার অবকাশ হারিয়ে হীনবল হয়েছে সে-দোকান। প্রশাসন দোকান ভেঙেছে। আর ভিতরপানে ভেঙে গেছে না-দেখা পুরোনোকে এক প্রৌঢ়ের এগিয়ে দেওয়া গ্লাস পাউরুটির টুকরো আর পেঁয়াজকুচির মধ্যে ছুঁয়ে নিয়ে নিজেদের সামনের দিকে ঠেলে দেওয়ার অবকাশ।
বুড়োদার দোকানের উল্টো দিকে কাগজের বাঘের বন্ধ গুমটির নীচের বাসিন্দা এক ভিখারিনীর মাতৃহারা ছেলেকে অনেক স্নেহে বড়ো করছিলেন এই চায়ের দোকানি। মৃত্যুর আগে ওই সংকুচিত দোকানটার অধিকার বুড়োদা দিয়ে যান ওই ছেলেটিকেই। এই শার্সি-লাগানো লড়াইয়ের কালে সে-দোকানও আজ নেই। ছেলেটি ভ্যান চালায়। প্রায়শই দেখি তাকে বইপাড়ার অলিতে গলিতে। আর দেখলেই জিজ্ঞাসা করতে যাই, 'বুড়োদার খবর কী রে ? দেখছি না অনেকদিন !' বস্তু আর বাস্তবের সিগন্যালে আটকে যাই। অথচ তোমার ছাকনির সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে কত অনায়াসেই পুরোনো সময়গুলো ঢুকে পড়ত আমাদের চায়ের গ্লাসে, বুড়োদা !

# প্রসঙ্গত, বুড়োদার ছবিটি বোধিসত্ত্ব করের সহায়তায় আয়নানগর.কম এর সূত্রে পাওয়া গেল।



0 comments: