0

গল্প - পুলিশমানুষশিবনাথ

Posted in


গল্প


ন্যায় অন্যায় 
পুলিশমানুষশিবনাথ 



"সার আমার কেস টার তাহলে কিচ্ছু হবে না?" 

চেম্বারে বসে পুট আপ ফাইলের কাগজ দেখছি, হঠাৎ এরকম একটা প্রশ্ন শুনে চোখ তুলে তাকালাম। 

প্রশ্ন কর্তার বয়েস আঠাশ কি ঊনত্রিশ হবে। বেশ লম্বা , তা প্রায় পাঁচ ফুট আট - দশ তো হবেই। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া এলোমেলো চুল। গালে তিন চার দিনের না কাটা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে একটা চকরা বকরা লাল কালো ফুল শার্ট, যার বুকের দুটো বোতাম ছেঁড়া, গালের হনু দুটো বের করা, একটা ময়লা নীল জিন্সের প্যান্ট পরনে, পায়ে হাওয়াই চটি। হাত দুটো বেশ বলিষ্ঠ, শিরা বের করা, আঙ্গুল গুলো মোটা মোটা। আমার দিকে চোখ দুটো তাক করা। চোখে একটু যেন অস্বভাবিকতার ছাপ চোখে পড়লো। তার সাথে একটা বছর পাঁচেকের বাচ্ছা মেয়ে। পরনে একটা মলিন গোলাপী সাদা ফ্রক। 

সেনট্রি রাইফেল নিয়ে প্রায় সাথে সাথেই ঢুকেছিল, সে লোকটিকে হাত ধরে ঘরের বাইরে বের করার জন্য টানতে লাগলো । 

লোকটিও যাবে না , সে সেনট্রি কে দেখে বুকের জামা সরিয়ে দিয়ে বলল " কি করবে আমাকে? গুলি করবে ?দাও আমাকে গুলি করে দাও, আমি বড় বাবুকে সব বলব তারপরে যাব"। বাচ্চা টা চুপ করে দেখছে আর বাবার প্যান্ট ধরে টানছে। 

সেনট্রি ও ছাড়বে না। সেও টানা টানি চালাতে থাকলো। আমি দেখলাম পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, সেনট্রি কে বললাম," ঠিক আছে আপনি বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আর মেজ বাবুকে পাঠিয়ে দিন। " 

এবার লোকটি একটু শান্ত হোলো। বললাম "বস, জল খাবে? এই অফিস ডিউটি এক গ্লাস জল দাও তো"। 

এইবার লোকটা একটা অদ্ভুত কান্ড করলো, হঠাৎ অতবড় লোকটা ধীরে ধীরে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো, হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, মনে হলো তার আগ্নেয়গিরির নীচে একটা আস্ত ঝর্ণা চাপা পড়ে ছিল। 

অফিস ডিউটি জল নিয়ে এল, সে ও হতবাক। 

আমি পুরো অবাক, ঘটনাটা কিচ্ছু বুঝতেই পারছি না। তবু ও বললাম "আরে কি হোলো? আরে বাবা তুমি জল টা তো খাও, তারপর তোমার সব কথা শোনা হবে, আমি বলছি তো"। 

লোকটি জামার হাতায় চোখ মুছতে লাগলো। তারপর একটা চেয়ারে বসে কোঁত কোঁত করে জল খেল, তারপরে মেয়েটাকে কোলে টেনে নিল। এবারে মনে হলো সে একটু ধাতস্থ হয়েছে। 

-- কি ব্যপার তুমি হঠাৎ কেঁদে উঠলে কেন? 

--- না বাবু থানায় তো এনারা শুধু গুঁতো মারার কথাই বলে, এই দু বছর কেউ তো কোনোদিন জল খাবার কথা বলেনি, তাই মনটা কেমন করলো, সে আবার ফোঁস ফোঁস করতে থাকলো। 

এবারে একটু কড়া হতেই হয়। আমি গলায় একটু পুলিশ সুলভ গাম্ভীর্য এনে বললাম, 

" দ্যাখো আমার প্রচুর কাজ আছে, যদি কাঁদা র জন্যই এসে থাকো তবে থানার বাইরে গাছ তলায় বসে সারাদিন কাঁদো, কেউ তোমাকে বারণ করবে না, আর যদি কিছু বলার থাকে চট পট করে বলে ফেল। আমি দশ মিনিটের মধ্যে বেরোবো।" 

এবার লোকটা থামলো। এরা গ্রাম বাংলার চাষী-বাসী শ্রেণীর লোকজন, খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, এক কথা বলতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা তুলে আনে। তবুও যেটুকু বুঝলাম, সেটুকু হল, যে এর নাম অসীম রায়। বাড়ী সাহেব ঘাটা। লোকের জমিতে কাজ করে। কখনো শাক সব্জী এনে বাজারেও বিক্রি করে। এর বউ এর নাম ছিল নীলিমা। কেউ একজন গজা ওরফে গজেন বিশ্বাস এর বউকে খুন করে, তাও প্রায় দু বছর আগের কথা। তাদের একটা তিন বছরের মেয়ে ছিল, এখন তার বয়েস পাঁচ। এই সেই মেয়ে। নাম সীমা। মা'কে ছাড়া বাচ্চা মানুষ করা খুব কষ্টের, তাকে সব জায়গায় বাচ্চাটাকে নিয়েই ঘুরতে হয়। 

তার অভিযোগ গজা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে পুলিশ ধরছে না, সে এর আগে দুজন বড়বাবু কে বলেছিল, সবাই ভরসা দিয়েছিল, কিন্তু কিচ্ছু হয়নি। 

আমি এই থানায় দিন সাতেক আগে জয়েন করেছি। গ্রাম্য থানা, তবে শহরের পাশে হওয়ার জন্য শহুরে সমস্যার আঁচ লাগতে শুরু করেছে। আমি তাকে বললাম, "দেখছি"। 

সেটা শুনে সে বলল " সার আগের বড়বাবু রাও ঠিক এই কথাটাই বলেছিল "দেখছি"। 


আমি কি করে তাকে বোঝাবো যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই একটি মাত্র কথা ছাড়া আমাদের আর বিশেষ কিছুই বলার থাকে না। 


যা হোক আমি তাকে সপ্তাহ খানেক পরে দেখা করতে বললাম। বললাম আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আগে ঘটনাটা একটু শুনে নি, যদি কিছু করার থাকে সাধ্যমত চেষ্টা করবো। 

অসীম যাবার সময় মেয়েকে বলল, "ইনি বড় বাবু, নমস্কার করতে হয়।" 

ছোট্ট মেয়েটি এক দোণ্ডর্ড প্রতাপ বড় বাবুর দিকে ভয় মিশ্রিত চাহনি দিয়ে টা টা করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 



বিকেলে ক্রাইম কনফারেন্স থেকে বেরিয়ে থানায় ফিরতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। একটু ফ্রেস হয়ে কোয়ার্টার থেকে ফিরে মেজবাবুকে ডাকলাম। মেজবাবু এস আই সমীর গাঙ্গুলী, এই থানায় প্রায় বছর খানেক আছে। ঠাণ্ডা মাথায় লোক। চাকরীর বয়েস প্রায় তিরিশ হয়ে গেল। 

আচ্ছা, নীলিমা রায়ের মার্ডার কেসটার কি ব্যাপার বলুন তো? আসামী এরেস্ট হয়নি কেন? 

সমীর বাবু একটু কেশে নিয়ে শুরু করলেন," স্যার, ঘটনাটা দু বছর আগের। সাহেব ঘাটা তে একটা মার্ডার হয়। যে বৌটা খুন হয় তার নাম নীলিমা রায়। বয়েস বাইশ কি তেইশ হবে। নীলিমা ও তার বর অসীম রায় রাত আট টা কি নটা নাগাদ হাট থেকে ফিরছিল, সাথে তাদের বছর তিনেকের একটা মেয়ে ছিল। সাহেবঘাটা ট্রেকার স্ট্রান্ড এর কাছে গজা ওরফে গজেন ও তার দলবল, ওদের আটকায়। গজেন ট্রেকার ইউনিয়ন এর সেক্রেটারী, এছাড়াও তার একটা মস্তান বাহিনী ছিল। অসীম ও তার মেয়েকে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখে, নীলিমাকে অফিস ঘরে ঢুকিয়ে সারারাত রেপ করে। তারপর বাইরে একটা ঝোপের পাশে ফেলে দেয়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয়ে মেয়েটা মারা গিয়েছিল। অসীম কে পরের দিন সকালে কিছু লোকজন মুক্ত করে। অসীমের কথা মত নীলিমা র বডি ও পাওয়া যায়। কেস কাছারি হয়। কিন্তু তেমন কোনও রেস্পেক্টবল ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাক্ষী মেলেনি। তারপর গজা মস্তান টাইপের ছেলে, পিছনে প্রধান সাহেবের ব্যাকিং ছিল, লোকাল লোকজন যারা দেখেছিল তারা মুখ খোলেনি। তিন জন সাক্ষী পাওয়া গেছিল, এই ভ্যান ওলা, হাটুরে এই সব, যারা নীলিমা কে গজেনরা যখন অফিসে ঢোকাচ্ছিল তখন দেখেছে, রতন বলে একজন বডি, ডিসপোজালের সময় দেখে ফেলেছিল, সে তখন ঝোপের অন্যদিকে পেচ্ছাপ করছিল। ফিজিকাল এভিডেন্স ও ঠিক মত প্রিসার্ভ করা হয়নি। সারকামস্টানসিয়াল এভিডেন্স ভালোই ছিল। কেসটা চার্জ সিট হয়, কিন্তু গজা কে এরেস্ট করা যায়নি। ওর সাগরেদ কালী, ভজ আর অনুকূল এরেস্ট হয়েছিল, কিন্তু বেল হয়ে গেছে। গজার এগেইনস্ট এ ওয়ারেন্ট বের করা হয়েছে। সেও মাস আটেক হয়ে গেল। এখন তো সে আরো বড় নেতা। তাই... সবই তো বোঝেন।" 

আরও দু একজনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ঘটনা টা সত্যি। অসীম তার পর থেকে একটু পাগলা গোছের হয়ে গেছে। নতুন বড়বাবু কেউ থানায় এলেই তাকে এসে ধরে। 

অনেক দিন আগেকার ঘটনা, এখন সব শান্ত হয়ে গেছে। 

সপ্তাহ খানেক পরে একদিন সেই গজা র সাথে দেখা হল। সাহেবঘাটা হরসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে। সে এখন আর ট্রেকার ইউনিয়নের সেক্রেটারি গজা নয়, সে এখন গজেন বাবু । স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারী, এছাড়াও মাননীয় মেম্বার সাহেব। কুঁত কুঁতে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে কপালে হাত জোড় করে একটি প্রনাম ঠুকলো, তারপর দাঁত বের করে বলল, "আমার বিরূদ্ধে মেলা কথাই শুনবেন ছার ( স্যার), কিন্তু সেসব শত্রুপক্ষের রটনা। ছার, একদিন সন্ধের দিকে আসুন না, গরীবের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দেবেন, পাটি হবে, দেশী মুরগীর সাথে.. হে হে দেশী, বিদেশী সব ব্যবস্থাই থাকবে ছার" বলে আমার দিকে একটু ভুরু নাচিয়ে ইশারা করলো । "আপনাদের থানার অনেকেই আমার এখানে আসেন ছার।" 

গা জ্বলে গেল। থানায় ফিরে ওয়ারেন্ট টা বার করলাম। এস ডি পি ও সাহেবের সাথে কথা বলে নিলাম। সাহেব ও নতুন এসেছেন। বয়েস কম, কিছু করার ইচ্ছা আছে। বললেন ঠিক আছে , এরেস্ট করে দাও। আমি এস পি সাহেবের সাথে কথা বলে নেব। 

দিন দুয়েক বাদে দিলাম এরেস্ট করে। সাহেব ঘাটা বাজার থেকে সকাল নয়টায় এরেস্ট করে থানায় আনলাম, কাগজপত্র রেডি করাই ছিল, ঝট পট কোর্টে চালান করে দিলাম। 

তারপর ঝামেলা , থানা ঘেরাও শুরু হলো। "সমাজসেবী গজেন বিশ্বাস কে কেন এরেস্ট করা হলো পুলিশ তুমি জবাব দাও, জবাব চাই। অপদার্থ বড়বাবু দূর হট দূর হট" এই সব শ্লোগানের সারাদিন থানা সরগরম থাকলো। এর মধ্যে শুনলাম অসীমের বাড়ী কিছু লোকজন মিলে ভাঙচুর করেছে। অসীম নাকি বাড়ী থেকে মেয়ে কে নিয়ে সকালেই পালিয়েছে। প্রতিবেশী কেউ সদবুদ্ধি দিয়েছিল নিশ্চই। 

সেদিন রাত্রে কোয়ার্টারে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি ভুতের মত লম্বা একটা কে যেন দেয়ালের পাশ থেকে বেরিয়ে এল, টর্চ মারলাম। লোকটা চাপা গলায় বলল, "আলোটা নেবান সার।" 

অসীম, মেয়েটাকে কাঁধের উপর চাপিয়েছে তাই ওত লম্বা লাগছিল। 

" সার আপনি বাপের বেটা আছেন"- আবেগে তার গলা কাঁপছে। 

আমি বললাম "সে ঠিক আছে, কিন্তু তুমি আপাতত কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাক, এখানে হাওয়া গরম"। 

অসীম বলল," সে সার বুঝেছি, আমি শুধু আপনার সাথে দেখা করবার জন্যই এসেছিলাম।" 

আমি আমার মোবাইল নম্বর টা তাকে একটা কাগজে লিখে দিলাম। বললাম "অসীম দরকারে ফোন কোরো, আর মেয়েটাকে কোথাও একটা আশ্রম টাশ্রমে দিয়ে দাও।অসীম সেই প্রথম দিনের মত মেয়ে কে বলল, বাবুকে নম করতে হয়, তারপর সে ছায়ার মত আস্তে আস্তে চলে গেল। 

গজেন বিশ্বাস চোদ্দ দিন পরে জামিন পেয়ে গেল। পয়সা ওলা লোক। তারপর পলিটিকস করে। ভালো উকিল দিয়েছিল। যাহোক কেসের ট্রায়াল শুরু হতে আর কোনো বাধা থাকলো না। 

আমার সাথে গজেন একদিন সন্ধ্যায় থানায় দেখা করতে এল। সাথে প্রধান সাহেব আর আরও দু জন মেম্বার। 

গজেন কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে বলল " কাজটা ভাল করলেন না ছার, দেখুন কদ্দিন চেয়ার সামলাতে পারেন"। 

মাস ছয়েক বাদে আমিও বদলি হলাম। অন্য জেলায় । কেস টার ট্রায়াল শুরু হয়নি তখনও। 

এরপর আর কোনও খোঁজ খবর রাখিনি। একদিন তা প্রায় বছর তিনেক বাদে একদিন একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন এল। ধরলাম, "হ্যালো"। 

"আমি অসীম বলছি সার, চিনতে পারলেন, সেই অসীম রায়, সাহেব ঘাটার" 

চড়াৎ করে মনে পড়লো সব। আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ চিনেছি, কি খবর তোমার, গ্রামে ফিরেছ? মেয়ে কত বড় হোলো? তোমার কেসের কি খবর? 

"মেয়ে সার বছর নয় -দশেকের হয়েছে। ওর মাসির বাড়িতে রেখেছি সার, আমি হিললি দিল্লি কাজ করে বেড়াই। কে দেখবে? বাবু, আমার কেসের টায়াল শুরু হয়েছে, এবার বোধহয় বিচার পাব, কি বলেন? গজা শুনছি সাক্ষীদের হুমকি দিচ্ছে, আবার রতন, যে নাকি ঝোপের পাশে পেচ্ছাপ করতে গিয়ে ওদের কুকীর্তি দেখে ফেলে, তাকে নাকি দশ হাজার টাকা দিয়েছে। সরকারি উকিল বলেছে, গজার নাকি রেহাই নেই, দশ বছরের জেল তো হবেই। আমার বউটার আত্মা শান্তি পাবে, না বাবু? আমি আপনার বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি খাইয়ে আসবো"। 

আমি বললাম, "ঠিক আছে অসীম, কি হলো জানিও"। 

আমার নতুন থানায় ব্যস্ততায় কাটছে। খবর নিতে পারিনি। মাস ছয়েক বাদে আবার একদিন অসীমের ফোন পেলাম। কাঁদছে। 

--- কি ব্যাপার? কাঁদছো কেন? 

---- হেরে গেলাম সার, কেউ ঠিক সাক্ষী দিলনা, কোটে উকিল বলছে আমি নাকি পাগল, আমি নিজেই নাকি বউকে খুন করে, মিথ্যে কেস করেছি। সব্বাই বেকসুর খাল্লাস। আমার চোখের সামনে বৌটা কে অত্যাচার করে করে মারলো, বলছে নাকি আমি নাটক করছি। গজেন ছাড়া পেয়ে বাড়ী তে এসেছিল, বলল "কি রে পাগলা, আমার কি ছিঁড়ে নিলি? এবার মেয়ে টাকে সামলে রাখিস, বাচ্চা বয়েস"। অসীম কাঁদতে লাগলো। আমি বললাম ঠিক আছে আমি ওই থানার বড় বাবুকে বলে দেব। 

এরপর অনেক দিন অসীমের আর কোনো খোঁজ খবর পাইনি। সেদিন পুরোনো জেলায় গেছিলাম, কোর্ট এ। একটা বধূ নির্যাতনের কেসের সাক্ষী ছিল। কোর্ট কম্পাউন্ডে ঘুরছি। বিভিন্ন থানার গাড়ী আসছে, আসামি নিয়ে। জেল থেকে আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনার দের নিয়ে আসছে, যাদের ডেট পড়েছে। পুলিশরা ঘিরে ধরে এক এক করে আসামীদের নামাচ্ছে। দেখছি। হঠাৎ দেখি অসীম। প্রিজনার ভ্যান থেকে নামছে। সেও আমাকে দেখে ফেলেছে। আমি এগিয়ে গেলাম। ইউনিফর্ম ছিল তাই কনস্টেবল রা বাধা দিল না। 

আমি বললাম, "এ কি অসীম , তুমি , কি ব্যাপার ? কি হয়েছে?" 

অসীম ম্লান হাসলো, "খুন করেছি সার।" 

-- তুমি , খুন ? কি সর্বনাশ, কাকে খুন করলে ?" 

--- "গজেন কে সার। বাজারের মধ্যেই দা দিয়ে গলা দু আধখানা করে দিয়েছি, তারপর দা নিয়ে সোজা থানায়। জজের কাছে স্বীকার গেছি সার। তার মুখে একটা কেমন যেন হাসি , সেটা তৃপ্তির নাকি পাগলামির বলতে পারবো না। সে কেমন যেন আচ্ছন্নের মত বলে চলল "আপনারা তো আমার কেসের বিচার দিলেন না। নীলিমা একদিন স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলল, "আমার মিত্যুর কোনো বিচার হবে না? তুই কেমন পুরুষ মানুষ?এরপর গজেন আমার মেয়েটাকে মারবে।" 

"আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ, মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল। আমার সামনে ওরা বউটাকে চার পাঁচজন মিলে অত্যাচার করে করে মারলো, আমায় গাছে বেঁধে রাখলো। বৌটা কত কানঁলো । কেউ শুনলো না। তিন চার বছর পেরিয়ে গেল, কিছু বিচার পেলাম না। মাথায় খুন চেপে গেল। ঘুম থেকে উঠে হাত- দা টা ব্যাগে লুকিয়ে বাজারে চলে গেলাম। গজেন সকালে বাজারে আসত, সেদিন ও এসেছিল। এক চোপ দিতেই গলাটা অর্ধেক ঝুলে গেল। কি রক্ত কি রক্ত, আমার নীলিমা র ও অনেক রক্ত বেরিয়েছিল। শোধ বোধ করে দিলাম। আমার বোধ হয় ফাঁসি হয়ে যাবে না কি বাবু?" 

তারপর অসীম তার এলোমেলো দৃষ্টি কে একত্রিত করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো "বাবু আপনি তো বহু পড়ালেখা জানা আইনের লোক , আচছা বলুন তো 

বাবু আমি কি অন্যায় করেছি ?" 

আমি চুপ করে রইলাম। কোর্টের সময় হয়ে গেছে। পুলিশ ওকে নিয়ে কোর্টে ঢুকে গেল। 

অসীমের কি হলো আর খবর রাখা হয় নি। হয়ত ফাঁসি ই হবে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সাক্ষী সাবুদ পাকা। কিন্তু তার শেষ প্রশ্নের জবাব সেদিন আমি দিতে পারিনি। শুধু সেদিন কেন আজ ও কি জবাব দিতে পারতাম ... 

0 comments: