2

গল্প - রিয়া ব্যানার্জী

Posted in


গল্প


নির্দয় নিয়োগ
রিয়া ব্যানার্জী 




"- আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। " 


*******************
আবছা অন্ধকারে চুপ করে বসে আছে দুজনে, মুখোমুখি! কিন্তু কেউ কারুর দিকে দেখছে না! রাস্তার আলো এসে পড়াতে মুখাবয়ব স্পষ্ট নয়। বেশ রাত হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির শব্দ তেমন ভাবে আর কানে আসছে না। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ধরা গলায় জয়িতা বললেন


-" বেশ! তুই যখন চাইছিস তাই হবে। তবে তোর বাবাকে বুঝতে হবে কারণ সে বারণ করেছিল আর আমরা কথা দিয়েছিলাম -"
-" তাও মা! প্লিজ! আমি ঘটনাটা না জানলে অন্য ব্যাপার হতো কিন্তু যখন জানতে পেরেছি তখন আমি সেই মানুষটিকে দেখতে চাই।" 
ষাট পাওয়ারের আলো তে ধাঁধিয়ে গেলো চোখ। হঠাৎ পড়া আলোর জন্য চোখ টা কুচকে জয়িতা বলল
"ধ্যাত! আলোটা নেভাও না। "
আশুতোষ সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে অবশেষটা ব্যালকনি থেকে টুস্কি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল
- "অনেক রাত হয়েছে। কাল আবার পূর্ণার সকালে রিহার্সাল আছে। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লে ভালো হয় না কি? "
-"বাবা, আমি কিন্তু ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি আর মা ও... " 
কথাটা শেষ করতে পারলো না পূর্ণা, আশুতোষ গম্ভীর স্বরে বললেন
- "কেন? তোর জীবনে কিসের অভাব? "
-" অভাব কিছুই নেই বাবা! তবু আমি একটি বার ওঁকে দেখতে চাই,প্লিজ বাবা, প্লিজ!" 
নির্দিষ্ট ইজি চেয়ারটাতে বসে একবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালো। তারপর চাপা স্বরে আশুতোষ প্রায় আত্মকথনের মতো করেই বলল
-" সে চেয়েছিল আমি আর তোর মা যেন তাকে ভুলে যাই। কিন্তু কোথাও যেন আমি নিজের বিবেকের সঙ্গে লড়াই করে হেরে গিয়ে খুশি হয়েছিলাম। আমি তার সন্ধান জানি বা বলতে পারিস রেখেছি। অবশ্য সেই রাখা টা খুব একটা কঠিন কিছু ছিল না, ঠিকানা তার বদলায়নি! "
-" তুমি কিন্তু আমাকে কিছুই বলো নি, তবে আমি জানতাম! আমি গেস করেছিলাম। দৃষ্টি নীচের দিকে রেখে জয়িতা কথাগুলো বলল। 
-" আসলে আমি চেয়েছিলাম --" 
-" থাক! আমি বুঝি। খাবার বাড়ছি, এসো তোমরা।" বলে উঠে চলে গেলো জয়িতা। 
পূর্ণা মা এর পিছুপিছু বেরিয়ে যাচ্ছিলো, থেমে ঘাড়টা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো 
-" বাবা! তাকে কেমন দেখতে? "
-" খানিকটা তোর মতো!" 


**************************************


জানলাটা খুলতেই বুনো গন্ধটা ঝাপটা দিলো নাকে। এর সঙ্গে একটা মাতাল করা গন্ধ মিশে একটা অদ্ভুত আবেশ ধরিয়ে দিচ্ছে। সময়টা হেমন্তের শুরু! পরিষ্কার দূষণ মুক্ত ঝকঝকে আকাশ। অবশ্য এদিকটা শহুরে দুষণ মুক্ত। 


ভালো করে শালটা গায়ে জড়িয়ে ঘরটা থেকে মাটির উঠানে বেরিয়ে এলো জয়ী। চোখটা ছলছল করছে। নাকটা লাল হয়ে আছে, থমথমে মুখ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে ও। ভিতরে কান্নারা মাথা কুটছে,চোখ ভরছে আবার চোখে ই শুকিয়ে যাচ্ছে। বাঁধ ভাঙছে না। কিন্তু সে যে চাইছে কাঁদতে, ভীষণ ভাবে চাইছে। 


অসম্ভব সুন্দর কাঠের এই বাংলোটার আশপাশ। সবুজ পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম। অনতিদূরে একটি ছোট্ট ঝোরা। বাংলোর দুপাশে পাইন গাছের সমারোহ।বাঙলোর পিছনে পাইন গাছের ঘন জঙ্গল। 


আশু স্ত্রীর পিছনে বেরিয়ে এলো বাইরে। ভোর নয় এখন সকাল, আকাশের বুক চিড়ে সূর্য্যের আলো পাহাড় চুঁইয়ে নামছে। দূরে কাছে বিভিন্ন নাম না জানা পাখির ডাক। শহুরে কলতানে বধির হয়ে আসা শ্রবণ শক্তির জন্য এই বাতাসের ফিসফিস গাছেদের আড্ডা পাখিদের বৈঠক কিযে আরাম দেয়, তা যে উপভোগ করেছে সেই জানে। আশু সাহিত্যের প্রফেসর, প্রকৃতির কোল তার ভীষণ প্রিয়।আগে সময় পেলেই ছুটে যেত এদিক সেদিক। এখন সময় বড্ড সংকুলান। 


বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশু একটা সিগারেট জ্বালালো। সামনের উঠোনে জয়ীকে প্রস্তর মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখটা হঠাৎ জ্বালা করে উঠলো আশুর, সিগারেটের ধোঁয়া নাকি..! জয়ী একদৃষ্টে সামনের ঝরণাটার দিকে তাকিয়ে আছে, এক পাশ থেকে মুখটা দেখতে পারছে আশু। সব হারিয়ে বসে থাকা মানুষের চোখে বোধহয় লেখা থাকে এইরকম শূন্যতার ভাষা। তৃতীয়বার ও সেই এক ঘটনা, নাহ আর সহ্য করতে পারেনি জয়ী। মানুষ সব দুঃখ কষ্ট বেদনা সহ্য করে নেয় কারণ একটাই, আশা! সুদিনের আশা। অথচ যখন সেই আশাই মরে যায় মানুষ বোধহয় বাঁচার উৎসাহ টাও হারিয়ে ফেলে। ঘুমের ওষুধগুলো ওয়াশ করে বের করে দেওয়ার পর হাসপাতালে ক্লান্ত বিধ্বস্ত ঘুমন্ত জয়ীকে দেখে মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল আশু। তবে সে তো পুরুষ তাই তার দূর্বলতা প্রকাশ করার অধিকার নেই। ডাক্তার এসে যখন বললেন যে জয়ী শারীরিকভাবে 'আউট অফ ডেঞ্জার' কিন্তু মানসিক অবস্থা 'ভেরী ক্রিটিকাল',তখনই সে ভেবে নেয় তার কর্তব্য। 
আশুর খুব প্রিয় জায়গা এই পাহাড় ঘেরা মেঘের বাড়ি। একমাসের ছুটি নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তাই চলে এসেছে এখানে। না, শহরের ভিতর নয়। এখন মেঘালয় ও আর পাঁচটা শহরের মতো ঘিঞ্জি হয়ে গেছে ওরা এসেছে শিলং, চেরাপুঞ্জী ছাড়িয়ে বেশ ভিতরে খাসিয়াদের ছোট্ট গ্রাম 'টুলাং' এ। এখানকার জায়গাগুলোর নামই এমন, শুনলে মনে হয় কেউ যেন টুংটাং করে জলতরঙ্গ বাজাচ্ছে। 
-" প্লিজ জয়ী, এরকম ভাবে কান্নাকাটি করলে আবার শরীর খারাপ করবে। তোমাকে ডাক্তার স্ট্রেস নিতে বারণ করেছে না?" আশু এগিয়ে এসে স্ত্রীর পিঠে হাত রাখলো। 
-"আমাকে কিছুক্ষণ একলা ছেড়ে দাও, প্লিজ আশু। " বেদনা ভরা চোখের আকুতি। স্বামী হয়ে স্ত্রী কে এই অবস্থায় রেখে যেতে মন চায় না, কিন্তু আশু জানে আর ভুল করবেনা জয়ী, সেই আশ্বাসেই এখানে এসেছে ওরা।
একটা ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে আশু হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল
-" বেশ! আমি তাহলে সীয়ারামের কে সঙ্গে নিয়ে বাজারটা সেরে আসি। " 
-" হুম! যাও। " 
আশু বেরিয়ে গেলে জয়ী ধীর পায় ঝোরাটার সামনে দাঁড়ালো। দুটো ছোট ছোট টিলার মাঝের ফাটল দিয়ে সাদা জলের ধারা বেড়িয়ে এসে একটা খাড়ির মধ্যে মিশেছে। অশান্ত শিশুদের মতো চঞ্চল,ঝরঝর শব্দটা যেন ছোট্ট পুঁচকির হাসির মতন। আনমনে হাঁটছিল জয়ী। টের পায়নি কখন ঝোরাটার অনেক কাছে চলে গেছে সে। জলের ছিটে লাগছে চোখে মুখে, জুড়িয়ে দিচ্ছে যেন ভিতরের জ্বালাটা। 
"- আর আগাও না, পড়ে যাবে। " 
ভাঙা ভাঙা বাঙলা কথা শুনে চমকে উঠলো জয়ী। পিছনে একটি মেয়ে, গমা রঙের গায়ের রঙ, চাপা নাক আর হ্যাঁ, মাথায় এক ঢাল চুল। পরণে সিল্কের রঙচটা মেখলা। আঁচলটা গাছ কোমর করে বাঁধা। গলায় কালো কারের সাথে একটা রূপোর ক্রশ। এই পুঞ্জিতে অধিকাংশ বাসিন্দা খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলম্বী। 
জয়ী পিছিয়ে এসে ভালো করে তাকালো মেয়েটার দিকে ।
-" তুমি কে"?
-" আমি টুম্পা! তগো ঘরে যে লোকটা কাম করে তার বড় মাইয়া আমি । "
"- ওহ, কই কাল যখন এলাম তোমাকে দেখিনি তো।" 
"- কাল আমি ঘুইরতেতে গেছিলাম বিশুর সাথে। ই দ্যাখো পায়ের তোড়া কিনেইঞ্চহি" হাসি তে ভরে গেলো মেয়েটার মুখটা। ভারী মিষ্টি হাসিটা। 
"- বাহ! তা বিশু কে হয় তোমার? " 
"- বিশু মোর বন্ধু আছে তো । তবে হারু ভাবে উটা মোর প্রেমিক। তা ভালো তো আমি দুইজনকেই বাসি আবার আমি সোন্দর বলি ওই আমাদের পুঞ্জের সিয়েমের পোলাটাও চায় আমাকে!" মুচকি হাসলো জয়ী। 
খাসিয়া উপজাতিটা বাঙলাদেশ থেকে এসেছিল বলে এদের বাঙলাতে ওপার বাঙলার একটা টান এখন ও বিদ্যমান। জয়ী কিছুক্ষণ টুম্পার দিকে তাকিয়ে রইলো, কি সহজে ওকে মনের কথা বলছে টুম্পা। পাহাড়িদের এই এক মস্ত গুণ। বড্ড সরল। এদের ভিতরটাও যেন এই জায়গাটার মতো চিরহরিৎ। এই যেমন জয়ীকে তো প্রথম দেখলো টুম্পা, অথচ - 
"- বাব্বা! তোমার তো অনেক প্রেমিক। " বলতে বলতে বারান্দায় উঠে এলো ওরা ।
অনেকক্ষণ পরে স্বাভাবিক ছন্দে কথা বলল জয়ী। কাল থেকে প্রায় চুপ করেই ছিল সে। পর পর দুইবছর এক ঘটনা ওর বাঁচার লয়টাই যেন এলোমেলো করে দিয়েছে। 
কাঠের বারান্দাটার ওপর চা গাছের গুড়ি দিয়ে টুলের মতো দুটো চেয়ার রাখা। একটাতে বসতে বসতে জয়ী মুখে হাসি টেনে এনে বলল
-" তা তুই কাকে বিয়ে করবি।" 
-" ভাবিনি তো। তা তোমরা এখানে এলে যে, কেউ তো এদিকে আসে না?" 
-" ভালো লাগলো তোমাদের গ্রামটা তাই। তা তুমি তো বেশ বাংলা বলতে পারো"
"- এখানে সবাই বাংলা বলতে পারে তো। " 
জয়ী সামনে রাখা ফ্লাক্স থেকে কফি ঢেলে নিলো দুজনের মতন। টুম্পা হঠাৎ বারান্দার যেদিকে আগাছার ঝোপগুলো আছে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে একটা নাম না ফুল গাছ থেকে ফুল তুলে প্রথমে নিজের মাথায় গুঁজলো। তারপর ওর দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো ফুলটা জয়ীর মাথায় লাগিয়ে দেবে কিনা। জয়ী ম্লান হেসে বলল
-"দে। তা হ্যাঁ রে টুম্পা, তুই পড়াশুনো করিস না নাকি কাজ করিস?" 
"- পড়ি তো, হুই ফাদারের কাছে। কামকাজ ও করি। হুই যে আমাগো জমি, ওখানে বড় দাদার কাম করে। আমি আর ছোটো ভাইটা মিলে উয়াকে সাহায্য করি,সকালে সীমান্ত বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করি । এই নাও আমাগো জমির জিনিস। " 
টুম্পার হাতে এক গোছা পান পাতা। এদিকটাতে চা আর পানের চাষ বেশী হয়।
"- খেয়ে দেখ,মিঠা বটে। " 
-" পরে খাবো রে, এখন তো খালি পেট, আর আর কি কি করিস রে?"


জয়ীর ভালো লাগছে সরল সহজ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে। কতই বা বয়েস হবে সতেরো আঠেরো, মুখের আদল তিব্বতিদের মতো। প্রায় পাঁচশো বছর আগে তিব্বত হয়ে বাঙলাদেশ দিয়ে এরা আসামে এসেছিল। মঙ্গোলীয় উপজাতির অংশ এই খাসিয়ারা। দেশের উত্তর পূর্ব দিক টাতে এখন খাসিয়াদের দখলে। এরা নিজেদের গণ্ডী মধ্যেই থাকে। এদের রহন শয়ন কথন বলন সব আলাদা। মেয়েটা এতক্ষণ বসেছিল, উত্তর না দিয়ে এবার উঠে ঘরগুলোতে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে আচমকা জিজ্ঞেস করলো 
-"তা তুই কাঁদছিলি কেনে রে? মন খারাপ?" দূরে একটা পাখি টকটক করে ডেকে উঠলো। শুনেই টুম্পা নেমে গেলো উঠোনে। খুঁজতে চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ তারপর কোথা থেকে একটা শুকনো ডাল জোগাড় কাঠের দেওয়ালে টকটক শব্দ করতে করতে আবার জিজ্ঞেস করলো 
"- বলো না"
কি বলবে জয়ী এই বাচ্চা মেয়েটাকে। জীবন কত নিষ্ঠুর পরীক্ষা নেয় এই মেয়েটা কি বুঝবে। একটা চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল 
"- কে বলল তোকে আমি কাঁদছিলাম। " 
"- আমি দেখলাম তো! তোমার সোয়ামী কিছু বলে চলে গেলো তারপর তুই কাঁদছিলি।"
'সোয়ামি' শুনে ফিক করে হেসে ফেলে জয়ী বলল 
-" কিছু না রে বাবু, আমি কাঁদতেই তো পারি না, চেষ্টা করছিলাম এমনি এমনি। "
টুম্পা এতক্ষণ এদিক সেদিক করতে করতে জয়ীকে প্রশ্ন করছিলো এবার ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল 
-" বাবা! তমাগো সব বড়সড় ব্যাপার। তোমরা এমনি এমনি কাঁদার চেষ্টা করো । আর আমাগো দুঃখ হলে তো এমনিই কাঁইন্দা ফেলি।" 
এবার হেসে ফেললো জয়ী, শব্দ করেই হাসলো। বুকে দম চাপা ভাব টা কম,বেশ হাল্কা লাগছে নিজেকে। হাল্কা ছলেই বলল 
-" তা তোর কিসের দুঃখ শুনি।" 
-" হুই যখন গেলো বর্ষায় আমাগো ঘর, শুওরের খোঁয়াড় সব ভেঙে গেলো গিয়া, তখন কেঁদেছিলাম। " 
-" ওহ!" 
-" হ! সঙ্গে মোর মা আর কোলের ছুটো ভাইটাও গেলো। জানো ওই পুঁচি ভাইটো মোর খুব পায়ে ঘুরতো ঘুরতো। আমাকে মাই বলতো। আমাকে ছাড়া তো একদণ্ড থাকতো না। ইস্কুলে ও উটাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে যেতে হতো। " 
জয়ী অবাক হয়ে টুম্পার দিকে তাকিয়ে দেখছে। মাথা নীচু করে বসে আছে মেয়েটা, হয়ত চোখের জল লুকোচ্ছে। কি সহজে মেয়েটা নিজের হারানোর কথা উচ্চারণ করলো। অথচ সে? জীবন বড় জটিল, বড় বন্ধুর। চাওয়া পাওয়ার হিসেবটা কারুর কারুর ক্ষেত্রে সরল রেখা আবার কারুর ক্ষেত্রে আঁকা বাঁকা। কেউ পেয়ে হারায় আর কেউ? এই যে দুই অসম বয়সী নারী আজ এক ছাতের এসে দাঁড়িয়েছে এদের বয়েস জাত ধর্ম বর্ণ সব আলাদা অথচ দুজনের মধ্যে রয়েছে এক ই স্বত্ত্বা। 
কালো মেঘের চাদর সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। রোদ্দুরের সোনালী রেখা পাহাড়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে ছোট্ট এই গ্রামটা কে উত্তাপ দিচ্ছে। 
-" রান্না করবে না?" 
গলাটা ধরে গেছিলো, ঝেড়ে নিয়ে জয়ী বলল
-" দাঁড়া! আগে ওরা ফিরুক। তারপর তো।" 
-" মাছ নেবে ? আজ ই ধরেঞ্চহি, অলেক। ই লদীর মাছ। " 
-" লদী নয় নদী। আর এখানে নদী কোথায় রে?" 
- "- হুই ইকটু ইগিয়েন ই তু।" 
-" নিয়ে যাবি আমাকে। " 
-" হ চ ইখনি যাই।" 
-" আরে দাঁড়া বাবু, ওরা আসুক। রান্না বান্না করি তারপর আর রোদ ও উঠবে ভালো করে তখন, যাবো খন। তুই বরং মাছ নিয়ে আয়। আর আজ তোরা আমার এখানেই খাবি,কেমন। " 
টুম্পা কেমন ভাবে যেন তাকিয়েছিল জয়ীর দিকে। কিছু বিড়বিড় করছে। 
"- কি রে? যা নিয়ে আয়। " 
-" বাবু বললে আবার? " 
-" হ্যাঁ, কেন?" 
-" মোর মা ও বাবু বলতো। দাঁড়াও আমি আসছি।" ছুটে পালিয়ে গেলো টুম্পা। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বুকটা কেমন যেন মুছড়ে উঠলো জয়ীর। হারানো আর না পাওয়ার যন্ত্রণা এই দুই এর মধ্যে অনেক মিল। 




******************************




-" আমি ওকে হারাতে পারবো না কিন্তু। " ঢুকরে উঠলো জয়িতা। 
-" তাহলে তুমি রাজি হলে কেন জয়ী। কেন ওকে সব জানালে? এড়িয়ে যেতে পারতে।" আশুতোষ এর কন্ঠে হতাশা মিশ্রিত উষ্মা। 
-" কেন তুমি জানো না আশু, বোঝোনা? ও তো তোমাকেও প্রশ্ন করতো আশু?। মানছি দোষ আমার ও আছে। আমি কি করবো বলতে পারো? ভালোবাসা কি অন্যায়, পাপ।আর আমি ও তো সহ্য করেছিলাম।কি করিনি? নিজের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। আমি জানি, সব দোষ একা আমার শুধু আমার। আমিই চেয়েছিলাম তাই, কিন্তু তুমি বলো আমি কি করতাম" আশুতোষ এগিয়ে এসে স্ত্রী কে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে বিছানার ওপর বসিয়ে দিলো। জয়িতার হাই প্রেশার, অল্পতেই ইমোশনাল হয়ে পড়ে। এক গ্লাস জল হাতে ধরিয়ে আস্তে আস্তে আশুতোষ স্ত্রীর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আলতো স্বরে বলল 
-" না জয়ী দোষ তোমার নয়। ও প্রশ্ন করে কারণ ও যে নিজেকে আয়নাতে দেখে আর মিল খোঁজার চেষ্টা করে। আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না কিন্তু তুমি তো বোঝো আবার 'ও'র সামনে দাঁড়াতে হবে আমাকে। আবার! " 
জয়িতা কিছুক্ষণ চুপ করে স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো তারপর আস্তে আস্তে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো বাইরের ব্যালকনিতে। 
পূর্ণা পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। কাল ওর একটা সারা রাতব্যাপী নাটকের শো ছিল সেখান থেকেই ডায়রেক্ট এয়ারপোর্ট সেখান থেকে গৌহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর,সেখান থেকে প্রায় ঘন্টা চারেক ট্রাভেল করে শিলং। আশুতোষ আর জয়িতা প্রায় বাইশ বছর আগে যখন এইখানে এসেছিলেন তখন জায়গাটা একদম অন্যরকম ছিল। সারা বছর ভারী মেঘের চাদরে ঢেকে থাকতো রাজধানীও অথচ এখন যখন বিভিন্ন ভাবে উন্নত হচ্ছে শহর, চওড়া রাস্তা, শপিং মল, বড় বড় হোটেল,গাড়ি, বাইক, ট্রাফিক জ্যাম সব আছে শুধু মেঘেরা বেপাত্তা। কে জানে সেই ছোট্ট গ্রাম টা কেমন আছে। আর সেই বা কেমন আছে। আনমনা হয়ে সিগারেটটা ধরে ভেবে যাচ্ছিলো আশুতোষ। আজ কত বছর সে তাকে দেখেনি , খবর রাখতো ঠিকই তবে গোপনে, অন্যের সূত্রে। মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে তো একে অন্যের? 
সিগারেটটা এস্ট্রেতে গুঁজে দিয়ে বাইরে লবিতে এলো। শিলং শহরটা একদম বদলে গেছে। বড্ড ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। জয়িতা এগিয়ে এলো আশুর দিকে
-" কি রকম লাগছে জানো?" 
-" ভালো এবং খারাপ এক সঙ্গে।" আশুতোষ দূরে পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে স্ত্রীর দিকে তাকালো, নিভে যাওয়া হাসি লেগে আছে ঠোঁটে।
পূর্ণা এবার বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ও জানে ও তার বাবা মা কে একটা কঠিন পরীক্ষার সামনে ফেলে দিয়েছে। এমন অতীত যে অতীত তারা ভুলতে চায়, ভুলে যেতে চায় ও আবার এক প্রকার জোর করে সেই অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে তাদের। কিন্তু সেই বা কি করবে, নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু পারেনি। তার এই চেহারা যে মানুষটা দিয়েছে তাকে একবার মাত্র একবার দেখার যে ইচ্ছে সেই ইচ্ছে সে কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারছে না। 
-" মা, কফি বলেছি। আর এবার রেডি হয়ে নাও। একটু ঘুরে আসি। কাল বেরোতে হলে আর সময় হবে না। " 
জয়িতা একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। পূর্ণা পেছন থেকে বাবার কাঁধে থুতনিটা ঠেকিয়ে অস্ফুটে বলল
-" সরি! " 
মেয়ের একটা হাতটা নিজের হাতে নিয়ে আশুতোষ বললেন
-" তোর কি মনে হয় তুই কি ভুল করছিস?" 
"- জানিনা বাবা। তোমাদের কষ্ট দিয়ে শুধু নিজের জন্য এইভাবে -" 
-" ভবিষ্যৎ কথা বলুক বরং। "
-" বাবা, আমি কিন্তু তোমাদেরই। "
-" সে কথা তোকে বলতে হবে না। তবে তোর মা একটু ভয় পান।" 
-" অমুলক। " 
-" জানি। আর --" 
-" আর কি বাবা? বাবা, সে আমার কথা কি ভুলে গেছে? এতবছরে একবার ও কি? তুমি যে বললে তুমি তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছো। "
পূর্ণার চোখে মুখে একটা ব্যাথার আভাস। আশুতোষ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা তার বড্ড নরম মনের। কি জানি যখন সত্যির সামনে দাঁড়াবে তখন কিভাবে রিএক্ট করবে। 
"- চ! কফি খেয়ে বেরোই। " 
পূর্ণার প্রশ্নরা এবারেও উত্তর পেলো না। 


***************************************


আশু হাঁ করে নিজের স্ত্রী কে দেখছে। জয়ীকে খাসি মেয়েদের ঐতিহ্যগত পোশাক 'জাইনসেম' এ, ফুলের মুকুটে আর বিভিন্ন পাথরের গয়নাতে ভীষণ আকর্ষণীয়া লাগছে। আশু নিজের শরীরে উত্তাপ টের পেলো। এগিয়ে এসে জয়ী কে নিজের বুকে নিয়ে ঠোঁট টা ডুবিয়ে দিয়ে শুষে নিতে লাগলো অধর সুধা। অনেক দিনের উপোষী দেহে কামনার ঝড় তুলেছে, পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে জয়ীকে। 
নাহ! 
একটা আলতো ধাক্কাতে সরিয়ে দিয়ে ছিটকে দূরে চলে গেলো জয়ী। 
-" টুম্পারা অপেক্ষা করবে। ওদের নাচ শুরু হয়ে গেছে। রেডি হয়ে নাও, আমি বাইরে আছি।" 
উত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো জয়ী। 
নিজেকে ধীক্কার দিয়ে উঠলো আশু। অপূর্ণ অবদমিত কাম আর বলপূর্বক হাসিল করার ইচ্ছে এই দ্বৈত দ্বন্দ্ব তার মনে একটা গভীর ছাপ ফেলেছিল হয়ত। 
ব্যাপারটা দুদিন পরে খেয়াল করলো জয়ী।
টুম্পাদের নংক্রেপ নাচের অনুষ্ঠানে আশুকে যখন জয়ী নিজের সঙ্গে পা মেলাতে টানতে গেলো আশু সেই প্রথম স্ত্রী এর হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে গেছিলো। অবাক হলেও বোঝেনি তখন কিন্তু আজ বাইরের ফায়ার প্লেসের সামনে ঘুমন্ত আশুকে দেখে জয়ীর মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সত্যি তো, সে এত স্বার্থপর কি করে হয়ে গেছে। তার নিজের দুঃখ, তার নিজের কষ্ট, অভাব বোধ সব কিছু তাদের স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন কে ঠেলে খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আশুর চাহিদা ভীষণ ভাবে প্রযোজ্য কিন্তু জয়ী যে পারছে না। আর যেখানে সে জানে যতই সার জল মাটি দিয়ে বীজ রোপন করা হোক, চারা গাছ কোন দিন ও জন্মাবে না। 
-" ঠাণ্ডাতে ইখানে কি করছো? " 
চমকে উঠলো জয়ী। ভাবনার মধ্যে বেঁহুশ হয়ে কখন সে বাইরে বেরিয়ে এসেছে টের পায়নি। টুম্পার গলা পেয়ে সম্বিত ফিরলো
-" তুই এত রাতে?" 
-" রাইত কই গো? হুই দেখো আকাইশে লাল রঙ ধরেইছে। পানের ক্ষেতে যাচ্ছি, এমোরদাদা মুঞ্জিশ। বৃষ্টি টো হলো না কত, দেখে আসি। যাবে গো " আজ প্রায় দশদিন হয়ে গেলো এখানে। সবাইকে জয়ী চেনে প্রায়, মুঞ্জিশ কে প্রথমে দেখেই চিনেছিল। আলাপটা এইভাবে হবে বোঝেনি। হাল্কা হ্যারিকেনের আলোতে বুঝলো বেশ শক্তপোক্ত চেহারার একজন পুরুষ এই মুঞ্জিশ। একবার ওদের দিকে দেখলো তারপর একমূহুর্ত ভেবে ফায়ার প্লেসের আগুন টা ভালো করে উস্কে দিয়ে গায়ে মোটা কম্বলের কোর্ট আর কান ঢাকা টুপি টা পরে টুম্পার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো জয়ী। মন টা বড্ড আনচান করছে। শূন্যতা, চারিদিকের শূন্যতা গ্রাস করছে ওকে, তলিয়ে যাচ্ছে যেন সে। কানের কাছে টুম্পা কি সব বলে যাচ্ছিলো, জয়ী একটা কথাও শোনে নি। সে ভেবে যাচ্ছে অথচ সমাধান? নেই। জীবন বড় কঠিন অঙ্ক। 
কেউ যেন জোরে ওকে টেনে নিলো নিজের দিকে। আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলো, নাহ! একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ঘেমো গন্ধ নাকে এসে লাগলো। 
-" তুমি কি পাগল হলে? ওইদেখো।" 
ভোরের আলোতে জয়ী দেখলো সামনে মৃত্যু গহ্বর। অতলান্ত। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ওদিকে,এই তো এই তো সব যন্ত্রণার অবসান। এই তো
মাথায় একটা কোমল হাতের স্পর্শ। 
-" কি হইঞ্চহে গো তোমার? বলো না, আমি আছি, বলো । " কথায় বলে শব্দ ব্রহ্ম। 'আমি আছি' কথাটা জয়ীর মনের কোন তার ছুঁলো জানা নেই, হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। বুকফাটা আর্তনাদে সেদিন ভোরের পাখিরাও তাদের ঘুম ভাঙানি গান গাইতে ভুলে গেছিলো। সূর্যের আলো মাখা একটা পাইন গাছের নীচে আঠারোর তরুণীর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছে তিরিশের যুবতী। সেদিন উজাড় করে দিয়েছল নিজেকে এক স্বল্প পরিচিতার কাছে, এতদিনের জমা দুঃখ ভয় গ্লানি সবটুকু। পাশে ছাব্বিশের জোয়ান ছেলে বসে, মুখে ফুটে আছে তীব্র যন্ত্রণা। 


***************************************


ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দটা থামাতেই পারছে না পূর্ণা। অপূর্ব সুন্দর আশপাশটা। ব্রিজটার পেরোতেই চোখের সামনের মেঘের পাহাড়। গারো পাহাড়টা পুরো ধোঁয়াটে মেঘে ঢাকা। নীচে পাইন গাছে ঢাকা দিমপেপ ভ্যালী আর ওখানেই আছে তার গন্তব্যস্থল। আছে প্রতীক্ষারত একটি মানুষ। আদৌ সে প্রতীক্ষা করছে তো? নাকি ভুলে গেছে তাকে, জানতেই হবে। ডানদিকে একটা পাথরের ওপর জয়ীতা বসে আছেন, যত রাস্তা ফুরিয়ে আসছে দুজনের মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে।
পূর্ণা বুঝতে পারছে সব অথচ ও যেন কোন অদৃশ্য টানে সবকিছু কে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে ওই নীচের গ্রামগুলোর দিকে। টুলাং এর পথে। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক উৎরাই তে নেমে ওরা একটা সরু রাস্তা ধরলো। টুলাং এর ঠিক আগে একটা সরু নদী পড়ে। ওই অব্দি গাড়ী যাবে। নদীটা পায়ে হেঁটে পার করলেই টুম্পাদের গ্রাম মুঞ্জিশের গ্রাম আর পূর্ণার...
-" বাড়িটা একই আছে শুধু --"
জয়ী আর আশুর জীবনটা যেখান থেকে অন্য বাঁকে ঘুরেছিল আজ তারা এবং যার জন্য সব কিছু সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে। 
- " হুম! শুধু সময়ের দাগ পড়েছে। "আশু এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলো তার গোপন সূত্র এই বাড়ির মালিক টুম্পা মঞ্জিশের বাপ সীয়ারাম কে। 
সীয়ারাম না এসে দাঁড়ালো মঞ্জিশ। বয়েসের ছাপ পড়েছে মুখে কিন্তু কর্মঠ চেহারা এখনো আগের মতোই আছে। সাধারণত যাদের শরীরে মঙ্গোলীয় ছাপ থাকে তাদের দেহের হাড় চওড়া হয়,মঞ্জিশের ও তাই। 
জয়িতা একবার কেঁপে উঠলো,ঠাণ্ডাটা কি বাড়ছে। মঞ্জিশ একবার জয়িতাকে আলতো দৃষ্টিতে দেখলো, বাইশ বছরের জয়ীর সঙ্গে বোধহয় মিল খোঁজার চেষ্টা করলো তারপর এগিয়ে এসে আশুতোষের হাত মিলিয়ে বলল
-" আসতে অসুবিধে হয়নি তো?" মুঞ্জিশের বাংলাটা আগের থেকে শুধরেছে। 
-" নাহ! সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়েছিলাম তাই তো ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই। মুঞ্জিশ! এই যে পূর্ণা, আমাদের মেয়ে।" বলতে গিয়ে গলাটা একটু কেঁপে গেলো আশুতোষের। মুঞ্জিশ একবার আড়চোখে দেখে নীচে রাখা ব্যাগ টা নিয়ে চলে গেলো। জয়িতা এতক্ষণ স্থানুর মতো দাঁড়িয়েছিল, এবার আস্তে আস্তে উঠে একটা ঘরে ঢুকে গেলো, সেই ঘরটা তেই। 
সেইরকম কেউ না এলেও এদিকের সব পুঞ্জিতেই একটা করে বাড়ি থাকে অতিথি অভ্যাগতদের জন্য। অনেক সময় অনেক পর্যটন পিপাসু মানুষ চলেও আসেন তার জন্য। তিনটে ঘরের কাঠের বাড়িটার একটা ঘরে পূর্ণা ঢুকে দেখলো একটা সিংগেল বেড আর একটা কাঠের আলমারি আর একটা বসার টেবিল চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে ধপ করে শুয়ে পড়লো সে, কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। 
দরজায় ঠকঠক শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসলো পূর্ণা, ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল টেরই পায়নি। জয়িতা এসে ঢুকলেন ঘরে 
-" কি রে! ওঠ এবার, কত ঘুমোবি?" 
একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো" কটা বাজে মা?" 
-" প্রায় আড়াইটে। নে যা হাত মুখ ধুয়ে আয়, খাবার বাড়বো। " 
-" উফ! মা তুমি ঘুরতে এসেও সেই এক, পারোও বটে। " 
পূর্ণা একটু বিরক্তিসহকারেই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। জয়িতা মেয়ের জন্য এবেলার জামা বের করতে করতে মনে মনেই হেসে উঠলো। নাহ! পূর্ণা তার ই,শুধু তার। 
-" এখানে কেন এসেছো আবার?" 
চমকে উঠলো জয়িতা। পেছনে মুঞ্জিশ দাঁড়িয়ে
-" আবার কেন এলে? যা চেয়েছিলে সব তো পেয়েছো তাহলে?" 
-" আসলে পূর্ণা বারবার " চোখ তুলতে পারছে না জয়িতা। 
-" তোমরা বাঁধা দিতে পারতে। জানানোর কি খুব প্রয়োজন ছিল?" 
মঞ্জিশের কন্ঠস্বরে প্রকাশ পাচ্ছে তার মনের উষ্মা। 
-" কেন বারণ করা ছিল না " 
-" ছিল কিন্তু নাহ! জয়িতার কাছে কোন উত্তর নেই। কি বলবে সে? মেয়ের সাথে সেও কি একবার দেখতে চায়নি মানুষটা কে? কেমন আছে সে সব ছেড়ে। হোক না কিছুদিনের সম্পর্ক, থাক না প্রতিজ্ঞা। অন্তরের ডাকের কাছে কোথাও যেন হেরে গেছিলো সব বাঁধা। ক্ষমা! ক্ষমা করেছে সে? জয়িতা মাথা নীচু করে বসে আছে বিছানায়। বাইরে পরন্ত রোদ এসে পড়েছে গালে, চুলে। রূপোলী চুলের রেখা আর চোখের কোণে জমা কালির ওপর পায়রার নখের আঁচড় বুঝিয়ে দিচ্ছে বয়েস টা। সেদিকে তাকিয়ে মুঞ্জিশ ধীর কণ্ঠে বলল
-" বেশ! তাই হবে। তবে এইবার শেষবারের মতো" 




********************************************


-" দিদিয়া" ডাকটা জয়ীই শিখিয়েছিল ওকে । 
টুম্পা যেন কঁকিয়ে উঠলো। 
-" প্লিজ! প্লিজ, আমি দোষী কিন্তু --" 
বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো জয়িতা। কাঁদতে কাঁদতেই বলল
-" আমি সব বুঝেছি কিন্তু জানতে দিইনি, চুপ করে থেকেছি। আমি যে স্বার্থপর। আমি যে.."


আশু মাস দেড়েক আগে ফিরে গেছে। লজ্জায় গ্লানিতে মিশে গিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে সে। অথচ জয়ীতা কিছুতেই ফিরতে চায়নি। ও যেন কিসের অপেক্ষা করছিলো। কেউ যেন আসবে। 
-" বিশ্বাস কর আমার কিচ্ছু করার ছিল না। ক্ষমা কর বোন। তুই ভাব আমার কথাটা। আমিও তো সহ্য করেছি। নিজের হাতে নিজের কপাল ভাঙা। কিন্তু তুই আমাকে ফেরাস না। দয়া কর লক্ষ্মীটি। " টুম্পা কে নিজের বুকে তুলে নিলো জয়িতা। 
"- কি হয়েছে তোমাদের"? মুঞ্জিশ, ক্ষেত থেকে ফিরে বোনকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে এখানে। 
জয়ী টুম্পা কে চেয়ারে বসিয়ে এগিয়ে গেলো মুঞ্জিশের দিকে। ঠাণ্ডা গলায় ওর চোখ চোখ রেখে বলল
-" তোমাদের আমার সঙ্গে যেতে হবে কলকাতায়। " 




*******************************************




আজ কলকাতায় ফিরে যাচ্ছে পূর্ণারা। টুলাং এ এই সাতটা দিন স্বপ্নের মতো কেটেছে ওর।হ্যাঁ! দেখা পেয়েছে ওর জন্মদাত্রী। টুম্পা ফিরে আসার বছর খানেকের মধ্যে বিয়ে করে তবে প্রথম বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল সে, এখন সে বিশু তার সেই বন্ধু প্রেমিক তার ঘরণী।


পূর্ণাদের আজ ওদের বাড়ি নিমন্ত্রণ। আশুতোষ আসেননি।আসবেন না সেটা ওরা জানতো, এই সাতটা দিন একপ্রকার পালিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। পোঁছানোর পরের দিন যখন টুম্পা ওদের বাড়িতে আসে সেদিন শুধু জানলার ফাঁক দিয়ে একটি বার শুধু ওকে দেখেছিলেন। 


সন্তান ধারণে তিন বার ব্যার্থতার জয়িতা যেন কেমন "ফ্রিজিড" হয়ে গেছিলো আর সেইজন্য বা হয়ত টুম্পার উচ্ছলতা, সরলতা ওর দিকে আকৃষ্ট করছিলো আশুকে। টুম্পাও এড়াতে পারেনি। ওরা যে মনের কথা শোনে তাই হয়ত মনের ডাকে সাড়া দিয়ে 'দিদিয়া' কে লুকিয়ে আশুর বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলো। 


কেঁপে গেছিলেন আশুতোষ যেদিন তিনি জানতে পারেন জয়িতা সব জানে। লোভ! একজনের দৈহিক সুখ আর একজনের সন্তান সুখ এই দুই এর শিকার হয়েছিল একটি পাহাড়ি সরল মেয়ে। ধীক্কার দিয়ে উঠেছিলেন তিনি,আর মুখোমুখি হননি তিনি কারুর না স্ত্রীর না প্রেয়সীর। গুটিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে। স্ত্রীকেও তিনি ভালোবাসেন আবার ওই মেয়েটাকেও। অথচ! কর্তব্য কারুর প্রতি করতে পারেননি। নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হচ্ছিলো। 


মাস তিনেক পরে জয়ী ফেরে টুম্পা আর মুঞ্জিশকে নিয়ে। কথামতো সন্তান জন্ম দিয়ে টুম্পা ফিরে যাবে নিজের ঘরে। 
-" তোমাকে বড্ড ভালোবাসি দিদিয়া আর আশুদাকেও। দোষ আমিও করেছি ওকে ভালোবেসে। তুমি যা চেয়েছিলে পেলে। আর এসো না সামনে। এই একেও এনো না। " তিনমাসের ছোট্ট পূর্ণাকে জয়ীর হাতে তুলে দিয়ে দাদার হাত ধরে ফিরে গেছিলো সে। সেদিন ও আশুতোষ সামনে আসেননি। 
-" এই নে পান আর গুয়া। ভালো থাকিস মাই" টুম্পা তার প্রথম সন্তানের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
-" আর আসিস না কোনদিন। আমি তোর কেউ নই। ওই আশুদা আর দিদিয়াই সব। তুই মোর মতো দেখতে বইল্যে সন্দো জেগেছিল মনে, মিটেছে তো। আর আসিস না মা। আমার দুটাই সন্তান, ছেলে! বিটি নাই, বিটি নাই " ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে গেলো টুম্পা। 
বাইরে গাড়ী স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। চোখটা মুছে মা'কে নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলো পূর্ণা। আসা ইস্তক জয়িতা একটা কথাও বলেনি এতক্ষণ। সারাটা সময় মাথা নীচু করে বসে ছিলো। অতিথিরা চলে যাচ্ছে, বিদায় জানাতেই হয়। বেরিয়ে এলো টুম্পা, চোখে জল। সেদিকে তাকিয়ে এবার জয়িতা অস্ফুটে বলল 
-" আসি "
টুম্পা ম্লান হেসে মাথাটা নাড়লো তারপর পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল 
-" মা! পারলে ক্ষমা করিস মোদের।" টুম্পার শেষ কথাটা মেঘের সঙ্গে ভেসে বেড়াতে লাগলো। 
ক্ষমা? 
পূর্ণা কাকে ক্ষমা করবে? তার জন্মদাত্রী কে? জন্মদাতা কে? নাকি পালনকর্তৃকে?

2 comments:

  1. ফ্ল্যাশব্যাক আর চলতি সময় দুটোর ধাঁধাঁয় বেশ খানিকক্ষণ ঘুরপাক খেলেও, শেষ পর্যন্ত বেশ ভাল লাগল গল্পটা। গল্পের পটভূমিটা আর ভাষাবিন্যাস ছবির মত।

    ReplyDelete